নীরব এই গণহত্যা বিভিন্নভাবেই চলছে
মুহম্মদ শফিকুর রহমান
এ মৌসুমে এ পর্যন্ত একটাও আম-জাম, লিচু কিনিনি। না কাঁঠাল, না আনারস। আঙ্গুল-আপেল-কমলা খাওয়া তো অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি। মোটা চামড়ার কলাতেও ভয়। পেয়ারাটা খেতাম, শুনতে পাচ্ছি ওটাও নাকি পাকানো হয় বিষাক্ত রাসায়নিক কার্বাইড দিয়ে। ঠিক অপরাপর ফল পাকানোর মতোই। গেল মৌসুমে তরমুজ, বাঙ্গিও কিনিনি। তবে হ্যাঁ, আমার এক আত্মীয়া নিজ গাছের আম পাঠিয়েছিল। ছোট ছোট, দু’গাছের দু’রকম আম। দেখলাম পাকা। দুটো আম খেয়ে ফেললাম। তারপরও দীর্ঘক্ষণ মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল; ওতে কার্বাইড-ফরমালিন নেই তো? পরদিনই আমে পচন ধরতে শুরু করল, তাই বিলিয়ে দিলাম। আশ্চর্য হলাম, বাজার থেকে যে ফলই কিনি সহজে পচে না। অথচ দু’দিনেই পচতে শুরু করল? আরেকদিন এক প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতে ৪/৫টা লিচু খেয়েছি। প্রথমদিকে খাচ্ছিলাম না। ভদ্রলোক বুঝতে পেরে বললেন, নিশ্চিন্তে খেতে পারো, ও আমার বাগানের লিচু। সেই উত্তরবঙ্গ থেকে পাঠিয়েছে। তখনি মুখে উঠল এবং ৪/৫ টা খেয়ে ফেললাম। কিন্তু এবারও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। মনে ভয় থেকেই যাচ্ছে। বিষয়টি হলো বিষাক্ত রাসায়নিক কার্বাইড, ফরমালিন, ডিডিটি, কীটনাশক ইত্যাদি যেভাবে আজকাল মানুষকে শারীরিকভাবে শেষ করে দিচ্ছে, তাতে আমরা কেউ গুরুত্ব দিচ্ছি বলে মনে হয় না। অবশ্য আমরা তো জানতামই না, ম্যাজিস্ট্রেট রোকুনদ্দৌলাই সবার আগে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। তবেই কিছু কিছু মানুষ সতর্ক হয়েছে। ‘কিছু কিছু মানুষ’ শব্দাবলী এ জন্য ব্যবহার করলাম যে, এখনও দেখার ধোপ দূরস্ত পোশাকী ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলারা ফরমালিনযুক্ত আম-জাম, কাঁঠাল বাজার থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তারা টেলিভিশন, খবরের কাগজে এসব দেখেনি তা কিন্তু নয়, বরং দেখেছে, দেখলে কি হবে? আগে তো খাই, তারপর দেখা যাবে কি হয়, বিষয়টা সম্ভবত এ রকমই? প্রফেসর ড. মুনতাসীর মামুন, প্রফেসর ড. ফারুককে ধন্যবাদ জানাব তারা এই বিষাক্ত রাসায়নিকের ভয়াবহতার ওপর কলম ধরেছেন। একই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাব ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার বেনজির আহমেদকে। তিনি ফরমালিন-কার্বাইড মেশানো ফল বাজারে আসার আগেই তার বাহিনী দিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছেন, যার ছবি ব্যাপকভাবে মিডিয়াতে এসেছে। এতে ফলের বাজারে কিছুটা আছর পড়েছে। প্রথম দু’জনের সঙ্গে আমার পরিচয় থাকলেও তৃতীয়জনের সঙ্গে নেই, তবুও দূর থেকে ধন্যবাদ জানালাম। কিন্তু মাছ-শাক-সবজির বাজারে কোন আছর নেই। ফল যেমন বাজার থেকে এনে ঘরে রেখে দিলে মাসেও পচে না তেমনি মাছও ১৫/২০ দিন ফ্রিজের বাইরে রাখলেও পচন ধরে না। এবার প্রসঙ্গ পাল্টাতে হচ্ছে।
ক’দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাব বলে নির্ধারিত চতুরঙ্গের লেখাটা আগেভাগে লিখতে শুরু করলাম। মঙ্গলবার। টেলিভিশনও অন করে রাখলাম। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের পরই সবচে বড় রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় হবে আজ। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম আজ রায় হচ্ছে না। কারণ নিজামী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তাকে আদালতে আনা যাচ্ছে না বলে ডাক্তারের রিপোর্টসহ কারাপ্রধান চিঠির মাধ্যমে আদালতকে জানিয়েছে। আইন বলে, এ ধরনের মামলায় আসামির উপস্থিতিতে বিচারক রায় পড়ে শোনাবেন। কেবল তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণে আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেয়া যেতে পারে- ১. আসামি যদি দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ ২. আসামি যদি পলাতক হয় অথবা ৩. আসামি যদি নিজে আদালতে উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানায়।
কে এই মতিউর রহমান নিজামী? অবশ্য নামের সঙ্গে ‘মাওলানা’ ব্যবহার করে। যতদূর জানি এই নিজামী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে তৎকালীন জামায়াতের ছাত্র অঙ্গ সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ সভাপতি ছিলেন। সবচে বড় রাজাকার গোলাম আযমের খুব কাছের মানুষ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রথমে পাকিস্তানী হানাদার সামরিক জান্তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো সশস্ত্র আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে গুপ্তহত্যা শুরু করে এবং বাঙালীর বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৩ ও ১৪-এর মধ্যে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এভাবে তিন শতাধিক খ্যাতনামা শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, শিল্পীকে হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে আমার সরাসরি শিক্ষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) প্রফেসর মুনীর চৌধুরী, প্রফেসর জিসি দেব, প্রফেসর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রফেসর আনোয়ার পাশা, মহসিন হলের হাউজ টিউটর প্রফেসর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ডা. আলীম চৌধুরী। ঐ মতিউর রহমান নিজামীর আলবদর, আলশামস বাহিনী এতই হিংস্র ও বর্বর ছিল যে, যিনি শিক্ষক বা চোখের ডাক্তার তাঁর দুই চোখ উপড়ে তারপর হত্যা করেছে, যিনি হার্টের ডাক্তার তাঁর বুক চিরে হার্ট বের করে হত্যা করেছে, যিনি লেখক তাঁর আঙ্গুলগুলো কেটে তারপর হত্যা করেছে, যিনি সাংবাদিক তাঁর চোখ ও আঙ্গুল কেটে তারপর গুলি করে বদ্ধভূমিতে ফেলে দিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করার পর আবার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। তাদের টার্গেট ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে বুদ্ধিশূন্য, মেধাশূন্য থাকে এবং সামনে এগুতে না পারে। এই আলবদর বাহিনী পরিচালনায় শীর্ষ নেতা ছিলেন নিজামী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হাজি মুহম্মদ মহসিন হলে থাকতাম। আগেই বলেছি ড. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের হাউজ টিউটর। তাঁকেও মহসিন হলেরই তাঁর কোয়ার্টার থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় হলেরই দুই আবাসিক ছাত্র চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফ আলী, এরা দু’জনই ঢাকায় তাদের অপারেশনের অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর। শুনেছি এই দুই বদর নাকি লন্ডন এবং আমেরিকায় তারেক রহমানের মতো পালিয়ে আছে, যদিও তা সত্য নয়। তারা দু’জনই এখন সক্রিয়, জঙ্গী কানেকশন মেনটেন করছে।
সেই নিজামীর যুদ্ধাপরাধের রায় হলো না। কষ্ট পেলাম। গোটা জাতিই হতাশ হয়েছে (অবশ্য খালেদা-নিজামীরা বাদে)। সবচে কষ্ট লেগেছে যখন টেলিভিশনে দেখলাম নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম হাসিমুখে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন এবং ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন, ভাবখানা এমন যেন তার জিত হয়েছে। শোনা গেল এটিই নাকি নিজামীর প্রথম অসুস্থতা নয়, এর আগেও কয়েকবার অসুস্থতার কথা বলে আদালতের রায় ঘোষণা স্থগিত করা হয়েছে। বস্তুত দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি জামায়াত নেতারা অনর্গল নাকে-মুখে মিথ্যা বলতে পারে পবিত্র ইসলামের নাম নিয়ে। তাদের কাছে মিথ্যাচার খালেদা জিয়াও ভালই শিখেছেন।
নিজামীর এই অজুহাতের নামই সম্ভবত হিপোক্র্যাসি। নইলে রায় হবে বলে আগের দিন মহানগরীর যানজট ঠেলে তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা গেল, গভীর রাত থেকে তার উচ্চ রক্তচাপ শুরু হলো। হতেই পারে, কিন্তু রক্তচাপ একটা সময় বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে। এটি হঠাৎ হয় না, ওষুধও চলে সারা বছর চাপ অনুযায়ী বাড়ানো-কমানো হয়ে থাকে। নানান প্রশ্ন মনে। নিজামী তার বাহিনী দিয়ে যখন তিন শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে তখন তার কি রক্ত চাপহীন ছিল? যে সব বুদ্ধিজীবীর চোখ উপড়ে ফেলা হচ্ছিল, যাঁদের হার্ট বের করা হয়েছিল তাঁদের কি তখন উচ্চ রক্তচাপ ছিল না? কি জবাব নিজামীদের?
তাছাড়া স্বাধীনতার পরও বিশেষ করে জাতির জনককে হত্যার পরও নিজামীরা যেভাবে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, জঙ্গী সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করছে, মানুষের সম্পদ হানি করেছে, পুলিশ-বিজিবি হত্যা করেছে তখন তাদের রক্তচাপ হয় না। সবচে বড় কথা হলো এই যে, বাংলাদেশের সন্তানদের জঙ্গী বানানো কি নীরব গণহত্যা নয়?
এবার মূল বিষয়ে ফিরে আসছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ খাবে কি? ক্যালসিয়াম মানব দেহের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন এবং তা সবচে বেশি থাকে ফলে। সেই ফলই যদি খাওয়া না যায়, তাহলে ক্যালসিয়ামের অভাবে শরীর দুর্বল হবে। আবার ওই সব বিষাক্ত রাসায়নিক শরীরে গেলে জন্ডিস, গ্যাসট্রিক, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও ক্যান্সার হতে পারে, নষ্ট হয়ে যাবে কিডনি ও লিভার (নীরব এই গণহত্যা ঠেকাবে কে, মুনতাসীর মামুন?)।
এইভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড খেলে কি কি রোগ হতে পারে অথবা ফরমালিন, ইউরিয়া, বিভিন্ন ধাতু, স্টেরয়েড শরীরে গেলে কি কি রোগ হতে পারে বা মানবদেহের কি কি ক্ষতি হতে পারে প্রফেসর মামুন তাঁর কলামে সবই বলে দিয়েছেন। আর মামুন যখন কোন বিষয়ের ওপর লেখেন তখন আমাদের মতো কলামিস্টদের ঐ বিষয়ে না লেখাই ভাল। তবু লিখছি এ জন্য যে, এত বড় জাতীয় সমস্যা, এর সমাধানে দু’একটা কথা বলে নিজেকে মামুনদের সঙ্গে শরিক করা। কিভাবে বাঁচবে মানুষ? সারাদেশ আর্সেনিক আক্রান্ত, পানিতে আর্সেনিক, যে ফসলের গাছ ঐ আর্সেনিকযুক্ত পানি টানে সেই ফসল বা শস্য শরীরে গেলে আর্সেনিকের কারণে কিডনি, চর্মরোগসহ নানান রোগ হতে পারে। এই তো রমজান আসছে। এই ঢাকা শহরের পানিও আর্সেনিকমুক্ত কিনা জানি না, তবে পানিতে অনেক সময় যে পরিমাণ ময়লা বাহিত হয়ে আসে তাতে এই পানি খেলেও পেটের নানান রোগ তো হবেই, অজু-গোসল করলেও চর্মরোগ হবে, এর জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত দরকার পড়ে না, আমরা প্রতিটি মানুষই ভুক্তভোগী। সবচে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা। অনেকে বিকলাঙ্গ হচ্ছে, অটিস্টিক হচ্ছে। প্রশ্ন হলো যাদের এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারা তো মে-জুনের গরমেও কমপ্লিট সুট পরে অফিস করে, সেমিনার করে দেশ উদ্ধার করছেন আর বড় বড় থিওরি ঝাড়েন। এরা বাংলাদেশের মানুষ না অন্য কোন দেশের? হাবভাবে তো মনে হয় ওদের বাংলাদেশে জন্মাবার কথা ছিল না। তবে হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানের সুটের ওপর কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করায় এখন মনে হয় কমতে শুরু করেছে।
আরেকটি নীরব ঘাতক হচ্ছে ড্রাগ বা মাদকদ্রব্য। আমরা এরই মধ্যে কিছু মাদকদ্রব্যের নাম জেনেছি। যেমন হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হাশিশ। বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে গত দেড় বছরে অন্য নাম দিয়ে ১৭ হাজার টন ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে। একই দিনের দৈনিক জনকণ্ঠ লিখেছে, দেশে এখন স্ট্রং বিয়ারের নামে অতিমাত্রায় এ্যালকোহলে বাজার ছেয়ে গেছে। এগুলোও কিন্তু নীরব গণহত্যার দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে। শোনা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা অর্ধকোটিরও বেশি। পুলিশ-র্যাব মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে। কিন্তু পরবর্তীতে কি হলো তা কেউ জানে না। এই মাদকের ছোবলের শিকার হচ্ছে প্রধানত শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা। একশ্রেণীর পুলিশের আবার আয়েরও পথ এরা। একজন মাদকসেবীকে ধরতে পারলে তার অভিভাবকদের কাছ থেকে টু-পাইস ইনকাম হয়ে যায়। ভদ্রলোকের মান-সম্মান রক্ষায় পুলিশকে টাকা দিয়ে সন্তানকে ছাড়িয়ে আনে। আর নীরবে চোখের পানি ফেলে। সন্তানরা তা বোঝে না। বস্তুত মাদকদ্রব্য এমন এক জঘন্য জিনিস যা তার অনুভূতির সেলগুলো ধ্বংস করে দেয়। ঢাকায় অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে, যাতে কেবল এ রকম আটকে রাখা হয়। ৩ মাস ৬ মাস পর বেরিয়ে এসে সে আবার মাদক সেবন শুরু করে। এভাবে হাজার হাজার শিক্ষিত পরিবার অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তারপরও সন্তানদের মাদকের টাকার জোগান দিতে হয়। নইলে ‘খুন-খারাবি’ পর্যন্ত গড়ায়, প্রায়ই সংবাদপত্রে এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়। মাদকসেবী সন্তানটিও দিনে দিনে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, স্ট্রং বিয়ারের মতো জঘন্য মাদক সেবনেও ক্যান্সার হতে পারে, কিডনি-লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দেশের সুশীল সভ্যরা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলে, অথচ পুরো সমাজ যে মাদকদ্রব্যের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যথা কমই দেখা যায়। মাদকের কাঁচা টাকা কখন যে কোনদিকে হাটে কে জানে?
ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ এ মৌসুমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিকা পালন করছেন, তা মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখলেও মানুষ একইভাবে তাঁকে সাধুবাদ জানাবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
ক’দিনের জন্য ঢাকার বাইরে যাব বলে নির্ধারিত চতুরঙ্গের লেখাটা আগেভাগে লিখতে শুরু করলাম। মঙ্গলবার। টেলিভিশনও অন করে রাখলাম। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের পরই সবচে বড় রাজাকার মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায় হবে আজ। কিন্তু হঠাৎ দেখলাম আজ রায় হচ্ছে না। কারণ নিজামী উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। তাকে আদালতে আনা যাচ্ছে না বলে ডাক্তারের রিপোর্টসহ কারাপ্রধান চিঠির মাধ্যমে আদালতকে জানিয়েছে। আইন বলে, এ ধরনের মামলায় আসামির উপস্থিতিতে বিচারক রায় পড়ে শোনাবেন। কেবল তিনটি সুনির্দিষ্ট কারণে আসামির অনুপস্থিতিতে রায় দেয়া যেতে পারে- ১. আসামি যদি দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ ২. আসামি যদি পলাতক হয় অথবা ৩. আসামি যদি নিজে আদালতে উপস্থিত থাকতে অস্বীকৃতি জানায়।
কে এই মতিউর রহমান নিজামী? অবশ্য নামের সঙ্গে ‘মাওলানা’ ব্যবহার করে। যতদূর জানি এই নিজামী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগে তৎকালীন জামায়াতের ছাত্র অঙ্গ সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘের’ সভাপতি ছিলেন। সবচে বড় রাজাকার গোলাম আযমের খুব কাছের মানুষ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে প্রথমে পাকিস্তানী হানাদার সামরিক জান্তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর মতো সশস্ত্র আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে গুপ্তহত্যা শুরু করে এবং বাঙালীর বিজয়ের পূর্বমুহূর্তে অর্থাৎ ডিসেম্বর ১৩ ও ১৪-এর মধ্যে দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি বাড়ি থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে রায়েরবাজার ও মিরপুরে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। এভাবে তিন শতাধিক খ্যাতনামা শিক্ষক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ডাক্তার, শিল্পীকে হত্যা করে। তাঁদের মধ্যে আমার সরাসরি শিক্ষক (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) প্রফেসর মুনীর চৌধুরী, প্রফেসর জিসি দেব, প্রফেসর মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রফেসর আনোয়ার পাশা, মহসিন হলের হাউজ টিউটর প্রফেসর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ডা. আলীম চৌধুরী। ঐ মতিউর রহমান নিজামীর আলবদর, আলশামস বাহিনী এতই হিংস্র ও বর্বর ছিল যে, যিনি শিক্ষক বা চোখের ডাক্তার তাঁর দুই চোখ উপড়ে তারপর হত্যা করেছে, যিনি হার্টের ডাক্তার তাঁর বুক চিরে হার্ট বের করে হত্যা করেছে, যিনি লেখক তাঁর আঙ্গুলগুলো কেটে তারপর হত্যা করেছে, যিনি সাংবাদিক তাঁর চোখ ও আঙ্গুল কেটে তারপর গুলি করে বদ্ধভূমিতে ফেলে দিয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য গুলি করার পর আবার বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। তাদের টার্গেট ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও যাতে বুদ্ধিশূন্য, মেধাশূন্য থাকে এবং সামনে এগুতে না পারে। এই আলবদর বাহিনী পরিচালনায় শীর্ষ নেতা ছিলেন নিজামী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় হাজি মুহম্মদ মহসিন হলে থাকতাম। আগেই বলেছি ড. গিয়াস উদ্দিন আহমেদ ছিলেন আমাদের হাউজ টিউটর। তাঁকেও মহসিন হলেরই তাঁর কোয়ার্টার থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যায় হলেরই দুই আবাসিক ছাত্র চৌধুরী মইনুদ্দিন এবং আশরাফ আলী, এরা দু’জনই ঢাকায় তাদের অপারেশনের অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত আলবদর। শুনেছি এই দুই বদর নাকি লন্ডন এবং আমেরিকায় তারেক রহমানের মতো পালিয়ে আছে, যদিও তা সত্য নয়। তারা দু’জনই এখন সক্রিয়, জঙ্গী কানেকশন মেনটেন করছে।
