Monday, June 2, 2014

প্রধানমন্ত্রীর স্নেহে বেড়ে উঠছে তার নাতি-নাতনিরা

নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের ৪ বছর

জামিউল আহসান সিপু
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চার নাতি-নাতনী। এদের একজনের নাম আলী মর্তুজা আযান, দ্বিতীয় জনের নাম শ্রদ্ধা, তৃতীয় জনের নাম রমাদান এবং চতুর্থ জনের নাম আদর। আলী মর্তুজা আযানের বয়স ২ দিন কম ৩ বছর। শ্রদ্ধার বয়স ১ বছর ৯ মাস এবং রমাদানের বয়স এক মাস কম তিন বছর। গত ২৯ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর চতুর্থ নাতি হয়। তার নাম আয়াত হোসেন আদর। এই চার নাতি-নাতনী হলো নিমতলী ট্রাজেডিতে আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া সেই তিন কন্যার সন্তান। প্রধানমন্ত্রীর তিন কন্যা হলেন উম্মে ফারোওয়া আক্তার রুনা, সাকিনা আক্তার রত্না ও আসমা আক্তার শান্তা। 

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩, নবাব কাটরা ৫ তলা বাড়িতে সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১২৩ জন প্রাণ হারান। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় কয়েকটি পরিবার। বাড়ির নিচে কেমিক্যাল গোডাউনে আগুন লেগে বিস্ফোরিত হয়ে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। রুনার বিয়ের 'পানচিনি' অনুষ্ঠানের দিন এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। অগ্নিকাণ্ডের পর পরিবার পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া রুনা, রত্না ও শান্তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুকে টেনে নেন। নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে ঘোষণা দেন তারা তার নিজের সন্তান। এরপরই গণভবনে নিজে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর তিন কন্যার বিয়ে দেন। গতকাল হোসেনী দালান রোড ও আগা সাদেক রোডে এই তিন কন্যার বাসায় গিয়ে কথা হয় তাদের সাথে। তাদের প্রত্যেকের ঘরে এসেছে নতুন অতিথি। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাঁর তিন নাতির খোঁজ খবর নিলেও চতুর্থ নাতি আয়াত হোসেন আদরের জন্ম গ্রহণের খবর পাননি। 

চাঁনখার পুলের হোসেনী দালান রোডের ১৮/১০, শিয়া গলির বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকেন প্রধানমন্ত্রীর বড় মেয়ে উম্মে ফারোওয়া আক্তার রুমা। কেমন আছেন ? জিজ্ঞাসা করা হয়। উত্তরে বলেন, 'মায়ের দোয়ায় ভালই আছি। হারিয়ে যাওয়া মা, খালা, বোনদের কথা বার বার মনে হয়। তাদেরকে হারানোর পর প্রধানমন্ত্রীকে 'মা' হিসাবে পেয়ে আমাদের আর কোন কষ্ট নেই। ২০১১ সালের ৫ জুন তার ঘরে এসেছে আলী মর্তুজা আযান। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তাঁর নাতির খোঁজ নিয়েছেন। আযান জন্ম গ্রহণের পর প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে ফুল পাঠিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নাতির নাম আযান নিজেই রাখেন। কিন্তু গত ২৯ ডিসেম্বর আদরের জন্ম গ্রহণের খবর 'মা'র কাছে দেয়া হয়নি। সংসদ নির্বাচনে ব্যস্ত থাকার কারণে 'মা'র সাথে যোগাযোগ হয়নি। নতুন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর 'মা'কে শুভেচ্ছা জানানোও হয়নি। এজন্য তারা তিন বোন তাদের মায়ের সাথে দেখা করতে চান। 

তার উকিল বাবা সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন। নির্বাচনে জয়ের পর উকিল বাবা তার খোঁজ খবর নিয়েছিলেন। কিন্তু গত ৪ মাসে তার উকিল বাবা খোঁজ নেননি। এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, তার মেয়ে সুখেই আছে। তবে ব্যস্ততার কারণে তিনি সরাসরি মেয়ের কোন খোঁজ নিতে পারেননি। লোকের মাধ্যমে তিনি মেয়ের খোঁজ খবর পান।

রুনার স্বামী সৈয়দ রাশেদ হোসাইন জামিল জানান, বিয়ের সময় তার মা (প্রধানমন্ত্রী) তাকে একটি চাকরি দেয়ার কথা বলেছিলেন। সে অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী তাকে নৌ বাহিনীতে চাকরি দিয়েছেন। এখন সংসার ভালই চলছে। 

প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় মেয়ে সাকিনা আক্তার রত্না জানান, এখনও সেই দিনের কথা বার বার মনে পড়ে। তখন কেউ দেখার ছিল না। গণভবনে বিয়ের পর মায়ের নির্দেশে তার স্বামী সাইদুর রহমান সুমনকে বেসিক ব্যাংকে চাকরি দেয়া হয়। এখন তারা ১৬/৫, নবাব বাগিচায় থাকছেন। তাদের ঘরে মেয়ে সন্তান শ্রদ্ধার আগমন ঘটে। এখন শ্রদ্ধাকে নিয়ে তাদের সময় কাটছে। 

প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় মেয়ে আসমা আক্তার শান্তা জানান, গণভবনে বিয়ের পর তার মা (প্রধানমন্ত্রী) স্বামী আলমগীর হোসেনকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দিয়েছেন। কিন্তু তার স্বামীর ঐ চাকরি এখনও স্থায়ী করা হয়নি। স্থায়ী করার জন্য তিনি মায়ের কাছে অনুরোধ করেন। এখন তারা পুরান ঢাকার আগা সাদেক লেনের ৯৬/১, একতা নিবাসের তৃতীয় তলায় ভাড়া থাকেন। গণভবনে বিয়ের পর তারা রমজানের ঈদে মায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এরপর তারা আর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। 

সেই বিভীষিকাময় বাড়ি

৪৩, নবাব কাটরা, নিমতলীর সেই ৫তলা বাড়িটিতে আগুনে পোড়ার কোন চিহ্ন নেই। নীচতলা থেকে ৫ম তলা পর্যন্ত পুরো বাড়িটি এই তিন বছরে অনেক পাল্টে গেছে। বাড়ির তিন তলায় দিদার, চতুর্থ তলায় ফারুক আহমেদ ও পঞ্চম তলায় গুলজার বসবাস করেন। তবে এই তিন ভাইয়ের স্ত্রী ও সন্তানরা নিমতলীর ট্র্যাজেডিতে নিহত হয়েছেন। বড় ভাই গুলজার জানান, অগ্নিকাণ্ডের পর নিহতদের জন্য সরকার মাথাপিছু এক লাখ টাকা আর্থিক সাহায্য করেন। কিন্তু পরিবারের সবাইকে হারিয়ে এখন মরা কাঠের মত বেঁচে আছি। বার বার মনে পড়ে স্ত্রী ইয়াসমিন গুলজার ও দুই ছেলে ইসতিয়াক গুলজার ও ইমতিয়াজ গুলজারকে। অগ্নিকাণ্ডে তার মা সাবেরা বেগম, চাচী মনোয়ারা বেগম, মেজো ভাইয়ের স্ত্রী শিল্পী, তার দুই ছেলে ইমরান ও আদৃতা, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রানী, তার দুই মেয়ে আনিকা ও অংকিতা নিহত হয়। 

নিমতলীর ৫৫ নম্বর বাড়িতে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন মুন্নি বেগম, তার মেয়ে লাভলী ও লাভলীর ছেলে ১০ মাস বয়সী লাবীব। ঐ বাসাতেই মারা যান মুন্নির বোন রমিজা বেগম, রমিজার ছেলের স্ত্রী মনোয়ারা ও মনোয়ারার ১৫ বছর বয়সি ছেলে পুচি। ঐ দিন বাসা থেকে প্রাণ নিয়ে বের হতে পেরেছিলেন মুন্নির দুই ছেলে রিপন ও স্বপন। রিপন বলেন, আগুনে শুধু তার মা, বোন, ভাগ্নেসহ পরিবারের ছয় সদস্যকেই হারাননি। সঙ্গে পুড়ে যাওয়া বাড়িটিও হারিয়েছেন। আগে থেকেই বাড়ি নিয়ে ঝামেলা চলায় আগুন লাগার পর স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি পোড়া বাড়িটিই দখল করে নেন। এখন তারা দুই ভাই পথে পথে ঘুরছেন। 

স্বজনহারা মানুষগুলো মর্মান্তিক ওই ঘটনার চার বছরেও বিচার না পেয়ে হতাশ। তবে তাদের দাবি, রাসায়নিকের আগুনে আর কাউকে যেন স্বজনহারা হতে না হয়। এজন্য তারা পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান-কারখানা সরাতে সরকারি সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়ন চান। এতে হয়তো পুরান ঢাকাবাসী কিছুটা স্বস্তি পাবে। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে আজ নিমতলীর স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এই এলাকায় শোক সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
The Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment