Sunday, June 29, 2014

সাঁওতাল বিদ্রোহ ॥ মহাকাব্যের এক অগ্রন্থিত কাব্য রিজভী রাইসুল জয়

সাঁওতাল বিদ্রোহ ॥ মহাকাব্যের এক অগ্রন্থিত কাব্য
রিজভী রাইসুল জয়
আজ ৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৫৯তম বার্ষিকী বা মহান ‘সান্তাল হুল’ দিবস। ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি বিশেষ এবং উজ্জ্বলতম দিবস এই সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।
অসম যুদ্ধের ফলস্বরূপ, বিদ্রোহ সাঁওতালদের পরাজয় ঘটালেও, বৈদেশিক শাসন এবং দেশীও সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের মূলোৎপাটন করার লক্ষ্যে পরিচালিত এ বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের মনে যে সাম্রারাজ্যবাদবিরোধী আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের চেতনা জাগ্রত করেছিল, তারই ফল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
নিষাদ জাতির অন্তর্ভুক্ত সাঁওতালদের আদি বাসভূমি যে ভারতবর্ষ তাতে নৃবিজ্ঞানীরা কোন সন্দেহ পোষণ করেননি। বিখ্যাত ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, ১৭৯০ সাল থেকে সাঁওতালরা বাংলা বিহার সীমান্তে আসতে শুরু করে। বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, পাকুর, পুর্নিয়া অঞ্চলে অবস্থান করলেও, সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বসতি স্থাপন করে ভাগলপুরের দামিন-ই-কো তে। বহু কষ্ট করে বন জঙ্গল সাফ করে শ্বাপদ-সঙ্কুল দামিন-ই-কো তে তারা তাদের জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে মানব বিচরণই ছিল না সে মাটিতে ফলিয়েছিল সোনালী ফসল। নিজেদের আলাদা একটা জগত তৈরি করেছিল তারা। যেখানে ছিল না কোন মহাজন-জমিদার-দালাল, ছিল না কোন ঋণগ্রস্ত।
দামিন-ই-কোর সমৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে সেখানে আগমন ঘটে ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণীর। তারা সাঁওতালদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও অন্যান্য তেলবীজ গরুগাড়ি বোঝাই করে নিয়ে যেত। বিনিময়ে সাঁওতালদের দেয়া হতো সামান্য লবণ, কাপড়, টাকা পয়সা অথবা তামাক। বিনিময়ের সময় সহজ সরল সাঁওতালদের চরম ভাবে ঠকানো হতো। কিছু চাল, কিছু অর্থ বা অন্য দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবনের জন্য ‘সাঁওতালদের ভাগ্যবিধাতা ও দণ্ডমুন্ডের কর্তা’ হয়ে বসত মহাজনরা। বার্ষিক আদায়ের সময় মহাজনরা একটা বড়সড় পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে ওজনের একক হিসেবে ব্যবহার করত। ফলে পাথুরে জমিতে সাঁওতালদের অশেষ পরিশ্রমে ফলানো ফসল, যা তারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতো, বন্য হাতি, শূকর ও অন্যান্য জীবজন্তুর হাত থেকে, তাই পরম মমতায় তুলে দিত মহাজনের হাতে। তবু শোধ হতো না ঋণ। কোন চাষী মহাজনের হাতে ফসল তুলে দিতে অস্বীকার করলে, মহাজনেরা দেওঘর বা ভাগলপুর আদালত এ ঘুষ দিয়ে আনত ক্রোকি পরোয়ানা। আদালতের পেয়াদার উপস্থিতিতে তখন নিজের সর্বনাশ দেখা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকতও না সাঁওতালদের। ঋণ দেয়ার সময় মহাজনরা যত টাকা ধার দিত, লিখিয়ে নিত তা থেকে অনেক বেশি এবং টাকা শোধের সময় ওই সুদ সমেত আসল টাকাকে আসল বা মূল ধরে, আবার তার সুদ আদায় করত। ফলে সব দিয়ে দেবার পরও শোধ হতো না মহাজনের ঋণ। তখন সাঁওতাল চাষী বাধ্য হতো নিজেকে বন্ধক দিতে এবং মহাজনের ক্রীতদাসে পরিণত হতে। বিনা পারিশ্রমিকে খাটতে খাটতে তার জীবন শেষ হয়ে যেত। তার পরবর্তী বংশধরের জন্য উত্তরাধিকার হিসাবে একটা জিনিসই সে রেখে যেতে পারত, তা হলো মহাজনের ঋণ। সেই ঋণ তার জীবদ্দশায় হয়ত সামান্যই বাকি ছিল, কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আবার বেড়ে হতো কয়েক গুণ। তার বংশধর, যে তার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে মহাজনের ক্রীতদাসত্ব লাভ করেছে, সেও খাটতে খাটতে জীবন শেষ করে দিত, কিন্তু দেনা পরিশোধ হতো না।
এর সঙ্গে যুক্ত হলো ইংরেজদের খাজনা আর জমিদারদের অত্যাচার, সাঁওতালদের চাষকৃত জমির উপরে ইংরেজদের নির্ধারিত খজনা বছরে বছরে বৃদ্ধি পেতে থাকে অবিশ্বাস্য হারে। ১৮৩৮ সালে সেখানে মোট খাজনা ছিল ২ হাজার টাকা, সেখানে ১৮৫১ সালে আদায় করা হয় ৪৩ হাজার ৯১৮ টাকা ১৩ আনা। এর সঙ্গে সঙ্গে যোগ হয়েছিল স্থানীও জমিদারদের লোলুপ দৃষ্টি, সাঁওতালদের জমি গ্রাস করার অন্যতম পন্থা ছিল খাজনা বাকি ফেলা। এই উদ্দেশ্যে তারা তাদের গরু, ছাগল, মহিষ, টাট্টু ঘোড়া এমনকি হাতির বাঁধন খুলে দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে দরিদ্র সাঁওতালদের ক্ষেতের পাকা ফসল নষ্ট করে ফেলত।
এই অমানবধিকতার কোন প্রতিকার সাঁওতালদের হাতে ছিল না। ইংরেজদের বিচারালয় তাদের নাগালের বাইরে ছিল। তাছাড়া দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাবার কোন নিশ্চয়তা ছিল না।
ঐতিহাসিক কে কে দত্ত তাঁর ‘দি সান্তাল ইন্সারেকশান’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বলেনÑ
‘দুর্নীতিগ্রস্ত কোর্টের আমলা, মোক্তার, পিওন ও বরকন্দাজদের কাছ থেকে ন্যায় বিচার পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না। যদিও মাঝে মাঝে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের দেখা মিলত, কিন্তু ভয়ে সাঁওতালরা সেখান থেকে দূরেই থাকত। বাড়ির কাছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনস্ত দারোগা বা থানা পুলিশের ন্যায় বিচারের যে রূপ তারা দেখতে পেত তা মৃত্যুরই নামান্তর।’
কাজেই আদালতে সুবিচার লাভ সাঁওতালদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। নিপীড়ন নিষ্পেষণের জালে আটকে যাওয়া এই সহজ সরল মানুষ-গুলোর আদতে মুক্তির কোন পথ খোলা ছিল না। ফলে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাস্বরূপ তারা বিদ্রোহে অংশ নেয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহ : ১৮৫৪ সালের শেষে আর ১৮৫৫ সালের শুরুতে দেখা গেল দামিন-ই-কোর সাঁওতালরা বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। এ অস্থিরতার কারণ তাদের একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। অবস্থাপন্ন সাঁওতালরা ঠিক করেছিল তারা হিন্দু মহাজনদের আর লাভের বখরা নিতে দেবে না। গরিব দিনমজুর সাঁওতালরা ঠিক করেছিল তারা আর ক্রীতদাসত্ব করবে না।
এইরূপ অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে বিশেষত মানুষ যখন এইরূপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে, তখন নেতার অভাব হয় না। সেই সময় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদের মধ্য থেকেই ত্রাণকর্তা রূপে আবির্ভূত হন বিদ্রোহের নায়ক, নিষ্কলুশ চরিত্রের চার ভাই সিদু, কানু, চাঁদ ও ভায়রো। তারা সাঁওতালদের বিদ্রোহের জন্য অনুপ্রাণিত ও সংগঠিত করেন।
১৮৫৫ সালের ৩০ জুন, ভাগনদিহি গ্রামে চারশত গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে দশ হাজার সাঁওতাল এক সমাবেশে উপস্থিত হয়। সিদু ইংরেজ ও জমিদার মহাজন কর্তৃক তাদের ওপর নির্মম নিপীড়নের করুণ কাহিনী তুলে ধরে বক্তব্য দেন। সমগ্র জনসভা এ সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দশ হাজার সাওতাল, ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণীকে উৎখাত করে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ গ্রহণ করে। এই সমাবেশ থেকে ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করা হয়। দারোগা ও জমিদারদের নিকট ১৫ দিনের মধ্যে জবাব দাবি করা হয়।
৩০ জুন প্রায় ৫০ হাজার সাঁওতাল বড়লাটের কাছে অভাব অভিযোগ পেশ করার উদ্দেশে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য ধর্মের শোষিত, নিপীড়িত মেহনতী মানুষ। সাঁওতালদের এ সমবেত অভিযাত্রার কথা শুনে শোষক শ্রেণীর মহাজন জমিদাররা ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়ে। তারা দারোগা মহেশলাল দত্তকে ঘুষ দিয়ে সিদু ও কানুকে গ্রেফতার করার জন্য প্ররোচিত করে। দারোগা সিদু ও কানুকে চুরি ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার করতে গেলে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বাঁধা দেয়। দারোগা জোর পূর্বক সিদু কানুকে গ্রেফতার করতে চাইলে বিদ্রোহীরা এখানেই দারোগা মহেশলাল দত্ত, মহাজন মানিকমুদিসহ ১৯ জনকে হত্যা করে। কানু ঘোষণা দেন, ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, এখন আর কোন হাকিম নেই, ইংরেজ নেই, সরকার নেই। সাঁওতালদের রাজত্ব এসে গেছে।’
সাঁওতালরা বহু থানা, ইংরেজ সৈন্যদের ঘাঁটি, নীলকরদের কুঠি আক্রমণ ও ভস্মীভূত করে। অগণিত জমিদারবাড়ি লুণ্ঠন ও জমিদারদের হত্যা করা হয়। সমগ্র বিহার, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতালরা আধিপত্য বিস্তার করে। ইংরেজ সরকার এ বিদ্রোহের প্রচ-তায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে।
অবশেষে মার্শাল ল জারির মাধ্যমে ১৫ হাজার সৈন্য, অশ্বারোহী বাহিনী, কামান বাহিনী ও হস্তী বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালান হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হয়। প্রচণ্ড বর্বরতায় উন্মত্ত হাতি ছেড়ে দেয়া হয় সাঁওতালি নারী ও শিশুদের মধ্যে। কামান ও বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে, বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
৩০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে বর্বরোচিত ভাবে হত্যা করে ইংরেজ সম্মিলিত বাহিনী। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ ও ভায়রো নিহত হয়। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সিদু ইংরেজদের হাতে ধৃত হয়। সিদুকে সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করা হয়। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশ কর্তৃক ধৃত হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রেষ্ঠ নায়ক সিদু ও কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রারাজ্যবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম সঙ্ঘটিত প্রতিবাদ। ১৮৫৫ সালে সিদু-কানু দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে যে বিদ্রোহ হয়েছিল তা পথ দেখিয়েছিল নিপীড়িত মানুষদের। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ সাম্রারাজ্যবাদবিরোধী, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। সাঁওতাল কৃষক বিদ্রোহীদের সংগ্রাম সরাসরি বিজয়ী না হলেও এই সংগ্রাম ভারতবর্ষের কৃষক সংগ্রামের ঐতিহ্যকে আরও উজ্জ্বল ও মহিমান্বিত করেছে। এই বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী প্রেরণা যুগিয়েছে ভারতবর্ষের পরবর্তী সকল স্বাধিকার আন্দোলনে। ফাঁসির মঞ্চে কানুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল- ‘আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব।’ বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেনদের আত্মত্যাগে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ আমাদের প্রমাণ দিয়ে দেখিয়েছে, শোষণ মুক্তির সংগ্রাম কোনদিন ফুরায় না, শেষ হয়ে যায় না। মানুষ পৃথিবীতে যতদিন থাকবে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম চলবে ততদিন।
rizvee.joy@gmail.com
http://www.allbanglanewspapers.com/janakantha.html

No comments:

Post a Comment