সেই নিজামীর যুদ্ধাপরাধের রায় হলো না। কষ্ট পেলাম। গোটা জাতিই হতাশ হয়েছে (অবশ্য খালেদা-নিজামীরা বাদে)। সবচে কষ্ট লেগেছে যখন টেলিভিশনে দেখলাম নিজামীর আইনজীবী তাজুল ইসলাম হাসিমুখে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন এবং ইন্টারভিউ দিচ্ছিলেন, ভাবখানা এমন যেন তার জিত হয়েছে। শোনা গেল এটিই নাকি নিজামীর প্রথম অসুস্থতা নয়, এর আগেও কয়েকবার অসুস্থতার কথা বলে আদালতের রায় ঘোষণা স্থগিত করা হয়েছে। বস্তুত দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি জামায়াত নেতারা অনর্গল নাকে-মুখে মিথ্যা বলতে পারে পবিত্র ইসলামের নাম নিয়ে। তাদের কাছে মিথ্যাচার খালেদা জিয়াও ভালই শিখেছেন।
নিজামীর এই অজুহাতের নামই সম্ভবত হিপোক্র্যাসি। নইলে রায় হবে বলে আগের দিন মহানগরীর যানজট ঠেলে তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা গেল, গভীর রাত থেকে তার উচ্চ রক্তচাপ শুরু হলো। হতেই পারে, কিন্তু রক্তচাপ একটা সময় বেশিরভাগ মানুষেরই থাকে। এটি হঠাৎ হয় না, ওষুধও চলে সারা বছর চাপ অনুযায়ী বাড়ানো-কমানো হয়ে থাকে। নানান প্রশ্ন মনে। নিজামী তার বাহিনী দিয়ে যখন তিন শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে তখন তার কি রক্ত চাপহীন ছিল? যে সব বুদ্ধিজীবীর চোখ উপড়ে ফেলা হচ্ছিল, যাঁদের হার্ট বের করা হয়েছিল তাঁদের কি তখন উচ্চ রক্তচাপ ছিল না? কি জবাব নিজামীদের?
তাছাড়া স্বাধীনতার পরও বিশেষ করে জাতির জনককে হত্যার পরও নিজামীরা যেভাবে দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, জঙ্গী সৃষ্টি করে মানুষ হত্যা করছে, মানুষের সম্পদ হানি করেছে, পুলিশ-বিজিবি হত্যা করেছে তখন তাদের রক্তচাপ হয় না। সবচে বড় কথা হলো এই যে, বাংলাদেশের সন্তানদের জঙ্গী বানানো কি নীরব গণহত্যা নয়?
এবার মূল বিষয়ে ফিরে আসছি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ খাবে কি? ক্যালসিয়াম মানব দেহের সুস্থতার জন্য প্রয়োজন এবং তা সবচে বেশি থাকে ফলে। সেই ফলই যদি খাওয়া না যায়, তাহলে ক্যালসিয়ামের অভাবে শরীর দুর্বল হবে। আবার ওই সব বিষাক্ত রাসায়নিক শরীরে গেলে জন্ডিস, গ্যাসট্রিক, শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া ও ক্যান্সার হতে পারে, নষ্ট হয়ে যাবে কিডনি ও লিভার (নীরব এই গণহত্যা ঠেকাবে কে, মুনতাসীর মামুন?)।
এইভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড খেলে কি কি রোগ হতে পারে অথবা ফরমালিন, ইউরিয়া, বিভিন্ন ধাতু, স্টেরয়েড শরীরে গেলে কি কি রোগ হতে পারে বা মানবদেহের কি কি ক্ষতি হতে পারে প্রফেসর মামুন তাঁর কলামে সবই বলে দিয়েছেন। আর মামুন যখন কোন বিষয়ের ওপর লেখেন তখন আমাদের মতো কলামিস্টদের ঐ বিষয়ে না লেখাই ভাল। তবু লিখছি এ জন্য যে, এত বড় জাতীয় সমস্যা, এর সমাধানে দু’একটা কথা বলে নিজেকে মামুনদের সঙ্গে শরিক করা। কিভাবে বাঁচবে মানুষ? সারাদেশ আর্সেনিক আক্রান্ত, পানিতে আর্সেনিক, যে ফসলের গাছ ঐ আর্সেনিকযুক্ত পানি টানে সেই ফসল বা শস্য শরীরে গেলে আর্সেনিকের কারণে কিডনি, চর্মরোগসহ নানান রোগ হতে পারে। এই তো রমজান আসছে। এই ঢাকা শহরের পানিও আর্সেনিকমুক্ত কিনা জানি না, তবে পানিতে অনেক সময় যে পরিমাণ ময়লা বাহিত হয়ে আসে তাতে এই পানি খেলেও পেটের নানান রোগ তো হবেই, অজু-গোসল করলেও চর্মরোগ হবে, এর জন্য বিশেষজ্ঞের মতামত দরকার পড়ে না, আমরা প্রতিটি মানুষই ভুক্তভোগী। সবচে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে শিশুরা। অনেকে বিকলাঙ্গ হচ্ছে, অটিস্টিক হচ্ছে। প্রশ্ন হলো যাদের এসব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারা তো মে-জুনের গরমেও কমপ্লিট সুট পরে অফিস করে, সেমিনার করে দেশ উদ্ধার করছেন আর বড় বড় থিওরি ঝাড়েন। এরা বাংলাদেশের মানুষ না অন্য কোন দেশের? হাবভাবে তো মনে হয় ওদের বাংলাদেশে জন্মাবার কথা ছিল না। তবে হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অনুষ্ঠানের সুটের ওপর কয়েকটি শব্দ উচ্চারণ করায় এখন মনে হয় কমতে শুরু করেছে।
আরেকটি নীরব ঘাতক হচ্ছে ড্রাগ বা মাদকদ্রব্য। আমরা এরই মধ্যে কিছু মাদকদ্রব্যের নাম জেনেছি। যেমন হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হাশিশ। বৃহস্পতিবার দৈনিক প্রথম আলো লিখেছে, আইনের অস্পষ্টতার সুযোগ নিয়ে গত দেড় বছরে অন্য নাম দিয়ে ১৭ হাজার টন ফরমালিন আমদানি করা হয়েছে। একই দিনের দৈনিক জনকণ্ঠ লিখেছে, দেশে এখন স্ট্রং বিয়ারের নামে অতিমাত্রায় এ্যালকোহলে বাজার ছেয়ে গেছে। এগুলোও কিন্তু নীরব গণহত্যার দিকে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে। শোনা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকসেবীর সংখ্যা অর্ধকোটিরও বেশি। পুলিশ-র্যাব মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছে। কিন্তু পরবর্তীতে কি হলো তা কেউ জানে না। এই মাদকের ছোবলের শিকার হচ্ছে প্রধানত শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানরা। একশ্রেণীর পুলিশের আবার আয়েরও পথ এরা। একজন মাদকসেবীকে ধরতে পারলে তার অভিভাবকদের কাছ থেকে টু-পাইস ইনকাম হয়ে যায়। ভদ্রলোকের মান-সম্মান রক্ষায় পুলিশকে টাকা দিয়ে সন্তানকে ছাড়িয়ে আনে। আর নীরবে চোখের পানি ফেলে। সন্তানরা তা বোঝে না। বস্তুত মাদকদ্রব্য এমন এক জঘন্য জিনিস যা তার অনুভূতির সেলগুলো ধ্বংস করে দেয়। ঢাকায় অনেক মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে, যাতে কেবল এ রকম আটকে রাখা হয়। ৩ মাস ৬ মাস পর বেরিয়ে এসে সে আবার মাদক সেবন শুরু করে। এভাবে হাজার হাজার শিক্ষিত পরিবার অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তারপরও সন্তানদের মাদকের টাকার জোগান দিতে হয়। নইলে ‘খুন-খারাবি’ পর্যন্ত গড়ায়, প্রায়ই সংবাদপত্রে এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়। মাদকসেবী সন্তানটিও দিনে দিনে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা, স্ট্রং বিয়ারের মতো জঘন্য মাদক সেবনেও ক্যান্সার হতে পারে, কিডনি-লিভার নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু দেশের সুশীল সভ্যরা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলে, অথচ পুরো সমাজ যে মাদকদ্রব্যের ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে সে ব্যাপারে তাদের মাথা ব্যথা কমই দেখা যায়। মাদকের কাঁচা টাকা কখন যে কোনদিকে হাটে কে জানে?
ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ এ মৌসুমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা ফরমালিন নিয়ন্ত্রণে যে ভূমিকা পালন করছেন, তা মানুষের প্রশংসা পেয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখলেও মানুষ একইভাবে তাঁকে সাধুবাদ জানাবে।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment