আমার মায়ের আঁচলখানিইমদাদুল হক মিলন
তুমি কি ঘুমিয়েছিলে, মা!
ফজরের নামাজ শেষ করে বাবা আর শোয় না। তোমার একটু শোয়ার অভ্যাস আছে। নামাজ শেষ করে, মিনিট পনেরো কোরআন শরিফ পড়ে আবার একটু শোও। ঘণ্টাখানেক বা মিনিট চল্লিশ-পঞ্চাশের মতো ঘুমাও।
আজও কি তেমন ঘুমে ছিলে!
প্রথমে বুটের শব্দ, তারপর গুলির শব্দে কি তোমার ঘুম ভেঙেছিল! হঠাৎ ভাঙা ঘুমচোখে তুমি কি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলে বসার ঘরের দিকে! তার আগেই সামনের দিককার উঠানে বাবাকে ওরা গুলি করেছে! বাবার লাশ উঠানে লুটিয়ে পড়ার পর ওরা ঢুকেছিল বসার ঘরে! আর ঠিক তখনই বোধ হয় ছুটে আসছিলে তুমি। তোমাকেও বাবার মতো করেই গুলি করেছে। তুমি লুটিয়ে পড়েছ বসার ঘরের মেঝেতে! তোমার শরীর ঝাঁঝরা করে ওদের গুলি গিয়ে বিঁধেছে আমাদের বহু বহু বছরের পুরনো বাড়ির, বসার ঘরের দেয়ালে। দেয়ালের আস্তর খসে পড়েছে মেঝেতে। তোমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে চুন-সুরকি। তোমার শাড়ি ভিজিয়ে রক্তের ধারা পুরনো কালের সিমেন্টে গড়িয়ে যাচ্ছিল। বাইরের দিককার দরজার কাছাকাছি গিয়ে আর যেতে পারেনি। জমাট বেঁধে গেছে।
আমি যখন বাবার লাশ দেখে বসার ঘরে ঢুকেছি, মা গো, এই যে আমি এত দিন পর বাড়ি ফিরেছি মাত্র একটা রাতের জন্য, উঠানে বাবার লাশ দেখার পর, কিভাবে কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে আমার মাথাটা যখন শূন্য হয়ে গেছে, তখন তোমাকে আমি দেখতে পেলাম।
তুমি পড়ে আছ বসার ঘরে। তোমার মুখ দরজার দিকে। চোখ বন্ধ। কাত হয়ে একটু যেন দুমড়ে আছ।
মা, মা গো, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে কোন সন্তান! তার বুক ফেটে যাওয়ার কথা, কলিজা ফেটে মরে যাওয়ার কথা, তার তো চোখের জল কোনও বাধ মানবে না।
আমি কাঁদতে পারছিলাম না, মা। আমার বুক কলিজা কোনওটাই ফেটে যায়নি। আমি কেমন যেন নির্বোধ হয়ে গেলাম। আমার শরীরে মনে কোথাও যেন কোনও অনুভূতি নেই। আমি যেন কোনও মানুষ নই, আমি যেন এক জড় পদার্থ। প্রথমে তাকিয়ে দেখলাম বাবার লাশ, তারপর কেমন উদাস নির্বিকার ভঙ্গিতে ঢুকলাম বসার ঘরে, তোমাকে দেখলাম। বকুলের ঘরে ঢুকে বকুলকে দেখলাম। আমার আর মায়ার ঘরের দিকে গিয়ে দেখি সেই ঘরে কেউ নেই। আমি যেন খুব স্বাভাবিক মানুষের মতো একটু অবাক হলাম। মায়া, কোথায় তুমি? এ রকম একটা ডাকও যেন আমার ডাকতে ইচ্ছা করল।
শেষ বিকালটা মায়ার খুব প্রিয় সময়। সে রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মেয়ে। প্রকৃতি তাকে খুব আকর্ষণ করে। শেষ বিকালের রোদ যখন উঠে যায় গাছপালার মাথায়, চারদিকে ডাকাডাকি শুরু করে দিনশেষের পাখিরা, শ্রাবণ আকাশে আজ মেঘ নেই বলে ঝকঝকে নীল আকাশ, রজতরেখার ওদিক থেকে, বর্ষার ধানি বিল মাঠ পেরিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে উড়ে আসা হাওয়া, গাছের পাতায় পাতায় হাওয়ার খেলা দেখতে মায়া নিশ্চয়ই পেছনের বাগানের দিকে গিয়েছে ভেবে আমি ঘর থেকে বেরোলাম।
আশ্চর্য ব্যাপার মা, আমি যে ততক্ষণে আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান দুজন মানুষের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া লাশ দেখেছি, হৃদয়ের টুকরো বোনটিকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি তার ঘরের মেঝেতে, তাকে আর গুলি করার প্রয়োজন মনে করেনি দানবরা, এমনিতেই মরে গিয়েছিল সে, সেই বোনটিকে দেখেছি, তারপর নিজের রুমে এসে মায়াকে ওভাবে ডাকতে ইচ্ছা করল আমার, এমন হয় নাকি, মা! একজন মানুষ কেমন করে পারে এমন নির্বিকার হয়ে যেতে!
তারপর মায়াকে খুঁজতে আমি ঘর থেকে বেরোলাম। তাকে পড়ে থাকতে দেখলাম পিছন দিককার উঠানে। বেয়নেটের পর বেয়নেট চার্জ করা হয়েছে তার পেটে। মায়ার গর্ভে ছিল আমার সাত সাড়ে সাত মাসের সন্তান। মুখ মাথা হাত পা সবই তৈরি হয়ে গেছে। মায়ের গর্ভেও নিরাপদে থাকতে পারেনি সে। বেয়নেট মায়ার মতোই লণ্ডভণ্ড করেছে তার ওইটুকু শরীর। শুধু মুখটুকু অক্ষত। ফোলা ফোলা বন্ধ দুটো চোখ। বিকাল শেষ হওয়া আলোয় সেই মুখ দেখেও আমি যেন কিছুই অনুভব করলাম না। মায়ার মায়াবী মুখ, আমার সন্তানের শরীর, ছোট্ট মুখখানি- কোনও কিছুই আমাকে বিচলিত করল না।
কেন মা?
কেন এমন হলো আমার?
বরং মায়া আর আমার সন্তানের লণ্ডভণ্ড শরীর ঘিরে, রক্তমাংস মেদ মজ্জার ঘ্রাণে নীল বড় সাইজের যে মাছিগুলো ওড়াউড়ি করছিল, ওদের শরীরে বসছিল, সামনে কিছুক্ষণ বসে ডান হাত হাতপাখার মতো নাড়িয়ে মাছিগুলোকে আমি তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।
আমি এমন হয়ে গেলাম কেন, মা?
এই অবস্থাটাকে কী বলে? অধিক শোকে পাথর! এই কি অধিক শোকে পাথর হওয়া!
কিন্তু তোমার ওজন এত কমে গেছে কেন, মা? আমার জন্য? আমার কথা ভেবে তুমি ঠিকমতো খাওনি, ঘুমাওনি। একমাত্র ছেলে কোথায় কোথায় যুদ্ধ করছে দেশের জন্য, তার কথা ভেবে এই অবস্থা তোমার! ছেলে তিন বেলা খেতে পাচ্ছে কি না, রাতে ঘুমাতে পারছে কি না, এসব ভেবে খাওয়া ঘুম বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি!
এই যে পাঁজাকোলে করে তোমাকে আমি উঠানে নিয়ে এলাম, বাবার কবরের দক্ষিণ দিকটায় শুইয়ে দিয়ে শুরু করেছি তোমার কবর খোঁড়ার কাজ, এই ফাঁকে টের পেলাম, তুমি আর তুমি ছিলে না, মা। আমার ভাবনায় শেষ হয়ে গিয়েছিলে তুমি!
তোমাদের দেখে বাবার কাছে ফিরলাম আমি। বাবার পাশে মাটিতে লেছড়ে-পেছড়ে বসে তাঁর বুকে হাত বোলাতে লাগলাম। তারপর মনে হলো, এভাবে বসে থেকে কী হবে! এখন শুরু করতে হবে আমার দায়িত্ব, সন্তান ভাই স্বামী আর জনকের দায়িত্ব।
গোয়ালঘরের ওদিক থেকে কোদাল এনে কাজ শুরু করলাম, সেই ফাঁকে কখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেল, কখন আবছা অন্ধকারে বাড়ি ভরে ওঠার আগেই চাঁদ উঠে গেল পুব আকাশে, টেরই পেলাম না।
আজ কি পূর্ণিমা?
নাকি পূর্ণিমার এখনো দু-এক দিন বাকি?
কী জানি!
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে নিতে, চাঁদের হিসাব আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। অথচ তোমরা সবাই জানো, আমি চাঁদপাগল ছেলে। পূর্ণিমা রাত, প্রখর জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া জগৎসংসার খুবই প্রিয় আমার। বাড়িতে থাকলে, আমাদের এই গাছপালাঘেরা বাড়িতে, জ্যোৎস্না রাতে একা একা আমি ঘুরে বেড়াতাম। রাত একটা দুটো বেজে যেত, আমি এদিক যাচ্ছি, ওদিক যাচ্ছি। কোথাও বসে তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। রাত কত হলো খেয়ালই করছি না।
আমাকে নিয়ে অদ্ভুত একটা ভয় ছিল তোমার।
ভূতের ভয়।
এত বড় গাছপালাঘেরা বাড়ি, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় রাতের বেলা কিছুতেই যেন না যাই, বারবার এসব বলতে। ওদিকটায় নাকি 'স্কন্ধকাটা' নামের একজনের বসবাস। অন্ধকার রাতে তার চলাচলের শব্দ পাওয়া যায়, চোখে দেখা যায় না। জ্যোৎস্না রাতে দেখা যায়। বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় হাঁটাচলা করে। ওই জিনিসের ধড় আছে, মাথা নেই। ঘাড়ের ওপর থেকে কাটা। এ জন্য ও রকম নাম- স্কন্ধকাটা। তবে সারা শরীরেই চোখ। দেড়-দু শ নাকি চোখ শরীরে। কোনও কোনও নির্জন দুপুরেও নাকি কদম তাকে দূর থেকে দেখেছে। বারেকের মা নাকি প্রায়ই দেখত।
ওই মহিলার কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করতাম না। গল্পবাজ মহিলা। ভূতের গল্প বলেও হাসত। তার হাসি দেখে ভূতের ভয় উধাও হয়ে যেত আমাদের। বুঝতাম, বানিয়ে বানিয়ে গল্প করছে।
তবে বারেকের মায়ের জান হচ্ছে বকুল।
না না, এখন বলতে হবে 'ছিল'!
বকুলকে সে ডাকত 'কুট্টি'। অর্থাৎ ছোট্ট। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। বহু বছর ধরে আমাদের বাড়িতে। বকুলকে জন্মাতে দেখেছে। তোমাকে ডাকত মা। বিয়ে হয়েছিল এক ডাকাতের সঙ্গে। প্রথমে জানত না লোকটা ডাকাতি করে। বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারে। তত দিনে বারেক তার গর্ভে। বারেককে পেটে নিয়েই বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। ডাকাতের সংসার সে করবে না। হতদরিদ্র বাপ-ভাই ভালো রকম বিপদে পড়ল তাকে নিয়ে। নিজেদের সাধ্যমতো অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। বাচ্চা পেটে এ রকম মেয়েকে কে বিয়ে করবে!
বারেক জন্মাল। সেই ছেলে কোলে নিয়ে বাপ-ভাইয়ের সংসার ছাড়ল সে। কেমন কেমন করে এসে উঠল আমাদের সংসারে। মহিলাটি বাজখাঁই টাইপের। কথা বলে চিৎকার করে। গলার স্বর পুরুষালি। কিন্তু মনটা খুব নরম। মানুষের জন্য খুব মায়া।
বারেকের মায়ের ভূতের গল্প শুনে বারেক পর্যন্ত হাসত। আমাদের কাউকে তো আর ধমক দিতে পারে না সে, বকুল হয়তো তার কোলে বসে আছে, হাসতে হাসতে নিজের ছেলেকেই একটা ধমক দিল।
বারেক ওসব ধমক পাত্তা দিত না। শরীরে ডাকাত বাপের রক্ত বলে ওইটুকু বয়স থেকেই বারেক বেশ সাহসী। ডর-ভয় একদমই নেই। আট-দশ বছর বয়সেই গভীর অন্ধকার রাতে বাড়ির এদিক-ওদিক চলে যেত। বারেকের মা কত রকমভাবে শাসন করত; শুনতই না।
তোমার মনে আছে মা, বারেককে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। ক্লাস টু না থ্রি পর্যন্ত অতিকষ্টে সে পড়ল। বাবা তুমি আমি, এমনকি ছোট বকুল পর্যন্ত তাকে পড়ানোর চেষ্টা করত, পড়ায় ওর মনই বসে না। পড়তে বসলেই উসখুস উসখুস করে। একদিন স্কুলে যায় তো দুদিন যায় না। স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়ে যে পালিয়ে থাকে! বারেককে কিছুতেই আমরা সামলাতে পারছিলাম না।
এসব দেখে একদিন বারেকের মা মহা খ্যাপা খেপল।
রান্নাঘরের সামনে বসে তার সেই বাজখাঁই গলায় গালাগাল করতে লাগল ছেলেকে। ওই ডাকাইতের পো, তুই কি মানুষ হবি, না ডাকাইত হবি?
বারেক নির্বিকার গলায় বলল, ডাকাইত হমু।
বারেকের বয়স তখন দশটশের বেশি না। দশ বছরের ছেলে এভাবে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে, বারেকের মা আরো খেপল। কী? কী হবি তুই?
ডাকাইত হমু। মানুষের গলা কাটুম।
কচ কী তুই?
হ, ঠিকই কই। আমার পড়তে ভাল্লাগে না, আমি পড়ুম না। আমি ডাকাইত হইয়া যামু।
বারেকের মা দুপুরের রান্না চড়িয়েছিল। রান্নাটা তাকে খুব ভালো শিখিয়েছিলে তুমি। চুলার পাড়ে বসে ছেলেকে বকছিল আর রান্না করছিল। বারেকের ওসব কথা শুনে চুলায় মাত্র গুঁজতে যাবে এমন একটা লাকড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে বেরোল। ধামা ধাম দু-তিনটা বাড়ি মারল বারেককে। ডাকাইত হবি তুই, ডাকাইত! যেই ডাকাইতের লেইগা আমি সংসার ছাড়ছি, আমার পেটের পোলা হইব সেই ডাকাইত! ডাকাইতের বংশ আমি রাখুম না। পিডাইয়া মাইরা হালামু।
আবার বাড়ি দিতে গেছে বারেককে, বারেক ঝাড়া একটা দৌড় দিল, দৌড় দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় চলে গেল।
সেদিন বাবার স্কুল ছিল না। ছুটির দিন। আমরা সবাই বাড়িতে। বারেকের মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি রান্নাঘরের ওদিকটায়। বারেক পালিয়ে গেছে দেখে, তাকে ইচ্ছামতন পিটাতে পারেনি বলে শরীরের রাগ মিটেনি বারেকের মায়ের। আমাদের সবাইকে দেখে রাগটা অভিমানে রূপান্তরিত হলো। হাতের লাকড়ি ছুড়ে ফেলে রান্নাঘরের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে বসে পড়ল। বসে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল- যার লেইগা এত কষ্ট করছি আমি, জীবনডা শেষ কইরা দিছি, হেই পোলায় আমারে আইজ কয় লেখাপড়া করব না, ডাকাইত হইব। তয় আর এই রকম পোলা রাইখা লাভ কী? ও মইরা যাউক। নাইলে অরে আমি নিজেই পিডাইয়া মাইরা হালামু।
বাবা খুব নরম গলায় বললেন, থামো বারেকের মা। কান্নাকাটি করে লাভ নেই। সব মানুষের সব কিছু হয় না। তুমি যা চাও তোমার ছেলের তা হবে না। আমি মাস্টার মানুষ। অনেক ছাত্র দেখেছি জীবনে। চেষ্টা তো কম করলাম না তোমার ছেলেকে নিয়ে। লেখাপড়া ওর হবে না। ওকে অন্য কাজে লাগাতে হবে। কদমের মতো ক্ষেতখোলার কাজ করুক। গরুর রাখাল হোক। আজ থেকে এই সব কাজে ওকে লাগিয়ে দাও।
কিন্তু সারা দিন বারেকের দেখা নেই। সেই যে দৌড়ে পালাল, বাঁশঝাড়ের ওদিকে গেল, দুপুর গড়িয়ে যায় ফেরার নাম নেই।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম আমরা। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর কদম বারেকের মা বারেক আর পারুল রান্নাঘরে বসেই খায়...
আরে, পারুলের কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মা!
সেও আমাদের সংসারে আছে দশ-বারো বছর ধরে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা একটি মেয়ে। যখন আমাদের বাড়িতে কাজে এলো, তখন এত রোগা, একদম বাঁশের মতো। বাঁশ না, বারেকের মা বলত কঞ্চির মতো।
একবার বৈশাখ মাসের দুপুরের পর বাড়ির সামনের দিকে কী কাজে গেছে, হঠাৎই শুরু হলো কালবৈশাখী। দমকা একটা বাতাস এলো, পারুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেল সেই দমকা বাতাস খড়নাড়ার মতো দশ-বারো হাত দূরে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে তাকে।
একজন মানুষকে এভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাওয়া!
পরে এই ঘটনা প্রায়ই বলত পারুল আর খুব হাসত।
ছোটবেলায় বসন্ত হয়েছিল। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। ঝিমকালো গায়ের রং। এতিম মেয়ে। জন্মের পর প্রথমে মা মরেছে, তারপর বাপ। মা মরেছে বসন্তে, বাপের হয়েছিল যক্ষ্মা। মায়ের সঙ্গে ছোট্ট পারুলেরও বসন্ত হয়েছিল, কিন্তু সে টিকে গেল। বেঁচে থাকল মামাদের গলগ্রহ হয়ে। সেও পদ্মার চরের মানুষ। চরের নাম বোধ হয় পাচ্চর। আমাদের এলাকায় এই ধরনের মানুষদের খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সবাই। বলে 'চউরা'। চউরা শব্দটা গাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। পুরুষরা চউরা, মহিলারা 'চউরানি'।
আমাদের বাড়িতে এসব অসভ্যতা নেই। পারুলকে ভুলেও কেউ আমরা চউরানি বলি না, এমনকি কদম বারেকের মাও না।
কদম বলবে কেন, সেও তো চরেরই লোক।
বাড়িতে আসার পর এমনভাবে পারুল আমাদের সঙ্গে মিশে গেল, মা-বাবার কথা, মামা-মামি, অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কথা সে বলতই না। সবার কথাই যেন ভুলে গেছে। আমরা ছাড়া তার যেন পৃথিবীতে আর কেউ ছিলই না।
তবে পারুলের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হলো আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে। কঞ্চির মতো মেয়েটি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবতী হতে লাগল। এমনিতেই ছয় ফুটের মতো লম্বা, তার ওপর স্বাস্থ্য ভালো হতে হতে প্রায় মোটা হয়ে গেল। এ রকম মোটা লম্বা একটি মেয়ে, আচমকা দেখলে কী রকম একটা ধাক্কা যেন লাগে। তার ওপর ঝিমকালো।
বারেকের মা ঠাট্টা করে বলত, ওই পারু, তুই কি মানুষ?
পারুল অবাক হয়ে বলত, তয় আমি কী?
মাইয়া ভূতগো কী কয়, জানচ?
জানি। পেতনি।
তার পরই বারেকের মায়ের ঠাট্টা সে ধরে ফেলত। রেগে গেলে বারেকের মাকে সে বলত বুড়ি। মারমুখো ভঙ্গিতে বলত, ওই বুড়ি, তুমি কি আমারে পেতনি মনে করো?
বারেকের মা খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা পান মুখে দিয়েছে। পান চিবাতে চিবাতেই হাসল। হ, তরে অমুনই লাগে। একলা একলা বাঁশঝাড়ের ওই দিকে যাইচ না।
পারুটা একটু বোকাসোকাও আছে। কথার মারপ্যাঁচ সহজে বোঝে না। বারেকের মা তাকে পেতনি বলেছে, সেটা ভুলে বাঁশঝাড়ের ওদিকে কেন তাকে যেতে মানা করা হচ্ছে ওই নিয়ে পড়ল।
ক্যান, ওই দিকে যামু না ক্যান?
বাঁশঝাড়ে যে একজন থাকে জানচ না?
জানি তো!
দেখছস কুনো দিন?
না। তোমার মুখে হুনছি। কদম মামার মুখে হুনছি।
কদমকে পারুল মামা ডাকত। কেন কে জানে। দুজনই চরের মানুষ বলেই কি না, নাকি মামাদের সংসারে বড় হয়েছে বলে মামাদের বয়সী লোককে মামা ডাকার অভ্যাস হয়েছে!
কিন্তু বাবাকে সে মামা ডাকত না। বাবাকে ডাকত 'ছার'। অর্থাৎ স্যার। উচ্চারণ দোষে সেটা ছার হয়ে যেত। আর তোমাকে ডাকত আম্মা। আমি হচ্ছি ভাইজান, বকুল আপা। বয়স বকুলের মতোই।
সেই দুপুরে বকুলও বোধ হয় ওদের কাছাকাছি ছিল। বারেকের মা আর পারুলের কথা শুনছিল। কদম থাকত গোলাঘরে। ওদিকটায় বসে নারকেলের হুঁকায় গুড়ুক গুড়ুক করে তামাক টানছে। পারুল আর বারেকের মায়ের দিকে তার মন নেই। তামাক টানার সময় তামাকে এতটা মগ্ন থাকে, অন্য কোনও দিকে তাকানোর যেন সময় নেই।
ঘটনা আমাকে বলেছিল বকুল। বলে কী যে হাসি!
বাঁশঝাড়ের ওদিকে পারুলকে যেতে মানা করেছে বারেকের মা। ওদিকে যিনি থাকেন তেনার কথাও বলেছেন।
কিন্তু আসল কথাটা তখনও বলেনি।
বারেকের মাকে পারুল ডাকে খালা। উতলা গলায় সে তারপর বলল, ও খালা, কইলা না, কির লাইগা আমি বাঁশঝাড়তলায় যামু না!
ওই যে কইলাম, একজন আছে।
হেইডা তো হুনলাম। জানিও। তার বাদেও হুকনা বাঁশপাতা আনতে যাই।
আর যাইচ না।
ক্যান? আমি তো রাইত্রে যাই না। যাই দিনে। তাও দোফরে যাই না। বিয়ানের দিকে যাই।
তাও যাইচ না।
ক্যান যামু না হেইডা কইবা তো?
তেনায় থাকেন একলা।
হ, হেইডাও জানি।
বউ নাই।
একলা থাকলে আবার বউ থাকব কেমনে?
তার একটা বউ দরকার।
পারুলও এবার ঠাট্টা করল। তোমার লগে দেখা হইছিল? কইছে তোমারে?
বারেকের মা হাসল। হ, দেখা হইছিল। কইছে আমারে।
কী কইছে?
তার একটা বউ দরকার। তরে তেনায় বহুত পছন্দ করেন। দূর থিকা দেখছেন। তেনার চেহারার লগে তর মিল আছে। তেনার খালি মাথাডা নাই, তর মাথা আছে। একলা পাইলেই সে তরে বিয়া কইরা ফালাইব।
এই শুনে পারুল মহা চেতা চেতল। বলল, আমি তো দেখি তোমার চেহারাও তেনার মতন। তোমার লগে যহন দেহা হইছিল, তোমারে তেনায় বিবাহ করেন নাই ক্যান?
বারেকের মা নির্বিকার। আরে আমি তো বুড়ি হইয়া গেছি। বুড়ি তেনায় বিবাহ করবেন না। আর আমার লগে তার জাতপাতও বনে না। তেনায় মানুষ বিবাহ করবেন না, তেনার দরকার তার জাতের জিনিস। পেতনি। ভূতের বউ পেতনি।
বোকা মানুষ রাগলে ভয়ংকর হয়। বারেকের মায়ের কথাবার্তা শুনে ভয়ংকর হয়ে উঠল পারুল। কী রেখে কী বলবে বুঝতে না পেরে তোতলাতে লাগল। রাগলে তোতলানোর স্বভাব তার।
বকুল গিয়ে থামাল পারুলকে। বারেকের মাকে কপট ধমক দিল হাসতে হাসতে, আর পারুলের হাত ধরে তাকে টেনে সরিয়ে আনল।
মা, আমি কি আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি?
আমি কি এখন আর বাস্তবে নেই! আমি কি এই সময়ের মধ্যে নেই! এই যে আমি গোরখোদকের ভঙ্গিতে কোদাল চালাচ্ছি, চাক চাক মাটি তুলে দুপাশে রাখছি, বাবার কবরের সঙ্গে তোমার কবরের ব্যবধান দু-আড়াই হাত, অতিকষ্টের কঠিন কাজ, ঘামে জবজব করছে শরীর, ওই তো আমার সামনে তুমি, বাবাকে যেভাবে সামনে রেখে খুঁড়েছিলাম তাঁর কবর, ঠিক সেইভাবেই করছি তোমার কাজ, তার পরও তোমার কথা আমি বলছি না, বাড়ির অন্যান্য মানুষের কথা বলছি। বারেকের মা, বারেক আর পারুলের কথা বলছি। কদমও আছে সঙ্গে। তাদের ঘিরে কত টুকটাক স্মৃতির কথা বলছি।
এত কথা আমার কেন মনে পড়ছে, মা!
আরে, ওই দেখো, এখনই আমার মনে পড়ল, বাবার কবর খোঁড়ার সময় বাবাকে নিয়ে যখন কথা বলছিলাম তখন বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে আমার শুধু কদমের কথাই মনে আসছিল। বাড়ির পোষা জীবগুলোর কথা মনে আসছিল। আমাদের গরু ছাগল মুরগি কুকুর বিড়াল কবুতরগুলোর কথা মনে আসছিল। খোঁয়াড়ের ওদিকটায় না কোথায় যেন কবুতর ডাকার মৃদু শব্দও পেলাম। অথচ বাড়িতে যে জলজ্যান্ত আরো দুজন মানুষ ছিল, বারেকের মা আর পারুল, তাদের কথা মনেই পড়ল না।
কেন মা?
আমার এমন হচ্ছে কেন?
স্মৃতিশক্তি, স্মরণশক্তি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
আর মানুষ দুজন গেলই বা কোথায়?
গোলাগুলির শব্দে, ভয়ে আতঙ্কে ওরা দুজন কি ছুটে গিয়ে কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়েছিল! নাকি বর্ষার পানিতে নেমে নিজের জীবন বাঁচাতে সাঁতরে চলে গিয়েছিল কোনও দিকে! ওরা কি বেঁচে আছে? নাকি বাড়ির সবাইকে শেষ করে, বাড়ি লুটপাট করে খুঁজে খুঁজে ওদেরও বের করেছিল পাকিস্তানি... ...গুলো! ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা মাঠের ওদিককার বর্ষার পানিতে খুঁজে পেয়েছিল ওদেরকে। ওখানেই গুলি করে শেষ করে দিয়েছে।
ওদের লাশও কি এতক্ষণে ভেসে উঠেছে মাঠবিলের ওদিকে!
বল্টু কুকুরটা গেল কোথায়?
বিড়ালটা?
গোলাগুলির শব্দে কুকুরটাও কি ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে নেমেছে বর্ষার পানিতে? সাঁতরে চলে গেছে অন্য কোনও বাড়িতে!
বিড়ালটা কি কোনও ঝোপঝাড়ে গিয়ে লুকিয়েছে! নাকি কোনও গাছে গিয়ে চড়েছে! পাতার আড়ালে বসে কাঁপছে!
বিড়াল পানিতে নামে না। সে বোধ হয় বাড়িতেই আছে। এতক্ষণে ফিরলে পারত। তাও তো সংসারের জীবিত কারো সঙ্গে আমার দেখা হতো।
চারদিক থেকে আসছে চাঁদের প্রখর আলো। তোমার আমার শরীরে পড়েছে। তোমার মুখ থেকে আমি চোখ ফেরালাম চাঁদের আলোর দিকে। তারপর কোদাল থামিয়ে তাকালাম পেছন দিকটায়, আমাদের দরদালানের দিকে। তাকিয়ে অবাক হলাম। আরে, দরজা জানালার কপাটগুলো তো নেই! জানালার শিকগুলোও নেই। তার মানে ওসবও খুলে নিয়ে গেছে রাজাকাররা! তোমাদের লাশ ছাড়া আর কিছুই ফেলে যায়নি!
মা, ও মা, সেই যে একদিন তুমি এক মায়ের আত্মার গল্প বলেছিলে, আত্মা কথা বলে উঠেছিল, তুমি কি আমার সঙ্গে তেমন করে কথা বলতে পারো না, মা! গল্পের সেই মা তো তার ছেলের ব্যথা পাওয়া নিয়ে কথা বলেছিল। তুমি কি পারো না সেইভাবে কথা বলতে!
মা, ও মা, বলো না! একটু কথা তুমি আমার সঙ্গে বলো না!
কয়েক মুহূর্তমাত্র, তারপর কপালের ঘাম আঙুলে কেচে আবার কোদাল চালাচ্ছি মা। তুমি দেখতে পাচ্ছ! মা, তুমি দেখতে পাচ্ছ মায়ের কবর খুঁড়ছে ছেলে!
ওই দ্যাখো, এখন আবার মনে পড়ছে বকুলের কথা।
বকুল আমার কথাই শোনে না, মা।
আমার চেয়ে আট বছরের ছোট। আমার কথা শুনবে না কেন? আমি কিছু চাইলেই বলে, আমাকে এত অর্ডার দেবে না। আমি কি তোমার চাকর? পারুলকে বলো, বারেকের মাকে বলো।
বারেকের মাকে আমরা ডাকি বুয়া।
আমার সঙ্গে কথা বলার সময়, বারেকের মা যে বকুলকে এত আদর করে, কুট্টি কুট্টি বলে জান দিয়ে দেয়, সেই বারেকের মাকে সে বুয়াটা পর্যন্ত বলে না। সোজা বলে বারেকের মা।
এসব অবশ্য অনেক আগের কথা, মা।
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বকুল টুতে উঠেছে। চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল, ছটফটে। একটা মুহূর্ত স্থির নেই। ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখছে। সামনে আমার পরীক্ষা। সকালবেলা পড়তে বসেছি। নাশতার পর সেই বয়সেই এক কাপ চা খাওয়া অভ্যাস হয়েছে। পড়ার টেবিলে দুলতে দুলতে পড়ছি। দেখি, বারান্দার দিকে বকুল একটা ফড়িং ধরার চেষ্টা করছে।
তুমি তো জানোই মা, আমাদের বাড়িতে ফড়িং প্রজাপতি মৌমাছি ভ্রমর- এসবের অন্ত নেই। মেঠো ইঁদুর আছে, ব্যাঙ আছে দুই তিন রকমের। কোলাব্যাঙ, কুনোব্যাঙ। সোনাব্যাঙ আছে পুকুরের ওদিকটায়। বর্ষার মুখে মুখে, বৃষ্টি-বাদলা শুরু হলেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকতে শুরু করে ব্যাঙগুলো। আমাদের এখনকার যে বিড়ালটা, ওটার মা-বাবা দুটোই তখন বাড়িতে। অর্থাৎ আমাদের তখন দুটো বিড়াল। হুলোটা কোনও কোনও দিন চলে যেত ঝোপ-জঙ্গলে; মেঠো ইঁদুর, ব্যাঙ- এসব ধরে নিয়ে আসত। ইঁদুর-বিড়ালের খেলাটা আমরা খুবই মজা করে দেখতাম।
হুলোটা করত কী, ইঁদুর ধরে সেটাকে আধমরা করে উঠানের দিকে নিয়ে আসত। সামনে ফেলে রেখে নিজে আয়েশ করে বসত। একটা পা দিয়ে আলতো করে একটু নাড়া দিত মড়ার মতো পড়ে থাকা ইঁদুরটাকে।
ইঁদুরও অতি চতুর জীব। সে ইচ্ছা করেই মরার ভান করে পড়ে থাকত। হুলোর নাড়া খেয়ে ভাবত, এখন আর বিপদ নেই, এখন আচমকা একটা দৌড় দিলেই জানে বাঁচি।
ইঁদুর সেই চেষ্টাই করত।
বিড়ালের নাড়া খেয়ে যেই না পালাতে গেছে, আমাদের হুলো অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ঘাপ করে কামড়ে ধরল ঘাড়ের কাছটা।
এই খেলা আমরা সবাই মজা করে দেখতাম। অনেকক্ষণ ধরে খেলাটা খেলত হুলো। তারপর একসময় তুমি কিংবা বুয়া, কদম বাড়িতে থাকলে কদম আর নয়তো পারুল তাড়া দিয়ে বিদায় করত হুলোটাকে। হুলো ইঁদুর মুখে নিয়ে বাড়ির কোন দিকে যে চলে যেত!
কী কারণে যেন ইঁদুর-বিড়ালের কথা বলছিলাম, মা!
আমার সব কিছু এলোমেলো, কেন কী বলছি, বুঝতে পারছি না। মাথায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে আসছে নানা রকম স্মৃতি। চোখে ভেসে উঠছে নিকট আর দূর অতীতের কত কত দৃশ্য। কোন স্মৃতি কেন আসছে মাথায়, চোখে কেন ভেসে উঠছে একের পর এক বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, বুঝতে পারছি না, মা।
ও মনে পড়েছে, বকুলের কথা বলছিলাম। আমার পড়ার ঘরের বারান্দায় ফড়িং ধরায় ব্যস্ত ছিল বকুল। সকালবেলার আলোয় ঝকঝক করছে চারদিক। সামনে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। জুন-জুলাই মাস। গ্রীষ্মকালও শেষ হয়ে আসছে। রোদ ওঠে বাঘের মতো। গাছপালাঘেরা বাড়ি বলে আমাদের বাড়িতে গরম লাগে কম। হাওয়া একটু না একটু আছেই। গাছপালার নিজস্ব শীতলতাও কাজ করে।
আমি পরীক্ষার পড়া পড়ছি। বকুলেরও পরীক্ষা। কিন্তু সে পড়ালেখা নিয়ে ভাবছেই না। তুমি বা বাবা কেউ ওকে তেমন কিছু বলো না। বাবা বলেন, ওইটুকু মেয়ে, ও ওর মতোই পড়ুক। যখন ইচ্ছা পড়তে বসবে, যতক্ষণ ইচ্ছা পড়বে, না হলে পড়বে না। ওকে চাপাচাপি করার দরকার নেই।
তবে সকাল-সন্ধ্যা নিয়মমতোই পড়াশোনাটা করত বকুল। সেদিন বোধ হয় পড়া শেষ করেই ফড়িং ধরায় ব্যস্ত হয়েছে।
আমি পড়তে পড়তে ডাকলাম, বকুল।
বকুল সাড়া দিল না, তাকিয়েও দেখল না।
আমি আবার ডাকলাম, এই বকুল।
এবার সে আমার দিকে মুখ ফেরাল। কী?
এদিকে আয়।
পারব না।
কেন?
দেখছ না আমি ব্যস্ত!
আমি বিরক্ত হলাম। না, দেখছি না। কী করছিস তুই?
ফড়িং ধরছি।
এখন ফড়িং ধরতে হবে না।
না, আমি ধরব। এই নীল রঙের ফড়িংটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এটাকে ধরে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখব।
না, এসব করতে হয় না।
করলে কী হয়?
আল্লাহ গুনাহ দেয়।
আমি তো ওটাকে মারব না। আল্লাহ গুনাহ দেবে কেন?
ঠিক আছে, একটু পরে ধর। আগে আমার একটা কাজ করে দে।
কী কাজ?
বুয়াকে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বারেকের মা চা বানাত অসাধারণ। আমাদের বাড়ির গরুর ঘন দুধের চা। চিনি দিয়ে এত চমৎকার করে বানাত! কাপের পর কাপ খেতে ইচ্ছা করত।
আমার কথা শুনে বকুলকে দেখলাম ভিতরের দিকে চলে যেতে।
আমি পড়ছি আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সময় যাচ্ছে, চায়ের খবরই নেই। কী ব্যাপার? বকুল বলে আসার পরও বুয়া চা দেবে না, এমন তো হওয়ার কথা না।
পড়া রেখে উঠলাম।
প্রথমে বকুলকে খুঁজলাম। কোন দিকে গেছে, খুঁজে পেলাম না। গেলাম রান্নাঘরে। গিয়ে দেখি, পারুল পাটাপুতায় ঘসর ঘসর করে হলুদ বাটছে। সামনে শুকনা মরিচ, জিরা, ধনিয়া। হলুদগুলো মাটির একটা মালসায় ভিজানো। ভিজালে নরম হয় হলুদ। বাটতে সুবিধা। সে মন দিয়ে তার কাজ করছে। আর বারেকের মা মাটির একটা হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা কই মাছ বের করার জন্য মাত্র হাত দেবে।
বুয়া।
বুয়া চমকে তাকাল, জে দাদা।
আমি না চা চাইলাম!
বুয়া আকাশ থেকে পড়ল। কার কাছে চাইছেন?
তোমার কাছে।
আমার কাছে?
হ্যাঁ। বকুল তোমাকে বলেনি?
না তো। কুট্টির লগে তো আমার দেখাই হয় নাই।
আমার খুবই মেজাজ খারাপ হলো। গম্ভীর গলায় বললাম, আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো।
ফেরার সময় দেখি, পিছন দিককার বারান্দায় একটা নীল লম্বা লেজের ফড়িংয়ের ডানা সুতা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে বকুল।
আমি গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বকুল।
বকুল আমার দিকে তাকাল না। কী?
তোকে আমি কী বলেছিলাম?
কী বলেছিলে?
ভুলে গেছিস?
বলো না, কী বলেছিলে?
বলেছিলাম না, বুয়াকে গিয়ে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বকুল তবু আমার দিকে তাকাল না। ফড়িং ধরছিলাম তো, মনে ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে বকুলের গালে একটা চড় মারলাম। তখনও ফড়িংটাকে সে বাঁধতে পারেনি। চড় খেয়ে হাত থেকে ফড়িং ছুটে গেল। ডানায় বোধ হয় ভালো রকম ব্যথা পেয়েছে। তবু ভাঙা ডানা নিয়ে উড়ে চলে গেল।
আমি চড় মারব এটা বকুল ভাবেইনি। প্রথমে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে তোমার ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর তুমি এসে ঢুকলে আমার ঘরে।
বকুলরে চড় মারছস কেন?
ও তোমাকে বলেনি, কেন মেরেছি!
বলছে।
তাহলে আবার জানতে চাইছ কেন?
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার ডান কান মুচড়ে ধরলে। বইনের গায়ে হাত তোলে কোনও ভাই! তাও এত ছোট বইন!
আমি গোঁয়ার গলায় বললাম, ও আমার কথা শোনেনি কেন?
ছোট মানুষ, ভুইলা গেছিল।
আমার কথা ও ভুলবে কেন? তোমরা ওকে বেশি আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছ। বড় ভাই কথা বলে, তাও শোনে না। তোমাদের জন্য সে এমন বেয়াদব হয়ে উঠছে। আরেক দিন আমার কথা না শুনলে, আজ তো শুধু চড় মেরেছি, এরপর লাঠি দিয়ে পিটাব।
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার চুলের মুঠি ধরে দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলে। এমন রাগলে, তোমার ফরসা সুন্দর মুখ লাল হয়ে গেল। বেয়াদব বকুল, না তুই! আমার মুখের উপরে এইভাবে কথা কস। আমি তোরেই লাঠি দিয়া পিটামু। পিটাইয়া হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিমু। ফাজিল কোথাকার।
বুয়া আমার চা নিয়ে মাত্র দরজা দিয়ে ঢুকবে, দেখে এই দৃশ্য। দেখে দরজার সামনেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আমাদের দুই ভাইবোনের কারো গায়ে তুমি কিংবা বাবা হাত তুলেছ এই দৃশ্য ওরা দেখেইনি।
আমি তখন রাগে-অভিমানে পড়ার টেবিলে বসেই মাথা নিচু করে ঝরঝর করে কাঁদছি। তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকালে না। বুয়াকে বললে, চা নিয়া যাও, চা ওরে দিবা না।
খুবই রাগী ভঙ্গিতে তুমি বেরিয়ে গিয়েছিলে, মা।
মনে আছে, এসব কথা তোমার মনে আছে, মা!
আমি যে তারপর অদ্ভুত একটা কাজ করলাম, তা কি তোমার মনে আছে? বলো না মা, আমার সঙ্গে একটু কথা তুমি বলো না। মনে আছে!
আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।
আমার পরনে পায়জামা ছিল আর স্যান্ডো গেঞ্জি। তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর চোখ মুছতে মুছতে আমি একটা হাফহাতা শার্ট গায়ে দিলাম। খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় গেলাম?
গেলাম বাচ্চুদের বাড়ি।
বাচ্চু আমাকে দেখে অবাক। কী রে, তুই এই সময় আমগো বাড়িতে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আইলাম।
স্কুলে যাবি না?
না। আমি তো যামুই না, তুইও যাইতে পারবি না।
কেন?
বাচ্চু আমাকে ওর পড়ার চেয়ারটায় বসাল। ঝগড়া করছস?
এখন কথা বলতে ভালো লাগতাছে না। আইজ সারা দিন আমি তগো বাড়িতে থাকুম।
বাচ্চু আমাকে ম্যানেজ করার জন্য বলল, আইচ্ছা ঠিক আছে।
দিনটা আমি বাচ্চুদের বাড়িতে কাটালাম। বাচ্চুও আমার জন্য স্কুলে গেল না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর কথায় কথায় বাচ্চু আমার কাছ থেকে সব জেনে নিল। তারপর আমাকে বোঝাতে লাগল। এই রকম হইতেই পারে। তুই বকুলরে মারছস, এইটা ভালো হয় নাই। খালাম্মা এই জন্যই তোরে শাসন করছে। এইটা নিয়া মন খারাপ করার কিছু নাই। চল, তোরে বাড়িতে দিয়া আসি।
বাচ্চুটা ওই বয়স থেকেই এত ভালো ছেলে, মা। এত সুন্দর করে সব ম্যানেজ করত। সত্যি সত্যিই বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিকালবেলা ও আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। স্কুল শেষ করে বাবা ফিরেছেন। তিনি তো সকালবেলায়ই জেনেছেন পুরো ঘটনা। হয়তো এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছে।
বিকালবেলা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন বাবা। অকারণে স্কুল কামাই করা খুবই অপছন্দ করেন তিনি। আমি আর বাচ্চু দুজনেই স্কুল কামাই করেছি। বাবা আমাদের কিছুই বললেন না। একবার শুধু চোখ তুলে তাকালেন।
সন্ধ্যার পর আমি পড়তে বসলাম না। বুয়া হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। চিত হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। তুমি এসে ঢুকলে। পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখলে। মায় একটু শাসন করছে, তাতেই এত রাগ!
আমি কথা বলি না। গম্ভীর।
তুমি আমার মাথাটা কোলে টেনে নিলে। বললে, তুই তোর বাবারে খুব ভালোবাসস আমি জানি। বাবা তোর জান, তুইও বাবার জান। কিন্তু তুই জানস না, আমি তোরে কত ভালোবাসি। বাবার জন্য তোর টান দেইখা আমি আমার ভালোবাসার কথাটা কখনও তোরে বলি না। আইজ বললাম।
শুনে আমার মন নরম হতে লাগল। টের পাই, ধীরে ধীরে অভিমান কমছে। তবু তোমাকে কিছু বুঝতে দেই না। তুমি আমার মাথা কোলে নিয়ে আদর করছ, আমি সাড়াই দিচ্ছি না। চুপচাপ তোমার কোলে মাথা দিয়ে আছি।
তখন তুমি সেই গল্পটা বললে, মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প।
নিজের জীবনের চেয়েও ছেলেকে বেশি ভালোবাসেন মা। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেই তাঁর সব কিছু। কী যে মমতায়, কী যে যত্নে ছেলেকে বড় করেছেন! মাটিতে রাখেননি, পিঁপড়ায় কামড় দেবে। মাথায় রাখেননি, উকুনে কামড় দেবে। ছেলেকে রেখেছেন তিনি বুকে, হৃদয়ের কাছে।
এই ছেলে বড় হলো। একটি মেয়েকে পছন্দ করল।
আমি নিঃশব্দে তোমার গল্প শুনছি। অদূরে পড়ার টেবিলে জ্বলছে হারিকেন। চিমনিটা নতুন। তাও আবার জ্বালানোর আগে যত্ন করে মুছেছে পারুল। আলোটা পরিষ্কার। খোলা জানালা দিয়ে আসছে সন্ধ্যারাতের হাওয়া। হাওয়ায় ফুল লতাপাতার স্নিগ্ধ গন্ধ।
গল্প চলছে। মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায় ছেলে। সরাসরি প্রস্তাব দিল। মেয়ে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। ছেলে নাছোড়বান্দা। সে লেগেই রইল।
মেয়ে একসময় বিরক্ত হয়ে গেল। ছেলেটিকে তার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কঠিন একটা শর্ত দিল।
এই প্রথম কথা বললাম আমি। কী শর্ত, মা?
তোমার গল্প বলার ধরনে আর আমার মাথায়-বুকে আদরের হাত বুলাচ্ছ, কোন ফাঁকে আমার মন থেকে মুছে গেছে সকালবেলার ঘটনা, রাগ করে বাচ্চুদের বাড়িতে চলে যাওয়া, মান-অভিমান সব আমি যেন নিজের অজান্তেই ভুলে গেছি। আর তুমি গল্প বলছ একদম বইয়ের ভাষায়। এমনিতে তুমি মোটামুটি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ থাকে ভিতরে ভিতরে। গ্রামে থেকেও অনেকটা শুদ্ধ ভাষা তোমার। সেই তুলনায় খালার ভাষা একদমই বিক্রমপুরের। ঢাকায় থেকেও বিক্রমপুরের ভাষা সে ছাড়তে পারেনি।
বাবার কারণে শুদ্ধ ভাষা বলতে শিখেছি আমরা। তুমিও অনেকটা সেই কারণেই শিখেছ। অন্য বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে বিক্রমপুরের ভাষায় কথা বলো। আমিও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেই ভাষাই বলি। বকুলও বলে।
কিন্তু বাড়িতে না। বাবার নিষেধ।
আবার গল্পে ফিরলে তুমি। বললে, মেয়ে বলল, শর্ত হলো, আমাকে একটা জিনিস উপহার দিতে হবে।
ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই দেব। বলো, কী চাও তুমি?
আমি চাই তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র।
ছেলে থতমত খেল। কী, কী চাও?
তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র। তাঁর হৃদযন্ত্র এনে আমাকে উপহার দিতে হবে। তাহলেই আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হব, তোমাকে বিয়ে করব।
আমার তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, মা। তোমার কোল থেকে মুখ না তুলে তোমার মুখের দিকে তাকালাম, চোখের দিকে তাকালাম। দূর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কী যে সুন্দর লাগছিল তোমার মুখ! যেন তুমি এই পৃথিবীর মানুষ নও, যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবীমা।
তোমার সৌন্দর্য দেখেই দাদু তোমাকে তাঁর ছেলের বউ করে এনেছিলেন। তখন তোমার খুবই কম বয়স। একেবারেই কিশোরী। বাবার চেয়ে তোমার বয়স অনেক কম। দশ-বারো বছর হতে পারে বা তারও বেশি। তার পরও দাদু তোমার মা-বাবাকে রাজি করিয়ে বাড়ির বউ করে এনেছিলেন তোমাকে।
ওইটুকু মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন না তোমার মা-বাবা, যদিও তোমাদের ওই কালে বাল্যবিবাহই হতো। বরের বয়স আঠারো উনিশ, কনে নয় দশ, বড়জোর এগারো। এই বাড়ির বউ হয়ে আসার সময় তোমার বয়স এগারো বারোর বেশি না।
তোমার মুখেই শুনেছি, ঘটকের কাছে খবর পেয়ে দাদু একদিন কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করেই তোমাদের বাড়ি গেছেন, মতলব হলো একেবারেই ঘরোয়া, বাড়ির পরিবেশে তোমাকে দেখবেন। প্রাথমিক দেখা শেষ হলে, পাত্রী পছন্দ হলে, তারপর ঘটা করে বিকালশেষের কনেদেখা আলোয় তোমাকে দেখবেন, বিয়ের কথাবার্তা, দিন তারিখ পাকা করবেন।
সেদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল।
দাদা ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি করা মানুষ তো! খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। গেছেন একা। দুপুরের দিকে। তোমাদের বাড়ির সঙ্গে পদ্মা নদী। গ্রীষ্মকাল। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি নদীতে নেমে শিশু-কিশোররা যেভাবে সাঁতরাসাঁতরি করে, ডুবোডুবি আর হৈচৈ করে, তা-ই করছিলে।
দাদু যখন তোমাদের বাড়িতে ঢুকবেন, ঠিক তখনই নদী থেকে উঠেছ তুমি। রোগা পটকা টিংটিংয়ে এক কিশোরী। কিন্তু অবাক করা সৌন্দর্য তোমার। গায়ের রং পাকা সবরি কলার মতো। নাকি দুধে আলতা রং বলব, মা!
দাদু তোমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তুমি ভেবেছ, গ্রামের কোনও মুরব্বিজন হবে। একবারও তাঁর দিকে না তাকিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দৌড়ে ভিতরবাড়িতে চলে যাচ্ছিলে। দাদু তোমাকে ডাকলেন, শোনো মা।
তুমি দাঁড়ালে। জি, বলেন।
তোমার নাম কী?
আলো।
বাবার নাম?
জয়নাল আবেদীন খান।
কোন ক্লাসে পড়ো?
ক্লাস ফোরে।
আচ্ছা, ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।
আপনি কে?
দাদু হাসিমুখে বললেন, আমাকে তুমি চিনবে না, মা।
বাবার কাছে আসছেন?
হ্যাঁ।
বাবা বাড়িতে নাই।
কোথায় গেছেন?
মুন্সীগঞ্জ।
কেন গেছেন বলতে পারো?
জি পারি। মামলার কাজে। আমাদের একটা জমি নিয়া মামলা চলতাছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
বাবা বাড়িতে আসলে কিছু বলতে হবে?
না না, ঠিক আছে। আমি আরেক দিন আসব।
আপনার নাম বইলা যান। কোন গ্রাম থেইকা আসছেন, বইলা যান।
স্বর্ণগ্রাম। বলবে, স্বর্ণগ্রামের চৌধুরী সাহেব আসছিলেন।
জি আইচ্ছা।
বাড়ি ফিরেই ঘটককে ডাকালেন দাদু। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। এখন কনেপক্ষের সঙ্গে কথা পাকাপাকি করে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলো। মেয়ে আমার খুবই পছন্দ। জাতবংশও ভালো। পদবি হচ্ছে খান।
মাস দুয়েকের মধ্যে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে তুমি। তখন শীতকালের শেষ দিক।
ওই দেখো, কোন কথা বলতে কোন কথায় চলে গেছি। বললাম না মা, তোমাকে বললাম না, আমার সব কিছু এলোমেলো। অতীত বর্তমান সব একাকার হয়ে গেছে। স্মৃতির পাতাগুলো চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে উল্টোপাল্টাভাবে। পাঁচ নম্বর পাতা থেকে ফিরে যাচ্ছি দুই নম্বর পাতায়, পনেরো নম্বর পাতা রেখে চলে যাচ্ছি পঁচিশে।
এখন আবার মনে হচ্ছে, এই যে আমার সামনে মাটিতে রেখেছি তোমার লাশ, কবর খুঁড়ছি আমি, দৃশ্যটা এমন না। তুমি যেন আমার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছ। এখনকার মতোই সন্ধ্যারাত। হারিকেনের আলোয় তোমার অপূর্ব মুখ দেখতে পাচ্ছি আমি। মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প বলতে বলতে একটু যেন উদাস হয়েছ। উদাস হলে তোমার চোখ কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে, গলার স্বর বদলে যায়।
আমি বললাম, তারপর কী হলো, বলো না মা!
ছেলে যাকে বিয়ে করতে চায়, সেই মেয়ে চেয়েছে তার মায়ের হৃদযন্ত্র! ছেলে খুবই চিন্তিত হলো। এই শর্ত কি তুমি বদলাতে পারো?
মানে?
আমার মায়ের হৃদযন্ত্র ছাড়া অন্য যা তুমি চাও, তা-ই তোমাকে আমি দেব। আমাদের যা কিছু আছে, সব দিয়ে দেব। জায়গাজমি, বাড়িঘর, সোনাদানা, স্থাবর অস্থাবর সব তোমাকে দিয়ে দেব।
না, আমি তোমার মায়ের হৃদযন্ত্রই চাই।
ছেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে, আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। মা আমাকে খুবই ভালোবাসেন।
তাহলে নিশ্চয় তোমার কথা শুনবেন। তোমার জন্য সব করবেন।
হয়তো করবেন।
তবে আর দেরি করছ কেন? যাও, তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র নিয়ে এসো। এনে আমাকে দাও। তারপর তোমার প্রস্তাবমতো আমি কাজ করব।
ছেলে মায়ের কাছে গেল। ঘটনা খুলে বলল মাকে।
আমি উৎকণ্ঠিত গলায় বললাম, মা কী বললেন?
বললেন, বাবা, তোমার জীবনের কোনও সাধ আমি অপূর্ণ রাখিনি। তুমি যখন যা চেয়েছ, আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে তা দিয়েছি। যা বলেছ, আমি তা-ই করেছি। তুমি আমার আত্মা, আমার জান। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই। তুমি আমার হৃদয়। আমার হৃদয় আমারই হৃদয় চেয়েছে, আমি কি তাকে তা না দিয়ে পারি!
তারপর?
তুমি এখনই আমাকে হত্যা করো। নিয়ে যাও আমার হৃদযন্ত্র। তুমি যাকে চাও, তাকে উপহার দাও। শর্ত পূরণ করো তার, খুশি করো তাকে। আমি চাই, আমার হৃদযন্ত্রের বিনিময়ে আমার ছেলে পূরণ করুক তার মনোবাঞ্ছা। খুশি হোক সে, সুখী হোক।
আমার দম ততক্ষণে প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কোনও রকমে বললাম, তারপর? তারপর কী হলো, মা?
মাকে হত্যা করল ছেলে।
সত্যি সত্যিই হত্যা করল?
হ্যাঁ। হত্যা করে তাঁর হৃদযন্ত্র নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেই মেয়ের বাড়ির দিকে। এমন উন্মাদের মতো ছুটছিল, পথে পাথর কঙ্কর কত কী ছড়িয়ে আছে, কোনও কিছুই খেয়াল করছিল না। হঠাৎ এক পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ল। বুকের কাছে দুই হাতে ধরা মায়ের রক্তাক্ত হৃদযন্ত্র। ছেলে হোঁচট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্র কথা বলে উঠল, ব্যথা পেয়েছ, বাবা?
উদাস মুখখানি নামিয়ে তুমি আমার দিকে তাকালে। বিক্রমপুরের ভাষায় বললে, এই হইতাছে মা, বুঝছস! মায়ের চেয়ে আপন কেউ নাই পৃথিবীতে, মায়ের চেয়ে বড় কেউ নাই।
তোমার গল্প শুনে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছে, চোখ ফেটে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলাম তোমার কোলে। দুই হাতে তোমার কোমর জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম। মা, মা গো, আমার মা!
আমাদের বাড়িতেই আরেক মাকে রাতের পর রাত বিলাপ করে কাঁদতে দেখেছি আমরা। কখনো কখনো দিনের কাজ করতে করতেও হঠাৎ করে কোথাও বসে সে কাঁদত। বারেকের মা। আমাদের বুয়া। তার সেই কান্না ছিল বারেকের জন্য। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে চলে গিয়েছিল বারেক, আর কোনও খবর নেই। যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল দশ বছরের ছেলেটি!
কোথায় গেল?
বিলের ওই দিকে আমাদের একটা দিঘি আছে।
তুমি তো জানোই মা, চারদিকে ধানি জমি, মাঝখানে বিশাল দিঘি। জমিগুলোও আমাদের। বর্ষা যে বছর কম হয়, বিলে মাঠে পানি কম, দিঘির চারটা পাড়ই জেগে থাকে। পাড়ে ঝোপজঙ্গল আছে, হিজল-বরুণগাছ আছে। তেঁতুলগাছ, গাবগাছ আছে, কদমগাছ আছে।
বিক্রমপুর অঞ্চলে বরুণগাছকে বলে 'বউন্না' গাছ। কী সুন্দর শব্দ বরুণ, সেটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে আঞ্চলিকতার কারণে।
নাকি আঞ্চলিকতার কারণে অন্য রকম সৌন্দর্য পেয়েছে!
মা, কোথা থেকে যেন কদম ফুলের গন্ধ আসছে!
তুমি পাচ্ছ!
গন্ধটা তুমি পাচ্ছ, মা!
আমাদের বাড়িতে কদমগাছ অনেক। দশ-বারোটার কম হবে না। কদম হচ্ছে আষাঢ় মাসের ফুল। শ্রাবণ মাসেও কি কদম থাকে! কদম ফুলের জীবন বেশিদিন স্থায়ী না। শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ফোটে কি না মনে করতে পারছি না।
বোধ হয় ফোটে।
বোধ হয় আমাদের বাড়ির গাছগুলোতে ফুটেছে। নয়তো গন্ধ আসবে কোত্থেকে!
নাকি দিঘির পাড়ের কদমগাছের কথা থেকে কদম ফুলের গন্ধ নাকে এলো! বাস্তবিকই এলো, নাকি ব্যাপারটা মনের! আমার মনের ভিতর থেকে আসেনি তো গন্ধ!
মা, মনে হচ্ছে তোমার শরীর থেকে আমি কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর, জমাটবাঁধা রক্ত, লণ্ডভণ্ড হাড়মাংস, মা, আমি তোমার শরীর থেকেই কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। তোমার হাত পা মুখ মাথা থেকে, আষাঢ় শ্রাবণ মাসের ঘোরতর বৃষ্টিতে ফুটে থাকা কদম ফুলের গন্ধ যেমন হঠাৎ হঠাৎ একটুখানি ভেসে আসে হাওয়ার টানে, ঠিক তেমন করে তোমার শরীর থেকে কদম ফুলের গন্ধ আসছে।
কী যেন বলছিলাম!
ও, আমাদের ওই দিঘির কথা।
ধানিবিলের মাঝখানে দিঘি। বহু বহু কালের পুরনো। দাদার বাবা নাকি কাটিয়েছিলেন জিওল মাছ খাওয়ার আশায়। কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল ভরা দিঘি বর্ষার পানিতে ডুবে গেলে, আশ্বিন কার্তিক মাসে বর্ষার পানি যখন নেমে যায় তখন জংলা পুকুর দিঘিতে কই শিং মাগুর শোল চিতল ফলি খলিসা ভেদা- এসব মাছ কচুরিপানা আর ঝোপজঙ্গলের তলায় আশ্রয় নেয়। টাকি মাছও থাকে। টাকি মাছের ভর্তা, আহা, কী যে মজা করে বানাতে তুমি! সরিষার তেল কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ ধনিয়া পাতা দিয়ে তোমার হাতের টাকি মাছের ভর্তার কোনও তুলনা নেই মা। আমাদের দিঘি থেকে ধরে আনত কদম আর তুমি ভর্তা বানাতে।
মাগো, কত দিন তোমার হাতের সেই ভর্তা খাইনি!
গ্রামের লোকজন প্রায়ই চুরি করে দিঘির মাছ ধরে নিয়ে যেত। এ জন্য পবন জেলেকে বছর চুক্তিতে দিয়ে দেওয়া হতো দিঘি। ধানের জমিগুলো যেভাবে বর্গা দেওয়া, অনেকটা সে রকমই ব্যবস্থা। পবন তার মতো করে পাহারা দিয়ে রাখত দিঘি। বছরে দুবার মাছ ধরবে, অর্ধেক তার, অর্ধেক আমাদের।
ইস্, একেকবার মাছ ধরলে, ভাগের অর্ধেক মাছে উঠান প্রায় ভরে যেত। এত মাছ দিয়ে কী করব?
বাবা তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি মাছ পাঠাতেন। গ্রামের লোকজনকে মাছ বিলাতেন। তার পরও জিওল মাছে মাটির বড় বড় হাঁড়ি ভরা থাকত প্রায় সারা বছর। গোলাঘর, রান্নাঘর দুঘরেই জিওল মাছের হাঁড়ি।
এর বাইরেও আরেকটা ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বাড়ির জন্য হঠাৎ মাছ ধরার দরকার হলে কদম একটা ঝাঁকি জাল আর একটা খাঁচি নিয়ে যেত। দু-তিন দিন চলার মতো মাছ ধরে আনত। পবন কিছু মনে করত না। দিঘির উত্তর পাড়ে ছাপরাঘর করে সে আর নয়তো তার ভাই, ভাইয়ের ছেলে, নিজের ছেলেরা পালা করে দিঘি পাহারা দিত।
ওই দিঘি নিয়ে এত কথা আমি বলছি কেন!
কোনও কোনও শীতকালে বিকাল হয়ে আসার সময় কদমের সঙ্গে দিঘির ওই দিকটায় বেড়াতে যেতাম। কী সুনসান নির্জন চারদিক! শীতের বেলা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ধানিবিল ছবির মতো স্থির। ধান কাটা হয়ে গেছে। নতুন করে চাষের আয়োজন করছে কৃষকরা। দিঘির পাড়ে উঠে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কচুরিপানা আর পানিতে ডোবা ঝোপজঙ্গলের ভিতর থেকে খোলা জায়গায় এসে ঘাই দিয়ে যেত মাছ।
আমার খুব কৌতূহল। কদমকে বলতাম, কী মাছ ঘাই দিল, কদম চাচা?
এইটা শোল।
বুঝলে কী করে?
আমি মাছের ঘাই দেইখা বুঝতে পারি।
তখন হয়তো আরেকটা মাছ ঘাই দিল। এটা কী মাছ?
চিতল।
দীঘির পাড়ের কোনও ঝোপে তখন হয়তো ডাকতে শুরু করেছে ডাহুক পাখি। কোনও কোনও ডাহুক পাখি একটানা সারা রাত ডাকে। ও রকম সারা রাত ডাকার ফলে সকালের দিকে তাদের গলা থেকে বেরোয় একফোঁটা রক্ত।
কদমই বলেছিল এ কথা।
কেন ও রকম রক্ত বেরোয় ডাহুক পাখির গলা থেকে!
কী অর্থ এই রহস্যের!
জানা হয়নি। নাকি রহস্যটা কদম বলেছিল, এখন মনে পড়ছে না। তবে ডাহুক পাখির ডাকে আমার একটা গানের কথা মনে পড়ত।
পদ্মদিঘির ধারে ধারে
ডাহুক ডাকা মাঠের পারে
কানামাছি খেলার কথা যায় কি ভোলা
মনে আজ সেই ভাবনা দেয় দোলা।
কার গাওয়া গান জানি না। রেকর্ডটা আমাদের বাড়িতে ছিল না। আকাশবাণী কলকাতা থেকে রবিবার দুপুরবেলা অনুরোধের আসর নামে গানের একটা অনুষ্ঠান হতো।
এখনো হয় নাকি, মা?
মনে করতে পারছি না।
হয়, নিশ্চয় হয়! এত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান না হয়ে পারে!
আমরা সবাই রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনতাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে, নাকি খাওয়াদাওয়ার আগেই, মা! অনুরোধের আসর আড়াইটার সময় হতো না! আড়াইটা থেকে তিনটা!
তাহলে খাওয়াদাওয়া সেরেই আমরা শুনতাম। ওই গানটা অনুরোধের আসরেই শুনেছিলাম।
আমাদের দিঘিটা পদ্মদিঘি না। পদ্ম ফুলের বালাই ছিল না। ছিল কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল। তবু সেই দিঘির পাড়ে দাঁড়ালে, ডাহুক পাখির ডাকে গানের কথাগুলো মনে আসত। কিশোর বয়সের কথা। এখনও ভুলিনি।
মা, আমাদের বাড়ির ঝোপজঙ্গলে, বাড়ির চারপাশে ধানিবিলে অনেক ডাহুক পাখি থাকে। নির্জন দুপুরে ডাকে, রাতে ডাকে। বর্ষাকালে পানিতে ডোবা ঝোপের আড়ালে বাসা বাঁধে। কালো কালো একঝাঁক ছানা নিয়ে মা ডাহুক চরতে বেরোয়। পানিতে ভাসে, ডাঙায় ওঠে। কিশোর বয়সে কত চেষ্টা করেছি একটা ডাহুকের ছানা ধরতে, কোনও দিন ধরতে পারিনি। এত চালাক ছানাগুলো! এই দেখছি চোখের সামনে চরছে, পা টিপে টিপে গেছি ধরতে, কাছাকাছি গেছি, সঙ্গে সঙ্গে উধাও। মুহূর্তে কোথায় যে লুকায়, কোথায় যে উধাও হয় কে জানে!
ডাঙায় যা পানিতেও তা-ই। হয়তো একদম পরিষ্কার পানিতে মায়ের সঙ্গে চরছে। কদমকে নিয়ে আমি গেছি ধরতে, আমাদের দেখেই ডুব দিল। ডুব দিয়ে কোথায় কোন দিকে যে চলে গেল, হদিস নেই।
মা, আমাদের বাড়ি ভর্তি পাখি ছিল। কাক শালিক চড়ুই- এসব তো সাধারণ পাখি। সব গ্রামে, সব বাড়িতেই থাকে। আমাদের গাছপালাঘেরা বাড়ি বলে বাড়ির নামার দিককার হিজলগাছগুলোতে নানা রকমের বক বাসা বাঁধত বর্ষাকালে। ঘুঘু ডাকত সারা দিন। বুলবুলি ছিল, তালগাছটায় ছিল বাবুই পাখির বাসা। ইষ্টিকুটুম, কাঠঠোকরা, পুকুরধারে মাছরাঙা, পেঁচা আর আমাদের কবুতরগুলো তো ছিলই। ডাহুকগুলো কোথায় গেল! পাখিগুলো সব কোথায় গেল, মা! কোথাও প্রাণের সাড়া নেই কেন?
খানিক আগে, বাবার কবর খোঁড়ার সময় একটু যেন কবুতরের শব্দ শুনেছিলাম! তারপর আর সাড়া নেই।
আসলে কি শুনেছিলাম!
নাকি মনের ভুল!
বিভ্রম!
বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটার মতো বাড়ির পাখিরাও কী সব গুলির অবিরাম শব্দে যে যার মতো উড়ে গেছে দূরের গ্রামে! নিরাপদে নির্জনে থাকতে!
এই গ্রামে এখন আর কোনও পাখিই নেই!
এমন স্তব্ধতা মানুষ সহ্য করে কেমন করে!
না মা, একটা শব্দ আছে মা। তুমি শুনতে পাচ্ছ না! তুমি শুনতে পাচ্ছ না, মা! ঝিঁঝি ডাকছে, শুধুই ঝিঁঝি ডাকছে। আর কোনও শব্দ নেই। এমনকি হাওয়ার চলাচল, গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দও নেই!
নাকি আছে! আমি টের পাচ্ছি না। নাকি পাকিস্তানি... ...গুলোর কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির গাছপালা, মাটি পানি হাওয়া- সবই কি কাঁদছে, মা!
এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে কাঁদছে!
কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে না কেন?
আমার চোখে পানি আসছে না কেন?
চোখ, চোখ। চোখের কথায় চোখ এলো মা। ওই যে খানিক আগে বক পাখির কথা বললাম, তখনই মনের ভিতর নড়েচড়ে উঠেছিল চোখ।
আমাদের গ্রামের ফইজু, কানা ফইজু আর কি, চিনতে পেরেছ মা?
হ্যাঁ, বক শিকারি, ডাহুক শিকারি।
বর্ষা শেষ হয়ে এলে, মাঠে মাঠে কাদাপানিতে ধান কাটা শুরু হবে। এ সময় ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে বকগুলো পুঁটি টেংরা শিকারের আশায় ঘুরে বেড়ায় আর ডাহুক পাখিগুলো ধান খায়। ফইজু ফাঁদ পাতত বক ডাহুক ধরার জন্য। প্রতিদিনই দু-চারটা ধরত। ধরে বাজারে নিয়ে বিক্রি করত।
কাজটা কার কাছে শিখেছিল কে জানে। কিশোর বয়সে প্রথম ফাঁদ পেতে একটা বক ধরেছে। কার্তিক মাস। প্রথম দিনই শিকার ধরতে পেরে বেজায় আনন্দ। বক নিয়ে বাড়ি এসেছে। ফাঁদ থেকে বক বের করে পলো দিয়ে উঠানে আটকে রেখেছে। পলোর মুখ দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সে জন্য পলোর মুখে মাটির একটা সরা বসিয়ে রেখেছে।
ধরা পড়া বক পলোর ভিতর বসে ঝিমাচ্ছে। ফইজু অতি উৎসাহে বাড়ির লোকজনকে ডেকে এনে দেখাচ্ছে। বকটা তখন বেশ কাহিল। শরীরের ধকলে মড়ার মতো লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
ফইজু ভাবল, হায় হায়, বক আমার মইরা গেল নি?
সরা সরিয়ে পলোর মুখ দিয়ে উঁকি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল বক। অল্প পানিতে পা ডুবিয়ে যে রকম তক্কে তক্কে থাকে ছোট মাছ শিকারের আশায়, স্বচ্ছ পানির তলায় কাচের মতো ঝকঝক করে যেসব ছোট মাছ, ফইজুর চোখ দুটোকে বক মনে করল সেই রকম কোনও মাছ।
যার যা স্বভাব!
লম্বা ঠোঁট বাড়িয়ে ফইজুর ডান দিককার চোখ বরাবর ঠিক মাছ ধরার কায়দায় একটা ঠোকর দিল। এক ঠোকরে ফইজুর চোখ তুলে, মাছ গেলার মতো কোঁৎ করে গিলে ফেলল।
এই হলো ফইজুর ঘটনা।
বালক বয়সেই ফইজু গেল কানা ফইজু হয়ে। তবে শিকারটা সে ছাড়ল না। এক চোখ নিয়েই আশ্বিন কার্তিক মাসে বক ডাহুক শিকার করে। লোকে ডাকে কানা ফইজু।
বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটা চোখ খোয়ালি বকের হাতে, তার পরও শিকারটা ছাড়লি না?
ফইজু হে হে করে হেসে বলল, জিদ কইরা ছাড়ি নাই, মাস্টার সাব। জিদ কইরা শিকার করি। যেই বকে আমার চোখ নিছে, আমারে কানা করছে, ওই বকের গুষ্টি আমি সাফা কইরা ফালামু।
মা, ফইজুর কথা ভেবে আমার শরীরের ভিতরে কী রকম যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে। রক্ত গরম হয়ে উঠছে। শরীর যাচ্ছে শক্ত হয়ে। বুকের ভিতর কাজ করছে প্রবল এক শক্তি। আমার মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে ফইজুর চোখ নিয়েছিল যে বক, সেই বকের গুষ্টি শেষ করার জন্য ফইজু যেমন বক শিকার করে, আমিও, মা, আমিও আমার বুক খালি করেছে যারা তাদের শেষ করে দেব। একটা একটা করে শেষ করে দেব। আমার বাবা মা বোন স্ত্রী আর আমার সন্তান যারা শেষ করেছে তাদের আমি ধ্বংস করে দেব। একটা পাকিস্তানি... ...কেও ছাড়ব না। একটা রাজাকারকেও ছাড়ব না। আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি, পাকিস্তানি... ...গুলোর যারা দোসর তাদের একটাকেও ছাড়ব না।
মা, পোষা প্রাণীরা তো বাড়ির লোকের গায়ের গন্ধ টের পায়। গন্ধ চেনে। এই যে এতক্ষণ ধরে আমি বাড়িতে, বল্টুর কুকুরটা বুঝলাম কোথাও পালিয়ে গেছে, অথবা গুলির শব্দে দৌড়ে পালাচ্ছিল কোনও দিকে, ওকেও গুলি করেছে। হয়তো বল্টু মরে পড়ে আছে কোনও ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা বর্ষার পানিতে।
কিন্তু মিনি! মিনি বিড়ালটা!
মিনি কোথায় গেল!
ও কি পালাতে পেরেছিল?
নাকি ওকেও গুলি করে মেরেছে?
নাকি খুবই আদুরে বিড়াল দেখে কোনও রাজাকার বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট করার মতো আমাদের মিনিকেও লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের গোয়ালঘর, রান্নাঘর, গোলাঘর, ঢেঁকিঘরের টিন কাঠ দিয়ে যেমন করে উঠবে রাজাকারদের ঘরবাড়ি, সে রকম কোনও বাড়িতেই কি জায়গা হবে মিনির! নাকি জায়গা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে!
মিনি কি আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে?
ওকে বাটি ভরা দুধ দেবে কে?
কোলে নিয়ে আদর করবে কে?
কী আশ্চর্য, মা! মানুষ রেখে আমি বিড়াল নিয়ে কথা বলছি, দ্যাখো।
না, আমি একদম আমার মধ্যে নেই। আমার সব কিছু এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড। যেমন লণ্ডভণ্ড তোমরা, আমার মা বাবা বোন স্ত্রী আর সন্তান, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের সংসার, সংসারের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জিনিস, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের বাড়ি, ঠিক তেমনই আমার ভিতরটা। মাথা কাজ করছে না, চিন্তাচেতনা খাপছাড়া।
মা, আমার আবার বারেকের কথা মনে পড়ছে, বারেকের মায়ের কথা মনে পড়ছে। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে দৌড়ে গেল বারেক, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বারেকের দেখা নেই।
কোথায় গেল সে?
ফিরছে না কেন?
আমাদের সবার খাওয়াদাওয়া হলে কাজের লোকরা খেতে বসে। আমরা খাওয়াদাওয়া শেষ করেছি। কদম পারুল বারেকের মা আর বারেক খেতে বসবে। কিন্তু বারেক নেই। কদম আর পারুলকে ভাত বেড়ে দিয়েছে বারেকের মা। নিজের ভাত, বারেকের ভাতও বেড়েছে। কিন্তু বারেক কোথায়?
বুয়া নিজের থালায় আর হাত দিতে পারে না। ভাত তুলতে পারে না মুখে।
ইস্, আমার যে কী এলোমেলো হচ্ছে সব! একবার বলছি বারেকের মা, একবার বলছি বুয়া।
এই অবস্থা আমি কেমন করে কাটাব, মা!
বলো না, কেমন করে কাটাব!
ওই দেখো, চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। কপাট ছাড়া দরজা জানালা দিয়ে দিনের আলোর মতো গলগলিয়ে ঢুকছে আমাদের বসার ঘরে। উঠান ভরা জ্যোৎস্না তো আছেই। তোমার আমার শরীরজুড়ে জ্যোৎস্না। আমরা মা ছেলে চাঁদের আলোয় ভাসছি। মা পড়ে আছে উঠানে, ছেলে তাঁর কবর খুঁড়ছে আর চাঁদের আলো তাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাবার কবরের ওপরও দেখো কী সুন্দর চাঁদের আলো!
মা, বুয়াও কি কোনও কোনও রাত ছেলেকে নিয়ে চাঁদের আলোয় ভাসেনি!
কদম খেতে খেতে বলল, কী হইল বারেকের মা, ভাত বাইরা বইয়া রইলা, খাইবা না?
পারুলও তো মেয়ে। মায়ের জাত। ঘটনা সে বুঝল। মুখের ভাত গিলে বলল, বুড়ি বইয়া রইছে পোলার লেইগা।
এই প্রথম কথা বলল বুয়া। হ রে, পোলাডারে এমুন মাইর মারলাম, অহন মনডা খারাপ লাগতাছে। বিয়ানের নাশতা খাইছে। এত বেলা হইল, তারপর থিকা আর কিছু মুখে দেয় নাই, কই যে গেল, তাও বুঝতাছি না। এতক্ষুণে পোলার বিরাট খিদা লাগনের কথা!
কদম বলল, হ, দোফর হইয়া গেছে। খিদা লাগনের কথা।
পারুল বলল, খিদা লাগলে তো ফিরত আহনের কথা।
বুয়া বলল, আইতাছে না জিদ কইরা। বিরাট জিদ্দি পোলা।
কদম হাসল। ডাকাইতের পোলা জিদ্দি হইবই।
বুয়া উঠল। তোমরা খাও।
পারুল বলল, তুমি যাও কই?
পোলাডারে বিচরাইয়া লইয়াহি।
আইচ্ছা যাও।
বুয়া বাড়াভাত রেখে বেরিয়ে গেল। ফিরলো আধাঘণ্টা পর। মুখে হতাশা, অসহায়ত্ব।
কদম পারুল তখন খাওয়া শেষ করে যে যার মতো আয়েশ করছে। গোলাঘরের সামনে বসে কদম তার প্রিয় তামাক টানছে। দুপুর শেষের নির্জনতা কিছুটা ভেঙেছে তার তামাক টানার গুড়ুক গুড়ুক শব্দে। পারুল গিয়ে কাত হয়েছে দালানের পিছন দিককার যে ঘরটায় বুয়া বারেক আর সে থাকে। বুয়ার হতাশ মুখ সে দেখতে পেল না। দেখল কদম। তামাকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটা বলল, কী হইল বারেকের মা? পাইলা না বারেকরে?
না গো, মিয়াভাই।
কও কী?
হ। পুরা বাড়ি বিচরাইলাম (খুঁজলাম)। বারেক কোনওখানে নাই।
জিদ কইরা অন্য কোনও বাড়িতে গিয়া মনে হয় বইসা রইছে।
অন্য কোন বাড়িতে যাইব?
গেরামে বাড়ির আকাল আছে নি? তোমার পোলারে চিনে বেবাকতেই। আছে কোনও বাড়িতে!
বুজলাম কোনও বাড়িতে গেছে, তয় অরে ভাত দিব কে?
কদম কথা বলল না।
আমি শুয়ে আছি আমার ঘরে। পিছন দিককার জানালা দিয়ে রান্নাঘর গোলাঘর ঢেঁকিঘর কদমের দুই চৌকিঅলা ঘর আর ওই দিককার উঠান পুরোপুরি দেখা যায়।
আমার ঘুম আসছে না। ছুটিছাটার দিনে সেই ছেলেবেলা থেকেই দুপুরবেলা সুযোগ পেলে ভালো একটা ঘুম দেই।
সেদিন ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে উদাস চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। বুয়া কদম পারুলদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে টুকরো টাকরা কথাবার্তা সবই কানে আসছিল। বুয়া বারেককে খুঁজে এলো তাও দেখলাম।
কদমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুয়া দেখি একসময় কাঁদছে। কদমকে সে ডাকে মিয়াভাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মিয়াভাই গো, আমার ডর করতাছে।
কিয়ের ডর?
পোলায় তো দৌড়াইয়া গেছিল বাঁশঝাড়তলায়।
হ।
ওইখানে অর কোনও বিপদ হইল না তো?
কিয়ের বিপদ?
ওই যে ওইখানে তেনায় থাকেন। তেনায় আমার পোলার ক্ষতি করে নাই তো!
বুয়াকে একটা ধমক দিল কদম। আরে ধুৎ! যাও, ভাত খাও গিয়া। খিদা লাগলে পোলায় নিজে থিকা দৌড়াইয়া আইসা কূল পাইব না নে!
বুয়া তবু ভাত খেলো না। না গো মিয়াভাই, আমার গলা দিয়া ভাত নামব না। পোলারে ছাইড়া এক ওক্ত (এক বেলা) ভাত আমি খাই নাই। আমি যাই, গেরাম ঘুইরা দেখি পোলা গেল কই। আছে কই।
বুয়া বেরিয়ে গেল। শেষ বিকালের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরল। না, বারেককে কোনও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। গ্রামের কোথাও পাওয়া যায়নি। বারেকের মা স্কুলবাড়িতে খুঁজেছে, বেসনাল, কামাড়খাড়ার এবাড়ি-ওবাড়ি গেছে।
বারেক নেই।
বারেক উধাও।
বুয়া বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। হায় হায়, কই গেল আমার পোলা! ক্যান আমি ওর গায়ে হাত তুললাম? অহন আমি পোলা পামু কই?
মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরেছে কদম। গোয়ালঘরে গরু বেঁধে মুখের সামনে রাখা গামলায় জাবনা দিয়েছে। গরুরা নির্বিকার ভঙ্গিতে সেরে নিচ্ছে রাতের খাবার। বুয়ার বিলাপে তাদের কী যায় আসে!
স্কুল ছুটির দিনে বিকালবেলাটা বাবা এদিক-ওদিক হাঁটতে যান। সন্ধ্যার মুখে মুখে ফিরে আসেন। সেদিন বেরোননি। বুয়ার বিলাপ শুনে আমরা সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, গ্রামের কোনও বাড়িতে নেই, এইটুকু ছেলে তাহলে যাবে কোথায়?
গম্ভীর গলায় কদমকে ডাকলেন। কদম।
জে কর্তা।
কর্তা ডাকটা সবাই ছাড়তে পেরেছিল, কদম পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও বাবা তাকে ছাড়াতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ডাকটা বাবা মেনে নিয়েছেন।
তুই একটা হারিকেন নিয়ে বেরো। গ্রামের লোকজনকে খবর দে। বারেককে খুঁজে বের কর।
জে কর্তা। অহনই যাইতাছি।
পারুল, হারিকেন জ্বেলে দে।
তখনও সন্ধ্যা হয়নি। অনেকগুলো হারিকেন নিয়ে পারুল এ সময় রান্নাঘরের সামনে বসে। হারিকেনের চিমনি অতিযত্নে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মোছে, কেরোসিন ভরে। সন্ধ্যা হলেই ম্যাচের কাঠি দিয়ে হারিকেন জ্বালায়।
সেদিনও ওই কাজে বসেছে। বাবার কথা শুনে দ্রুত হাতে একটা হারিকেন জ্বেলে দিল। তখনও পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়নি। কদম হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মা, তুমি তো অনেকবার ঢাকায় গিয়েছ। পদ্মায় তোমাদের বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর নানা গ্রামে আর বাড়িই করেননি। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় গিয়ে, দীননাথ সেন রোডের একেবারে শেষ মাথায় বিঘাখানেক জমির ওপর একটা বাড়ি করলেন। তোমরা দুভাই, দুবোন। আমাদের মতো না হলেও নানারও ভূসম্পত্তি কম ছিল না। ওসব বিক্রি করে তিনি দুই ছেলেকে দশ কাঠা দশ কাঠা করে জমি কিনে আলাদা আলাদা বাড়ি করে দিলেন ঢাকায়। জলু মামাকে দিলেন মগবাজারে, মাবু মামাকে আজিমপুরে। দীননাথ সেন রোডের বাড়িটা তোমাদের দুই বোনের।
নানা-নানি যত দিন বেঁচেছিলেন তাঁরা ছিলেন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে। বেলা খালাও থাকতেন নানার সঙ্গে। মায়াকে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। কিন্তু অভাব-অনটন তাঁর ছিল না।
ছিল না বলছি কেন! এখনও নেই।
জহুরুল খালু মানিকগঞ্জের লোক। তিনিও পৈতৃকসূত্রে জায়গা-সম্পত্তি পেয়েছিলেন অনেক। যদিও তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসায় খরচা হয়েছে অনেক, তার পরও বেলা খালা নগদ টাকা পেয়েছেন ভালোই, মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় জায়গা-সম্পত্তি এখনো কিছু আছে তাঁর। কিছু মানে কী, ভালোই আছে।
আর যেটা খালার সবচাইতে বড় ভাগ্য, তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদরা তাঁকে খুবই ভালো জানেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে শাশুড়ি মারা গেলেন। শ্বশুর এখনো বেঁচে আছেন। আশির ওপর বয়স হবে। ঢাকা মানিকগঞ্জ মিলিয়েই বেলা খালা থাকতেন। কিছুদিন মানিকগঞ্জে, কিছুদিন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই খালাকে তাঁর শ্বশুর মানিকগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। বাড়িতে ভাড়াটেও আছে। তাদের হাতে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে খালা চলে গেলেন শ্বশুরের কাছে। নিজের মেয়েদের চেয়েও ছেলের বউকে বেশি স্নেহ করেন শ্বশুর। আর খালাও সারাক্ষণ শিশুর মতো আগলে রাখছেন আশি বছর বয়সী শ্বশুরকে।
খালা যখন মানিকগঞ্জে থাকেন, নিজের পড়াশোনার জন্য মায়া থাকত ঢাকায়। তার দেখভাল করার জন্য ওই তিনজন কাজের লোক। রহমতের মা তো আছেই, সঙ্গে আছে রফিক আর রফিকের বউ মাজেদা। রফিক বাজারঘাট আর বাইরের কাজ করে, অর্থাৎ পুরুষ মানুষের যা কাজ তা-ই করে। মাজেদা সংসার সামলায়। মায়া তার মতো পড়াশোনা নিয়ে থাকে। রহমতের মা সারাক্ষণ খালার সঙ্গে। কখনও কখনও খালার সঙ্গে গড়পাড়ায়ও চলে যায়। কোথাও কোনও অসুবিধা নেই।
বেলা খালা আমার শাশুড়ি। কিন্তু তাঁকে কখনও মা বলা হলো না, আম্মা বলা হলো না। শাশুড়িকে তো মানুষ মা অথবা আম্মাই বলে। আমি খালাই বলি। এই ডাকটা আর বদলাতে পারিনি।
জলু মামার পুরো নাম জালাল আবেদিন খান। সংক্ষেপে জলু। তুমি ডাকো জলুদা। মাবু মামা হচ্ছেন মাহবুব আবেদিন খান। তাঁরা কে কোথায় আছেন জানি না। উড়ো উড়ো খবর পেয়েছি, জলু মামা আছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি লালমনিরহাটে। মাবু মামা আছেন বিক্রমপুরেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি কবুতরখোলা গ্রামে। আমাদের এলাকা থেকে বহুদূর। শ্রীনগরের ওদিকে।
জলু মামার অবস্থা আমাদের মতো। মানে মামার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়। নাদিরা আপা। বিএ পাস করার পর বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। এখন হয়তো সেখানে নেই। কুমিল্লার কোনও গ্রামের দিকে চলে গেছেন। গ্রামেও নিশ্চয় বাড়ি আছে। জলু মামার ছেলে বাদল মানসিক প্রতিবন্ধী। এই ছেলে নিয়েই মামা-মামির যত কষ্ট। কষ্ট যেমন, ভালোবাসাও তেমন। দুজনের জান হচ্ছে বাদল।
জলু মামা তোমার বড়।
তোমাদের ভাইবোনের সিরিয়ালটা হচ্ছে এই রকম- প্রথমে জলু মামা, তারপর তুমি, তারপর মাবু মামা, তারপর বেলা খালা।
মাবু মামার ছেলে নেই। তিন মেয়ে। বিনু মিনু দিনু। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দিনুর এখনো হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ে। বিনু মিনু নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে। দিনু আছে মামার সঙ্গে।
কী অবস্থা বলো তো, কারো কোনও খোঁজখবরই নিতে পারছি না আমরা। পাকিস্তানি... ...গুলো আমাদেরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নাদিরা আপা তাঁর যমজ ছেলে দুটোকে নিয়ে কেমন আছেন, জানতে ইচ্ছা করে।
তোমার ঢাকায় যাওয়ার কথা বলছিলাম না, মা!
কেন বলছিলাম জানো!
গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্য।
বাবাকে নিয়ে তুমি গুলিস্তান হলে গিয়ে উত্তম-সুচিত্রার অনেক সিনেমা দেখেছ। আমি সে কথা জানি। আমাকে আর বকুলকে, মায়া এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পর মায়াকে ওইসব সিনেমার গল্প তুমি বলেছ। সুচিত্রা-উত্তমের ছবিতে হেমন্ত আর সন্ধ্যার গান থাকত বেশি। 'হারানো সুর' ছবির সেই বিখ্যাত গানটির রেকর্ড ছিল আমাদের বাড়িতে। হেমন্তের গাওয়া গান,
আজ দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে।
সুচিত্রার গলায় যে গানটা ছিল সেটা হচ্ছে,
তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো।
এই গানটা কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাননি। এটা গেয়েছেন গীতা দত্ত। কী মিষ্টি গান! শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে।
পঁয়ষট্টি সালে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের একটি হাস্যকর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর থেকে ইন্ডিয়ান সিনেমা পূর্ব পাকিস্তানে আর আসে না। এ জন্য কত ভালো ভালো ছবি আমাদের দেখা হয়নি! ঢাকায় যখন জগন্নাথ কলেজে পড়ছি, তেষট্টি চৌষট্টি সালের কথা, তখন সপ্তাহে সপ্তাহে ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখতে যেতাম। বাংলা হিন্দি সব ছবিই দেখতাম। সদরঘাটের রূপমহল, ইসলামপুরের লায়ন, কোর্ট কাছারির সামনে মুকুল। কত সিনেমা হল চারপাশে!
যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, ইন্ডিয়ান সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আসত পশ্চিম পাকিস্তানের নিলু মোহাম্মদ আলী, জেবা ওয়াহিদ মুরাদ, দিবা সুধীর- এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীর সিনেমা। পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমা আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সিনেমাগুলো। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত- এঁরা কী সুন্দর স্নিগ্ধ ছবি বানাতেন! রাজ্জাক কবরী, আজিম সুজাতা, সুচন্দা, সুলতানা জামান- এঁদের ছবি আমার খুব ভালো লাগত। নতুন ছবি এলেই বন্ধুরা দল বেঁধে দেখতে যেতাম।
মা, তুমি কি খেয়াল করেছ, বাড়ির সব কিছুতেই 'ছিল' বলতে হচ্ছে। অর্থাৎ এখন আর নেই। সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে ওরা। সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
যে জন্য ঢাকার কথা বলছিলাম, গুলিস্তান সিনেমা হলের কথা বলছিলাম, সেই কথা শোনো, মা। গুলিস্তানের সঙ্গেই, একই বিল্ডিংয়ে 'নাজ' নামে ছোট্ট আরেকটা সিনেমা হল আছে। ওই হলটায় শুধু ইংরেজি ছবি চলে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ইংরেজি ছবি। অন্য ভাষার ছবি চলে ইংরেজি সাব টাইটেলে। ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকার বাংলা ছবি দেখতে যাওয়ার মতো আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে নাজে সিনেমা দেখতে যেতাম। কী অসাধারণ সব সিনেমা চলত হলটায়!
এখন, এই অবস্থায়ও হয়তো পাকিস্তানিরা নাজ খোলা রেখেছে। সব সিনেমা হলই খোলা রেখেছে। সিনেমা হয়তো চলে। কারা দেখতে যায় না যায় কে জানে। পাকিস্তানিরা ঢাকাকে এমনভাবে রেখেছে, যেন বাইরের পৃথিবীর কেউ বুঝতেই পারে না এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। ওরা ঢাকা শহর ঠিক রেখে ধ্বংস করছে অন্য শহরগুলো, গ্রামের পর গ্রাম, গঞ্জের পর গঞ্জ। ঢাকায় পাকিস্তানিরা এখন যা করছে তা করছে একটু অন্য রকমভাবে। অত্যাচার নির্যাতন হত্যাকাণ্ড সবই চালাচ্ছে কিন্তু বিদেশিদের কিছুই বুঝতে দিচ্ছে না।
একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে, মা। নাজেই দেখেছিলাম। রাশিয়ান ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি।
নামটা যেন কী!
মনে পড়েছে। 'ব্যালাড অব এ সোলজার'। পুরো গল্প মনে পড়ছে না, মা। একটা দৃশ্যের কথা শুধু মনে পড়ছে। এক কিশোর ছেলে যুদ্ধে চলে গেছে। তখনও তার দাড়ি-গোঁফ ওঠেনি। ট্রেনে করে এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে। সৈনিকের পোশাক পরা, কাঁধে রাইফেল। নিজেদের এলাকার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। স্টেশনে ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করবে। ছেলে এই সুযোগটা নিল। কমান্ডারকে অনুরোধ করল, আমি আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। তুমি কি আমাকে ঘণ্টা দুয়েক সময় দেবে? মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি শুধু মাকে একটু দেখেই চলে আসব।
কমান্ডার সময় দিলেন। ছেলে এলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই যে আমি যেমন তোমাদের সঙ্গে এক রাতের জন্য দেখা করতে এসেছি, অনেকটা এই রকম।
যুদ্ধের ডামাডোলে তছনছ হয়ে যাওয়া চারদিক। মা ব্যস্ত ছিলেন কোনও কাজে। ছেলে এসেছে শুনে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন। এসে ছেলেকে দেখে কী রেখে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই তিনি ছেলের গালে হাত দিলেন। তুই শেভ করেছিস!
অর্থাৎ যুদ্ধে যুদ্ধে কিশোর ছেলেটি তাঁর কোন ফাঁকে যে বড় হয়ে গেছে!
জানি না মা, কেন যে এই দৃশ্যটি দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল!
আজ আমি যখন বাড়ি ফিরেছি, মা গো, আমার মনে হয়েছিল, এত দিন পর বাড়ি ফিরেছি আমি, আমার আসার খবর পেয়ে সেই রাশিয়ান মায়ের মতোই ছুটে আসবে তুমি।
আমার মাথা দুহাতে জড়িয়ে ধরবে তোমার বুকে। আমার গালে মাথায় বুকে পিঠে হাত বোলাবে আর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলবে, আহা রে, আমার ছেলেটা কত রোগা হয়ে গেছে। ও বাবা রবি, তোরা ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করস না? ঘুমাস না ঠিকমতন। চোখ এত লাল কেন, বাবা?
মা গো, কী ভেবে এলাম, কোন স্বপ্ন নিয়ে এলাম আর এসে এ কী দেখছি! তোমরা কেউ নেই, মা। তোমরা কেউ নেই।
আশ্চর্য ব্যাপার, তার পরও আমার কান্না পাচ্ছে না। চোখে পানি আসছে না।
কেন বলো তো!
আমি কি সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গেলাম! সিনেমার দৃশ্য দেখে যে ছেলে কাঁদে, তাও কোনও মৃত্যুর দৃশ্য না, অতি সামান্য এক আবেগের দৃশ্য, সেই ছেলেই তার বাবা মা বোন স্ত্রী এবং স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানের এ রকম ভয়াবহ মৃত্যু দেখে কাঁদতে পারছে না কেন!
কোন কথা থেকে যে কোন কথা এসে যাচ্ছে, মা।
কথায় কথায় বারেকের মায়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই যে হারিকেন হাতে বাবার কথামতো সন্ধ্যার আগে আগেই বারেককে খুঁজতে বেরিয়ে গেল কদম, বাড়িতে আমরা অপেক্ষা করছি, অনেকটা রাত হয়ে গেল কদমের খবর নেই, বারেকের খবর তো নেই-ই।
বারেকের মা পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।
আমাদের ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছে। এই এদিক যাচ্ছে বারেকের মা, এই ওদিক যাচ্ছে। একবার সামনের উঠানে যায়, একবার পিছনের উঠানে আসে। অকারণেই রান্নাঘরে ঢোকে, গোলাঘর ঢেঁকিঘরে ঢোকে। বিড়বিড় করে, শব্দ করে কথা বলে। কদম মিয়াভাই অহন তরি আহে না ক্যান? আমার বারেকরে নিয়া আহে না ক্যান মিয়াভাইয়ে?
আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে বারেকের মায়ের অস্থিরতা দেখি।
বকুল তোমার কোলে। আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। বুয়াকে বলত 'বুলা'। তোমার কোল থেকে বলছিল, বুলা কী, মা! বুলা কী!
অর্থাৎ বুয়ার কী হয়েছে?
তুমি নানা রকম কথায় তাকে ভুলাচ্ছিলে। আর বারেকের মাকে ভুলাচ্ছিল পারুল। তুমি অস্থির হয়ো না, বুড়ি। এত অস্থির হয়ো না। কদম মামায় ঠিকই বারেকরে খুঁইজা আনব। এইটুকু পোলা আর কই যাইব? এই দেখবা বাড়িতে আইসা পড়ল।
বুয়া বুক চাপড়ায়। কাঁদে না, বিলাপ করে। আল্লায় য্যান তা-ই করে। মিয়াভাইয়ে য্যান আমার পোলারে লইয়াই ফিরত আহে। দোয়া কর, তুই আমার পোলার লেইগা দোয়া কর।
তারপর তোমার দিকে তাকাল সে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আম্মা, আম্মা গো, আপনে রোজ বিয়ানে কোরআন শরিফ পড়েন। আমার বারেকের লেইগা দোয়া করেন। মিয়াভাইয়ে য্যান বারেকরে লইয়াই বাড়িতে আহে। আপনের দোয়া কামে লাগব। আল্লায় আপনের কথা শুনব।
তুমি তাকে সান্ত্বনা দিলে। আমি দোয়া করতেছি। আল্লায় তোমার পোলা ফিরত আনব। তুমি সুস্থির হও।
বাবা গম্ভীর হয়ে পায়চারি করছিলেন সামনের দিককার উঠানে।
কদম ফিরল রাত প্রায় দশটার দিকে। ততক্ষণে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। রোজ এই কাজটা বুয়া আর পারুল মিলে করে। সেদিন এদিকে মন থাকার কথা না বুয়ার। আমাদের খাওয়াদাওয়ার কাজ পারুল একাই সামলাল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার অনেক পরে ফিরল কদম।
কিন্তু একা।
বারেক নেই।
বারেককে পাওয়া যায়নি।
সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, আশপাশের গ্রামে খোঁজা হয়েছে, সঙ্গে গ্রামের লোকজনও ছিল। সবার এক কথা, বারেককে আজ সকাল থেকে তারা কোথাও দেখেইনি।
আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
বারেকের মায়ের মাথায় যেন আমাদের পুরো দালান বাড়িটা ভেঙে পড়ল।
প্রথমে মুহূর্তের জন্য সে একটু স্থির হলো, তারপর দুহাতে বুক চাপড়ে চিৎকার করে বিলাপ আর কান্না। হায় হায়, এইডা কী হইল? আমি ক্যান মারলাম আমার পোলারে? ক্যান অর গায়ে হাত তুললাম? কই চইলা গেল আমার পোলা? হায় হায়, এইডা কোন সব্বনাশ হইল আমার? আল্লাহ, আল্লাহ গো, এইডা তুমি কী করলা! কই লইয়া গেলা আমার পোলারে? হায় হায়, আমি অহন কী লইয়া বাঁচুম, আমি অহন কারে লইয়া বাঁচুম? আমার বুকের সামনে রাইত্রে কে ঘুমাইয়া থাকব? কে আমারে মা ডাকব? কে আমারে প্যাঁচাইয়া ধরব? আল্লাহ আল্লাহ, এইডা কী হইল! যার লেইগা আমি সংসার ছাড়লাম, সেও চইলা গেল আমারে ছাইড়া!
বারেকের মায়ের আহাজারি দেখে পারুলও চোখ মুছতে লাগল। কদম গোলাঘরের সামনে হারিকেন নামিয়ে রেখে পাথর হয়ে বসে রইল।
বারেকের মাকে কে কী সান্ত্বনা দেবে?
তুমি বললে, এমন কইরা কাইন্দো না বারেকের মা। তোমার ছেলে বাঁইচা আছে। রাগ কইরা লুকাইয়া আছে কোনোখানে। ফিরত আসব।
বারেকের মা আগের মতোই বুক চাপড়ায়। না গো আম্মা গো, আমার পোলা ফিরত আইব না। অর কী হইছে আমি বুইঝা গেছি। আমার পোলা বাঁইচা নাই।
বাবা বললেন, কী আবোলতাবোল কথা বলছ। বেঁচে থাকবে না কেন? আছে, বেঁচে আছে। কোথায় আছে এখন সেটাই দেখতে হবে। আজ রাতে না হয় পাওয়া যায়নি, কাল থেকে সব দিকে লোক পাঠাব, ঠিকই বারেককে খুঁজে পাওয়া যাবে।
বারেকের মায়ের ওই এক কথা। না গো খালু গো, অরে আপনেরা পাইবেন না। ও নাই। অরে কে খাইছে আমি বুইঝা গেছি। ওই যে বাঁশঝাড়তলায় গেল, ওই বাঁশঝাড়ের তেনায় অরে খাইছেন। আমার পোলারে মাইরা পুশকুনির (পুকুরের) তলায় কেদার (কাদা) মইধ্যে গুঁইজা রাখছে। অরে আমি আর কোনও দিন পামু না। হায় হায় রে, হায় রে, এইডা আমি কী করলাম! ক্যান গায়ে হাত তুললাম পোলার! ক্যান নিজের এই সব্বনাশ করলাম!
সারা রাত থেকে থেকে এ রকম আহাজারি করল বারেকের মা। একটু থামে, আবার শুরু করে। আমরা সেই রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেই পারলাম না।
আমিও বারেকের কাছাকাছি বয়সের। বারেকের মায়ের ওই বাঁশঝাড়তলার তেনার কথা শুনে খুবই ভয় করছিল। তার মানে জিনিসটা সত্যি সত্যি দিনের বেলায়ও বেরোয়। বারেক হয়তো তেনার সামনে পড়েছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওইটুকু ছেলেকে ধরে সে আমাদের ওই দিককার কাদাভর্তি পুকুরে, কাদার তলায় গুঁজে দিয়েছে। কোনও দিন বারেকের লাশও ভেসে উঠবে না।
পরদিন আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। চারপাশের গ্রামে লোকজন পাঠালেন বাবা। বারেকের মা নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মাঠে-ঘাটে যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, বারেকরে দেখছেন? আমার বারেকরে? দশ বছইরা পোলা। দেখতে কালাকোলা। তয় চেহারায় মায়া আছে। আমার পোলার হাসি খুব সোন্দর। চক্ষু দুইখান খুব সোন্দর। দেখছেন? ওই রকম একটা পোলারে দেখছেন আপনেরা?
না, বারেককে কাল থেকে কেউ দেখেনি।
কেউ কোনও খোঁজ দিতে পারল না। চারদিকে পাঠানো লোকজন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। বারেকের মায়ের আহাজারি আরো বাড়ল, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই যে বারেককে গুম করেছে- এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল।
আহা, তার পর থেকে আমাদের বুয়া রাতের পর রাত ঘুমাত না। ঘরে বসে কাঁদলে পারুলের ঘুমের অসুবিধা হবে দেখে নিঃশব্দে দরজা খুলে উঠানে বেরিয়ে আসত। ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় গিয়ে যতটা নিচু গলায় সম্ভব কাঁদত আর বারেককে ডাকত। বারেক রে, ও বারেক, ও আমার বাজান। আমি নাইলে তরে একটু মারছিলাম, এর লেইগা মার লগে রাগ করতে হয়, বাজান? মারে ছাইড়া চইলা যাইতে হয়? ও বাজান, বাজান, আমার কথা তর মনে হয় না? আমার লেইগা তর মায়া লাগে না, কান্দন আহে না? আমারে ছাইড়া তুই ঘুমাস কেমনে? খাস কেমনে? খাইতে বইলে আমার কথা তর মনে হয় না? ও বাজান, বাজান!
নিশিরাতে বারেকের মায়ের সেই কান্না শোনে অন্ধকার কিংবা জ্যোৎস্না রাত। গাছের পাতারা আর হাওয়া, ঝিঁঝিপোকা আর রাতপাখিরা। আমাদের বাড়ির মাটি আর মাটির মতো নিরীহ গরুগুলো। খোঁয়াড় থেকে শোনে ঘুমভাঙা কবুতররা, মোরগ মুরগিরা। মিনি বিড়ালটার মা বাবা ছিল, সেই জীব দুটো শুনত। ইঁদুর ব্যাঙেরা শুনত। কোনও কোনও রাতে ঘুম ভেঙে শুনি আমি। আমারও তখন বারেকের জন্য খুব কান্না পেত।
আরেকটা কাণ্ড করত বুয়া। নির্জন দুপুরে আর কোনও কোনও গভীর রাতে একা একা চলে যেত বাঁশঝাড়তলায়। সেখানকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তেনার অশরীরী হাতে-পায়ে ধরত।
বাবা, আমার বাবা। আমার পোলাডারে ফিরত দেন। পোলার জানের বদলে আমার জান আপনে নেন। এই তো আমি আপনের সামনে। আমারে আপনে মাইরা ফালান। তাও আমার পোলাডারে ফিরত দেন।
সেটা হয়তো ফাগুন মাসের কোনও দুপুর কিংবা রাত। বারেকের মায়ের কাকুতি-মিনতি শুনত আমাদের বাঁশবনের বাঁশঝাড়গুলো। বাঁশের পাতায় পাতায় তখন শনশন করত মধ্যদুপুর কিংবা রাতের হাওয়া। হাওয়ার টানে কোথায় কোন সুদূরে ভেসে যেত বারেকের মায়ের আকুতি।
বাঁশঝাড়তলা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনত কদম আর নয়তো পারুল। বারেকের জন্য আমাদের বাড়িতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল।
তবু দিন বসে থাকে না, দিন চলে যায়। বুয়া ছেলের জন্য নিশিরাতে, দিনদুপুরে কেঁদেই চলে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় কান্নাও কমে আসে তার। ওই যে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত লিখেছেন না, 'পৃথিবীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।'
বছরখানেক ধরে বারেকের জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির চলল। মালখানগরের মোসলেম ফকির, ইছাপুরার পবন ঠাকুর, আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব তো ছিলেনই। মোসলেম ফকির নানা রকম তাবিজ আর পানিপড়া দিয়েছিল বুয়াকে। পবন ঠাকুর ছিল গণক। গণনা করে বলেছিল, না, তোমার পোলা নাই। পোলার আশা ছাইড়া দেও। আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব, হাফেজ শেখ মোহাম্মদ নুরুদ্দিন, বারেকের মা তাঁর কাছে গেলেই দোয়া-দরুদ পড়তেন বারেকের উদ্দেশে।
বড় ভালো মানুষ ছিলেন ইমাম সাহেব। কত সান্ত্বনা যে বারেকের মাকে দিতেন! কত রকমভাবে যে বোঝাতেন, বাঁশঝাড়ের ওই সব ভূতপ্রেত কিছু না। ভূত বলতে আসলে কিছু নেই। তোমার ছেলের জীবনে অন্য ঘটনা ঘটেছে।
বুয়া আকুল হয়ে বলত, কী ঘটনা, হুজুর?
সেটা আল্লাহপাক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
এ ঘটনার এগারো বছর পর একদিন দুপুরবেলা একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলায় হালকা আকাশি রঙের লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। খালি পা ধুলায় ধূসর। মুখে ঘন কালো চাপদাড়ি। চৈত্র মাসের দুপুরবেলা। রোদে ঘামে, বহুদূর পথ হেঁটে আসার ফলে ক্লান্ত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। লম্বা পাঞ্জাবিটা পুরনো, বোধ হয় ধোয়াও হয়নি বেশ কিছুদিন। বারবাড়ির ওদিক থেকে সোজা হেঁটে এসে ঢুকল আমাদের পিছন দিককার উঠানে। একেবারেই মুসাফির টাইপের লোক। কাঁধে রেকসিনের সস্তা খয়েরি রঙের ব্যাগ।
কে, লোকটা কে?
সেই লোকের কথা পরে বলি, মা। তার আগে শোনো এক মায়ের কথা। এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের কথা।
সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ইব্রাহিম। বাবা নেই। মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের গজারিয়ায়, ওই তো মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তরে, উত্তর-পূর্ব দিকে, শীতলক্ষ্যা পার হলেই গজারিয়া।
তার আগে তোমাকে গজারিয়ার গণহত্যার কথা বলি। মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সবচাইতে বড় গণহত্যা হয়েছে গজারিয়া থানায়। মে মাসের ঘটনা। ৯ মে ভোরবেলা পাকিস্তানি... ...গুলো অতর্কিতে আক্রমণ চালাল গজারিয়া থানার কয়েকটি গ্রামে। গোসাইরচর নয়ানগর বালুচর বাঁশগাঁও আর গজারিয়া গ্রামে। এক সকালে হত্যা করল ৩৬০ জন নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিকে।
নিরীহ নিরপরাধ কেন বলছি! বাঙালি চিরকালই নিরীহ নিরপরাধ এবং শান্তিপ্রিয় জাতি। কিন্তু অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা জাতি। ওই গানের মতো,
মা গো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্রহাতে ধরতে জানি
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
'৫২ সালে ভাষার জন্য আমরা প্রতিবাদ করেছি না! আমরা জীবন দিয়েছি না ভাষার জন্য! বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি না বাংলা ভাষা!
গজারিয়ায় গণহত্যা ঘটানোর পিছনে এলাকার কিছু মুসলিম লীগ নেতার তৎপরতা ছিল। তারাই পিছন থেকে নাড়িয়েছিল কলকাঠি।
মে মাসের ৪ তারিখে গজারিয়া হাই স্কুলে এলাকার তিরিশ-চল্লিশজন ছাত্র যুবক মিটিং করে। আলোচনার বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। কী করে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যায়, কী করে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় পাকিস্তানি... ...গুলোর ওপর! কী করে মুক্ত করা যায় দেশ!
প্রাথমিক আলোচনা হলো সেদিন। দ্বিতীয় আলোচনা সভা হলো মে মাসের ৮ তারিখ সন্ধ্যাবেলা, গজারিয়া বাজারের অগ্নিবীণা সমিতির অফিসে। খবর পেয়ে গেল মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতারা। তারা আবার শান্তি কমিটিরও মেম্বার। ওরা করল কী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার প্রভুদের গোপনে জানিয়ে দিল।
কী জানাল?
জানাল একেবারেই মিথ্যা খবর। গজারিয়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফুলদি নদী। পাকিস্তানি... ...গুলোকে ওরা জানাল ফুলদি নদীর গা ঘেঁষা গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনীর বিশাল আস্তানা গড়ে উঠেছে। হুজুর, মাই বাপ, আপনারা আসেন। মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে পাকিস্তান রক্ষা করেন। আমাদের প্রিয় পাকিস্তান বাঁচান।
আর কথা কী!
পরদিন ভোরবেলাই চলে এলো পাকিস্তানি... ...গুলো। এক সকালে শহীদ হলো ৩৬০ জন বাঙালি।
বিক্রমপুরের আরো তিনটি গণহত্যার কথা বলি, মা। কেওয়ার গ্রামটির নাম শুনেছ না! হ্যাঁ, শোনার কথা! মুন্সীগঞ্জ থানায় পড়েছে গ্রামটি। স্বর্ণগ্রামের মতো কেওয়ারেও আছে এক চৌধুরীবাড়ি। মে মাসের ১৪ তারিখে কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি ঘেরাও করল পাকিস্তানি... ...গুলো। পুরুষ-মহিলা মিলে ২৪ জনকে আটক করল। এই ২৪ জনের মধ্যে ১৭ জনকে হত্যা করল।
এপ্রিল মাসে সিরাজদিখান থানার রশুনিয়া সিংবাড়িতে গণহত্যা চালাল ওরা।
পঁচিশে মার্চের পরদিন থেকেই যে যেভাবে পারে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিল মানুষ। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বিক্রমপুরের দিকে আসছিল বহু মানুষ। রশুনিয়া সিংবাড়িতে এইসব মানুষের থাকা-খাওয়ার জন্য আশ্রয়শিবির খোলা হয়েছিল।
এই বাড়ি আক্রমণ করল পাকিস্তানি... ...গুলো। ৯ জন মানুষ মেরে ফেলল। রশুনিয়া হাই স্কুলের টিচার কান্ত বাবুকে হত্যা করল, বাড়ির মালিক রামসিংহকে হত্যা করল।
আমাদের টঙ্গিবাড়ী থানার কথা শুনবে?
আবদুল্লাহপুর পালবাড়ি খুব নামকরা। এই বাড়িতে ঢাকা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল কয়েকটি হিন্দু পরিবার। এপ্রিল না মে মাস, ঠিক মনে করতে পারছি না, এই বাড়ি আক্রমণ করল ওরা। ১১ জনকে হত্যা করল, পালবাড়ি জ্বালিয়ে ছাই করে দিল।
দ্যাখো মা, এক ঘটনা থেকে কেমন করে চলে যাচ্ছি আরেক ঘটনায়। বললাম না, আমার কোনও কিছুর ঠিক নেই। মাথা এলোমেলো। তোমার কবর খুঁড়ছি, ক্লান্তও লাগছে না!
নাকি লাগছে টের পাচ্ছি না! তোমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি তো বলেই যাচ্ছি। এত কথা বলছি বলেই কি ক্লান্তি টের পাচ্ছি না!
ইব্রাহিমের কথা শোনো মা, ইব্রাহিমের মায়ের কথা শোনো।
গজারিয়ার যুদ্ধে শহীদ হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম। মাথায় গুলি লেগেছিল। মরদেহ নিয়ে ইব্রাহিমদের বাড়িতে গেলেন সহযোদ্ধারা। ইব্রাহিমের মা তখন ঘরে। সেই বীরের মরদেহ উঠানে রেখে সহযোদ্ধারা ঢুকলেন ঘরে। কিন্তু একমাত্র সন্তানের শহীদ হওয়ার কথা কেমন করে বলবেন মাকে! কী করে দেবেন এ রকম সংবাদ!
ঘরে ঢোকার আগে ইব্রাহিমের মাকে চাচি চাচি বলে ডাকছিলেন সহযোদ্ধারা। তিনি ঘর থেকে বেরোনোর আগেই ঘরে ঢুকে গেছেন সহযোদ্ধারা।
ইব্রাহিমের মা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কী রে, কী হইছে?
মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক রফিক আছেন দলে। তিনি অন্য রকমভাবে কথা শুরু করলেন। আছেন কেমুন, চাচি?
ভালো আছি, বাজান।
আমরা যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতাছি সেই কথা তো আপনে জানেনই।
জানুম না ক্যান। আমার ইব্রাহিমও তো আছে তগো লগে। আমার পোলায়ও তো মুক্তিযোদ্ধা।
কিন্তু চাচি, এই যে আমরা যুদ্ধ করতাছি, যুদ্ধে কোন দিন না জানি কে মইরা যাই।
হ বাজান, কথা ঠিক।
আপনের ইব্রাহিমও মরতে পারে!
তা তো পারেই।
তারপর সেই মহীয়সী নারী, সেই মা সরল গলায় বললেন, আমার ইব্রাহিম মরলে কী হইছে? তোরা আছছ না!
যে মায়ের একমাত্র সন্তানের লাশ রাখা উঠানে আর ঘরে বসে যে মা বলছেন একথা, কে সইতে পারে কথাটা। সহযোদ্ধারা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলেন।
আমার শুধু এ রকম মায়েদের কথা বলতে ইচ্ছা করছে, মা।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলি। জানুয়ারির ১৯ তারিখে ছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ করল পুলিশ। অসুরের ভঙ্গিতে লাঠিপেটা করল ছাত্রীদের। পরদিন, ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন আসাদুজ্জামান, শহীদ আসাদ নামে যিনি পরিচিত।
শহীদ আসাদদের বাড়ি শিবপুরে।
শিবপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে আসাদের মা সংগ্রামী ছাত্রনেতাদের কাছে বাণী পাঠালেন। "আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, 'মা, আগামী দশ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।' আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমরা সার্থক করো।"
এই তো আমাদের বাংলার মা।
মুক্তিযোদ্ধা কারা, মা? শুধু অস্ত্রহাতে তোমার এই ছেলের মতো যারা যুদ্ধ করছে তারা? না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নারী-পুরুষের জীবন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, মা। সবাই মুক্তিযোদ্ধা।
সামরিক গেরিলা যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এই যুদ্ধে সাফল্য সম্ভব না। সাধারণ মানুষ যেমন হয়েছেন ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা, ঠিক তেমনি দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমভাবে, সব কাজে সাহায্য করছেন সাধারণ মানুষ।
তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা না?
অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা।
বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশে এখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। তার অর্ধেক নারী। সুতরাং দেশের তিন কোটি ৭৪ লাখ নারীই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শত্রুর খবর আদান-প্রদান করেন। রাডার যেমন ভিতর ও বাইরের শত্রুদের খবর দেয়, এখন আমাদের নারীরা, মা বোনরা স্ত্রীরা ঠিক সেই ভূমিকা পালন করছেন।
মা, রাজাকার আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির... ...গুলো ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। নারী পুরুষ শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবাই।
আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছেন। তিনি দেশ নিয়ে ভেবেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া, মুক্তিকামী মানুষ ছাড়া কে চায় স্বাধীনতা।
আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তুমি আমার মা, তুমি আরেক মুক্তিযোদ্ধা। বুকের রত্ন ঠেলে দিয়েছ যুদ্ধে। যাও, যুদ্ধ করো। খতম করো শত্রু। স্বাধীন করো আমার দেশ।
আমার বোন মুক্তিযোদ্ধা, আমার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা। আমার অনাগত সন্তান, যার চারপাশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের আলো না দেখেও সে মুক্তিযোদ্ধা। মাতৃগর্ভে থাকা মুক্তিযোদ্ধা।
মা, তুমি কি তোমার রবিকে কখনও এ রকম পরিশ্রম করতে দেখেছ?
কখনও ভেবেছ এ রকম পরিশ্রম করতে পারে তোমার একমাত্র ছেলে! চৌধুরীবাড়ির ছেলে, বলতে গেলে এলাকার জমিদার, সেই বাড়ির একমাত্র ছেলে এ রকম পরিশ্রম করছে, ভাবতে পারো?
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিশ্রমের শেষ নেই, মা। তাঁদের পরিশ্রম দুরকম। শারীরিক এবং মানসিক। মাথা খাটিয়ে প্ল্যান করা, শরীর খাটিয়ে শত্রু শেষ করা। তার ওপর ঠিকমতো খাবার পাওয়া যায় না, ঘুম নেই চোখে।
খাবার প্রসঙ্গে আমার কমান্ডার খালেদ মোশাররফের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। একদিন আমরা শুনলাম, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিটিং করছেন। দুপুরের খাওয়ার সময় বিমানবাহিনীর অফিসারদেরও ডাকা হলো কনফারেন্স রুমে। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বসেছিলেন ঘরে ঢুকতেই টেবিলের একপ্রান্তে। সবার সামনে উপুড় করা খাবার প্লেট। সাবেগ সিংয়ের বাঁয়ে বসা খালেদ মোশাররফ, ডানে জিয়াউর রহমান।
সাবেগ সিং খালেদ মোশাররফের দিকে তাকালেন। আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, খালেদ, তোমার এত রেশন লাগে কেন?
খালেদ মোশাররফ জবাব দিলেন, স্যার, আমি ঢাকার সবচে' কাছে, কুমিল্লা নোয়াখালীর লাগোয়া। আমার ক্যাম্পে সকালে যদি থাকে ৫০০ ছেলে, দুপুরে থাকে ১৫০০, রাতে থাকে ৩০০০। কোনও কিছুই ঠিক নেই।
সাবেগ সিং বললেন, আমি দুঃখিত, খালেদ। আমাকে তোমার রেশনের হিসাব নিতে হবে।
খালেদ মোশাররফ বুঝলেন সাবেগ সিং তাঁর সততার প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
খালেদ মোশাররফ ডান হাতে ধাক্কা দিয়ে খাবার প্লেটটি সামনে ঠেলে দিলেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার ইংরেজিতে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, 'ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং, আপনি নিশ্চয় চান না যে আমি আমার রাইফেলের ব্যারেল দুই দিকে ঘুরাই।'
বলে সাবেগ সিংয়ের পিছনের দরজা দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জিয়াউর রহমানও বেরোলেন। খালেদ মোশাররফের হাত ধরে বাংলায় বললেন, 'খালেদ, এটা রাগারাগি করার সময় না, জায়গাও না। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ফেরত আসো।'
ততক্ষণে সাবেগ সিং তাঁর ভুল বুঝেছেন। তিনিও বেরিয়ে এলেন। প্রথমে আমার কমান্ডারের কাছে ক্ষমা চাইলেন। আই অ্যাম স্যরি, খালেদ।
তারপর তাঁর হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন।
কী যেন বলছিলাম! ও, আমার পরিশ্রম করার কথা। আমি পরিশ্রমী হয়ে গেছি, মা। কঠিন পরিশ্রম এখন তোমার ছেলে করতে পারে। পঁচিশে মার্চের পর থেকে পরিশ্রম আর উৎকণ্ঠার মধ্যেই তো আছি। যুদ্ধের মধ্যে আছি। জীবনের মায়া নেই। জীবনের চেয়ে অনেক মূল্যবান এখন দেশ। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও শক্ত হয়ে গেছে, কঠোর কঠিন হয়ে গেছে। আবেগ কমে গেছে।
যোদ্ধাদের আবেগ থাকতে নেই।
এই যে এইভাবে আমি এলাম, সারা দিনে জেলে নৌকায় ওই একথালা ভাত, তারপর এতটা পথ এইভাবে আসা, তারপর বাড়ির এই অবস্থা, পুরো পরিবার শহীদ হয়েছে, বাবাকে কবর দিয়ে মায়ের কবর খুঁড়ছি, তারপর বোন স্ত্রীর কবর খুঁড়ব, আমার ক্লান্ত লাগছে না, মা। কবর খোঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি তোমার দিকে তাকাচ্ছি। কথার পর কথা বলে যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
এখন কী মনে পড়ছে জানো!
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়টার কথা মনে পড়ছে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিট পড়েছে মুন্সীগঞ্জে। আমাদের স্বর্ণগ্রাম হাই স্কুল আর লৌহজং থানার কাজীর পাগলা হাই স্কুলের সিট পড়েছিল মুন্সীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
মুন্সীগঞ্জ মহকুমা শহর।
স্বর্ণগ্রাম থেকে আট দশ মাইল দূরের পথ। বর্ষাকালে যাতায়াতের ব্যবস্থা নৌকা আর গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা। আট দশ মাইল পথ হেঁটে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার এতটা পথ হেঁটে আসা সম্ভব না।
পরীক্ষার সময় বিক্রমপুর অঞ্চলের সব ছাত্রছাত্রী মুন্সীগঞ্জ শহরে এসে কোনও না কোনও বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। থাকা-খাওয়া বাবদ টাকা-পয়সাও দিতে হয়। তবে শহরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের জন্য টাকা-পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। যাদের কেউ নেই, তাদের জন্য এক ধরনের মধ্যবিত্ত পরিবার টাকা-পয়সার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
আমার জন্য তেমন কিছু করতে হয়নি।
বাবার বন্ধু মুন্সীগঞ্জের বিখ্যাত কাদের ডাক্তার। ডাক্তার এম এ কাদের। হরগঙ্গা কলেজের উত্তর দিকটায় ডাক্তার কাকার বাড়ি। আমি সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম।
ডাক্তার কাকার পরিবারের সবার কথা আমার এখন মনে পড়ছে না, মা। শুধু দুজন মানুষের কথা মনে পড়ছে। একজন প্রায় আমার বয়সী। ডাক্তার কাকার ছেলে বাবুল আখতার। অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়ে।
তোমার কানে বাজছে না, মা! রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, খবর পড়ছি বাবুল আখতার।
হ্যাঁ, সেই বাবুল আখতার। এখন সে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। সেখান থেকে খবর পড়ে, কথিকা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করে।
ডাক্তার কাকার আরেক ছেলের কথা মনে পড়ছে। সে সবার ছোট কি না মনে পড়ছে না। ছেলেটির তিনটা নাম। এক নাম আজাদ, আরেক নাম জিল্লু। ভালো নাম মুনির কাদের।
কেন যেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা তুললাম!
মনে পড়েছে। বাবার সঙ্গে পরীক্ষার তিন দিন আগে রওনা দিয়েছি। পায়ে হেঁটে মুন্সীগঞ্জ যাব। সঙ্গে কদম আছে। আমার বইপত্র কাপড়চোপড়ের স্যুটকেস মাথায় করে নিয়ে যাবে কদম। আমার কাঁধে হালকা একটা ব্যাগ, বাবার কাঁধেও একটা ব্যাগ, কদমের হাতেও একটা ব্যাগ। কদমের ব্যাগে নানা রকমের শুকনো খাবার তৈরি করে দিয়েছ তুমি। মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, তিল কাউনের নাড়ু। একটা বয়ামে দিয়েছ আমের মোরব্বা। পড়তে পড়তে খিদে পেলেই যেন কিছু না কিছু খেতে পারি।
ওসবের কোনও দরকারই ছিল না, মা। ডাক্তার কাকার বাড়িতে কাকি আমাকে একদম তোমার মতো করে সামলাতে লাগলেন। এটা খাও বাবা, ওটা খাও। তোমার মা কেন এত সব খাবার দিয়া দিছেন! আমার বাড়িতে কি খাবারের অভাব! তোমার ডাক্তার কাকা রোজ চিত্তর দোকানের মিষ্টি নিয়া আসেন।
চিত্তর দোকানের ছানার আমিত্তির কোনও তুলনা হয় না, মা।
দোকানের নাম 'লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'। মালিকের নাম চিত্তরঞ্জন। সবাই বলে চিত্ত, চিত্তর মিষ্টির দোকান।
ডাক্তার কাকি আমাকে সকাল-বিকাল মিষ্টি খেতে দিতেন। কী যে স্বাদ সেসব মিষ্টির! মিষ্টি খেতে খেতে তোমার দেওয়া নাড়ু মোয়া মোরব্বা খাওয়াই হয় না।
কী কারণে এসব কথা বলছি, মা!
মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। পরীক্ষার জন্য দিন বিশেক মুন্সীগঞ্জে থাকব আমি। যেদিন যাব তার আগের রাত থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। যখন তখন কাঁদছ। আমাকে খেতে দিয়ে, আমি পড়তে বসলে পড়ার টেবিলের সামনে এসে মাথায় হাত রেখে তুমি চোখ মুছছ।
আমি তোমাকে বোঝাই, বাবাও নানা রকমভাবে বোঝান।
আমি বলি, আমি যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে আর তুমি কাঁদছ! তোমার এ রকম কান্নাকাটি দেখে গেলে আমার ভালো লাগবে! মন খারাপ হবে না! যখন-তখন তোমার কান্নাভেজা মুখ চোখে ভাসবে না! আমি ঠিকঠাকমতো পরীক্ষা দিতে পারব? রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে না!
তুমি চোখ মুছতে মুছতে বললে, তোরে ছাইড়া এত দিন আমি কোনও দিন থাকছি!
আমাদের বাড়িতে সবাই আমরা বইয়ের ভাষায় কথা বলি। একেবারে শুদ্ধ ভাষা। শুধু তুমি শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে বলো। শুদ্ধর সঙ্গে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলো।
তোমার সেই ভাষা এ জীবনে আমার আর কখনো শোনা হবে না, মা। পাকিস্তানি... ...গুলো, সঙ্গে তাদের দোসররা ছিল, তারা চিরতরে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল তোমাকে।
কী বলব, মা!
ওদেরকে আমি এখন কী বলব!
পৃথিবীর এমন কোনও কুৎসিত গাল নেই, যা দিলে সত্যিকার গাল দেওয়া হবে ওদেরকে।
আর গাল দিতে তো আমি শিখিনি, মা।
তোমার মতো মা, বাবার মতো বাবা, তোমরা যে কী যত্নে, কী মমতায় এবং রুচিস্নিগ্ধতায় আমাকে আর বকুলকে বড় করেছ, কোন মানুষের এমন ভাগ্য হয় তোমাদের মতো মা-বাবা পাওয়ার!
ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা বলি, বাবার কথা বলি।
মানে বাবা তোমাকে ওসময় কী বুঝ দিয়েছিলেন ওসব কথা আর কি!
তোমার কান্নাকাটি দেখে বাবা আগের দিন সন্ধ্যায় বললেন, ছেলে যাচ্ছে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আর তুমি কেঁদেকেটে বিনাশ করছ!
বাবার কথা শুনে তুমি রেগে গেলে। বিনাশ করছি অর্থ কী?
মানে তোমার কান্না দেখে ছেলের মন খারাপ হচ্ছে।
আর আমি যে এত দিন আমার ছেলেরে না দেইখা থাকুম, আমার মন খারাপ হয় না! আমার চোখে পানি আসে না!
আমিও এত দিন আমার ছেলেকে কখনও না দেখে থাকিনি। ঢাকায় গিয়েছে আমাদের সঙ্গে। কখনও কখনও দু-চার দিন বেলার ওখানে থেকেছে, কিন্তু বিশ দিন একসঙ্গে থাকেনি। এবার পরীক্ষার জন্য থাকতে হচ্ছে।
আমি কি আমার ছেলেকে কম ভালোবাসি? কই, আমি তো কাঁদছি না, আমার চোখে তো পানি আসছে না!
বাপ আর মা এক জিনিস না। মার কলিজা ছেলেমেয়ের জইন্য যেইভাবে পোড়ে, বাপের সেইভাবে পোড়ে না।
আমি আমার পড়ার ঘর থেকে বারান্দায় তোমাদের দুজনের এসব কথা শুনি আর মনে মনে হাসি। আট-দশ মাইল দূরের মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে, দিন বিশেক থাকব, ওই নিয়ে তোমরা কত কথা বলছ!
কিন্তু মা, মুন্সীগঞ্জ গিয়ে প্রথম দু-চার দিন তেমন কিছু মনে হলো না। তার পর থেকে তোমাদের জন্য খুবই মন খারাপ হতে লাগল। যখন-তখন তোমাদের কথা মনে হয়, রাতের বেলা ঘুম আসতে চায় না। পরীক্ষার মাঝখানে এক দুদিনের গ্যাপ থাকে, ইচ্ছা করে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাই, তোমার মুখটা একটু দেখে আসি। বাবার মুখটা, আর আমার বকুলের মুখটা একটু দেখে আসি।
যদিও ওই বিশ দিনে চারবার বাবা আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তবু আমার মন খারাপ হয়ে থাকত।
ডাক্তার কাকি খুবই আগলে রাখেন। তিনিও মা। আমার মন বুঝতে পারেন। পড়তে বসে আমি গেছি উদাস হয়ে, পিছন থেকে এসে তিনি আমার মাথায় হাত দিলেন, কী হইছে, বাজান?
না, কিছু না।
মন খারাপ দেখতাছি।
কই?
হ বাবা। আমি দূর থিকা তোমারে খেয়াল করছি। তোমার মন ভালো নাই। মা-বাবার কথা মনে পড়তাছে?
জি না, কাকি। তেমন কিছু না।
আমি বুঝি, বাজান। আমার ছেলেরা বাইরে গিয়া থাকলে তাগো যেমন আমার জন্য খারাপ লাগে, আমারও খারাপ লাগে তাগো জন্য। ওই দিকে তোমার মা তোমার জন্য মন খারাপ করতাছেন আর এই দিকে তুমি করতাছ মায়ের জন্য।
বাবার কথাও আমার খুব মনে হয়। বকুলের কথা মনে হয়।
এই তো কয়টা মাত্র দিন। পরীক্ষা শেষ হইলেই তো মা-বাবার কাছে চইলা যাইবা, বইনের কাছে চইলা যাইবা। এখন মন খারাপ কইরো না। তাইলে পরীক্ষা খারাপ হইব।
না, পরীক্ষা আমার খারাপ হয়নি, মা। আর্টস থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম। অঙ্কে লেটার মার্কস।
মুন্সীগঞ্জ থেকে ফেরার সময় অন্য কারণে আবার মন খারাপ। চলে আসার দিন দেখি ডাক্তার কাকি ঘন ঘন আঁচলে চোখ মোছেন। আমি এতগুলো দিন তাঁর কাছে ছিলাম, নিজের ছেলেদের মতো করে আমার দেখভাল করেছেন, আগলে রেখেছেন, এখন আমি চলে যাচ্ছি আর তিনি চোখের জলে ভাসছেন।
আহা রে, কী ভালো আমার দেশের মায়েরা!
এমন মমতাময়ী মা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে!
ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়তে চলে গেলাম ঢাকায়। তোমাদের দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে থাকি, ভর্তি হয়েছি জগন্নাথ কলেজে। কখনও লোহারপুলের ওদিক দিয়ে ফরাশগঞ্জ, শ্যামবাজার, বাংলাবাজার হয়ে কলেজে যাই, কখনও যাই ডিস্টিলারি রোডের ওদিক দিয়ে, কাঠেরপুল পার হয়ে প্যারীদাস রোড হয়ে সোজা বাংলাবাজারের দিকে।
রিকশায় চড়তে আমার ভালো লাগে না। আমার হাঁটতে ভালো লাগে। হেঁটে হেঁটে কলেজে যাই। এই নিয়ে মায়া আমাকে কিপটা কিপটা বলে খেপায়। এত বড়লোকের ছেলে, সে কলেজে যায় হেঁটে! রিকশা ভাড়ার পয়সা বাঁচায়।
সাপখেলা দেখানো বেদেনীদের ভঙ্গিতে মজা করে বলে, খা খা খা, বক্ষিলারে খা।
বক্ষিল মানে কৃপণ।
মায়া তখন মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে।
আমি কলেজে ভর্তি হব, তোমরা সবাই এ উপলক্ষে ঢাকায় এলে। যেন বিশাল একটা উৎসব শুরু হলো আমাকে নিয়ে। আমি বেলা খালার বাড়িতে থেকে জগন্নাথে পড়ব।
আমরা সব সময় বলতাম বেলা খালার বাড়ি।
বেলা খালা মাঝে মাঝে হাসতেন। বেলা খালার বাড়ি বলছস কেন? এই বাড়ি তোর মারও। তোর মার অর্ধেক, আমার অর্ধেক। দুইটা ভাড়াইটা আছে, কিছু টাকা ভাড়াও পাওয়া যায়। তোর মা সেই টাকা নেয় না। ছোট বোনরে দিয়া দেয়। আমাদের দুই বইনের ভালোবাসা যে কী রকম, সেইটা তোরা বুঝবি না।
মা, আমি বুঝতাম। বেলা খালা যে তোমার জান, এটা আমি টের পেতাম। খালাকে তুমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলে, ওই বাড়ি তোরই। আমার অনেক আছে। আমার ওই বাড়ি লাগব না। শুধু আমার ছেলেমেয়ে দুইটা যখন ঢাকায় পড়তে যাইব তখন ওই বাড়িতে থাকব। অর্থাৎ তোর কাছে থাকব। কারণ একটাই, মায়ার মতো আমার ছেলেমেয়ে দুইটারেও তুই একই রকম ভালোবাসবি, একই রকম আদর করবি।
খালা তোমাকে ডাকে 'বুজি'।
বিক্রমপুরের ভাষা। বুজি মানে বুবু, আপা।
তোমার কথা শুনে বেলা খালা বলত, এই সব কথা কেন বলো, বুজি? তোমার ছেলেমেয়ে আমারই ছেলেমেয়ে। মায়ার সঙ্গে বকুলের কি কোনও ব্যবধান আছে! আর রবি হইতাছে তোমার আমার দুইজনেরই একমাত্র ছেলে।
দীননাথ সেন রোডে তোমাদের বাড়িটা গ্রামের বনেদি বাড়ি ধরনের।
বাড়ির সামনে তিন-চারটা লিচুগাছ। তারপর টিনের চৌচালা সুন্দর একটা বসার ঘর। বাড়ির চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। গেটটা কাঠের। তারপর দক্ষিণমুখী দোতলা টিনের বিশাল একটা ঘর। ওপর-নিচ মিলিয়ে সাত-আটটা কামরা। পিছন দিকে আরো দুটো বেশ বড় সাইজের টিনের ঘর। ওই দুই ঘরেও তিন-চারটা করে কামরা। দুই ঘরে দুটো পরিবার ভাড়া থাকে। এক ঘরে শান্তি আপারা, অন্য ঘরে হারুনরা। দুই ঘরের জন্য দুটো রান্নাঘর, আলাদা চাপকল আছে, আলাদা গোসলখানা, পায়খানা। ভাড়া কত হবে? দুই ঘরের ভাড়া বোধ হয় দেড় শ দেড় শ তিন শ টাকা। আগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। দু-তিন বছর হলো ইলেকট্রিসিটি এনেছে খালা।
বেলা খালার পরিবারের জন্য একেবারেই আলাদা ব্যবস্থা।
চাপকল আলাদা। চাপকলের সঙ্গে পানি জমিয়ে রাখার জন্য পাকা একটা হাউস। তার দক্ষিণ পাশে চারদিকে ইটের দেয়ালঘেরা গোসলখানা, পায়খানা। রান্নাঘরটা দোতলা ঘরের পশ্চিমে। তারও পশ্চিমে দু-তিন কাঠা খোলা জায়গা। সেখানে বাগান করেছে খালা। একটা জামরুলগাছ আছে। দুটো আমগাছ, পেয়ারা, বরইগাছ আছে। শীতকালে খালা নিজ হাতে সবজির চাষ করে। লাউ কুমড়া শিম ঢেঁড়স ডাঁটা টমেটো বেগুন। বাগানের দিকটা বেশ সবুজ। তাকালেই ভালো লাগে।
মাজেদা আর মাজেদার স্বামী রফিক, ওদের ছেলেমেয়ে নেই। নাকি ছিল, মারাটারা গেছে!
ইস্, কেন যে মনে পড়ছে না!
যা ইচ্ছা হোক গিয়ে। ওরা থাকে দোতলা ঘরের নিচতলার একটা কামরায়। ওপরে খালা আর মায়া। আমারও জায়গা হলো ওপরেই।
দোতলার সামনে সুন্দর রেলিং দেওয়া বারান্দা। বারান্দার সঙ্গেই কামরাগুলো। দক্ষিণমুখী বারান্দা। বিকেলের দিকটায় ওই বারান্দায় বসলে কী যে ভালো লাগে! বাইরে ফুরিয়ে যাচ্ছে একেকটা মনোরম বিকাল। বাড়ির দক্ষিণ দিকটায় হালিম ভাইদের বিশাল জলাভূমি। সারা বছর কচুরি ভর্তি। এমন ঘন কচুরি, পানি দেখাই যায় না। আর পুব-দক্ষিণ কোণে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন। বাড়ির পুব দিকে বাঁধানো ঘাটলার একটা পুকুর আছে। পুকুরের পানিটা জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো। কাকচক্ষু জল। অর্থাৎ কাক পাখির চোখের মতো স্বচ্ছ পানি।
খালার বাড়ির উত্তর পাশে, রাস্তার ওপারে, পুরনো আমলের, আমাদের এই বাড়ির মতো একতলা একটা দালানবাড়ি। নিশ্চয় মাঝারি সাইজের কোনও হিন্দু টাকাঅলা লোকের বাড়ি ছিল। পুকুরটা তাদেরই। পার্টিশনের সময় হয়তো কোনও মুসলমান কিনে নিয়েছেন পুকুরসহ।
বাড়ির মালিক ভদ্রলোককে আমি চিনি। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোকেও চিনি। মেয়েগুলোর নাম ফিরোজা মমতাজ ও কোহিনূর। ছেলেটার নাম রঞ্জু। শুধু ভদ্রলোকের নাম মনে করতে পারছি না।
পুকুরের ওপারে বেশ কিছুটা উঁচু জমি। পুকুরের পাড়। সেখানে ছাপরাঘর তুলে থাকে কয়েকটি পরিবার। জায়গাটা নিশ্চয়ই রেলের খাসজমি। কারণ ওই ছাপরাঘরগুলোর ঠিক পিছনেই বিশ-ত্রিশ হাত চওড়া নালা, তারপর রেললাইন। ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে রেল যায় নারায়ণগঞ্জে। যাওয়ার পথে গেণ্ডারিয়া স্টেশন আর পাগলা স্টেশনে থামে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার সময়ও ওভাবেই দুটো স্টেশন ধরে আসে।
ভোররাতের দিকে ঢাকা থেকে যেত একটা ট্রেন। দূর থেকে সেই ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসত। ঘুমের ভিতর থেকে সেই শব্দ পাই আমি। মনে হতো স্বপ্নের রেলগাড়ি যায়।
আরেকটা ট্রেন দুপুরের ঠিক পরপর। ওটা আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে। নিজের ঘরে বসে মায়া হয়তো তখন গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। গ্রামোফোনে বাজছে হেমন্তের গান।
ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো
এখন কত দূরে
আজ আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে
কী যে স্নিগ্ধ নির্জন একেকটা দুপুর! কী যে মনোরম একেকটা বিকাল! লিচুগাছগুলো তোলপাড় করছে হাওয়ায়। আমি গিয়ে বসে আছি ফিরোজাদের পুকুরঘাটে। উদাস চোখে তাকিয়ে আছি রেললাইনের দিকে।
কোনও কোনও দিন মালগাড়ি যায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে। ইট রঙের বগি। এত বগি একেকটা মালগাড়ির! যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, শেষ হয় না। পুকুরঘাটে বসে কিংবা দোতলার রেলিংয়ে বসে আমি মালগাড়ির বগি গুনি। এক দুই তিন...
বগি গোনা আর শেষ হয় না।
কিন্তু সেই চৈত্র মাসের দুপুরবেলা মুসাফির টাইপের লোকটা এসে যে সরাসরি আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায় চলে এলো, লোকটা কে? এভাবে বাড়ির ভিতর এসে ঢুকল কেন? কোন সাহসে ঢুকল!
চৈত্র মাসের দুপুরবেলাটা গুমোট হয়ে আছে।
কোথাও হাওয়া নেই, হাওয়ার চলাচল টের পাওয়া যায় না। হঠাৎ মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায় আচমকা উঠছে চৈতালি ঘূর্ণি। একটা জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাওয়া। ঘুরে ঘুরে মাঠের ধুলাবালি আর খড়কুটো নিয়ে কোনও একটা দিকে এগোচ্ছে।
আমাদের এলাকায় এই ঘূর্ণিকে বলে 'বানাডুলি'।
ছেলেবেলায় তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে, স্কুল থেকে ফেরার সময় বা মাঠের দিকে দুপুরবেলা গেলে, নির্জন মাঠে বানাডুলি দেখলেই যেন বুকে থুতু দিই।
কেন বলেছিলে?
আমার মনে আছে, মা। আমি তোমার কোনও কথাই ভুলিনি। সেই কবে কোন ছেলেবেলায় বানাডুলি দেখলে বুকে থুতু ছিটাতে হবে সে কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে।
আমাদের বাঁশঝাড়ে যে তেনায় থাকতেন, ও রকম তেনারা নাকি কোনও কোনও নির্জন দুপুরে, বিশেষ করে চৈত্র মাসের নির্জন দুপুরে বিল-বাদাড়ে, মাঠঘাটে চরতে বেরোন। চৈত্রের রোদ তাঁদের খুব পছন্দ। রোদ গায়ে মেখে কিছুক্ষণ চলাচল করেন। ওই চলাচলের সময় ঘূর্ণি হাওয়ার রূপ ধারণ করেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় কোথায় মিলিয়ে যান, কেউ জানে না।
ওই সময় তেনাদের সামনে পড়লে বিপদ। ওই হাওয়ার মধ্যে পড়লে বিপদ।
তখনই কিছু হবে না। বাড়ি ফেরার পর জ্বর হবে। সেই জ্বর একমুহূর্তের জন্যও কমবে না। জ্বরে জ্বরে মরতে হবে। মরণ অবধারিত।
তবে বুকে থুতু ছিটালে তেনারা সামনে আসেন না। তেনারা সবচাইতে ঘেন্না করেন মানুষের থুতু। থুতুর বদগন্ধে অন্যদিকে চলে যান। মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন না।
বারেকের মাও শিখিয়েছিল একই রকম কথা। বারেককে, আমাকে। নির্জন দুপুরে বাঁশঝাড়তলায় গেলে, মাঠঘাটে গেলে, আচমকা বাঁশঝাড় দুলে উঠতে দেখলে, মাঠঘাটে বানাডুলি দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকে থুতু ছিটাই আমরা।
বারেক কি সেদিন বুকে থুতু ছিটিয়েছিল, মা!
মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে চলে গেল, তারপর যে তেনায় বারেককে বাগে পেয়ে ওদিককার কাদাভর্তি পুকুরের তলায় এমন করে পুঁতে দিলেন, বারেকের লাশও কোনও দিন ভেসে উঠল না!
আহা রে, বারেকটা যে কেন এমন করল! মায়ের মার খেয়ে কেন যে বুকে থুতু ছিটাতে ভুলে গেল! তাহলে তো ওভাবে মরতে হয় না তাকে!
সম্পূর্ণ ছেলেবেলাটা, বারেকের কথা মনে হলেই একথা ভাবতাম আমি। রাতদুপুরে বারেকের মায়ের গুমরে গুমরে কান্না আর বিলাপ শুনে যে রাতে আমার ঘুম ভাঙত, বুকে থুতু ছিটানোর কথা মনে হতো।
আর মনে হতো তোমার কথা। মা, মা গো, তোমার কথা মনে হতো। ওই তো পাশের ঘরেই বকুলকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছ তুমি। তবু মনে হতো। মনে হতো, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বারেকের মায়ের জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও রাতে ঘুমাতে পারতে না। গভীর রাতে উঠানে বারান্দায়, রান্নাঘর গোলাঘরের সামনে বসে, কদমের ঘরের ওদিকটায় বসে আমার জন্য গুমরে গুমরে কাঁদতে। বারেকের মায়ের মতো বিলাপ করতে। রবি রে, আমার রবি। আমারে ছাইড়া তুই কই চইলা গেলি, বাজান? আমার কথা তোর মনে হয় না? আমার লেইগা তোর মায়া লাগে না? মনডা কান্দে না মার লেইগা? মারে ছাইড়া তুই থাকস কেমনে? কে তোরে ডাইকা আইনা ভাত খাওয়ায়! কে তোরে নাওন ধোওনের কথা কয়! কে তোরে ঘুমানের সময় মাথায় হাত বুলাইয়া দেয়! ও রবি, রবি!
এসব ভেবে আমার চোখে পানি আসত, মা। বারান্দা কিংবা উঠানে বসে, রান্নাঘরের সামনে কিংবা গোলাঘরের ওদিকটায় বসে যে রাতদুপুরে বারেকের মা ওভাবে কাঁদত আর বিলাপ করত, এদিকে আমার ঘরে শুয়ে ঘুমভাঙা আমি কোনও কোনও রাতে চোখের জলে ভাসতাম। বারেকের মায়ের জায়গায় তোমাকে ভাবতাম, মা। বারেকের জায়গায় ভাবতাম আমাকে।
দিনে দিনে দিন কেটে গেল। বারেকের কথা ভুলে গেলাম আমরা। দশ বছরের একজন বারেক আমাদের সংসারে ছিল, সে এখন আর নেই।
আমরা তো ভুললামই, বারেকের মাও বোধ হয় ভুলল।
মায়ের মন পুরোপুরি হয়তো ভোলে না। মনের অনেক ভিতরে চাপা পড়ে গেল বারেক। দু-চার মাসে হয়তো একদিন হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির কথা সে ভাবত, হয়তো একটু চোখের পানি ফেলত, কিন্তু রাত জেগে সেই গুমরে গুমরে কাঁদা আর বিলাপ করাটা বন্ধ হয়েছিল।
এ সময় চৈত্র মাসের দুপুরে এলো সেই মুসাফির। ধূলিধূসর পা, মাথায় গোল সাদা টুপি, মুখে চাপদাড়ি, মোচ নেই। নাকের তলাটা কামানো। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি, তার তলায় লুঙ্গির একটুখানি দেখা যাচ্ছে। কাঁধে রেকসিনের খয়েরি রঙের চটে যাওয়া ব্যাগ। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায়।
কদিন হলো বাড়িতে এসেছি আমি। কলেজ বন্ধ। বাবা স্কুলে। বকুল সেদিন স্কুলে যায়নি। চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে প্রতিবছরই দু-চার দিন জ্বরে ভুগত বকুল। এই জ্বরটা ওর বাঁধা ছিল।
সেদিনও জ্বর বকুলের।
খানিক আগে বারেকের মা আর পারুল তার মাথায় পানি দিয়েছে। পানি দেওয়া শেষ করে মাথা মুছিয়ে দুধ বার্লি খেতে দিয়েছে। নাকি দুধের সঙ্গে সাগুদানা ভিজিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারছি না, মা।
জ্বরের সময় একদমই খেতে চাইত না বকুল। তুমি সামনে বসে চামচে করে খাওয়াতে। বকুল শিশুর মতো মাথা দোলাত, কাঁদো কাঁদো মুখে বলত, আর খাব না, মা। আর খাব না। আমার বমি আসছে।
তুমি বুঝিয়ে-শুনিয়ে খাওয়াতে। আরেকটু খা মা, আরেকটু। না খাইলে শরীল দুর্বল হইব। দুধ বার্লি খাইলে, দুধ সাগু খাইলে জ্বর তাড়াতাড়ি কমে। তোর ডাক্তার কাকা বইলা গেছেন।
ডাক্তার কাকা মানে গগন ডাক্তার।
পুরা বাজারে গগন ডাক্তারের ডিসপেনসারি। তাঁর কম্পাউন্ডার হরিপদ। ডাক্তার কাকা দেশগ্রামের খুবই নামকরা ডাক্তার। রোগী দেখতে ভিজিট নিতেন দুই টাকা। আমাদের বাড়ির কাউকে দেখে ভিজিট নিতেন না। বাবার বন্ধু মানুষ। আমাদেরকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখতেন। পার্টিশনের পর দেশগ্রামের বেশির ভাগ সচ্ছল হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। ডাক্তার কাকা যাননি। মাঝারি ধরনের অবস্থাপন্ন মানুষ। ইচ্ছা করলেই কলকাতার ওদিকে গিয়ে বাড়িঘর করে ভালোই থাকতে পারতেন। আরামে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি দেশ ছাড়েননি। বাবাকে বলতেন, যেই মাটিতে জন্মাইছি, এই মাটিতেই মরুম। নিজের মাটি ছাইড়া যামু না রে, মতি।
নিজে তো যানইনি, ছেলেমেয়েদেরও যেতে দেননি। দুই ছেলেই দেশে। একমাত্র মেয়ে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলে। মেয়ের জামাই সেখানকার চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
ডাক্তার কাকা আমাদের বাড়িতে রোগী দেখতে এলেই প্রথমে তোমাকে ডাকতেন।
আচ্ছা, ডাকতেন বলছি কেন? ডাক্তার কাকা তো এখনও বেঁচে আছেন। তাঁর দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। বড় ছেলে নবীন ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে চাকরি করে। ছোট ছেলে কিশোর ভাইয়ের কাছে থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বকুলের বয়সী হবে।
ডাক্তার কাকা কি গ্রামে আছেন, মা?
তাঁর ছেলেরা নিশ্চয়ই ঢাকায় নেই। নবীন আমার বয়সী। এখনও বিয়ে করেনি। নবীন আর কিশোর দুজনই কি মুক্তিযুদ্ধে গেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, গেছে তো!
দুজনই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। একথা আমি আগেই শুনেছি। ভুলে গিয়েছিলাম কেন!
আমার এখনকার অবস্থাটা কী রকম জানো, মা! এই এক কথা মনে পড়ছে, এই আরেক কথা মনে পড়ছে। বহু আগের কথা চলে আসছে পরে, অনেক পরের কথা চলে আসছে আগে। চিন্তাচেতনা একদম এলোমেলো। পরিষ্কার করে ভাবতে পারছি অনেক কিছুই, আবার অনেক কিছুই পারছি না, মা। মাথার ভিতরে একবার ঢুকছে চাঁদের আলো, চিন্তার জায়গা আলোকিত হচ্ছে, আবার ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার। সব ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। আকাশের চাঁদ যেমন হঠাৎ হঠাৎ ঢেকে দেয় গভীর কালো মেঘ, তারপর সরে যায়, সরে যাওয়ার পর যেমন আগের মতো আলোকিত হয় চারদিক, আমার মাথার ভিতরটা সেভাবে একবার আলোকিত হচ্ছে, আবার সেই আলো ঢেকে যাচ্ছে মেঘে।
আমার কি এমন হওয়ার কথা, মা!
একজন যোদ্ধার কি এমন হওয়ার কথা! যোদ্ধা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে। নিজের জীবনের মায়া যোদ্ধাকে মানায় না। যোদ্ধা জীবন দেবে হাসিমুখে। যোদ্ধা কোনও মৃত্যু দেখে কষ্ট পাবে না, চিন্তাচেতনা এলোমেলো হবে না তার। যুদ্ধক্ষেত্রে লাশের পর লাশ সে দেখবে নির্বিকার চোখে, নির্বিকার দৃষ্টিতে।
আমি পারছি না কেন, মা!
অথবা পারছি। চোখে পানি আসছে না আমার। যোদ্ধার চোখে পানি মানায় না।
কিন্তু চিন্তাচেতনা এলোমেলো হচ্ছে কেন?
বাড়িতে এসে এ রকম দৃশ্য দেখব ভাবা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি বলে কি এমন হচ্ছে! আচমকা এক কিশোর আমি কি পড়েছি চৈতালি কোনো ঘূর্ণির মধ্যে!
বড় হয়ে জেনেছি, চৈতালি ঘূর্ণির সঙ্গে তেনাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা প্রকৃতির খেলা। ওরকম প্রকৃতির খেলা কি ঢুকে গেছে আমার বুকে আর মাথায়! আমার চিন্তাচেতনা কি ঘুরপাক খাচ্ছে বানাডুলির মতো! ফেলে আসা জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কি মাঠের ধুলোবালি আর টুকরোটাকরা খড়কুটোর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়! মাথা স্থির করতে পারছি না আমি!
মুসাফির লোকটার কথা বলি মা, মুসাফির লোকটার কথা বলি।
সরাসরি এসে ঢুকেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে। বুয়া আর পারুল বকুলের মাথায় পানি দিয়ে যে যার কাজে গেছে। তুমি বকুলকে জ্বরের পথ্য খাইয়ে দিয়েছ। আমি বড় পুকুরে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে এসেছি। কদম স্কুলে গেছে বাবার দুপুরের খাবার নিয়ে।
পুরনো আমলের পিতলের একটা টিফিন ক্যারিয়ারে স্কুল খোলা থাকার দিনগুলোয় দুপুরের মুখে মুখে বাবার খাবার নিয়ে যেত কদম। বাবার খাওয়া হলে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ফিরে আসত।
কদম তখনও ফেরেনি।
মুসাফির লোকটাকে প্রথমে দেখল পারুল। বুয়ার সঙ্গে রান্নাঘরে ছিল। কী কাজে ওদিককার উঠান পেরিয়ে দালানঘরের বারান্দার দিকে আসছে, দেখে গোলাঘর ছাড়িয়ে ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক মুসাফির।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেডা, আপনে কেডা?
মুসাফির কথা বলে না। অপলক চোখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
পারুল বিরক্ত। কথা কন না ক্যাঁ? কে আপনে? চিনা নাই জানা নাই বাড়ির ভিতরে আইসা ঢুকছেন?
মুসাফির তবু কথা বলে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে।
পারুল এবার রাগল। আরে, কোন পদের মানুষ আপনে? কথা কইতে পারেন না? নাকি বোবা! কই থিকা আইছেন? চান কারে?
পারুলের চড়া গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে বুয়া। কী হইছে রে পারুল? কার লগে চিল্লাস? কে আইছে বাড়িতে?
বুয়াকে দেখে মুসাফির লোকটা পারুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়েছে তার দিকে। ফিরিয়ে পারুলের দিকে যে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল, সেভাবেই তাকাল বুয়ার দিকে। তাকিয়েই রইল। চোখ দুটো ছলছল করছে।
এই দৃশ্য আমি দেখতে পেয়েছিলাম আমার রুম থেকে।
গোসল সেরে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছি। দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁকই দিয়ে মাথা আঁচড়িয়েছি। খানিক পর খেতে বসব। বাইরে অচেনা এক মুসাফির, তার অদূরে পারুল আর বুয়া। পারুলের কথার কোনও জবাবই দিচ্ছে না মুসাফির। তাকিয়ে ছিল পারুলের দিকে, বুয়াকে দেখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এখন চোখ ছলছল করছে।
ঘটনা কী?
লোকটা কে?
আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। কিছু একটা বলতে যাব, তার আগেই দেখি মুসাফির লোকটা যেভাবে তাকিয়ে আছে বুয়ার দিকে, বুয়াও সে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। মুখটা একটু যেন হাঁ হয়ে আছে।
পারুল একবার মুসাফিরের দিকে তাকায়, একবার বুয়ার দিকে।
বারান্দায় বেরিয়ে দুজন মানুষের এই অবস্থা দেখে আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছি। কথা বলতে পারছি না।
মুসাফির কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাল উঠানে। ছলছল চোখে এগিয়ে গেল বুয়ার কাছে।
বুয়া তখনও কথা বলছে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে মুসাফিরের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিড়বিড় করে বলল, কে? কে রে? বারেক, আমার বারেক!
সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল মুসাফির। হ গো মা, আমি বারেক। আমি তোমার পোলা বারেক।
দুহাতে পাগলের মতো মাকে জড়িয়ে ধরল বারেক। হাউমাউ করে কাঁদতেই লাগল। আমি বারেক, মা। আমি বারেক। তোমার পোলা।
আশ্চর্য ব্যাপার, ছেলে উধাও হয়ে যাওয়ার পর যে মা রাতের পর রাত উঠান বারান্দায় বসে, রান্নাঘর ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় বসে, কোনও কোনও দুপুর কিংবা রাতে গোয়ালঘরের ওদিকে গিয়ে কদমের ঘরের ওদিকে গিয়ে অথবা গোলাঘরের সামনে বসে গুমরে গুমরে ছেলের জন্য কাঁদত, বিলাপ করত, সেই মা আজ আশ্চর্য রকমের নির্বিকার। ছেলে জড়িয়ে ধরেছে মাকে, কাঁদছে বুকফাটা কান্না, মা কাঁদছে না। তার চোখে পানি নেই, তার কোনও আবেগ নেই। ছেলেকে সে জড়িয়ে ধরেনি। যেন গাছ কিংবা পাথর হয়ে আছে। বারেক যেন একটা গাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বারেক যেন মানুষের মতো দেখতে একটা পাথর জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
বাড়িতে ততক্ষণে সাড়া পড়ে গেছে।
মুসাফির লোকটা বারেক জানার পরই দৌড়ে বকুলের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে পারুল। তোমাকে খবর দিয়েছে। ভীষণ উত্তেজিত সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বিরাট কারবার হইয়া গেছে গো, আম্মা। বিরাট কারবার। বুড়ির পোলায় ফিরত আইছে। বারেক, বারেক ফিরত আইছে।
শুনে তুমি হতভম্ব হয়ে গেছ। বারেক ফিরত আইছে!
হ গো আম্মা, হ। রান্ধনঘরের সামনে বুড়িরে প্যাঁচাইয়া ধইরা কানতাছে। আপনে তাড়াতাড়ি আসেন। আইসা দেখেন।
তুমি তো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেই, জ্বর শরীরে বকুলও এলো তোমার পিছন পিছন। আমরা তিনজন মানুষ বারান্দায়। পারুল গিয়ে দাঁড়িয়েছে উঠানে। রান্নাঘরের সামনে বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারেক। বুয়া আগের মতোই নির্বিকার।
যে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল তার ছেলে জীবিত নেই, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই শেষ করেছেন ছেলেকে, সেই মৃত ছেলে এগারো বছর পর ফিরে এসেছে, কিন্তু মা নির্বিকার। এ তো আশ্চর্য ঘটনা!
বারেককে দেখে যতটা না অবাক আমরা, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক বুয়ার কাণ্ড দেখে।
কেন এমন গাছ হয়ে আছে সে!
কেন এমন পাথর হয়ে আছে!
পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে এ রকম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন একজন মানুষ।
তাঁর নাম মনে করতে পারছি না। পুলিশের লোক। সেই রাতে ডিউটি পড়েছিল পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানায়। সঙ্গে আরো কয়েকজন।
মধ্যরাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন তিনি সে কথাও আমার মনে নেই। মনে পড়ছে তাঁর থানায় ঢোকার সময় থেকে পরের সময়টার কথা।
থানায় ঢুকেই তিনি দেখতে পান মেঝে চাপ চাপ রক্তে ভিজে আছে। বুলেটের আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছে দেয়াল। থানাহাজতে বন্দি নেই কেউ, তাঁর সহকর্মীরাও নেই। খাঁ খাঁ নির্জন থানা। শুধু মেঝেতে রক্ত আর রক্ত।
ঘটনা কী ঘটেছে তিনি বুঝে গেলেন। বুঝে প্রথমে দিশাহারা হলেন। বাড়িতে ঢুকে তোমাদেরকে দেখে প্রথমে আমি যেমন দিশাহারা হলাম, ঠিক তেমন। তারপর গেলেন পাথর হয়ে।
ওদিকটায় তখন পাকিস্তানি... ...দের গোলাগুলি থেমে গেছে। ইসলামপুর বাবুবাজার মিটফোর্ডের দিকে চলছে তাণ্ডব।
তিনি থানা থেকে বেরোলেন।
কোতোয়ালি থানার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। তিনি নদীর দিকে হাঁটতে লাগলেন। নদীতীরে এসে দেখেন এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছিটানো শুধু লাশ আর লাশ। রাস্তার ওপর লাশ, জেটিতে লাশ, পানিতে লাশ।
তিনি মৃতের মতো এদিক-ওদিক তাকান। লাশের সারির ভিতর দিয়ে তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও গেছে জমাট বেঁধে। রক্তের গন্ধে নদীর হাওয়া বদলে গেছে।
এইসব লাশের মধ্যে তিনি দেখেন তাঁর অনেক সহকর্মীর লাশ। পুলিশের পোশাক পরা বহু লাশ ভাসছে নদীতে। সহকর্মী এবং বন্ধু তাহেরের লাশ দেখেন মাথার দিকটা তীরে, পা দুটো নদীতে।
তিনি দৌড়ে যান বন্ধুর লাশ তুলতে।
ততক্ষণে ফরসা হয়ে গেছে চারদিক। ফজরের আজান ভেসে আসছে নবাববাড়ির মসজিদ থেকে। সেই আজানের সুর ম্লান করে দিল এক পাকিস্তানি... ...র কঠিন কণ্ঠ। শুয়োর কা বাচ্চা, তোমকো ভি গুলি করে গা! ভাগো হিয়াসে।
বন্ধুর লাশে হাত লাগাতে পারলেন না তিনি। মুখ ঘুরিয়ে পুব দিকে হাঁটতে লাগলেন। সদরঘাট টার্মিনাল, রূপমহল সিনেমা হলের ওদিক এলেন। এক জায়গায় কয়েকটি শিশুর লাশ দেখতে পেলেন, শরীর ঠিক আছে। শরীরের কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, শুধু মাথা থেঁতলানো। দেখে বোঝা যায় মায়ের কোল থেকে টেনে নিয়ে পা ধরে পাকা রাস্তায় আছড়িয়ে মারা হয়েছে।
টার্মিনালে নারী পুরুষ যুবক বৃদ্ধ কিশোর কিশোরী বহু মানুষের লাশ। তারা রাতের লঞ্চের যাত্রী ছিল। নারীদের লাশের যে অবস্থা তা তোমাকে আমি বলতে পারব না, মা। বহু যুবকের লাশ ছিল, ভাসমান মানুষ, রিকশাঅলা আর ভিখিরির লাশ ছিল। কিছু যুবকের জন্য পাকিস্তানি... ...রা গুলি খরচা করেনি। তাদেরকে হত্যা করেছে বেয়নেট চার্জ করে। শরীর ছিন্নভিন্ন। বুক পেট চিরে ফালা ফালা করা হয়েছে।
এক জায়গায় পড়েছিল দুজন যুবকের লাশ। তাদের পোশাক-আশাক সব ঠিক আছে, শরীর ঠিক আছে, শুধু মাথা চূর্ণবিচূর্ণ। এদেরকে রাস্তায় চেপে ধরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে এমনভাবে আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে, বেলের মতো ফেটে চৌচির হয়েছে মাথা। রক্ত মগজ মিলেমিশে জমাট বেঁধে আছে মাথার তলায়।
রূপমহল সিনেমা হলের সামনে ছিল স্তূপ করা লাশ। তারা সবাই সেই রাতে সিনেমা দেখতে এসেছিল। নাইট শো।
লক্ষ্মীবাজার মোড়ে তিনি দেখতে পান কয়েকজন যুুবকের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করা হয়েছে। পায়ের গিঁট আর হাতের কবজি ভাঙা।
কোথাও জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ভোরবেলার কাকগুলো চরতে নেমেছে। ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে মানুষের লাশ আর ডাকাডাকি করছে। মিউনিসিপ্যালিটির সামনে কয়েকটা ময়লা ফেলার গাড়ি। প্রতিটি গাড়ি ভর্তি মানুষের লাশ। রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু লাশ টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে সুইপাররা। একদল পাকিস্তানি... ...পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুইপারদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন মানুষগুলো মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। লাশ তোলার কাজ না করলে তাদেরকেও লাশ হতে হবে।
তখনও আগুনে পুড়ছে কোনও কোনও বাড়ি। উঁচু দালানকোঠার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরের জ্বলন্ত বাড়িঘর। আর থেকে থেকে আসছিল গুলির শব্দ।
তখনও পুরোপুরি থামেনি পাকিস্তানি... ...রা।
রায়সাহেব বাজার ব্রিজ পেরিয়ে নবাবপুর রোডে ঢুকলেন তিনি।
এই এলাকায় চলছিল বিহারিদের উৎসব। বীভৎস উল্লাসে মেতে আছে তারা। লাফালাফি, হাসাহাসি করছে দলে দলে বিহারি। প্রত্যেকের হাতে ধারালো অস্ত্র। ছুরি দা বল্লম কুড়াল শাবল রড। কয়েকজন বাঙালিকে ধরে এনেছে ওরা। কারো গায়ে কাপড় নেই, হাত পিছন দিকে বাঁধা। এক বাঙালিকে রাস্তায় চিত করে শুইয়ে তার ওপর কয়েকটি বিহারি দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে। হাত বাঁধা এক বাঙালির পেটে আচমকা ছোরা ঢুকিয়ে দিল এক বিহারি।
পাকিস্তানিদের গাড়ি চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। বিহারিদের বাঙালি নিধন দেখে মহাখুশি তারা। হাত উঁচিয়ে, দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে।
পুলিশের পোশাক পরা দেখে তাঁর ওপর চড়াও হচ্ছিল না বিহারিরা। তিনি নির্বাক, কলের পুতুলের মতো হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটু এগিয়ে দেখতে পান বিহারিরা কয়েকটি বাঙালি শিশুকে বাঁশের চোখা মাথায় গেঁথে টাঙিয়ে রেখেছে রাস্তার ওপর। জীবন্ত অবস্থায় গাঁথা হয়েছিল তাদের। একটি শিশু তখনও বেঁচে আছে।
বিহারিরা সমানে লুটপাট চালাচ্ছিল এলাকার বাঙালি বাড়ি আর দোকানপাটে। লুটপাট শেষ করে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল।
ঠাঁটারিবাজার ট্রাফিক সিগন্যালের কাছে এসে তিনি দেখেন আরেক ভয়ংকর দৃশ্য। এক বাঙালি যুবকের পেটে বাঁশ ঢুকিয়ে তার মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আর এই যুবককে ঘিরে উল্লাসনৃত্য করছে বিহারিরা।
মা, মা গো, তুমি ভাবতে পারো, তুমি ভাবতে পারো এসব। পাকিস্তানি... ...দের দোসর হয়েছে যারা তারাও তো ওদের চেয়ে কম যায় না।
এই দেখো মা, তোমাকে এসব কথা বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার। শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে।
মা, আমরা ওদের একটাকেও ছাড়ব না। বদলা নেব, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বদলা নেব।
ছাব্বিশে মার্চ মিরপুরে বিহারিরা কী করেছিল, শোনো মা। মাথায় লাল কাপড় বেঁধে দলে দলে বাঙালি বাড়িতে ঢুকেছে, প্রথমে লুটপাট, তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে প্রতিটা বাড়িতে। বাড়ির লোকজন সবাইকে ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তায়। রাস্তায় ফেলে গরু জবাই করার ছুরি দিয়ে প্রত্যেককে জবাই করেছে। বাঙালির রক্ত রাস্তা থেকে গড়িয়ে গেছে ড্রেনের দিকে।
মায়েদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে শিশুদেরকে। এক বিহারি গরু জবাই করার ছুরি ওপর দিকে খাড়া করেছে, আরেক বিহারি শিশুটিকে ছুড়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। সেই শিশু শূন্য থেকে এসে পড়েছে ছুরির ওপর। ছুরিতে গাঁথা শিশুদেরকে তখন ফালা ফালা করে কেটে ফেলা হয়েছে।
মেয়েদের ওপর যে নির্যাতন করেছে পাকিস্তানি... ...গুলো, রাজাকার আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির ওইগুলো আর বিহারিরা, সেসব তোমাকে আমি বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলি, মিরপুরে সেদিন বহু বাঙালি মা বোন স্ত্রী কন্যার গায়ে কেরোসিন ঢেলে খোলা রাস্তায় তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
বেঁচে থাকলে এইসব বর্ণনা তোমাকে আমি দিতে পারতাম না, মা। শুনে হয় তুমি অঝোর ধারায় কাঁদতে আর নয়তো ফিট হয়ে যেতে।
মে মাসের ৯ তারিখে ঢাকা থেকে রাজশাহীর দিকে রওনা দেয় পাকিস্তানি... ...রা। যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ফজরের নামাজ পড়ছিলেন এক মা। তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। নামাজ শেষ করে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন আরেক মা। তাঁকেও ধরে নিয়ে যায়।
এ রকম কত ঘটনা বলব, মা! প্রতিদিনই নির্যাতনের নানা ঘটনা আমাদের কানে আসে। আর আমাদের রক্তে লেগে যায় আগুন।
ও, তোমাকে তো আমাদের গুরুর কথা বলা হয়নি। আমাদের ওস্তাদের কথা। সেই বীর বাঙালির নাম মেজর এ টি এম হায়দার। মার্চ মাসে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন ছিলেন। পাকিস্তানিদের বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত কমান্ডো বাহিনীর সদস্য। আমাদেরকে যখন তিনি ট্রেনিং করাচ্ছেন তখন তিনি মেজর পদে উন্নীত। আমাদের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ। বিদ্রোহী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার।
মেজর হায়দারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। গুরুর একটা হাত তখন ভাঙা। সিলিংয়ে ঝোলানো। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসার সময়, আর নয়তো ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজের ডেমুলেশনে হাত ভেঙেছেন, অথবা কোনওভাবে হাতে হয়তো গুলি লেগেছে। শক্ত চেহারা। এই মেজরই হবেন সমগ্র ঢাকা এলাকার কমান্ডিং অফিসার। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন সুবেদার হাবিলদার বিভিন্ন অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়াবেন আমাদের।
মেজর হায়দার আমাদের স্যার, আমাদের গুরু, আমাদের চে গুয়েভারা। এ পর্যন্ত বিশ পঁচিশ হাজার গেরিলা যোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়েছেন। এখনও প্রতিদিনই চলছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং। কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন আমাদের স্যার। অসম্ভব শক্তিশালী মানুষটি কখনও ক্লান্ত হন না।
গুরু আমাদের বলতেন মাও সেতুংয়ের গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি, চে গুয়েভারার বক্স অ্যাম্বুশ। শত্রু যখন পালাচ্ছে, তখন আক্রমণ করো। শত্রু যখন তোমাকে ধাওয়া করবে, তখন তুমি পালাবে। শত্রু যখন বিশ্রাম করবে, তখন তাকে আক্রমণ করবে, যাতে বিশ্রাম নিতে না পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সময় চেয়েছিল ১২ সপ্তাহ। বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে ট্রেনিংয়ের সময় কমিয়ে ৬ সপ্তাহ করতে বলে। এই নিয়ে কথাবার্তাও কম হয়নি। পরে ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে।
ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে পাঠানোর আগে মেজর হায়দার আমাদের শপথ পাঠ করান। শপথটা শোনো, মা।
'আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত আছি। আমি আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে- ১. সর্বদা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, সরকারের প্রতি ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি অনুগত থাকিব, ২. আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করিব, ৩. আমাদের শত্রু পাকিস্তানিদের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত থাকিব, ৪. কোনও প্রকার লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হইব না, ৫. কোনও লুটের মাল ছুঁইব না, ৬. নারী ও শিশুদের প্রতি কোনও অশোভন আচরণ করিব না, এবং ৭. মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করিলে কোনও বাঙালিকে হত্যা করিব না এবং হত্যা করিতে সহায়তা করিব না। জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বঙ্গবন্ধু।'
এই শপথ পাঠের পর আমরা লাইন ধরে একজন একজন করে মেজর হায়দারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। মেলাঘর থেকে মতিনগরে পৌঁছলাম। মতিনগরে একজন গাইড ছিল আমাদের। তাঁর সাহায্যে রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে ঢুকলাম। গন্তব্য ঢাকা শহর।
হজরত আবু হুরায়রা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আমি সবার আগে কার সঙ্গে সদাচরণ করিব? রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে।
লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর?
উত্তর এলো, তোমার মা।
লোকটি আবার জানতে চাইল, তারপর কে?
রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইবারও একই জবাব দিলেন, তোমার মা।
ওই লোক চারবারের বার একই প্রশ্ন করল। নবীজী জবাব দিলেন, তোমার পিতা।
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মায়ের সঙ্গে কারো তুলনা হয় না।
তোমার মনে আছে মা, সেইসব দিনের কথা মনে আছে!
সন্ধ্যার পরপর আমরা সবাই পিছন দিককার বারান্দায় বসে আছি। বাবা বাড়িতে নেই। বারান্দায় তুমি আমি বকুল বসে আছি চেয়ারে। কদম পারুল আর বুয়া বসে আছে পুব দিককার দেয়ালে হেলান দিয়ে। বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। খানিক আগে মাগরিবের নামাজ পড়েছে বারেক। নামাজ পড়ার পর গোলাঘরের ওদিকটায় তসবি হাতে পায়চারি করেছে, দোয়া দরুদ পড়েছে। তারপর এসে বারান্দায় বসেছে। বসে কোরআন হাদিসের কথা বলতে শুরু করেছে।
বারেক ফিরেছিল একেবারে অন্য মানুষ হয়ে। মুসল্লি হয়ে। অতি বিনয়ী ভঙ্গি। নম্র গভীরভাবে ধার্মিক এক যুবক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে। অতি সহিহ্ ভঙ্গিতে অজু করে নিজেই আজান দেয়, তারপর ঘরে ঢুকে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর তসবি হাতে পায়চারি করে আর দোয়া দরুদ পড়ে। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে চলে যায় মসজিদে।
বারেক আসার পর বাড়ির পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে গেল।
সে থাকে কদমের ঘরে। ওই ঘরে দুটো চৌকি পাতা। একটায় কদম ঘুমায়, আরেকটা খালি পড়ে থাকে। পুরনো কাঁথা বালিশ ডাঁই করে রাখা। সেই চৌকি এত সুন্দর করে পরিষ্কার করল বারেক! পুরনো ছেঁড়া কাঁথা বিছানো অতি দীন ধরনের বিছানা। বালিশ তেল চিটচিটে, বিক্রমপুরের ভাষায় 'ল্যাড়ল্যাড়া'। ওই কাঁথা বালিশেই বারেকের বিছানাটা আশ্চর্য এক পবিত্রতায় ভরে গেল।
মা, তুমি অবশ্য বারেককে পুরনো ধোয়া একটা চাদর দিয়েছিলে। চাদরটা বেশ বড়। চৌকির চারদিক দিয়ে ঝুলে পড়ত। সেই চাদরে এমনভাবে নিজের কাঁথা বালিশ বারেক ঢেকে রাখত, ছিমছাম পবিত্র একটা ভাব ফুটে থাকত বারেকের বিছানায়।
এক দুপুরে আমি বারেকের ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কদম তার বিছানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার পাশেই নিজের বিছানায় আসনপিঁড়ি করে বসে বারেক খবরের কাগজ দিয়ে অতিযত্নে মলাট দেওয়া নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা শখানেক পৃষ্ঠার কী একটা বই পড়ছে। এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, পাশের বিছানায় শুয়ে, ভালো রকম শব্দ করে একজন মানুষ নাক ডাকাচ্ছে, আর একজন মানুষ আমি, খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছি, বারেক কিছু টেরই পাচ্ছে না।
আশ্চর্য ব্যাপার!
পড়ার জন্য মায়ের মার খেয়ে যে ছেলে মাত্র দশ বছর বয়সে উধাও হয়ে গিয়েছিল, এগারো বছর পর সেই ছেলেই পড়ার প্রতি এমন মনোযোগী হয়ে কোত্থেকে ফিরল?
কে তাকে এমন করে বদলে দিল?
কারা তাকে এমন করে বদলে দিল?
এই এতগুলো দিন কোথায় ছিল বারেক?
খানিক বারেককে দেখে মৃদু শব্দে গলা খাঁকারি দিলাম। আচমকা শব্দে মানুষ সাধারণত একটু হলেও চমকায়। বারেক চমকাল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকাল। হাসিমুখে সালাম দিল। আসসালামু আলাইকুম।
এই আরেক স্বভাব নিয়ে ফিরেছে বারেক। দিনে যতবার যার সঙ্গে দেখা হয় তাকে ততবারই সালাম দেয়। বাবাকে তোমাকে আমাকে আর বকুলকে তো দিচ্ছেই, কদম পারুল বুয়াকেও দিচ্ছে।
বারেকের সালামের চোটে আমরা একটু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। পারুল একদিন ধমকই দিল। এই ছেমড়া, এতবার সেলামালাইকুম দেওনের কাম কী? একবার দিলেই তো হয়?
বারেক হাসিমুখে নম্র গলায় বলল, আসসালামু আলাইকুম অর্থ হইতেছে আপনার ওপর বা তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। দিনে যতবার সালাম দেওয়া যায়, ততবারই আল্লাহপাক তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ করবেন। তুমি যতবার সালামের জবাব দিবা ততবারই যেই মানুষটা তোমারে সালাম দিতাছেন তার ওপর আল্লাহপাক শান্তি বর্ষণ করবেন।
সেই দুপুরে বারেকের সালামের জবাব দিয়ে আমি ঘরে ঢুকলাম। কী পড়ছিস, বারেক?
কিতাব। বুখারি শরিফের ছোট একটা অংশ।
বারেকের পরনে সাদা লম্বা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। নিয়মিতই আতর ব্যবহার করে। শরীর থেকে আসছিল আতরের পবিত্র গন্ধ।
বলল, বসেন মামা, বসেন। বুখারি শরিফে এই মাত্র যা পড়লাম, বলি আপনারে।
আমি বারেকের বিছানায় বসলাম। বারেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, একবার এক ব্যক্তি রাসুলে করিমের কাছে এলো। আইসা বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি জিহাদে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করতেছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি মা-বাবা জীবিত আছেন?
লোকটি জবাব দিল, জি হুজুর, জীবিত আছেন।
রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি তোমার মা-বাবার সেবাযত্নে নিজেকে নিয়োজিত করো।
তার পরই দেখি বারেকের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। গাল ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ সে কাঁদছে কেন?
আমি কথা বলার আগেই বারেক কান্নাকাতর, ধরা গলায় বলল, আমার বাবায় ডাকাইত আছিল। জানি না সে জীবিত আছে, না আল্লাহপাক তারে তুইলা নিছে। ডাকাইত স্বামীর সংসার করে নাই আমার মায়। আমারে বুকে লইয়া সংসার ছাইড়া আইছিল। আমারে ডাকাইত বানাইতে চায় নাই, লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষের মতন মানুষ বানাইতে চাইছিল। আমার রক্ত হইল ডাকাইতের রক্ত মামা। আমার লেখাপড়া ভাল্লাগে না। দশ বচ্ছর বয়সেই আমার মনডা উড়ু উড়ু। ঘরবাড়িতে আমার থাকতে ইচ্ছা করে না। বই লইয়া বইতে ইচ্ছা করে না। ইসকুল আমার কাছে জেলখানা মনে হয়। এই জইন্য মায়ের হাতে মাইর খাইয়া আমি চইলা গেছিলাম। এই বাড়ি ছাইড়া, আপনেগো ছাইড়া আর আমার মারে ছাইড়া চইলা গেছিলাম। অবশ্য চইলা গিয়া আমার ভালো হইছে। আল্লাহপাক আমারে পথ দেখাইছেন। মা কী, আমি বুঝতে শিখছি মামা!
তুই গিয়েছিলি কোথায়? এত দিন কোথায় ছিলি? লেখাপড়া শিখলি কোথায়? এরকমভাবে নিজেকে বদলে ফেললি কেমন করে?
বারেক দুহাতে চোখ মুছল। বলব মামা, বলব। সব আপনাদের বলব। তয় মামা, আমার মারে এগারোটা বচ্ছর আমি যেই দুঃখ দিছি, জানি না আল্লাহপাক আমারে দয়া করবেন কি না। আমার এই গুনাহ তিনি মাফ করবেন কি না! তবে মামা, আমার মায় যুদি আমারে মাফ করে তয় আল্লাহপাকও আমারে মাফ করবেন। এই জইন্য আমি ফিরত আইছি। মার পাও ধইরা পইড়া থাকি, মা, মা গো, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। তুমি মাফ না করলে আল্লায়ও আমারে মাফ করবেন না। তোমার লগে আমি যা করছি এই গুনাহর জইন্য দোজকের আগুনে পুইড়া মরতে হইব আমার। কিন্তু মামা, মায় আমারে মাফ করে না। মার পাও ধইরা এত কান্দি আমি, মায় আমারে মাফ করে না!
বারেক আবার কাঁদতে লাগল।
আমাদের কথাবার্তার কোন ফাঁকে যে কদমের ঘুম ভেঙে গেছে, বারেক, আমি কেউ তা খেয়াল করিনি। আনমনা চোখে কদমের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি কদম তার বিছানায় উঠে বসেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বারেকের দিকে।
কিন্তু বুয়া এত কঠিন হয়ে গিয়েছিল কেমন করে, মা?
আমরা সবাই দেখছি, বাড়ির সবাই দেখছে, সুযোগ পেলেই বারেক তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরছে, অনুনয়-বিনয় করছে, কাঁদছে, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। বুয়া তার কথা পাত্তাই দেয় না। তার যেন কোনও অনুভূতিই নেই। সে যেন পাথর, সে যেন মানুষের মতো দেখতে একটা গাছ!
সেই সন্ধ্যায় বারান্দায় হারিকেন ছিল না।
আমাদের প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা। প্রতিটি ঘরেই জ্বলছে হারিকেন। কদম বারেকের ঘরেও জ্বলছে। বাইরে, বাগানের দিকে, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায়, সর্বত্র ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে, দু-একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছে, উড়ে আসছে। গোয়ালঘরের ওদিকটায় লেজ ঝাপটে মশা তাড়াচ্ছে গরুগুলো। আমরা বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছি।
বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। এক হাতে মায়ের পায়ে কখনও হাত বোলাচ্ছে, কখনও পা টিপে দিচ্ছে।
বুয়া নির্বিকার।
সে বারেকের দিকে তাকায়ই না। আমি দু-একবার বুয়ার মুখের দিকে তাকালাম। বিভিন্ন ঘর থেকে বারান্দায় এসে পড়েছে হারিকেনের আলো। আমাদের পায়ের কাছে, হাতের কাছে, শরীরের কোথাও কোথাও পড়েছে আলো। যারা নিচে বসে আছে তাদের মুখে, চোখে পড়েছে, মাথায় পড়েছে।
বুয়ার মুখে পড়েছিল হারিকেনের আলো। তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না তার চোখ। তবে সে যে বারেকের দিকে তাকিয়ে নেই এটা বোঝা যাচ্ছিল। বারেক ফিরে আসার দিন থেকেই প্রথমবার বারেকের মুখের দিকে সে তাকিয়ে ছিল, ছেলেকে চিনেছিল, বিড়বিড় করে তার নাম উচ্চারণ করেছিল, তারপর...
কিন্তু বারেক যে মায়ের পা ধরছে, পা টিপে দিচ্ছে, বুয়া পা সরিয়েও নিচ্ছে না। যেন ছেলের স্পর্শ সে টেরই পাচ্ছে না। আর ছেলের সঙ্গে কথা সে বলেই না। ছেলে এত যে মা মা করছে, নানা রকমভাবে মাফ চাইছে, বুয়া নির্বিকার। যেন আপন ছেলেকে সে চেনেই না।
বারেক একবার বুয়ার দিকে তাকাল। বারেকের গলা পর্যন্ত হারিকেনের আলো, তার ওপর থেকে আবছা অন্ধকার। আমাদের বারান্দায় আলো-আঁধারির খেলা।
বারেক বলল, সাহাবি আলকামা মারা যাইতেছেন। এই সময় তাঁর জবান থেকে কালেমা বাইর হইতেছে না। খবর পাইয়া নবীজি আসলেন। আলকামার অবস্থা দেইখা তাঁর মারে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আলকামার ওপর নারাজ?
আলকামার মা উত্তর করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ছেলে আমার চেয়ে তার স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত। এই কারণে আমি তার প্রতি নারাজ!
তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যকে হুকুম দিলেন, আলকামাকে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার কইরা দাও।
আলকামার মা এই কথা শুইনা গগনবিদারী চিৎকার দিয়া বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার চোখের সামনে আমার সন্তানরে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার করলে, আমি মা হইয়া কেমন কইরা তা সহ্য করব?
নবী করিম তখন আলকামার মাকে অনুরোধ করলেন, তাহলে আপনার সন্তানরে মাফ কইরা দেন। তা না হইলে অনন্তকাল ধইরা আপনার আলকামা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তা আপনি কেমন কইরা সহ্য করবেন?
এই কথা শুইনা মায়ের মন বিগলিত হইল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরে ক্ষমা কইরা দিলেন।
বারেক একটু থামল।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি বারেকের কথায়। এত সুন্দর করে গুছিয়ে সে মছলা-মাছায়েল বলে, শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই বারেক! সেই দুরন্ত, দুষ্টের শিরোমণি বারেক! যে তার মায়ের মুখের ওপর দশ বছর বয়সেই বলত, আমি লেখাপড়া করুম না, আমি ডাকাইত হমু।
এই সেই বারেক!
বারেক থামার সঙ্গে সঙ্গে পারুল বলল, তারপর?
বারেক বলল, তারপর আলকামার জবান থেকে কালেমা তাইয়্যেবা জারি হইয়া গেল। কালেমা পড়তে পড়তে ইমানের সঙ্গে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন!
বারেক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পারুল বলল, নবীজির কথা আরো ক বারেক। শুনি।
আচ্ছা মা, বাবা সেই সন্ধ্যায় কোথায় ছিলেন?
আমি মনে করতে পারছি না, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না!
বাবা কি বাড়িতে ছিলেন?
নাকি স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন?
নাকি গ্রামের কোনও বিচার সালিসে গিয়েছিলেন?
বিচার সালিসে গেলে কদম যায় বাবার সঙ্গে। রাতবিরাতে কদমকে ছাড়া চলাফেরা করেন না বাবা। অন্ধকার রাতে হারিকেন হাতে কদম হাঁটে আগে আগে, বাবা হাঁটেন পিছন পিছন।
কদম সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে! এটা আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে। সেও বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছে।
তাহলে বাবা কোথায়?
মা, বাবা কোথায়?
স্কুলের কাজে ঢাকায়?
আমি বড় হয়ে গেছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, সেই ছেলেবেলার মতো বাবার জন্য কান্নাকাটি করি না। বাবা বাড়িতে না থাকলে ছটফট করি না। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো বদলাতে শুরু করেছিল।
এটাই মানুষের নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে মানুষকে বদলে দেয়। বদলটা হয় এত ধীরে, মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
বকুলের কিশোরী বয়সে বাবা একদিন তোমাকে বলছিলেন, মেয়ের বাবা হওয়ার দুঃখ কী জানো?
কোনও কোনও রাতে বাবার মাথায় তিব্বতের কদুর তেল দিয়ে দিতে তুমি। সারা দিন স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে বাবার মাথাটা গরম হয়ে যেত। রাতে ভালো ঘুম হতো না। কদুর তেল বাবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতেন। রাতের বেলা ওই তেল মাথায় দিলে মাথা ঠাণ্ডা হয়, ঘুম ভালো হয়।
বাবা তাঁর ঘরে চেয়ারে বসে আছেন, পিছন থেকে তুমি তাঁর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছ। মাথার চুল এলোমেলো করে অতিযত্নে মাথা টিপে দিচ্ছ।
এই অবস্থায় কথাটা বললেন বাবা।
শুনে তুমি বললে, কী?
মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তাকে আর কোলে নেওয়া যায় না।
তুমি হাসলে। এইটা খালি মেয়ের বেলায়ই না, ছেলের বেলায়ও। আমি কি রবিরে এখন কোলে নিতে পারি?
তা ঠিক। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে নিজেদের অজান্তেই মা-বাবার সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সম্পর্কের মাঝখানে আবছা একটা আড়াল তৈরি হয়।
আমি বারান্দার দিকে যাচ্ছিলাম। তোমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে কথা বলছিলে শুনে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে শুনলাম ওই কথা। শুনে মন খুব খারাপ হয়েছিল, মা। খুব খারাপ হয়েছিল।
সত্যি তো, যত বড় হচ্ছি ততই দূরে সরে যাচ্ছি তোমাদের কাছ থেকে। যে ছেলে বাবার জন্য ছটফট করত সারাক্ষণ, বাবা ঢাকায় গেলে বারবার তোমাকে বলত, বাবা কবে আসবে, বাবা কখন আসবে! যেদিন বাবার আসার কথা সেদিন সকাল থেকে বাবার জন্য অপেক্ষা। বাবা আসবেন বিকালে, সেই বিকাল যেন হতেই চায় না। সেদিন যেন দিনটা হয়ে যায় অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। সকাল যেন দুপুরই হয় না, দুপুর যেন বিকালই হয় না!
সেই ছটফটে ছেলে এখন বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মা-বাবাকে চিঠি লেখে তাও মাসে একটা দুটো। অতি ধীরে কেমন এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এগারো বছর পর বারেক ফিরে আসাতে কি তেমন এক দূরত্ব বারেকের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল বুয়ার?
না, বারেকের ব্যাপারটাই অন্য রকম!
দিনে দিনে বুয়া জেনেছিল তার ছেলে বেঁচে নেই। সে মারা গেছে। বাঁশঝাড়ের তেনায়ই বারেককে মেরেছেন। সে আর কোনও দিন ফিরবে না। এ কারণে সে ফিরে আসার পর বুয়া প্রথমে হতভম্ব, হতবাক। তারপর তার ভিতর জন্ম নিল অভিমান। গভীর অভিমান। বেঁচে থাকার পরও মায়ের কাছে বারেক ফেরেনি কেন? এগারো বছর কেটে গেছে। এই এতগুলো দিন, এতগুলো বছর সে কোথায় ছিল? কার কাছে ছিল?
মা গো, আমি যুদ্ধ করব তোমার জন্য।
তোমার বুক থেকে যারা রক্ত ঝরিয়েছে, আমার বুক থেকে যারা কেড়ে নিয়েছে আমার মাকে, আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে দেওয়া পর্যন্ত, তাদের বুক থেকে রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত, জন্তুগুলোর প্রতিটিকে শেষ না করা পর্যন্ত আমি যুদ্ধ করব। আমার হাত থেকে ওদের নিস্তার নেই, মুক্তি নেই।
মা গো, আমি যুদ্ধ করব আমার বাবার জন্য।
আমার বাবাকে যারা শেষ করেছে, বাবার বুকের রক্তে যারা ভাসিয়েছে উঠানের মাটি, তাদের রক্ত কাক কুকুরকে না খাইয়ে আমি থামব না। আমি যুদ্ধ করব, আমি ওদেরকে শেষ করে দেব মা, ওদেরকে একদম শেষ করে দেব।
আমি যুদ্ধ করব আমার বোনের জন্য। আমার বকুল ফুলটির জন্য। 'কই গো কই গো কই, আমার বকুল ফুল কই!'
মা গো, আমি আমার বকুল ফুলকে খুঁজি, মা। আমার বোনটিকে খুঁজি। যে বকুল ফুল তার মা-বাবার বুক জুড়ে ছিল, ভাইয়ের বুক জুড়ে ছিল, ভাই যুদ্ধে চলে গেল আর বোন রয়ে গেল মা-বাবার বুকে, ফিরে এসে দেখি, মা গো, ফিরে এসে দেখি কোথায় আমার সেই বকুল ফুল! কোথায় আমার বোনটি! তার ঘরে পড়ে আছে এক ছিন্নভিন্ন বকুল। যেন মাত্র ফুটে ওঠা এক বকুল ফুল পায়ে দলে অথবা দু আঙুলের ডগায় ধরে অবিরাম পিষেছে কোনও জন্তু। আমার বোন আর মানুষের চেহারায় নেই। আমার বকুল আর বকুল নেই।
আমি আমার বকুলের জন্য যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য। আমার মায়ার জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার অনাগত সন্তানের জন্য। ছেলে ছিল মা, আমার সন্তান ছেলে ছিল। আমি আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করব। পিতা যুদ্ধ করবে পুত্রের জন্য।
আমি যুদ্ধ করব বুয়া পারুল আর কদমের জন্য। আমি যুদ্ধ করব বারেকের জন্য। আমি যুদ্ধ করব দেশের সাত কোটি বাঙালির জন্য।
আমি যুদ্ধ করব আমাদের গোয়ালের গরুগুলোর জন্য, বাড়ির হাঁস মুরগিগুলোর জন্য, ছাগলছানা দুটো, বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটা আর খোপভর্তি পায়রাগুলোর জন্য। আমি যুদ্ধ করব বাগানের গাছপালার জন্য, বর্ষার পানি আর পানির তলার মাছের জন্য। বাঁশঝাড়গুলোর জন্য আমি যুদ্ধ করব, আমি যুদ্ধ করব বাঁশঝাড়ের তেনার জন্য। তেনায় থাকুন তাঁর মতো, তাঁকে রক্ষা করার জন্য আমি যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব বাগানের পাখি, প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের জন্য, মাছি আর মশাগুলোর জন্য। ঝিঁঝিপোকা আর ইঁদুর ব্যাঙের জন্য। আমি যুদ্ধ করব মাথার ওপরকার আকাশ, বয়ে যাওয়া হাওয়া আর বৃষ্টির জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার নিজস্ব রৌদ্রটুকুর জন্য। আমার ছয়টি ঋতু, মানুষের ঘরবাড়ি আর ফসলের মাঠ, আমার নদী আর বিল-বাঁওড়, আমার নিজস্ব পায়ে চলা পথটুকুর জন্য আমি যুদ্ধ করব।
আমি যুদ্ধ করব দেশের প্রতিটি ঘাসের জন্য। সবুজ ঘাসের ডগায় লাল একটুখানি ফুলের জন্য। ফুলের সুবাস আর আকাশের চাঁদের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমার বাউল ফকির আর ভাটিয়ালি গানের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমি যুদ্ধ করব আমার স্বাধীনতার জন্য, আমার দেশের মাটির জন্য। 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা'। আমি যুদ্ধ করব আমার কবরের জমিটুকুর জন্য, আমার সাড়ে তিন হাত ভূমির জন্য।
আমার কী হয়েছে, মা!
কী হয়েছে আমার!
এই যে তোমার কবর খুঁড়ছি আমি, তোমার মাথা মুখ আর শরীর ভরে আছে চাঁদের আলোয়, তোমার গা থেকে জমাটবাঁধা রক্তের গন্ধও পাচ্ছি, সকাল থেকে রাত, তোমাদের লাশ পড়ে আছে বাড়িতে, শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি নেই, আকাশে চাঁদ, গরম তেমন নেই, আবার আছেও, তার পরও শরীরে এখনো পচন ধরেনি কারো।
নাকি ধরেছে, মা!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধশূন্য মানুষ কি বুঝতে পারে এসব!
সোহাগপুরের কথা শুনবে, মা?
সোহাগপুর হচ্ছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায়। সোহাগপুর গ্রামের একটি পাড়ার নাম বেণুপাড়া। এই কদিন আগে, জুলাই মাসের ২৫ তারিখ, পাকিস্তানি... ...গুলো আর ওদের এদেশীয় ওইগুলো নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাল বেণুপাড়ায়। বেণুপাড়ার প্রতিটি পুরুষ মানুষকে মেরে ফেলল। মোট ১৮৭ জন পুরুষ, মা। ১৮৭ জন পুরুষ। বেণুপাড়া পুরুষশূন্য হয়ে গেল। বেণুপাড়া বিধবা পল্লী হয়ে গেল।
আর নারীদের ওপর যে অত্যাচার হলো না, মা, তোমাকে সে কথা আমি বলতে পারব না। তোমাকে বলি চুকনগরের কথা।
চুকনগর কোথায়?
চুকনগর হচ্ছে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানায়। খুলনা, যশোর আর সাতক্ষীরার মিলনস্থল। চুকনগর বাজারের ভিতর দিয়ে যশোর সাতক্ষীরার মহাসড়ক এবং খুলনা সড়ক। বাজারের উত্তর পাশে ভদ্রা নদী। খুবই খরস্রোতা নদী।
মে মাসের ২০ তারিখ।
চুকনগরে এসে আশ্রয় নিয়েছে পিরোজপুর বাগেরহাট গোপালগঞ্জ আর খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার হিন্দু পরিবার। পাকিস্তানি... ...গুলোর হাত থেকে বাঁচার আশায়, ওদের দোসর... ...গুলোর হাত থেকে বাঁচার আশায় চুকনগরে এসেছে তারা। বাজারের ভিতর দিয়ে ভারতে চলে যাবে। বাজারে জড়ো হয়েছে অসহায় হাজার হাজার মানুষ।
এই খবর রাজাকাররা পৌঁছে দিল ওদের প্রভুদের কাছে।
আর কথা কী?
বাজারের দুদিক থেকে পাকিস্তানি... ...গুলোর দুটো গাড়ি ঢুকল চুকনগর বাজারে। ঢুকেই শুরু করল গুলি।
তখন সকাল এগারোটা।
এগারোটা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত চার ঘণ্টা মুষলধারায় গুলি চালাল ওরা। তিনটার পর যখন বাজার ছেড়ে চলে গেল তখন চুকনগর বাজার এক মৃত্যুপুরী। চারদিকে শুধু লাশ শুধু লাশ। মানুষের রক্ত বয়ে যাচ্ছে ভদ্রার খরস্রোতা পানির মতো।
মা গো, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে সেদিন স্থির হয়েছিল নদীর বয়ে যাওয়া পানি, মাথার ওপরকার আকাশ, আকাশের সূর্য আর ভেসে যাওয়া মেঘমালা। এই হত্যাকাণ্ড দেখে বইতে ভুলে গিয়েছিল বাংলার হাওয়া, গাছপালা হয়েছিল মৃতের মতো স্থির। নিজের অজান্তে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বাংলার মাটি। শ্বাস ফেলতে ভুলে গিয়েছিল পানির তলার মাছ, আকাশে উড়তে ভুলে গিয়েছিল সোনালি ডানার চিল, ডাকতে ভুলে গিয়েছিল পাখিরা।
মাত্র চার ঘণ্টায় কত মানুষ মারল ওরা জানো, মা?
বিশ হাজারের বেশি, মা। বিশ হাজারের বেশি মানুষ।
চুকনগর গণহত্যার কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে পাবলো নেরুদার সেই বিখ্যাত কবিতার কথা। কবিতার নাম 'ধর্ষিতা দেশ'।
'এই ভয়ংকর রক্তাক্ত ক্ষত কিছুতেই শুকোবার নয়
জয়লাভেও না
কিছুতে না সমুদ্র সিঞ্চনে না
সময়ের সিক্ত সৈকত অতিক্রম করে এলেও না
কবরের মাটিতে জ্বলন্ত জেরেনিয়াম ফুটলেও না'
পৃথিবীর কোনও দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে মাত্র চার ঘণ্টায় বিশ হাজারের বেশি মানুষ এক জায়গায় এভাবে হত্যা করার ইতিহাস নেই, মা। এত বড় গণহত্যার নজির নেই।
গণহত্যা শেষ করে যখন ওরা চলে যায় তখন চুকনগর বাজারে ছুটে আসে এলাকার বেঁচে যাওয়া মানুষজন। লাশের পর লাশ, লাশের পর লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তারা। কাঁদতে থাকেন কেউ কেউ, কাঁদতে ভুলে যান কেউ কেউ।
চুকনগরের পাশের গ্রাম মালিথা। সেই গ্রামের দরিদ্র কৃষক এরশাদ। তিনিও ছুটে এসেছিলেন চুকনগর বাজারে। লাশের স্তূপ দেখে বাকরুদ্ধ মানুষটি বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান এক মৃত মায়ের বুকের দুধ পান করে চলেছে তাঁর কোলের অবুঝ শিশুকন্যা। মায়ের শরীরের তলায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ওই অবুঝ শিশু এসবের কী বোঝে! সে পান করছে মায়ের দুধ। মৃত মায়ের হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর।
অতি দরিদ্র কৃষক এরশাদ পরম মমতায় কোলে নিলেন সেই শিশুকে। যেন নিজের সন্তানকে কোলে নিয়েছেন তিনি, বুকে নিয়েছেন।
বাড়ি এসে স্ত্রীর কোলে দিলেন শিশুটিকে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘটনা বললেন। তাঁর মতোই গভীর মমতায় শিশুকন্যাটিকে বুকে নিলেন এরশাদের স্ত্রী। সেই মুহূর্তে তিনি হয়ে গেলেন শিশুটির মা।
আমাদের মুন্সীগঞ্জে কবে এলো পাকিস্তানি... ...রা জানো, মা?
মে মাসের ৮ তারিখে। এসে উঠল হরগঙ্গা কলেজ হোস্টেলে। ওখানেই ক্যাম্প করল। মুন্সীগঞ্জে ঢুকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, বঙ্গবন্ধুর প্রধান দেহরক্ষী মহিউদ্দিন আহমদ এবং কারো কারো বাড়িতে আগুন দেয়। ছোট্ট শহর মুন্সীগঞ্জ কাঁপতে লাগল পাকিস্তানি... ...গুলোর নৃশংসতায়। প্রতিদিনই শহরের ছাত্র যুবকদের ধরে আনত ক্যাম্পে। অমানুষিক নির্যাতন চালাত। কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি ঘেরাও করে দশ-বারোজন যুবক বৃদ্ধ কিশোর ধরে এনে লোহারপুলের খালের ওখানটায় সার ধরে দাঁড় করায়। তারপর গুলি। লাশ পড়ে গেল খালের পানিতে।
এসব মানুষের অপরাধ কী, মা?
এরা দেশ ভালোবাসে!
এরা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়?
মাতৃভূমিকে ভালোবাসা ইমানি দায়িত্ব, মা! প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব তার দেশকে ভালোবাসা। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুুষের বড় ধর্ম। মানুষ তার পরিবার-পরিজন আর দেশকে জন্মগতভাবেই ভালোবাসে। মা মাতৃভাষা মাতৃভূমি এই তিনটি জিনিস মানুষের কাছে অনেক সময় নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মহামূল্য সম্পদ। মাতৃভূমি কিংবা জন্মস্থানের প্রতি মানুষের থাকে প্রবল আবেগ, আকর্ষণ, প্রবল ভালোবাসা আর মমত্ববোধ। ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম শুধু আবশ্যক না, অত্যাবশ্যক।
মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে লোক তার দেশকে ভালোবাসে না সে প্রকৃত ইমানদার না।'
দেশের জন্য ভালোবাসা না থাকলে, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা, মায়া-মমতা না থাকলে সেই মানুষ দেশের জন্য কোনও কিছু ত্যাগ করতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান সম্মান, স্বাধিকার ও ইমান আমল রক্ষা করা যায় না। দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ইমান ও আমল ভিত্তিকই হতে হবে। ইমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে।
একটি আরবি প্রবাদ আছে, 'হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ইমান।' অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।
মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মক্কার কাফেরদের নির্মম নির্যাতন চলছিল তাঁর ওপর। নির্মম অত্যাচারের পর নিজের জাতিই তাঁকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল। তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। যখন তিনি মক্কা ত্যাগ করেছিলেন সেই মুহূর্তে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মক্কার দিকে। কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, 'হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি! আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।'
নিজের দেশকে হেফাজত করতে না পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষকে রক্ষা করা যায় না, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায় না। দেশপ্রেম জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়।
এসব কথা বলেছিল বারেক।
আমি প্রায়ই দুপুরের দিকে কদম বারেকের ঘরে যাই। কদম নাক ডাকিয়ে ঘুমায় আর বারেক বিভিন্ন কিতাবে পড়া নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। এক দুপুরে বলল এসব কথা।
আমি তখন বারেককে খুবই পছন্দ করতে শুরু করেছি। কী বারেক, কী হয়ে গেছে! কেমন করে, কোন ফাঁকে এমনভাবে বদলে গেল সে!
বারেকের কথা মনে পড়ছে, মা। বুয়ার কথা মনে পড়ছে।
কিন্তু কেন মনে পড়ছে তাদের কথা! নিজের মায়ের কবর খুঁড়ছে যে ছেলে, সেই ছেলের কেন মনে পড়বে আরেক ছেলের কথা! কেন মনে পড়বে আরেক মায়ের কথা!
আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মা। আমার মনে পড়ার কথা তোমাকে। তোমার কত দিনকার কত কথা, কত স্মৃতি। আমার জন্য কত চোখের পানি তোমার। কত কান্না, কত হাহাকার।
এসএসসি পরীক্ষা দিতে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে থাকব, মাত্র দিন বিশেকের ব্যাপার, তাও তুমি কাঁদছ! ঢাকায় গিয়ে কলেজে পড়ব, খালার কাছে থাকব, তোমার বাড়িতেই থাকব, তাও তুমি কাঁদছ!
বাবার স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে বকুলও চলে গেল ঢাকায়। ইডেন কলেজে পড়বে। মায়াও পড়ত ওই কলেজে। তোমার দুই ছেলেমেয়ে দুজনই ঢাকায়, চোখের আড়ালে। ছেলেমেয়ের জন্য দিনে এক-দুবার তুমি কাঁদছই! আহা রে, এত নরম মন তোমার! এত মায়াভরা মন!
প্রথমবার কলেজ ছুটির পর বাড়ি এসেছি, ফিরে যাওয়ার আগের সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। রাতের বেলা আমরা সবাই খেতে বসেছি। তুমি চোখ মুছছ আর আমার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছ। তোমার দিকে তাকিয়ে এত মন খারাপ হলো আমার, আবার একটা চালাকিও এলো মনে। বললাম, একটা কাজ করো, মা...
শুনে তুমি তো চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেই বাবা আর বকুলও তাকাল।
তুমি চোখ মুছে বললে, কী করতে কছ?
আমার সঙ্গে চলো।
কই যামু তোর লগে?
ঢাকায়।
তারপর?
তারপর আবার কী! আমার সঙ্গে থাকবে। তাহলে আর কান্নাকাটি করতে হবে না তোমাকে। আমি সারাক্ষণ তোমার চোখের সামনেই থাকব।
আর এইদিকে কী হইব? বকুলরে কে দেখব? তোর বাবারে কে দেখব?
এসএসসি পাসের পর বকুলও চলে যাবে ঢাকায়। এখন শুধু ছেলের জন্য কাঁদছ, তখন ছেলেমেয়ে দুজনের জন্যই কাঁদবে। এত কান্নাকাটি না করে ঢাকায় চলো। বকুল ঢাকায় গিয়ে মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ভর্তি হোক। ওখান থেকে এসএসসি দিক।
তোর বাবা কি একলা থাকবে বাড়িতে?
বাবাকেও নিয়ে চলো।
বাবা হাসলেন। আর আমার স্কুল?
মুখের ভাত গিলে বললাম, তুমি একটা কাজ করতে পারো, বাবা। অনেক দিন তো স্কুল চালালে, এখন অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে রিটায়ার করো। সবাই মিলে ঢাকায় চলে যাই। ঢাকায় থাকি।
বাবা বললেন, সেটা কখনোই সম্ভব না।
কেন?
আমি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার স্কুল ফেলে কোথাও যাব না।
তাহলে আমার মা সব সময় আমাদের জন্য কেঁদেই যাবে?
বরং অন্য একটা কাজ করা যায়।
কী কাজ?
তোর মা তোদের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে থাকল, আমি থাকলাম বাড়িতেই। কদম ওরা আছে, ওরা আমার দেখাশোনা করবে।
আমি তোমার দিকে তাকালাম। কী বলো, মা? এটা তো ভালো প্রস্তাব।
তুমি চোখ মুছে বললে, ভাত খা। আর কথার দরকার নাই।
বাবাকে ছেড়ে তুমি যে যাবে না তা তো আমি জানতামই। এসব কথা তুলেছিলাম তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য। বকুল আমার চালাকিটা ধরে ফেলেছিল। হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝতে পারো নাই মা, তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য দাদা এসব কথা বলল।
বকুলটা খুব বুদ্ধিমতী হয়েছিল, মা। খুব বুদ্ধিমতী।
আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলে বড় ভাইকে দাদা বলার নিয়ম। বহু বহুকাল ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ছিল বলেই এই নিয়ম কি না, কে জানে!
বকুল আমাকে দাদা বলে ঠিকই কিন্তু দাদার সঙ্গে 'তুই'। দাদা তুই।
আহা রে আমার বোনটি! আহা রে আমার বকুল ফুলটি!
চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। তোমার আমার শরীরে বিকালবেলার কোমল রোদের মতো পড়েছে জ্যোৎস্না। তোমার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মা। চোখ বুজে যেন ঘুমিয়ে আছ তুমি। নিথর প্রশান্ত মুখ। বন্ধ চোখের ওপর পড়েছে চাঁদের আলো। শ্রাবণ রাতের একটু একটু হাওয়া আসছে। সকালবেলার গোলাগুলির শব্দে আকাশ পাতালে উড়ে গিয়েছিল যেসব পাখি, থেমে গিয়েছিল বাড়ির পোকামাকড়, ইঁদুর, ব্যাঙের চলাচল আর ডাকাডাকি, তারা বোধ হয় ভুলে গেছে সকালবেলার স্মৃতি। ঝিঁঝি ডাকছে গলা খুলে। সঙ্গে নানা ধরনের রাতপোকা। রাতের প্রাণী বাদুড় ওড়াউড়ি করছে বাগানের দিকে। দু-একটা রাতপাখি ডাকছে।
দূরে ডাকছে, নাকি আমাদের বাড়িতেই!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মা। আমার কাছে সব কিছুই বহুদূরের মনে হচ্ছে। কদম পারুল আর বুয়া কোথায় গেল! বারেকের হদিস তো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নেই। আমাদের বল্টু, বল্টুকে কি নিয়ে গেছে কোনো রাজাকার?
না, তা হওয়ার কথা না।
বল্টু মহা তেজি। অন্য কেউ তাকে নিতে পারবে না। ঘেউ ঘেউ করে খাবলে ধরবে পা। কামড়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে।
তাহলে বল্টুর কী হলো!
বল্টুকে কি গুলি করে মেরেছে ওরা?
নিশ্চয়ই ওদেরকে দেখে তেড়ে গিয়েছিল বল্টু। তখনই গুলি করেছে বল্টুকে। অথবা বল্টু তার স্বভাবমতো উঠানের কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল। অথবা বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘরের ওদিকে ছিল। গুলির শব্দে দিশাহারা হয়ে সামনের দিকে ছুটে এসেছিল। অথবা দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। তখনই গুলি করা হয়েছে। গুলি খেয়ে সে হয়তো ছিটকে গিয়ে পড়েছে বর্ষার পানিতে। এতক্ষণে হয়তো মরে ফুলে উঠেছে আমাদের বল্টু।
আর মিনি! অমন সাদা ধবধবে আদুরে বিড়াল। তাকে নিশ্চয়ই কোলে তুলে আদর করতে করতে নিয়ে গেছে... ...গুলোর কেউ।
কিন্তু একবার যে আমার মনে হলো পায়রার একটুখানি শব্দ এলো। পায়রার খোঁয়াড়, হাঁস মুরগির খোঁয়াড় সবই ওরা নিয়ে গেছে, এমনকি আমাদের ঢেঁকিটাও নেই। গোলাঘরে পড়ে নেই এক দানা ধান। শুধু বাড়ির ইটগুলো খুলে নিতে পারেনি। পারলে সেগুলোও নিয়ে যেত।
গুলির শব্দে পায়রাগুলো উড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। কোথায় কোন দিকে গিয়েছিল কে জানে।
কোনওটা কি ফিরে এলো!
খোঁয়াড়ে নিশ্চয় ছানা ছিল। দু-চারটা ছানা তো সব সময়ই থাকছে কোনও না কোনও খোপে। ছানার মায়ায় কি ফিরে এলো কোনও পায়রা!
বিকাল থেকে আমি বাড়িতে। তখন তো কোনো পায়রার ডাক শুনলাম না, দেখলামও না কোথাও। এমনকি কাক শালিকের ডাকও শুনলাম না, চোখেও দেখলাম না। গোলাগুলির শব্দে পাখিরা সব পালিয়েছিল। আর বেশির ভাগ পাখিই তো রাতকানা। রাতের বেলা চোখে দেখে না। তাহলে রাতের বেলা কেমন করে ফিরবে পায়রা! পূর্ণিমা রাত হোক আর যা-ই হোক, দিনের পাখি কখনও রাতে বেরোবে না।
আসলে ডাক বোধ হয় আমি শুনিনি, মা।
ওসব আমার মনের ভুল।
বিভ্রম।
নাকি উড়তে পারে না এমন কোনও পায়রা...
আচ্ছা মা, আমি এত পায়রা পায়রা করছি কেন? আমরা তো বলি কবুতর! কবুতর না বলে আমি সমানে পায়রা বলে যাচ্ছি!
এলোমেলো, সব এলোমেলো, মা।
আমাদের কবুতরগুলোর কোনওটা হয়তো ভালোমতো উড়তে পারে না। হয়তো কোনও ছানা উড়তে শেখার চেষ্টা করছে। ওরা যখন বাড়ির মানুষজন শেষ করে লুটপাট চালাচ্ছে, খোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে কবুতরগুলোর যেটা যেদিকে পারে উড়াল দিয়েছে, ওরকম সদ্য উড়তে শেখা কোনও কবুতর উড়াল দিয়ে হয়তো বেশিদূর যেতে পারেনি, কোনও গাছের ডালে, পাতার আড়ালে গিয়ে বসেছে, সে হয়তো কোনও শব্দ করেছে।
শেষ বিকালে বাড়ি ঢুকে তোমাদেরকে দেখে, প্রথমে বাবাকে উঠানে পড়ে থাকতে দেখে, বসার ঘরে তোমাকে, বকুল মায়া আর মায়ার গর্ভজুড়ে আমার ছেলে সব দেখে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঢুকলাম মায়া আর আমার রুমে।
না না, মায়াকে দেখার আগেই ওকে খুঁজতে ঢুকেছিলাম আমার রুমে। সেই রুমে কিছুই নেই। সব লুটপাট হয়ে গেছে। এককোণে পড়ে আছে কতগুলো ছেঁড়াখোঁড়া জীর্ণ পুরনো খবরের কাগজ। ওই দিকটায় ওদের বোধ হয় চোখ পড়েনি। চোখ পড়লেই বা কী! ওই জিনিস দিয়ে কী করবে? ওগুলো ওরা ছুঁয়েও দেখেনি। দু পয়সার মূল্য নেই।
কিন্তু ওর তলায় ছিল মহামূল্য এক সম্পদ। কাগজগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার সে কথা মনে পড়েছিল। বাড়িতে ঘটে গেছে এত বড় সর্বনাশ, সে কথা ভুলে গেলাম। পাগলের মতো হাতড়াতে লাগলাম কাগজগুলো। তলার দিকে পেয়ে গেলাম আমার সম্পদ। আমার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সবুজ জমিনের ওপর লাল টকটকে সূর্য। সূর্যের বুকে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র।
গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে, মনিজা রহমান গার্লস স্কুল ছাড়িয়ে ফারুক ভাইদের বাড়ির সামনে কাশেমের মুদি দোকান আর মোসলেমের দর্জি দোকান। অতিযত্নে মোসলেম দর্জি এই পতাকা আমাকে তৈরি করে দিয়েছিল। বাড়ি আসার সময় পতাকাটা নিয়ে এসেছিলাম। মায়ার হাতে দিয়েছিলাম। কী মনে করে পুরনো খবরের কাগজের তলায় যত্নে রেখে দিয়েছিল মায়া।
রুমে ঢুকে, ফাঁকা শূন্য রুম, কোথাও কিছু নেই; শুধু এককোণে পড়ে আছে খবরের কাগজগুলো, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়েছে পতাকার কথা। আমি পাগলের মতো কাগজগুলো এলোমেলো করে বের করলাম পতাকা। সেই পতাকা ভাঁজ করে পেঁচিয়ে বাঁধলাম মাথায়। যেন একজন বীর যোদ্ধা তার প্রাণপ্রিয় পতাকা মাথায় বেঁধে শত্রুর বিরুদ্ধে এখনই শুরু করবে ভয়াবহ যুদ্ধ। শত্রু শেষ না করে থামবে না।
এই পতাকাই এখন আমার একমাত্র শক্তি, মা। এই পতাকাই এখন আমার সব কিছু।
আমি আমার পতাকার জন্য যুদ্ধ করব।
আমি আমার জাতীয় সংগীতের জন্য যুদ্ধ করব।
'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'।
সেই যে চৈত্র মাসের দুপুরবেলা মুসাফির বারেক ফিরে এলো, বুয়া চিনতে পারল তার ছেলেকে। বারেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে ছেলের নাম উচ্চারণ করল, বারেক দুহাতে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, পুরো বাড়িতে খবর হয়ে গেছে। আমরা যে যেখানে ছিলাম পেছন দিককার উঠানে চলে এসেছি। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, বিড়বিড় করে বারেকের নাম উচ্চারণ করার পর, বারেক মাকে জড়িয়ে ধরার পর, বুয়াও দুহাত তুলল ছেলেকে জড়িয়ে ধরার জন্য, তার পরই তার হাত থেমে গেল। তার হাত নেমে গেল। বারেকের মতো করে বারেককে সে জড়িয়ে ধরল না। দাঁড়িয়ে রইল পাথর হয়ে, গাছ হয়ে।
কেন?
কেন এমন করল বুয়া?
আমি খুবই অবাক। বুয়ার চোখে পানিও নেই। যেন ধরেই নিয়েছিল তার ছেলে নেই, বাঁশঝাড়ের তেনায় বারেককে মেরে পচা পুকুরের কাদার তলায় এমন করে পুঁতেছে, লাশও কোনও দিন ভেসে উঠবে না।
আর বারেকের জন্য তার কান্না!
দিনদুপুরে!
রাতদুপুরে!
বিলাপ করে কান্না। বারেক রে, আমার বারেক। ও আমার বাজান, আমারে ছাইড়া তুই কই চইলা গেলি? ক্যান চইলা গেলি? আমি নাইলে তরে একটু মারছিলাম, এর লেইগা এত বড় কষ্ট মারে দিলি? এত বড় শাস্তি মারে দিলি? অহন তরে ছাইড়া আমি বাঁচি কেমনে! ও বাজান, বাজান।
রাতদুপুরে বুয়ার কান্নায় স্তব্ধ হতো ঝিঁঝিপোকারা, চলাফেরা বন্ধ করত ইঁদুর ব্যাঙ রাতপোকারা। আকাশে ডানা মেলা বাদুড় আর দূরে অদূরে থেকে থেকে ডাকতে থাকা রাতপাখিরা থেমে যেত।
দুই ধরনের রাতপাখি দু চার ছ মাসে এক দুবার ডাকত আমাদের বাঁশঝাড়ের ওদিকে, বাচ্চুদের বাড়ির ওদিকে। গভীর রাতে ডাকত।
একটা পাখি ডাকত কু কু করে। কু শব্দে একটা ডাক দিয়ে থামত, মিনিটখানেক পর আবার ডাকত। এরকমই ডাকার স্বভাব পাখিটার। দেশগ্রামের লোকে বলত 'কুপাখি'। মানে খারাপ পাখি।
কেন খারাপ পাখি?
এই পাখির ডাকের সঙ্গে কু শব্দটা আছে। যে বাড়িতে ডাকে, সেই বাড়িতে খারাপ কিছু ঘটে।
ছেলেবেলায় শোনা এসব কুসংস্কারের কথা। তবু আমরা বিশ্বাস করতাম। রাতদুপুরে কুপাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙলে সহজে আর ঘুম আসত না।
আমাদের বাড়িতে ডাকছে না তো পাখিটা! আমাদের বাড়িতে খারাপ কিছু ঘটবে না তো! বড় রকমের কোনও অসুখবিসুখ কারো কিংবা অন্য রকমের কোনও বিপদ! অজানা আতঙ্কে কাঁপত বুক।
অন্য পাখিটা হচ্ছে নিমপাখি।
এই পাখির ডাকার স্বভাবও কুপাখির মতোই। নিম শব্দে একটা ডাক দিয়ে তিরিশ সেকেন্ড বা মিনিটখানেকের গ্যাপ, তারপর আবার 'নিম'। ডাকটা অদ্ভুত ধরনের। যেন ছোট্ট কোনও বিড়ালছানা ডাকছে। সরু বিড়ালগলায় 'মিউ' না ডেকে ডাকছে 'নিম'।
গভীর কোনও রাতে এই পাখির ডাক শুনলেই গা শিউরে উঠত আমার। পরদিন এই নিয়ে আলোচনা হতো বাড়িতে। হয়তো আমার মতো ডাকটা শুনেছ তুমি আর বাবা। বকুলও হয়তো শুনেছে। কিংবা আমরা কেউ শুনিনি, শুনেছে কদম অথবা বুয়া পারুল। দশ বছর বয়স পর্যন্ত হয়তো বারেকও শুনেছে।
যে-ই শুনে থাকুক, পরদিন নিমপাখি নিয়ে আলোচনা হতো সকালবেলাই।
বিক্রমপুর অঞ্চলে নিম শব্দের অর্থ হচ্ছে 'নেব' অথবা 'নিয়ে যাব'। যে বাড়িতে রাতদুপুরে এই পাখি ডাকে, সেই বাড়ির কাউকে না কাউকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ মৃত্যু এসে নিয়ে যায়। বাড়ির কেউ না কেউ মারা যায়।
কুসংস্কার।
গ্রাম্য কুসংস্কার।
বুজরকি।
বুয়া আবিষ্কার করেছিল, যেদিন বারেক উধাও হলো, তার কয়েক দিন আগের এক রাতে এই বাড়ির দক্ষিণ দিকটায়, যেদিক দিয়ে বাড়িতে আমি আজ উঠলাম, ওই দিকটায়, তেঁতুলগাছে কুপাখি ডেকেছিল। বাড়ির কেউ শোনেনি, শুধুমাত্র সে শুনেছে। তখন থেকেই নাকি তার বুক কাঁপত।
কিছু একটা কু ঘটনা এই বাড়িতে ঘটবে।
বারেক উধাও হওয়ার আগের রাতে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় তিনবার পরিষ্কার নিমপাখির ডাক শুনেছে বুয়া।
ও, আরেকটা কথা। নিমপাখি দিনের বেলা কোথায় কোন গাছের ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে থাকে, ওই পাখি চোখেও দেখে না কেউ। চেনেও না। রাতের বেলা, তাও গভীর রাতে গাছপালা থেকে নেমে আসে, ঝোপঝাড়ে থাকলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর যে বাড়ির মানুষকে সে নেবে, সেই বাড়ির মাটিতে নেমে একটা করে ঠোকর দেবে, একটা করে ডাক দেবে।
অর্থ হচ্ছে এই বাড়ির কাউকে মৃত্যুর ডাক দিচ্ছে।
কবরে নেওয়ার ডাক দিচ্ছে।
মাটির তলায় নেওয়ার ডাক দিচ্ছে।
আমাদের ছেলেবেলা আচ্ছন্ন করেছিল এই সব কুসংস্কার। বাঁশঝাড়ের তেনায়, কুপাখি নিমপাখি, এ রকম কত কী!
তবে ওই কুপাখি আর নিমপাখির ডাক নিয়েও বিলাপ করত বুয়া। যেই রাইত্রে কুপাখির ডাক হুনছি, আমার কলিজা কাঁপছে। কী জানি হয়! আর যেই রাইত্রে নিমপাখি ডাকছে, ওই রাইত্রে ডরে আমি ঘুমাইতেই পারি নাই। হায় হায় রে, তখন কি আর বুঝছি, ওই পাখি আমার পোলারেই নিব! বাঁশঝাড়তলায় নাইমা ডাকছে, ওইখানেই মরছে আমার পোলায়।
এই পাখির রহস্য আমি বড় হয়ে বুঝেছি। জানি না কী পাখি। দেশগ্রামের সব পাখিই তো আর চিনি না। হয়তো এমন এক পাখি, যে পাখি দিনের পাখি না, রাতের পাখি। দিনে গাছপালা ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘুমায়, বেরোয় রাতে। রাতপাখি। গাছপালার তলার পরিষ্কার মাটিতে, গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় রাতের বেলা গর্ত থেকে বেরোয় নানা ধরনের পোকামাকড়। এই পাখি হয়তো ঠুকরে ঠুকরে সেই সব পোকামাকড় ধরে খায় আর ডাকে। সেই ডাককেই কুসংস্কার বানিয়েছে মানুষ। কেউ হয়তো কোনও রাতে দেখেছে ওই পাখি। মাটিতে পোকামাকড় ঠুকরে খাচ্ছে আর ডাকছে, দু-চার দিনের মধ্যে হয়তো সেই বাড়িতে মারা গেছে কেউ, তৈরি হয়ে গেছে কুসংস্কার।
কুসংস্কার এভাবেই তৈরি হয়।
তবে বাঁশঝাড়ের তেনায় যে বারেককে মারেনি, নিমপাখির ডাকে যে মারা যায়নি বারেক, এগারো বছর পর তার ফিরে আসাই প্রমাণ করল সব।
একটা রহস্য রয়ে গেল।
বুয়ার ভাষায় কুপাখি ডেকেছিল। দুর্ঘটনা একটা ঘটেছিল আমাদের বাড়িতে। বারেকের উধাও হয়ে যাওয়া।
কিন্তু বারেকটা গিয়েছিল কোথায়?
মা গো, নিমপাখির কুসংস্কারটা আজ আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। আমার মনে হচ্ছে, কাল রাতে আমাদের বাড়িতে, বাড়ির সামনের দিককার উঠানে, যেখানে এখন তোমার লাশ, বাবার কবর, পিছন দিককার উঠানে, যেখানে পড়ে আছে মায়া আর আমার অপুষ্ট ছেলের লাশ, এই দুটো জায়গায় নিমপাখি নেমেছিল। কাল রাতে সে আর পোকামাকড় ঠুকরে খায়নি। কাল রাতে সে বাড়ির মানুষজনের মৃত্যুবার্তা নিয়ে এসেছিল। মাটিতে ঠোকর দিয়ে অবিরাম ডেকেছিল, নিম নিম।
তোমরা কেউ শুনতে পাওনি, মা?
শুনতে পাওনি নিমপাখির ডাক?
দেখো কী অবস্থা আমার! একবার যুক্তি দিয়ে নিমপাখির স্বভাব ব্যাখ্যা করছি, আরেকবার ফিরে যাচ্ছি কুসংস্কারে!
এলোমেলো।
সব এলোমেলো, মা।
সব এলোমেলো।
কিন্তু বারেক কোথায় চলে গিয়েছিল?
এই এগারোটা বছর সে কোথায় ছিল?
কার কাছে ছিল?
ওভাবে গেলই বা কেন, ফিরেই বা এলো কেন?
পুরো ঘটনা বারেক একদিন বলল। এ রকম এক জ্যোৎস্না রাতে, আমাদের পেছন দিককার বারান্দায় বসে। ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর। আমি তখনও বাড়িতে, বকুল বাড়িতে। বারেকের মুখে মছলা-মাছায়েল শোনার জন্য কদম পারুল বুয়া তুমি আমি বকুল বসেছি। বাবা বাড়িতে। তাঁর রুমে বসে স্কুলের কী সব হিসাব কিতাব দেখছেন।
বারেক সেদিন মছলা-মাছায়েল না বলে শুরু করল তার এগারো বছরের উধাও হয়ে থাকা জীবনের গল্প।
তার আগে যেদিন সে ফিরে এলো, সেদিনকার ঘটনা শেষ করি, মা।
বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারেক। মা, মা গো! আমি তোমার বারেক, মা। আমি তোমার বারেক। তোমারে ছাইড়া আমি চইলা গেছিলাম, আবার তোমার কাছে ফিরত আইছি। তুমি আমারে মাফ কইরা দেও মা, তুমি আমারে মাফ কইরা দেও। আমি তোমার কাছে বিরাট অন্যায় করছি। তোমারে ছাইড়া থাইকা বিরাট গুনাহর কাজ করছি। তুমি না মাফ করলে আল্লাহপাকও আমারে মাফ করব না। রোজ হাশরের দিন আমার মাথার ওপরে নাইমা আসব সূর্য। সূর্যের তাপে আমার মাথার মগজ গইলা গইলা পড়ব। দোজখের আগুনে আমি সারা জীবন জ্বলুম। তুমি আমারে মাফ কইরা দেও, মা।
বারেক জড়িয়ে ধরে আছে বুয়াকে, বুয়া গাছপাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কোনও রাগারাগি না, মান অভিমান না, কান্নাকাটি না একেবারেই নির্বিকার ভঙ্গিতে দুহাতে আলতো করে সরিয়ে দিল বারেককে। একটাও কথা বলল না। রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে বসল। পা দুটো উঠানের মাটিতে।
উঠান থেকে প্রতিটা ঘরই হাত দেড়েক উঁচুতে। বারান্দায় বসে পা ঝোলানো যায়।
সেভাবেই বসেছে বুয়া।
মা তাকে বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে দেখে বারেকও কাঁদতে কাঁদতেই থতমত খেল। তারপর গিয়ে বুয়ার পায়ের সামনে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তার পা। মা, মা গো, আমার ভুল হইয়া গেছে, বহুত বড় ভুল হইয়া গেছে। তুমি মাফ না করলে আমার কোনও গতি নাই। ইহকাল পরকাল দুই কালেই আমি জ্বইলা পুইড়া মরুম।
বুয়ার মুখে তবু কথা নেই। নির্বিকার সে, একেবারেই নির্বিকার। বারেক তার পা ধরে কাঁদছে, এটা যেন কোনও ব্যাপারই না। বারেকের দিকে সে তাকিয়েও দেখছে না। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে গোলাঘরের ওদিককার জামগাছটার দিকে।
বারেককে দেখে যতটা না অবাক আমরা, বুয়ার আচরণ দেখে তার চেয়ে বেশি অবাক।
একি কাণ্ড!
যে ছেলের জন্য এত কান্নাকাটি, এত বিলাপ হাহাকার, সেই ছেলে ফিরে আসার পর এত নির্বিকার মা! এটা কী করে সম্ভব!
বারেকের সঙ্গে কথাই বলে না বুয়া, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখে না। সে থাকে তার কাজ নিয়ে, আগের মতোই আমাদের সংসারের কাজ। যখন তখন বারেক তার কাছে যাচ্ছে, হাতে পায়ে ধরে কাঁদছে। আকুলিবিকুলি করে মাফ চাইছে।
বুয়া নির্বিকার। নিঃশব্দে ছেলের হাত ছাড়িয়ে দেয়। রাগ বিরক্তি ক্ষোভ কোনও কিছুই প্রকাশ করে না। অদ্ভুত এক আচরণ।
বারেকের থাকার জায়গা হয়েছে কদমের ঘরে। সেই ঘরে বসে যখন তখন শিশুর মতো কাঁদে বারেক। কদমকে বলে, কদম মামা, আমার মারে বুঝাও। আমারে মাফ কইরা দিতে কও।
পারুলকে বলে, ও পারুল খালা, মারে বুঝাও। যেই কষ্ট মারে আমি দিছি, ফিরা আইসা মার ব্যবহারে তার থিকা বহুত বেশি কষ্ট পাইতাছি। মারে জিগাও, কী করলে সে আমারে মাফ করব? মায় যা কইব, আমি তা-ই করুম।
কদম পারুল বুয়াকে বোঝায়। বুয়া কানেই নেয় না তাদের কথা। বারেকের নাম উঠলেই নির্বিকার হয়ে যায়। কোনও কাজে থাকলে সেই কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়। কাজ না থাকলে উঠে চলে যায় কোনও দিকে।
বারেক তারপর আমাকে ধরে, বকুলকে ধরে। আমরা দুজন দুভাবে বোঝাই বুয়াকে। আমার আর বকুলের সঙ্গে তো কদম পারুলের মতো ব্যবহার করা সম্ভব না। বুয়া অন্যভাবে আমাদের কথা এড়িয়ে যায়। আমাকে বলে, আমি তোমার কাছে মাফ চাই, দাদা। এইটা লইয়া আমার লগে কথা কইয়ো না।
বকুলকে বলে, মাফ চাই বইন। আমি তোমার কাছে মাফ চাই। ওর নাম আমার সামনে লইয়ো না।
এরপর আমাদের কী বলার থাকে!
বুয়ার বুকের ভিতর যে এত অভিমানী এক মায়ের বাস, এটা বুঝে আমি আর বকুল থেমে যাই।
বারেক সব শেষে ধরে তোমাকে আর বাবাকে। আপনেরা আমার মারে বুঝান। আপনেগো কথা না শুইনা পারব না মায়। মার লগে আমার সম্পর্ক ঠিক কইরা দেন। তার বিনিময়ে আমি সারা জীবন এই বাড়ির কামলা মজুর হইয়া থাকুম, চাকর হইয়া থাকুম।
এক দুপুরে বুয়াকে তুমি আর বাবা ডাকলে।
সেদিন ছুটির দিন। রবিবার। স্কুল বন্ধ। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বুয়াকে বসার ঘরে ডাকলে। আমি আর বকুল দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে। বারেক পায়চারি করছে বারান্দায়। পারুল উঁকি দিয়ে আছে উত্তর দিককার জানালা দিয়ে। কদম তার ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।
তোমরা কী বলবে বুয়া বুঝে গিয়েছিল। বুঝে এমন একটা কাজ করল, তোমাদের দুজনকে বারেকের বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগই দিল না, সরাসরি বাবার পা জড়িয়ে ধরল। আমি আপনের পায়ে ধরি, ওর কথা আপনে আমারে কইবেন না। দরকার হইলে আমারে আপনের পায়ের জুতা দিয়া মারেন, তাও ওর কথা আমারে কইয়েন না। ও আমার কেউ না। আমার পোলা এগারো বছর আগে মইরা গেছে।
বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কোনও কথাই বললেন না। তুমিও কথা বললে না, মা।
এমন অভিমানী মাও হয়, মা!
এমন পাথরহৃদয় মাও হয়!
এমন শীতল কঠিন বরফ হতে পারে কোনও মায়ের মন!
না, পারে না, মা। পারে না। অভিমান একদিন ভেঙে যায়। পাথর একদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়। শীতল কঠিন বরফ একদিন গলে পানি হয়।
বুয়ারও হয়েছিল।
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মায়ের কথা বলি, মা।
পঁচিশ মার্চের দুদিন পরের ঘটনা। সাতাশে মার্চ। সেদিন সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে।
এই মা থাকেন নিউ মার্কেটের উত্তর পাশে, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ওদিকটায়। তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। সেই মায়ের নাম সামসুন নাহার। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে চিটাগাং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, ছোট ছেলের নাম ওয়াকার হাসান, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। মেয়ে ছোট। সে কলেজে পড়ে।
পঁচিশে মার্চের ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মা। সারা রাত জেগে ছিলেন। পরের দিন বাড়িতে অবরুদ্ধ। কারণ শহরে কারফিউ জারি করেছে ... ...গুলো।
বাড়িতে অবরুদ্ধ মা ছটফট করছেন। তিনি খুবই সাহসী মানুষ। আর ততক্ষণে বিভিন্নভাবে জেনে গেছেন কী ঘটে গেছে ঢাকা শহরে। ছাত্র শিক্ষক নিরীহ অসহায় বাঙালিকে কিভাবে হত্যা করেছে ওরা।
সাতাশ তারিখ কারফিউ উঠে যাওয়ার পরপরই ওয়াকারকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন তিনি। রিকশা নিলেন। রিকশায় মা ছেলে সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওদিকে এসেই দেখতে পেলেন গুলিতে ঝাঁঝরা মৃতদেহ পড়ে আছে, এলিফ্যান্ট রোডেও একই দৃশ্য।
হতবিহ্বল মা ছেলে তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখেন। দেখে রিকশাওয়ালা। কারো মুখে কথা নেই।
ও রকম দৃশ্য দেখে কে কথা বলতে পারে, মা?
রিকশা এলো শহীদ মিনারে। যে ভাষার জন্য বাহান্ন সালে বুকের রক্ত দিয়েছিল বাঙালি, ভাষাশহীদ রফিক জব্বার সালাম বরকতের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম যে রাষ্ট্রভাষা, ভাষার জন্য জীবন দান, রক্তের ইতিহাস পৃথিবীর কোনও জাতির নেই। শুধু আমাদের আছে। বাঙালি জাতির আছে। আমাদের সেই বীর ভাষাশহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শহীদ মিনার আমাদের বড় গৌরবের জায়গা। আমাদের বড় অহংকারের জায়গা।
মা ছেলে শহীদ মিনারে এসে দেখেন শহীদ মিনার ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি...গুলো। কামান দেগে মিসমার করা হয়েছে আমাদের গৌরব স্তম্ভ।
মা ছেলে দুজনেই বিস্মিত, ব্যথিত। ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ।
ছেলেকে নিয়ে মা তারপর গেলেন জগন্নাথ হলে।
জগন্নাথ হলে সেই রাতে যেসব ছাত্র ছিল তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। হলের আঙিনায় বিশাল গর্ত করে একসঙ্গে চাপামাটি দেওয়া হয়েছে বহু ছাত্রের লাশ। খুবই তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে কাজ। ফলে হত্যাকাণ্ডের দুদিন পরও চাপা দেওয়া মাটির বাইরে বেরিয়ে আছে কোনও ছাত্রের হাত, কোনও ছাত্রের পা।
পঁচিশের রাতে ওই ঘটনা ঘটিয়ে পরদিন শহরে কারফিউ দিয়ে বাঙালির লাশ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল ওরা। তাড়াহুড়া করে সব সরাতে পারেনি। সাতাশ তারিখেও শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বহু মৃতদেহ।
মা ছেলে এসব দৃশ্য দেখে বাড়ির দিকে ফিরলেন।
রিকশায় বসে এই এতটা সময় পর প্রথম কথা বললেন মা। গম্ভীর, ব্যথিত গলায় ওয়াকারকে জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখলে?
মায়ের এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ওয়াকার!
মা তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী করবে? কী করণীয় তোমার?
এবার গলা নিচু করে, বুকের ভিতর থেকে গভীর প্রত্যয়ের গলায় ওয়াকার বলল, এই হত্যার প্রতিশোধ নেব মা। এই নির্যাতনের প্রতিশোধ নেব। দেশ স্বাধীন করব। করবই।
ছেলের মুখের দিকে তাকালেন মা। বললেন, আমার দুই ছেলে। এক ছেলে আমি দেশের জন্য ত্যাগ করব। তোমাকে আমি দেশের জন্য ত্যাগ করলাম।
ছেলে কথা বলে না। তার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। চোয়াল শক্ত।
মা ছেলে দুজনেই খানিক চুপচাপ। রিকশা চলছে।
মা তারপর ছেলেকে নির্দেশ দিলেন, যুদ্ধের মাঠে যেন পিঠে গুলি না লাগে। যুদ্ধ করবে বীরের মতো। মরতে হলে মরবেও বীরের মতো। ফিরে এলে তাও আসবে বীরের মতো। দেশ স্বাধীন করে।
তিরিশে মার্চ নিজ হাতে ছেলের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন মা। যাও, দেশের জন্য যুদ্ধ করো, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করো। বাঙালি হত্যার প্রতিশোধ নাও।
ব্যাগ কাঁধে বাড়ি থেকে বেরোল ছেলে। মা দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়। তাঁর চোখে পানি নেই, মুখে হাসি। মায়ের চোখে পানি দেখলে ছেলের মন নরম হবে। অতিকষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলেন মা। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন বাড়ির দরজায়। যতক্ষণ ছেলেকে দেখা যায় দেখলেন। ছেলে চোখের আড়াল হতেই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না মা। দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন।
মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াকার হাসান। যুদ্ধের মাঠে তার বীরত্বে সবাই মুগ্ধ।
আরেক মায়ের কথা বলি, মা। ঢাকা চিটাগাং রোডের শুভপুর ব্রিজ থেকে টিচাগাংয়ের দিকে মাইল তিনেক গেলে করেরহাট। একসময়ের ছোটখাটো ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে গেছে। মানুষজন বলতে গেলে নেই। এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ। ক্যাপ্টেন রফিক শখানেক ইপিআর সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি... ...দের ঠেকাবার জন্য যুদ্ধ করছেন। তেমন অস্ত্র নেই সঙ্গে, খাদ্য নেই। যোদ্ধারা ক্লান্ত বিপর্যস্ত। তবু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ সময় খবর এলো মহালছড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান মারাত্মক বিপর্যয়ে। পাকিস্তানি... ...রা অবরুদ্ধ করে ফেলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মেজর মীর শওকত আলী সেনাদল চেয়ে পাঠিয়েছেন। বাধ্য হয়েই ৩০ জনের একটি দল পাঠিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন রফিক। ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে বেশ বড় এলাকা করেরহাটের চারপাশ রক্ষা করতে হবে তাঁকে। এমনভাবে পরিকল্পনা করলেন তিনি, যেন পাকিস্তানি... ...রা কিছুতেই বুঝতে না পারে এখানে মুক্তিযোদ্ধা আছে মাত্র ৭০ জন। সহযোদ্ধাদের সেভাবেই উজ্জীবিত করলেন তিনি। যোদ্ধাদের সঙ্গে সামান্য চিড়া আর গুড়। এক দুই মুঠ করে চিড়া খেলেন সবাই, এক দু-চিমটি গুড়। খালের ঘোলা পানি খেলেন। এই সামান্য খাদ্যের শক্তি নিয়ে তৈরি হলেন শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য।
খাওয়াদাওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক এলেন করেরহাট স্কুলের সামনে। তখনই বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হলো পাকিস্তানি... ...দের আর্টিলারির গোলা। বাতাস ভারী হলো বারুদের গন্ধে।
পাশেই তিনটি কুঁড়েঘর ছিল। গোলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে ঘরগুলো। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দুজন মহিলা দিশাহারা ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছেন। একপাশে পড়ে আছে এক কিশোরের রক্তাক্ত দেহ। পাকিস্তানি... ...দের আর্টিলারি শেলের ধারালো স্প্লিন্টার কিশোরের পেট কেটে দুভাগ করে ফেলেছে।
ক্যাপ্টেন চিৎকার করে মহিলা দুজনকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বললেন। সেলিং বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত যেন তারা উঠে না দাঁড়ান।
এক মহিলা ধীর শান্ত বেদনাভরা গলায় বললেন, তোমরা কারা?
আমরা আপনাদেরই সন্তান।
ক্যাপ্টেন তাঁর হাতে শক্ত করে ধরা এসএমজি নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটে গেলেন।
মহিলা তখন সেই নিথর কিশোরের সামনে বসে পড়েছেন। মৃত সন্তানের জন্য কাঁপা কাঁপা দুহাত তুললেন পরম করুণাময়ের উদ্দেশে।
পাকিস্তানিদের ট্যাংক আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর্টিলারি মর্টার আর মেশিনগানের বৃষ্টির মতো গুলিতে ভয়ংকর পরিস্থিতি।
এরকম চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হলো গোলাগুলি। সব শান্ত হলো। ক্যাপ্টেন রফিক ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিলেন মাঠের ঘাসে। চিত হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। অদূরে মৃত কিশোরের পাশে তখনও বসে আছেন মা। মোনাজাত তোলা হাত। ক্যাপ্টেন শুনতে পেলেন, তিনি পরিষ্কার উচ্চারণে আল্লাহপাকের উদ্দেশে বলছেন, আল্লাহ, আমার প্রাণপ্রিয় ছেলেটিকে তুমি নিয়ে গেছ সেজন্য আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমার ছেলের প্রাণের বিনিময়ে আমি এখন শুধু এই ছেলেদের জন্য দোয়া চাইছি, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে।
ক্যাপ্টেন রফিক নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। মনে মনে বললেন, হে দয়াময় খোদা, এই দুঃখিনী মায়ের দোয়া তুমি কবুল করো।
হিব্রু ভাষার একটা কথা মনে পড়ছে মা। 'ঈশ্বর যেহেতু সব জায়গায় থাকতে পারেন না সেজন্য তিনি মা তৈরি করেছেন।'
আমি কাইল চইলা যামু।
সন্ধ্যাবেলা পেছন দিককার বারান্দায় বসেছি আমরা। বারেক তার মছলা-মাছায়েল বলবে। মা, তুমি আছ আমার পাশের চেয়ারে, তোমার পাশে বকুল। আর সবাই মেঝেতে। কদম পারুল বুয়া, বুয়ার পায়ের কাছে বারেক। আজ আর মায়ের পায়ে হাত রাখেনি সে। বাবা তাঁর রুমে বসে স্কুলের কাজ করছেন। বিভিন্ন ঘর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কারো কারো মুখে আবছায়া, কারো কারো মুখ শরীর একটুখানি পরিষ্কার।
বারেকের মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। গলার স্বরে তার দুঃখ অভিমান বেদনাবোধ টের পাওয়া গেল।
পারুল বলল, কী কইলি বারেক?
আমি কাইল চইলা যামু।
কই যাবি?
এগারো বছর যেইখানে আছিলাম, যার কাছে আছিলাম, তার কাছে চইলা যামু। বড় আশা কইরা ফিরত আইছিলাম। মায় আমারে মাফ করব, মাইনা নিব আমারে। বহুত দিন চেষ্টা করলাম। মায় আমারে মাফ তো করলই না, মাইনা তো নিলই না, আমার মুখের দিকে একপলকের লেইগা চাইয়াও দেখল না। তয় আমি এখানে থাকুম ক্যান? কার লেইগা থাকুম? এই এত দিনে আমি বুইঝা গেছি, মার কাছে আমি মরা। আমি জীবিত না। মন থেইকা মায় আমারে মুইছা ফালাইছে। আমার লেইগা কোনও টান মহব্বত আদর সোহাগ মার আর নাই।
বুয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। বারেক ফিরে আসার পর থেকে যেমন নির্বিকার, এখনও তেমন।
বারেকের চলে যাওয়ার কথা শুনে আমরা সবাই কমবেশি চমকেছি। পারুল তো বলেই ফেলল, কই যাবি?
বুয়া চমকাল কি না বা তার মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল কি না বোঝা গেল না। বুয়ার মুখ পরিষ্কার দেখাও যাচ্ছে না। হারিকেনের ছিটকে আসা ওইটুকু আলোয় কারো চমকে ওঠা না ওঠা মুখ দেখে বোঝাও সম্ভব না।
তোমার মনে আছে, মা! কথা শুরু করলে তারপর তুমি। এত দিন হইল আইছস, এখন পর্যন্ত কইলি না তুই গেছিলি কই, আছিলি কার কাছে! এগারোটা বছর কাইটা গেল, ফিরলি না ক্যান?
বারেক কাতর গলায় বলল, আমি চাইছি মায় পয়লা আমারে মাফ করুক। খালি একবার কউক, হ, তরে আমি মাফ করলাম। আমারে যেই কষ্ট তুই দিছস, ওই কষ্ট আমি ভুইলা গেলাম। আমার মাথায় একটু হাত দিত, আমারে একটু বুকে জড়াইয়া ধরত। একবার খালি কইত, আয়, আমার বুকে আয়, বাজান। আমি এইটা চাইছি, নানু। এইটা হওনের পর সব কথা আমি সবাইরে কইতাম। কী হইছিল সেদিন। মার হাতে মাইর খাইয়া একদৌড়ে কই চইলা গেলাম আমি! এগারো বছর কই রইলাম, কার কাছে রইলাম!
তয় আইজ ক।
হ কমু। চইলা যাওনের সিদ্ধান্ত যখন নিছি, তখন সব কইয়াই যামু।
বারেক একটু থামল। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি বারেকের এগারো বছর নিখোঁজ হয়ে থাকার ঘটনা শোনার জন্য।
বারেক বলতে লাগল, মায় আমারে মারল, মাইর খাইয়া এমন জিদ হইল আমার, দৌড়াইয়া গেলাম বাঁশঝাড়তলায়। একটুখানি দাঁড়াইলাম। তারপর বাঁশঝাড়ের ওই দিক দিয়া মাঠের দিকে নাইমা গেলাম। দিকপাশ কোনও দিকে তাকাই না। হনহন কইরা হাঁইটা গেলাম বাজারে।
আমি বললাম, কোন বাজারে গেলি, বারেক? দীঘিরপাড় বাজারে নাকি পুরা বাজারে?
পুরা বাজারে। দিনটা আমার মনে আছে। মঙ্গলবার আছিল।
তাই নাকি!
হ মামা।
আচ্ছা, তারপর বল।
মঙ্গলবার পুরা বাজারে হাট বসে। দূর-দূরান্ত থিকা রজতরেখা নদী দিয়া নৌকা নিয়া পাইকার কারবারিরা আসে।
সেটা জানি।
হ, জানবেন না ক্যান, সবাই জানে। সেই হাটের দিনও আইছে। নদীর ঘাটে ম্যালা নৌকা। হাটবাজার মানুষে ভর্তি। গমগম করতাছে। একজন মুসল্লি মতন মানুষ হাটের এক কোনায় পাটি বিছাইয়া পাটির ওপর বিছাইছে সাদা একখান চাদর, তার ওপরে 'কাটা কাপড়' অর্থাৎ পোলাপানের শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি লুঙ্গি এই সব নিয়া বইছে। লোকটা কাটা কাপড়ের কারবারি। তয় খুবই মুসল্লি ধরনের মানুষ। মুখে চাপদাড়ি, চোখে সুরমা, শরীলে আতরের গন্ধ, মাথায় টুপি। লম্বা সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। এই ধরনের কারবারিদের লগে অল্পবয়সী পোলাপান কর্মচারী থাকে। এইটা ওইটা আগাইয়া দ্যায়, কাস্টমারের লগে দামদস্তর করে। এই লোকটার লগে কেউ নাই। তিনায় একলা। কিছু না ভাইবা আমি তার সামনে গিয়া খাড়াইছি। তিনায় হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাও, বাজান? কিনবা কিছু? শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি? তোমার মাপের লুঙ্গিও আছে।
আমি কইলাম, না কিছু কিনুম না।
তয়?
এমনেই খাড়াইয়া রইছি।
তিনায় খেয়াল কইরা আমারে দেখলেন। তোমার মুখখান শুকনা। মনটাও খারাপ মনে হইতাছে। বিয়ানবেলা নাশতাপানি খাও নাই?
আমি চুপ কইরা খাড়াইয়া রইলাম, কথা কইলাম না।
তিনায় বহুত আদরের গলায় বললেন, বসো বাজান, আমার পাশে বসো। তোমার লগে কথা কই। বেচাকেনার ফাঁকে ফাঁকে কথা কইলে টাইমটা ভালো কাইটা যাইব। বিকালের দিকে তো রওনাই দিমু।
তিনার কথাবার্তা এতো ভালো লাগল আমার, কী কমু! মুখে য্যান মধুমাখা।
আমি তার পাশে বসলাম।
দু-একজন কাস্টমার আসে, দামদস্তর করে। মানুষটার কথায় কাস্টমার দেখি তার কাছ থিকা ফিরতে পারে না। যে আসে সে-ই কিছু না কিছু কিনা ফালায়।
তিনায় যেখানে দোকান সাজাইয়া বসছেন, ঠিক তার পিছনে একটা চা মিষ্টির দোকান। হাটবার দেইখা বিয়ানবেলাই জিলাপি ভাজা শুরু করছে ময়রা। কাস্টমারের ভিড়ও লাইগা আছে। চামচের খটাখট শব্দে চা বানাইতাছে। গরমাগরম জিলাপি চা আর বিস্কুট খাইতাছে কাস্টমাররা। ডাইলপুরি শিঙ্গাড়াও খাইতাছে। জিলাপি ভাজার গন্ধে আমার খিদাটা এমন বাড়া বাড়ছে, কী কমু!
মুখ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দোকানটার দিকে চাই।
তিনায় আমার অবস্থা বুঝলেন। মুখ ঘুরাইয়া দোকানের দিকে চাইলেন। দোকানের একটা যুবক কর্মচারীরে বললেন, ওই ফজলু, এক পোয়া জিলাপি দে আর দুই কাপ চা। দুই গেলাস পানিও দিস।
বুঝলাম তিনায় প্রতি মঙ্গলবার এই জায়গাটায় বসেন, এখানে বইসাই দোকানদারি করেন। ফজলু তার পরিচিত।
তিনার কথামতন প্রথমে জিলাপি দিল ফজলু, দুই গেলাস পানি দিল। তিনায় আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, খাও বাজান, খাও। আমি নাশতা করছি। তাও তোমার লগে এক দুইখান জিলাপি খামুনে। তুমি খাও, পেট ভইরা খাও।
আমি কথা না বইলা খাইতে শুরু করলাম।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনায় আমারে জিজ্ঞাসা করেন, তোমগো বাড়ি কোন গেরামে?
আমার ভিতরে তো তখন একটা শয়তান বাস করে! আমি তো তখন মানুষ আছিলাম না। মিছা কথা কইতে শুরু করলাম।
কদম বলল, এই গেরামের নাম কইলি না?
না।
কোন গেরামের নাম কইলি?
কইলাম আমার কোনও গেরাম নাই।
তিনায় অবাক, কী!
হ, গেরাম নাই, বাড়িঘর নাই।
কও কী!
হ।
তোমার মা-বাবা?
আমার মা বাবা ভাই বইন কেউ নাই।
কোনো আত্মীয়স্বজন?
তাও নাই।
তয় তুমি থাকো কই? খাও কী?
একেক গেরামের একেক বাড়িতে যাই, এতিম পোলা দেইখা তারা দুই চাইর দিন থাকতে খাইতে দেয়, বাড়ির কাম কাইজ করায়, তার বাদে খেদাইয়া দেয়।
তখন?
তখন অন্য গেরামে যাই, অন্য বাড়িতে থাকি ওই একই কায়দায়।
মানুষটা অবাক। তোমার মা-বাপের কথা তুমি কিছু জানোই না?
না।
কিছু শোনো নাই?
একটু একটু শুনছি।
কী শুনছ?
আমার জন্মের আগে বাপ মরছে, জন্মের দুই তিন বছর পর মায়। সে এক বাড়িতে কাজ করত। মায় মরণের পর ওই বাড়ির আরেকজন কাজের বুয়া আমারে কিছুদিন পালছে। তারপর থিকা আমি এই গেরাম ওই গেরাম ঘুরি। এই বাড়ি ওই বাড়ি থাকি। আমার মতন এতিম দুনিয়ায় কেউ নাই।
আমার কথা শুইনা তিনার চোখ ছলছল করে। আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, আহা রে, আহা!
এরপর বললেন, তয় তুমি আইজ আইলা কোন গেরাম থিকা?
গেরামের নাম বাণীখাড়া। আছিলাম এক বাড়িতে। সেই বাড়ির একজনে আমারে নাশতাপানি তো দেয়ই নাই, মাইরা বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিছে।
তিনায় আবার বললেন, আহা রে, আহা! এমুন মায়াভরা একটা পোলারে কেউ মারে! না খাওয়াইয়া রাখে! মানুষের কলিজায় মায়াদয়া নাই! তয়, তুমি অহন কী করবা, কই যাইবা?
জিলাপি খাইয়া আমার পেট ভইরা গেছে। কয়েক ঢোঁক পানিও খাইলাম। তার বাদে এক কাপ চা বড় মানুষের লাহান তিনার লগে ফুরুক ফুরুক কইরা খাইতে লাগলাম। চা খাইতে খাইতে কইলাম, আমার কিছু করনের নাই। কোনোখানে যাওনের জায়গা নাই।
আমার লগে যাইবা?
আপনেগো বাড়ি কই?
এখান থিকা বহুত দূর।
কোন গেরাম?
গেরামের নাম নারায়ণপুর।
সেইটা কোন জায়গায়?
কুমিল্লার মতলব থানায়।
যাইতে হয় কেমনে?
আমার নিজের নৌকা আছে। ছইওয়ালা নৌকা। দুইজন মাঝি আছে। আমি বাড়ি থিকা মাল নিয়া, নৌকা নিয়া বাইর হই। এক দেড় মাস দূর-দূরান্তের হাটে বাজারে মাল বেচাকিনা কইরা বাড়িত যাই। কিছুদিন বাড়িতে থাইকা আবার রওনা দেই। বাড়িতে আমার দুইজন দর্জি আছে। আমগো গেরামেরই লোক। আমি কাপড় কিনা দেই, তারা শার্ট প্যান্ট পায়জামা এই সব বানায়। লুঙ্গি গেঞ্জি আমি মতলব বাজার থিকা পাইকারি দরে কিনি। এইটাই আমার ব্যবসা। সংসারে আমার স্ত্রী আছেন আর একটা বিধবা বইন। বইনের একটা মাইয়া। তার বিয়া হইয়া গেছে। সে থাকে চাঁদপুরে। আমার সন্তানাদি নাই।
আমি কিছু না ভাইবা তিনারে কইলাম, আপনের লগে আমারে নিবেন?
তিনায় এককথায় রাজি। হ নিতে পারি। তুমি যাইবা?
যামু দেইখাই তো কইলাম।
সব সময় থাকবা আমার কাছে?
থাকুম।
চিন্তাভাবনা কইরা কইতাছ তো?
হ চিন্তা কইরাই কইতাছি। আমার দুনিয়াতে কেউ নাই। আপনের মতন একজন মানুষের লগে থাকুম, হাটে বাজারে ঘুরুম, আপনের লগে দোকানদারি করুম...
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনায় বললেন, তয় আমার লগে থাকলে তোমার খারাপ হইব না, বাজান। ভালোই হইব।
দোফরে মোল্লার ভাতের হোইটালে তিনায় আমারে ভাত খাওয়াইলেন। পয়লা আমি খাইয়া আসলাম, আইসা তার জায়গায় বসলাম, তার বাদে তিনায় খাইয়া আসলেন।
বিকালের দিকে হাট যখন ভাঙতেছে, মালসামান গুছাইয়া তিনার লগে আমি তার নৌকায় চড়লাম। মাঝি দুইজন খাওয়াদাওয়া কইরা নৌকায় শুইয়া ঘুমাইতাছিল। আমরা নৌকায় উঠার পর নৌকা ছাড়ল। তিনায় মাঝি দুইজনরে আমার কথা বললেন। এখন থিকা আমি তার লগে আছি, তার ছেলের মতন, এই সব বললেন।
আমার মনের মধ্যে তখন বিরাট এক আনন্দ। য্যান এক খাঁচা থিকা মুক্তি পাইছি। এখন মুক্ত স্বাধীন পাখি আমি। তিনার সঙ্গে দেশের এইদিক ওইদিক ঘুইরা বেড়ামু। কারবার শিখুম। একসময় হয়তো তার কারবারটা পুরাপুরি আমি দেখুম।
মনে আছে তোমার, মা? তুমি বললে, ওই বয়সেই এই সব ভাবলি তুই?
হ নানু, ভাবলাম।
বকুল বলল, ও ছোটবেলা থেকেই মহা পাকনা।
আমি বললাম, ট্যাটন, বিরাট ট্যাটন।
কদম বলল, তারপর কী হইল সেটা ক।
আমি বললাম, তার আগে বল, লোকটার নাম কী। তিনায় তিনায় করছিস, নাম বলছিস না কেন?
তিনার নাম মোসলেম মিয়া। নৌকায় চইড়াই টের পাইয়া গেলাম, বিরাট পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পড়েন। অন্য সময় নৌকায় বসে হাদিস শরিফ পড়েন।
মা, তুমি বললে, কিন্তু তুই যে তোর মারে ছাইড়া অচেনা একজন মানুষের লগে রওনা দিলি, একবারও মার কথা মনে পড়ল না তোর? আমগো কারো কথা মনে পড়ল না?
পড়ছে। কিন্তু মায় আমারে মারছে, তার ওপরে বিরাট রাগ, বিরাট জিদ। মনে মনে খালি কই, তোমার কাছে আমি আর ফিরত আসুম না মা। কোনও দিন ফিরত আসুম না।
আর আমি! মা, আমি! আমি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছি তোমার কাছে। বাবাকে যেমন ভালোবাসি আমি, তোমাকে কি তার চেয়ে কম ভালোবাসি!
না মা, না। একদম না। একদম না।
তোমাদের দুজনার জন্যই আমার ভালোবাসা এক রকম। ছোটবেলায় হয়তো আমার আচরণে, বাবার জন্য অস্থিরতা দেখে তোমার মনে হয়েছে আমি আমার বাবার জন্য পাগল, তাঁকেই বেশি ভালোবাসি। তোমার জন্য টান কম।
না মা, না।
সেই যে মায়ের আত্মার গল্পটা তুমি বলেছিলে, সেদিন থেকে আমি তোমার জন্য ভিতরে ভিতরে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার কোলে সেই যে মুখ রেখে কেঁদেছিলাম সেই কান্নাটা তোমার কাছ থেকে দূরে গেলেই আমার বুক ঠেলে উঠত। মুন্সীগঞ্জে পরীক্ষা দিতে গিয়ে উঠেছে। ঢাকায় থাকার সময় উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার সময় উঠেছে। তোমাকে আর আমার দেশকে আমি একাকার করে ফেলেছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করা মানে আমার মায়ের জন্য যুদ্ধ করা। মায়ের মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করা।
আমার চোখজুড়ে তুমি, মা।
আমার হৃদয়জুড়ে তুমি।
তুমি আর বাবা। বকুল আর মায়া। আর মায়ার গর্ভে আমার সন্তান। এই কজন মানুষ নিয়েই তো আমি!
একটা সময় এ রকম ভাবনাই ছিল, মা। মুক্তিযুদ্ধ এই ভাবনা বদলে দিল। মা, শুধু এই পাঁচজন মানুষই আমার না, দেশের প্রতিটি মানুষ আমার। শুধু আমার মায়ের মুখের হাসির জন্য আমি যুদ্ধ করছি না, আমি যুদ্ধ করছি দেশের প্রত্যেক মায়ের জন্য, প্রত্যেক বাবার জন্য। দেশের প্রতিটি বোনের জন্য। শুধুই আমার স্ত্রী আর সন্তানের জন্য না, সব সন্তানের জন্য, প্রত্যেক স্বামী এবং স্ত্রীর জন্য। সাত কোটি মানুষের জন্য।
আমার মা দেশের প্রত্যেক মায়ের প্রতীক।
আমার বাবা দেশের প্রত্যেক বাবার প্রতীক।
বকুল দেশের প্রতিটি বোনের প্রতীক।
মায়া স্ত্রীর প্রতীক।
আর আমার ছেলে, যার শরীর এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি, সে হবে অনাগত সব সন্তানের প্রতীক।
দেশের বুড়ো মানুষরা, শিশু কিশোররা, সব মানুষ আমার। আমি তাদের সবার জন্য যুদ্ধ করব। যুদ্ধ জয় করব, দেশ স্বাধীন করব।
কিন্তু তুমি চলে গেলে, মা। বাবা বকুল মায়া আর মায়ার গর্ভে আমার সন্তান কাউকে ওরা বাঁচতে দিল না। এই দুঃখ নিয়ে আমি বাঁচব কেমন করে? যুদ্ধ করব কেমন করে?
আমি বোধ হয় একটু দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, মা। বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছি।
না না, দুর্বল আমি হতে পারি না। যোদ্ধাদের দুর্বল হতে নেই। একদম দুর্বল হতে নেই। যোদ্ধারা সব রকমের পরিস্থিতির জন্য তৈরি। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনই তাদের কাছে তুচ্ছ।
না না, দুর্বল আমি হতে পারি না।
বারেকের কথা বলি। আবার বারেকের কথা বলি। এক মা এবং ছেলের কথা বলি।
মোসলেম মিয়ার নৌকায় চড়ে বারেক পাড়ি দিল অন্য এক জগতে। দশ বছরের বালকটির বুকভরা অভিমান। মা তাকে মারল কেন? ওই অভিমান নিয়ে অচেনা মানুষের সঙ্গে অজানা গন্তব্যে রওনা দিল।
একের পর এক মিথ্যা কথা বলে মোসলেম মিয়ার মন গলিয়ে ফেলেছিল সে। নারায়ণপুরে মোসলেম মিয়ার বাড়িতে এসে তাঁর স্ত্রী আর বিধবা বোনের মনও গলিয়ে ফেলল। বাড়ির বাইরের দিকে একটা একচালা টিনের ঘর। সেই ঘরে দুখানা সেলাই মেশিন নিয়ে শিশু কিশোরদের জামাকাপড় তৈরি করে দুজন দর্জি। মধ্যবয়সী মানুষ। ওই গ্রামেরই লোক। মোসলেম মিয়া মাসিক বেতনে তাদের রেখেছেন। একজনের নাম হাতেম, আরেকজন গাজী।
কী আশ্চর্য মা, দেখো, কোথাকার কোন হাতেম আর গাজী এসব নামও আমার মনে আছে। কত আগে বারেকের মুখে শোনা নাম, তাও ভুলিনি।
কেন ভুলিনি, মা? স্মৃতি এত প্রখর হয়ে গেছে কেন?
আবার ভুলেও যাচ্ছি কোনও কোনও ঘটনা।
পরিস্থিতি মানুষকে সত্যি খুব বিচিত্র করে তোলে। মোসলেম মিয়ার বেতনভুক্ত দর্জি হাতেম আর গাজীর নাম যেমন মনে আছে, মাঝি দুজনের নামও মনে আছে। একজনের নাম বদর, আরেকজন হচ্ছে কাদের।
কারণ আছে মা, সবার নাম মনে থাকার কারণ আছে। মানুষগুলো তো দেশের! দেশের মানুষের নাম মনে থাকবে না কেন? আমি কেন ভুলে যাব আমার দেশের মানুষের নাম!
আমার মা বাবার নাম কি আমি ভুলে যেতে পারি? বকুল মায়ার নাম ভুলে যেতে পারি!
সেই সন্ধ্যায় বারেক বলল, নৌকায় চড়নের পর থিকা তিনারে আমি খালুজান ডাকতে শুরু করছি। মাঝি দুইজনরে ডাকি ভাই। বাড়িতে আইসা তিনার স্ত্রীরে ডাকলাম খালাম্মা, বিধবা বইনরে ডাকি ফুবুম্মা। আর দর্জি দুইজনরে ডাকি মিয়াভাই। একদিনেই বাড়ির বেবাক মানুষ আমার আপন হইয়া গেল। দেখি, আরে এই বাড়ির বেবাক মানুষই ভালো। বেবাকতেই আমারে আদর করে। বুঝলাম বাড়ির কর্তা যদি ভালো মানুষ হয়, তাইলে অন্যরাও তার দেখাদেখি ভালো মানুষ হইয়া যায়। খারাপ মানুষও ভালো মানুষের লগে থাইকা ভালো হয়।
তয় খালুজান পরহেজগার মানুষ। তাঁর বাড়ির মানুষরাও পরহেজগার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সবাই। নামাজের ওয়াক্ত হইলে অজু কইরা আজান দেন খালুজান। কারখানা ঘরে মাদুর বিছাইয়া হাতেম আর গাজীরে নিয়া নামাজ পড়েন। ভিতরঘরে নামাজ পড়েন খালাম্মা আর ফুবুম্মা।
আমারে নিয়া বাড়িতে আসার পরই খালুজানে খালাম্মা, ফুবুম্মারে বললেন, এইবার আমি বাড়িতে থাকুম মাসখানেক।
খালাম্মা বললেন, এত দিন থাকবেন?
হ। মোবারকরে মানুষ করতে হইব।
মোবারক নামটা শুনে আমরা চমকালাম। অন্য কেউ কথা বলার আগেই পারুল বলল, মোবারক কেডা?
বারেক হাসল। এই নামটা কইতে ভুইলা গেছিলাম। খালুজানে হাটে বইসাই আমার নাম জিজ্ঞাসা করছিলেন। সত্য নামটা আমি কই নাই। বারেক নামটারে বানাইয়া কইছি মোবারক।
কদম বলল, ওই বয়সে এত পাকনা তুই পাকছিলি!
মা, তুমি বললে, আইচ্ছা ক, তারপর কী হইল?
খালুজানের কথা শুইনা খালাম্মায় হাসলেন। এক মাসের মইধ্যে এইটুকু একটা পোলারে মানুষ বানাইয়া ফালাইবেন?
হ বানামু।
ফুবুম্মা বললেন, কেমনে বানাইবেন মিয়াভাই?
দেখ কেমনে বানাই।
পরদিন থিকা খালুজানে আমারে দোয়া দরুদ মুখস্থ করাইতে লাগলেন। কায়দা, সিপারা পড়াইতে লাগলেন, আদর্শলিপি পড়াইতে লাগলেন।
আমি বললাম, পড়ালেখার জন্য বুয়া তোকে মারল আর তুই মোসলেম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে পড়ালেখা শুরু করলি?
হ করলাম।
বকুল বলল, কেন?
খালুজানে এত মায়া কইরা, এত আদর কইরা সুরা মুখস্থ করাইতেন, এত আদর কইরা পড়াইতেন, সিলেট পেনসিল দিয়া লেখাইতেন, কী কমু আপনেগো! ভুল করলে একটুও রাগ করেন না। হাসেন। হাসিমুখে আবার পড়ান। রাগ বলতে কিছু নাই মানুষটার।
এক মাসের মইধ্যে আমি অজু কইরা আজান দেই। খালুজানের লগে ফজরের নামাজ পড়ি। অন্য ওয়াক্তের নামাজে মিয়া ভাইরাও থাকে। এক গেরামের মানুষ। সকাল দশটার দিকে কাজে আসে, যায় রাত্র নয়টার দিকে। দুপুরে খালুজানের বাড়িতে খায়, রাত্রে খায়।
খালুজানের অবস্থা ভালো। বাড়িটা বড়। চকে ফসলের জমি ম্যালা। ধান যা পায়, বছরেরটা তো চলেই, বিক্রি করেন অনেক। আর লগে আছে কাপড়ের ব্যবসা।
ওই বাড়িতে থাকতে থাকতে, খালুজানের লগে থাকতে থাকতে দেখি আমি কেমুন জানি বদলাইয়া যাইতাছি। নামাজ পড়তে ভালো লাগে, লেখাপড়া করতে ভালো লাগে। স্বভাবটাই বদলাইয়া যাইতাছে।
মা, তুমি বললে, তোর মার কথা মনে হইত না?
হইত। কিন্তু মার ওপরের রাগটা কমত না। যখনই মনে হইত, মনে মনে কইতাম, তোমার কাছে আর কোনও দিন ফিরত আসুম না। দুনিয়াতে আমার মা বাপ কেউ নাই। খালুজানেই আমার বাপ, খালাম্মাই আমার মা। আমি আর কেউরে চিনি না।
আইচ্ছা ক, তারপর?
মাসখানেক পর আবার নৌকা নিয়া বাইর হইল খালুজানে। লগে আমি আছি। আমারে লইয়া হাটে হাটে যান তিনায়। দোকানদারি করেন। নামাজের সময় আগে তিনায় নামাজ পড়েন, আমি দোকান চালাই। তার বাদে তিনায় আইসা বসেন, আমি নামাজে যাই।
তয় এত বিশ্বাস তিনায় আমারে করেন, আমিও তার বিশ্বাসের বরখেলাপ করি না। টাকা-পয়সার কোনও লোভ আমার নাই। ওই যে কইলাম আমি অন্য মানুষ হইয়া গেছি। ভিতরে ভিতরে বদলাইয়া গেছি।
বকুল বলল, পুরা বাজারে আসতি, এই বাড়িতে আসতি না কেন?
না না, পুরা বাজারে আর কোনও দিন আসি নাই।
তাই নাকি?
হ। তিনায়ই আর এইদিকে আসেন নাই।
কেন?
এইদিকে আসলে পুরান দিনের কথা মনে হইতে পারে আমার। মন খারাপ হইতে পারে। কোনও বাড়িতে যাইতে ইচ্ছা করতে পারে, এই জন্য।
বুঝেছি।
মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর এলাকায় আমরা আসতাম। শ্রীনগর গোয়ালিমান্দ্রা ভাগ্যকুল ষোলঘর ওই সব দিকে। এই দিকে আসতাম না। তবে ওই জীবনটা আমার বহুত ভালো লাইগা গেল। কিছুদিন বাড়িতে, কিছুদিন নৌকায় করে হাটেবাজারে। নৌকায় যখন থাকি খালুজানে সকালবেলা, সন্ধ্যাবেলা আমারে আরবি পড়ান, বাংলা পড়ান। সকালবেলার আলোয় আরবি পড়া শিখি, সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের আলোয় শিখি বাংলা পড়া। দিনে দিনে দিন গেল। কোরআন শরিফ পড়তে শিখলাম। ফজরের নামাজ পইড়া কোরআন তেলাওয়াত করি। আর দিনে রাইত্রে যখন সময় পাই হাদিস পড়ি, ইসলামী বই পড়ি। হাটবাজারে গেলেই এই সব বই কিনা আনি।
তখন মাঝে মাঝে মার কথা মনে হইত।
কোরআন হাদিসে মায়ের কথা এমনভাবে লেখা, পড়ি আর বুকটা মোচড়ায়। মনে হয়, আমার মায় কি বাঁইচা আছে, নাকি আমার শোকে মইরা গেছে!
কিছুদিন ধইরা এই সব কথা খুব মনে হয়। যখন মনে হয় তখনই বুক ফাইটা কান্দন আসে। রাত্রে গোপনে গোপনে কান্দি। মারে স্বপ্নে দেইখা কান্দি।
খালুজানে বুড়া হইছেন। আগের মতন কাজকাম করতে পারেন না। নৌকার জীবন তাঁর আর ভালো লাগে না। নারায়ণপুর বাজারে দোকান দিলেন। কাটা কাপড়ের দোকান। দোকান চালাই আমি। মাঝে মাঝে তিনি বসেন। দোকান বন্ধ কইরা রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরা আসি। আমার আলাদা ঘর হইছে। রাত্রে খাওয়াদাওয়া শেষ কইরা আমি আমার ঘরে হারিকেন জ্বালাইয়া ইসলামী বই পড়ি, বুখারি শরিফ পড়ি।
একদিন নবীজির সাহাবা আলকামার ঘটনা পড়তাছি। পড়তে পড়তে মনে পড়ছে আমার মার কথা। নিজে টের পাই নাই, চোখের পানিতে গাল ভাসতাছে। তখন কী কাজে খালুজানে আসছেন আমার ঘরে। দরজা খোলাই আছিল। আমারে কানতে দেইখা চমকাইলেন। কী হইছে রে বাজান, কান্দছ ক্যান?
নবীজির সাহাবা আর তাঁর মার কথা পইড়া কানতাছি, মনে পড়ছে নিজের মায়ের কথা। এই অবস্থায় মিছা কথা বলি কেমনে। সত্য কথাই বললাম।
পারুল বলল, কী কইলি?
কইলাম আলকামার আর তার মার ঘটনা পইড়া নিজের মার কথা মনে পড়ছে, খালুজান। মা বাপ লইয়া আমি আপনের লগে মিছা কথা কইছি।
কী? কী কইলি তুই?
হ।
খালুজানে আমার বিছানায় বসলেন। আমার কান্দে হাত দিলেন। সব আমারে খুইলা ক।
আমি কানতে কানতে তাঁরে সব কইলাম। শুইনা তিনায় আমারে বললেন, এইটা তুই কী করছস, বাজান? এইটা তুই কী করছস? মারে এমুন কষ্ট দিছস? কাইলই তুই যা। তোর মার খবর ল। তিনায় বাঁইচা থাকলে তাঁর পাও ধইরা মাফ চা। মায়ে মাফ না করলে তোর জায়গা হইব জাহান্নামে। যা বাজান যা, কাইল বিয়ানেই রওনা দে।
পরদিন আমি রওনা দিলাম। এই বাড়িতে আসতে দেড় দিন লাইগা গেল। নারায়ণপুর থিকা আইলাম মতলব। মতলব থিকা চাঁদপুর, চাঁদপুর থিকা মুন্সীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থিকা স্বর্ণগ্রাম।
বারেক একটু থামল। তারপর কাঁদতে লাগল। কিন্তু আইসা আমার কী লাভ হইল? মায় আমারে মাফ করল না। মায় আমারে বুকে টাইনা নিল না। মার কাছে আমি মরা। ঠিক আছে আমি আমার মার কাছে এগারো বছর আগে মইরা যাওয়া পোলাই থাকলাম। কাইল বিয়ানে চইলা যামু, আমার এই মুখ আমার মায় আর কোনও দিন দেখব না।
তখন, তোমার মনে আছে মা, তখন, আমরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুয়া ঠাস করে বারেকের গালে একটা চড় মারল। এত জোরে মারল, আমরা চমকে উঠলাম। কেউ কিছু বলার আগেই দেখি বুয়া দুহাতে বারেকের মাথাটা জড়িয়ে ধরেছে বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এত পাষাণ তুই হইলি কেমনে? এত কষ্ট আমারে তুই দিলি কেমনে? এগারোটা বছর তোর লেইগা আমি কত কান্দন কানছি, তুই জানচ? একটা রাতইও আমি ঘুমাইতে পারি নাই। খালি তোর কথা মনে হইছে। পেটের পোলা হইয়া আমারে তুই এত কষ্ট দিলি?
বুয়াকে জড়িয়ে ধরে বারেকও তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও।
বাবার পাশে তোমাকে রেখে দিচ্ছি, মা।
বাবা এক জায়গায়, তুমি আরেক জায়গায়, এমন ঘটনা আমরা কখনও দেখিনি।
মা, আগে বাবা যখন স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়ে থাকতেন সেটা অন্য ব্যাপার। পুরুষ মানুষ প্রয়োজনে, কাজেটাজে দু-চারদিন বাইরে থাকতেই পারে! কিন্তু তুমি বাবাকে ছেড়ে কখনও থাকতে চাওনি। একটি দিনের জন্যও থাকতে চাওনি। দু-চারদিন ঢাকায় গিয়ে থাকলেই অস্থির হয়ে যেতে বাবার জন্য। আমাকে আর বকুলকে বলতে, তোরা থাক। আমার ভালো লাগছে না। তোর বাবা কী খায় না খায়, তার শরীর ঠিক আছে কি না কে জানে। আমি কালই চলে যাব।
খালা তোমাকে নানা রকমভাবে বুঝিয়েও রাখতে পারতেন না।
আমি বকুল আর মায়া আড়ালে হাসাহাসি করতাম। মায়া বলত, খালুর জন্য খালার টান আশ্চর্য রকমের।
তারপর আমার দিকে তাকাত। তখন আমাদের সম্পর্ক একটু একটু তৈরি হচ্ছে। মায়া আমার দিকে তাকিয়ে বলত, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত।
আমি বুঝতাম, মায়া কী ইঙ্গিত করছে!
তোমাদের দুজন সারা জীবন যেভাবে থেকেছ, আজও সেভাবে পাশাপাশিই থাকো। একজন আরেকজনের ছায়া হয়ে থাকো। মরণও যেন বিচ্ছিন্ন করতে না পারে তোমাদের!
তার আগে, মা গো, তার আগে বারেককে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি। বুয়াকে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি।
বারেককে ও রকম একটা চড় মেরে বুয়া যখন তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর ওসব কথা বলছে, তখন আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হয়েছিল, আচ্ছা, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বুয়ার জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও কি আমার সঙ্গে এমন আচরণই করতে? অমন জোরে ঠাস করে চড় মারতে আমার গালে! আমার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বুয়ার মতো করে কাঁদতে! আমিও কি তোমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আর মাফ চাইতাম! অথবা বারেক ফিরে আসার পর বুয়া তার সঙ্গে যে রকম আচরণ করেছিল, তুমিও কি আমার সঙ্গে তাই করতে!
না, তুমি আমার সঙ্গে তা করতে না, মা। আমি ও রকম উধাও হয়ে গেলে এগারো বছর তুমি বেঁচেই থাকতে না। আমার শোকে পাগল হয়ে যেতে। মরে যেতে। আর আমিও তোমাকে ছেড়ে অমন করে উধাও হয়ে থাকতে পারতাম না, মা। আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যেতাম, কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যেতাম।
কিন্তু এখন আমার কান্না আসছে না কেন, মা?
এখন আমার কান্না আসছে না কেন!
জানি, কারণটা আমি জানি। আমি এখন আর নিজের মধ্যে নেই। আমি এখন এক দিশাহারা এলোমেলো মানুষ! যে মানুষের মা বাবা বোন স্ত্রী আর স্ত্রীর গর্ভের সন্তান এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় সেই মানুষ কি আর মানুষ থাকে! মানুষের মতো মন অনুভব আর অনুভূতি থাক!
এতগুলো মাস তোমাদের ছেড়ে ছিলাম। ট্রেনিং ক্যাম্পে কোনো কোনো রাতে তোমাদের কাউকে কাউকে স্বপ্নে দেখতাম। বাবাকে বকুলকে মায়াকে আর তোমাকে। খুবই স্বাভাবিক সব স্বপ্ন। ওই সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙত, কয়েক মিনিট স্বপ্ন নিয়ে ভাবতাম, তারপর আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
এক রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম।
কী স্বপ্ন?
দেখি আমাদের বারবাড়ির সামনের আমগাছটার তলায় বসে তুমি কাঁদছ আর আমার নাম ধরে ডাকছ। রবি রে, আমার রবি। কতদিন হইয়া গেল তোরে আমি দেখি না বাজান। তুই কই আছস, কেমন আছস কিচ্ছু জানি না। তুই কী খাছ, কই ঘুমাছ, কিচ্ছু জানি না। আমার কলিজাটা তোর জইন্য পুইড়া যায়, বাজান। আমার জইন্য তোর কলিজা পোড়ে না? মার কথা মনে হয় না?
এই স্বপ্ন দেখে আমি বিছানায় উঠে বসলাম।
আমার দুই পাশে সার ধরে ঘুমাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। ভোর চারটায় উঠে ট্রেনিং শুরু করব। এমন পরিশ্রমের কাজ সেটা, সারা দিন ট্রেনিং নেওয়ার পর রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় যাওয়া মাত্রই ঘুমে ঢলে পড়ি আমরা। কারো কোনও খবর থাকে না। কারো কারো নাক ডাকে, কেউ ঘুমায় নিঃশব্দে।
আমার নিঃশব্দে ঘুমানোর অভ্যাস।
স্বপ্ন দেখে উঠে বসেছি। বসার পর কোত্থেকে যে বুক ঠেলে উঠল কান্না। স্বপ্নে তোমার কান্নার দৃশ্য আর কথাগুলো ভুলতেই পারি না।
আমি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম, মা।
শিশুর মতো কাঁদতে লাগলাম।
পাশে শুয়ে সবাই ঘুমায়। কেউ টের পায় না আমার কান্না।
মা গো, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেমন করে পারি কমান্ডারকে ম্যানেজ করে একটি রাতের জন্য বাড়ি আসব। তোমাদের সবাইকে দেখে যাব। তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলব, আমার জন্য যে তুমি কাঁদো আমি তা টের পাই, মা। বহুদূরে থেকেও টের পাই। স্বপ্নে তোমাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কাঁদি।
নিশ্চয়ই তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি কাঁদতে, মা।
তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আমি।
এই জীবনে সেই কান্না আমার জন্য তোমার আর কাঁদা হলো না, মা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হলো না আমার।
ওদের আমি কী বলে গাল দেব, মা!
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গালও ওদের জন্য বেমানান।
কী গাল দেওয়া যায়!
কী গাল!
ওই যে বারেকের কথা বলছিলাম মা, সেই সব কথা বলাই হচ্ছে না!
বুয়ার চড় খেয়ে শেষ পর্যন্ত বারেক তার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও।
মাফ তো বুয়া তখনই করেছে যখন চড় মেরেছে!
সেই মুহূর্ত থেকে বারেক ফিরে গেল তার ছেলেবেলায়, শিশু বয়সে। তবে অন্য ছেলেবেলায়, অন্য শিশু বয়সে। মা ন্যাওটা শিশুর মতো সারাক্ষণ বুয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বুয়াকে কোনও কাজই করতে দেয় না, বুয়ার সব কাজ সে করে। পারলে রান্নাবান্নাটাও করে দেয়, মাছ কুটে দেয়, বাটনা বেটে দেয়। পারলে বুয়াকে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
এমন মাতৃভক্তি!
বাড়ির সবাই আমরা বিস্মিত হয়ে গেলাম!
বারেক পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে নামাজ পড়ে আর মায়ের সেবা করে।
একদিন আমাকে বলল, এগারোটা বছর যেই দুঃখ আমি আমার মারে দিছি, আমার মায় যতদিন বাঁইচা আছে, ততদিন তার সেবা এইভাবেই আমি করতে চাই।
আর ওই যে মোসলেম মিয়ার ওখানে তুই ছিলি, তাঁর প্রতিও তোর দায়িত্ব আছে। সেই ভদ্রলোক তোকে মানুষ করেছেন?
হ মামা, সেইটা ঠিক। তবে তাঁর কাছেও আমি যাব। যাব মার অনুমতি নিয়া। মায় অনুমতি দিলে যামু। তাঁর সেবাযত্নও করুম।
বারেককে অনুমতি দিয়েছিল বুয়া।
তার পর থেকে এক দুই মাস আমাদের বাড়িতে থাকে বারেক, এক দুই মাস গিয়ে নারায়ণপুরে থাকে। নিজের মায়ের পাশে থাকে, মোসলেম মিয়ার পরিবারের পাশে থাকে। এত নম্র ও বিনয়ী ভঙ্গিতে জীবন কাটায়, ভাবাই যায় না, এই সেই বারেক, যে ডাকাত হতে চেয়েছিল। মোসলেম মিয়ার মতো এক পরশপাথরের ছোঁয়ায় সে মানুষ হয়ে গেল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধও এক পরশপাথর, মা! দেশপ্রেম এক পরশপাথর। আর সবচেয়ে বড় পরশপাথর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সাত কোটি মানুষকে তিনি মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশপ্রেমের মন্ত্র শিখিয়েছেন।
যে মানুষ নিজের দেশকে ভালোবাসে না, সে কি মানুষ!
যে মানুষের দেশপ্রেম নেই, সে কি মানুষ!
যে... ...গুলো পাকিস্তানি... ...দের দোসর হয়েছে সেগুলো তো মানুষ না, মা!
যারা এইভাবে মানুষ হত্যা করে তারা কেমন করে মানুষ হয়!
আমরা ওদের একটিকেও ছাড়ব না, একটিকেও না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রে আমরা উজ্জীবিত। আমাদের কেউ 'দাবায়া রাখতে পারবে না'। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমার মাথায় বাঁধা পতাকা দেশের হাওয়ায় পতপত করে উড়বেই।
তোমার মনে আছে মা, আমার সেই জ্বরের সময়কার কথাটা তোমার মনে আছে?
আমার পরিষ্কার মনে আছে।
কতবারই তো জ্বরজ্বারি হয়েছে ছেলেবেলায়। কতবারই তো তুমি আমাকে কোলে নিয়েছ। কিন্তু আমার মনে পড়ে শুধু সেবারের কথা।
কত বয়স হবে আমার তখন? আট নয় বছর! নাকি দশ! মা, নাকি দশ বছর বয়স আমার!
তা-ই হবে। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হঠাৎ এমন জ্বর হলো! সেই জ্বর আর কমেই না। ডাক্তার কাকা দুই বেলা এসে দেখে যান। শিশিতে করে মিক্সচার দিয়েছেন। কমলা রঙের মিক্সচার। কাগজ কেটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে শিশির গায়ে। কাগজটা বাঁকা করে কাটত ডাক্তার কাকার কম্পাউন্ডার। করে আঙুলের অর্ধেক মাপের হবে এমন জায়গায় একটি করে বাঁক। ওই বাঁককে বলা হতো 'দাগ'। দিনে তিনবেলা এক দাগ করে সেই তেতো মিক্সচার গিলতে হতো।
কী যে বিচ্ছিরি স্বাদ মিক্সচারের!
দাগ বলতে বোঝানো হতো ওষুধের মাপ।
কিন্তু ডাক্তার কাকার ওই মিক্সচারে আমার জ্বর কমছিল না। এক দুপুরে এমন জ্বর উঠল, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগলাম। তুমি পাগলের মতো ছুটে এসে আমাকে কোলে নিলে। চিৎকার করে বুয়াকে ডাকলে। দৌড়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো বুয়া। আমাকে কোলে নিয়ে বসে রইলে তুমি আর বুয়া বদনার নল দিয়ে মাথায় পানি দিতে লাগল।
আমি চোখ বুজে তোমার কোলে নেতিয়ে আছি।
ততক্ষণে বাড়ির সবাই তোমার ঘরে। তুমি বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে আমার কপালে মুখে ফুঁ দিচ্ছ। বুয়া পানি দিয়েই যাচ্ছে।
কতক্ষণ!
এভাবে কতক্ষণ কে জানে!
একসময় চোখ মেলে তাকালাম আমি। অন্য কোনও দিকে না, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম তোমার মুখের দিকে।
তুমিও তাকিয়ে আছ আমার মুখের দিকে। চোখ দুটো ছলছল করছে। বিড়বিড় করে তখনও দোয়া পড়ছ।
আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একসময় বললে, আল্লাহ রহম করো, রহম করো আল্লাহ। আমার বাজানরে রহম করো।
বুয়া আমার মাথায় পানি দিচ্ছিল। সেই পানিতে তোমার শাড়ি ভিজেছে।
মা, মা গো, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট লুঙ্গি। ওই সেদিনের মতো আমার মাথার পানিতে ভিজেছিল তোমার শাড়ি, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট লুঙ্গি। কবরে নামাবার আগে কোলে নিয়েছি তোমাকে, তাকিয়ে আছি তোমার মুখের দিকে। চাঁদের আলোয় অনেকটাই পরিষ্কার তোমার মুখ। চোখ দুটো বন্ধ। সেখানে আবছামতো অন্ধকার।
আহা, তুমি যদি একবার তাকাতে আমার দিকে!
জ্বরের ঘোর কাটিয়ে আমি যেমন সেদিন তাকিয়েছিলাম তোমার মুখের দিকে, মৃত্যু কাটিয়ে তুমি যদি তাকাতে আমার দিকে! আল্লাহপাককে যদি আমি বলতে পারতাম, রহম করো আল্লাহ, আমার মাকে তুমি রহম করো।
এখন কোলে নেওয়ার পর আবার মনে হলো তোমার ওজন এত কমে গেছে কেন, মা?
তুমি খাওয়াদাওয়া করতে না ঠিকঠাকমতো!
নাকি আমার কথা ভেবে খাওয়া বন্ধ করেছিলে।
মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে ছেলে! মেলাঘরে ট্রেনিং নিচ্ছে, ট্রেনিং শেষে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করছে পাকিস্তানি... ...দের বিরুদ্ধে। এ কথা তুমি জানতে। বাড়ির সবাই জানত। নিশ্চয়ই তোমার মনে হতো, সেখানে ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া হচ্ছে কি না আমার! পেটভরে তিনবেলা খেতে পাচ্ছি কি না আমি। হয়তো খেতে বসলেই আমার কথা তোমার মনে হতো আর ওসব ভেবে তুমি খেতে পারতে না।
আমি বুঝেছি মা, আমি বুঝেছি। আমার জন্যই তোমার ওজন কমে গেছে! আমার কথা ভেবেই তুমি ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করোনি।
কিন্তু আমি ভালো ছিলাম মা। আমি মোটামুটি ভালো ছিলাম। খাওয়াদাওয়া হতো আর কি!
দেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে গেছে ভারতে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী অবর্ণনীয় কষ্টে আছে তারা। অপুষ্টিতে ভুগে শিশুরা মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। মানুষের কঙ্কালসার চেহারা। সেই তুলনায় ভালোই ছিলাম।
আমার কথা ভেবে কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিয়েছ, মা! বরং তোমার তো ভালো থাকার কথা ছিল। তোমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। দেশ স্বাধীন করবে! এই নিয়ে তোমার তো অহংকার করার কথা!
অহংকার তুমি করেছ নিশ্চয়ই কিন্তু নিজের খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবোনি।
এটা তোমার দোষ না, মা। তুমি হচ্ছো বাঙালি মায়ের প্রতীক। বাংলার প্রত্যেক মা-ই তোমার মতো। সন্তানের কথা ভেবে এমনই করেন তাঁরা।
এই দেখো মা, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির সামনের আঙিনা। সেখানে বাবাকে কবর দিয়েছি আমি। এখন দেব তোমার কবর। একটু একটু হাওয়া আসছে। ঝিঁঝি ডাকছে তাদের নিজস্ব নিয়মে। মাথার ওপর দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে উড়ে গেল একটা বাদুড়। কোথায় যেন ডাকছে একটা ডাহুক পাখি।
আমাদের দিঘির ওদিকে?
হতে পারে।
আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। শুধু অচেনা একটা ফুলের গন্ধ আসে হাওয়ায়। কোথায় কোন ঝোপে ফুটেছে বুনো ফুল, কে জানে!
মা গো, সেই কিশোর বয়সে বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন,
মনে রে আজ কহো যে
ভালোমন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে
আমি সেকথা ভুলিনি। বাবা আর তুমি যখন যা বলেছ আমি মনে রেখেছি। যখন যা শিখিয়েছ, মনে রেখেছি। কিচ্ছু ভুলিনি।
কিন্তু আমি আমার মনকে আজ কী করে বলি, কী করে এই সত্য মেনে নিই, বাবা নেই, তুমি নেই। আমার বকুল নেই, মায়া নেই। আমার স্বপ্নের সন্তান নেই। আমার জীবনে আর কিছু নেই, কিচ্ছু নেই। আমার মতো দুঃখী মানুষ আর কে আছে, বলো মা, কে আছে!
আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, আমার সব ভালোলাগা শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে আমার আর দিন থাকবে না, রাত থাকবে না। এখন থেকে বাবা থাকবে না, মা থাকবে না, বোন থাকবে না, মায়াকে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো থাকবে না!
আমি কার কাছে ফিরব, মা! কার কাছে যাব!
আমার পায়ের তলায় বাংলাদেশের মাটি থাকবে, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি, মাথার ওপর যে আকাশটুকু থাকবে তাও আমার নিজস্ব আকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীন আকাশ। হাওয়া থাকবে, রোদ্র ছায়া থাকবে। গ্রীষ্ম ফুরিয়ে বর্ষা আসবে, শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত আসবে। বনে বনে ফুটবে বসন্তের ফুল। গানে গানে মুখর হবে পাখিরা। তিল ফুলের মধু নিতে শস্যের মাঠে ছুটবে মৌমাছির দল, হলুদ শর্ষে ফুলে ভরে যাবে বাংলার মাঠ, ধানিবিল সবুজ সোনালি হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাঁশবন শনশন করবে হাওয়ায়। ফুলের গন্ধে ঘুম আসবে না। বর্ষার নিঝুম বৃষ্টিতে দিনের বেলাই অন্ধকার হবে চারদিক। কোনও ফুল ঝরে যাবে অন্ধকারে। সেই কবিতার লাইন মা, সেই কবিতার লাইন। 'কী ফুল ঝরিল অন্ধকারে'।
শরতের আকাশ তোমার শাড়ির আঁচলের মতো নির্মল হবে। নীল আকাশে ভাসবে সাদা মেঘের ভেলা। রজতরেখার তীর সাদা হবে কাশফুলে। আমার চোখের পানির মতো নিঃশব্দে ঝরবে কাশের রেণু। হেমন্তে বইবে উত্তরে হাওয়া। শীতের কুয়াশা নামবে এই বাংলায়। কুয়াশা সরিয়ে একটু বেলা করে উঠবে সূর্য। আড়মোড়া ভাঙবে গাছের পাতা আর ঝোপঝাড়, ঘাসের ডগায় জমবে শিশুর চোখের কোণে জমে থাকা কান্নার মতো একটুখানি শিশির। সেই শিশির ঝরে পড়বে মাটিতে। ভাঁড়ে করে খেজুরের রস নিয়ে আসবে গাছিরা। খেজুরের গাছে পাতা রসের হাঁড়িতে ঠোঁট ডুবাবে ভোরবেলার বুলবুলি।
স্বাধীনতা আসছে। বাংলার স্বাধীনতা। যেন এই বাংলায় আসছে দুরন্ত এক বসন্তকাল। বসন্তের হাওয়ায় দেশগ্রামের চারদিকে ভাসবে ফুলের সুবাস। বসন্ত জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হবে রাতের গ্রামবাংলা।
ওরকম জ্যোৎস্না রাতে আমি হয়তো একাকী বাড়ি ফিরতে চাইব। আমার হয়তো মনে হবে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে আমার মা, বাবা আছেন, বকুল তাকিয়ে আছে তার জানালা দিয়ে, মায়া অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে সামনের উঠানে। বিকালের লঞ্চে আসার কথা। রাত তো হবেই। পূর্ণিমা সন্ধ্যায় এই বাড়িতে না ফিরে কি আমি পারি!
সেই অপেক্ষায় থাকবে সবাই।
মা, আজ থেকে কেউ কোথাও আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। না বাবা, না তুমি। না বকুল, না মায়া। আমি একাকী এক দুঃখী মানুষ শ্রাবণ রাতের জ্যোৎস্না দেখে কাঁদব। আষাঢ়ের বৃষ্টি হবে চোখের পানি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার চোখের ভিতরটা হয়ে থাকবে বর্ষাকালের রজতরেখা।
মা, গ্রীষ্মের ছুটি হবে কয়েক দিন পর। আম কাঁঠালের ছুটি। তার আগেই এমন গরম পড়তে শুরু করেছে। বিকালের মুখে মুখে ছুটি হয়েছে স্কুল। বাড়ি থেকে তেমন দূরের পথ না। তবু ওইটুকু পথ হেঁটে এসে ভালো রকম ঘেমেছি। দরজায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি। আমার জন্য অপেক্ষা করছ। কখন স্কুল ছুটি হবে, কখন ফিরবে তোমার ছেলেটি। যেই আমি ফিরেছি, তুমি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছ আমাকে। কী যে মমতায় আঁচলে মুছিয়ে দিয়েছ মুখখানি! মাথাটা বুকে জড়িয়ে বলেছ, আহা রে আমার সোনা, আমার মানিক। গরমে কষ্ট পাইছ, বাজান! আসো তোমার হাতমুখ ধোয়াইয়া দেই, ভাত খাওয়াইয়া দেই।
ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার বয়স পর্যন্ত নিজ হাতে আমাকে তুমি ভাত খাইয়ে দিতে। এ নিয়ে বাবা হাসাহাসি করতেন। ছেলেটাকে তুমি বড় হতে দেবে না।
তুমি রেগে যেতে। মায়ের কাছে ছেলে আবার বড় হয় কেমনে? ছেলে সব সময়ই থাকে মায়ের আঁচলের তলায়।
মা গো, তোমার সেই আঁচল আমি কোথায় পাব! কে আমাকে ফিরিয়ে দেবে তোমার আঁচলখানি।
বড় হয়ে যাওয়ার পরও, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বাড়ি এলে তুমি সেই ছেলেবেলার মতো প্রথমেই আঁচলে মুছিয়ে দিতে মুখ। আমার মাথাটা কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখতে বুকে।
একদিনের কথা মনে পড়েছে।
ছেলেবেলার কথা। আষাঢ় মাস। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমাকে নিয়ে তুমি গেছ বাগানের দিকটায়। ওদিককার কদমগাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে গেছে। আমিই টেনে নিয়ে গেছি তোমাকে। চলো মা, কদম ফুল দেখে আসি।
তখনও বকুল হয়নি।
কত বয়স আমার! ছয় সাড়ে ছয়।
আমাকে নিয়ে তুমি কদম বাগানে গেছ। হঠাৎ নামল বৃষ্টি। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরজ্বারি হয় না। তবু তুমি এমন দিশাহারা হলে, কী করে বৃষ্টির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে প্রথমে বুঝতে পারলে না। তারপর শাড়ির আঁচলে আমার মাথা ঢেকে, আমাকে জড়িয়ে ধরে দরদালানের দিকে দৌড় দিলে। যেন তোমার আঁচল বৃষ্টি থেকে বাঁচাবে আমাকে। যাবতীয় বালা মুসিবত থেকে বাঁচাবে।
বিয়ের দিনও আঁচল দিয়ে তুমি আমার মুখ মুছিয়ে দিয়েছিলে, মা।
আমাদের বিয়ে হলো ফেব্রুয়ারি মাসে। তখনও শীতকাল পুরোপুরি শেষ হয়নি। আমি শেরোয়ানি পরেছি, ঘি রঙের শেরোয়ানি। সাদা চোস্ত পায়জামা, পায়ে নাগরা, মাথায় পাগড়ি, মুখটা একটু বোধ হয় ঘেমেছিল। ওই অবস্থায় আঁচলে চেপে চেপে তুমি আমার মুখ মোছালে।
তোমার আঁচলের ছোঁয়া আমার সারা মুখে মা, তোমার আঁচলের ছায়া আমার মাথায়, আমার জীবনজুড়ে। তোমার সেই আঁচল আজ রক্তাক্ত। আমার জীবন থেকে চিরতরে সরে গেল তোমার আঁচলের ছায়া।
এই ছায়াটুকুর জন্য আমি কার কাছে যাব, মা?
বিয়ের পর মায়াকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। খেজুরতলায় গিয়ে অপেক্ষা করছিল বকুল কদম বুয়া পারুল আশপাশের বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়ে অনেকেই। বারেকও ছিল। বিকালবেলা। ঢাকা থেকে আসতে হয় সদরঘাট থেকে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ থেকে রিকশায় কাটাখালী। কাটাখালী থেকে লঞ্চের মতো ছোট ছোট স্পিডবোট আসে দীঘিরপার পর্যন্ত। মাঝখানে পুরা খেজুরতলায় আরও কোথাও কোথাও থামে।
খেজুরতলা থেকে বাড়ি এলাম আমরা।
মায়ার জন্য পালকির ব্যবস্থা ছিল। মায়া এলো পালকি চড়ে, আমি সবার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে। বাড়ি আসার পর বউকে পালকি থেকে কী নামাবে তুমি, ছুটে এলো আমার কাছে। সেই ছেলেবেলার মতো আঁচলে আমার মুখ মুছিয়ে দিতে লাগলে। যেন ভুলেই গেলে ছেলে তোমার বিয়ে করেছে এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে। ঘটা করে বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। তোমরা সবাই তখন ঢাকাতেই ছিলে। দুই বোনের ছেলেমেয়েতে বিয়ে হচ্ছে। এক বাড়িতেই সবকিছু, বিয়ের অনুষ্ঠান, বৌভাত। দুই বোনের তো একই বাড়ি।
তারপর কয়েক দিন ঢাকায় থেকে তোমরা চলে এসেছিলে বাড়িতে। মায়াকে নিয়ে আমি এলাম আরও কয়েক দিন পর।
বউ বাড়ির উঠানে, তখনও বসে আছে পালকিতে আর তুমি আঁচলে মুছাচ্ছ ছেলের মুখ, পালকিতে বসেই মায়া হাসতে লাগল। বাবা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, এই বয়সে এভাবে ছেলের মুখ মোছাতে হবে না। পালকি থেকে বউ নামাও।
তখন তোমার খেয়াল হলো, আরে তাই তো! তুমি মায়াকে নিয়ে ব্যস্ত হলে।
কিন্তু মা, আমার ভালো লেগেছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল। যত বড়ই হয়ে থাকি, তোমার কাছে এলেই আমি শিশু। মনে মনে অপেক্ষা করি আমার মাথাটা তুমি বুকে জড়িয়ে ধরো। ঘাম না থাকলেও মুখটা আঁচলে মুছিয়ে দাও।
মায়া এই বাড়িতে, ওই তো বিয়ের পরের ওই দিলগুলোর কথাই বলছি। সকালবেলা আমরা সবাই নাশতা করতে বসেছি, বাবা হাসতে হাসতে বললেন, রবি বড় হয়েছে, বাড়িতে বউ এসেছে, এখন আর ছেলে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।
তুমি বাবার দিকে তাকালে। কিয়ের বাড়াবাড়ি?
ওই যে আঁচলে মুখটুখ মোছানো!
তুমি একটু রাগলে। আমার ছেলের মুখ আমি মোছাইয়া দিলে অন্য কেউর কোনও অসুবিধা আছে?
না তা নেই, কিন্তু ছেলে বড় হয়েছে তো!
তখন তুমি একটা গল্প বললে। ছেলে বিয়ে করিয়ে বাড়িতে বউ এনেছেন এক মা। ছেলের ঘরে নাতিও হয়েছে। ছেলের বউ এক রোদেলা দিনে ছেলেকে বলল, উঠানের কোণে আমি ফুলের চারা লাগাব, মাটি পরিপাটি করো।
বউয়ের কথায় কাজে লেগে গেল ছেলে। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ফুলের চারা লাগাবার উপযুক্ত করতে লাগল উঠানের এক কোণ। গরমের দিন। কোদাল চালাতে চালাতে ঘেমে একেবারে নেয়ে গেল ছেলে।
মা তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। একটা সময়ে তাঁর আর সহ্য হলো না। বউ ছেলের ঘরে ঘুমাচ্ছে তাদের ছোট্ট শিশুটি। তিনি সেই ঘরে ঢুকে নাতিকে কোলে নিয়ে উঠানের রোদে এলেন। শিশুটিকে শুইয়ে দিলেন রোদে গরমে ভেসে যাওয়া উঠানের মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে ছুটে এলো ছেলের বউ। হায় হায়, এটা কী করেছেন আম্মা। আমার ছেলে তো গরমে অস্থির হয়ে যাবে।
শাশুড়ি বললেন, তোমার ছেলে ছেলে! আমার ছেলে ছেলে না! সে যে রোদে গরমে কষ্ট পাচ্ছে এটা আমি সহ্য করি কেমন করে? তুমি তো এক মিনিট নিজের ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারলে না!
সেই ছেলে বউয়ের কথায় বাড়ির উঠানে কোদাল চালাচ্ছিল, বউ মোরগফুল, দোপাটি বেলি এসবের চারা লাগাবে। আর আমি কোদাল চালাচ্ছি আমার মায়ের কবর খোঁড়ার জন্য। হায় রে আমার নিয়তি।
মনে আছে, মা। তোমার বলা গল্পটা আমার মনে আছে।
গল্প শুনে বকুল তাকিয়েছিল মায়ার দিকে। মায়ের গল্পের অর্থ বুঝেছ, মায়াপা! তোমাকে কিন্তু যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ছেলেকে কষ্ট দিয়ো না।
মায়া মাথা নিচু করে বসে রইল।
আরে, দেখো মা আমি কী করেছি! তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কতটা সময় চলে গেছে খেয়ালই করিনি। তোমার কবরের পাশে নিজের অজান্তেই খুঁড়ে ফেলেছি বকুলের কবর। দুটো কবরের কাজ শেষ করেছি। ঘামে জবজব করছে মুখ, গলা বুক পিঠ। মা গো, ওই তো তোমার আঁচল লুটাচ্ছে উঠানের মাটিতে। আমার মুখটা একটু মুছিয়ে দাও না, মা! আমার মাথাটা একটুখানি জড়িয়ে ধরো না তোমার বুকে।
মা গো, স্কুল মাঠের দক্ষিণ কোণে বিশাল বটগাছ। টিফিন পিরিয়ডে সেই বটের ছায়ায় বসে কত দুপুর গল্প করে কাটিয়েছি আমি আর বাচ্চু। বড় হয়ে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কোনও কোনও জ্যোৎস্না রাতে কদমকে নিয়ে চলে গেছি ওদিকটায়। রজতরেখার তীরেও ঘুরে বেরিয়েছি। আজকের পর সেই জীবনে আমার আর কখনও ফেরা হবে না।
এই যে এখন আমি তোমাকে কবরে শোয়াচ্ছি মা, আমার বুক ফেটে যায়, চোখ ফেটে যায়। তোমার রক্ত মাখা আঁচলে আমি আমার মুখটা একটু মুছি, মা? আমার চোখের পানিটা একটু মুছি?
মা গো, স্কুল মাঠের বটতলায় গেলে আমি দেখতে পাব তোমার আঁচলের ছায়া। বটের তলায় শুয়ে পড়লে মনে হবে আমি চলে গেছি আমার শিশু বয়সে, শুয়ে আছি তোমার আঁচলের তলায়। আমার তখন চোখ ভেসে যাবে চোখের পানিতে। স্বাধীন বাংলার রোদেলা দুপুরে বটের ছায়ায় শুয়ে তোমার জন্য চোখের পানিতে ভাসব আমি।
কোনও কোনও বিষণ্ন বিকালে রজতরেখার তীরে একাকী হাঁটতে হাঁটতে নদীর হাওয়ায় পাব তোমার আঁচলের ছোঁয়া। আমার বুক হু হু করবে, চোখ ভেসে যাবে। নদীটি তোমার মতো গভীর মমতায় তার হাওয়ায় আঁচলে মুছিয়ে দেবে চোখের পানি।
তুমি নেই, আমার জন্য রইল আমার বাংলা মা।
যেসব বই ও পত্রপত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে
১. 'মুক্তিযুদ্ধে নারী'- মালেকা বেগম
২. '২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স কমান্ডার খালেদের কথা'- সম্পাদনা : মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
৩. 'একাত্তরের কন্যা জায়া জননীরা'- মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
৪. 'একাত্তরের বধ্যভূমি'- মো. জয়নাল আবেদীন সম্পাদিত
৫. 'একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন'- আসাদুজ্জামান আসাদ
৬. ফতেহ আলী চৌধুরীর ভাষ্য- 'মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়'- জহিরুল ইসলাম
৭. জহির উদ্দিন জালালের ভাষ্য- 'মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়'- জহিরুল ইসলাম
৮. 'সোহাগপুরের বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু'- প্রথম আলো, ১০ মে ২০১৩
৯. 'চুকনগর গণহত্যা দিবস'- সুরঞ্জিত বৈদ্য, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ মে ২০১৩
১০. 'মুক্তিযুদ্ধে বিক্রমপুর'- মো. জয়নাল আবেদীন
১১. 'দেশকে ভালোবাসা ইমানি দায়িত্ব'- মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০১৩
ফজরের নামাজ শেষ করে বাবা আর শোয় না। তোমার একটু শোয়ার অভ্যাস আছে। নামাজ শেষ করে, মিনিট পনেরো কোরআন শরিফ পড়ে আবার একটু শোও। ঘণ্টাখানেক বা মিনিট চল্লিশ-পঞ্চাশের মতো ঘুমাও।
আজও কি তেমন ঘুমে ছিলে!
প্রথমে বুটের শব্দ, তারপর গুলির শব্দে কি তোমার ঘুম ভেঙেছিল! হঠাৎ ভাঙা ঘুমচোখে তুমি কি পাগলের মতো ছুটে এসেছিলে বসার ঘরের দিকে! তার আগেই সামনের দিককার উঠানে বাবাকে ওরা গুলি করেছে! বাবার লাশ উঠানে লুটিয়ে পড়ার পর ওরা ঢুকেছিল বসার ঘরে! আর ঠিক তখনই বোধ হয় ছুটে আসছিলে তুমি। তোমাকেও বাবার মতো করেই গুলি করেছে। তুমি লুটিয়ে পড়েছ বসার ঘরের মেঝেতে! তোমার শরীর ঝাঁঝরা করে ওদের গুলি গিয়ে বিঁধেছে আমাদের বহু বহু বছরের পুরনো বাড়ির, বসার ঘরের দেয়ালে। দেয়ালের আস্তর খসে পড়েছে মেঝেতে। তোমার রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে চুন-সুরকি। তোমার শাড়ি ভিজিয়ে রক্তের ধারা পুরনো কালের সিমেন্টে গড়িয়ে যাচ্ছিল। বাইরের দিককার দরজার কাছাকাছি গিয়ে আর যেতে পারেনি। জমাট বেঁধে গেছে।
আমি যখন বাবার লাশ দেখে বসার ঘরে ঢুকেছি, মা গো, এই যে আমি এত দিন পর বাড়ি ফিরেছি মাত্র একটা রাতের জন্য, উঠানে বাবার লাশ দেখার পর, কিভাবে কী হয়েছে ভাবতে ভাবতে আমার মাথাটা যখন শূন্য হয়ে গেছে, তখন তোমাকে আমি দেখতে পেলাম।
তুমি পড়ে আছ বসার ঘরে। তোমার মুখ দরজার দিকে। চোখ বন্ধ। কাত হয়ে একটু যেন দুমড়ে আছ।
মা, মা গো, এই দৃশ্য সহ্য করতে পারে কোন সন্তান! তার বুক ফেটে যাওয়ার কথা, কলিজা ফেটে মরে যাওয়ার কথা, তার তো চোখের জল কোনও বাধ মানবে না।
আমি কাঁদতে পারছিলাম না, মা। আমার বুক কলিজা কোনওটাই ফেটে যায়নি। আমি কেমন যেন নির্বোধ হয়ে গেলাম। আমার শরীরে মনে কোথাও যেন কোনও অনুভূতি নেই। আমি যেন কোনও মানুষ নই, আমি যেন এক জড় পদার্থ। প্রথমে তাকিয়ে দেখলাম বাবার লাশ, তারপর কেমন উদাস নির্বিকার ভঙ্গিতে ঢুকলাম বসার ঘরে, তোমাকে দেখলাম। বকুলের ঘরে ঢুকে বকুলকে দেখলাম। আমার আর মায়ার ঘরের দিকে গিয়ে দেখি সেই ঘরে কেউ নেই। আমি যেন খুব স্বাভাবিক মানুষের মতো একটু অবাক হলাম। মায়া, কোথায় তুমি? এ রকম একটা ডাকও যেন আমার ডাকতে ইচ্ছা করল।
শেষ বিকালটা মায়ার খুব প্রিয় সময়। সে রবীন্দ্রনাথে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা মেয়ে। প্রকৃতি তাকে খুব আকর্ষণ করে। শেষ বিকালের রোদ যখন উঠে যায় গাছপালার মাথায়, চারদিকে ডাকাডাকি শুরু করে দিনশেষের পাখিরা, শ্রাবণ আকাশে আজ মেঘ নেই বলে ঝকঝকে নীল আকাশ, রজতরেখার ওদিক থেকে, বর্ষার ধানি বিল মাঠ পেরিয়ে আমাদের বাড়ির দিকে উড়ে আসা হাওয়া, গাছের পাতায় পাতায় হাওয়ার খেলা দেখতে মায়া নিশ্চয়ই পেছনের বাগানের দিকে গিয়েছে ভেবে আমি ঘর থেকে বেরোলাম।
আশ্চর্য ব্যাপার মা, আমি যে ততক্ষণে আমার জীবনের সবচাইতে মূল্যবান দুজন মানুষের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া লাশ দেখেছি, হৃদয়ের টুকরো বোনটিকে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছি তার ঘরের মেঝেতে, তাকে আর গুলি করার প্রয়োজন মনে করেনি দানবরা, এমনিতেই মরে গিয়েছিল সে, সেই বোনটিকে দেখেছি, তারপর নিজের রুমে এসে মায়াকে ওভাবে ডাকতে ইচ্ছা করল আমার, এমন হয় নাকি, মা! একজন মানুষ কেমন করে পারে এমন নির্বিকার হয়ে যেতে!
তারপর মায়াকে খুঁজতে আমি ঘর থেকে বেরোলাম। তাকে পড়ে থাকতে দেখলাম পিছন দিককার উঠানে। বেয়নেটের পর বেয়নেট চার্জ করা হয়েছে তার পেটে। মায়ার গর্ভে ছিল আমার সাত সাড়ে সাত মাসের সন্তান। মুখ মাথা হাত পা সবই তৈরি হয়ে গেছে। মায়ের গর্ভেও নিরাপদে থাকতে পারেনি সে। বেয়নেট মায়ার মতোই লণ্ডভণ্ড করেছে তার ওইটুকু শরীর। শুধু মুখটুকু অক্ষত। ফোলা ফোলা বন্ধ দুটো চোখ। বিকাল শেষ হওয়া আলোয় সেই মুখ দেখেও আমি যেন কিছুই অনুভব করলাম না। মায়ার মায়াবী মুখ, আমার সন্তানের শরীর, ছোট্ট মুখখানি- কোনও কিছুই আমাকে বিচলিত করল না।
কেন মা?
কেন এমন হলো আমার?
বরং মায়া আর আমার সন্তানের লণ্ডভণ্ড শরীর ঘিরে, রক্তমাংস মেদ মজ্জার ঘ্রাণে নীল বড় সাইজের যে মাছিগুলো ওড়াউড়ি করছিল, ওদের শরীরে বসছিল, সামনে কিছুক্ষণ বসে ডান হাত হাতপাখার মতো নাড়িয়ে মাছিগুলোকে আমি তাড়ানোর চেষ্টা করলাম।
আমি এমন হয়ে গেলাম কেন, মা?
এই অবস্থাটাকে কী বলে? অধিক শোকে পাথর! এই কি অধিক শোকে পাথর হওয়া!
কিন্তু তোমার ওজন এত কমে গেছে কেন, মা? আমার জন্য? আমার কথা ভেবে তুমি ঠিকমতো খাওনি, ঘুমাওনি। একমাত্র ছেলে কোথায় কোথায় যুদ্ধ করছে দেশের জন্য, তার কথা ভেবে এই অবস্থা তোমার! ছেলে তিন বেলা খেতে পাচ্ছে কি না, রাতে ঘুমাতে পারছে কি না, এসব ভেবে খাওয়া ঘুম বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি!
এই যে পাঁজাকোলে করে তোমাকে আমি উঠানে নিয়ে এলাম, বাবার কবরের দক্ষিণ দিকটায় শুইয়ে দিয়ে শুরু করেছি তোমার কবর খোঁড়ার কাজ, এই ফাঁকে টের পেলাম, তুমি আর তুমি ছিলে না, মা। আমার ভাবনায় শেষ হয়ে গিয়েছিলে তুমি!
তোমাদের দেখে বাবার কাছে ফিরলাম আমি। বাবার পাশে মাটিতে লেছড়ে-পেছড়ে বসে তাঁর বুকে হাত বোলাতে লাগলাম। তারপর মনে হলো, এভাবে বসে থেকে কী হবে! এখন শুরু করতে হবে আমার দায়িত্ব, সন্তান ভাই স্বামী আর জনকের দায়িত্ব।
গোয়ালঘরের ওদিক থেকে কোদাল এনে কাজ শুরু করলাম, সেই ফাঁকে কখন দিনের আলো ফুরিয়ে গেল, কখন আবছা অন্ধকারে বাড়ি ভরে ওঠার আগেই চাঁদ উঠে গেল পুব আকাশে, টেরই পেলাম না।
আজ কি পূর্ণিমা?
নাকি পূর্ণিমার এখনো দু-এক দিন বাকি?
কী জানি!
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং নিতে নিতে, চাঁদের হিসাব আমার মাথা থেকে উধাও হয়ে গেছে। অথচ তোমরা সবাই জানো, আমি চাঁদপাগল ছেলে। পূর্ণিমা রাত, প্রখর জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া জগৎসংসার খুবই প্রিয় আমার। বাড়িতে থাকলে, আমাদের এই গাছপালাঘেরা বাড়িতে, জ্যোৎস্না রাতে একা একা আমি ঘুরে বেড়াতাম। রাত একটা দুটো বেজে যেত, আমি এদিক যাচ্ছি, ওদিক যাচ্ছি। কোথাও বসে তাকিয়ে আছি চাঁদের দিকে। রাত কত হলো খেয়ালই করছি না।
আমাকে নিয়ে অদ্ভুত একটা ভয় ছিল তোমার।
ভূতের ভয়।
এত বড় গাছপালাঘেরা বাড়ি, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় রাতের বেলা কিছুতেই যেন না যাই, বারবার এসব বলতে। ওদিকটায় নাকি 'স্কন্ধকাটা' নামের একজনের বসবাস। অন্ধকার রাতে তার চলাচলের শব্দ পাওয়া যায়, চোখে দেখা যায় না। জ্যোৎস্না রাতে দেখা যায়। বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় হাঁটাচলা করে। ওই জিনিসের ধড় আছে, মাথা নেই। ঘাড়ের ওপর থেকে কাটা। এ জন্য ও রকম নাম- স্কন্ধকাটা। তবে সারা শরীরেই চোখ। দেড়-দু শ নাকি চোখ শরীরে। কোনও কোনও নির্জন দুপুরেও নাকি কদম তাকে দূর থেকে দেখেছে। বারেকের মা নাকি প্রায়ই দেখত।
ওই মহিলার কথা আমরা কেউ বিশ্বাস করতাম না। গল্পবাজ মহিলা। ভূতের গল্প বলেও হাসত। তার হাসি দেখে ভূতের ভয় উধাও হয়ে যেত আমাদের। বুঝতাম, বানিয়ে বানিয়ে গল্প করছে।
তবে বারেকের মায়ের জান হচ্ছে বকুল।
না না, এখন বলতে হবে 'ছিল'!
বকুলকে সে ডাকত 'কুট্টি'। অর্থাৎ ছোট্ট। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ। বহু বছর ধরে আমাদের বাড়িতে। বকুলকে জন্মাতে দেখেছে। তোমাকে ডাকত মা। বিয়ে হয়েছিল এক ডাকাতের সঙ্গে। প্রথমে জানত না লোকটা ডাকাতি করে। বিয়ের কিছুদিন পর জানতে পারে। তত দিনে বারেক তার গর্ভে। বারেককে পেটে নিয়েই বাপের বাড়িতে চলে এসেছিল। ডাকাতের সংসার সে করবে না। হতদরিদ্র বাপ-ভাই ভালো রকম বিপদে পড়ল তাকে নিয়ে। নিজেদের সাধ্যমতো অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। বাচ্চা পেটে এ রকম মেয়েকে কে বিয়ে করবে!
বারেক জন্মাল। সেই ছেলে কোলে নিয়ে বাপ-ভাইয়ের সংসার ছাড়ল সে। কেমন কেমন করে এসে উঠল আমাদের সংসারে। মহিলাটি বাজখাঁই টাইপের। কথা বলে চিৎকার করে। গলার স্বর পুরুষালি। কিন্তু মনটা খুব নরম। মানুষের জন্য খুব মায়া।
বারেকের মায়ের ভূতের গল্প শুনে বারেক পর্যন্ত হাসত। আমাদের কাউকে তো আর ধমক দিতে পারে না সে, বকুল হয়তো তার কোলে বসে আছে, হাসতে হাসতে নিজের ছেলেকেই একটা ধমক দিল।
বারেক ওসব ধমক পাত্তা দিত না। শরীরে ডাকাত বাপের রক্ত বলে ওইটুকু বয়স থেকেই বারেক বেশ সাহসী। ডর-ভয় একদমই নেই। আট-দশ বছর বয়সেই গভীর অন্ধকার রাতে বাড়ির এদিক-ওদিক চলে যেত। বারেকের মা কত রকমভাবে শাসন করত; শুনতই না।
তোমার মনে আছে মা, বারেককে আমাদের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা। ক্লাস টু না থ্রি পর্যন্ত অতিকষ্টে সে পড়ল। বাবা তুমি আমি, এমনকি ছোট বকুল পর্যন্ত তাকে পড়ানোর চেষ্টা করত, পড়ায় ওর মনই বসে না। পড়তে বসলেই উসখুস উসখুস করে। একদিন স্কুলে যায় তো দুদিন যায় না। স্কুলের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গিয়ে যে পালিয়ে থাকে! বারেককে কিছুতেই আমরা সামলাতে পারছিলাম না।
এসব দেখে একদিন বারেকের মা মহা খ্যাপা খেপল।
রান্নাঘরের সামনে বসে তার সেই বাজখাঁই গলায় গালাগাল করতে লাগল ছেলেকে। ওই ডাকাইতের পো, তুই কি মানুষ হবি, না ডাকাইত হবি?
বারেক নির্বিকার গলায় বলল, ডাকাইত হমু।
বারেকের বয়স তখন দশটশের বেশি না। দশ বছরের ছেলে এভাবে কথা বলছে মায়ের সঙ্গে, বারেকের মা আরো খেপল। কী? কী হবি তুই?
ডাকাইত হমু। মানুষের গলা কাটুম।
কচ কী তুই?
হ, ঠিকই কই। আমার পড়তে ভাল্লাগে না, আমি পড়ুম না। আমি ডাকাইত হইয়া যামু।
বারেকের মা দুপুরের রান্না চড়িয়েছিল। রান্নাটা তাকে খুব ভালো শিখিয়েছিলে তুমি। চুলার পাড়ে বসে ছেলেকে বকছিল আর রান্না করছিল। বারেকের ওসব কথা শুনে চুলায় মাত্র গুঁজতে যাবে এমন একটা লাকড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে বেরোল। ধামা ধাম দু-তিনটা বাড়ি মারল বারেককে। ডাকাইত হবি তুই, ডাকাইত! যেই ডাকাইতের লেইগা আমি সংসার ছাড়ছি, আমার পেটের পোলা হইব সেই ডাকাইত! ডাকাইতের বংশ আমি রাখুম না। পিডাইয়া মাইরা হালামু।
আবার বাড়ি দিতে গেছে বারেককে, বারেক ঝাড়া একটা দৌড় দিল, দৌড় দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় চলে গেল।
সেদিন বাবার স্কুল ছিল না। ছুটির দিন। আমরা সবাই বাড়িতে। বারেকের মায়ের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে সবাই এসে দাঁড়িয়েছি রান্নাঘরের ওদিকটায়। বারেক পালিয়ে গেছে দেখে, তাকে ইচ্ছামতন পিটাতে পারেনি বলে শরীরের রাগ মিটেনি বারেকের মায়ের। আমাদের সবাইকে দেখে রাগটা অভিমানে রূপান্তরিত হলো। হাতের লাকড়ি ছুড়ে ফেলে রান্নাঘরের সামনে অসহায় ভঙ্গিতে বসে পড়ল। বসে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল- যার লেইগা এত কষ্ট করছি আমি, জীবনডা শেষ কইরা দিছি, হেই পোলায় আমারে আইজ কয় লেখাপড়া করব না, ডাকাইত হইব। তয় আর এই রকম পোলা রাইখা লাভ কী? ও মইরা যাউক। নাইলে অরে আমি নিজেই পিডাইয়া মাইরা হালামু।
বাবা খুব নরম গলায় বললেন, থামো বারেকের মা। কান্নাকাটি করে লাভ নেই। সব মানুষের সব কিছু হয় না। তুমি যা চাও তোমার ছেলের তা হবে না। আমি মাস্টার মানুষ। অনেক ছাত্র দেখেছি জীবনে। চেষ্টা তো কম করলাম না তোমার ছেলেকে নিয়ে। লেখাপড়া ওর হবে না। ওকে অন্য কাজে লাগাতে হবে। কদমের মতো ক্ষেতখোলার কাজ করুক। গরুর রাখাল হোক। আজ থেকে এই সব কাজে ওকে লাগিয়ে দাও।
কিন্তু সারা দিন বারেকের দেখা নেই। সেই যে দৌড়ে পালাল, বাঁশঝাড়ের ওদিকে গেল, দুপুর গড়িয়ে যায় ফেরার নাম নেই।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম আমরা। আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর কদম বারেকের মা বারেক আর পারুল রান্নাঘরে বসেই খায়...
আরে, পারুলের কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, মা!
সেও আমাদের সংসারে আছে দশ-বারো বছর ধরে। ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা একটি মেয়ে। যখন আমাদের বাড়িতে কাজে এলো, তখন এত রোগা, একদম বাঁশের মতো। বাঁশ না, বারেকের মা বলত কঞ্চির মতো।
একবার বৈশাখ মাসের দুপুরের পর বাড়ির সামনের দিকে কী কাজে গেছে, হঠাৎই শুরু হলো কালবৈশাখী। দমকা একটা বাতাস এলো, পারুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেল সেই দমকা বাতাস খড়নাড়ার মতো দশ-বারো হাত দূরে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে তাকে।
একজন মানুষকে এভাবে উড়িয়ে নিয়ে যায় হাওয়া!
পরে এই ঘটনা প্রায়ই বলত পারুল আর খুব হাসত।
ছোটবেলায় বসন্ত হয়েছিল। মুখভর্তি বসন্তের দাগ। ঝিমকালো গায়ের রং। এতিম মেয়ে। জন্মের পর প্রথমে মা মরেছে, তারপর বাপ। মা মরেছে বসন্তে, বাপের হয়েছিল যক্ষ্মা। মায়ের সঙ্গে ছোট্ট পারুলেরও বসন্ত হয়েছিল, কিন্তু সে টিকে গেল। বেঁচে থাকল মামাদের গলগ্রহ হয়ে। সেও পদ্মার চরের মানুষ। চরের নাম বোধ হয় পাচ্চর। আমাদের এলাকায় এই ধরনের মানুষদের খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে সবাই। বলে 'চউরা'। চউরা শব্দটা গাল হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। পুরুষরা চউরা, মহিলারা 'চউরানি'।
আমাদের বাড়িতে এসব অসভ্যতা নেই। পারুলকে ভুলেও কেউ আমরা চউরানি বলি না, এমনকি কদম বারেকের মাও না।
কদম বলবে কেন, সেও তো চরেরই লোক।
বাড়িতে আসার পর এমনভাবে পারুল আমাদের সঙ্গে মিশে গেল, মা-বাবার কথা, মামা-মামি, অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের কথা সে বলতই না। সবার কথাই যেন ভুলে গেছে। আমরা ছাড়া তার যেন পৃথিবীতে আর কেউ ছিলই না।
তবে পারুলের অদ্ভুত একটা পরিবর্তন হলো আমাদের বাড়িতে থাকতে থাকতে। কঞ্চির মতো মেয়েটি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবতী হতে লাগল। এমনিতেই ছয় ফুটের মতো লম্বা, তার ওপর স্বাস্থ্য ভালো হতে হতে প্রায় মোটা হয়ে গেল। এ রকম মোটা লম্বা একটি মেয়ে, আচমকা দেখলে কী রকম একটা ধাক্কা যেন লাগে। তার ওপর ঝিমকালো।
বারেকের মা ঠাট্টা করে বলত, ওই পারু, তুই কি মানুষ?
পারুল অবাক হয়ে বলত, তয় আমি কী?
মাইয়া ভূতগো কী কয়, জানচ?
জানি। পেতনি।
তার পরই বারেকের মায়ের ঠাট্টা সে ধরে ফেলত। রেগে গেলে বারেকের মাকে সে বলত বুড়ি। মারমুখো ভঙ্গিতে বলত, ওই বুড়ি, তুমি কি আমারে পেতনি মনে করো?
বারেকের মা খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা পান মুখে দিয়েছে। পান চিবাতে চিবাতেই হাসল। হ, তরে অমুনই লাগে। একলা একলা বাঁশঝাড়ের ওই দিকে যাইচ না।
পারুটা একটু বোকাসোকাও আছে। কথার মারপ্যাঁচ সহজে বোঝে না। বারেকের মা তাকে পেতনি বলেছে, সেটা ভুলে বাঁশঝাড়ের ওদিকে কেন তাকে যেতে মানা করা হচ্ছে ওই নিয়ে পড়ল।
ক্যান, ওই দিকে যামু না ক্যান?
বাঁশঝাড়ে যে একজন থাকে জানচ না?
জানি তো!
দেখছস কুনো দিন?
না। তোমার মুখে হুনছি। কদম মামার মুখে হুনছি।
কদমকে পারুল মামা ডাকত। কেন কে জানে। দুজনই চরের মানুষ বলেই কি না, নাকি মামাদের সংসারে বড় হয়েছে বলে মামাদের বয়সী লোককে মামা ডাকার অভ্যাস হয়েছে!
কিন্তু বাবাকে সে মামা ডাকত না। বাবাকে ডাকত 'ছার'। অর্থাৎ স্যার। উচ্চারণ দোষে সেটা ছার হয়ে যেত। আর তোমাকে ডাকত আম্মা। আমি হচ্ছি ভাইজান, বকুল আপা। বয়স বকুলের মতোই।
সেই দুপুরে বকুলও বোধ হয় ওদের কাছাকাছি ছিল। বারেকের মা আর পারুলের কথা শুনছিল। কদম থাকত গোলাঘরে। ওদিকটায় বসে নারকেলের হুঁকায় গুড়ুক গুড়ুক করে তামাক টানছে। পারুল আর বারেকের মায়ের দিকে তার মন নেই। তামাক টানার সময় তামাকে এতটা মগ্ন থাকে, অন্য কোনও দিকে তাকানোর যেন সময় নেই।
ঘটনা আমাকে বলেছিল বকুল। বলে কী যে হাসি!
বাঁশঝাড়ের ওদিকে পারুলকে যেতে মানা করেছে বারেকের মা। ওদিকে যিনি থাকেন তেনার কথাও বলেছেন।
কিন্তু আসল কথাটা তখনও বলেনি।
বারেকের মাকে পারুল ডাকে খালা। উতলা গলায় সে তারপর বলল, ও খালা, কইলা না, কির লাইগা আমি বাঁশঝাড়তলায় যামু না!
ওই যে কইলাম, একজন আছে।
হেইডা তো হুনলাম। জানিও। তার বাদেও হুকনা বাঁশপাতা আনতে যাই।
আর যাইচ না।
ক্যান? আমি তো রাইত্রে যাই না। যাই দিনে। তাও দোফরে যাই না। বিয়ানের দিকে যাই।
তাও যাইচ না।
ক্যান যামু না হেইডা কইবা তো?
তেনায় থাকেন একলা।
হ, হেইডাও জানি।
বউ নাই।
একলা থাকলে আবার বউ থাকব কেমনে?
তার একটা বউ দরকার।
পারুলও এবার ঠাট্টা করল। তোমার লগে দেখা হইছিল? কইছে তোমারে?
বারেকের মা হাসল। হ, দেখা হইছিল। কইছে আমারে।
কী কইছে?
তার একটা বউ দরকার। তরে তেনায় বহুত পছন্দ করেন। দূর থিকা দেখছেন। তেনার চেহারার লগে তর মিল আছে। তেনার খালি মাথাডা নাই, তর মাথা আছে। একলা পাইলেই সে তরে বিয়া কইরা ফালাইব।
এই শুনে পারুল মহা চেতা চেতল। বলল, আমি তো দেখি তোমার চেহারাও তেনার মতন। তোমার লগে যহন দেহা হইছিল, তোমারে তেনায় বিবাহ করেন নাই ক্যান?
বারেকের মা নির্বিকার। আরে আমি তো বুড়ি হইয়া গেছি। বুড়ি তেনায় বিবাহ করবেন না। আর আমার লগে তার জাতপাতও বনে না। তেনায় মানুষ বিবাহ করবেন না, তেনার দরকার তার জাতের জিনিস। পেতনি। ভূতের বউ পেতনি।
বোকা মানুষ রাগলে ভয়ংকর হয়। বারেকের মায়ের কথাবার্তা শুনে ভয়ংকর হয়ে উঠল পারুল। কী রেখে কী বলবে বুঝতে না পেরে তোতলাতে লাগল। রাগলে তোতলানোর স্বভাব তার।
বকুল গিয়ে থামাল পারুলকে। বারেকের মাকে কপট ধমক দিল হাসতে হাসতে, আর পারুলের হাত ধরে তাকে টেনে সরিয়ে আনল।
মা, আমি কি আবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি?
আমি কি এখন আর বাস্তবে নেই! আমি কি এই সময়ের মধ্যে নেই! এই যে আমি গোরখোদকের ভঙ্গিতে কোদাল চালাচ্ছি, চাক চাক মাটি তুলে দুপাশে রাখছি, বাবার কবরের সঙ্গে তোমার কবরের ব্যবধান দু-আড়াই হাত, অতিকষ্টের কঠিন কাজ, ঘামে জবজব করছে শরীর, ওই তো আমার সামনে তুমি, বাবাকে যেভাবে সামনে রেখে খুঁড়েছিলাম তাঁর কবর, ঠিক সেইভাবেই করছি তোমার কাজ, তার পরও তোমার কথা আমি বলছি না, বাড়ির অন্যান্য মানুষের কথা বলছি। বারেকের মা, বারেক আর পারুলের কথা বলছি। কদমও আছে সঙ্গে। তাদের ঘিরে কত টুকটাক স্মৃতির কথা বলছি।
এত কথা আমার কেন মনে পড়ছে, মা!
আরে, ওই দেখো, এখনই আমার মনে পড়ল, বাবার কবর খোঁড়ার সময় বাবাকে নিয়ে যখন কথা বলছিলাম তখন বাড়ির কাজের লোকদের মধ্যে আমার শুধু কদমের কথাই মনে আসছিল। বাড়ির পোষা জীবগুলোর কথা মনে আসছিল। আমাদের গরু ছাগল মুরগি কুকুর বিড়াল কবুতরগুলোর কথা মনে আসছিল। খোঁয়াড়ের ওদিকটায় না কোথায় যেন কবুতর ডাকার মৃদু শব্দও পেলাম। অথচ বাড়িতে যে জলজ্যান্ত আরো দুজন মানুষ ছিল, বারেকের মা আর পারুল, তাদের কথা মনেই পড়ল না।
কেন মা?
আমার এমন হচ্ছে কেন?
স্মৃতিশক্তি, স্মরণশক্তি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে কেন?
আর মানুষ দুজন গেলই বা কোথায়?
গোলাগুলির শব্দে, ভয়ে আতঙ্কে ওরা দুজন কি ছুটে গিয়ে কোনো ঝোপঝাড়ে লুকিয়েছিল! নাকি বর্ষার পানিতে নেমে নিজের জীবন বাঁচাতে সাঁতরে চলে গিয়েছিল কোনও দিকে! ওরা কি বেঁচে আছে? নাকি বাড়ির সবাইকে শেষ করে, বাড়ি লুটপাট করে খুঁজে খুঁজে ওদেরও বের করেছিল পাকিস্তানি... ...গুলো! ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা মাঠের ওদিককার বর্ষার পানিতে খুঁজে পেয়েছিল ওদেরকে। ওখানেই গুলি করে শেষ করে দিয়েছে।
ওদের লাশও কি এতক্ষণে ভেসে উঠেছে মাঠবিলের ওদিকে!
বল্টু কুকুরটা গেল কোথায়?
বিড়ালটা?
গোলাগুলির শব্দে কুকুরটাও কি ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে নেমেছে বর্ষার পানিতে? সাঁতরে চলে গেছে অন্য কোনও বাড়িতে!
বিড়ালটা কি কোনও ঝোপঝাড়ে গিয়ে লুকিয়েছে! নাকি কোনও গাছে গিয়ে চড়েছে! পাতার আড়ালে বসে কাঁপছে!
বিড়াল পানিতে নামে না। সে বোধ হয় বাড়িতেই আছে। এতক্ষণে ফিরলে পারত। তাও তো সংসারের জীবিত কারো সঙ্গে আমার দেখা হতো।
চারদিক থেকে আসছে চাঁদের প্রখর আলো। তোমার আমার শরীরে পড়েছে। তোমার মুখ থেকে আমি চোখ ফেরালাম চাঁদের আলোর দিকে। তারপর কোদাল থামিয়ে তাকালাম পেছন দিকটায়, আমাদের দরদালানের দিকে। তাকিয়ে অবাক হলাম। আরে, দরজা জানালার কপাটগুলো তো নেই! জানালার শিকগুলোও নেই। তার মানে ওসবও খুলে নিয়ে গেছে রাজাকাররা! তোমাদের লাশ ছাড়া আর কিছুই ফেলে যায়নি!
মা, ও মা, সেই যে একদিন তুমি এক মায়ের আত্মার গল্প বলেছিলে, আত্মা কথা বলে উঠেছিল, তুমি কি আমার সঙ্গে তেমন করে কথা বলতে পারো না, মা! গল্পের সেই মা তো তার ছেলের ব্যথা পাওয়া নিয়ে কথা বলেছিল। তুমি কি পারো না সেইভাবে কথা বলতে!
মা, ও মা, বলো না! একটু কথা তুমি আমার সঙ্গে বলো না!
কয়েক মুহূর্তমাত্র, তারপর কপালের ঘাম আঙুলে কেচে আবার কোদাল চালাচ্ছি মা। তুমি দেখতে পাচ্ছ! মা, তুমি দেখতে পাচ্ছ মায়ের কবর খুঁড়ছে ছেলে!
ওই দ্যাখো, এখন আবার মনে পড়ছে বকুলের কথা।
বকুল আমার কথাই শোনে না, মা।
আমার চেয়ে আট বছরের ছোট। আমার কথা শুনবে না কেন? আমি কিছু চাইলেই বলে, আমাকে এত অর্ডার দেবে না। আমি কি তোমার চাকর? পারুলকে বলো, বারেকের মাকে বলো।
বারেকের মাকে আমরা ডাকি বুয়া।
আমার সঙ্গে কথা বলার সময়, বারেকের মা যে বকুলকে এত আদর করে, কুট্টি কুট্টি বলে জান দিয়ে দেয়, সেই বারেকের মাকে সে বুয়াটা পর্যন্ত বলে না। সোজা বলে বারেকের মা।
এসব অবশ্য অনেক আগের কথা, মা।
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। বকুল টুতে উঠেছে। চড়ুই পাখির মতো চঞ্চল, ছটফটে। একটা মুহূর্ত স্থির নেই। ছোটাছুটি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে রাখছে। সামনে আমার পরীক্ষা। সকালবেলা পড়তে বসেছি। নাশতার পর সেই বয়সেই এক কাপ চা খাওয়া অভ্যাস হয়েছে। পড়ার টেবিলে দুলতে দুলতে পড়ছি। দেখি, বারান্দার দিকে বকুল একটা ফড়িং ধরার চেষ্টা করছে।
তুমি তো জানোই মা, আমাদের বাড়িতে ফড়িং প্রজাপতি মৌমাছি ভ্রমর- এসবের অন্ত নেই। মেঠো ইঁদুর আছে, ব্যাঙ আছে দুই তিন রকমের। কোলাব্যাঙ, কুনোব্যাঙ। সোনাব্যাঙ আছে পুকুরের ওদিকটায়। বর্ষার মুখে মুখে, বৃষ্টি-বাদলা শুরু হলেই ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডাকতে শুরু করে ব্যাঙগুলো। আমাদের এখনকার যে বিড়ালটা, ওটার মা-বাবা দুটোই তখন বাড়িতে। অর্থাৎ আমাদের তখন দুটো বিড়াল। হুলোটা কোনও কোনও দিন চলে যেত ঝোপ-জঙ্গলে; মেঠো ইঁদুর, ব্যাঙ- এসব ধরে নিয়ে আসত। ইঁদুর-বিড়ালের খেলাটা আমরা খুবই মজা করে দেখতাম।
হুলোটা করত কী, ইঁদুর ধরে সেটাকে আধমরা করে উঠানের দিকে নিয়ে আসত। সামনে ফেলে রেখে নিজে আয়েশ করে বসত। একটা পা দিয়ে আলতো করে একটু নাড়া দিত মড়ার মতো পড়ে থাকা ইঁদুরটাকে।
ইঁদুরও অতি চতুর জীব। সে ইচ্ছা করেই মরার ভান করে পড়ে থাকত। হুলোর নাড়া খেয়ে ভাবত, এখন আর বিপদ নেই, এখন আচমকা একটা দৌড় দিলেই জানে বাঁচি।
ইঁদুর সেই চেষ্টাই করত।
বিড়ালের নাড়া খেয়ে যেই না পালাতে গেছে, আমাদের হুলো অমনি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ঘাপ করে কামড়ে ধরল ঘাড়ের কাছটা।
এই খেলা আমরা সবাই মজা করে দেখতাম। অনেকক্ষণ ধরে খেলাটা খেলত হুলো। তারপর একসময় তুমি কিংবা বুয়া, কদম বাড়িতে থাকলে কদম আর নয়তো পারুল তাড়া দিয়ে বিদায় করত হুলোটাকে। হুলো ইঁদুর মুখে নিয়ে বাড়ির কোন দিকে যে চলে যেত!
কী কারণে যেন ইঁদুর-বিড়ালের কথা বলছিলাম, মা!
আমার সব কিছু এলোমেলো, কেন কী বলছি, বুঝতে পারছি না। মাথায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্নভাবে আসছে নানা রকম স্মৃতি। চোখে ভেসে উঠছে নিকট আর দূর অতীতের কত কত দৃশ্য। কোন স্মৃতি কেন আসছে মাথায়, চোখে কেন ভেসে উঠছে একের পর এক বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, বুঝতে পারছি না, মা।
ও মনে পড়েছে, বকুলের কথা বলছিলাম। আমার পড়ার ঘরের বারান্দায় ফড়িং ধরায় ব্যস্ত ছিল বকুল। সকালবেলার আলোয় ঝকঝক করছে চারদিক। সামনে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। জুন-জুলাই মাস। গ্রীষ্মকালও শেষ হয়ে আসছে। রোদ ওঠে বাঘের মতো। গাছপালাঘেরা বাড়ি বলে আমাদের বাড়িতে গরম লাগে কম। হাওয়া একটু না একটু আছেই। গাছপালার নিজস্ব শীতলতাও কাজ করে।
আমি পরীক্ষার পড়া পড়ছি। বকুলেরও পরীক্ষা। কিন্তু সে পড়ালেখা নিয়ে ভাবছেই না। তুমি বা বাবা কেউ ওকে তেমন কিছু বলো না। বাবা বলেন, ওইটুকু মেয়ে, ও ওর মতোই পড়ুক। যখন ইচ্ছা পড়তে বসবে, যতক্ষণ ইচ্ছা পড়বে, না হলে পড়বে না। ওকে চাপাচাপি করার দরকার নেই।
তবে সকাল-সন্ধ্যা নিয়মমতোই পড়াশোনাটা করত বকুল। সেদিন বোধ হয় পড়া শেষ করেই ফড়িং ধরায় ব্যস্ত হয়েছে।
আমি পড়তে পড়তে ডাকলাম, বকুল।
বকুল সাড়া দিল না, তাকিয়েও দেখল না।
আমি আবার ডাকলাম, এই বকুল।
এবার সে আমার দিকে মুখ ফেরাল। কী?
এদিকে আয়।
পারব না।
কেন?
দেখছ না আমি ব্যস্ত!
আমি বিরক্ত হলাম। না, দেখছি না। কী করছিস তুই?
ফড়িং ধরছি।
এখন ফড়িং ধরতে হবে না।
না, আমি ধরব। এই নীল রঙের ফড়িংটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এটাকে ধরে সুতা দিয়ে বেঁধে রাখব।
না, এসব করতে হয় না।
করলে কী হয়?
আল্লাহ গুনাহ দেয়।
আমি তো ওটাকে মারব না। আল্লাহ গুনাহ দেবে কেন?
ঠিক আছে, একটু পরে ধর। আগে আমার একটা কাজ করে দে।
কী কাজ?
বুয়াকে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বারেকের মা চা বানাত অসাধারণ। আমাদের বাড়ির গরুর ঘন দুধের চা। চিনি দিয়ে এত চমৎকার করে বানাত! কাপের পর কাপ খেতে ইচ্ছা করত।
আমার কথা শুনে বকুলকে দেখলাম ভিতরের দিকে চলে যেতে।
আমি পড়ছি আর চায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। সময় যাচ্ছে, চায়ের খবরই নেই। কী ব্যাপার? বকুল বলে আসার পরও বুয়া চা দেবে না, এমন তো হওয়ার কথা না।
পড়া রেখে উঠলাম।
প্রথমে বকুলকে খুঁজলাম। কোন দিকে গেছে, খুঁজে পেলাম না। গেলাম রান্নাঘরে। গিয়ে দেখি, পারুল পাটাপুতায় ঘসর ঘসর করে হলুদ বাটছে। সামনে শুকনা মরিচ, জিরা, ধনিয়া। হলুদগুলো মাটির একটা মালসায় ভিজানো। ভিজালে নরম হয় হলুদ। বাটতে সুবিধা। সে মন দিয়ে তার কাজ করছে। আর বারেকের মা মাটির একটা হাঁড়িতে জিইয়ে রাখা কই মাছ বের করার জন্য মাত্র হাত দেবে।
বুয়া।
বুয়া চমকে তাকাল, জে দাদা।
আমি না চা চাইলাম!
বুয়া আকাশ থেকে পড়ল। কার কাছে চাইছেন?
তোমার কাছে।
আমার কাছে?
হ্যাঁ। বকুল তোমাকে বলেনি?
না তো। কুট্টির লগে তো আমার দেখাই হয় নাই।
আমার খুবই মেজাজ খারাপ হলো। গম্ভীর গলায় বললাম, আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসো।
ফেরার সময় দেখি, পিছন দিককার বারান্দায় একটা নীল লম্বা লেজের ফড়িংয়ের ডানা সুতা দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করছে বকুল।
আমি গিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। বকুল।
বকুল আমার দিকে তাকাল না। কী?
তোকে আমি কী বলেছিলাম?
কী বলেছিলে?
ভুলে গেছিস?
বলো না, কী বলেছিলে?
বলেছিলাম না, বুয়াকে গিয়ে বল আমাকে এক কাপ চা দিতে।
বকুল তবু আমার দিকে তাকাল না। ফড়িং ধরছিলাম তো, মনে ছিল না।
সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে বকুলের গালে একটা চড় মারলাম। তখনও ফড়িংটাকে সে বাঁধতে পারেনি। চড় খেয়ে হাত থেকে ফড়িং ছুটে গেল। ডানায় বোধ হয় ভালো রকম ব্যথা পেয়েছে। তবু ভাঙা ডানা নিয়ে উড়ে চলে গেল।
আমি চড় মারব এটা বকুল ভাবেইনি। প্রথমে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে তোমার ঘরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর তুমি এসে ঢুকলে আমার ঘরে।
বকুলরে চড় মারছস কেন?
ও তোমাকে বলেনি, কেন মেরেছি!
বলছে।
তাহলে আবার জানতে চাইছ কেন?
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার ডান কান মুচড়ে ধরলে। বইনের গায়ে হাত তোলে কোনও ভাই! তাও এত ছোট বইন!
আমি গোঁয়ার গলায় বললাম, ও আমার কথা শোনেনি কেন?
ছোট মানুষ, ভুইলা গেছিল।
আমার কথা ও ভুলবে কেন? তোমরা ওকে বেশি আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছ। বড় ভাই কথা বলে, তাও শোনে না। তোমাদের জন্য সে এমন বেয়াদব হয়ে উঠছে। আরেক দিন আমার কথা না শুনলে, আজ তো শুধু চড় মেরেছি, এরপর লাঠি দিয়ে পিটাব।
সঙ্গে সঙ্গে তুমি আমার চুলের মুঠি ধরে দুই গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলে। এমন রাগলে, তোমার ফরসা সুন্দর মুখ লাল হয়ে গেল। বেয়াদব বকুল, না তুই! আমার মুখের উপরে এইভাবে কথা কস। আমি তোরেই লাঠি দিয়া পিটামু। পিটাইয়া হাড্ডিগুড্ডি ভাইঙ্গা দিমু। ফাজিল কোথাকার।
বুয়া আমার চা নিয়ে মাত্র দরজা দিয়ে ঢুকবে, দেখে এই দৃশ্য। দেখে দরজার সামনেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ আমাদের দুই ভাইবোনের কারো গায়ে তুমি কিংবা বাবা হাত তুলেছ এই দৃশ্য ওরা দেখেইনি।
আমি তখন রাগে-অভিমানে পড়ার টেবিলে বসেই মাথা নিচু করে ঝরঝর করে কাঁদছি। তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকালে না। বুয়াকে বললে, চা নিয়া যাও, চা ওরে দিবা না।
খুবই রাগী ভঙ্গিতে তুমি বেরিয়ে গিয়েছিলে, মা।
মনে আছে, এসব কথা তোমার মনে আছে, মা!
আমি যে তারপর অদ্ভুত একটা কাজ করলাম, তা কি তোমার মনে আছে? বলো না মা, আমার সঙ্গে একটু কথা তুমি বলো না। মনে আছে!
আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি।
আমার পরনে পায়জামা ছিল আর স্যান্ডো গেঞ্জি। তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর চোখ মুছতে মুছতে আমি একটা হাফহাতা শার্ট গায়ে দিলাম। খালি পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম।
কোথায় গেলাম?
গেলাম বাচ্চুদের বাড়ি।
বাচ্চু আমাকে দেখে অবাক। কী রে, তুই এই সময় আমগো বাড়িতে?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আইলাম।
স্কুলে যাবি না?
না। আমি তো যামুই না, তুইও যাইতে পারবি না।
কেন?
বাচ্চু আমাকে ওর পড়ার চেয়ারটায় বসাল। ঝগড়া করছস?
এখন কথা বলতে ভালো লাগতাছে না। আইজ সারা দিন আমি তগো বাড়িতে থাকুম।
বাচ্চু আমাকে ম্যানেজ করার জন্য বলল, আইচ্ছা ঠিক আছে।
দিনটা আমি বাচ্চুদের বাড়িতে কাটালাম। বাচ্চুও আমার জন্য স্কুলে গেল না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর কথায় কথায় বাচ্চু আমার কাছ থেকে সব জেনে নিল। তারপর আমাকে বোঝাতে লাগল। এই রকম হইতেই পারে। তুই বকুলরে মারছস, এইটা ভালো হয় নাই। খালাম্মা এই জন্যই তোরে শাসন করছে। এইটা নিয়া মন খারাপ করার কিছু নাই। চল, তোরে বাড়িতে দিয়া আসি।
বাচ্চুটা ওই বয়স থেকেই এত ভালো ছেলে, মা। এত সুন্দর করে সব ম্যানেজ করত। সত্যি সত্যিই বুঝিয়ে-শুনিয়ে বিকালবেলা ও আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলো। স্কুল শেষ করে বাবা ফিরেছেন। তিনি তো সকালবেলায়ই জেনেছেন পুরো ঘটনা। হয়তো এসব নিয়ে তোমার সঙ্গে কথাও হয়েছে।
বিকালবেলা বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন বাবা। অকারণে স্কুল কামাই করা খুবই অপছন্দ করেন তিনি। আমি আর বাচ্চু দুজনেই স্কুল কামাই করেছি। বাবা আমাদের কিছুই বললেন না। একবার শুধু চোখ তুলে তাকালেন।
সন্ধ্যার পর আমি পড়তে বসলাম না। বুয়া হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। চিত হয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। তুমি এসে ঢুকলে। পাশে বসে আমার মাথায় হাত রাখলে। মায় একটু শাসন করছে, তাতেই এত রাগ!
আমি কথা বলি না। গম্ভীর।
তুমি আমার মাথাটা কোলে টেনে নিলে। বললে, তুই তোর বাবারে খুব ভালোবাসস আমি জানি। বাবা তোর জান, তুইও বাবার জান। কিন্তু তুই জানস না, আমি তোরে কত ভালোবাসি। বাবার জন্য তোর টান দেইখা আমি আমার ভালোবাসার কথাটা কখনও তোরে বলি না। আইজ বললাম।
শুনে আমার মন নরম হতে লাগল। টের পাই, ধীরে ধীরে অভিমান কমছে। তবু তোমাকে কিছু বুঝতে দেই না। তুমি আমার মাথা কোলে নিয়ে আদর করছ, আমি সাড়াই দিচ্ছি না। চুপচাপ তোমার কোলে মাথা দিয়ে আছি।
তখন তুমি সেই গল্পটা বললে, মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প।
নিজের জীবনের চেয়েও ছেলেকে বেশি ভালোবাসেন মা। স্বামী নেই, একমাত্র ছেলেই তাঁর সব কিছু। কী যে মমতায়, কী যে যত্নে ছেলেকে বড় করেছেন! মাটিতে রাখেননি, পিঁপড়ায় কামড় দেবে। মাথায় রাখেননি, উকুনে কামড় দেবে। ছেলেকে রেখেছেন তিনি বুকে, হৃদয়ের কাছে।
এই ছেলে বড় হলো। একটি মেয়েকে পছন্দ করল।
আমি নিঃশব্দে তোমার গল্প শুনছি। অদূরে পড়ার টেবিলে জ্বলছে হারিকেন। চিমনিটা নতুন। তাও আবার জ্বালানোর আগে যত্ন করে মুছেছে পারুল। আলোটা পরিষ্কার। খোলা জানালা দিয়ে আসছে সন্ধ্যারাতের হাওয়া। হাওয়ায় ফুল লতাপাতার স্নিগ্ধ গন্ধ।
গল্প চলছে। মেয়েটিকে বিয়ে করতে চায় ছেলে। সরাসরি প্রস্তাব দিল। মেয়ে তার প্রস্তাবে সাড়া দেয় না। ছেলে নাছোড়বান্দা। সে লেগেই রইল।
মেয়ে একসময় বিরক্ত হয়ে গেল। ছেলেটিকে তার জীবন থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কঠিন একটা শর্ত দিল।
এই প্রথম কথা বললাম আমি। কী শর্ত, মা?
তোমার গল্প বলার ধরনে আর আমার মাথায়-বুকে আদরের হাত বুলাচ্ছ, কোন ফাঁকে আমার মন থেকে মুছে গেছে সকালবেলার ঘটনা, রাগ করে বাচ্চুদের বাড়িতে চলে যাওয়া, মান-অভিমান সব আমি যেন নিজের অজান্তেই ভুলে গেছি। আর তুমি গল্প বলছ একদম বইয়ের ভাষায়। এমনিতে তুমি মোটামুটি শুদ্ধ ভাষায় কথা বলো। বিক্রমপুরের আঞ্চলিক শব্দ থাকে ভিতরে ভিতরে। গ্রামে থেকেও অনেকটা শুদ্ধ ভাষা তোমার। সেই তুলনায় খালার ভাষা একদমই বিক্রমপুরের। ঢাকায় থেকেও বিক্রমপুরের ভাষা সে ছাড়তে পারেনি।
বাবার কারণে শুদ্ধ ভাষা বলতে শিখেছি আমরা। তুমিও অনেকটা সেই কারণেই শিখেছ। অন্য বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গেলে বিক্রমপুরের ভাষায় কথা বলো। আমিও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সেই ভাষাই বলি। বকুলও বলে।
কিন্তু বাড়িতে না। বাবার নিষেধ।
আবার গল্পে ফিরলে তুমি। বললে, মেয়ে বলল, শর্ত হলো, আমাকে একটা জিনিস উপহার দিতে হবে।
ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই দেব। বলো, কী চাও তুমি?
আমি চাই তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র।
ছেলে থতমত খেল। কী, কী চাও?
তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র। তাঁর হৃদযন্ত্র এনে আমাকে উপহার দিতে হবে। তাহলেই আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি হব, তোমাকে বিয়ে করব।
আমার তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, মা। তোমার কোল থেকে মুখ না তুলে তোমার মুখের দিকে তাকালাম, চোখের দিকে তাকালাম। দূর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কী যে সুন্দর লাগছিল তোমার মুখ! যেন তুমি এই পৃথিবীর মানুষ নও, যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা এক দেবীমা।
তোমার সৌন্দর্য দেখেই দাদু তোমাকে তাঁর ছেলের বউ করে এনেছিলেন। তখন তোমার খুবই কম বয়স। একেবারেই কিশোরী। বাবার চেয়ে তোমার বয়স অনেক কম। দশ-বারো বছর হতে পারে বা তারও বেশি। তার পরও দাদু তোমার মা-বাবাকে রাজি করিয়ে বাড়ির বউ করে এনেছিলেন তোমাকে।
ওইটুকু মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন না তোমার মা-বাবা, যদিও তোমাদের ওই কালে বাল্যবিবাহই হতো। বরের বয়স আঠারো উনিশ, কনে নয় দশ, বড়জোর এগারো। এই বাড়ির বউ হয়ে আসার সময় তোমার বয়স এগারো বারোর বেশি না।
তোমার মুখেই শুনেছি, ঘটকের কাছে খবর পেয়ে দাদু একদিন কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ করেই তোমাদের বাড়ি গেছেন, মতলব হলো একেবারেই ঘরোয়া, বাড়ির পরিবেশে তোমাকে দেখবেন। প্রাথমিক দেখা শেষ হলে, পাত্রী পছন্দ হলে, তারপর ঘটা করে বিকালশেষের কনেদেখা আলোয় তোমাকে দেখবেন, বিয়ের কথাবার্তা, দিন তারিখ পাকা করবেন।
সেদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল।
দাদা ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি করা মানুষ তো! খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। গেছেন একা। দুপুরের দিকে। তোমাদের বাড়ির সঙ্গে পদ্মা নদী। গ্রীষ্মকাল। বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুমি নদীতে নেমে শিশু-কিশোররা যেভাবে সাঁতরাসাঁতরি করে, ডুবোডুবি আর হৈচৈ করে, তা-ই করছিলে।
দাদু যখন তোমাদের বাড়িতে ঢুকবেন, ঠিক তখনই নদী থেকে উঠেছ তুমি। রোগা পটকা টিংটিংয়ে এক কিশোরী। কিন্তু অবাক করা সৌন্দর্য তোমার। গায়ের রং পাকা সবরি কলার মতো। নাকি দুধে আলতা রং বলব, মা!
দাদু তোমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তুমি ভেবেছ, গ্রামের কোনও মুরব্বিজন হবে। একবারও তাঁর দিকে না তাকিয়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দৌড়ে ভিতরবাড়িতে চলে যাচ্ছিলে। দাদু তোমাকে ডাকলেন, শোনো মা।
তুমি দাঁড়ালে। জি, বলেন।
তোমার নাম কী?
আলো।
বাবার নাম?
জয়নাল আবেদীন খান।
কোন ক্লাসে পড়ো?
ক্লাস ফোরে।
আচ্ছা, ঠিক আছে মা, ঠিক আছে।
আপনি কে?
দাদু হাসিমুখে বললেন, আমাকে তুমি চিনবে না, মা।
বাবার কাছে আসছেন?
হ্যাঁ।
বাবা বাড়িতে নাই।
কোথায় গেছেন?
মুন্সীগঞ্জ।
কেন গেছেন বলতে পারো?
জি পারি। মামলার কাজে। আমাদের একটা জমি নিয়া মামলা চলতাছে।
আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি তাহলে যাই।
বাবা বাড়িতে আসলে কিছু বলতে হবে?
না না, ঠিক আছে। আমি আরেক দিন আসব।
আপনার নাম বইলা যান। কোন গ্রাম থেইকা আসছেন, বইলা যান।
স্বর্ণগ্রাম। বলবে, স্বর্ণগ্রামের চৌধুরী সাহেব আসছিলেন।
জি আইচ্ছা।
বাড়ি ফিরেই ঘটককে ডাকালেন দাদু। মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। এখন কনেপক্ষের সঙ্গে কথা পাকাপাকি করে বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলো। মেয়ে আমার খুবই পছন্দ। জাতবংশও ভালো। পদবি হচ্ছে খান।
মাস দুয়েকের মধ্যে এই বাড়ির বউ হয়ে এলে তুমি। তখন শীতকালের শেষ দিক।
ওই দেখো, কোন কথা বলতে কোন কথায় চলে গেছি। বললাম না মা, তোমাকে বললাম না, আমার সব কিছু এলোমেলো। অতীত বর্তমান সব একাকার হয়ে গেছে। স্মৃতির পাতাগুলো চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে উল্টোপাল্টাভাবে। পাঁচ নম্বর পাতা থেকে ফিরে যাচ্ছি দুই নম্বর পাতায়, পনেরো নম্বর পাতা রেখে চলে যাচ্ছি পঁচিশে।
এখন আবার মনে হচ্ছে, এই যে আমার সামনে মাটিতে রেখেছি তোমার লাশ, কবর খুঁড়ছি আমি, দৃশ্যটা এমন না। তুমি যেন আমার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছ। এখনকার মতোই সন্ধ্যারাত। হারিকেনের আলোয় তোমার অপূর্ব মুখ দেখতে পাচ্ছি আমি। মায়ের হৃদযন্ত্রের গল্প বলতে বলতে একটু যেন উদাস হয়েছ। উদাস হলে তোমার চোখ কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে, গলার স্বর বদলে যায়।
আমি বললাম, তারপর কী হলো, বলো না মা!
ছেলে যাকে বিয়ে করতে চায়, সেই মেয়ে চেয়েছে তার মায়ের হৃদযন্ত্র! ছেলে খুবই চিন্তিত হলো। এই শর্ত কি তুমি বদলাতে পারো?
মানে?
আমার মায়ের হৃদযন্ত্র ছাড়া অন্য যা তুমি চাও, তা-ই তোমাকে আমি দেব। আমাদের যা কিছু আছে, সব দিয়ে দেব। জায়গাজমি, বাড়িঘর, সোনাদানা, স্থাবর অস্থাবর সব তোমাকে দিয়ে দেব।
না, আমি তোমার মায়ের হৃদযন্ত্রই চাই।
ছেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠিক আছে, আমি আমার মায়ের কাছে যাচ্ছি। মা আমাকে খুবই ভালোবাসেন।
তাহলে নিশ্চয় তোমার কথা শুনবেন। তোমার জন্য সব করবেন।
হয়তো করবেন।
তবে আর দেরি করছ কেন? যাও, তোমার মায়ের হৃদযন্ত্র নিয়ে এসো। এনে আমাকে দাও। তারপর তোমার প্রস্তাবমতো আমি কাজ করব।
ছেলে মায়ের কাছে গেল। ঘটনা খুলে বলল মাকে।
আমি উৎকণ্ঠিত গলায় বললাম, মা কী বললেন?
বললেন, বাবা, তোমার জীবনের কোনও সাধ আমি অপূর্ণ রাখিনি। তুমি যখন যা চেয়েছ, আমি সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে তা দিয়েছি। যা বলেছ, আমি তা-ই করেছি। তুমি আমার আত্মা, আমার জান। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কিছু নেই। তুমি আমার হৃদয়। আমার হৃদয় আমারই হৃদয় চেয়েছে, আমি কি তাকে তা না দিয়ে পারি!
তারপর?
তুমি এখনই আমাকে হত্যা করো। নিয়ে যাও আমার হৃদযন্ত্র। তুমি যাকে চাও, তাকে উপহার দাও। শর্ত পূরণ করো তার, খুশি করো তাকে। আমি চাই, আমার হৃদযন্ত্রের বিনিময়ে আমার ছেলে পূরণ করুক তার মনোবাঞ্ছা। খুশি হোক সে, সুখী হোক।
আমার দম ততক্ষণে প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কোনও রকমে বললাম, তারপর? তারপর কী হলো, মা?
মাকে হত্যা করল ছেলে।
সত্যি সত্যিই হত্যা করল?
হ্যাঁ। হত্যা করে তাঁর হৃদযন্ত্র নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল সেই মেয়ের বাড়ির দিকে। এমন উন্মাদের মতো ছুটছিল, পথে পাথর কঙ্কর কত কী ছড়িয়ে আছে, কোনও কিছুই খেয়াল করছিল না। হঠাৎ এক পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ল। বুকের কাছে দুই হাতে ধরা মায়ের রক্তাক্ত হৃদযন্ত্র। ছেলে হোঁচট খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদযন্ত্র কথা বলে উঠল, ব্যথা পেয়েছ, বাবা?
উদাস মুখখানি নামিয়ে তুমি আমার দিকে তাকালে। বিক্রমপুরের ভাষায় বললে, এই হইতাছে মা, বুঝছস! মায়ের চেয়ে আপন কেউ নাই পৃথিবীতে, মায়ের চেয়ে বড় কেউ নাই।
তোমার গল্প শুনে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছে, চোখ ফেটে যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছিলাম না। উপুড় হয়ে মুখ গুঁজে দিলাম তোমার কোলে। দুই হাতে তোমার কোমর জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগলাম। মা, মা গো, আমার মা!
আমাদের বাড়িতেই আরেক মাকে রাতের পর রাত বিলাপ করে কাঁদতে দেখেছি আমরা। কখনো কখনো দিনের কাজ করতে করতেও হঠাৎ করে কোথাও বসে সে কাঁদত। বারেকের মা। আমাদের বুয়া। তার সেই কান্না ছিল বারেকের জন্য। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে চলে গিয়েছিল বারেক, আর কোনও খবর নেই। যেন ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেল দশ বছরের ছেলেটি!
কোথায় গেল?
বিলের ওই দিকে আমাদের একটা দিঘি আছে।
তুমি তো জানোই মা, চারদিকে ধানি জমি, মাঝখানে বিশাল দিঘি। জমিগুলোও আমাদের। বর্ষা যে বছর কম হয়, বিলে মাঠে পানি কম, দিঘির চারটা পাড়ই জেগে থাকে। পাড়ে ঝোপজঙ্গল আছে, হিজল-বরুণগাছ আছে। তেঁতুলগাছ, গাবগাছ আছে, কদমগাছ আছে।
বিক্রমপুর অঞ্চলে বরুণগাছকে বলে 'বউন্না' গাছ। কী সুন্দর শব্দ বরুণ, সেটা কেমন নষ্ট হয়ে গেছে আঞ্চলিকতার কারণে।
নাকি আঞ্চলিকতার কারণে অন্য রকম সৌন্দর্য পেয়েছে!
মা, কোথা থেকে যেন কদম ফুলের গন্ধ আসছে!
তুমি পাচ্ছ!
গন্ধটা তুমি পাচ্ছ, মা!
আমাদের বাড়িতে কদমগাছ অনেক। দশ-বারোটার কম হবে না। কদম হচ্ছে আষাঢ় মাসের ফুল। শ্রাবণ মাসেও কি কদম থাকে! কদম ফুলের জীবন বেশিদিন স্থায়ী না। শ্রাবণ মাস পর্যন্ত ফোটে কি না মনে করতে পারছি না।
বোধ হয় ফোটে।
বোধ হয় আমাদের বাড়ির গাছগুলোতে ফুটেছে। নয়তো গন্ধ আসবে কোত্থেকে!
নাকি দিঘির পাড়ের কদমগাছের কথা থেকে কদম ফুলের গন্ধ নাকে এলো! বাস্তবিকই এলো, নাকি ব্যাপারটা মনের! আমার মনের ভিতর থেকে আসেনি তো গন্ধ!
মা, মনে হচ্ছে তোমার শরীর থেকে আমি কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া শরীর, জমাটবাঁধা রক্ত, লণ্ডভণ্ড হাড়মাংস, মা, আমি তোমার শরীর থেকেই কদম ফুলের গন্ধ পাচ্ছি। তোমার হাত পা মুখ মাথা থেকে, আষাঢ় শ্রাবণ মাসের ঘোরতর বৃষ্টিতে ফুটে থাকা কদম ফুলের গন্ধ যেমন হঠাৎ হঠাৎ একটুখানি ভেসে আসে হাওয়ার টানে, ঠিক তেমন করে তোমার শরীর থেকে কদম ফুলের গন্ধ আসছে।
কী যেন বলছিলাম!
ও, আমাদের ওই দিঘির কথা।
ধানিবিলের মাঝখানে দিঘি। বহু বহু কালের পুরনো। দাদার বাবা নাকি কাটিয়েছিলেন জিওল মাছ খাওয়ার আশায়। কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল ভরা দিঘি বর্ষার পানিতে ডুবে গেলে, আশ্বিন কার্তিক মাসে বর্ষার পানি যখন নেমে যায় তখন জংলা পুকুর দিঘিতে কই শিং মাগুর শোল চিতল ফলি খলিসা ভেদা- এসব মাছ কচুরিপানা আর ঝোপজঙ্গলের তলায় আশ্রয় নেয়। টাকি মাছও থাকে। টাকি মাছের ভর্তা, আহা, কী যে মজা করে বানাতে তুমি! সরিষার তেল কাঁচা মরিচ পেঁয়াজ ধনিয়া পাতা দিয়ে তোমার হাতের টাকি মাছের ভর্তার কোনও তুলনা নেই মা। আমাদের দিঘি থেকে ধরে আনত কদম আর তুমি ভর্তা বানাতে।
মাগো, কত দিন তোমার হাতের সেই ভর্তা খাইনি!
গ্রামের লোকজন প্রায়ই চুরি করে দিঘির মাছ ধরে নিয়ে যেত। এ জন্য পবন জেলেকে বছর চুক্তিতে দিয়ে দেওয়া হতো দিঘি। ধানের জমিগুলো যেভাবে বর্গা দেওয়া, অনেকটা সে রকমই ব্যবস্থা। পবন তার মতো করে পাহারা দিয়ে রাখত দিঘি। বছরে দুবার মাছ ধরবে, অর্ধেক তার, অর্ধেক আমাদের।
ইস্, একেকবার মাছ ধরলে, ভাগের অর্ধেক মাছে উঠান প্রায় ভরে যেত। এত মাছ দিয়ে কী করব?
বাবা তাঁর স্কুলের শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি মাছ পাঠাতেন। গ্রামের লোকজনকে মাছ বিলাতেন। তার পরও জিওল মাছে মাটির বড় বড় হাঁড়ি ভরা থাকত প্রায় সারা বছর। গোলাঘর, রান্নাঘর দুঘরেই জিওল মাছের হাঁড়ি।
এর বাইরেও আরেকটা ব্যবস্থা ছিল। আমাদের বাড়ির জন্য হঠাৎ মাছ ধরার দরকার হলে কদম একটা ঝাঁকি জাল আর একটা খাঁচি নিয়ে যেত। দু-তিন দিন চলার মতো মাছ ধরে আনত। পবন কিছু মনে করত না। দিঘির উত্তর পাড়ে ছাপরাঘর করে সে আর নয়তো তার ভাই, ভাইয়ের ছেলে, নিজের ছেলেরা পালা করে দিঘি পাহারা দিত।
ওই দিঘি নিয়ে এত কথা আমি বলছি কেন!
কোনও কোনও শীতকালে বিকাল হয়ে আসার সময় কদমের সঙ্গে দিঘির ওই দিকটায় বেড়াতে যেতাম। কী সুনসান নির্জন চারদিক! শীতের বেলা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। ধানিবিল ছবির মতো স্থির। ধান কাটা হয়ে গেছে। নতুন করে চাষের আয়োজন করছে কৃষকরা। দিঘির পাড়ে উঠে পানির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কচুরিপানা আর পানিতে ডোবা ঝোপজঙ্গলের ভিতর থেকে খোলা জায়গায় এসে ঘাই দিয়ে যেত মাছ।
আমার খুব কৌতূহল। কদমকে বলতাম, কী মাছ ঘাই দিল, কদম চাচা?
এইটা শোল।
বুঝলে কী করে?
আমি মাছের ঘাই দেইখা বুঝতে পারি।
তখন হয়তো আরেকটা মাছ ঘাই দিল। এটা কী মাছ?
চিতল।
দীঘির পাড়ের কোনও ঝোপে তখন হয়তো ডাকতে শুরু করেছে ডাহুক পাখি। কোনও কোনও ডাহুক পাখি একটানা সারা রাত ডাকে। ও রকম সারা রাত ডাকার ফলে সকালের দিকে তাদের গলা থেকে বেরোয় একফোঁটা রক্ত।
কদমই বলেছিল এ কথা।
কেন ও রকম রক্ত বেরোয় ডাহুক পাখির গলা থেকে!
কী অর্থ এই রহস্যের!
জানা হয়নি। নাকি রহস্যটা কদম বলেছিল, এখন মনে পড়ছে না। তবে ডাহুক পাখির ডাকে আমার একটা গানের কথা মনে পড়ত।
পদ্মদিঘির ধারে ধারে
ডাহুক ডাকা মাঠের পারে
কানামাছি খেলার কথা যায় কি ভোলা
মনে আজ সেই ভাবনা দেয় দোলা।
কার গাওয়া গান জানি না। রেকর্ডটা আমাদের বাড়িতে ছিল না। আকাশবাণী কলকাতা থেকে রবিবার দুপুরবেলা অনুরোধের আসর নামে গানের একটা অনুষ্ঠান হতো।
এখনো হয় নাকি, মা?
মনে করতে পারছি না।
হয়, নিশ্চয় হয়! এত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান না হয়ে পারে!
আমরা সবাই রেডিওতে অনুরোধের আসর শুনতাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে, নাকি খাওয়াদাওয়ার আগেই, মা! অনুরোধের আসর আড়াইটার সময় হতো না! আড়াইটা থেকে তিনটা!
তাহলে খাওয়াদাওয়া সেরেই আমরা শুনতাম। ওই গানটা অনুরোধের আসরেই শুনেছিলাম।
আমাদের দিঘিটা পদ্মদিঘি না। পদ্ম ফুলের বালাই ছিল না। ছিল কচুরিপানা, ঝোপজঙ্গল। তবু সেই দিঘির পাড়ে দাঁড়ালে, ডাহুক পাখির ডাকে গানের কথাগুলো মনে আসত। কিশোর বয়সের কথা। এখনও ভুলিনি।
মা, আমাদের বাড়ির ঝোপজঙ্গলে, বাড়ির চারপাশে ধানিবিলে অনেক ডাহুক পাখি থাকে। নির্জন দুপুরে ডাকে, রাতে ডাকে। বর্ষাকালে পানিতে ডোবা ঝোপের আড়ালে বাসা বাঁধে। কালো কালো একঝাঁক ছানা নিয়ে মা ডাহুক চরতে বেরোয়। পানিতে ভাসে, ডাঙায় ওঠে। কিশোর বয়সে কত চেষ্টা করেছি একটা ডাহুকের ছানা ধরতে, কোনও দিন ধরতে পারিনি। এত চালাক ছানাগুলো! এই দেখছি চোখের সামনে চরছে, পা টিপে টিপে গেছি ধরতে, কাছাকাছি গেছি, সঙ্গে সঙ্গে উধাও। মুহূর্তে কোথায় যে লুকায়, কোথায় যে উধাও হয় কে জানে!
ডাঙায় যা পানিতেও তা-ই। হয়তো একদম পরিষ্কার পানিতে মায়ের সঙ্গে চরছে। কদমকে নিয়ে আমি গেছি ধরতে, আমাদের দেখেই ডুব দিল। ডুব দিয়ে কোথায় কোন দিকে যে চলে গেল, হদিস নেই।
মা, আমাদের বাড়ি ভর্তি পাখি ছিল। কাক শালিক চড়ুই- এসব তো সাধারণ পাখি। সব গ্রামে, সব বাড়িতেই থাকে। আমাদের গাছপালাঘেরা বাড়ি বলে বাড়ির নামার দিককার হিজলগাছগুলোতে নানা রকমের বক বাসা বাঁধত বর্ষাকালে। ঘুঘু ডাকত সারা দিন। বুলবুলি ছিল, তালগাছটায় ছিল বাবুই পাখির বাসা। ইষ্টিকুটুম, কাঠঠোকরা, পুকুরধারে মাছরাঙা, পেঁচা আর আমাদের কবুতরগুলো তো ছিলই। ডাহুকগুলো কোথায় গেল! পাখিগুলো সব কোথায় গেল, মা! কোথাও প্রাণের সাড়া নেই কেন?
খানিক আগে, বাবার কবর খোঁড়ার সময় একটু যেন কবুতরের শব্দ শুনেছিলাম! তারপর আর সাড়া নেই।
আসলে কি শুনেছিলাম!
নাকি মনের ভুল!
বিভ্রম!
বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটার মতো বাড়ির পাখিরাও কী সব গুলির অবিরাম শব্দে যে যার মতো উড়ে গেছে দূরের গ্রামে! নিরাপদে নির্জনে থাকতে!
এই গ্রামে এখন আর কোনও পাখিই নেই!
এমন স্তব্ধতা মানুষ সহ্য করে কেমন করে!
না মা, একটা শব্দ আছে মা। তুমি শুনতে পাচ্ছ না! তুমি শুনতে পাচ্ছ না, মা! ঝিঁঝি ডাকছে, শুধুই ঝিঁঝি ডাকছে। আর কোনও শব্দ নেই। এমনকি হাওয়ার চলাচল, গাছের পাতা নড়াচড়ার শব্দও নেই!
নাকি আছে! আমি টের পাচ্ছি না। নাকি পাকিস্তানি... ...গুলোর কর্মকাণ্ড দেখে প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির গাছপালা, মাটি পানি হাওয়া- সবই কি কাঁদছে, মা!
এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে কাঁদছে!
কিন্তু আমার কান্না পাচ্ছে না কেন?
আমার চোখে পানি আসছে না কেন?
চোখ, চোখ। চোখের কথায় চোখ এলো মা। ওই যে খানিক আগে বক পাখির কথা বললাম, তখনই মনের ভিতর নড়েচড়ে উঠেছিল চোখ।
আমাদের গ্রামের ফইজু, কানা ফইজু আর কি, চিনতে পেরেছ মা?
হ্যাঁ, বক শিকারি, ডাহুক শিকারি।
বর্ষা শেষ হয়ে এলে, মাঠে মাঠে কাদাপানিতে ধান কাটা শুরু হবে। এ সময় ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে বকগুলো পুঁটি টেংরা শিকারের আশায় ঘুরে বেড়ায় আর ডাহুক পাখিগুলো ধান খায়। ফইজু ফাঁদ পাতত বক ডাহুক ধরার জন্য। প্রতিদিনই দু-চারটা ধরত। ধরে বাজারে নিয়ে বিক্রি করত।
কাজটা কার কাছে শিখেছিল কে জানে। কিশোর বয়সে প্রথম ফাঁদ পেতে একটা বক ধরেছে। কার্তিক মাস। প্রথম দিনই শিকার ধরতে পেরে বেজায় আনন্দ। বক নিয়ে বাড়ি এসেছে। ফাঁদ থেকে বক বের করে পলো দিয়ে উঠানে আটকে রেখেছে। পলোর মুখ দিয়ে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে সে জন্য পলোর মুখে মাটির একটা সরা বসিয়ে রেখেছে।
ধরা পড়া বক পলোর ভিতর বসে ঝিমাচ্ছে। ফইজু অতি উৎসাহে বাড়ির লোকজনকে ডেকে এনে দেখাচ্ছে। বকটা তখন বেশ কাহিল। শরীরের ধকলে মড়ার মতো লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
ফইজু ভাবল, হায় হায়, বক আমার মইরা গেল নি?
সরা সরিয়ে পলোর মুখ দিয়ে উঁকি দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল বক। অল্প পানিতে পা ডুবিয়ে যে রকম তক্কে তক্কে থাকে ছোট মাছ শিকারের আশায়, স্বচ্ছ পানির তলায় কাচের মতো ঝকঝক করে যেসব ছোট মাছ, ফইজুর চোখ দুটোকে বক মনে করল সেই রকম কোনও মাছ।
যার যা স্বভাব!
লম্বা ঠোঁট বাড়িয়ে ফইজুর ডান দিককার চোখ বরাবর ঠিক মাছ ধরার কায়দায় একটা ঠোকর দিল। এক ঠোকরে ফইজুর চোখ তুলে, মাছ গেলার মতো কোঁৎ করে গিলে ফেলল।
এই হলো ফইজুর ঘটনা।
বালক বয়সেই ফইজু গেল কানা ফইজু হয়ে। তবে শিকারটা সে ছাড়ল না। এক চোখ নিয়েই আশ্বিন কার্তিক মাসে বক ডাহুক শিকার করে। লোকে ডাকে কানা ফইজু।
বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, একটা চোখ খোয়ালি বকের হাতে, তার পরও শিকারটা ছাড়লি না?
ফইজু হে হে করে হেসে বলল, জিদ কইরা ছাড়ি নাই, মাস্টার সাব। জিদ কইরা শিকার করি। যেই বকে আমার চোখ নিছে, আমারে কানা করছে, ওই বকের গুষ্টি আমি সাফা কইরা ফালামু।
মা, ফইজুর কথা ভেবে আমার শরীরের ভিতরে কী রকম যেন একটা অনুভূতি হচ্ছে। রক্ত গরম হয়ে উঠছে। শরীর যাচ্ছে শক্ত হয়ে। বুকের ভিতর কাজ করছে প্রবল এক শক্তি। আমার মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে ফইজুর চোখ নিয়েছিল যে বক, সেই বকের গুষ্টি শেষ করার জন্য ফইজু যেমন বক শিকার করে, আমিও, মা, আমিও আমার বুক খালি করেছে যারা তাদের শেষ করে দেব। একটা একটা করে শেষ করে দেব। আমার বাবা মা বোন স্ত্রী আর আমার সন্তান যারা শেষ করেছে তাদের আমি ধ্বংস করে দেব। একটা পাকিস্তানি... ...কেও ছাড়ব না। একটা রাজাকারকেও ছাড়ব না। আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি, পাকিস্তানি... ...গুলোর যারা দোসর তাদের একটাকেও ছাড়ব না।
মা, পোষা প্রাণীরা তো বাড়ির লোকের গায়ের গন্ধ টের পায়। গন্ধ চেনে। এই যে এতক্ষণ ধরে আমি বাড়িতে, বল্টুর কুকুরটা বুঝলাম কোথাও পালিয়ে গেছে, অথবা গুলির শব্দে দৌড়ে পালাচ্ছিল কোনও দিকে, ওকেও গুলি করেছে। হয়তো বল্টু মরে পড়ে আছে কোনও ঝোপঝাড়ের আড়ালে কিংবা বর্ষার পানিতে।
কিন্তু মিনি! মিনি বিড়ালটা!
মিনি কোথায় গেল!
ও কি পালাতে পেরেছিল?
নাকি ওকেও গুলি করে মেরেছে?
নাকি খুবই আদুরে বিড়াল দেখে কোনও রাজাকার বাড়ির যাবতীয় মালামাল লুট করার মতো আমাদের মিনিকেও লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের গোয়ালঘর, রান্নাঘর, গোলাঘর, ঢেঁকিঘরের টিন কাঠ দিয়ে যেমন করে উঠবে রাজাকারদের ঘরবাড়ি, সে রকম কোনও বাড়িতেই কি জায়গা হবে মিনির! নাকি জায়গা ইতিমধ্যে হয়ে গেছে!
মিনি কি আমাদের ছাড়া থাকতে পারবে?
ওকে বাটি ভরা দুধ দেবে কে?
কোলে নিয়ে আদর করবে কে?
কী আশ্চর্য, মা! মানুষ রেখে আমি বিড়াল নিয়ে কথা বলছি, দ্যাখো।
না, আমি একদম আমার মধ্যে নেই। আমার সব কিছু এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড। যেমন লণ্ডভণ্ড তোমরা, আমার মা বাবা বোন স্ত্রী আর সন্তান, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের সংসার, সংসারের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জিনিস, যেমন লণ্ডভণ্ড আমাদের বাড়ি, ঠিক তেমনই আমার ভিতরটা। মাথা কাজ করছে না, চিন্তাচেতনা খাপছাড়া।
মা, আমার আবার বারেকের কথা মনে পড়ছে, বারেকের মায়ের কথা মনে পড়ছে। সেই যে মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে দৌড়ে গেল বারেক, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বারেকের দেখা নেই।
কোথায় গেল সে?
ফিরছে না কেন?
আমাদের সবার খাওয়াদাওয়া হলে কাজের লোকরা খেতে বসে। আমরা খাওয়াদাওয়া শেষ করেছি। কদম পারুল বারেকের মা আর বারেক খেতে বসবে। কিন্তু বারেক নেই। কদম আর পারুলকে ভাত বেড়ে দিয়েছে বারেকের মা। নিজের ভাত, বারেকের ভাতও বেড়েছে। কিন্তু বারেক কোথায়?
বুয়া নিজের থালায় আর হাত দিতে পারে না। ভাত তুলতে পারে না মুখে।
ইস্, আমার যে কী এলোমেলো হচ্ছে সব! একবার বলছি বারেকের মা, একবার বলছি বুয়া।
এই অবস্থা আমি কেমন করে কাটাব, মা!
বলো না, কেমন করে কাটাব!
ওই দেখো, চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। কপাট ছাড়া দরজা জানালা দিয়ে দিনের আলোর মতো গলগলিয়ে ঢুকছে আমাদের বসার ঘরে। উঠান ভরা জ্যোৎস্না তো আছেই। তোমার আমার শরীরজুড়ে জ্যোৎস্না। আমরা মা ছেলে চাঁদের আলোয় ভাসছি। মা পড়ে আছে উঠানে, ছেলে তাঁর কবর খুঁড়ছে আর চাঁদের আলো তাদের ভাসিয়ে দিচ্ছে। বাবার কবরের ওপরও দেখো কী সুন্দর চাঁদের আলো!
মা, বুয়াও কি কোনও কোনও রাত ছেলেকে নিয়ে চাঁদের আলোয় ভাসেনি!
কদম খেতে খেতে বলল, কী হইল বারেকের মা, ভাত বাইরা বইয়া রইলা, খাইবা না?
পারুলও তো মেয়ে। মায়ের জাত। ঘটনা সে বুঝল। মুখের ভাত গিলে বলল, বুড়ি বইয়া রইছে পোলার লেইগা।
এই প্রথম কথা বলল বুয়া। হ রে, পোলাডারে এমুন মাইর মারলাম, অহন মনডা খারাপ লাগতাছে। বিয়ানের নাশতা খাইছে। এত বেলা হইল, তারপর থিকা আর কিছু মুখে দেয় নাই, কই যে গেল, তাও বুঝতাছি না। এতক্ষুণে পোলার বিরাট খিদা লাগনের কথা!
কদম বলল, হ, দোফর হইয়া গেছে। খিদা লাগনের কথা।
পারুল বলল, খিদা লাগলে তো ফিরত আহনের কথা।
বুয়া বলল, আইতাছে না জিদ কইরা। বিরাট জিদ্দি পোলা।
কদম হাসল। ডাকাইতের পোলা জিদ্দি হইবই।
বুয়া উঠল। তোমরা খাও।
পারুল বলল, তুমি যাও কই?
পোলাডারে বিচরাইয়া লইয়াহি।
আইচ্ছা যাও।
বুয়া বাড়াভাত রেখে বেরিয়ে গেল। ফিরলো আধাঘণ্টা পর। মুখে হতাশা, অসহায়ত্ব।
কদম পারুল তখন খাওয়া শেষ করে যে যার মতো আয়েশ করছে। গোলাঘরের সামনে বসে কদম তার প্রিয় তামাক টানছে। দুপুর শেষের নির্জনতা কিছুটা ভেঙেছে তার তামাক টানার গুড়ুক গুড়ুক শব্দে। পারুল গিয়ে কাত হয়েছে দালানের পিছন দিককার যে ঘরটায় বুয়া বারেক আর সে থাকে। বুয়ার হতাশ মুখ সে দেখতে পেল না। দেখল কদম। তামাকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা মানুষটা বলল, কী হইল বারেকের মা? পাইলা না বারেকরে?
না গো, মিয়াভাই।
কও কী?
হ। পুরা বাড়ি বিচরাইলাম (খুঁজলাম)। বারেক কোনওখানে নাই।
জিদ কইরা অন্য কোনও বাড়িতে গিয়া মনে হয় বইসা রইছে।
অন্য কোন বাড়িতে যাইব?
গেরামে বাড়ির আকাল আছে নি? তোমার পোলারে চিনে বেবাকতেই। আছে কোনও বাড়িতে!
বুজলাম কোনও বাড়িতে গেছে, তয় অরে ভাত দিব কে?
কদম কথা বলল না।
আমি শুয়ে আছি আমার ঘরে। পিছন দিককার জানালা দিয়ে রান্নাঘর গোলাঘর ঢেঁকিঘর কদমের দুই চৌকিঅলা ঘর আর ওই দিককার উঠান পুরোপুরি দেখা যায়।
আমার ঘুম আসছে না। ছুটিছাটার দিনে সেই ছেলেবেলা থেকেই দুপুরবেলা সুযোগ পেলে ভালো একটা ঘুম দেই।
সেদিন ঘুম আসছিল না। বিছানায় শুয়ে উদাস চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। বুয়া কদম পারুলদের খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে টুকরো টাকরা কথাবার্তা সবই কানে আসছিল। বুয়া বারেককে খুঁজে এলো তাও দেখলাম।
কদমের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুয়া দেখি একসময় কাঁদছে। কদমকে সে ডাকে মিয়াভাই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মিয়াভাই গো, আমার ডর করতাছে।
কিয়ের ডর?
পোলায় তো দৌড়াইয়া গেছিল বাঁশঝাড়তলায়।
হ।
ওইখানে অর কোনও বিপদ হইল না তো?
কিয়ের বিপদ?
ওই যে ওইখানে তেনায় থাকেন। তেনায় আমার পোলার ক্ষতি করে নাই তো!
বুয়াকে একটা ধমক দিল কদম। আরে ধুৎ! যাও, ভাত খাও গিয়া। খিদা লাগলে পোলায় নিজে থিকা দৌড়াইয়া আইসা কূল পাইব না নে!
বুয়া তবু ভাত খেলো না। না গো মিয়াভাই, আমার গলা দিয়া ভাত নামব না। পোলারে ছাইড়া এক ওক্ত (এক বেলা) ভাত আমি খাই নাই। আমি যাই, গেরাম ঘুইরা দেখি পোলা গেল কই। আছে কই।
বুয়া বেরিয়ে গেল। শেষ বিকালের দিকে কাঁদতে কাঁদতে ফিরল। না, বারেককে কোনও বাড়িতে পাওয়া যায়নি। গ্রামের কোথাও পাওয়া যায়নি। বারেকের মা স্কুলবাড়িতে খুঁজেছে, বেসনাল, কামাড়খাড়ার এবাড়ি-ওবাড়ি গেছে।
বারেক নেই।
বারেক উধাও।
বুয়া বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। হায় হায়, কই গেল আমার পোলা! ক্যান আমি ওর গায়ে হাত তুললাম? অহন আমি পোলা পামু কই?
মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরেছে কদম। গোয়ালঘরে গরু বেঁধে মুখের সামনে রাখা গামলায় জাবনা দিয়েছে। গরুরা নির্বিকার ভঙ্গিতে সেরে নিচ্ছে রাতের খাবার। বুয়ার বিলাপে তাদের কী যায় আসে!
স্কুল ছুটির দিনে বিকালবেলাটা বাবা এদিক-ওদিক হাঁটতে যান। সন্ধ্যার মুখে মুখে ফিরে আসেন। সেদিন বেরোননি। বুয়ার বিলাপ শুনে আমরা সবাই বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি।
বাবা চিন্তিত গলায় বললেন, গ্রামের কোনও বাড়িতে নেই, এইটুকু ছেলে তাহলে যাবে কোথায়?
গম্ভীর গলায় কদমকে ডাকলেন। কদম।
জে কর্তা।
কর্তা ডাকটা সবাই ছাড়তে পেরেছিল, কদম পারেনি। অনেক চেষ্টা করেও বাবা তাকে ছাড়াতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত ডাকটা বাবা মেনে নিয়েছেন।
তুই একটা হারিকেন নিয়ে বেরো। গ্রামের লোকজনকে খবর দে। বারেককে খুঁজে বের কর।
জে কর্তা। অহনই যাইতাছি।
পারুল, হারিকেন জ্বেলে দে।
তখনও সন্ধ্যা হয়নি। অনেকগুলো হারিকেন নিয়ে পারুল এ সময় রান্নাঘরের সামনে বসে। হারিকেনের চিমনি অতিযত্নে পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে মোছে, কেরোসিন ভরে। সন্ধ্যা হলেই ম্যাচের কাঠি দিয়ে হারিকেন জ্বালায়।
সেদিনও ওই কাজে বসেছে। বাবার কথা শুনে দ্রুত হাতে একটা হারিকেন জ্বেলে দিল। তখনও পুরোপুরি সন্ধ্যা হয়নি। কদম হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম।
মা, তুমি তো অনেকবার ঢাকায় গিয়েছ। পদ্মায় তোমাদের বাড়ি ভেঙে যাওয়ার পর নানা গ্রামে আর বাড়িই করেননি। ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় গিয়ে, দীননাথ সেন রোডের একেবারে শেষ মাথায় বিঘাখানেক জমির ওপর একটা বাড়ি করলেন। তোমরা দুভাই, দুবোন। আমাদের মতো না হলেও নানারও ভূসম্পত্তি কম ছিল না। ওসব বিক্রি করে তিনি দুই ছেলেকে দশ কাঠা দশ কাঠা করে জমি কিনে আলাদা আলাদা বাড়ি করে দিলেন ঢাকায়। জলু মামাকে দিলেন মগবাজারে, মাবু মামাকে আজিমপুরে। দীননাথ সেন রোডের বাড়িটা তোমাদের দুই বোনের।
নানা-নানি যত দিন বেঁচেছিলেন তাঁরা ছিলেন গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে। বেলা খালাও থাকতেন নানার সঙ্গে। মায়াকে নিয়ে অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। কিন্তু অভাব-অনটন তাঁর ছিল না।
ছিল না বলছি কেন! এখনও নেই।
জহুরুল খালু মানিকগঞ্জের লোক। তিনিও পৈতৃকসূত্রে জায়গা-সম্পত্তি পেয়েছিলেন অনেক। যদিও তাঁর ক্যান্সার চিকিৎসায় খরচা হয়েছে অনেক, তার পরও বেলা খালা নগদ টাকা পেয়েছেন ভালোই, মানিকগঞ্জের গড়পাড়ায় জায়গা-সম্পত্তি এখনো কিছু আছে তাঁর। কিছু মানে কী, ভালোই আছে।
আর যেটা খালার সবচাইতে বড় ভাগ্য, তাঁর শ্বশুর শাশুড়ি দেবর ননদরা তাঁকে খুবই ভালো জানেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে শাশুড়ি মারা গেলেন। শ্বশুর এখনো বেঁচে আছেন। আশির ওপর বয়স হবে। ঢাকা মানিকগঞ্জ মিলিয়েই বেলা খালা থাকতেন। কিছুদিন মানিকগঞ্জে, কিছুদিন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই খালাকে তাঁর শ্বশুর মানিকগঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক পাঠালেন। বাড়িতে ভাড়াটেও আছে। তাদের হাতে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে খালা চলে গেলেন শ্বশুরের কাছে। নিজের মেয়েদের চেয়েও ছেলের বউকে বেশি স্নেহ করেন শ্বশুর। আর খালাও সারাক্ষণ শিশুর মতো আগলে রাখছেন আশি বছর বয়সী শ্বশুরকে।
খালা যখন মানিকগঞ্জে থাকেন, নিজের পড়াশোনার জন্য মায়া থাকত ঢাকায়। তার দেখভাল করার জন্য ওই তিনজন কাজের লোক। রহমতের মা তো আছেই, সঙ্গে আছে রফিক আর রফিকের বউ মাজেদা। রফিক বাজারঘাট আর বাইরের কাজ করে, অর্থাৎ পুরুষ মানুষের যা কাজ তা-ই করে। মাজেদা সংসার সামলায়। মায়া তার মতো পড়াশোনা নিয়ে থাকে। রহমতের মা সারাক্ষণ খালার সঙ্গে। কখনও কখনও খালার সঙ্গে গড়পাড়ায়ও চলে যায়। কোথাও কোনও অসুবিধা নেই।
বেলা খালা আমার শাশুড়ি। কিন্তু তাঁকে কখনও মা বলা হলো না, আম্মা বলা হলো না। শাশুড়িকে তো মানুষ মা অথবা আম্মাই বলে। আমি খালাই বলি। এই ডাকটা আর বদলাতে পারিনি।
জলু মামার পুরো নাম জালাল আবেদিন খান। সংক্ষেপে জলু। তুমি ডাকো জলুদা। মাবু মামা হচ্ছেন মাহবুব আবেদিন খান। তাঁরা কে কোথায় আছেন জানি না। উড়ো উড়ো খবর পেয়েছি, জলু মামা আছেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি লালমনিরহাটে। মাবু মামা আছেন বিক্রমপুরেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি কবুতরখোলা গ্রামে। আমাদের এলাকা থেকে বহুদূর। শ্রীনগরের ওদিকে।
জলু মামার অবস্থা আমাদের মতো। মানে মামার এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে বড়। নাদিরা আপা। বিএ পাস করার পর বিয়ে হয়েছে। শ্বশুরবাড়ি কুমিল্লা শহরে। এখন হয়তো সেখানে নেই। কুমিল্লার কোনও গ্রামের দিকে চলে গেছেন। গ্রামেও নিশ্চয় বাড়ি আছে। জলু মামার ছেলে বাদল মানসিক প্রতিবন্ধী। এই ছেলে নিয়েই মামা-মামির যত কষ্ট। কষ্ট যেমন, ভালোবাসাও তেমন। দুজনের জান হচ্ছে বাদল।
জলু মামা তোমার বড়।
তোমাদের ভাইবোনের সিরিয়ালটা হচ্ছে এই রকম- প্রথমে জলু মামা, তারপর তুমি, তারপর মাবু মামা, তারপর বেলা খালা।
মাবু মামার ছেলে নেই। তিন মেয়ে। বিনু মিনু দিনু। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। দিনুর এখনো হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় অনার্স পড়ে। বিনু মিনু নিশ্চয় শ্বশুরবাড়িতে। দিনু আছে মামার সঙ্গে।
কী অবস্থা বলো তো, কারো কোনও খোঁজখবরই নিতে পারছি না আমরা। পাকিস্তানি... ...গুলো আমাদেরকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। নাদিরা আপা তাঁর যমজ ছেলে দুটোকে নিয়ে কেমন আছেন, জানতে ইচ্ছা করে।
তোমার ঢাকায় যাওয়ার কথা বলছিলাম না, মা!
কেন বলছিলাম জানো!
গুলিস্তান সিনেমা হলের জন্য।
বাবাকে নিয়ে তুমি গুলিস্তান হলে গিয়ে উত্তম-সুচিত্রার অনেক সিনেমা দেখেছ। আমি সে কথা জানি। আমাকে আর বকুলকে, মায়া এ বাড়ির বউ হয়ে আসার পর মায়াকে ওইসব সিনেমার গল্প তুমি বলেছ। সুচিত্রা-উত্তমের ছবিতে হেমন্ত আর সন্ধ্যার গান থাকত বেশি। 'হারানো সুর' ছবির সেই বিখ্যাত গানটির রেকর্ড ছিল আমাদের বাড়িতে। হেমন্তের গাওয়া গান,
আজ দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে।
সুচিত্রার গলায় যে গানটা ছিল সেটা হচ্ছে,
তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার
কানে কানে শুধু একবার বলো।
এই গানটা কিন্তু সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গাননি। এটা গেয়েছেন গীতা দত্ত। কী মিষ্টি গান! শুনলে শুধু শুনতেই ইচ্ছা করে।
পঁয়ষট্টি সালে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের একটি হাস্যকর যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর থেকে ইন্ডিয়ান সিনেমা পূর্ব পাকিস্তানে আর আসে না। এ জন্য কত ভালো ভালো ছবি আমাদের দেখা হয়নি! ঢাকায় যখন জগন্নাথ কলেজে পড়ছি, তেষট্টি চৌষট্টি সালের কথা, তখন সপ্তাহে সপ্তাহে ইন্ডিয়ান সিনেমা দেখতে যেতাম। বাংলা হিন্দি সব ছবিই দেখতাম। সদরঘাটের রূপমহল, ইসলামপুরের লায়ন, কোর্ট কাছারির সামনে মুকুল। কত সিনেমা হল চারপাশে!
যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি, ইন্ডিয়ান সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। আসত পশ্চিম পাকিস্তানের নিলু মোহাম্মদ আলী, জেবা ওয়াহিদ মুরাদ, দিবা সুধীর- এসব অভিনেতা-অভিনেত্রীর সিনেমা। পশ্চিম পাকিস্তানের সিনেমা আমার ভালো লাগত না। আমার ভালো লাগত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা সিনেমাগুলো। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত- এঁরা কী সুন্দর স্নিগ্ধ ছবি বানাতেন! রাজ্জাক কবরী, আজিম সুজাতা, সুচন্দা, সুলতানা জামান- এঁদের ছবি আমার খুব ভালো লাগত। নতুন ছবি এলেই বন্ধুরা দল বেঁধে দেখতে যেতাম।
মা, তুমি কি খেয়াল করেছ, বাড়ির সব কিছুতেই 'ছিল' বলতে হচ্ছে। অর্থাৎ এখন আর নেই। সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে ওরা। সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।
যে জন্য ঢাকার কথা বলছিলাম, গুলিস্তান সিনেমা হলের কথা বলছিলাম, সেই কথা শোনো, মা। গুলিস্তানের সঙ্গেই, একই বিল্ডিংয়ে 'নাজ' নামে ছোট্ট আরেকটা সিনেমা হল আছে। ওই হলটায় শুধু ইংরেজি ছবি চলে। পৃথিবীর বিখ্যাত সব ইংরেজি ছবি। অন্য ভাষার ছবি চলে ইংরেজি সাব টাইটেলে। ইউনিভার্সিটি থেকে ঢাকার বাংলা ছবি দেখতে যাওয়ার মতো আমরা বন্ধুরা দল বেঁধে নাজে সিনেমা দেখতে যেতাম। কী অসাধারণ সব সিনেমা চলত হলটায়!
এখন, এই অবস্থায়ও হয়তো পাকিস্তানিরা নাজ খোলা রেখেছে। সব সিনেমা হলই খোলা রেখেছে। সিনেমা হয়তো চলে। কারা দেখতে যায় না যায় কে জানে। পাকিস্তানিরা ঢাকাকে এমনভাবে রেখেছে, যেন বাইরের পৃথিবীর কেউ বুঝতেই পারে না এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, পাকিস্তানিরা চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। ওরা ঢাকা শহর ঠিক রেখে ধ্বংস করছে অন্য শহরগুলো, গ্রামের পর গ্রাম, গঞ্জের পর গঞ্জ। ঢাকায় পাকিস্তানিরা এখন যা করছে তা করছে একটু অন্য রকমভাবে। অত্যাচার নির্যাতন হত্যাকাণ্ড সবই চালাচ্ছে কিন্তু বিদেশিদের কিছুই বুঝতে দিচ্ছে না।
একটা সিনেমার কথা মনে পড়ছে, মা। নাজেই দেখেছিলাম। রাশিয়ান ছবি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে তৈরি।
নামটা যেন কী!
মনে পড়েছে। 'ব্যালাড অব এ সোলজার'। পুরো গল্প মনে পড়ছে না, মা। একটা দৃশ্যের কথা শুধু মনে পড়ছে। এক কিশোর ছেলে যুদ্ধে চলে গেছে। তখনও তার দাড়ি-গোঁফ ওঠেনি। ট্রেনে করে এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেক যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছে। সৈনিকের পোশাক পরা, কাঁধে রাইফেল। নিজেদের এলাকার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। স্টেশনে ঘণ্টা তিনেক অপেক্ষা করবে। ছেলে এই সুযোগটা নিল। কমান্ডারকে অনুরোধ করল, আমি আমার মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। তুমি কি আমাকে ঘণ্টা দুয়েক সময় দেবে? মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমি শুধু মাকে একটু দেখেই চলে আসব।
কমান্ডার সময় দিলেন। ছেলে এলো মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। এই যে আমি যেমন তোমাদের সঙ্গে এক রাতের জন্য দেখা করতে এসেছি, অনেকটা এই রকম।
যুদ্ধের ডামাডোলে তছনছ হয়ে যাওয়া চারদিক। মা ব্যস্ত ছিলেন কোনও কাজে। ছেলে এসেছে শুনে পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এলেন। এসে ছেলেকে দেখে কী রেখে কী করবেন বুঝতে পারলেন না। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ করেই তিনি ছেলের গালে হাত দিলেন। তুই শেভ করেছিস!
অর্থাৎ যুদ্ধে যুদ্ধে কিশোর ছেলেটি তাঁর কোন ফাঁকে যে বড় হয়ে গেছে!
জানি না মা, কেন যে এই দৃশ্যটি দেখে আমার চোখে পানি এসেছিল!
আজ আমি যখন বাড়ি ফিরেছি, মা গো, আমার মনে হয়েছিল, এত দিন পর বাড়ি ফিরেছি আমি, আমার আসার খবর পেয়ে সেই রাশিয়ান মায়ের মতোই ছুটে আসবে তুমি।
আমার মাথা দুহাতে জড়িয়ে ধরবে তোমার বুকে। আমার গালে মাথায় বুকে পিঠে হাত বোলাবে আর চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বলবে, আহা রে, আমার ছেলেটা কত রোগা হয়ে গেছে। ও বাবা রবি, তোরা ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করস না? ঘুমাস না ঠিকমতন। চোখ এত লাল কেন, বাবা?
মা গো, কী ভেবে এলাম, কোন স্বপ্ন নিয়ে এলাম আর এসে এ কী দেখছি! তোমরা কেউ নেই, মা। তোমরা কেউ নেই।
আশ্চর্য ব্যাপার, তার পরও আমার কান্না পাচ্ছে না। চোখে পানি আসছে না।
কেন বলো তো!
আমি কি সত্যি সত্যি পাথর হয়ে গেলাম! সিনেমার দৃশ্য দেখে যে ছেলে কাঁদে, তাও কোনও মৃত্যুর দৃশ্য না, অতি সামান্য এক আবেগের দৃশ্য, সেই ছেলেই তার বাবা মা বোন স্ত্রী এবং স্ত্রীর গর্ভে থাকা সন্তানের এ রকম ভয়াবহ মৃত্যু দেখে কাঁদতে পারছে না কেন!
কোন কথা থেকে যে কোন কথা এসে যাচ্ছে, মা।
কথায় কথায় বারেকের মায়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই যে হারিকেন হাতে বাবার কথামতো সন্ধ্যার আগে আগেই বারেককে খুঁজতে বেরিয়ে গেল কদম, বাড়িতে আমরা অপেক্ষা করছি, অনেকটা রাত হয়ে গেল কদমের খবর নেই, বারেকের খবর তো নেই-ই।
বারেকের মা পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।
আমাদের ঘরে ঘরে হারিকেন জ্বলছে। এই এদিক যাচ্ছে বারেকের মা, এই ওদিক যাচ্ছে। একবার সামনের উঠানে যায়, একবার পিছনের উঠানে আসে। অকারণেই রান্নাঘরে ঢোকে, গোলাঘর ঢেঁকিঘরে ঢোকে। বিড়বিড় করে, শব্দ করে কথা বলে। কদম মিয়াভাই অহন তরি আহে না ক্যান? আমার বারেকরে নিয়া আহে না ক্যান মিয়াভাইয়ে?
আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে বারেকের মায়ের অস্থিরতা দেখি।
বকুল তোমার কোলে। আধো আধো কথা বলতে শিখেছে। বুয়াকে বলত 'বুলা'। তোমার কোল থেকে বলছিল, বুলা কী, মা! বুলা কী!
অর্থাৎ বুয়ার কী হয়েছে?
তুমি নানা রকম কথায় তাকে ভুলাচ্ছিলে। আর বারেকের মাকে ভুলাচ্ছিল পারুল। তুমি অস্থির হয়ো না, বুড়ি। এত অস্থির হয়ো না। কদম মামায় ঠিকই বারেকরে খুঁইজা আনব। এইটুকু পোলা আর কই যাইব? এই দেখবা বাড়িতে আইসা পড়ল।
বুয়া বুক চাপড়ায়। কাঁদে না, বিলাপ করে। আল্লায় য্যান তা-ই করে। মিয়াভাইয়ে য্যান আমার পোলারে লইয়াই ফিরত আহে। দোয়া কর, তুই আমার পোলার লেইগা দোয়া কর।
তারপর তোমার দিকে তাকাল সে। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আম্মা, আম্মা গো, আপনে রোজ বিয়ানে কোরআন শরিফ পড়েন। আমার বারেকের লেইগা দোয়া করেন। মিয়াভাইয়ে য্যান বারেকরে লইয়াই বাড়িতে আহে। আপনের দোয়া কামে লাগব। আল্লায় আপনের কথা শুনব।
তুমি তাকে সান্ত্বনা দিলে। আমি দোয়া করতেছি। আল্লায় তোমার পোলা ফিরত আনব। তুমি সুস্থির হও।
বাবা গম্ভীর হয়ে পায়চারি করছিলেন সামনের দিককার উঠানে।
কদম ফিরল রাত প্রায় দশটার দিকে। ততক্ষণে আমাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে। রোজ এই কাজটা বুয়া আর পারুল মিলে করে। সেদিন এদিকে মন থাকার কথা না বুয়ার। আমাদের খাওয়াদাওয়ার কাজ পারুল একাই সামলাল।
খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার অনেক পরে ফিরল কদম।
কিন্তু একা।
বারেক নেই।
বারেককে পাওয়া যায়নি।
সারা গ্রাম তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে, আশপাশের গ্রামে খোঁজা হয়েছে, সঙ্গে গ্রামের লোকজনও ছিল। সবার এক কথা, বারেককে আজ সকাল থেকে তারা কোথাও দেখেইনি।
আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
বারেকের মায়ের মাথায় যেন আমাদের পুরো দালান বাড়িটা ভেঙে পড়ল।
প্রথমে মুহূর্তের জন্য সে একটু স্থির হলো, তারপর দুহাতে বুক চাপড়ে চিৎকার করে বিলাপ আর কান্না। হায় হায়, এইডা কী হইল? আমি ক্যান মারলাম আমার পোলারে? ক্যান অর গায়ে হাত তুললাম? কই চইলা গেল আমার পোলা? হায় হায়, এইডা কোন সব্বনাশ হইল আমার? আল্লাহ, আল্লাহ গো, এইডা তুমি কী করলা! কই লইয়া গেলা আমার পোলারে? হায় হায়, আমি অহন কী লইয়া বাঁচুম, আমি অহন কারে লইয়া বাঁচুম? আমার বুকের সামনে রাইত্রে কে ঘুমাইয়া থাকব? কে আমারে মা ডাকব? কে আমারে প্যাঁচাইয়া ধরব? আল্লাহ আল্লাহ, এইডা কী হইল! যার লেইগা আমি সংসার ছাড়লাম, সেও চইলা গেল আমারে ছাইড়া!
বারেকের মায়ের আহাজারি দেখে পারুলও চোখ মুছতে লাগল। কদম গোলাঘরের সামনে হারিকেন নামিয়ে রেখে পাথর হয়ে বসে রইল।
বারেকের মাকে কে কী সান্ত্বনা দেবে?
তুমি বললে, এমন কইরা কাইন্দো না বারেকের মা। তোমার ছেলে বাঁইচা আছে। রাগ কইরা লুকাইয়া আছে কোনোখানে। ফিরত আসব।
বারেকের মা আগের মতোই বুক চাপড়ায়। না গো আম্মা গো, আমার পোলা ফিরত আইব না। অর কী হইছে আমি বুইঝা গেছি। আমার পোলা বাঁইচা নাই।
বাবা বললেন, কী আবোলতাবোল কথা বলছ। বেঁচে থাকবে না কেন? আছে, বেঁচে আছে। কোথায় আছে এখন সেটাই দেখতে হবে। আজ রাতে না হয় পাওয়া যায়নি, কাল থেকে সব দিকে লোক পাঠাব, ঠিকই বারেককে খুঁজে পাওয়া যাবে।
বারেকের মায়ের ওই এক কথা। না গো খালু গো, অরে আপনেরা পাইবেন না। ও নাই। অরে কে খাইছে আমি বুইঝা গেছি। ওই যে বাঁশঝাড়তলায় গেল, ওই বাঁশঝাড়ের তেনায় অরে খাইছেন। আমার পোলারে মাইরা পুশকুনির (পুকুরের) তলায় কেদার (কাদা) মইধ্যে গুঁইজা রাখছে। অরে আমি আর কোনও দিন পামু না। হায় হায় রে, হায় রে, এইডা আমি কী করলাম! ক্যান গায়ে হাত তুললাম পোলার! ক্যান নিজের এই সব্বনাশ করলাম!
সারা রাত থেকে থেকে এ রকম আহাজারি করল বারেকের মা। একটু থামে, আবার শুরু করে। আমরা সেই রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেই পারলাম না।
আমিও বারেকের কাছাকাছি বয়সের। বারেকের মায়ের ওই বাঁশঝাড়তলার তেনার কথা শুনে খুবই ভয় করছিল। তার মানে জিনিসটা সত্যি সত্যি দিনের বেলায়ও বেরোয়। বারেক হয়তো তেনার সামনে পড়েছিল। আর সঙ্গে সঙ্গে ওইটুকু ছেলেকে ধরে সে আমাদের ওই দিককার কাদাভর্তি পুকুরে, কাদার তলায় গুঁজে দিয়েছে। কোনও দিন বারেকের লাশও ভেসে উঠবে না।
পরদিন আবার খোঁজাখুঁজি শুরু হলো। চারপাশের গ্রামে লোকজন পাঠালেন বাবা। বারেকের মা নিজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। মাঠে-ঘাটে যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, বারেকরে দেখছেন? আমার বারেকরে? দশ বছইরা পোলা। দেখতে কালাকোলা। তয় চেহারায় মায়া আছে। আমার পোলার হাসি খুব সোন্দর। চক্ষু দুইখান খুব সোন্দর। দেখছেন? ওই রকম একটা পোলারে দেখছেন আপনেরা?
না, বারেককে কাল থেকে কেউ দেখেনি।
কেউ কোনও খোঁজ দিতে পারল না। চারদিকে পাঠানো লোকজন ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। বারেকের মায়ের আহাজারি আরো বাড়ল, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই যে বারেককে গুম করেছে- এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেল।
আহা, তার পর থেকে আমাদের বুয়া রাতের পর রাত ঘুমাত না। ঘরে বসে কাঁদলে পারুলের ঘুমের অসুবিধা হবে দেখে নিঃশব্দে দরজা খুলে উঠানে বেরিয়ে আসত। ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় গিয়ে যতটা নিচু গলায় সম্ভব কাঁদত আর বারেককে ডাকত। বারেক রে, ও বারেক, ও আমার বাজান। আমি নাইলে তরে একটু মারছিলাম, এর লেইগা মার লগে রাগ করতে হয়, বাজান? মারে ছাইড়া চইলা যাইতে হয়? ও বাজান, বাজান, আমার কথা তর মনে হয় না? আমার লেইগা তর মায়া লাগে না, কান্দন আহে না? আমারে ছাইড়া তুই ঘুমাস কেমনে? খাস কেমনে? খাইতে বইলে আমার কথা তর মনে হয় না? ও বাজান, বাজান!
নিশিরাতে বারেকের মায়ের সেই কান্না শোনে অন্ধকার কিংবা জ্যোৎস্না রাত। গাছের পাতারা আর হাওয়া, ঝিঁঝিপোকা আর রাতপাখিরা। আমাদের বাড়ির মাটি আর মাটির মতো নিরীহ গরুগুলো। খোঁয়াড় থেকে শোনে ঘুমভাঙা কবুতররা, মোরগ মুরগিরা। মিনি বিড়ালটার মা বাবা ছিল, সেই জীব দুটো শুনত। ইঁদুর ব্যাঙেরা শুনত। কোনও কোনও রাতে ঘুম ভেঙে শুনি আমি। আমারও তখন বারেকের জন্য খুব কান্না পেত।
আরেকটা কাণ্ড করত বুয়া। নির্জন দুপুরে আর কোনও কোনও গভীর রাতে একা একা চলে যেত বাঁশঝাড়তলায়। সেখানকার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তেনার অশরীরী হাতে-পায়ে ধরত।
বাবা, আমার বাবা। আমার পোলাডারে ফিরত দেন। পোলার জানের বদলে আমার জান আপনে নেন। এই তো আমি আপনের সামনে। আমারে আপনে মাইরা ফালান। তাও আমার পোলাডারে ফিরত দেন।
সেটা হয়তো ফাগুন মাসের কোনও দুপুর কিংবা রাত। বারেকের মায়ের কাকুতি-মিনতি শুনত আমাদের বাঁশবনের বাঁশঝাড়গুলো। বাঁশের পাতায় পাতায় তখন শনশন করত মধ্যদুপুর কিংবা রাতের হাওয়া। হাওয়ার টানে কোথায় কোন সুদূরে ভেসে যেত বারেকের মায়ের আকুতি।
বাঁশঝাড়তলা থেকে তাকে ফিরিয়ে আনত কদম আর নয়তো পারুল। বারেকের জন্য আমাদের বাড়িতে একটা শূন্যতা তৈরি হয়ে গেল।
তবু দিন বসে থাকে না, দিন চলে যায়। বুয়া ছেলের জন্য নিশিরাতে, দিনদুপুরে কেঁদেই চলে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় কান্নাও কমে আসে তার। ওই যে তুরস্কের কবি নাজিম হিকমত লিখেছেন না, 'পৃথিবীতে শোকের আয়ু বড়জোর এক বছর।'
বছরখানেক ধরে বারেকের জন্য অনেক চেষ্টা-তদবির চলল। মালখানগরের মোসলেম ফকির, ইছাপুরার পবন ঠাকুর, আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব তো ছিলেনই। মোসলেম ফকির নানা রকম তাবিজ আর পানিপড়া দিয়েছিল বুয়াকে। পবন ঠাকুর ছিল গণক। গণনা করে বলেছিল, না, তোমার পোলা নাই। পোলার আশা ছাইড়া দেও। আর আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব, হাফেজ শেখ মোহাম্মদ নুরুদ্দিন, বারেকের মা তাঁর কাছে গেলেই দোয়া-দরুদ পড়তেন বারেকের উদ্দেশে।
বড় ভালো মানুষ ছিলেন ইমাম সাহেব। কত সান্ত্বনা যে বারেকের মাকে দিতেন! কত রকমভাবে যে বোঝাতেন, বাঁশঝাড়ের ওই সব ভূতপ্রেত কিছু না। ভূত বলতে আসলে কিছু নেই। তোমার ছেলের জীবনে অন্য ঘটনা ঘটেছে।
বুয়া আকুল হয়ে বলত, কী ঘটনা, হুজুর?
সেটা আল্লাহপাক ছাড়া কেউ বলতে পারবে না।
এ ঘটনার এগারো বছর পর একদিন দুপুরবেলা একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা সাদা পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলায় হালকা আকাশি রঙের লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। খালি পা ধুলায় ধূসর। মুখে ঘন কালো চাপদাড়ি। চৈত্র মাসের দুপুরবেলা। রোদে ঘামে, বহুদূর পথ হেঁটে আসার ফলে ক্লান্ত বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। লম্বা পাঞ্জাবিটা পুরনো, বোধ হয় ধোয়াও হয়নি বেশ কিছুদিন। বারবাড়ির ওদিক থেকে সোজা হেঁটে এসে ঢুকল আমাদের পিছন দিককার উঠানে। একেবারেই মুসাফির টাইপের লোক। কাঁধে রেকসিনের সস্তা খয়েরি রঙের ব্যাগ।
কে, লোকটা কে?
সেই লোকের কথা পরে বলি, মা। তার আগে শোনো এক মায়ের কথা। এক মুক্তিযোদ্ধার মায়ের কথা।
সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ইব্রাহিম। বাবা নেই। মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের গজারিয়ায়, ওই তো মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তরে, উত্তর-পূর্ব দিকে, শীতলক্ষ্যা পার হলেই গজারিয়া।
তার আগে তোমাকে গজারিয়ার গণহত্যার কথা বলি। মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সবচাইতে বড় গণহত্যা হয়েছে গজারিয়া থানায়। মে মাসের ঘটনা। ৯ মে ভোরবেলা পাকিস্তানি... ...গুলো অতর্কিতে আক্রমণ চালাল গজারিয়া থানার কয়েকটি গ্রামে। গোসাইরচর নয়ানগর বালুচর বাঁশগাঁও আর গজারিয়া গ্রামে। এক সকালে হত্যা করল ৩৬০ জন নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিকে।
নিরীহ নিরপরাধ কেন বলছি! বাঙালি চিরকালই নিরীহ নিরপরাধ এবং শান্তিপ্রিয় জাতি। কিন্তু অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা জাতি। ওই গানের মতো,
মা গো ভাবনা কেন
আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে
তবু শত্রু এলে অস্ত্রহাতে ধরতে জানি
আমরা প্রতিবাদ করতে জানি
'৫২ সালে ভাষার জন্য আমরা প্রতিবাদ করেছি না! আমরা জীবন দিয়েছি না ভাষার জন্য! বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছি না বাংলা ভাষা!
গজারিয়ায় গণহত্যা ঘটানোর পিছনে এলাকার কিছু মুসলিম লীগ নেতার তৎপরতা ছিল। তারাই পিছন থেকে নাড়িয়েছিল কলকাঠি।
মে মাসের ৪ তারিখে গজারিয়া হাই স্কুলে এলাকার তিরিশ-চল্লিশজন ছাত্র যুবক মিটিং করে। আলোচনার বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। কী করে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যায়, কী করে ঝাঁপিয়ে পড়া যায় পাকিস্তানি... ...গুলোর ওপর! কী করে মুক্ত করা যায় দেশ!
প্রাথমিক আলোচনা হলো সেদিন। দ্বিতীয় আলোচনা সভা হলো মে মাসের ৮ তারিখ সন্ধ্যাবেলা, গজারিয়া বাজারের অগ্নিবীণা সমিতির অফিসে। খবর পেয়ে গেল মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতারা। তারা আবার শান্তি কমিটিরও মেম্বার। ওরা করল কী, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার প্রভুদের গোপনে জানিয়ে দিল।
কী জানাল?
জানাল একেবারেই মিথ্যা খবর। গজারিয়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ফুলদি নদী। পাকিস্তানি... ...গুলোকে ওরা জানাল ফুলদি নদীর গা ঘেঁষা গ্রামগুলোতে মুক্তিবাহিনীর বিশাল আস্তানা গড়ে উঠেছে। হুজুর, মাই বাপ, আপনারা আসেন। মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে পাকিস্তান রক্ষা করেন। আমাদের প্রিয় পাকিস্তান বাঁচান।
আর কথা কী!
পরদিন ভোরবেলাই চলে এলো পাকিস্তানি... ...গুলো। এক সকালে শহীদ হলো ৩৬০ জন বাঙালি।
বিক্রমপুরের আরো তিনটি গণহত্যার কথা বলি, মা। কেওয়ার গ্রামটির নাম শুনেছ না! হ্যাঁ, শোনার কথা! মুন্সীগঞ্জ থানায় পড়েছে গ্রামটি। স্বর্ণগ্রামের মতো কেওয়ারেও আছে এক চৌধুরীবাড়ি। মে মাসের ১৪ তারিখে কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি ঘেরাও করল পাকিস্তানি... ...গুলো। পুরুষ-মহিলা মিলে ২৪ জনকে আটক করল। এই ২৪ জনের মধ্যে ১৭ জনকে হত্যা করল।
এপ্রিল মাসে সিরাজদিখান থানার রশুনিয়া সিংবাড়িতে গণহত্যা চালাল ওরা।
পঁচিশে মার্চের পরদিন থেকেই যে যেভাবে পারে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিল মানুষ। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বিক্রমপুরের দিকে আসছিল বহু মানুষ। রশুনিয়া সিংবাড়িতে এইসব মানুষের থাকা-খাওয়ার জন্য আশ্রয়শিবির খোলা হয়েছিল।
এই বাড়ি আক্রমণ করল পাকিস্তানি... ...গুলো। ৯ জন মানুষ মেরে ফেলল। রশুনিয়া হাই স্কুলের টিচার কান্ত বাবুকে হত্যা করল, বাড়ির মালিক রামসিংহকে হত্যা করল।
আমাদের টঙ্গিবাড়ী থানার কথা শুনবে?
আবদুল্লাহপুর পালবাড়ি খুব নামকরা। এই বাড়িতে ঢাকা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছিল কয়েকটি হিন্দু পরিবার। এপ্রিল না মে মাস, ঠিক মনে করতে পারছি না, এই বাড়ি আক্রমণ করল ওরা। ১১ জনকে হত্যা করল, পালবাড়ি জ্বালিয়ে ছাই করে দিল।
দ্যাখো মা, এক ঘটনা থেকে কেমন করে চলে যাচ্ছি আরেক ঘটনায়। বললাম না, আমার কোনও কিছুর ঠিক নেই। মাথা এলোমেলো। তোমার কবর খুঁড়ছি, ক্লান্তও লাগছে না!
নাকি লাগছে টের পাচ্ছি না! তোমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি তো বলেই যাচ্ছি। এত কথা বলছি বলেই কি ক্লান্তি টের পাচ্ছি না!
ইব্রাহিমের কথা শোনো মা, ইব্রাহিমের মায়ের কথা শোনো।
গজারিয়ার যুদ্ধে শহীদ হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ইব্রাহিম। মাথায় গুলি লেগেছিল। মরদেহ নিয়ে ইব্রাহিমদের বাড়িতে গেলেন সহযোদ্ধারা। ইব্রাহিমের মা তখন ঘরে। সেই বীরের মরদেহ উঠানে রেখে সহযোদ্ধারা ঢুকলেন ঘরে। কিন্তু একমাত্র সন্তানের শহীদ হওয়ার কথা কেমন করে বলবেন মাকে! কী করে দেবেন এ রকম সংবাদ!
ঘরে ঢোকার আগে ইব্রাহিমের মাকে চাচি চাচি বলে ডাকছিলেন সহযোদ্ধারা। তিনি ঘর থেকে বেরোনোর আগেই ঘরে ঢুকে গেছেন সহযোদ্ধারা।
ইব্রাহিমের মা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন। কী রে, কী হইছে?
মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক রফিক আছেন দলে। তিনি অন্য রকমভাবে কথা শুরু করলেন। আছেন কেমুন, চাচি?
ভালো আছি, বাজান।
আমরা যে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতাছি সেই কথা তো আপনে জানেনই।
জানুম না ক্যান। আমার ইব্রাহিমও তো আছে তগো লগে। আমার পোলায়ও তো মুক্তিযোদ্ধা।
কিন্তু চাচি, এই যে আমরা যুদ্ধ করতাছি, যুদ্ধে কোন দিন না জানি কে মইরা যাই।
হ বাজান, কথা ঠিক।
আপনের ইব্রাহিমও মরতে পারে!
তা তো পারেই।
তারপর সেই মহীয়সী নারী, সেই মা সরল গলায় বললেন, আমার ইব্রাহিম মরলে কী হইছে? তোরা আছছ না!
যে মায়ের একমাত্র সন্তানের লাশ রাখা উঠানে আর ঘরে বসে যে মা বলছেন একথা, কে সইতে পারে কথাটা। সহযোদ্ধারা মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলেন।
আমার শুধু এ রকম মায়েদের কথা বলতে ইচ্ছা করছে, মা।
ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলি। জানুয়ারির ১৯ তারিখে ছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ করল পুলিশ। অসুরের ভঙ্গিতে লাঠিপেটা করল ছাত্রীদের। পরদিন, ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন আসাদুজ্জামান, শহীদ আসাদ নামে যিনি পরিচিত।
শহীদ আসাদদের বাড়ি শিবপুরে।
শিবপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে আসাদের মা সংগ্রামী ছাত্রনেতাদের কাছে বাণী পাঠালেন। "আমার আসাদের মৃত্যু হয়নি। আমার আসাদ বলত, 'মা, আগামী দশ বছরের মধ্যে এই মাতৃভূমি নতুন জীবন পাবে।' আমার আসাদের এই স্বপ্ন তোমরা সার্থক করো।"
এই তো আমাদের বাংলার মা।
মুক্তিযোদ্ধা কারা, মা? শুধু অস্ত্রহাতে তোমার এই ছেলের মতো যারা যুদ্ধ করছে তারা? না। পঁচিশে মার্চের পর থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি নারী-পুরুষের জীবন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। প্রায় এক কোটি বাঙালি শরণার্থী হয়ে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। এরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, মা। সবাই মুক্তিযোদ্ধা।
সামরিক গেরিলা যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া এই যুদ্ধে সাফল্য সম্ভব না। সাধারণ মানুষ যেমন হয়েছেন ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা, ঠিক তেমনি দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমভাবে, সব কাজে সাহায্য করছেন সাধারণ মানুষ।
তাঁরা কি মুক্তিযোদ্ধা না?
অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা।
বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশে এখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। তার অর্ধেক নারী। সুতরাং দেশের তিন কোটি ৭৪ লাখ নারীই মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে শত্রুর খবর আদান-প্রদান করেন। রাডার যেমন ভিতর ও বাইরের শত্রুদের খবর দেয়, এখন আমাদের নারীরা, মা বোনরা স্ত্রীরা ঠিক সেই ভূমিকা পালন করছেন।
মা, রাজাকার আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির... ...গুলো ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। নারী পুরুষ শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ সবাই।
আমার বাবাও একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শহীদ হয়েছেন। তিনি দেশ নিয়ে ভেবেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া, মুক্তিকামী মানুষ ছাড়া কে চায় স্বাধীনতা।
আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা।
তুমি আমার মা, তুমি আরেক মুক্তিযোদ্ধা। বুকের রত্ন ঠেলে দিয়েছ যুদ্ধে। যাও, যুদ্ধ করো। খতম করো শত্রু। স্বাধীন করো আমার দেশ।
আমার বোন মুক্তিযোদ্ধা, আমার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা। আমার অনাগত সন্তান, যার চারপাশের প্রতিটি মানুষ মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশের আলো না দেখেও সে মুক্তিযোদ্ধা। মাতৃগর্ভে থাকা মুক্তিযোদ্ধা।
মা, তুমি কি তোমার রবিকে কখনও এ রকম পরিশ্রম করতে দেখেছ?
কখনও ভেবেছ এ রকম পরিশ্রম করতে পারে তোমার একমাত্র ছেলে! চৌধুরীবাড়ির ছেলে, বলতে গেলে এলাকার জমিদার, সেই বাড়ির একমাত্র ছেলে এ রকম পরিশ্রম করছে, ভাবতে পারো?
মুক্তিযোদ্ধাদের পরিশ্রমের শেষ নেই, মা। তাঁদের পরিশ্রম দুরকম। শারীরিক এবং মানসিক। মাথা খাটিয়ে প্ল্যান করা, শরীর খাটিয়ে শত্রু শেষ করা। তার ওপর ঠিকমতো খাবার পাওয়া যায় না, ঘুম নেই চোখে।
খাবার প্রসঙ্গে আমার কমান্ডার খালেদ মোশাররফের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। একদিন আমরা শুনলাম, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে মিটিং করছেন। দুপুরের খাওয়ার সময় বিমানবাহিনীর অফিসারদেরও ডাকা হলো কনফারেন্স রুমে। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বসেছিলেন ঘরে ঢুকতেই টেবিলের একপ্রান্তে। সবার সামনে উপুড় করা খাবার প্লেট। সাবেগ সিংয়ের বাঁয়ে বসা খালেদ মোশাররফ, ডানে জিয়াউর রহমান।
সাবেগ সিং খালেদ মোশাররফের দিকে তাকালেন। আচমকা জিজ্ঞেস করলেন, খালেদ, তোমার এত রেশন লাগে কেন?
খালেদ মোশাররফ জবাব দিলেন, স্যার, আমি ঢাকার সবচে' কাছে, কুমিল্লা নোয়াখালীর লাগোয়া। আমার ক্যাম্পে সকালে যদি থাকে ৫০০ ছেলে, দুপুরে থাকে ১৫০০, রাতে থাকে ৩০০০। কোনও কিছুই ঠিক নেই।
সাবেগ সিং বললেন, আমি দুঃখিত, খালেদ। আমাকে তোমার রেশনের হিসাব নিতে হবে।
খালেদ মোশাররফ বুঝলেন সাবেগ সিং তাঁর সততার প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
খালেদ মোশাররফ ডান হাতে ধাক্কা দিয়ে খাবার প্লেটটি সামনে ঠেলে দিলেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার ইংরেজিতে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, 'ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং, আপনি নিশ্চয় চান না যে আমি আমার রাইফেলের ব্যারেল দুই দিকে ঘুরাই।'
বলে সাবেগ সিংয়ের পিছনের দরজা দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেজর জিয়াউর রহমানও বেরোলেন। খালেদ মোশাররফের হাত ধরে বাংলায় বললেন, 'খালেদ, এটা রাগারাগি করার সময় না, জায়গাও না। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। ফেরত আসো।'
ততক্ষণে সাবেগ সিং তাঁর ভুল বুঝেছেন। তিনিও বেরিয়ে এলেন। প্রথমে আমার কমান্ডারের কাছে ক্ষমা চাইলেন। আই অ্যাম স্যরি, খালেদ।
তারপর তাঁর হাত ধরে ঘরে ঢুকলেন।
কী যেন বলছিলাম! ও, আমার পরিশ্রম করার কথা। আমি পরিশ্রমী হয়ে গেছি, মা। কঠিন পরিশ্রম এখন তোমার ছেলে করতে পারে। পঁচিশে মার্চের পর থেকে পরিশ্রম আর উৎকণ্ঠার মধ্যেই তো আছি। যুদ্ধের মধ্যে আছি। জীবনের মায়া নেই। জীবনের চেয়ে অনেক মূল্যবান এখন দেশ। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনও শক্ত হয়ে গেছে, কঠোর কঠিন হয়ে গেছে। আবেগ কমে গেছে।
যোদ্ধাদের আবেগ থাকতে নেই।
এই যে এইভাবে আমি এলাম, সারা দিনে জেলে নৌকায় ওই একথালা ভাত, তারপর এতটা পথ এইভাবে আসা, তারপর বাড়ির এই অবস্থা, পুরো পরিবার শহীদ হয়েছে, বাবাকে কবর দিয়ে মায়ের কবর খুঁড়ছি, তারপর বোন স্ত্রীর কবর খুঁড়ব, আমার ক্লান্ত লাগছে না, মা। কবর খোঁড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমি তোমার দিকে তাকাচ্ছি। কথার পর কথা বলে যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
এখন কী মনে পড়ছে জানো!
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময়টার কথা মনে পড়ছে।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সিট পড়েছে মুন্সীগঞ্জে। আমাদের স্বর্ণগ্রাম হাই স্কুল আর লৌহজং থানার কাজীর পাগলা হাই স্কুলের সিট পড়েছিল মুন্সীগঞ্জ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
মুন্সীগঞ্জ মহকুমা শহর।
স্বর্ণগ্রাম থেকে আট দশ মাইল দূরের পথ। বর্ষাকালে যাতায়াতের ব্যবস্থা নৌকা আর গ্রীষ্মকালে পায়ে হাঁটা। আট দশ মাইল পথ হেঁটে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আবার এতটা পথ হেঁটে আসা সম্ভব না।
পরীক্ষার সময় বিক্রমপুর অঞ্চলের সব ছাত্রছাত্রী মুন্সীগঞ্জ শহরে এসে কোনও না কোনও বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে। থাকা-খাওয়া বাবদ টাকা-পয়সাও দিতে হয়। তবে শহরে যাদের আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের জন্য টাকা-পয়সার কোনও ব্যাপার নেই। যাদের কেউ নেই, তাদের জন্য এক ধরনের মধ্যবিত্ত পরিবার টাকা-পয়সার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে।
আমার জন্য তেমন কিছু করতে হয়নি।
বাবার বন্ধু মুন্সীগঞ্জের বিখ্যাত কাদের ডাক্তার। ডাক্তার এম এ কাদের। হরগঙ্গা কলেজের উত্তর দিকটায় ডাক্তার কাকার বাড়ি। আমি সেই বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলাম।
ডাক্তার কাকার পরিবারের সবার কথা আমার এখন মনে পড়ছে না, মা। শুধু দুজন মানুষের কথা মনে পড়ছে। একজন প্রায় আমার বয়সী। ডাক্তার কাকার ছেলে বাবুল আখতার। অসম্ভব সুন্দর গলার স্বর। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করে। রেডিও-টেলিভিশনে খবর পড়ে।
তোমার কানে বাজছে না, মা! রেডিও পাকিস্তান ঢাকা, খবর পড়ছি বাবুল আখতার।
হ্যাঁ, সেই বাবুল আখতার। এখন সে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। সেখান থেকে খবর পড়ে, কথিকা পড়ে। রবীন্দ্রনাথ নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আবৃত্তি করে।
ডাক্তার কাকার আরেক ছেলের কথা মনে পড়ছে। সে সবার ছোট কি না মনে পড়ছে না। ছেলেটির তিনটা নাম। এক নাম আজাদ, আরেক নাম জিল্লু। ভালো নাম মুনির কাদের।
কেন যেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা তুললাম!
মনে পড়েছে। বাবার সঙ্গে পরীক্ষার তিন দিন আগে রওনা দিয়েছি। পায়ে হেঁটে মুন্সীগঞ্জ যাব। সঙ্গে কদম আছে। আমার বইপত্র কাপড়চোপড়ের স্যুটকেস মাথায় করে নিয়ে যাবে কদম। আমার কাঁধে হালকা একটা ব্যাগ, বাবার কাঁধেও একটা ব্যাগ, কদমের হাতেও একটা ব্যাগ। কদমের ব্যাগে নানা রকমের শুকনো খাবার তৈরি করে দিয়েছ তুমি। মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, তিল কাউনের নাড়ু। একটা বয়ামে দিয়েছ আমের মোরব্বা। পড়তে পড়তে খিদে পেলেই যেন কিছু না কিছু খেতে পারি।
ওসবের কোনও দরকারই ছিল না, মা। ডাক্তার কাকার বাড়িতে কাকি আমাকে একদম তোমার মতো করে সামলাতে লাগলেন। এটা খাও বাবা, ওটা খাও। তোমার মা কেন এত সব খাবার দিয়া দিছেন! আমার বাড়িতে কি খাবারের অভাব! তোমার ডাক্তার কাকা রোজ চিত্তর দোকানের মিষ্টি নিয়া আসেন।
চিত্তর দোকানের ছানার আমিত্তির কোনও তুলনা হয় না, মা।
দোকানের নাম 'লক্ষ্মীনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'। মালিকের নাম চিত্তরঞ্জন। সবাই বলে চিত্ত, চিত্তর মিষ্টির দোকান।
ডাক্তার কাকি আমাকে সকাল-বিকাল মিষ্টি খেতে দিতেন। কী যে স্বাদ সেসব মিষ্টির! মিষ্টি খেতে খেতে তোমার দেওয়া নাড়ু মোয়া মোরব্বা খাওয়াই হয় না।
কী কারণে এসব কথা বলছি, মা!
মনে পড়েছে, মনে পড়েছে। পরীক্ষার জন্য দিন বিশেক মুন্সীগঞ্জে থাকব আমি। যেদিন যাব তার আগের রাত থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। যখন তখন কাঁদছ। আমাকে খেতে দিয়ে, আমি পড়তে বসলে পড়ার টেবিলের সামনে এসে মাথায় হাত রেখে তুমি চোখ মুছছ।
আমি তোমাকে বোঝাই, বাবাও নানা রকমভাবে বোঝান।
আমি বলি, আমি যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে আর তুমি কাঁদছ! তোমার এ রকম কান্নাকাটি দেখে গেলে আমার ভালো লাগবে! মন খারাপ হবে না! যখন-তখন তোমার কান্নাভেজা মুখ চোখে ভাসবে না! আমি ঠিকঠাকমতো পরীক্ষা দিতে পারব? রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে না!
তুমি চোখ মুছতে মুছতে বললে, তোরে ছাইড়া এত দিন আমি কোনও দিন থাকছি!
আমাদের বাড়িতে সবাই আমরা বইয়ের ভাষায় কথা বলি। একেবারে শুদ্ধ ভাষা। শুধু তুমি শুদ্ধ-অশুদ্ধ মিলিয়ে বলো। শুদ্ধর সঙ্গে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষার মিশেল দিয়ে কথা বলো।
তোমার সেই ভাষা এ জীবনে আমার আর কখনো শোনা হবে না, মা। পাকিস্তানি... ...গুলো, সঙ্গে তাদের দোসররা ছিল, তারা চিরতরে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল তোমাকে।
কী বলব, মা!
ওদেরকে আমি এখন কী বলব!
পৃথিবীর এমন কোনও কুৎসিত গাল নেই, যা দিলে সত্যিকার গাল দেওয়া হবে ওদেরকে।
আর গাল দিতে তো আমি শিখিনি, মা।
তোমার মতো মা, বাবার মতো বাবা, তোমরা যে কী যত্নে, কী মমতায় এবং রুচিস্নিগ্ধতায় আমাকে আর বকুলকে বড় করেছ, কোন মানুষের এমন ভাগ্য হয় তোমাদের মতো মা-বাবা পাওয়ার!
ম্যাট্রিক পরীক্ষার কথা বলি, বাবার কথা বলি।
মানে বাবা তোমাকে ওসময় কী বুঝ দিয়েছিলেন ওসব কথা আর কি!
তোমার কান্নাকাটি দেখে বাবা আগের দিন সন্ধ্যায় বললেন, ছেলে যাচ্ছে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিতে আর তুমি কেঁদেকেটে বিনাশ করছ!
বাবার কথা শুনে তুমি রেগে গেলে। বিনাশ করছি অর্থ কী?
মানে তোমার কান্না দেখে ছেলের মন খারাপ হচ্ছে।
আর আমি যে এত দিন আমার ছেলেরে না দেইখা থাকুম, আমার মন খারাপ হয় না! আমার চোখে পানি আসে না!
আমিও এত দিন আমার ছেলেকে কখনও না দেখে থাকিনি। ঢাকায় গিয়েছে আমাদের সঙ্গে। কখনও কখনও দু-চার দিন বেলার ওখানে থেকেছে, কিন্তু বিশ দিন একসঙ্গে থাকেনি। এবার পরীক্ষার জন্য থাকতে হচ্ছে।
আমি কি আমার ছেলেকে কম ভালোবাসি? কই, আমি তো কাঁদছি না, আমার চোখে তো পানি আসছে না!
বাপ আর মা এক জিনিস না। মার কলিজা ছেলেমেয়ের জইন্য যেইভাবে পোড়ে, বাপের সেইভাবে পোড়ে না।
আমি আমার পড়ার ঘর থেকে বারান্দায় তোমাদের দুজনের এসব কথা শুনি আর মনে মনে হাসি। আট-দশ মাইল দূরের মুন্সীগঞ্জে যাচ্ছি পরীক্ষা দিতে, দিন বিশেক থাকব, ওই নিয়ে তোমরা কত কথা বলছ!
কিন্তু মা, মুন্সীগঞ্জ গিয়ে প্রথম দু-চার দিন তেমন কিছু মনে হলো না। তার পর থেকে তোমাদের জন্য খুবই মন খারাপ হতে লাগল। যখন-তখন তোমাদের কথা মনে হয়, রাতের বেলা ঘুম আসতে চায় না। পরীক্ষার মাঝখানে এক দুদিনের গ্যাপ থাকে, ইচ্ছা করে এক দৌড়ে বাড়ি চলে যাই, তোমার মুখটা একটু দেখে আসি। বাবার মুখটা, আর আমার বকুলের মুখটা একটু দেখে আসি।
যদিও ওই বিশ দিনে চারবার বাবা আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন, তবু আমার মন খারাপ হয়ে থাকত।
ডাক্তার কাকি খুবই আগলে রাখেন। তিনিও মা। আমার মন বুঝতে পারেন। পড়তে বসে আমি গেছি উদাস হয়ে, পিছন থেকে এসে তিনি আমার মাথায় হাত দিলেন, কী হইছে, বাজান?
না, কিছু না।
মন খারাপ দেখতাছি।
কই?
হ বাবা। আমি দূর থিকা তোমারে খেয়াল করছি। তোমার মন ভালো নাই। মা-বাবার কথা মনে পড়তাছে?
জি না, কাকি। তেমন কিছু না।
আমি বুঝি, বাজান। আমার ছেলেরা বাইরে গিয়া থাকলে তাগো যেমন আমার জন্য খারাপ লাগে, আমারও খারাপ লাগে তাগো জন্য। ওই দিকে তোমার মা তোমার জন্য মন খারাপ করতাছেন আর এই দিকে তুমি করতাছ মায়ের জন্য।
বাবার কথাও আমার খুব মনে হয়। বকুলের কথা মনে হয়।
এই তো কয়টা মাত্র দিন। পরীক্ষা শেষ হইলেই তো মা-বাবার কাছে চইলা যাইবা, বইনের কাছে চইলা যাইবা। এখন মন খারাপ কইরো না। তাইলে পরীক্ষা খারাপ হইব।
না, পরীক্ষা আমার খারাপ হয়নি, মা। আর্টস থেকে ফার্স্ট ডিভিশন পেলাম। অঙ্কে লেটার মার্কস।
মুন্সীগঞ্জ থেকে ফেরার সময় অন্য কারণে আবার মন খারাপ। চলে আসার দিন দেখি ডাক্তার কাকি ঘন ঘন আঁচলে চোখ মোছেন। আমি এতগুলো দিন তাঁর কাছে ছিলাম, নিজের ছেলেদের মতো করে আমার দেখভাল করেছেন, আগলে রেখেছেন, এখন আমি চলে যাচ্ছি আর তিনি চোখের জলে ভাসছেন।
আহা রে, কী ভালো আমার দেশের মায়েরা!
এমন মমতাময়ী মা পৃথিবীর আর কোন দেশে আছে!
ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে পড়তে চলে গেলাম ঢাকায়। তোমাদের দীননাথ সেন রোডের বাড়িতে থাকি, ভর্তি হয়েছি জগন্নাথ কলেজে। কখনও লোহারপুলের ওদিক দিয়ে ফরাশগঞ্জ, শ্যামবাজার, বাংলাবাজার হয়ে কলেজে যাই, কখনও যাই ডিস্টিলারি রোডের ওদিক দিয়ে, কাঠেরপুল পার হয়ে প্যারীদাস রোড হয়ে সোজা বাংলাবাজারের দিকে।
রিকশায় চড়তে আমার ভালো লাগে না। আমার হাঁটতে ভালো লাগে। হেঁটে হেঁটে কলেজে যাই। এই নিয়ে মায়া আমাকে কিপটা কিপটা বলে খেপায়। এত বড়লোকের ছেলে, সে কলেজে যায় হেঁটে! রিকশা ভাড়ার পয়সা বাঁচায়।
সাপখেলা দেখানো বেদেনীদের ভঙ্গিতে মজা করে বলে, খা খা খা, বক্ষিলারে খা।
বক্ষিল মানে কৃপণ।
মায়া তখন মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে।
আমি কলেজে ভর্তি হব, তোমরা সবাই এ উপলক্ষে ঢাকায় এলে। যেন বিশাল একটা উৎসব শুরু হলো আমাকে নিয়ে। আমি বেলা খালার বাড়িতে থেকে জগন্নাথে পড়ব।
আমরা সব সময় বলতাম বেলা খালার বাড়ি।
বেলা খালা মাঝে মাঝে হাসতেন। বেলা খালার বাড়ি বলছস কেন? এই বাড়ি তোর মারও। তোর মার অর্ধেক, আমার অর্ধেক। দুইটা ভাড়াইটা আছে, কিছু টাকা ভাড়াও পাওয়া যায়। তোর মা সেই টাকা নেয় না। ছোট বোনরে দিয়া দেয়। আমাদের দুই বইনের ভালোবাসা যে কী রকম, সেইটা তোরা বুঝবি না।
মা, আমি বুঝতাম। বেলা খালা যে তোমার জান, এটা আমি টের পেতাম। খালাকে তুমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলে, ওই বাড়ি তোরই। আমার অনেক আছে। আমার ওই বাড়ি লাগব না। শুধু আমার ছেলেমেয়ে দুইটা যখন ঢাকায় পড়তে যাইব তখন ওই বাড়িতে থাকব। অর্থাৎ তোর কাছে থাকব। কারণ একটাই, মায়ার মতো আমার ছেলেমেয়ে দুইটারেও তুই একই রকম ভালোবাসবি, একই রকম আদর করবি।
খালা তোমাকে ডাকে 'বুজি'।
বিক্রমপুরের ভাষা। বুজি মানে বুবু, আপা।
তোমার কথা শুনে বেলা খালা বলত, এই সব কথা কেন বলো, বুজি? তোমার ছেলেমেয়ে আমারই ছেলেমেয়ে। মায়ার সঙ্গে বকুলের কি কোনও ব্যবধান আছে! আর রবি হইতাছে তোমার আমার দুইজনেরই একমাত্র ছেলে।
দীননাথ সেন রোডে তোমাদের বাড়িটা গ্রামের বনেদি বাড়ি ধরনের।
বাড়ির সামনে তিন-চারটা লিচুগাছ। তারপর টিনের চৌচালা সুন্দর একটা বসার ঘর। বাড়ির চারদিকে ঢেউটিনের বেড়া। গেটটা কাঠের। তারপর দক্ষিণমুখী দোতলা টিনের বিশাল একটা ঘর। ওপর-নিচ মিলিয়ে সাত-আটটা কামরা। পিছন দিকে আরো দুটো বেশ বড় সাইজের টিনের ঘর। ওই দুই ঘরেও তিন-চারটা করে কামরা। দুই ঘরে দুটো পরিবার ভাড়া থাকে। এক ঘরে শান্তি আপারা, অন্য ঘরে হারুনরা। দুই ঘরের জন্য দুটো রান্নাঘর, আলাদা চাপকল আছে, আলাদা গোসলখানা, পায়খানা। ভাড়া কত হবে? দুই ঘরের ভাড়া বোধ হয় দেড় শ দেড় শ তিন শ টাকা। আগে ইলেকট্রিসিটি ছিল না। দু-তিন বছর হলো ইলেকট্রিসিটি এনেছে খালা।
বেলা খালার পরিবারের জন্য একেবারেই আলাদা ব্যবস্থা।
চাপকল আলাদা। চাপকলের সঙ্গে পানি জমিয়ে রাখার জন্য পাকা একটা হাউস। তার দক্ষিণ পাশে চারদিকে ইটের দেয়ালঘেরা গোসলখানা, পায়খানা। রান্নাঘরটা দোতলা ঘরের পশ্চিমে। তারও পশ্চিমে দু-তিন কাঠা খোলা জায়গা। সেখানে বাগান করেছে খালা। একটা জামরুলগাছ আছে। দুটো আমগাছ, পেয়ারা, বরইগাছ আছে। শীতকালে খালা নিজ হাতে সবজির চাষ করে। লাউ কুমড়া শিম ঢেঁড়স ডাঁটা টমেটো বেগুন। বাগানের দিকটা বেশ সবুজ। তাকালেই ভালো লাগে।
মাজেদা আর মাজেদার স্বামী রফিক, ওদের ছেলেমেয়ে নেই। নাকি ছিল, মারাটারা গেছে!
ইস্, কেন যে মনে পড়ছে না!
যা ইচ্ছা হোক গিয়ে। ওরা থাকে দোতলা ঘরের নিচতলার একটা কামরায়। ওপরে খালা আর মায়া। আমারও জায়গা হলো ওপরেই।
দোতলার সামনে সুন্দর রেলিং দেওয়া বারান্দা। বারান্দার সঙ্গেই কামরাগুলো। দক্ষিণমুখী বারান্দা। বিকেলের দিকটায় ওই বারান্দায় বসলে কী যে ভালো লাগে! বাইরে ফুরিয়ে যাচ্ছে একেকটা মনোরম বিকাল। বাড়ির দক্ষিণ দিকটায় হালিম ভাইদের বিশাল জলাভূমি। সারা বছর কচুরি ভর্তি। এমন ঘন কচুরি, পানি দেখাই যায় না। আর পুব-দক্ষিণ কোণে গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশন। বাড়ির পুব দিকে বাঁধানো ঘাটলার একটা পুকুর আছে। পুকুরের পানিটা জসীমউদ্দীনের কবিতার মতো। কাকচক্ষু জল। অর্থাৎ কাক পাখির চোখের মতো স্বচ্ছ পানি।
খালার বাড়ির উত্তর পাশে, রাস্তার ওপারে, পুরনো আমলের, আমাদের এই বাড়ির মতো একতলা একটা দালানবাড়ি। নিশ্চয় মাঝারি সাইজের কোনও হিন্দু টাকাঅলা লোকের বাড়ি ছিল। পুকুরটা তাদেরই। পার্টিশনের সময় হয়তো কোনও মুসলমান কিনে নিয়েছেন পুকুরসহ।
বাড়ির মালিক ভদ্রলোককে আমি চিনি। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। বাড়ির ছেলেমেয়েগুলোকেও চিনি। মেয়েগুলোর নাম ফিরোজা মমতাজ ও কোহিনূর। ছেলেটার নাম রঞ্জু। শুধু ভদ্রলোকের নাম মনে করতে পারছি না।
পুকুরের ওপারে বেশ কিছুটা উঁচু জমি। পুকুরের পাড়। সেখানে ছাপরাঘর তুলে থাকে কয়েকটি পরিবার। জায়গাটা নিশ্চয়ই রেলের খাসজমি। কারণ ওই ছাপরাঘরগুলোর ঠিক পিছনেই বিশ-ত্রিশ হাত চওড়া নালা, তারপর রেললাইন। ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশন থেকে রেল যায় নারায়ণগঞ্জে। যাওয়ার পথে গেণ্ডারিয়া স্টেশন আর পাগলা স্টেশনে থামে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফেরার সময়ও ওভাবেই দুটো স্টেশন ধরে আসে।
ভোররাতের দিকে ঢাকা থেকে যেত একটা ট্রেন। দূর থেকে সেই ট্রেনের হুইসেল ভেসে আসত। ঘুমের ভিতর থেকে সেই শব্দ পাই আমি। মনে হতো স্বপ্নের রেলগাড়ি যায়।
আরেকটা ট্রেন দুপুরের ঠিক পরপর। ওটা আসে নারায়ণগঞ্জ থেকে। নিজের ঘরে বসে মায়া হয়তো তখন গ্রামোফোন বাজাচ্ছে। গ্রামোফোনে বাজছে হেমন্তের গান।
ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলো
এখন কত দূরে
আজ আসে না রাজার কুমার পঙ্খীরাজে উড়ে
কী যে স্নিগ্ধ নির্জন একেকটা দুপুর! কী যে মনোরম একেকটা বিকাল! লিচুগাছগুলো তোলপাড় করছে হাওয়ায়। আমি গিয়ে বসে আছি ফিরোজাদের পুকুরঘাটে। উদাস চোখে তাকিয়ে আছি রেললাইনের দিকে।
কোনও কোনও দিন মালগাড়ি যায় ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে। ইট রঙের বগি। এত বগি একেকটা মালগাড়ির! যাচ্ছে তো যাচ্ছেই, শেষ হয় না। পুকুরঘাটে বসে কিংবা দোতলার রেলিংয়ে বসে আমি মালগাড়ির বগি গুনি। এক দুই তিন...
বগি গোনা আর শেষ হয় না।
কিন্তু সেই চৈত্র মাসের দুপুরবেলা মুসাফির টাইপের লোকটা এসে যে সরাসরি আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায় চলে এলো, লোকটা কে? এভাবে বাড়ির ভিতর এসে ঢুকল কেন? কোন সাহসে ঢুকল!
চৈত্র মাসের দুপুরবেলাটা গুমোট হয়ে আছে।
কোথাও হাওয়া নেই, হাওয়ার চলাচল টের পাওয়া যায় না। হঠাৎ মাঠের দিকে তাকালে দেখা যায় আচমকা উঠছে চৈতালি ঘূর্ণি। একটা জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে হাওয়া। ঘুরে ঘুরে মাঠের ধুলাবালি আর খড়কুটো নিয়ে কোনও একটা দিকে এগোচ্ছে।
আমাদের এলাকায় এই ঘূর্ণিকে বলে 'বানাডুলি'।
ছেলেবেলায় তুমি আমাকে শিখিয়েছিলে, স্কুল থেকে ফেরার সময় বা মাঠের দিকে দুপুরবেলা গেলে, নির্জন মাঠে বানাডুলি দেখলেই যেন বুকে থুতু দিই।
কেন বলেছিলে?
আমার মনে আছে, মা। আমি তোমার কোনও কথাই ভুলিনি। সেই কবে কোন ছেলেবেলায় বানাডুলি দেখলে বুকে থুতু ছিটাতে হবে সে কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে।
আমাদের বাঁশঝাড়ে যে তেনায় থাকতেন, ও রকম তেনারা নাকি কোনও কোনও নির্জন দুপুরে, বিশেষ করে চৈত্র মাসের নির্জন দুপুরে বিল-বাদাড়ে, মাঠঘাটে চরতে বেরোন। চৈত্রের রোদ তাঁদের খুব পছন্দ। রোদ গায়ে মেখে কিছুক্ষণ চলাচল করেন। ওই চলাচলের সময় ঘূর্ণি হাওয়ার রূপ ধারণ করেন। ঘুরতে ঘুরতে একসময় কোথায় মিলিয়ে যান, কেউ জানে না।
ওই সময় তেনাদের সামনে পড়লে বিপদ। ওই হাওয়ার মধ্যে পড়লে বিপদ।
তখনই কিছু হবে না। বাড়ি ফেরার পর জ্বর হবে। সেই জ্বর একমুহূর্তের জন্যও কমবে না। জ্বরে জ্বরে মরতে হবে। মরণ অবধারিত।
তবে বুকে থুতু ছিটালে তেনারা সামনে আসেন না। তেনারা সবচাইতে ঘেন্না করেন মানুষের থুতু। থুতুর বদগন্ধে অন্যদিকে চলে যান। মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা পর্যন্ত করেন না।
বারেকের মাও শিখিয়েছিল একই রকম কথা। বারেককে, আমাকে। নির্জন দুপুরে বাঁশঝাড়তলায় গেলে, মাঠঘাটে গেলে, আচমকা বাঁশঝাড় দুলে উঠতে দেখলে, মাঠঘাটে বানাডুলি দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে যেন বুকে থুতু ছিটাই আমরা।
বারেক কি সেদিন বুকে থুতু ছিটিয়েছিল, মা!
মায়ের মার খেয়ে বাঁশঝাড়তলার দিকে চলে গেল, তারপর যে তেনায় বারেককে বাগে পেয়ে ওদিককার কাদাভর্তি পুকুরের তলায় এমন করে পুঁতে দিলেন, বারেকের লাশও কোনও দিন ভেসে উঠল না!
আহা রে, বারেকটা যে কেন এমন করল! মায়ের মার খেয়ে কেন যে বুকে থুতু ছিটাতে ভুলে গেল! তাহলে তো ওভাবে মরতে হয় না তাকে!
সম্পূর্ণ ছেলেবেলাটা, বারেকের কথা মনে হলেই একথা ভাবতাম আমি। রাতদুপুরে বারেকের মায়ের গুমরে গুমরে কান্না আর বিলাপ শুনে যে রাতে আমার ঘুম ভাঙত, বুকে থুতু ছিটানোর কথা মনে হতো।
আর মনে হতো তোমার কথা। মা, মা গো, তোমার কথা মনে হতো। ওই তো পাশের ঘরেই বকুলকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছ তুমি। তবু মনে হতো। মনে হতো, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বারেকের মায়ের জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও রাতে ঘুমাতে পারতে না। গভীর রাতে উঠানে বারান্দায়, রান্নাঘর গোলাঘরের সামনে বসে, কদমের ঘরের ওদিকটায় বসে আমার জন্য গুমরে গুমরে কাঁদতে। বারেকের মায়ের মতো বিলাপ করতে। রবি রে, আমার রবি। আমারে ছাইড়া তুই কই চইলা গেলি, বাজান? আমার কথা তোর মনে হয় না? আমার লেইগা তোর মায়া লাগে না? মনডা কান্দে না মার লেইগা? মারে ছাইড়া তুই থাকস কেমনে? কে তোরে ডাইকা আইনা ভাত খাওয়ায়! কে তোরে নাওন ধোওনের কথা কয়! কে তোরে ঘুমানের সময় মাথায় হাত বুলাইয়া দেয়! ও রবি, রবি!
এসব ভেবে আমার চোখে পানি আসত, মা। বারান্দা কিংবা উঠানে বসে, রান্নাঘরের সামনে কিংবা গোলাঘরের ওদিকটায় বসে যে রাতদুপুরে বারেকের মা ওভাবে কাঁদত আর বিলাপ করত, এদিকে আমার ঘরে শুয়ে ঘুমভাঙা আমি কোনও কোনও রাতে চোখের জলে ভাসতাম। বারেকের মায়ের জায়গায় তোমাকে ভাবতাম, মা। বারেকের জায়গায় ভাবতাম আমাকে।
দিনে দিনে দিন কেটে গেল। বারেকের কথা ভুলে গেলাম আমরা। দশ বছরের একজন বারেক আমাদের সংসারে ছিল, সে এখন আর নেই।
আমরা তো ভুললামই, বারেকের মাও বোধ হয় ভুলল।
মায়ের মন পুরোপুরি হয়তো ভোলে না। মনের অনেক ভিতরে চাপা পড়ে গেল বারেক। দু-চার মাসে হয়তো একদিন হারিয়ে যাওয়া ছেলেটির কথা সে ভাবত, হয়তো একটু চোখের পানি ফেলত, কিন্তু রাত জেগে সেই গুমরে গুমরে কাঁদা আর বিলাপ করাটা বন্ধ হয়েছিল।
এ সময় চৈত্র মাসের দুপুরে এলো সেই মুসাফির। ধূলিধূসর পা, মাথায় গোল সাদা টুপি, মুখে চাপদাড়ি, মোচ নেই। নাকের তলাটা কামানো। পরনে গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পাঞ্জাবি, তার তলায় লুঙ্গির একটুখানি দেখা যাচ্ছে। কাঁধে রেকসিনের খয়েরি রঙের চটে যাওয়া ব্যাগ। কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে গেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে, রান্নাঘরের ওদিকটায়।
কদিন হলো বাড়িতে এসেছি আমি। কলেজ বন্ধ। বাবা স্কুলে। বকুল সেদিন স্কুলে যায়নি। চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে প্রতিবছরই দু-চার দিন জ্বরে ভুগত বকুল। এই জ্বরটা ওর বাঁধা ছিল।
সেদিনও জ্বর বকুলের।
খানিক আগে বারেকের মা আর পারুল তার মাথায় পানি দিয়েছে। পানি দেওয়া শেষ করে মাথা মুছিয়ে দুধ বার্লি খেতে দিয়েছে। নাকি দুধের সঙ্গে সাগুদানা ভিজিয়ে দিয়েছিল, মনে করতে পারছি না, মা।
জ্বরের সময় একদমই খেতে চাইত না বকুল। তুমি সামনে বসে চামচে করে খাওয়াতে। বকুল শিশুর মতো মাথা দোলাত, কাঁদো কাঁদো মুখে বলত, আর খাব না, মা। আর খাব না। আমার বমি আসছে।
তুমি বুঝিয়ে-শুনিয়ে খাওয়াতে। আরেকটু খা মা, আরেকটু। না খাইলে শরীল দুর্বল হইব। দুধ বার্লি খাইলে, দুধ সাগু খাইলে জ্বর তাড়াতাড়ি কমে। তোর ডাক্তার কাকা বইলা গেছেন।
ডাক্তার কাকা মানে গগন ডাক্তার।
পুরা বাজারে গগন ডাক্তারের ডিসপেনসারি। তাঁর কম্পাউন্ডার হরিপদ। ডাক্তার কাকা দেশগ্রামের খুবই নামকরা ডাক্তার। রোগী দেখতে ভিজিট নিতেন দুই টাকা। আমাদের বাড়ির কাউকে দেখে ভিজিট নিতেন না। বাবার বন্ধু মানুষ। আমাদেরকে নিজের ছেলেমেয়ের মতো দেখতেন। পার্টিশনের পর দেশগ্রামের বেশির ভাগ সচ্ছল হিন্দু পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেছে। ডাক্তার কাকা যাননি। মাঝারি ধরনের অবস্থাপন্ন মানুষ। ইচ্ছা করলেই কলকাতার ওদিকে গিয়ে বাড়িঘর করে ভালোই থাকতে পারতেন। আরামে থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি দেশ ছাড়েননি। বাবাকে বলতেন, যেই মাটিতে জন্মাইছি, এই মাটিতেই মরুম। নিজের মাটি ছাইড়া যামু না রে, মতি।
নিজে তো যানইনি, ছেলেমেয়েদেরও যেতে দেননি। দুই ছেলেই দেশে। একমাত্র মেয়ে প্রতিমার বিয়ে দিয়েছেন শ্রীমঙ্গলে। মেয়ের জামাই সেখানকার চা বাগানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
ডাক্তার কাকা আমাদের বাড়িতে রোগী দেখতে এলেই প্রথমে তোমাকে ডাকতেন।
আচ্ছা, ডাকতেন বলছি কেন? ডাক্তার কাকা তো এখনও বেঁচে আছেন। তাঁর দুই ছেলে ঢাকায় থাকে। বড় ছেলে নবীন ইনস্যুরেন্স কম্পানিতে চাকরি করে। ছোট ছেলে কিশোর ভাইয়ের কাছে থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বকুলের বয়সী হবে।
ডাক্তার কাকা কি গ্রামে আছেন, মা?
তাঁর ছেলেরা নিশ্চয়ই ঢাকায় নেই। নবীন আমার বয়সী। এখনও বিয়ে করেনি। নবীন আর কিশোর দুজনই কি মুক্তিযুদ্ধে গেছে?
হ্যাঁ হ্যাঁ, গেছে তো!
দুজনই মুক্তিযুদ্ধে গেছে। একথা আমি আগেই শুনেছি। ভুলে গিয়েছিলাম কেন!
আমার এখনকার অবস্থাটা কী রকম জানো, মা! এই এক কথা মনে পড়ছে, এই আরেক কথা মনে পড়ছে। বহু আগের কথা চলে আসছে পরে, অনেক পরের কথা চলে আসছে আগে। চিন্তাচেতনা একদম এলোমেলো। পরিষ্কার করে ভাবতে পারছি অনেক কিছুই, আবার অনেক কিছুই পারছি না, মা। মাথার ভিতরে একবার ঢুকছে চাঁদের আলো, চিন্তার জায়গা আলোকিত হচ্ছে, আবার ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকার। সব ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে। আকাশের চাঁদ যেমন হঠাৎ হঠাৎ ঢেকে দেয় গভীর কালো মেঘ, তারপর সরে যায়, সরে যাওয়ার পর যেমন আগের মতো আলোকিত হয় চারদিক, আমার মাথার ভিতরটা সেভাবে একবার আলোকিত হচ্ছে, আবার সেই আলো ঢেকে যাচ্ছে মেঘে।
আমার কি এমন হওয়ার কথা, মা!
একজন যোদ্ধার কি এমন হওয়ার কথা! যোদ্ধা যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকে। নিজের জীবনের মায়া যোদ্ধাকে মানায় না। যোদ্ধা জীবন দেবে হাসিমুখে। যোদ্ধা কোনও মৃত্যু দেখে কষ্ট পাবে না, চিন্তাচেতনা এলোমেলো হবে না তার। যুদ্ধক্ষেত্রে লাশের পর লাশ সে দেখবে নির্বিকার চোখে, নির্বিকার দৃষ্টিতে।
আমি পারছি না কেন, মা!
অথবা পারছি। চোখে পানি আসছে না আমার। যোদ্ধার চোখে পানি মানায় না।
কিন্তু চিন্তাচেতনা এলোমেলো হচ্ছে কেন?
বাড়িতে এসে এ রকম দৃশ্য দেখব ভাবা তো দূরের কথা, কল্পনাও করিনি বলে কি এমন হচ্ছে! আচমকা এক কিশোর আমি কি পড়েছি চৈতালি কোনো ঘূর্ণির মধ্যে!
বড় হয়ে জেনেছি, চৈতালি ঘূর্ণির সঙ্গে তেনাদের কোনও সম্পর্ক নেই। ওটা প্রকৃতির খেলা। ওরকম প্রকৃতির খেলা কি ঢুকে গেছে আমার বুকে আর মাথায়! আমার চিন্তাচেতনা কি ঘুরপাক খাচ্ছে বানাডুলির মতো! ফেলে আসা জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা কি মাঠের ধুলোবালি আর টুকরোটাকরা খড়কুটোর মতো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়! মাথা স্থির করতে পারছি না আমি!
মুসাফির লোকটার কথা বলি মা, মুসাফির লোকটার কথা বলি।
সরাসরি এসে ঢুকেছে আমাদের ভিতরবাড়িতে। বুয়া আর পারুল বকুলের মাথায় পানি দিয়ে যে যার কাজে গেছে। তুমি বকুলকে জ্বরের পথ্য খাইয়ে দিয়েছ। আমি বড় পুকুরে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে গোসল করে এসেছি। কদম স্কুলে গেছে বাবার দুপুরের খাবার নিয়ে।
পুরনো আমলের পিতলের একটা টিফিন ক্যারিয়ারে স্কুল খোলা থাকার দিনগুলোয় দুপুরের মুখে মুখে বাবার খাবার নিয়ে যেত কদম। বাবার খাওয়া হলে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে ফিরে আসত।
কদম তখনও ফেরেনি।
মুসাফির লোকটাকে প্রথমে দেখল পারুল। বুয়ার সঙ্গে রান্নাঘরে ছিল। কী কাজে ওদিককার উঠান পেরিয়ে দালানঘরের বারান্দার দিকে আসছে, দেখে গোলাঘর ছাড়িয়ে ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় এসে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক মুসাফির।
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, কেডা, আপনে কেডা?
মুসাফির কথা বলে না। অপলক চোখে পারুলের দিকে তাকিয়ে আছে।
পারুল বিরক্ত। কথা কন না ক্যাঁ? কে আপনে? চিনা নাই জানা নাই বাড়ির ভিতরে আইসা ঢুকছেন?
মুসাফির তবু কথা বলে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে।
পারুল এবার রাগল। আরে, কোন পদের মানুষ আপনে? কথা কইতে পারেন না? নাকি বোবা! কই থিকা আইছেন? চান কারে?
পারুলের চড়া গলা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়েছে বুয়া। কী হইছে রে পারুল? কার লগে চিল্লাস? কে আইছে বাড়িতে?
বুয়াকে দেখে মুসাফির লোকটা পারুলের দিক থেকে চোখ ফিরিয়েছে তার দিকে। ফিরিয়ে পারুলের দিকে যে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে ছিল, সেভাবেই তাকাল বুয়ার দিকে। তাকিয়েই রইল। চোখ দুটো ছলছল করছে।
এই দৃশ্য আমি দেখতে পেয়েছিলাম আমার রুম থেকে।
গোসল সেরে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরেছি। দেয়ালে ঝোলানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁকই দিয়ে মাথা আঁচড়িয়েছি। খানিক পর খেতে বসব। বাইরে অচেনা এক মুসাফির, তার অদূরে পারুল আর বুয়া। পারুলের কথার কোনও জবাবই দিচ্ছে না মুসাফির। তাকিয়ে ছিল পারুলের দিকে, বুয়াকে দেখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। এখন চোখ ছলছল করছে।
ঘটনা কী?
লোকটা কে?
আমি বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। কিছু একটা বলতে যাব, তার আগেই দেখি মুসাফির লোকটা যেভাবে তাকিয়ে আছে বুয়ার দিকে, বুয়াও সে রকম অপলক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কথা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। মুখটা একটু যেন হাঁ হয়ে আছে।
পারুল একবার মুসাফিরের দিকে তাকায়, একবার বুয়ার দিকে।
বারান্দায় বেরিয়ে দুজন মানুষের এই অবস্থা দেখে আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছি। কথা বলতে পারছি না।
মুসাফির কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাল উঠানে। ছলছল চোখে এগিয়ে গেল বুয়ার কাছে।
বুয়া তখনও কথা বলছে না। আগের মতোই তাকিয়ে আছে মুসাফিরের দিকে। কাছাকাছি আসতেই বিড়বিড় করে বলল, কে? কে রে? বারেক, আমার বারেক!
সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল মুসাফির। হ গো মা, আমি বারেক। আমি তোমার পোলা বারেক।
দুহাতে পাগলের মতো মাকে জড়িয়ে ধরল বারেক। হাউমাউ করে কাঁদতেই লাগল। আমি বারেক, মা। আমি বারেক। তোমার পোলা।
আশ্চর্য ব্যাপার, ছেলে উধাও হয়ে যাওয়ার পর যে মা রাতের পর রাত উঠান বারান্দায় বসে, রান্নাঘর ঢেঁকিঘরের ওদিকটায় বসে, কোনও কোনও দুপুর কিংবা রাতে গোয়ালঘরের ওদিকে গিয়ে কদমের ঘরের ওদিকে গিয়ে অথবা গোলাঘরের সামনে বসে গুমরে গুমরে ছেলের জন্য কাঁদত, বিলাপ করত, সেই মা আজ আশ্চর্য রকমের নির্বিকার। ছেলে জড়িয়ে ধরেছে মাকে, কাঁদছে বুকফাটা কান্না, মা কাঁদছে না। তার চোখে পানি নেই, তার কোনও আবেগ নেই। ছেলেকে সে জড়িয়ে ধরেনি। যেন গাছ কিংবা পাথর হয়ে আছে। বারেক যেন একটা গাছ জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। বারেক যেন মানুষের মতো দেখতে একটা পাথর জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
বাড়িতে ততক্ষণে সাড়া পড়ে গেছে।
মুসাফির লোকটা বারেক জানার পরই দৌড়ে বকুলের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে পারুল। তোমাকে খবর দিয়েছে। ভীষণ উত্তেজিত সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বিরাট কারবার হইয়া গেছে গো, আম্মা। বিরাট কারবার। বুড়ির পোলায় ফিরত আইছে। বারেক, বারেক ফিরত আইছে।
শুনে তুমি হতভম্ব হয়ে গেছ। বারেক ফিরত আইছে!
হ গো আম্মা, হ। রান্ধনঘরের সামনে বুড়িরে প্যাঁচাইয়া ধইরা কানতাছে। আপনে তাড়াতাড়ি আসেন। আইসা দেখেন।
তুমি তো সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেই, জ্বর শরীরে বকুলও এলো তোমার পিছন পিছন। আমরা তিনজন মানুষ বারান্দায়। পারুল গিয়ে দাঁড়িয়েছে উঠানে। রান্নাঘরের সামনে বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারেক। বুয়া আগের মতোই নির্বিকার।
যে শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছিল তার ছেলে জীবিত নেই, বাঁশঝাড়ের তেনায়ই শেষ করেছেন ছেলেকে, সেই মৃত ছেলে এগারো বছর পর ফিরে এসেছে, কিন্তু মা নির্বিকার। এ তো আশ্চর্য ঘটনা!
বারেককে দেখে যতটা না অবাক আমরা, তার চেয়ে অনেক বেশি অবাক বুয়ার কাণ্ড দেখে।
কেন এমন গাছ হয়ে আছে সে!
কেন এমন পাথর হয়ে আছে!
পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতে এ রকম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন একজন মানুষ।
তাঁর নাম মনে করতে পারছি না। পুলিশের লোক। সেই রাতে ডিউটি পড়েছিল পুরান ঢাকার কোতোয়ালি থানায়। সঙ্গে আরো কয়েকজন।
মধ্যরাত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন তিনি সে কথাও আমার মনে নেই। মনে পড়ছে তাঁর থানায় ঢোকার সময় থেকে পরের সময়টার কথা।
থানায় ঢুকেই তিনি দেখতে পান মেঝে চাপ চাপ রক্তে ভিজে আছে। বুলেটের আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝরা হয়েছে দেয়াল। থানাহাজতে বন্দি নেই কেউ, তাঁর সহকর্মীরাও নেই। খাঁ খাঁ নির্জন থানা। শুধু মেঝেতে রক্ত আর রক্ত।
ঘটনা কী ঘটেছে তিনি বুঝে গেলেন। বুঝে প্রথমে দিশাহারা হলেন। বাড়িতে ঢুকে তোমাদেরকে দেখে প্রথমে আমি যেমন দিশাহারা হলাম, ঠিক তেমন। তারপর গেলেন পাথর হয়ে।
ওদিকটায় তখন পাকিস্তানি... ...দের গোলাগুলি থেমে গেছে। ইসলামপুর বাবুবাজার মিটফোর্ডের দিকে চলছে তাণ্ডব।
তিনি থানা থেকে বেরোলেন।
কোতোয়ালি থানার দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা। তিনি নদীর দিকে হাঁটতে লাগলেন। নদীতীরে এসে দেখেন এদিক-ওদিক ছড়ানো-ছিটানো শুধু লাশ আর লাশ। রাস্তার ওপর লাশ, জেটিতে লাশ, পানিতে লাশ।
তিনি মৃতের মতো এদিক-ওদিক তাকান। লাশের সারির ভিতর দিয়ে তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও গেছে জমাট বেঁধে। রক্তের গন্ধে নদীর হাওয়া বদলে গেছে।
এইসব লাশের মধ্যে তিনি দেখেন তাঁর অনেক সহকর্মীর লাশ। পুলিশের পোশাক পরা বহু লাশ ভাসছে নদীতে। সহকর্মী এবং বন্ধু তাহেরের লাশ দেখেন মাথার দিকটা তীরে, পা দুটো নদীতে।
তিনি দৌড়ে যান বন্ধুর লাশ তুলতে।
ততক্ষণে ফরসা হয়ে গেছে চারদিক। ফজরের আজান ভেসে আসছে নবাববাড়ির মসজিদ থেকে। সেই আজানের সুর ম্লান করে দিল এক পাকিস্তানি... ...র কঠিন কণ্ঠ। শুয়োর কা বাচ্চা, তোমকো ভি গুলি করে গা! ভাগো হিয়াসে।
বন্ধুর লাশে হাত লাগাতে পারলেন না তিনি। মুখ ঘুরিয়ে পুব দিকে হাঁটতে লাগলেন। সদরঘাট টার্মিনাল, রূপমহল সিনেমা হলের ওদিক এলেন। এক জায়গায় কয়েকটি শিশুর লাশ দেখতে পেলেন, শরীর ঠিক আছে। শরীরের কোথাও কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই, শুধু মাথা থেঁতলানো। দেখে বোঝা যায় মায়ের কোল থেকে টেনে নিয়ে পা ধরে পাকা রাস্তায় আছড়িয়ে মারা হয়েছে।
টার্মিনালে নারী পুরুষ যুবক বৃদ্ধ কিশোর কিশোরী বহু মানুষের লাশ। তারা রাতের লঞ্চের যাত্রী ছিল। নারীদের লাশের যে অবস্থা তা তোমাকে আমি বলতে পারব না, মা। বহু যুবকের লাশ ছিল, ভাসমান মানুষ, রিকশাঅলা আর ভিখিরির লাশ ছিল। কিছু যুবকের জন্য পাকিস্তানি... ...রা গুলি খরচা করেনি। তাদেরকে হত্যা করেছে বেয়নেট চার্জ করে। শরীর ছিন্নভিন্ন। বুক পেট চিরে ফালা ফালা করা হয়েছে।
এক জায়গায় পড়েছিল দুজন যুবকের লাশ। তাদের পোশাক-আশাক সব ঠিক আছে, শরীর ঠিক আছে, শুধু মাথা চূর্ণবিচূর্ণ। এদেরকে রাস্তায় চেপে ধরে রাইফেলের বাঁট দিয়ে এমনভাবে আঘাতের পর আঘাত করা হয়েছে, বেলের মতো ফেটে চৌচির হয়েছে মাথা। রক্ত মগজ মিলেমিশে জমাট বেঁধে আছে মাথার তলায়।
রূপমহল সিনেমা হলের সামনে ছিল স্তূপ করা লাশ। তারা সবাই সেই রাতে সিনেমা দেখতে এসেছিল। নাইট শো।
লক্ষ্মীবাজার মোড়ে তিনি দেখতে পান কয়েকজন যুুবকের বুক চিরে হৃৎপিণ্ড বের করা হয়েছে। পায়ের গিঁট আর হাতের কবজি ভাঙা।
কোথাও জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই। ভোরবেলার কাকগুলো চরতে নেমেছে। ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে মানুষের লাশ আর ডাকাডাকি করছে। মিউনিসিপ্যালিটির সামনে কয়েকটা ময়লা ফেলার গাড়ি। প্রতিটি গাড়ি ভর্তি মানুষের লাশ। রাস্তায় পড়ে থাকা কিছু লাশ টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তুলছে সুইপাররা। একদল পাকিস্তানি... ...পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সুইপারদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি দেখেন মানুষগুলো মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কাজ করছে। লাশ তোলার কাজ না করলে তাদেরকেও লাশ হতে হবে।
তখনও আগুনে পুড়ছে কোনও কোনও বাড়ি। উঁচু দালানকোঠার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল দূরের জ্বলন্ত বাড়িঘর। আর থেকে থেকে আসছিল গুলির শব্দ।
তখনও পুরোপুরি থামেনি পাকিস্তানি... ...রা।
রায়সাহেব বাজার ব্রিজ পেরিয়ে নবাবপুর রোডে ঢুকলেন তিনি।
এই এলাকায় চলছিল বিহারিদের উৎসব। বীভৎস উল্লাসে মেতে আছে তারা। লাফালাফি, হাসাহাসি করছে দলে দলে বিহারি। প্রত্যেকের হাতে ধারালো অস্ত্র। ছুরি দা বল্লম কুড়াল শাবল রড। কয়েকজন বাঙালিকে ধরে এনেছে ওরা। কারো গায়ে কাপড় নেই, হাত পিছন দিকে বাঁধা। এক বাঙালিকে রাস্তায় চিত করে শুইয়ে তার ওপর কয়েকটি বিহারি দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে। হাত বাঁধা এক বাঙালির পেটে আচমকা ছোরা ঢুকিয়ে দিল এক বিহারি।
পাকিস্তানিদের গাড়ি চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। বিহারিদের বাঙালি নিধন দেখে মহাখুশি তারা। হাত উঁচিয়ে, দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছে।
পুলিশের পোশাক পরা দেখে তাঁর ওপর চড়াও হচ্ছিল না বিহারিরা। তিনি নির্বাক, কলের পুতুলের মতো হেঁটে যাচ্ছিলেন। একটু এগিয়ে দেখতে পান বিহারিরা কয়েকটি বাঙালি শিশুকে বাঁশের চোখা মাথায় গেঁথে টাঙিয়ে রেখেছে রাস্তার ওপর। জীবন্ত অবস্থায় গাঁথা হয়েছিল তাদের। একটি শিশু তখনও বেঁচে আছে।
বিহারিরা সমানে লুটপাট চালাচ্ছিল এলাকার বাঙালি বাড়ি আর দোকানপাটে। লুটপাট শেষ করে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছিল।
ঠাঁটারিবাজার ট্রাফিক সিগন্যালের কাছে এসে তিনি দেখেন আরেক ভয়ংকর দৃশ্য। এক বাঙালি যুবকের পেটে বাঁশ ঢুকিয়ে তার মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। আর এই যুবককে ঘিরে উল্লাসনৃত্য করছে বিহারিরা।
মা, মা গো, তুমি ভাবতে পারো, তুমি ভাবতে পারো এসব। পাকিস্তানি... ...দের দোসর হয়েছে যারা তারাও তো ওদের চেয়ে কম যায় না।
এই দেখো মা, তোমাকে এসব কথা বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে আমার। শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে।
মা, আমরা ওদের একটাকেও ছাড়ব না। বদলা নেব, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বদলা নেব।
ছাব্বিশে মার্চ মিরপুরে বিহারিরা কী করেছিল, শোনো মা। মাথায় লাল কাপড় বেঁধে দলে দলে বাঙালি বাড়িতে ঢুকেছে, প্রথমে লুটপাট, তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে প্রতিটা বাড়িতে। বাড়ির লোকজন সবাইকে ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তায়। রাস্তায় ফেলে গরু জবাই করার ছুরি দিয়ে প্রত্যেককে জবাই করেছে। বাঙালির রক্ত রাস্তা থেকে গড়িয়ে গেছে ড্রেনের দিকে।
মায়েদের কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে শিশুদেরকে। এক বিহারি গরু জবাই করার ছুরি ওপর দিকে খাড়া করেছে, আরেক বিহারি শিশুটিকে ছুড়ে দিয়েছে আকাশের দিকে। সেই শিশু শূন্য থেকে এসে পড়েছে ছুরির ওপর। ছুরিতে গাঁথা শিশুদেরকে তখন ফালা ফালা করে কেটে ফেলা হয়েছে।
মেয়েদের ওপর যে নির্যাতন করেছে পাকিস্তানি... ...গুলো, রাজাকার আলবদর আলশামস শান্তি কমিটির ওইগুলো আর বিহারিরা, সেসব তোমাকে আমি বলতে পারব না। শুধু এইটুকু বলি, মিরপুরে সেদিন বহু বাঙালি মা বোন স্ত্রী কন্যার গায়ে কেরোসিন ঢেলে খোলা রাস্তায় তাদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।
বেঁচে থাকলে এইসব বর্ণনা তোমাকে আমি দিতে পারতাম না, মা। শুনে হয় তুমি অঝোর ধারায় কাঁদতে আর নয়তো ফিট হয়ে যেতে।
মে মাসের ৯ তারিখে ঢাকা থেকে রাজশাহীর দিকে রওনা দেয় পাকিস্তানি... ...রা। যাওয়ার পথে রাস্তার দুপাশের প্রায় প্রতিটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ফজরের নামাজ পড়ছিলেন এক মা। তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। নামাজ শেষ করে কোরআন শরিফ পড়ছিলেন আরেক মা। তাঁকেও ধরে নিয়ে যায়।
এ রকম কত ঘটনা বলব, মা! প্রতিদিনই নির্যাতনের নানা ঘটনা আমাদের কানে আসে। আর আমাদের রক্তে লেগে যায় আগুন।
ও, তোমাকে তো আমাদের গুরুর কথা বলা হয়নি। আমাদের ওস্তাদের কথা। সেই বীর বাঙালির নাম মেজর এ টি এম হায়দার। মার্চ মাসে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ক্যাপ্টেন ছিলেন। পাকিস্তানিদের বিশেষ শিক্ষাপ্রাপ্ত কমান্ডো বাহিনীর সদস্য। আমাদেরকে যখন তিনি ট্রেনিং করাচ্ছেন তখন তিনি মেজর পদে উন্নীত। আমাদের কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফ। বিদ্রোহী চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার।
মেজর হায়দারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। গুরুর একটা হাত তখন ভাঙা। সিলিংয়ে ঝোলানো। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসার সময়, আর নয়তো ইলিয়টগঞ্জ ব্রিজের ডেমুলেশনে হাত ভেঙেছেন, অথবা কোনওভাবে হাতে হয়তো গুলি লেগেছে। শক্ত চেহারা। এই মেজরই হবেন সমগ্র ঢাকা এলাকার কমান্ডিং অফিসার। তাঁর নেতৃত্বে বিভিন্ন সুবেদার হাবিলদার বিভিন্ন অস্ত্রের ট্রেনিং দেওয়াবেন আমাদের।
মেজর হায়দার আমাদের স্যার, আমাদের গুরু, আমাদের চে গুয়েভারা। এ পর্যন্ত বিশ পঁচিশ হাজার গেরিলা যোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়েছেন। এখনও প্রতিদিনই চলছে হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং। কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন আমাদের স্যার। অসম্ভব শক্তিশালী মানুষটি কখনও ক্লান্ত হন না।
গুরু আমাদের বলতেন মাও সেতুংয়ের গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি, চে গুয়েভারার বক্স অ্যাম্বুশ। শত্রু যখন পালাচ্ছে, তখন আক্রমণ করো। শত্রু যখন তোমাকে ধাওয়া করবে, তখন তুমি পালাবে। শত্রু যখন বিশ্রাম করবে, তখন তাকে আক্রমণ করবে, যাতে বিশ্রাম নিতে না পারে।
মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী সময় চেয়েছিল ১২ সপ্তাহ। বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবে ট্রেনিংয়ের সময় কমিয়ে ৬ সপ্তাহ করতে বলে। এই নিয়ে কথাবার্তাও কম হয়নি। পরে ৬ সপ্তাহের ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করতে গিয়ে তাদের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে।
ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে পাঠানোর আগে মেজর হায়দার আমাদের শপথ পাঠ করান। শপথটা শোনো, মা।
'আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার নিজের জীবন উৎসর্গ করিতে প্রস্তুত আছি। আমি আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে- ১. সর্বদা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি, সরকারের প্রতি ও মুক্তিবাহিনীর প্রতি অনুগত থাকিব, ২. আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করিব, ৩. আমাদের শত্রু পাকিস্তানিদের ধ্বংস সাধনে লিপ্ত থাকিব, ৪. কোনও প্রকার লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও অসামাজিক কাজে লিপ্ত হইব না, ৫. কোনও লুটের মাল ছুঁইব না, ৬. নারী ও শিশুদের প্রতি কোনও অশোভন আচরণ করিব না, এবং ৭. মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করিলে কোনও বাঙালিকে হত্যা করিব না এবং হত্যা করিতে সহায়তা করিব না। জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বঙ্গবন্ধু, জয় বঙ্গবন্ধু।'
এই শপথ পাঠের পর আমরা লাইন ধরে একজন একজন করে মেজর হায়দারের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম। মেলাঘর থেকে মতিনগরে পৌঁছলাম। মতিনগরে একজন গাইড ছিল আমাদের। তাঁর সাহায্যে রাতের অন্ধকারে বর্ডার ক্রস করে বাংলাদেশে ঢুকলাম। গন্তব্য ঢাকা শহর।
হজরত আবু হুরায়রা হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ্! আমি সবার আগে কার সঙ্গে সদাচরণ করিব? রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিলেন, তোমার মায়ের সঙ্গে।
লোকটি প্রশ্ন করল, তারপর?
উত্তর এলো, তোমার মা।
লোকটি আবার জানতে চাইল, তারপর কে?
রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইবারও একই জবাব দিলেন, তোমার মা।
ওই লোক চারবারের বার একই প্রশ্ন করল। নবীজী জবাব দিলেন, তোমার পিতা।
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, মায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। মায়ের সঙ্গে কারো তুলনা হয় না।
তোমার মনে আছে মা, সেইসব দিনের কথা মনে আছে!
সন্ধ্যার পরপর আমরা সবাই পিছন দিককার বারান্দায় বসে আছি। বাবা বাড়িতে নেই। বারান্দায় তুমি আমি বকুল বসে আছি চেয়ারে। কদম পারুল আর বুয়া বসে আছে পুব দিককার দেয়ালে হেলান দিয়ে। বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। খানিক আগে মাগরিবের নামাজ পড়েছে বারেক। নামাজ পড়ার পর গোলাঘরের ওদিকটায় তসবি হাতে পায়চারি করেছে, দোয়া দরুদ পড়েছে। তারপর এসে বারান্দায় বসেছে। বসে কোরআন হাদিসের কথা বলতে শুরু করেছে।
বারেক ফিরেছিল একেবারে অন্য মানুষ হয়ে। মুসল্লি হয়ে। অতি বিনয়ী ভঙ্গি। নম্র গভীরভাবে ধার্মিক এক যুবক। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে। অতি সহিহ্ ভঙ্গিতে অজু করে নিজেই আজান দেয়, তারপর ঘরে ঢুকে জায়নামাজ পেতে নামাজ পড়ে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর তসবি হাতে পায়চারি করে আর দোয়া দরুদ পড়ে। শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে চলে যায় মসজিদে।
বারেক আসার পর বাড়ির পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে গেল।
সে থাকে কদমের ঘরে। ওই ঘরে দুটো চৌকি পাতা। একটায় কদম ঘুমায়, আরেকটা খালি পড়ে থাকে। পুরনো কাঁথা বালিশ ডাঁই করে রাখা। সেই চৌকি এত সুন্দর করে পরিষ্কার করল বারেক! পুরনো ছেঁড়া কাঁথা বিছানো অতি দীন ধরনের বিছানা। বালিশ তেল চিটচিটে, বিক্রমপুরের ভাষায় 'ল্যাড়ল্যাড়া'। ওই কাঁথা বালিশেই বারেকের বিছানাটা আশ্চর্য এক পবিত্রতায় ভরে গেল।
মা, তুমি অবশ্য বারেককে পুরনো ধোয়া একটা চাদর দিয়েছিলে। চাদরটা বেশ বড়। চৌকির চারদিক দিয়ে ঝুলে পড়ত। সেই চাদরে এমনভাবে নিজের কাঁথা বালিশ বারেক ঢেকে রাখত, ছিমছাম পবিত্র একটা ভাব ফুটে থাকত বারেকের বিছানায়।
এক দুপুরে আমি বারেকের ঘরে উঁকি দিয়েছিলাম।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে কদম তার বিছানায় নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার পাশেই নিজের বিছানায় আসনপিঁড়ি করে বসে বারেক খবরের কাগজ দিয়ে অতিযত্নে মলাট দেওয়া নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা শখানেক পৃষ্ঠার কী একটা বই পড়ছে। এত মনোযোগ দিয়ে পড়ছে, পাশের বিছানায় শুয়ে, ভালো রকম শব্দ করে একজন মানুষ নাক ডাকাচ্ছে, আর একজন মানুষ আমি, খোলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়েছি, বারেক কিছু টেরই পাচ্ছে না।
আশ্চর্য ব্যাপার!
পড়ার জন্য মায়ের মার খেয়ে যে ছেলে মাত্র দশ বছর বয়সে উধাও হয়ে গিয়েছিল, এগারো বছর পর সেই ছেলেই পড়ার প্রতি এমন মনোযোগী হয়ে কোত্থেকে ফিরল?
কে তাকে এমন করে বদলে দিল?
কারা তাকে এমন করে বদলে দিল?
এই এতগুলো দিন কোথায় ছিল বারেক?
খানিক বারেককে দেখে মৃদু শব্দে গলা খাঁকারি দিলাম। আচমকা শব্দে মানুষ সাধারণত একটু হলেও চমকায়। বারেক চমকাল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখ তুলে তাকাল। হাসিমুখে সালাম দিল। আসসালামু আলাইকুম।
এই আরেক স্বভাব নিয়ে ফিরেছে বারেক। দিনে যতবার যার সঙ্গে দেখা হয় তাকে ততবারই সালাম দেয়। বাবাকে তোমাকে আমাকে আর বকুলকে তো দিচ্ছেই, কদম পারুল বুয়াকেও দিচ্ছে।
বারেকের সালামের চোটে আমরা একটু অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। পারুল একদিন ধমকই দিল। এই ছেমড়া, এতবার সেলামালাইকুম দেওনের কাম কী? একবার দিলেই তো হয়?
বারেক হাসিমুখে নম্র গলায় বলল, আসসালামু আলাইকুম অর্থ হইতেছে আপনার ওপর বা তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। দিনে যতবার সালাম দেওয়া যায়, ততবারই আল্লাহপাক তোমার ওপর শান্তি বর্ষণ করবেন। তুমি যতবার সালামের জবাব দিবা ততবারই যেই মানুষটা তোমারে সালাম দিতাছেন তার ওপর আল্লাহপাক শান্তি বর্ষণ করবেন।
সেই দুপুরে বারেকের সালামের জবাব দিয়ে আমি ঘরে ঢুকলাম। কী পড়ছিস, বারেক?
কিতাব। বুখারি শরিফের ছোট একটা অংশ।
বারেকের পরনে সাদা লম্বা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি। মাথায় সাদা টুপি। নিয়মিতই আতর ব্যবহার করে। শরীর থেকে আসছিল আতরের পবিত্র গন্ধ।
বলল, বসেন মামা, বসেন। বুখারি শরিফে এই মাত্র যা পড়লাম, বলি আপনারে।
আমি বারেকের বিছানায় বসলাম। বারেক আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, একবার এক ব্যক্তি রাসুলে করিমের কাছে এলো। আইসা বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি জিহাদে যাওয়ার জন্য আপনার অনুমতি প্রার্থনা করতেছি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার কি মা-বাবা জীবিত আছেন?
লোকটি জবাব দিল, জি হুজুর, জীবিত আছেন।
রাসুলুল্লাহ বললেন, তুমি তোমার মা-বাবার সেবাযত্নে নিজেকে নিয়োজিত করো।
তার পরই দেখি বারেকের দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে। গাল ভিজে যাচ্ছে। হঠাৎ সে কাঁদছে কেন?
আমি কথা বলার আগেই বারেক কান্নাকাতর, ধরা গলায় বলল, আমার বাবায় ডাকাইত আছিল। জানি না সে জীবিত আছে, না আল্লাহপাক তারে তুইলা নিছে। ডাকাইত স্বামীর সংসার করে নাই আমার মায়। আমারে বুকে লইয়া সংসার ছাইড়া আইছিল। আমারে ডাকাইত বানাইতে চায় নাই, লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষের মতন মানুষ বানাইতে চাইছিল। আমার রক্ত হইল ডাকাইতের রক্ত মামা। আমার লেখাপড়া ভাল্লাগে না। দশ বচ্ছর বয়সেই আমার মনডা উড়ু উড়ু। ঘরবাড়িতে আমার থাকতে ইচ্ছা করে না। বই লইয়া বইতে ইচ্ছা করে না। ইসকুল আমার কাছে জেলখানা মনে হয়। এই জইন্য মায়ের হাতে মাইর খাইয়া আমি চইলা গেছিলাম। এই বাড়ি ছাইড়া, আপনেগো ছাইড়া আর আমার মারে ছাইড়া চইলা গেছিলাম। অবশ্য চইলা গিয়া আমার ভালো হইছে। আল্লাহপাক আমারে পথ দেখাইছেন। মা কী, আমি বুঝতে শিখছি মামা!
তুই গিয়েছিলি কোথায়? এত দিন কোথায় ছিলি? লেখাপড়া শিখলি কোথায়? এরকমভাবে নিজেকে বদলে ফেললি কেমন করে?
বারেক দুহাতে চোখ মুছল। বলব মামা, বলব। সব আপনাদের বলব। তয় মামা, আমার মারে এগারোটা বচ্ছর আমি যেই দুঃখ দিছি, জানি না আল্লাহপাক আমারে দয়া করবেন কি না। আমার এই গুনাহ তিনি মাফ করবেন কি না! তবে মামা, আমার মায় যুদি আমারে মাফ করে তয় আল্লাহপাকও আমারে মাফ করবেন। এই জইন্য আমি ফিরত আইছি। মার পাও ধইরা পইড়া থাকি, মা, মা গো, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। তুমি মাফ না করলে আল্লায়ও আমারে মাফ করবেন না। তোমার লগে আমি যা করছি এই গুনাহর জইন্য দোজকের আগুনে পুইড়া মরতে হইব আমার। কিন্তু মামা, মায় আমারে মাফ করে না। মার পাও ধইরা এত কান্দি আমি, মায় আমারে মাফ করে না!
বারেক আবার কাঁদতে লাগল।
আমাদের কথাবার্তার কোন ফাঁকে যে কদমের ঘুম ভেঙে গেছে, বারেক, আমি কেউ তা খেয়াল করিনি। আনমনা চোখে কদমের বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখি কদম তার বিছানায় উঠে বসেছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে বারেকের দিকে।
কিন্তু বুয়া এত কঠিন হয়ে গিয়েছিল কেমন করে, মা?
আমরা সবাই দেখছি, বাড়ির সবাই দেখছে, সুযোগ পেলেই বারেক তার মায়ের পা জড়িয়ে ধরছে, অনুনয়-বিনয় করছে, কাঁদছে, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও। বুয়া তার কথা পাত্তাই দেয় না। তার যেন কোনও অনুভূতিই নেই। সে যেন পাথর, সে যেন মানুষের মতো দেখতে একটা গাছ!
সেই সন্ধ্যায় বারান্দায় হারিকেন ছিল না।
আমাদের প্রতিটি ঘরের দরজা খোলা। প্রতিটি ঘরেই জ্বলছে হারিকেন। কদম বারেকের ঘরেও জ্বলছে। বাইরে, বাগানের দিকে, বাঁশঝাড়ের ওদিকটায়, সর্বত্র ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝিঁঝি ডাকছে, দু-একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছে, উড়ে আসছে। গোয়ালঘরের ওদিকটায় লেজ ঝাপটে মশা তাড়াচ্ছে গরুগুলো। আমরা বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছি।
বারেক বসে আছে বুয়ার পায়ের কাছে। এক হাতে মায়ের পায়ে কখনও হাত বোলাচ্ছে, কখনও পা টিপে দিচ্ছে।
বুয়া নির্বিকার।
সে বারেকের দিকে তাকায়ই না। আমি দু-একবার বুয়ার মুখের দিকে তাকালাম। বিভিন্ন ঘর থেকে বারান্দায় এসে পড়েছে হারিকেনের আলো। আমাদের পায়ের কাছে, হাতের কাছে, শরীরের কোথাও কোথাও পড়েছে আলো। যারা নিচে বসে আছে তাদের মুখে, চোখে পড়েছে, মাথায় পড়েছে।
বুয়ার মুখে পড়েছিল হারিকেনের আলো। তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না তার চোখ। তবে সে যে বারেকের দিকে তাকিয়ে নেই এটা বোঝা যাচ্ছিল। বারেক ফিরে আসার দিন থেকেই প্রথমবার বারেকের মুখের দিকে সে তাকিয়ে ছিল, ছেলেকে চিনেছিল, বিড়বিড় করে তার নাম উচ্চারণ করেছিল, তারপর...
কিন্তু বারেক যে মায়ের পা ধরছে, পা টিপে দিচ্ছে, বুয়া পা সরিয়েও নিচ্ছে না। যেন ছেলের স্পর্শ সে টেরই পাচ্ছে না। আর ছেলের সঙ্গে কথা সে বলেই না। ছেলে এত যে মা মা করছে, নানা রকমভাবে মাফ চাইছে, বুয়া নির্বিকার। যেন আপন ছেলেকে সে চেনেই না।
বারেক একবার বুয়ার দিকে তাকাল। বারেকের গলা পর্যন্ত হারিকেনের আলো, তার ওপর থেকে আবছা অন্ধকার। আমাদের বারান্দায় আলো-আঁধারির খেলা।
বারেক বলল, সাহাবি আলকামা মারা যাইতেছেন। এই সময় তাঁর জবান থেকে কালেমা বাইর হইতেছে না। খবর পাইয়া নবীজি আসলেন। আলকামার অবস্থা দেইখা তাঁর মারে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি আলকামার ওপর নারাজ?
আলকামার মা উত্তর করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার ছেলে আমার চেয়ে তার স্ত্রীকে বেশি গুরুত্ব দিত। এই কারণে আমি তার প্রতি নারাজ!
তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্যকে হুকুম দিলেন, আলকামাকে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার কইরা দাও।
আলকামার মা এই কথা শুইনা গগনবিদারী চিৎকার দিয়া বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার চোখের সামনে আমার সন্তানরে আগুনে জ্বালাইয়া পোড়াইয়া ছারখার করলে, আমি মা হইয়া কেমন কইরা তা সহ্য করব?
নবী করিম তখন আলকামার মাকে অনুরোধ করলেন, তাহলে আপনার সন্তানরে মাফ কইরা দেন। তা না হইলে অনন্তকাল ধইরা আপনার আলকামা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। তা আপনি কেমন কইরা সহ্য করবেন?
এই কথা শুইনা মায়ের মন বিগলিত হইল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরে ক্ষমা কইরা দিলেন।
বারেক একটু থামল।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি বারেকের কথায়। এত সুন্দর করে গুছিয়ে সে মছলা-মাছায়েল বলে, শুনতে শুনতে ঘোর লেগে যায়। ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই বারেক! সেই দুরন্ত, দুষ্টের শিরোমণি বারেক! যে তার মায়ের মুখের ওপর দশ বছর বয়সেই বলত, আমি লেখাপড়া করুম না, আমি ডাকাইত হমু।
এই সেই বারেক!
বারেক থামার সঙ্গে সঙ্গে পারুল বলল, তারপর?
বারেক বলল, তারপর আলকামার জবান থেকে কালেমা তাইয়্যেবা জারি হইয়া গেল। কালেমা পড়তে পড়তে ইমানের সঙ্গে তিনি মৃত্যুবরণ করলেন!
বারেক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
পারুল বলল, নবীজির কথা আরো ক বারেক। শুনি।
আচ্ছা মা, বাবা সেই সন্ধ্যায় কোথায় ছিলেন?
আমি মনে করতে পারছি না, আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না!
বাবা কি বাড়িতে ছিলেন?
নাকি স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়েছিলেন?
নাকি গ্রামের কোনও বিচার সালিসে গিয়েছিলেন?
বিচার সালিসে গেলে কদম যায় বাবার সঙ্গে। রাতবিরাতে কদমকে ছাড়া চলাফেরা করেন না বাবা। অন্ধকার রাতে হারিকেন হাতে কদম হাঁটে আগে আগে, বাবা হাঁটেন পিছন পিছন।
কদম সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে! এটা আমার পরিষ্কার মনে পড়ছে। সেও বারান্দায় বসে বারেকের কথা শুনছে।
তাহলে বাবা কোথায়?
মা, বাবা কোথায়?
স্কুলের কাজে ঢাকায়?
আমি বড় হয়ে গেছি, ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, সেই ছেলেবেলার মতো বাবার জন্য কান্নাকাটি করি না। বাবা বাড়িতে না থাকলে ছটফট করি না। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অনুভূতিগুলো বদলাতে শুরু করেছিল।
এটাই মানুষের নিয়ম। প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে মানুষকে বদলে দেয়। বদলটা হয় এত ধীরে, মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
বকুলের কিশোরী বয়সে বাবা একদিন তোমাকে বলছিলেন, মেয়ের বাবা হওয়ার দুঃখ কী জানো?
কোনও কোনও রাতে বাবার মাথায় তিব্বতের কদুর তেল দিয়ে দিতে তুমি। সারা দিন স্কুলের কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে বাবার মাথাটা গরম হয়ে যেত। রাতে ভালো ঘুম হতো না। কদুর তেল বাবা ঢাকা থেকে নিয়ে আসতেন। রাতের বেলা ওই তেল মাথায় দিলে মাথা ঠাণ্ডা হয়, ঘুম ভালো হয়।
বাবা তাঁর ঘরে চেয়ারে বসে আছেন, পিছন থেকে তুমি তাঁর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছ। মাথার চুল এলোমেলো করে অতিযত্নে মাথা টিপে দিচ্ছ।
এই অবস্থায় কথাটা বললেন বাবা।
শুনে তুমি বললে, কী?
মেয়ে বড় হয়ে উঠলে তাকে আর কোলে নেওয়া যায় না।
তুমি হাসলে। এইটা খালি মেয়ের বেলায়ই না, ছেলের বেলায়ও। আমি কি রবিরে এখন কোলে নিতে পারি?
তা ঠিক। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে নিজেদের অজান্তেই মা-বাবার সঙ্গে তাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সম্পর্কের মাঝখানে আবছা একটা আড়াল তৈরি হয়।
আমি বারান্দার দিকে যাচ্ছিলাম। তোমরা ছেলেমেয়ে নিয়ে কথা বলছিলে শুনে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে শুনলাম ওই কথা। শুনে মন খুব খারাপ হয়েছিল, মা। খুব খারাপ হয়েছিল।
সত্যি তো, যত বড় হচ্ছি ততই দূরে সরে যাচ্ছি তোমাদের কাছ থেকে। যে ছেলে বাবার জন্য ছটফট করত সারাক্ষণ, বাবা ঢাকায় গেলে বারবার তোমাকে বলত, বাবা কবে আসবে, বাবা কখন আসবে! যেদিন বাবার আসার কথা সেদিন সকাল থেকে বাবার জন্য অপেক্ষা। বাবা আসবেন বিকালে, সেই বিকাল যেন হতেই চায় না। সেদিন যেন দিনটা হয়ে যায় অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। সকাল যেন দুপুরই হয় না, দুপুর যেন বিকালই হয় না!
সেই ছটফটে ছেলে এখন বাবাকে ছেড়ে ঢাকায় থাকে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। মা-বাবাকে চিঠি লেখে তাও মাসে একটা দুটো। অতি ধীরে কেমন এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
এগারো বছর পর বারেক ফিরে আসাতে কি তেমন এক দূরত্ব বারেকের সঙ্গে তৈরি হয়েছিল বুয়ার?
না, বারেকের ব্যাপারটাই অন্য রকম!
দিনে দিনে বুয়া জেনেছিল তার ছেলে বেঁচে নেই। সে মারা গেছে। বাঁশঝাড়ের তেনায়ই বারেককে মেরেছেন। সে আর কোনও দিন ফিরবে না। এ কারণে সে ফিরে আসার পর বুয়া প্রথমে হতভম্ব, হতবাক। তারপর তার ভিতর জন্ম নিল অভিমান। গভীর অভিমান। বেঁচে থাকার পরও মায়ের কাছে বারেক ফেরেনি কেন? এগারো বছর কেটে গেছে। এই এতগুলো দিন, এতগুলো বছর সে কোথায় ছিল? কার কাছে ছিল?
মা গো, আমি যুদ্ধ করব তোমার জন্য।
তোমার বুক থেকে যারা রক্ত ঝরিয়েছে, আমার বুক থেকে যারা কেড়ে নিয়েছে আমার মাকে, আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব। তাদের সম্পূর্ণ ধ্বংস না করে দেওয়া পর্যন্ত, তাদের বুক থেকে রক্ত না ঝরানো পর্যন্ত, জন্তুগুলোর প্রতিটিকে শেষ না করা পর্যন্ত আমি যুদ্ধ করব। আমার হাত থেকে ওদের নিস্তার নেই, মুক্তি নেই।
মা গো, আমি যুদ্ধ করব আমার বাবার জন্য।
আমার বাবাকে যারা শেষ করেছে, বাবার বুকের রক্তে যারা ভাসিয়েছে উঠানের মাটি, তাদের রক্ত কাক কুকুরকে না খাইয়ে আমি থামব না। আমি যুদ্ধ করব, আমি ওদেরকে শেষ করে দেব মা, ওদেরকে একদম শেষ করে দেব।
আমি যুদ্ধ করব আমার বোনের জন্য। আমার বকুল ফুলটির জন্য। 'কই গো কই গো কই, আমার বকুল ফুল কই!'
মা গো, আমি আমার বকুল ফুলকে খুঁজি, মা। আমার বোনটিকে খুঁজি। যে বকুল ফুল তার মা-বাবার বুক জুড়ে ছিল, ভাইয়ের বুক জুড়ে ছিল, ভাই যুদ্ধে চলে গেল আর বোন রয়ে গেল মা-বাবার বুকে, ফিরে এসে দেখি, মা গো, ফিরে এসে দেখি কোথায় আমার সেই বকুল ফুল! কোথায় আমার বোনটি! তার ঘরে পড়ে আছে এক ছিন্নভিন্ন বকুল। যেন মাত্র ফুটে ওঠা এক বকুল ফুল পায়ে দলে অথবা দু আঙুলের ডগায় ধরে অবিরাম পিষেছে কোনও জন্তু। আমার বোন আর মানুষের চেহারায় নেই। আমার বকুল আর বকুল নেই।
আমি আমার বকুলের জন্য যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য। আমার মায়ার জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার অনাগত সন্তানের জন্য। ছেলে ছিল মা, আমার সন্তান ছেলে ছিল। আমি আমার ছেলের জন্য যুদ্ধ করব। পিতা যুদ্ধ করবে পুত্রের জন্য।
আমি যুদ্ধ করব বুয়া পারুল আর কদমের জন্য। আমি যুদ্ধ করব বারেকের জন্য। আমি যুদ্ধ করব দেশের সাত কোটি বাঙালির জন্য।
আমি যুদ্ধ করব আমাদের গোয়ালের গরুগুলোর জন্য, বাড়ির হাঁস মুরগিগুলোর জন্য, ছাগলছানা দুটো, বল্টু কুকুরটা, মিনি বিড়ালটা আর খোপভর্তি পায়রাগুলোর জন্য। আমি যুদ্ধ করব বাগানের গাছপালার জন্য, বর্ষার পানি আর পানির তলার মাছের জন্য। বাঁশঝাড়গুলোর জন্য আমি যুদ্ধ করব, আমি যুদ্ধ করব বাঁশঝাড়ের তেনার জন্য। তেনায় থাকুন তাঁর মতো, তাঁকে রক্ষা করার জন্য আমি যুদ্ধ করব, মা।
আমি যুদ্ধ করব বাগানের পাখি, প্রজাপতি আর ফড়িংয়ের জন্য, মাছি আর মশাগুলোর জন্য। ঝিঁঝিপোকা আর ইঁদুর ব্যাঙের জন্য। আমি যুদ্ধ করব মাথার ওপরকার আকাশ, বয়ে যাওয়া হাওয়া আর বৃষ্টির জন্য। আমি যুদ্ধ করব আমার নিজস্ব রৌদ্রটুকুর জন্য। আমার ছয়টি ঋতু, মানুষের ঘরবাড়ি আর ফসলের মাঠ, আমার নদী আর বিল-বাঁওড়, আমার নিজস্ব পায়ে চলা পথটুকুর জন্য আমি যুদ্ধ করব।
আমি যুদ্ধ করব দেশের প্রতিটি ঘাসের জন্য। সবুজ ঘাসের ডগায় লাল একটুখানি ফুলের জন্য। ফুলের সুবাস আর আকাশের চাঁদের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমার বাউল ফকির আর ভাটিয়ালি গানের জন্য আমি যুদ্ধ করব। আমি যুদ্ধ করব আমার স্বাধীনতার জন্য, আমার দেশের মাটির জন্য। 'ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা'। আমি যুদ্ধ করব আমার কবরের জমিটুকুর জন্য, আমার সাড়ে তিন হাত ভূমির জন্য।
আমার কী হয়েছে, মা!
কী হয়েছে আমার!
এই যে তোমার কবর খুঁড়ছি আমি, তোমার মাথা মুখ আর শরীর ভরে আছে চাঁদের আলোয়, তোমার গা থেকে জমাটবাঁধা রক্তের গন্ধও পাচ্ছি, সকাল থেকে রাত, তোমাদের লাশ পড়ে আছে বাড়িতে, শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি নেই, আকাশে চাঁদ, গরম তেমন নেই, আবার আছেও, তার পরও শরীরে এখনো পচন ধরেনি কারো।
নাকি ধরেছে, মা!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। বোধশূন্য মানুষ কি বুঝতে পারে এসব!
সোহাগপুরের কথা শুনবে, মা?
সোহাগপুর হচ্ছে শেরপুরের নালিতাবাড়ী এলাকায়। সোহাগপুর গ্রামের একটি পাড়ার নাম বেণুপাড়া। এই কদিন আগে, জুলাই মাসের ২৫ তারিখ, পাকিস্তানি... ...গুলো আর ওদের এদেশীয় ওইগুলো নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালাল বেণুপাড়ায়। বেণুপাড়ার প্রতিটি পুরুষ মানুষকে মেরে ফেলল। মোট ১৮৭ জন পুরুষ, মা। ১৮৭ জন পুরুষ। বেণুপাড়া পুরুষশূন্য হয়ে গেল। বেণুপাড়া বিধবা পল্লী হয়ে গেল।
আর নারীদের ওপর যে অত্যাচার হলো না, মা, তোমাকে সে কথা আমি বলতে পারব না। তোমাকে বলি চুকনগরের কথা।
চুকনগর কোথায়?
চুকনগর হচ্ছে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া থানায়। খুলনা, যশোর আর সাতক্ষীরার মিলনস্থল। চুকনগর বাজারের ভিতর দিয়ে যশোর সাতক্ষীরার মহাসড়ক এবং খুলনা সড়ক। বাজারের উত্তর পাশে ভদ্রা নদী। খুবই খরস্রোতা নদী।
মে মাসের ২০ তারিখ।
চুকনগরে এসে আশ্রয় নিয়েছে পিরোজপুর বাগেরহাট গোপালগঞ্জ আর খুলনার বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার হিন্দু পরিবার। পাকিস্তানি... ...গুলোর হাত থেকে বাঁচার আশায়, ওদের দোসর... ...গুলোর হাত থেকে বাঁচার আশায় চুকনগরে এসেছে তারা। বাজারের ভিতর দিয়ে ভারতে চলে যাবে। বাজারে জড়ো হয়েছে অসহায় হাজার হাজার মানুষ।
এই খবর রাজাকাররা পৌঁছে দিল ওদের প্রভুদের কাছে।
আর কথা কী?
বাজারের দুদিক থেকে পাকিস্তানি... ...গুলোর দুটো গাড়ি ঢুকল চুকনগর বাজারে। ঢুকেই শুরু করল গুলি।
তখন সকাল এগারোটা।
এগারোটা থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত চার ঘণ্টা মুষলধারায় গুলি চালাল ওরা। তিনটার পর যখন বাজার ছেড়ে চলে গেল তখন চুকনগর বাজার এক মৃত্যুপুরী। চারদিকে শুধু লাশ শুধু লাশ। মানুষের রক্ত বয়ে যাচ্ছে ভদ্রার খরস্রোতা পানির মতো।
মা গো, এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখে সেদিন স্থির হয়েছিল নদীর বয়ে যাওয়া পানি, মাথার ওপরকার আকাশ, আকাশের সূর্য আর ভেসে যাওয়া মেঘমালা। এই হত্যাকাণ্ড দেখে বইতে ভুলে গিয়েছিল বাংলার হাওয়া, গাছপালা হয়েছিল মৃতের মতো স্থির। নিজের অজান্তে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বাংলার মাটি। শ্বাস ফেলতে ভুলে গিয়েছিল পানির তলার মাছ, আকাশে উড়তে ভুলে গিয়েছিল সোনালি ডানার চিল, ডাকতে ভুলে গিয়েছিল পাখিরা।
মাত্র চার ঘণ্টায় কত মানুষ মারল ওরা জানো, মা?
বিশ হাজারের বেশি, মা। বিশ হাজারের বেশি মানুষ।
চুকনগর গণহত্যার কথা ভাবলেই আমার মনে পড়ে পাবলো নেরুদার সেই বিখ্যাত কবিতার কথা। কবিতার নাম 'ধর্ষিতা দেশ'।
'এই ভয়ংকর রক্তাক্ত ক্ষত কিছুতেই শুকোবার নয়
জয়লাভেও না
কিছুতে না সমুদ্র সিঞ্চনে না
সময়ের সিক্ত সৈকত অতিক্রম করে এলেও না
কবরের মাটিতে জ্বলন্ত জেরেনিয়াম ফুটলেও না'
পৃথিবীর কোনও দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে মাত্র চার ঘণ্টায় বিশ হাজারের বেশি মানুষ এক জায়গায় এভাবে হত্যা করার ইতিহাস নেই, মা। এত বড় গণহত্যার নজির নেই।
গণহত্যা শেষ করে যখন ওরা চলে যায় তখন চুকনগর বাজারে ছুটে আসে এলাকার বেঁচে যাওয়া মানুষজন। লাশের পর লাশ, লাশের পর লাশ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায় তারা। কাঁদতে থাকেন কেউ কেউ, কাঁদতে ভুলে যান কেউ কেউ।
চুকনগরের পাশের গ্রাম মালিথা। সেই গ্রামের দরিদ্র কৃষক এরশাদ। তিনিও ছুটে এসেছিলেন চুকনগর বাজারে। লাশের স্তূপ দেখে বাকরুদ্ধ মানুষটি বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখতে পান এক মৃত মায়ের বুকের দুধ পান করে চলেছে তাঁর কোলের অবুঝ শিশুকন্যা। মায়ের শরীরের তলায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ওই অবুঝ শিশু এসবের কী বোঝে! সে পান করছে মায়ের দুধ। মৃত মায়ের হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর।
অতি দরিদ্র কৃষক এরশাদ পরম মমতায় কোলে নিলেন সেই শিশুকে। যেন নিজের সন্তানকে কোলে নিয়েছেন তিনি, বুকে নিয়েছেন।
বাড়ি এসে স্ত্রীর কোলে দিলেন শিশুটিকে। চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে ঘটনা বললেন। তাঁর মতোই গভীর মমতায় শিশুকন্যাটিকে বুকে নিলেন এরশাদের স্ত্রী। সেই মুহূর্তে তিনি হয়ে গেলেন শিশুটির মা।
আমাদের মুন্সীগঞ্জে কবে এলো পাকিস্তানি... ...রা জানো, মা?
মে মাসের ৮ তারিখে। এসে উঠল হরগঙ্গা কলেজ হোস্টেলে। ওখানেই ক্যাম্প করল। মুন্সীগঞ্জে ঢুকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, বঙ্গবন্ধুর প্রধান দেহরক্ষী মহিউদ্দিন আহমদ এবং কারো কারো বাড়িতে আগুন দেয়। ছোট্ট শহর মুন্সীগঞ্জ কাঁপতে লাগল পাকিস্তানি... ...গুলোর নৃশংসতায়। প্রতিদিনই শহরের ছাত্র যুবকদের ধরে আনত ক্যাম্পে। অমানুষিক নির্যাতন চালাত। কেওয়ার চৌধুরীবাড়ি ঘেরাও করে দশ-বারোজন যুবক বৃদ্ধ কিশোর ধরে এনে লোহারপুলের খালের ওখানটায় সার ধরে দাঁড় করায়। তারপর গুলি। লাশ পড়ে গেল খালের পানিতে।
এসব মানুষের অপরাধ কী, মা?
এরা দেশ ভালোবাসে!
এরা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়?
মাতৃভূমিকে ভালোবাসা ইমানি দায়িত্ব, মা! প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব তার দেশকে ভালোবাসা। মাতৃভূমির মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ধর্মপ্রাণ মানুুষের বড় ধর্ম। মানুষ তার পরিবার-পরিজন আর দেশকে জন্মগতভাবেই ভালোবাসে। মা মাতৃভাষা মাতৃভূমি এই তিনটি জিনিস মানুষের কাছে অনেক সময় নিজের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। মহামূল্য সম্পদ। মাতৃভূমি কিংবা জন্মস্থানের প্রতি মানুষের থাকে প্রবল আবেগ, আকর্ষণ, প্রবল ভালোবাসা আর মমত্ববোধ। ইসলামের দৃষ্টিতে দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত করতে হলে স্বদেশপ্রেম শুধু আবশ্যক না, অত্যাবশ্যক।
মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 'প্রত্যেক মানুষের উচিত দেশকে ভালোবাসা। যে লোক তার দেশকে ভালোবাসে না সে প্রকৃত ইমানদার না।'
দেশের জন্য ভালোবাসা না থাকলে, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা, মায়া-মমতা না থাকলে সেই মানুষ দেশের জন্য কোনও কিছু ত্যাগ করতে পারে না। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে না পারলে মান সম্মান, স্বাধিকার ও ইমান আমল রক্ষা করা যায় না। দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ইমান ও আমল ভিত্তিকই হতে হবে। ইমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে।
একটি আরবি প্রবাদ আছে, 'হুব্বুল ওয়াতানি মিনাল ইমান।' অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।
মহানবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। মক্কার কাফেরদের নির্মম নির্যাতন চলছিল তাঁর ওপর। নির্মম অত্যাচারের পর নিজের জাতিই তাঁকে মক্কা থেকে বিতাড়িত করেছিল। তিনি তাঁর জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। যখন তিনি মক্কা ত্যাগ করেছিলেন সেই মুহূর্তে বারবার ফিরে তাকাচ্ছিলেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমি মক্কার দিকে। কাতর কণ্ঠে আফসোস করে বলেছিলেন, 'হে আমার স্বদেশ! তুমি কতই না সুন্দর! আমি তোমাকে কতই না ভালোবাসি! আমার আপন গোত্রের লোকেরা যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।'
নিজের দেশকে হেফাজত করতে না পারলে ধর্মকে হেফাজত করা যায় না, দেশের মানুষকে রক্ষা করা যায় না, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা যায় না। দেশপ্রেম জাহান্নাম থেকে মুক্তির উপায়।
এসব কথা বলেছিল বারেক।
আমি প্রায়ই দুপুরের দিকে কদম বারেকের ঘরে যাই। কদম নাক ডাকিয়ে ঘুমায় আর বারেক বিভিন্ন কিতাবে পড়া নানা বিষয় নিয়ে কথা বলে। এক দুপুরে বলল এসব কথা।
আমি তখন বারেককে খুবই পছন্দ করতে শুরু করেছি। কী বারেক, কী হয়ে গেছে! কেমন করে, কোন ফাঁকে এমনভাবে বদলে গেল সে!
বারেকের কথা মনে পড়ছে, মা। বুয়ার কথা মনে পড়ছে।
কিন্তু কেন মনে পড়ছে তাদের কথা! নিজের মায়ের কবর খুঁড়ছে যে ছেলে, সেই ছেলের কেন মনে পড়বে আরেক ছেলের কথা! কেন মনে পড়বে আরেক মায়ের কথা!
আমি বুঝতে পারছি না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, মা। আমার মনে পড়ার কথা তোমাকে। তোমার কত দিনকার কত কথা, কত স্মৃতি। আমার জন্য কত চোখের পানি তোমার। কত কান্না, কত হাহাকার।
এসএসসি পরীক্ষা দিতে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে থাকব, মাত্র দিন বিশেকের ব্যাপার, তাও তুমি কাঁদছ! ঢাকায় গিয়ে কলেজে পড়ব, খালার কাছে থাকব, তোমার বাড়িতেই থাকব, তাও তুমি কাঁদছ!
বাবার স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে বকুলও চলে গেল ঢাকায়। ইডেন কলেজে পড়বে। মায়াও পড়ত ওই কলেজে। তোমার দুই ছেলেমেয়ে দুজনই ঢাকায়, চোখের আড়ালে। ছেলেমেয়ের জন্য দিনে এক-দুবার তুমি কাঁদছই! আহা রে, এত নরম মন তোমার! এত মায়াভরা মন!
প্রথমবার কলেজ ছুটির পর বাড়ি এসেছি, ফিরে যাওয়ার আগের সন্ধ্যা থেকে শুরু হলো তোমার কান্না। রাতের বেলা আমরা সবাই খেতে বসেছি। তুমি চোখ মুছছ আর আমার পাতে খাবার তুলে দিচ্ছ। তোমার দিকে তাকিয়ে এত মন খারাপ হলো আমার, আবার একটা চালাকিও এলো মনে। বললাম, একটা কাজ করো, মা...
শুনে তুমি তো চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেই বাবা আর বকুলও তাকাল।
তুমি চোখ মুছে বললে, কী করতে কছ?
আমার সঙ্গে চলো।
কই যামু তোর লগে?
ঢাকায়।
তারপর?
তারপর আবার কী! আমার সঙ্গে থাকবে। তাহলে আর কান্নাকাটি করতে হবে না তোমাকে। আমি সারাক্ষণ তোমার চোখের সামনেই থাকব।
আর এইদিকে কী হইব? বকুলরে কে দেখব? তোর বাবারে কে দেখব?
এসএসসি পাসের পর বকুলও চলে যাবে ঢাকায়। এখন শুধু ছেলের জন্য কাঁদছ, তখন ছেলেমেয়ে দুজনের জন্যই কাঁদবে। এত কান্নাকাটি না করে ঢাকায় চলো। বকুল ঢাকায় গিয়ে মনিজা রহমান গার্লস স্কুলে ভর্তি হোক। ওখান থেকে এসএসসি দিক।
তোর বাবা কি একলা থাকবে বাড়িতে?
বাবাকেও নিয়ে চলো।
বাবা হাসলেন। আর আমার স্কুল?
মুখের ভাত গিলে বললাম, তুমি একটা কাজ করতে পারো, বাবা। অনেক দিন তো স্কুল চালালে, এখন অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে রিটায়ার করো। সবাই মিলে ঢাকায় চলে যাই। ঢাকায় থাকি।
বাবা বললেন, সেটা কখনোই সম্ভব না।
কেন?
আমি এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার স্কুল ফেলে কোথাও যাব না।
তাহলে আমার মা সব সময় আমাদের জন্য কেঁদেই যাবে?
বরং অন্য একটা কাজ করা যায়।
কী কাজ?
তোর মা তোদের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে থাকল, আমি থাকলাম বাড়িতেই। কদম ওরা আছে, ওরা আমার দেখাশোনা করবে।
আমি তোমার দিকে তাকালাম। কী বলো, মা? এটা তো ভালো প্রস্তাব।
তুমি চোখ মুছে বললে, ভাত খা। আর কথার দরকার নাই।
বাবাকে ছেড়ে তুমি যে যাবে না তা তো আমি জানতামই। এসব কথা তুলেছিলাম তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য। বকুল আমার চালাকিটা ধরে ফেলেছিল। হাসিমুখে বলল, তুমি বুঝতে পারো নাই মা, তোমার কান্নাকাটি থামাবার জন্য দাদা এসব কথা বলল।
বকুলটা খুব বুদ্ধিমতী হয়েছিল, মা। খুব বুদ্ধিমতী।
আমাদের বিক্রমপুর অঞ্চলে বড় ভাইকে দাদা বলার নিয়ম। বহু বহুকাল ধরে চলে আসছে এই নিয়ম। হিন্দুপ্রধান অঞ্চল ছিল বলেই এই নিয়ম কি না, কে জানে!
বকুল আমাকে দাদা বলে ঠিকই কিন্তু দাদার সঙ্গে 'তুই'। দাদা তুই।
আহা রে আমার বোনটি! আহা রে আমার বকুল ফুলটি!
চাঁদের আলো আরেকটু প্রখর হয়েছে। তোমার আমার শরীরে বিকালবেলার কোমল রোদের মতো পড়েছে জ্যোৎস্না। তোমার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, মা। চোখ বুজে যেন ঘুমিয়ে আছ তুমি। নিথর প্রশান্ত মুখ। বন্ধ চোখের ওপর পড়েছে চাঁদের আলো। শ্রাবণ রাতের একটু একটু হাওয়া আসছে। সকালবেলার গোলাগুলির শব্দে আকাশ পাতালে উড়ে গিয়েছিল যেসব পাখি, থেমে গিয়েছিল বাড়ির পোকামাকড়, ইঁদুর, ব্যাঙের চলাচল আর ডাকাডাকি, তারা বোধ হয় ভুলে গেছে সকালবেলার স্মৃতি। ঝিঁঝি ডাকছে গলা খুলে। সঙ্গে নানা ধরনের রাতপোকা। রাতের প্রাণী বাদুড় ওড়াউড়ি করছে বাগানের দিকে। দু-একটা রাতপাখি ডাকছে।
দূরে ডাকছে, নাকি আমাদের বাড়িতেই!
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, মা। আমার কাছে সব কিছুই বহুদূরের মনে হচ্ছে। কদম পারুল আর বুয়া কোথায় গেল! বারেকের হদিস তো যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নেই। আমাদের বল্টু, বল্টুকে কি নিয়ে গেছে কোনো রাজাকার?
না, তা হওয়ার কথা না।
বল্টু মহা তেজি। অন্য কেউ তাকে নিতে পারবে না। ঘেউ ঘেউ করে খাবলে ধরবে পা। কামড়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে।
তাহলে বল্টুর কী হলো!
বল্টুকে কি গুলি করে মেরেছে ওরা?
নিশ্চয়ই ওদেরকে দেখে তেড়ে গিয়েছিল বল্টু। তখনই গুলি করেছে বল্টুকে। অথবা বল্টু তার স্বভাবমতো উঠানের কোণে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিল। অথবা বাড়ির পেছন দিকে, রান্নাঘরের ওদিকে ছিল। গুলির শব্দে দিশাহারা হয়ে সামনের দিকে ছুটে এসেছিল। অথবা দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। তখনই গুলি করা হয়েছে। গুলি খেয়ে সে হয়তো ছিটকে গিয়ে পড়েছে বর্ষার পানিতে। এতক্ষণে হয়তো মরে ফুলে উঠেছে আমাদের বল্টু।
আর মিনি! অমন সাদা ধবধবে আদুরে বিড়াল। তাকে নিশ্চয়ই কোলে তুলে আদর করতে করতে নিয়ে গেছে... ...গুলোর কেউ।
কিন্তু একবার যে আমার মনে হলো পায়রার একটুখানি শব্দ এলো। পায়রার খোঁয়াড়, হাঁস মুরগির খোঁয়াড় সবই ওরা নিয়ে গেছে, এমনকি আমাদের ঢেঁকিটাও নেই। গোলাঘরে পড়ে নেই এক দানা ধান। শুধু বাড়ির ইটগুলো খুলে নিতে পারেনি। পারলে সেগুলোও নিয়ে যেত।
গুলির শব্দে পায়রাগুলো উড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়। কোথায় কোন দিকে গিয়েছিল কে জানে।
কোনওটা কি ফিরে এলো!
খোঁয়াড়ে নিশ্চয় ছানা ছিল। দু-চারটা ছানা তো সব সময়ই থাকছে কোনও না কোনও খোপে। ছানার মায়ায় কি ফিরে এলো কোনও পায়রা!
বিকাল থেকে আমি বাড়িতে। তখন তো কোনো পায়রার ডাক শুনলাম না, দেখলামও না কোথাও। এমনকি কাক শালিকের ডাকও শুনলাম না, চোখেও দেখলাম না। গোলাগুলির শব্দে পাখিরা সব পালিয়েছিল। আর বেশির ভাগ পাখিই তো রাতকানা। রাতের বেলা চোখে দেখে না। তাহলে রাতের বেলা কেমন করে ফিরবে পায়রা! পূর্ণিমা রাত হোক আর যা-ই হোক, দিনের পাখি কখনও রাতে বেরোবে না।
আসলে ডাক বোধ হয় আমি শুনিনি, মা।
ওসব আমার মনের ভুল।
বিভ্রম।
নাকি উড়তে পারে না এমন কোনও পায়রা...
আচ্ছা মা, আমি এত পায়রা পায়রা করছি কেন? আমরা তো বলি কবুতর! কবুতর না বলে আমি সমানে পায়রা বলে যাচ্ছি!
এলোমেলো, সব এলোমেলো, মা।
আমাদের কবুতরগুলোর কোনওটা হয়তো ভালোমতো উড়তে পারে না। হয়তো কোনও ছানা উড়তে শেখার চেষ্টা করছে। ওরা যখন বাড়ির মানুষজন শেষ করে লুটপাট চালাচ্ছে, খোপ থেকে ছিটকে বেরিয়ে কবুতরগুলোর যেটা যেদিকে পারে উড়াল দিয়েছে, ওরকম সদ্য উড়তে শেখা কোনও কবুতর উড়াল দিয়ে হয়তো বেশিদূর যেতে পারেনি, কোনও গাছের ডালে, পাতার আড়ালে গিয়ে বসেছে, সে হয়তো কোনও শব্দ করেছে।
শেষ বিকালে বাড়ি ঢুকে তোমাদেরকে দেখে, প্রথমে বাবাকে উঠানে পড়ে থাকতে দেখে, বসার ঘরে তোমাকে, বকুল মায়া আর মায়ার গর্ভজুড়ে আমার ছেলে সব দেখে আমি উদ্ভ্রান্তের মতো ঢুকলাম মায়া আর আমার রুমে।
না না, মায়াকে দেখার আগেই ওকে খুঁজতে ঢুকেছিলাম আমার রুমে। সেই রুমে কিছুই নেই। সব লুটপাট হয়ে গেছে। এককোণে পড়ে আছে কতগুলো ছেঁড়াখোঁড়া জীর্ণ পুরনো খবরের কাগজ। ওই দিকটায় ওদের বোধ হয় চোখ পড়েনি। চোখ পড়লেই বা কী! ওই জিনিস দিয়ে কী করবে? ওগুলো ওরা ছুঁয়েও দেখেনি। দু পয়সার মূল্য নেই।
কিন্তু ওর তলায় ছিল মহামূল্য এক সম্পদ। কাগজগুলোর দিকে তাকিয়েই আমার সে কথা মনে পড়েছিল। বাড়িতে ঘটে গেছে এত বড় সর্বনাশ, সে কথা ভুলে গেলাম। পাগলের মতো হাতড়াতে লাগলাম কাগজগুলো। তলার দিকে পেয়ে গেলাম আমার সম্পদ। আমার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সবুজ জমিনের ওপর লাল টকটকে সূর্য। সূর্যের বুকে হলুদ রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র।
গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী রোডে, মনিজা রহমান গার্লস স্কুল ছাড়িয়ে ফারুক ভাইদের বাড়ির সামনে কাশেমের মুদি দোকান আর মোসলেমের দর্জি দোকান। অতিযত্নে মোসলেম দর্জি এই পতাকা আমাকে তৈরি করে দিয়েছিল। বাড়ি আসার সময় পতাকাটা নিয়ে এসেছিলাম। মায়ার হাতে দিয়েছিলাম। কী মনে করে পুরনো খবরের কাগজের তলায় যত্নে রেখে দিয়েছিল মায়া।
রুমে ঢুকে, ফাঁকা শূন্য রুম, কোথাও কিছু নেই; শুধু এককোণে পড়ে আছে খবরের কাগজগুলো, সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়েছে পতাকার কথা। আমি পাগলের মতো কাগজগুলো এলোমেলো করে বের করলাম পতাকা। সেই পতাকা ভাঁজ করে পেঁচিয়ে বাঁধলাম মাথায়। যেন একজন বীর যোদ্ধা তার প্রাণপ্রিয় পতাকা মাথায় বেঁধে শত্রুর বিরুদ্ধে এখনই শুরু করবে ভয়াবহ যুদ্ধ। শত্রু শেষ না করে থামবে না।
এই পতাকাই এখন আমার একমাত্র শক্তি, মা। এই পতাকাই এখন আমার সব কিছু।
আমি আমার পতাকার জন্য যুদ্ধ করব।
আমি আমার জাতীয় সংগীতের জন্য যুদ্ধ করব।
'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি'।
সেই যে চৈত্র মাসের দুপুরবেলা মুসাফির বারেক ফিরে এলো, বুয়া চিনতে পারল তার ছেলেকে। বারেকের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে ছেলের নাম উচ্চারণ করল, বারেক দুহাতে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, পুরো বাড়িতে খবর হয়ে গেছে। আমরা যে যেখানে ছিলাম পেছন দিককার উঠানে চলে এসেছি। আমি পরিষ্কার দেখতে পেলাম, বিড়বিড় করে বারেকের নাম উচ্চারণ করার পর, বারেক মাকে জড়িয়ে ধরার পর, বুয়াও দুহাত তুলল ছেলেকে জড়িয়ে ধরার জন্য, তার পরই তার হাত থেমে গেল। তার হাত নেমে গেল। বারেকের মতো করে বারেককে সে জড়িয়ে ধরল না। দাঁড়িয়ে রইল পাথর হয়ে, গাছ হয়ে।
কেন?
কেন এমন করল বুয়া?
আমি খুবই অবাক। বুয়ার চোখে পানিও নেই। যেন ধরেই নিয়েছিল তার ছেলে নেই, বাঁশঝাড়ের তেনায় বারেককে মেরে পচা পুকুরের কাদার তলায় এমন করে পুঁতেছে, লাশও কোনও দিন ভেসে উঠবে না।
আর বারেকের জন্য তার কান্না!
দিনদুপুরে!
রাতদুপুরে!
বিলাপ করে কান্না। বারেক রে, আমার বারেক। ও আমার বাজান, আমারে ছাইড়া তুই কই চইলা গেলি? ক্যান চইলা গেলি? আমি নাইলে তরে একটু মারছিলাম, এর লেইগা এত বড় কষ্ট মারে দিলি? এত বড় শাস্তি মারে দিলি? অহন তরে ছাইড়া আমি বাঁচি কেমনে! ও বাজান, বাজান।
রাতদুপুরে বুয়ার কান্নায় স্তব্ধ হতো ঝিঁঝিপোকারা, চলাফেরা বন্ধ করত ইঁদুর ব্যাঙ রাতপোকারা। আকাশে ডানা মেলা বাদুড় আর দূরে অদূরে থেকে থেকে ডাকতে থাকা রাতপাখিরা থেমে যেত।
দুই ধরনের রাতপাখি দু চার ছ মাসে এক দুবার ডাকত আমাদের বাঁশঝাড়ের ওদিকে, বাচ্চুদের বাড়ির ওদিকে। গভীর রাতে ডাকত।
একটা পাখি ডাকত কু কু করে। কু শব্দে একটা ডাক দিয়ে থামত, মিনিটখানেক পর আবার ডাকত। এরকমই ডাকার স্বভাব পাখিটার। দেশগ্রামের লোকে বলত 'কুপাখি'। মানে খারাপ পাখি।
কেন খারাপ পাখি?
এই পাখির ডাকের সঙ্গে কু শব্দটা আছে। যে বাড়িতে ডাকে, সেই বাড়িতে খারাপ কিছু ঘটে।
ছেলেবেলায় শোনা এসব কুসংস্কারের কথা। তবু আমরা বিশ্বাস করতাম। রাতদুপুরে কুপাখির ডাক শুনে ঘুম ভাঙলে সহজে আর ঘুম আসত না।
আমাদের বাড়িতে ডাকছে না তো পাখিটা! আমাদের বাড়িতে খারাপ কিছু ঘটবে না তো! বড় রকমের কোনও অসুখবিসুখ কারো কিংবা অন্য রকমের কোনও বিপদ! অজানা আতঙ্কে কাঁপত বুক।
অন্য পাখিটা হচ্ছে নিমপাখি।
এই পাখির ডাকার স্বভাবও কুপাখির মতোই। নিম শব্দে একটা ডাক দিয়ে তিরিশ সেকেন্ড বা মিনিটখানেকের গ্যাপ, তারপর আবার 'নিম'। ডাকটা অদ্ভুত ধরনের। যেন ছোট্ট কোনও বিড়ালছানা ডাকছে। সরু বিড়ালগলায় 'মিউ' না ডেকে ডাকছে 'নিম'।
গভীর কোনও রাতে এই পাখির ডাক শুনলেই গা শিউরে উঠত আমার। পরদিন এই নিয়ে আলোচনা হতো বাড়িতে। হয়তো আমার মতো ডাকটা শুনেছ তুমি আর বাবা। বকুলও হয়তো শুনেছে। কিংবা আমরা কেউ শুনিনি, শুনেছে কদম অথবা বুয়া পারুল। দশ বছর বয়স পর্যন্ত হয়তো বারেকও শুনেছে।
যে-ই শুনে থাকুক, পরদিন নিমপাখি নিয়ে আলোচনা হতো সকালবেলাই।
বিক্রমপুর অঞ্চলে নিম শব্দের অর্থ হচ্ছে 'নেব' অথবা 'নিয়ে যাব'। যে বাড়িতে রাতদুপুরে এই পাখি ডাকে, সেই বাড়ির কাউকে না কাউকে নিয়ে যায়। অর্থাৎ মৃত্যু এসে নিয়ে যায়। বাড়ির কেউ না কেউ মারা যায়।
কুসংস্কার।
গ্রাম্য কুসংস্কার।
বুজরকি।
বুয়া আবিষ্কার করেছিল, যেদিন বারেক উধাও হলো, তার কয়েক দিন আগের এক রাতে এই বাড়ির দক্ষিণ দিকটায়, যেদিক দিয়ে বাড়িতে আমি আজ উঠলাম, ওই দিকটায়, তেঁতুলগাছে কুপাখি ডেকেছিল। বাড়ির কেউ শোনেনি, শুধুমাত্র সে শুনেছে। তখন থেকেই নাকি তার বুক কাঁপত।
কিছু একটা কু ঘটনা এই বাড়িতে ঘটবে।
বারেক উধাও হওয়ার আগের রাতে বাঁশঝাড়ের ওদিকটায় তিনবার পরিষ্কার নিমপাখির ডাক শুনেছে বুয়া।
ও, আরেকটা কথা। নিমপাখি দিনের বেলা কোথায় কোন গাছের ডালপালার আড়ালে লুকিয়ে থাকে, ওই পাখি চোখেও দেখে না কেউ। চেনেও না। রাতের বেলা, তাও গভীর রাতে গাছপালা থেকে নেমে আসে, ঝোপঝাড়ে থাকলে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর যে বাড়ির মানুষকে সে নেবে, সেই বাড়ির মাটিতে নেমে একটা করে ঠোকর দেবে, একটা করে ডাক দেবে।
অর্থ হচ্ছে এই বাড়ির কাউকে মৃত্যুর ডাক দিচ্ছে।
কবরে নেওয়ার ডাক দিচ্ছে।
মাটির তলায় নেওয়ার ডাক দিচ্ছে।
আমাদের ছেলেবেলা আচ্ছন্ন করেছিল এই সব কুসংস্কার। বাঁশঝাড়ের তেনায়, কুপাখি নিমপাখি, এ রকম কত কী!
তবে ওই কুপাখি আর নিমপাখির ডাক নিয়েও বিলাপ করত বুয়া। যেই রাইত্রে কুপাখির ডাক হুনছি, আমার কলিজা কাঁপছে। কী জানি হয়! আর যেই রাইত্রে নিমপাখি ডাকছে, ওই রাইত্রে ডরে আমি ঘুমাইতেই পারি নাই। হায় হায় রে, তখন কি আর বুঝছি, ওই পাখি আমার পোলারেই নিব! বাঁশঝাড়তলায় নাইমা ডাকছে, ওইখানেই মরছে আমার পোলায়।
এই পাখির রহস্য আমি বড় হয়ে বুঝেছি। জানি না কী পাখি। দেশগ্রামের সব পাখিই তো আর চিনি না। হয়তো এমন এক পাখি, যে পাখি দিনের পাখি না, রাতের পাখি। দিনে গাছপালা ঝোপঝাড়ের আড়ালে ঘুমায়, বেরোয় রাতে। রাতপাখি। গাছপালার তলার পরিষ্কার মাটিতে, গৃহস্থবাড়ির আঙিনায় রাতের বেলা গর্ত থেকে বেরোয় নানা ধরনের পোকামাকড়। এই পাখি হয়তো ঠুকরে ঠুকরে সেই সব পোকামাকড় ধরে খায় আর ডাকে। সেই ডাককেই কুসংস্কার বানিয়েছে মানুষ। কেউ হয়তো কোনও রাতে দেখেছে ওই পাখি। মাটিতে পোকামাকড় ঠুকরে খাচ্ছে আর ডাকছে, দু-চার দিনের মধ্যে হয়তো সেই বাড়িতে মারা গেছে কেউ, তৈরি হয়ে গেছে কুসংস্কার।
কুসংস্কার এভাবেই তৈরি হয়।
তবে বাঁশঝাড়ের তেনায় যে বারেককে মারেনি, নিমপাখির ডাকে যে মারা যায়নি বারেক, এগারো বছর পর তার ফিরে আসাই প্রমাণ করল সব।
একটা রহস্য রয়ে গেল।
বুয়ার ভাষায় কুপাখি ডেকেছিল। দুর্ঘটনা একটা ঘটেছিল আমাদের বাড়িতে। বারেকের উধাও হয়ে যাওয়া।
কিন্তু বারেকটা গিয়েছিল কোথায়?
মা গো, নিমপাখির কুসংস্কারটা আজ আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে। আমার মনে হচ্ছে, কাল রাতে আমাদের বাড়িতে, বাড়ির সামনের দিককার উঠানে, যেখানে এখন তোমার লাশ, বাবার কবর, পিছন দিককার উঠানে, যেখানে পড়ে আছে মায়া আর আমার অপুষ্ট ছেলের লাশ, এই দুটো জায়গায় নিমপাখি নেমেছিল। কাল রাতে সে আর পোকামাকড় ঠুকরে খায়নি। কাল রাতে সে বাড়ির মানুষজনের মৃত্যুবার্তা নিয়ে এসেছিল। মাটিতে ঠোকর দিয়ে অবিরাম ডেকেছিল, নিম নিম।
তোমরা কেউ শুনতে পাওনি, মা?
শুনতে পাওনি নিমপাখির ডাক?
দেখো কী অবস্থা আমার! একবার যুক্তি দিয়ে নিমপাখির স্বভাব ব্যাখ্যা করছি, আরেকবার ফিরে যাচ্ছি কুসংস্কারে!
এলোমেলো।
সব এলোমেলো, মা।
সব এলোমেলো।
কিন্তু বারেক কোথায় চলে গিয়েছিল?
এই এগারোটা বছর সে কোথায় ছিল?
কার কাছে ছিল?
ওভাবে গেলই বা কেন, ফিরেই বা এলো কেন?
পুরো ঘটনা বারেক একদিন বলল। এ রকম এক জ্যোৎস্না রাতে, আমাদের পেছন দিককার বারান্দায় বসে। ফিরে আসার বেশ কিছুদিন পর। আমি তখনও বাড়িতে, বকুল বাড়িতে। বারেকের মুখে মছলা-মাছায়েল শোনার জন্য কদম পারুল বুয়া তুমি আমি বকুল বসেছি। বাবা বাড়িতে। তাঁর রুমে বসে স্কুলের কী সব হিসাব কিতাব দেখছেন।
বারেক সেদিন মছলা-মাছায়েল না বলে শুরু করল তার এগারো বছরের উধাও হয়ে থাকা জীবনের গল্প।
তার আগে যেদিন সে ফিরে এলো, সেদিনকার ঘটনা শেষ করি, মা।
বুয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে বারেক। মা, মা গো! আমি তোমার বারেক, মা। আমি তোমার বারেক। তোমারে ছাইড়া আমি চইলা গেছিলাম, আবার তোমার কাছে ফিরত আইছি। তুমি আমারে মাফ কইরা দেও মা, তুমি আমারে মাফ কইরা দেও। আমি তোমার কাছে বিরাট অন্যায় করছি। তোমারে ছাইড়া থাইকা বিরাট গুনাহর কাজ করছি। তুমি না মাফ করলে আল্লাহপাকও আমারে মাফ করব না। রোজ হাশরের দিন আমার মাথার ওপরে নাইমা আসব সূর্য। সূর্যের তাপে আমার মাথার মগজ গইলা গইলা পড়ব। দোজখের আগুনে আমি সারা জীবন জ্বলুম। তুমি আমারে মাফ কইরা দেও, মা।
বারেক জড়িয়ে ধরে আছে বুয়াকে, বুয়া গাছপাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর কোনও রাগারাগি না, মান অভিমান না, কান্নাকাটি না একেবারেই নির্বিকার ভঙ্গিতে দুহাতে আলতো করে সরিয়ে দিল বারেককে। একটাও কথা বলল না। রান্নাঘরের বারান্দায় গিয়ে বসল। পা দুটো উঠানের মাটিতে।
উঠান থেকে প্রতিটা ঘরই হাত দেড়েক উঁচুতে। বারান্দায় বসে পা ঝোলানো যায়।
সেভাবেই বসেছে বুয়া।
মা তাকে বুক থেকে সরিয়ে দিয়েছে দেখে বারেকও কাঁদতে কাঁদতেই থতমত খেল। তারপর গিয়ে বুয়ার পায়ের সামনে বসে দুহাতে জড়িয়ে ধরল তার পা। মা, মা গো, আমার ভুল হইয়া গেছে, বহুত বড় ভুল হইয়া গেছে। তুমি মাফ না করলে আমার কোনও গতি নাই। ইহকাল পরকাল দুই কালেই আমি জ্বইলা পুইড়া মরুম।
বুয়ার মুখে তবু কথা নেই। নির্বিকার সে, একেবারেই নির্বিকার। বারেক তার পা ধরে কাঁদছে, এটা যেন কোনও ব্যাপারই না। বারেকের দিকে সে তাকিয়েও দেখছে না। উদাস চোখে তাকিয়ে আছে গোলাঘরের ওদিককার জামগাছটার দিকে।
বারেককে দেখে যতটা না অবাক আমরা, বুয়ার আচরণ দেখে তার চেয়ে বেশি অবাক।
একি কাণ্ড!
যে ছেলের জন্য এত কান্নাকাটি, এত বিলাপ হাহাকার, সেই ছেলে ফিরে আসার পর এত নির্বিকার মা! এটা কী করে সম্ভব!
বারেকের সঙ্গে কথাই বলে না বুয়া, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও দেখে না। সে থাকে তার কাজ নিয়ে, আগের মতোই আমাদের সংসারের কাজ। যখন তখন বারেক তার কাছে যাচ্ছে, হাতে পায়ে ধরে কাঁদছে। আকুলিবিকুলি করে মাফ চাইছে।
বুয়া নির্বিকার। নিঃশব্দে ছেলের হাত ছাড়িয়ে দেয়। রাগ বিরক্তি ক্ষোভ কোনও কিছুই প্রকাশ করে না। অদ্ভুত এক আচরণ।
বারেকের থাকার জায়গা হয়েছে কদমের ঘরে। সেই ঘরে বসে যখন তখন শিশুর মতো কাঁদে বারেক। কদমকে বলে, কদম মামা, আমার মারে বুঝাও। আমারে মাফ কইরা দিতে কও।
পারুলকে বলে, ও পারুল খালা, মারে বুঝাও। যেই কষ্ট মারে আমি দিছি, ফিরা আইসা মার ব্যবহারে তার থিকা বহুত বেশি কষ্ট পাইতাছি। মারে জিগাও, কী করলে সে আমারে মাফ করব? মায় যা কইব, আমি তা-ই করুম।
কদম পারুল বুয়াকে বোঝায়। বুয়া কানেই নেয় না তাদের কথা। বারেকের নাম উঠলেই নির্বিকার হয়ে যায়। কোনও কাজে থাকলে সেই কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়। কাজ না থাকলে উঠে চলে যায় কোনও দিকে।
বারেক তারপর আমাকে ধরে, বকুলকে ধরে। আমরা দুজন দুভাবে বোঝাই বুয়াকে। আমার আর বকুলের সঙ্গে তো কদম পারুলের মতো ব্যবহার করা সম্ভব না। বুয়া অন্যভাবে আমাদের কথা এড়িয়ে যায়। আমাকে বলে, আমি তোমার কাছে মাফ চাই, দাদা। এইটা লইয়া আমার লগে কথা কইয়ো না।
বকুলকে বলে, মাফ চাই বইন। আমি তোমার কাছে মাফ চাই। ওর নাম আমার সামনে লইয়ো না।
এরপর আমাদের কী বলার থাকে!
বুয়ার বুকের ভিতর যে এত অভিমানী এক মায়ের বাস, এটা বুঝে আমি আর বকুল থেমে যাই।
বারেক সব শেষে ধরে তোমাকে আর বাবাকে। আপনেরা আমার মারে বুঝান। আপনেগো কথা না শুইনা পারব না মায়। মার লগে আমার সম্পর্ক ঠিক কইরা দেন। তার বিনিময়ে আমি সারা জীবন এই বাড়ির কামলা মজুর হইয়া থাকুম, চাকর হইয়া থাকুম।
এক দুপুরে বুয়াকে তুমি আর বাবা ডাকলে।
সেদিন ছুটির দিন। রবিবার। স্কুল বন্ধ। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বুয়াকে বসার ঘরে ডাকলে। আমি আর বকুল দাঁড়িয়ে আছি দরজার সামনে। বারেক পায়চারি করছে বারান্দায়। পারুল উঁকি দিয়ে আছে উত্তর দিককার জানালা দিয়ে। কদম তার ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে।
তোমরা কী বলবে বুয়া বুঝে গিয়েছিল। বুঝে এমন একটা কাজ করল, তোমাদের দুজনকে বারেকের বিষয় নিয়ে কথা বলার সুযোগই দিল না, সরাসরি বাবার পা জড়িয়ে ধরল। আমি আপনের পায়ে ধরি, ওর কথা আপনে আমারে কইবেন না। দরকার হইলে আমারে আপনের পায়ের জুতা দিয়া মারেন, তাও ওর কথা আমারে কইয়েন না। ও আমার কেউ না। আমার পোলা এগারো বছর আগে মইরা গেছে।
বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কোনও কথাই বললেন না। তুমিও কথা বললে না, মা।
এমন অভিমানী মাও হয়, মা!
এমন পাথরহৃদয় মাও হয়!
এমন শীতল কঠিন বরফ হতে পারে কোনও মায়ের মন!
না, পারে না, মা। পারে না। অভিমান একদিন ভেঙে যায়। পাথর একদিন চূর্ণবিচূর্ণ হয়। শীতল কঠিন বরফ একদিন গলে পানি হয়।
বুয়ারও হয়েছিল।
এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মায়ের কথা বলি, মা।
পঁচিশ মার্চের দুদিন পরের ঘটনা। সাতাশে মার্চ। সেদিন সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হয়েছে।
এই মা থাকেন নিউ মার্কেটের উত্তর পাশে, টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ওদিকটায়। তিনি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল। সেই মায়ের নাম সামসুন নাহার। তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে চিটাগাং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র, ছোট ছেলের নাম ওয়াকার হাসান, রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। মেয়ে ছোট। সে কলেজে পড়ে।
পঁচিশে মার্চের ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন মা। সারা রাত জেগে ছিলেন। পরের দিন বাড়িতে অবরুদ্ধ। কারণ শহরে কারফিউ জারি করেছে ... ...গুলো।
বাড়িতে অবরুদ্ধ মা ছটফট করছেন। তিনি খুবই সাহসী মানুষ। আর ততক্ষণে বিভিন্নভাবে জেনে গেছেন কী ঘটে গেছে ঢাকা শহরে। ছাত্র শিক্ষক নিরীহ অসহায় বাঙালিকে কিভাবে হত্যা করেছে ওরা।
সাতাশ তারিখ কারফিউ উঠে যাওয়ার পরপরই ওয়াকারকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন তিনি। রিকশা নিলেন। রিকশায় মা ছেলে সায়েন্স ল্যাবরেটরির ওদিকে এসেই দেখতে পেলেন গুলিতে ঝাঁঝরা মৃতদেহ পড়ে আছে, এলিফ্যান্ট রোডেও একই দৃশ্য।
হতবিহ্বল মা ছেলে তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখেন। দেখে রিকশাওয়ালা। কারো মুখে কথা নেই।
ও রকম দৃশ্য দেখে কে কথা বলতে পারে, মা?
রিকশা এলো শহীদ মিনারে। যে ভাষার জন্য বাহান্ন সালে বুকের রক্ত দিয়েছিল বাঙালি, ভাষাশহীদ রফিক জব্বার সালাম বরকতের রক্তের বিনিময়ে আমরা পেলাম যে রাষ্ট্রভাষা, ভাষার জন্য জীবন দান, রক্তের ইতিহাস পৃথিবীর কোনও জাতির নেই। শুধু আমাদের আছে। বাঙালি জাতির আছে। আমাদের সেই বীর ভাষাশহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে নির্মিত শহীদ মিনার আমাদের বড় গৌরবের জায়গা। আমাদের বড় অহংকারের জায়গা।
মা ছেলে শহীদ মিনারে এসে দেখেন শহীদ মিনার ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানি...গুলো। কামান দেগে মিসমার করা হয়েছে আমাদের গৌরব স্তম্ভ।
মা ছেলে দুজনেই বিস্মিত, ব্যথিত। ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ।
ছেলেকে নিয়ে মা তারপর গেলেন জগন্নাথ হলে।
জগন্নাথ হলে সেই রাতে যেসব ছাত্র ছিল তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। হলের আঙিনায় বিশাল গর্ত করে একসঙ্গে চাপামাটি দেওয়া হয়েছে বহু ছাত্রের লাশ। খুবই তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে কাজ। ফলে হত্যাকাণ্ডের দুদিন পরও চাপা দেওয়া মাটির বাইরে বেরিয়ে আছে কোনও ছাত্রের হাত, কোনও ছাত্রের পা।
পঁচিশের রাতে ওই ঘটনা ঘটিয়ে পরদিন শহরে কারফিউ দিয়ে বাঙালির লাশ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল ওরা। তাড়াহুড়া করে সব সরাতে পারেনি। সাতাশ তারিখেও শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল বহু মৃতদেহ।
মা ছেলে এসব দৃশ্য দেখে বাড়ির দিকে ফিরলেন।
রিকশায় বসে এই এতটা সময় পর প্রথম কথা বললেন মা। গম্ভীর, ব্যথিত গলায় ওয়াকারকে জিজ্ঞেস করলেন, কী দেখলে?
মায়ের এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবে ওয়াকার!
মা তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এখন কী করবে? কী করণীয় তোমার?
এবার গলা নিচু করে, বুকের ভিতর থেকে গভীর প্রত্যয়ের গলায় ওয়াকার বলল, এই হত্যার প্রতিশোধ নেব মা। এই নির্যাতনের প্রতিশোধ নেব। দেশ স্বাধীন করব। করবই।
ছেলের মুখের দিকে তাকালেন মা। বললেন, আমার দুই ছেলে। এক ছেলে আমি দেশের জন্য ত্যাগ করব। তোমাকে আমি দেশের জন্য ত্যাগ করলাম।
ছেলে কথা বলে না। তার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। চোয়াল শক্ত।
মা ছেলে দুজনেই খানিক চুপচাপ। রিকশা চলছে।
মা তারপর ছেলেকে নির্দেশ দিলেন, যুদ্ধের মাঠে যেন পিঠে গুলি না লাগে। যুদ্ধ করবে বীরের মতো। মরতে হলে মরবেও বীরের মতো। ফিরে এলে তাও আসবে বীরের মতো। দেশ স্বাধীন করে।
তিরিশে মার্চ নিজ হাতে ছেলের ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন মা। যাও, দেশের জন্য যুদ্ধ করো, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করো। বাঙালি হত্যার প্রতিশোধ নাও।
ব্যাগ কাঁধে বাড়ি থেকে বেরোল ছেলে। মা দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়। তাঁর চোখে পানি নেই, মুখে হাসি। মায়ের চোখে পানি দেখলে ছেলের মন নরম হবে। অতিকষ্টে চোখের পানি আটকে রাখলেন মা। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইলেন বাড়ির দরজায়। যতক্ষণ ছেলেকে দেখা যায় দেখলেন। ছেলে চোখের আড়াল হতেই চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলেন না মা। দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন।
মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াকার হাসান। যুদ্ধের মাঠে তার বীরত্বে সবাই মুগ্ধ।
আরেক মায়ের কথা বলি, মা। ঢাকা চিটাগাং রোডের শুভপুর ব্রিজ থেকে টিচাগাংয়ের দিকে মাইল তিনেক গেলে করেরহাট। একসময়ের ছোটখাটো ব্যবসাকেন্দ্র হয়ে গেছে। মানুষজন বলতে গেলে নেই। এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ। ক্যাপ্টেন রফিক শখানেক ইপিআর সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি... ...দের ঠেকাবার জন্য যুদ্ধ করছেন। তেমন অস্ত্র নেই সঙ্গে, খাদ্য নেই। যোদ্ধারা ক্লান্ত বিপর্যস্ত। তবু যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এ সময় খবর এলো মহালছড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান মারাত্মক বিপর্যয়ে। পাকিস্তানি... ...রা অবরুদ্ধ করে ফেলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। মেজর মীর শওকত আলী সেনাদল চেয়ে পাঠিয়েছেন। বাধ্য হয়েই ৩০ জনের একটি দল পাঠিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন রফিক। ৭০ জন যোদ্ধা নিয়ে বেশ বড় এলাকা করেরহাটের চারপাশ রক্ষা করতে হবে তাঁকে। এমনভাবে পরিকল্পনা করলেন তিনি, যেন পাকিস্তানি... ...রা কিছুতেই বুঝতে না পারে এখানে মুক্তিযোদ্ধা আছে মাত্র ৭০ জন। সহযোদ্ধাদের সেভাবেই উজ্জীবিত করলেন তিনি। যোদ্ধাদের সঙ্গে সামান্য চিড়া আর গুড়। এক দুই মুঠ করে চিড়া খেলেন সবাই, এক দু-চিমটি গুড়। খালের ঘোলা পানি খেলেন। এই সামান্য খাদ্যের শক্তি নিয়ে তৈরি হলেন শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য।
খাওয়াদাওয়ার পর ক্যাপ্টেন রফিক এলেন করেরহাট স্কুলের সামনে। তখনই বিক্ষিপ্তভাবে শুরু হলো পাকিস্তানি... ...দের আর্টিলারির গোলা। বাতাস ভারী হলো বারুদের গন্ধে।
পাশেই তিনটি কুঁড়েঘর ছিল। গোলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে ঘরগুলো। ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দুজন মহিলা দিশাহারা ভঙ্গিতে ছোটাছুটি করছেন। একপাশে পড়ে আছে এক কিশোরের রক্তাক্ত দেহ। পাকিস্তানি... ...দের আর্টিলারি শেলের ধারালো স্প্লিন্টার কিশোরের পেট কেটে দুভাগ করে ফেলেছে।
ক্যাপ্টেন চিৎকার করে মহিলা দুজনকে মাটিতে শুয়ে পড়তে বললেন। সেলিং বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত যেন তারা উঠে না দাঁড়ান।
এক মহিলা ধীর শান্ত বেদনাভরা গলায় বললেন, তোমরা কারা?
আমরা আপনাদেরই সন্তান।
ক্যাপ্টেন তাঁর হাতে শক্ত করে ধরা এসএমজি নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটে গেলেন।
মহিলা তখন সেই নিথর কিশোরের সামনে বসে পড়েছেন। মৃত সন্তানের জন্য কাঁপা কাঁপা দুহাত তুললেন পরম করুণাময়ের উদ্দেশে।
পাকিস্তানিদের ট্যাংক আসার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর্টিলারি মর্টার আর মেশিনগানের বৃষ্টির মতো গুলিতে ভয়ংকর পরিস্থিতি।
এরকম চলল সন্ধ্যা পর্যন্ত।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হলো গোলাগুলি। সব শান্ত হলো। ক্যাপ্টেন রফিক ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিলেন মাঠের ঘাসে। চিত হয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলেন। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। অদূরে মৃত কিশোরের পাশে তখনও বসে আছেন মা। মোনাজাত তোলা হাত। ক্যাপ্টেন শুনতে পেলেন, তিনি পরিষ্কার উচ্চারণে আল্লাহপাকের উদ্দেশে বলছেন, আল্লাহ, আমার প্রাণপ্রিয় ছেলেটিকে তুমি নিয়ে গেছ সেজন্য আমার কোনও অভিযোগ নেই। আমার ছেলের প্রাণের বিনিময়ে আমি এখন শুধু এই ছেলেদের জন্য দোয়া চাইছি, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে।
ক্যাপ্টেন রফিক নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। মনে মনে বললেন, হে দয়াময় খোদা, এই দুঃখিনী মায়ের দোয়া তুমি কবুল করো।
হিব্রু ভাষার একটা কথা মনে পড়ছে মা। 'ঈশ্বর যেহেতু সব জায়গায় থাকতে পারেন না সেজন্য তিনি মা তৈরি করেছেন।'
আমি কাইল চইলা যামু।
সন্ধ্যাবেলা পেছন দিককার বারান্দায় বসেছি আমরা। বারেক তার মছলা-মাছায়েল বলবে। মা, তুমি আছ আমার পাশের চেয়ারে, তোমার পাশে বকুল। আর সবাই মেঝেতে। কদম পারুল বুয়া, বুয়ার পায়ের কাছে বারেক। আজ আর মায়ের পায়ে হাত রাখেনি সে। বাবা তাঁর রুমে বসে স্কুলের কাজ করছেন। বিভিন্ন ঘর থেকে আসা হারিকেনের আলোয় কারো কারো মুখে আবছায়া, কারো কারো মুখ শরীর একটুখানি পরিষ্কার।
বারেকের মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। গলার স্বরে তার দুঃখ অভিমান বেদনাবোধ টের পাওয়া গেল।
পারুল বলল, কী কইলি বারেক?
আমি কাইল চইলা যামু।
কই যাবি?
এগারো বছর যেইখানে আছিলাম, যার কাছে আছিলাম, তার কাছে চইলা যামু। বড় আশা কইরা ফিরত আইছিলাম। মায় আমারে মাফ করব, মাইনা নিব আমারে। বহুত দিন চেষ্টা করলাম। মায় আমারে মাফ তো করলই না, মাইনা তো নিলই না, আমার মুখের দিকে একপলকের লেইগা চাইয়াও দেখল না। তয় আমি এখানে থাকুম ক্যান? কার লেইগা থাকুম? এই এত দিনে আমি বুইঝা গেছি, মার কাছে আমি মরা। আমি জীবিত না। মন থেইকা মায় আমারে মুইছা ফালাইছে। আমার লেইগা কোনও টান মহব্বত আদর সোহাগ মার আর নাই।
বুয়া দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। বারেক ফিরে আসার পর থেকে যেমন নির্বিকার, এখনও তেমন।
বারেকের চলে যাওয়ার কথা শুনে আমরা সবাই কমবেশি চমকেছি। পারুল তো বলেই ফেলল, কই যাবি?
বুয়া চমকাল কি না বা তার মুখে চিন্তার ছায়া পড়ল কি না বোঝা গেল না। বুয়ার মুখ পরিষ্কার দেখাও যাচ্ছে না। হারিকেনের ছিটকে আসা ওইটুকু আলোয় কারো চমকে ওঠা না ওঠা মুখ দেখে বোঝাও সম্ভব না।
তোমার মনে আছে, মা! কথা শুরু করলে তারপর তুমি। এত দিন হইল আইছস, এখন পর্যন্ত কইলি না তুই গেছিলি কই, আছিলি কার কাছে! এগারোটা বছর কাইটা গেল, ফিরলি না ক্যান?
বারেক কাতর গলায় বলল, আমি চাইছি মায় পয়লা আমারে মাফ করুক। খালি একবার কউক, হ, তরে আমি মাফ করলাম। আমারে যেই কষ্ট তুই দিছস, ওই কষ্ট আমি ভুইলা গেলাম। আমার মাথায় একটু হাত দিত, আমারে একটু বুকে জড়াইয়া ধরত। একবার খালি কইত, আয়, আমার বুকে আয়, বাজান। আমি এইটা চাইছি, নানু। এইটা হওনের পর সব কথা আমি সবাইরে কইতাম। কী হইছিল সেদিন। মার হাতে মাইর খাইয়া একদৌড়ে কই চইলা গেলাম আমি! এগারো বছর কই রইলাম, কার কাছে রইলাম!
তয় আইজ ক।
হ কমু। চইলা যাওনের সিদ্ধান্ত যখন নিছি, তখন সব কইয়াই যামু।
বারেক একটু থামল। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছি বারেকের এগারো বছর নিখোঁজ হয়ে থাকার ঘটনা শোনার জন্য।
বারেক বলতে লাগল, মায় আমারে মারল, মাইর খাইয়া এমন জিদ হইল আমার, দৌড়াইয়া গেলাম বাঁশঝাড়তলায়। একটুখানি দাঁড়াইলাম। তারপর বাঁশঝাড়ের ওই দিক দিয়া মাঠের দিকে নাইমা গেলাম। দিকপাশ কোনও দিকে তাকাই না। হনহন কইরা হাঁইটা গেলাম বাজারে।
আমি বললাম, কোন বাজারে গেলি, বারেক? দীঘিরপাড় বাজারে নাকি পুরা বাজারে?
পুরা বাজারে। দিনটা আমার মনে আছে। মঙ্গলবার আছিল।
তাই নাকি!
হ মামা।
আচ্ছা, তারপর বল।
মঙ্গলবার পুরা বাজারে হাট বসে। দূর-দূরান্ত থিকা রজতরেখা নদী দিয়া নৌকা নিয়া পাইকার কারবারিরা আসে।
সেটা জানি।
হ, জানবেন না ক্যান, সবাই জানে। সেই হাটের দিনও আইছে। নদীর ঘাটে ম্যালা নৌকা। হাটবাজার মানুষে ভর্তি। গমগম করতাছে। একজন মুসল্লি মতন মানুষ হাটের এক কোনায় পাটি বিছাইয়া পাটির ওপর বিছাইছে সাদা একখান চাদর, তার ওপরে 'কাটা কাপড়' অর্থাৎ পোলাপানের শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি লুঙ্গি এই সব নিয়া বইছে। লোকটা কাটা কাপড়ের কারবারি। তয় খুবই মুসল্লি ধরনের মানুষ। মুখে চাপদাড়ি, চোখে সুরমা, শরীলে আতরের গন্ধ, মাথায় টুপি। লম্বা সাদা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা। এই ধরনের কারবারিদের লগে অল্পবয়সী পোলাপান কর্মচারী থাকে। এইটা ওইটা আগাইয়া দ্যায়, কাস্টমারের লগে দামদস্তর করে। এই লোকটার লগে কেউ নাই। তিনায় একলা। কিছু না ভাইবা আমি তার সামনে গিয়া খাড়াইছি। তিনায় হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী চাও, বাজান? কিনবা কিছু? শার্ট প্যান্ট পায়জামা গেঞ্জি? তোমার মাপের লুঙ্গিও আছে।
আমি কইলাম, না কিছু কিনুম না।
তয়?
এমনেই খাড়াইয়া রইছি।
তিনায় খেয়াল কইরা আমারে দেখলেন। তোমার মুখখান শুকনা। মনটাও খারাপ মনে হইতাছে। বিয়ানবেলা নাশতাপানি খাও নাই?
আমি চুপ কইরা খাড়াইয়া রইলাম, কথা কইলাম না।
তিনায় বহুত আদরের গলায় বললেন, বসো বাজান, আমার পাশে বসো। তোমার লগে কথা কই। বেচাকেনার ফাঁকে ফাঁকে কথা কইলে টাইমটা ভালো কাইটা যাইব। বিকালের দিকে তো রওনাই দিমু।
তিনার কথাবার্তা এতো ভালো লাগল আমার, কী কমু! মুখে য্যান মধুমাখা।
আমি তার পাশে বসলাম।
দু-একজন কাস্টমার আসে, দামদস্তর করে। মানুষটার কথায় কাস্টমার দেখি তার কাছ থিকা ফিরতে পারে না। যে আসে সে-ই কিছু না কিছু কিনা ফালায়।
তিনায় যেখানে দোকান সাজাইয়া বসছেন, ঠিক তার পিছনে একটা চা মিষ্টির দোকান। হাটবার দেইখা বিয়ানবেলাই জিলাপি ভাজা শুরু করছে ময়রা। কাস্টমারের ভিড়ও লাইগা আছে। চামচের খটাখট শব্দে চা বানাইতাছে। গরমাগরম জিলাপি চা আর বিস্কুট খাইতাছে কাস্টমাররা। ডাইলপুরি শিঙ্গাড়াও খাইতাছে। জিলাপি ভাজার গন্ধে আমার খিদাটা এমন বাড়া বাড়ছে, কী কমু!
মুখ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দোকানটার দিকে চাই।
তিনায় আমার অবস্থা বুঝলেন। মুখ ঘুরাইয়া দোকানের দিকে চাইলেন। দোকানের একটা যুবক কর্মচারীরে বললেন, ওই ফজলু, এক পোয়া জিলাপি দে আর দুই কাপ চা। দুই গেলাস পানিও দিস।
বুঝলাম তিনায় প্রতি মঙ্গলবার এই জায়গাটায় বসেন, এখানে বইসাই দোকানদারি করেন। ফজলু তার পরিচিত।
তিনার কথামতন প্রথমে জিলাপি দিল ফজলু, দুই গেলাস পানি দিল। তিনায় আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, খাও বাজান, খাও। আমি নাশতা করছি। তাও তোমার লগে এক দুইখান জিলাপি খামুনে। তুমি খাও, পেট ভইরা খাও।
আমি কথা না বইলা খাইতে শুরু করলাম।
খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনায় আমারে জিজ্ঞাসা করেন, তোমগো বাড়ি কোন গেরামে?
আমার ভিতরে তো তখন একটা শয়তান বাস করে! আমি তো তখন মানুষ আছিলাম না। মিছা কথা কইতে শুরু করলাম।
কদম বলল, এই গেরামের নাম কইলি না?
না।
কোন গেরামের নাম কইলি?
কইলাম আমার কোনও গেরাম নাই।
তিনায় অবাক, কী!
হ, গেরাম নাই, বাড়িঘর নাই।
কও কী!
হ।
তোমার মা-বাবা?
আমার মা বাবা ভাই বইন কেউ নাই।
কোনো আত্মীয়স্বজন?
তাও নাই।
তয় তুমি থাকো কই? খাও কী?
একেক গেরামের একেক বাড়িতে যাই, এতিম পোলা দেইখা তারা দুই চাইর দিন থাকতে খাইতে দেয়, বাড়ির কাম কাইজ করায়, তার বাদে খেদাইয়া দেয়।
তখন?
তখন অন্য গেরামে যাই, অন্য বাড়িতে থাকি ওই একই কায়দায়।
মানুষটা অবাক। তোমার মা-বাপের কথা তুমি কিছু জানোই না?
না।
কিছু শোনো নাই?
একটু একটু শুনছি।
কী শুনছ?
আমার জন্মের আগে বাপ মরছে, জন্মের দুই তিন বছর পর মায়। সে এক বাড়িতে কাজ করত। মায় মরণের পর ওই বাড়ির আরেকজন কাজের বুয়া আমারে কিছুদিন পালছে। তারপর থিকা আমি এই গেরাম ওই গেরাম ঘুরি। এই বাড়ি ওই বাড়ি থাকি। আমার মতন এতিম দুনিয়ায় কেউ নাই।
আমার কথা শুইনা তিনার চোখ ছলছল করে। আমার মাথায় পিঠে হাত বুলাইয়া বললেন, আহা রে, আহা!
এরপর বললেন, তয় তুমি আইজ আইলা কোন গেরাম থিকা?
গেরামের নাম বাণীখাড়া। আছিলাম এক বাড়িতে। সেই বাড়ির একজনে আমারে নাশতাপানি তো দেয়ই নাই, মাইরা বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিছে।
তিনায় আবার বললেন, আহা রে, আহা! এমুন মায়াভরা একটা পোলারে কেউ মারে! না খাওয়াইয়া রাখে! মানুষের কলিজায় মায়াদয়া নাই! তয়, তুমি অহন কী করবা, কই যাইবা?
জিলাপি খাইয়া আমার পেট ভইরা গেছে। কয়েক ঢোঁক পানিও খাইলাম। তার বাদে এক কাপ চা বড় মানুষের লাহান তিনার লগে ফুরুক ফুরুক কইরা খাইতে লাগলাম। চা খাইতে খাইতে কইলাম, আমার কিছু করনের নাই। কোনোখানে যাওনের জায়গা নাই।
আমার লগে যাইবা?
আপনেগো বাড়ি কই?
এখান থিকা বহুত দূর।
কোন গেরাম?
গেরামের নাম নারায়ণপুর।
সেইটা কোন জায়গায়?
কুমিল্লার মতলব থানায়।
যাইতে হয় কেমনে?
আমার নিজের নৌকা আছে। ছইওয়ালা নৌকা। দুইজন মাঝি আছে। আমি বাড়ি থিকা মাল নিয়া, নৌকা নিয়া বাইর হই। এক দেড় মাস দূর-দূরান্তের হাটে বাজারে মাল বেচাকিনা কইরা বাড়িত যাই। কিছুদিন বাড়িতে থাইকা আবার রওনা দেই। বাড়িতে আমার দুইজন দর্জি আছে। আমগো গেরামেরই লোক। আমি কাপড় কিনা দেই, তারা শার্ট প্যান্ট পায়জামা এই সব বানায়। লুঙ্গি গেঞ্জি আমি মতলব বাজার থিকা পাইকারি দরে কিনি। এইটাই আমার ব্যবসা। সংসারে আমার স্ত্রী আছেন আর একটা বিধবা বইন। বইনের একটা মাইয়া। তার বিয়া হইয়া গেছে। সে থাকে চাঁদপুরে। আমার সন্তানাদি নাই।
আমি কিছু না ভাইবা তিনারে কইলাম, আপনের লগে আমারে নিবেন?
তিনায় এককথায় রাজি। হ নিতে পারি। তুমি যাইবা?
যামু দেইখাই তো কইলাম।
সব সময় থাকবা আমার কাছে?
থাকুম।
চিন্তাভাবনা কইরা কইতাছ তো?
হ চিন্তা কইরাই কইতাছি। আমার দুনিয়াতে কেউ নাই। আপনের মতন একজন মানুষের লগে থাকুম, হাটে বাজারে ঘুরুম, আপনের লগে দোকানদারি করুম...
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনায় বললেন, তয় আমার লগে থাকলে তোমার খারাপ হইব না, বাজান। ভালোই হইব।
দোফরে মোল্লার ভাতের হোইটালে তিনায় আমারে ভাত খাওয়াইলেন। পয়লা আমি খাইয়া আসলাম, আইসা তার জায়গায় বসলাম, তার বাদে তিনায় খাইয়া আসলেন।
বিকালের দিকে হাট যখন ভাঙতেছে, মালসামান গুছাইয়া তিনার লগে আমি তার নৌকায় চড়লাম। মাঝি দুইজন খাওয়াদাওয়া কইরা নৌকায় শুইয়া ঘুমাইতাছিল। আমরা নৌকায় উঠার পর নৌকা ছাড়ল। তিনায় মাঝি দুইজনরে আমার কথা বললেন। এখন থিকা আমি তার লগে আছি, তার ছেলের মতন, এই সব বললেন।
আমার মনের মধ্যে তখন বিরাট এক আনন্দ। য্যান এক খাঁচা থিকা মুক্তি পাইছি। এখন মুক্ত স্বাধীন পাখি আমি। তিনার সঙ্গে দেশের এইদিক ওইদিক ঘুইরা বেড়ামু। কারবার শিখুম। একসময় হয়তো তার কারবারটা পুরাপুরি আমি দেখুম।
মনে আছে তোমার, মা? তুমি বললে, ওই বয়সেই এই সব ভাবলি তুই?
হ নানু, ভাবলাম।
বকুল বলল, ও ছোটবেলা থেকেই মহা পাকনা।
আমি বললাম, ট্যাটন, বিরাট ট্যাটন।
কদম বলল, তারপর কী হইল সেটা ক।
আমি বললাম, তার আগে বল, লোকটার নাম কী। তিনায় তিনায় করছিস, নাম বলছিস না কেন?
তিনার নাম মোসলেম মিয়া। নৌকায় চইড়াই টের পাইয়া গেলাম, বিরাট পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে কোরআন শরিফ পড়েন। অন্য সময় নৌকায় বসে হাদিস শরিফ পড়েন।
মা, তুমি বললে, কিন্তু তুই যে তোর মারে ছাইড়া অচেনা একজন মানুষের লগে রওনা দিলি, একবারও মার কথা মনে পড়ল না তোর? আমগো কারো কথা মনে পড়ল না?
পড়ছে। কিন্তু মায় আমারে মারছে, তার ওপরে বিরাট রাগ, বিরাট জিদ। মনে মনে খালি কই, তোমার কাছে আমি আর ফিরত আসুম না মা। কোনও দিন ফিরত আসুম না।
আর আমি! মা, আমি! আমি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছি তোমার কাছে। বাবাকে যেমন ভালোবাসি আমি, তোমাকে কি তার চেয়ে কম ভালোবাসি!
না মা, না। একদম না। একদম না।
তোমাদের দুজনার জন্যই আমার ভালোবাসা এক রকম। ছোটবেলায় হয়তো আমার আচরণে, বাবার জন্য অস্থিরতা দেখে তোমার মনে হয়েছে আমি আমার বাবার জন্য পাগল, তাঁকেই বেশি ভালোবাসি। তোমার জন্য টান কম।
না মা, না।
সেই যে মায়ের আত্মার গল্পটা তুমি বলেছিলে, সেদিন থেকে আমি তোমার জন্য ভিতরে ভিতরে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার কোলে সেই যে মুখ রেখে কেঁদেছিলাম সেই কান্নাটা তোমার কাছ থেকে দূরে গেলেই আমার বুক ঠেলে উঠত। মুন্সীগঞ্জে পরীক্ষা দিতে গিয়ে উঠেছে। ঢাকায় থাকার সময় উঠেছে, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেওয়ার সময় উঠেছে। তোমাকে আর আমার দেশকে আমি একাকার করে ফেলেছি। দেশের জন্য যুদ্ধ করা মানে আমার মায়ের জন্য যুদ্ধ করা। মায়ের মুখের হাসির জন্য যুদ্ধ করা।
আমার চোখজুড়ে তুমি, মা।
আমার হৃদয়জুড়ে তুমি।
তুমি আর বাবা। বকুল আর মায়া। আর মায়ার গর্ভে আমার সন্তান। এই কজন মানুষ নিয়েই তো আমি!
একটা সময় এ রকম ভাবনাই ছিল, মা। মুক্তিযুদ্ধ এই ভাবনা বদলে দিল। মা, শুধু এই পাঁচজন মানুষই আমার না, দেশের প্রতিটি মানুষ আমার। শুধু আমার মায়ের মুখের হাসির জন্য আমি যুদ্ধ করছি না, আমি যুদ্ধ করছি দেশের প্রত্যেক মায়ের জন্য, প্রত্যেক বাবার জন্য। দেশের প্রতিটি বোনের জন্য। শুধুই আমার স্ত্রী আর সন্তানের জন্য না, সব সন্তানের জন্য, প্রত্যেক স্বামী এবং স্ত্রীর জন্য। সাত কোটি মানুষের জন্য।
আমার মা দেশের প্রত্যেক মায়ের প্রতীক।
আমার বাবা দেশের প্রত্যেক বাবার প্রতীক।
বকুল দেশের প্রতিটি বোনের প্রতীক।
মায়া স্ত্রীর প্রতীক।
আর আমার ছেলে, যার শরীর এখনও পুরোপুরি তৈরি হয়নি, সে হবে অনাগত সব সন্তানের প্রতীক।
দেশের বুড়ো মানুষরা, শিশু কিশোররা, সব মানুষ আমার। আমি তাদের সবার জন্য যুদ্ধ করব। যুদ্ধ জয় করব, দেশ স্বাধীন করব।
কিন্তু তুমি চলে গেলে, মা। বাবা বকুল মায়া আর মায়ার গর্ভে আমার সন্তান কাউকে ওরা বাঁচতে দিল না। এই দুঃখ নিয়ে আমি বাঁচব কেমন করে? যুদ্ধ করব কেমন করে?
আমি বোধ হয় একটু দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, মা। বেশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছি।
না না, দুর্বল আমি হতে পারি না। যোদ্ধাদের দুর্বল হতে নেই। একদম দুর্বল হতে নেই। যোদ্ধারা সব রকমের পরিস্থিতির জন্য তৈরি। দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবনই তাদের কাছে তুচ্ছ।
না না, দুর্বল আমি হতে পারি না।
বারেকের কথা বলি। আবার বারেকের কথা বলি। এক মা এবং ছেলের কথা বলি।
মোসলেম মিয়ার নৌকায় চড়ে বারেক পাড়ি দিল অন্য এক জগতে। দশ বছরের বালকটির বুকভরা অভিমান। মা তাকে মারল কেন? ওই অভিমান নিয়ে অচেনা মানুষের সঙ্গে অজানা গন্তব্যে রওনা দিল।
একের পর এক মিথ্যা কথা বলে মোসলেম মিয়ার মন গলিয়ে ফেলেছিল সে। নারায়ণপুরে মোসলেম মিয়ার বাড়িতে এসে তাঁর স্ত্রী আর বিধবা বোনের মনও গলিয়ে ফেলল। বাড়ির বাইরের দিকে একটা একচালা টিনের ঘর। সেই ঘরে দুখানা সেলাই মেশিন নিয়ে শিশু কিশোরদের জামাকাপড় তৈরি করে দুজন দর্জি। মধ্যবয়সী মানুষ। ওই গ্রামেরই লোক। মোসলেম মিয়া মাসিক বেতনে তাদের রেখেছেন। একজনের নাম হাতেম, আরেকজন গাজী।
কী আশ্চর্য মা, দেখো, কোথাকার কোন হাতেম আর গাজী এসব নামও আমার মনে আছে। কত আগে বারেকের মুখে শোনা নাম, তাও ভুলিনি।
কেন ভুলিনি, মা? স্মৃতি এত প্রখর হয়ে গেছে কেন?
আবার ভুলেও যাচ্ছি কোনও কোনও ঘটনা।
পরিস্থিতি মানুষকে সত্যি খুব বিচিত্র করে তোলে। মোসলেম মিয়ার বেতনভুক্ত দর্জি হাতেম আর গাজীর নাম যেমন মনে আছে, মাঝি দুজনের নামও মনে আছে। একজনের নাম বদর, আরেকজন হচ্ছে কাদের।
কারণ আছে মা, সবার নাম মনে থাকার কারণ আছে। মানুষগুলো তো দেশের! দেশের মানুষের নাম মনে থাকবে না কেন? আমি কেন ভুলে যাব আমার দেশের মানুষের নাম!
আমার মা বাবার নাম কি আমি ভুলে যেতে পারি? বকুল মায়ার নাম ভুলে যেতে পারি!
সেই সন্ধ্যায় বারেক বলল, নৌকায় চড়নের পর থিকা তিনারে আমি খালুজান ডাকতে শুরু করছি। মাঝি দুইজনরে ডাকি ভাই। বাড়িতে আইসা তিনার স্ত্রীরে ডাকলাম খালাম্মা, বিধবা বইনরে ডাকি ফুবুম্মা। আর দর্জি দুইজনরে ডাকি মিয়াভাই। একদিনেই বাড়ির বেবাক মানুষ আমার আপন হইয়া গেল। দেখি, আরে এই বাড়ির বেবাক মানুষই ভালো। বেবাকতেই আমারে আদর করে। বুঝলাম বাড়ির কর্তা যদি ভালো মানুষ হয়, তাইলে অন্যরাও তার দেখাদেখি ভালো মানুষ হইয়া যায়। খারাপ মানুষও ভালো মানুষের লগে থাইকা ভালো হয়।
তয় খালুজান পরহেজগার মানুষ। তাঁর বাড়ির মানুষরাও পরহেজগার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সবাই। নামাজের ওয়াক্ত হইলে অজু কইরা আজান দেন খালুজান। কারখানা ঘরে মাদুর বিছাইয়া হাতেম আর গাজীরে নিয়া নামাজ পড়েন। ভিতরঘরে নামাজ পড়েন খালাম্মা আর ফুবুম্মা।
আমারে নিয়া বাড়িতে আসার পরই খালুজানে খালাম্মা, ফুবুম্মারে বললেন, এইবার আমি বাড়িতে থাকুম মাসখানেক।
খালাম্মা বললেন, এত দিন থাকবেন?
হ। মোবারকরে মানুষ করতে হইব।
মোবারক নামটা শুনে আমরা চমকালাম। অন্য কেউ কথা বলার আগেই পারুল বলল, মোবারক কেডা?
বারেক হাসল। এই নামটা কইতে ভুইলা গেছিলাম। খালুজানে হাটে বইসাই আমার নাম জিজ্ঞাসা করছিলেন। সত্য নামটা আমি কই নাই। বারেক নামটারে বানাইয়া কইছি মোবারক।
কদম বলল, ওই বয়সে এত পাকনা তুই পাকছিলি!
মা, তুমি বললে, আইচ্ছা ক, তারপর কী হইল?
খালুজানের কথা শুইনা খালাম্মায় হাসলেন। এক মাসের মইধ্যে এইটুকু একটা পোলারে মানুষ বানাইয়া ফালাইবেন?
হ বানামু।
ফুবুম্মা বললেন, কেমনে বানাইবেন মিয়াভাই?
দেখ কেমনে বানাই।
পরদিন থিকা খালুজানে আমারে দোয়া দরুদ মুখস্থ করাইতে লাগলেন। কায়দা, সিপারা পড়াইতে লাগলেন, আদর্শলিপি পড়াইতে লাগলেন।
আমি বললাম, পড়ালেখার জন্য বুয়া তোকে মারল আর তুই মোসলেম মিয়ার বাড়িতে গিয়ে পড়ালেখা শুরু করলি?
হ করলাম।
বকুল বলল, কেন?
খালুজানে এত মায়া কইরা, এত আদর কইরা সুরা মুখস্থ করাইতেন, এত আদর কইরা পড়াইতেন, সিলেট পেনসিল দিয়া লেখাইতেন, কী কমু আপনেগো! ভুল করলে একটুও রাগ করেন না। হাসেন। হাসিমুখে আবার পড়ান। রাগ বলতে কিছু নাই মানুষটার।
এক মাসের মইধ্যে আমি অজু কইরা আজান দেই। খালুজানের লগে ফজরের নামাজ পড়ি। অন্য ওয়াক্তের নামাজে মিয়া ভাইরাও থাকে। এক গেরামের মানুষ। সকাল দশটার দিকে কাজে আসে, যায় রাত্র নয়টার দিকে। দুপুরে খালুজানের বাড়িতে খায়, রাত্রে খায়।
খালুজানের অবস্থা ভালো। বাড়িটা বড়। চকে ফসলের জমি ম্যালা। ধান যা পায়, বছরেরটা তো চলেই, বিক্রি করেন অনেক। আর লগে আছে কাপড়ের ব্যবসা।
ওই বাড়িতে থাকতে থাকতে, খালুজানের লগে থাকতে থাকতে দেখি আমি কেমুন জানি বদলাইয়া যাইতাছি। নামাজ পড়তে ভালো লাগে, লেখাপড়া করতে ভালো লাগে। স্বভাবটাই বদলাইয়া যাইতাছে।
মা, তুমি বললে, তোর মার কথা মনে হইত না?
হইত। কিন্তু মার ওপরের রাগটা কমত না। যখনই মনে হইত, মনে মনে কইতাম, তোমার কাছে আর কোনও দিন ফিরত আসুম না। দুনিয়াতে আমার মা বাপ কেউ নাই। খালুজানেই আমার বাপ, খালাম্মাই আমার মা। আমি আর কেউরে চিনি না।
আইচ্ছা ক, তারপর?
মাসখানেক পর আবার নৌকা নিয়া বাইর হইল খালুজানে। লগে আমি আছি। আমারে লইয়া হাটে হাটে যান তিনায়। দোকানদারি করেন। নামাজের সময় আগে তিনায় নামাজ পড়েন, আমি দোকান চালাই। তার বাদে তিনায় আইসা বসেন, আমি নামাজে যাই।
তয় এত বিশ্বাস তিনায় আমারে করেন, আমিও তার বিশ্বাসের বরখেলাপ করি না। টাকা-পয়সার কোনও লোভ আমার নাই। ওই যে কইলাম আমি অন্য মানুষ হইয়া গেছি। ভিতরে ভিতরে বদলাইয়া গেছি।
বকুল বলল, পুরা বাজারে আসতি, এই বাড়িতে আসতি না কেন?
না না, পুরা বাজারে আর কোনও দিন আসি নাই।
তাই নাকি?
হ। তিনায়ই আর এইদিকে আসেন নাই।
কেন?
এইদিকে আসলে পুরান দিনের কথা মনে হইতে পারে আমার। মন খারাপ হইতে পারে। কোনও বাড়িতে যাইতে ইচ্ছা করতে পারে, এই জন্য।
বুঝেছি।
মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর এলাকায় আমরা আসতাম। শ্রীনগর গোয়ালিমান্দ্রা ভাগ্যকুল ষোলঘর ওই সব দিকে। এই দিকে আসতাম না। তবে ওই জীবনটা আমার বহুত ভালো লাইগা গেল। কিছুদিন বাড়িতে, কিছুদিন নৌকায় করে হাটেবাজারে। নৌকায় যখন থাকি খালুজানে সকালবেলা, সন্ধ্যাবেলা আমারে আরবি পড়ান, বাংলা পড়ান। সকালবেলার আলোয় আরবি পড়া শিখি, সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের আলোয় শিখি বাংলা পড়া। দিনে দিনে দিন গেল। কোরআন শরিফ পড়তে শিখলাম। ফজরের নামাজ পইড়া কোরআন তেলাওয়াত করি। আর দিনে রাইত্রে যখন সময় পাই হাদিস পড়ি, ইসলামী বই পড়ি। হাটবাজারে গেলেই এই সব বই কিনা আনি।
তখন মাঝে মাঝে মার কথা মনে হইত।
কোরআন হাদিসে মায়ের কথা এমনভাবে লেখা, পড়ি আর বুকটা মোচড়ায়। মনে হয়, আমার মায় কি বাঁইচা আছে, নাকি আমার শোকে মইরা গেছে!
কিছুদিন ধইরা এই সব কথা খুব মনে হয়। যখন মনে হয় তখনই বুক ফাইটা কান্দন আসে। রাত্রে গোপনে গোপনে কান্দি। মারে স্বপ্নে দেইখা কান্দি।
খালুজানে বুড়া হইছেন। আগের মতন কাজকাম করতে পারেন না। নৌকার জীবন তাঁর আর ভালো লাগে না। নারায়ণপুর বাজারে দোকান দিলেন। কাটা কাপড়ের দোকান। দোকান চালাই আমি। মাঝে মাঝে তিনি বসেন। দোকান বন্ধ কইরা রাত আটটার দিকে বাড়ি ফিরা আসি। আমার আলাদা ঘর হইছে। রাত্রে খাওয়াদাওয়া শেষ কইরা আমি আমার ঘরে হারিকেন জ্বালাইয়া ইসলামী বই পড়ি, বুখারি শরিফ পড়ি।
একদিন নবীজির সাহাবা আলকামার ঘটনা পড়তাছি। পড়তে পড়তে মনে পড়ছে আমার মার কথা। নিজে টের পাই নাই, চোখের পানিতে গাল ভাসতাছে। তখন কী কাজে খালুজানে আসছেন আমার ঘরে। দরজা খোলাই আছিল। আমারে কানতে দেইখা চমকাইলেন। কী হইছে রে বাজান, কান্দছ ক্যান?
নবীজির সাহাবা আর তাঁর মার কথা পইড়া কানতাছি, মনে পড়ছে নিজের মায়ের কথা। এই অবস্থায় মিছা কথা বলি কেমনে। সত্য কথাই বললাম।
পারুল বলল, কী কইলি?
কইলাম আলকামার আর তার মার ঘটনা পইড়া নিজের মার কথা মনে পড়ছে, খালুজান। মা বাপ লইয়া আমি আপনের লগে মিছা কথা কইছি।
কী? কী কইলি তুই?
হ।
খালুজানে আমার বিছানায় বসলেন। আমার কান্দে হাত দিলেন। সব আমারে খুইলা ক।
আমি কানতে কানতে তাঁরে সব কইলাম। শুইনা তিনায় আমারে বললেন, এইটা তুই কী করছস, বাজান? এইটা তুই কী করছস? মারে এমুন কষ্ট দিছস? কাইলই তুই যা। তোর মার খবর ল। তিনায় বাঁইচা থাকলে তাঁর পাও ধইরা মাফ চা। মায়ে মাফ না করলে তোর জায়গা হইব জাহান্নামে। যা বাজান যা, কাইল বিয়ানেই রওনা দে।
পরদিন আমি রওনা দিলাম। এই বাড়িতে আসতে দেড় দিন লাইগা গেল। নারায়ণপুর থিকা আইলাম মতলব। মতলব থিকা চাঁদপুর, চাঁদপুর থিকা মুন্সীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থিকা স্বর্ণগ্রাম।
বারেক একটু থামল। তারপর কাঁদতে লাগল। কিন্তু আইসা আমার কী লাভ হইল? মায় আমারে মাফ করল না। মায় আমারে বুকে টাইনা নিল না। মার কাছে আমি মরা। ঠিক আছে আমি আমার মার কাছে এগারো বছর আগে মইরা যাওয়া পোলাই থাকলাম। কাইল বিয়ানে চইলা যামু, আমার এই মুখ আমার মায় আর কোনও দিন দেখব না।
তখন, তোমার মনে আছে মা, তখন, আমরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বুয়া ঠাস করে বারেকের গালে একটা চড় মারল। এত জোরে মারল, আমরা চমকে উঠলাম। কেউ কিছু বলার আগেই দেখি বুয়া দুহাতে বারেকের মাথাটা জড়িয়ে ধরেছে বুকে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, এত পাষাণ তুই হইলি কেমনে? এত কষ্ট আমারে তুই দিলি কেমনে? এগারোটা বছর তোর লেইগা আমি কত কান্দন কানছি, তুই জানচ? একটা রাতইও আমি ঘুমাইতে পারি নাই। খালি তোর কথা মনে হইছে। পেটের পোলা হইয়া আমারে তুই এত কষ্ট দিলি?
বুয়াকে জড়িয়ে ধরে বারেকও তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও, মা। আমারে তুমি মাফ কইরা দেও।
বাবার পাশে তোমাকে রেখে দিচ্ছি, মা।
বাবা এক জায়গায়, তুমি আরেক জায়গায়, এমন ঘটনা আমরা কখনও দেখিনি।
মা, আগে বাবা যখন স্কুলের কাজে ঢাকায় গিয়ে থাকতেন সেটা অন্য ব্যাপার। পুরুষ মানুষ প্রয়োজনে, কাজেটাজে দু-চারদিন বাইরে থাকতেই পারে! কিন্তু তুমি বাবাকে ছেড়ে কখনও থাকতে চাওনি। একটি দিনের জন্যও থাকতে চাওনি। দু-চারদিন ঢাকায় গিয়ে থাকলেই অস্থির হয়ে যেতে বাবার জন্য। আমাকে আর বকুলকে বলতে, তোরা থাক। আমার ভালো লাগছে না। তোর বাবা কী খায় না খায়, তার শরীর ঠিক আছে কি না কে জানে। আমি কালই চলে যাব।
খালা তোমাকে নানা রকমভাবে বুঝিয়েও রাখতে পারতেন না।
আমি বকুল আর মায়া আড়ালে হাসাহাসি করতাম। মায়া বলত, খালুর জন্য খালার টান আশ্চর্য রকমের।
তারপর আমার দিকে তাকাত। তখন আমাদের সম্পর্ক একটু একটু তৈরি হচ্ছে। মায়া আমার দিকে তাকিয়ে বলত, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত।
আমি বুঝতাম, মায়া কী ইঙ্গিত করছে!
তোমাদের দুজন সারা জীবন যেভাবে থেকেছ, আজও সেভাবে পাশাপাশিই থাকো। একজন আরেকজনের ছায়া হয়ে থাকো। মরণও যেন বিচ্ছিন্ন করতে না পারে তোমাদের!
তার আগে, মা গো, তার আগে বারেককে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি। বুয়াকে নিয়ে আর কয়েকটা কথা বলি।
বারেককে ও রকম একটা চড় মেরে বুয়া যখন তার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে আর ওসব কথা বলছে, তখন আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। অদ্ভুত অনুভূতি। মনে হয়েছিল, আচ্ছা, বারেকের জায়গায় যদি হতাম আমি আর বুয়ার জায়গায় হতে তুমি, তাহলে তুমিও কি আমার সঙ্গে এমন আচরণই করতে? অমন জোরে ঠাস করে চড় মারতে আমার গালে! আমার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বুয়ার মতো করে কাঁদতে! আমিও কি তোমার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আর মাফ চাইতাম! অথবা বারেক ফিরে আসার পর বুয়া তার সঙ্গে যে রকম আচরণ করেছিল, তুমিও কি আমার সঙ্গে তাই করতে!
না, তুমি আমার সঙ্গে তা করতে না, মা। আমি ও রকম উধাও হয়ে গেলে এগারো বছর তুমি বেঁচেই থাকতে না। আমার শোকে পাগল হয়ে যেতে। মরে যেতে। আর আমিও তোমাকে ছেড়ে অমন করে উধাও হয়ে থাকতে পারতাম না, মা। আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে যেতাম, কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যেতাম।
কিন্তু এখন আমার কান্না আসছে না কেন, মা?
এখন আমার কান্না আসছে না কেন!
জানি, কারণটা আমি জানি। আমি এখন আর নিজের মধ্যে নেই। আমি এখন এক দিশাহারা এলোমেলো মানুষ! যে মানুষের মা বাবা বোন স্ত্রী আর স্ত্রীর গর্ভের সন্তান এ রকম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় সেই মানুষ কি আর মানুষ থাকে! মানুষের মতো মন অনুভব আর অনুভূতি থাক!
এতগুলো মাস তোমাদের ছেড়ে ছিলাম। ট্রেনিং ক্যাম্পে কোনো কোনো রাতে তোমাদের কাউকে কাউকে স্বপ্নে দেখতাম। বাবাকে বকুলকে মায়াকে আর তোমাকে। খুবই স্বাভাবিক সব স্বপ্ন। ওই সব স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙত, কয়েক মিনিট স্বপ্ন নিয়ে ভাবতাম, তারপর আবার ঘুমিয়ে যেতাম।
এক রাতে তোমাকে স্বপ্নে দেখলাম।
কী স্বপ্ন?
দেখি আমাদের বারবাড়ির সামনের আমগাছটার তলায় বসে তুমি কাঁদছ আর আমার নাম ধরে ডাকছ। রবি রে, আমার রবি। কতদিন হইয়া গেল তোরে আমি দেখি না বাজান। তুই কই আছস, কেমন আছস কিচ্ছু জানি না। তুই কী খাছ, কই ঘুমাছ, কিচ্ছু জানি না। আমার কলিজাটা তোর জইন্য পুইড়া যায়, বাজান। আমার জইন্য তোর কলিজা পোড়ে না? মার কথা মনে হয় না?
এই স্বপ্ন দেখে আমি বিছানায় উঠে বসলাম।
আমার দুই পাশে সার ধরে ঘুমাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা। ভোর চারটায় উঠে ট্রেনিং শুরু করব। এমন পরিশ্রমের কাজ সেটা, সারা দিন ট্রেনিং নেওয়ার পর রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় যাওয়া মাত্রই ঘুমে ঢলে পড়ি আমরা। কারো কোনও খবর থাকে না। কারো কারো নাক ডাকে, কেউ ঘুমায় নিঃশব্দে।
আমার নিঃশব্দে ঘুমানোর অভ্যাস।
স্বপ্ন দেখে উঠে বসেছি। বসার পর কোত্থেকে যে বুক ঠেলে উঠল কান্না। স্বপ্নে তোমার কান্নার দৃশ্য আর কথাগুলো ভুলতেই পারি না।
আমি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলাম, মা।
শিশুর মতো কাঁদতে লাগলাম।
পাশে শুয়ে সবাই ঘুমায়। কেউ টের পায় না আমার কান্না।
মা গো, সেদিনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যেমন করে পারি কমান্ডারকে ম্যানেজ করে একটি রাতের জন্য বাড়ি আসব। তোমাদের সবাইকে দেখে যাব। তোমাকে জড়িয়ে ধরে বলব, আমার জন্য যে তুমি কাঁদো আমি তা টের পাই, মা। বহুদূরে থেকেও টের পাই। স্বপ্নে তোমাকে কাঁদতে দেখে নিজেও কাঁদি।
নিশ্চয়ই তখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তুমি কাঁদতে, মা।
তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম আমি।
এই জীবনে সেই কান্না আমার জন্য তোমার আর কাঁদা হলো না, মা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হলো না আমার।
ওদের আমি কী বলে গাল দেব, মা!
পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গালও ওদের জন্য বেমানান।
কী গাল দেওয়া যায়!
কী গাল!
ওই যে বারেকের কথা বলছিলাম মা, সেই সব কথা বলাই হচ্ছে না!
বুয়ার চড় খেয়ে শেষ পর্যন্ত বারেক তার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও মা, আমারে তুমি মাফ কইরা দেও।
মাফ তো বুয়া তখনই করেছে যখন চড় মেরেছে!
সেই মুহূর্ত থেকে বারেক ফিরে গেল তার ছেলেবেলায়, শিশু বয়সে। তবে অন্য ছেলেবেলায়, অন্য শিশু বয়সে। মা ন্যাওটা শিশুর মতো সারাক্ষণ বুয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বুয়াকে কোনও কাজই করতে দেয় না, বুয়ার সব কাজ সে করে। পারলে রান্নাবান্নাটাও করে দেয়, মাছ কুটে দেয়, বাটনা বেটে দেয়। পারলে বুয়াকে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়।
এমন মাতৃভক্তি!
বাড়ির সবাই আমরা বিস্মিত হয়ে গেলাম!
বারেক পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে নামাজ পড়ে আর মায়ের সেবা করে।
একদিন আমাকে বলল, এগারোটা বছর যেই দুঃখ আমি আমার মারে দিছি, আমার মায় যতদিন বাঁইচা আছে, ততদিন তার সেবা এইভাবেই আমি করতে চাই।
আর ওই যে মোসলেম মিয়ার ওখানে তুই ছিলি, তাঁর প্রতিও তোর দায়িত্ব আছে। সেই ভদ্রলোক তোকে মানুষ করেছেন?
হ মামা, সেইটা ঠিক। তবে তাঁর কাছেও আমি যাব। যাব মার অনুমতি নিয়া। মায় অনুমতি দিলে যামু। তাঁর সেবাযত্নও করুম।
বারেককে অনুমতি দিয়েছিল বুয়া।
তার পর থেকে এক দুই মাস আমাদের বাড়িতে থাকে বারেক, এক দুই মাস গিয়ে নারায়ণপুরে থাকে। নিজের মায়ের পাশে থাকে, মোসলেম মিয়ার পরিবারের পাশে থাকে। এত নম্র ও বিনয়ী ভঙ্গিতে জীবন কাটায়, ভাবাই যায় না, এই সেই বারেক, যে ডাকাত হতে চেয়েছিল। মোসলেম মিয়ার মতো এক পরশপাথরের ছোঁয়ায় সে মানুষ হয়ে গেল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধও এক পরশপাথর, মা! দেশপ্রেম এক পরশপাথর। আর সবচেয়ে বড় পরশপাথর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের সাত কোটি মানুষকে তিনি মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র শিখিয়েছেন। দেশপ্রেমের মন্ত্র শিখিয়েছেন।
যে মানুষ নিজের দেশকে ভালোবাসে না, সে কি মানুষ!
যে মানুষের দেশপ্রেম নেই, সে কি মানুষ!
যে... ...গুলো পাকিস্তানি... ...দের দোসর হয়েছে সেগুলো তো মানুষ না, মা!
যারা এইভাবে মানুষ হত্যা করে তারা কেমন করে মানুষ হয়!
আমরা ওদের একটিকেও ছাড়ব না, একটিকেও না। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রে আমরা উজ্জীবিত। আমাদের কেউ 'দাবায়া রাখতে পারবে না'। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। আমার মাথায় বাঁধা পতাকা দেশের হাওয়ায় পতপত করে উড়বেই।
তোমার মনে আছে মা, আমার সেই জ্বরের সময়কার কথাটা তোমার মনে আছে?
আমার পরিষ্কার মনে আছে।
কতবারই তো জ্বরজ্বারি হয়েছে ছেলেবেলায়। কতবারই তো তুমি আমাকে কোলে নিয়েছ। কিন্তু আমার মনে পড়ে শুধু সেবারের কথা।
কত বয়স হবে আমার তখন? আট নয় বছর! নাকি দশ! মা, নাকি দশ বছর বয়স আমার!
তা-ই হবে। আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। হঠাৎ এমন জ্বর হলো! সেই জ্বর আর কমেই না। ডাক্তার কাকা দুই বেলা এসে দেখে যান। শিশিতে করে মিক্সচার দিয়েছেন। কমলা রঙের মিক্সচার। কাগজ কেটে সেঁটে দেওয়া হয়েছে শিশির গায়ে। কাগজটা বাঁকা করে কাটত ডাক্তার কাকার কম্পাউন্ডার। করে আঙুলের অর্ধেক মাপের হবে এমন জায়গায় একটি করে বাঁক। ওই বাঁককে বলা হতো 'দাগ'। দিনে তিনবেলা এক দাগ করে সেই তেতো মিক্সচার গিলতে হতো।
কী যে বিচ্ছিরি স্বাদ মিক্সচারের!
দাগ বলতে বোঝানো হতো ওষুধের মাপ।
কিন্তু ডাক্তার কাকার ওই মিক্সচারে আমার জ্বর কমছিল না। এক দুপুরে এমন জ্বর উঠল, জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগলাম। তুমি পাগলের মতো ছুটে এসে আমাকে কোলে নিলে। চিৎকার করে বুয়াকে ডাকলে। দৌড়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো বুয়া। আমাকে কোলে নিয়ে বসে রইলে তুমি আর বুয়া বদনার নল দিয়ে মাথায় পানি দিতে লাগল।
আমি চোখ বুজে তোমার কোলে নেতিয়ে আছি।
ততক্ষণে বাড়ির সবাই তোমার ঘরে। তুমি বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে আমার কপালে মুখে ফুঁ দিচ্ছ। বুয়া পানি দিয়েই যাচ্ছে।
কতক্ষণ!
এভাবে কতক্ষণ কে জানে!
একসময় চোখ মেলে তাকালাম আমি। অন্য কোনও দিকে না, অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম তোমার মুখের দিকে।
তুমিও তাকিয়ে আছ আমার মুখের দিকে। চোখ দুটো ছলছল করছে। বিড়বিড় করে তখনও দোয়া পড়ছ।
আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একসময় বললে, আল্লাহ রহম করো, রহম করো আল্লাহ। আমার বাজানরে রহম করো।
বুয়া আমার মাথায় পানি দিচ্ছিল। সেই পানিতে তোমার শাড়ি ভিজেছে।
মা, মা গো, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট লুঙ্গি। ওই সেদিনের মতো আমার মাথার পানিতে ভিজেছিল তোমার শাড়ি, আজ তোমার রক্তে ভিজেছে আমার শার্ট লুঙ্গি। কবরে নামাবার আগে কোলে নিয়েছি তোমাকে, তাকিয়ে আছি তোমার মুখের দিকে। চাঁদের আলোয় অনেকটাই পরিষ্কার তোমার মুখ। চোখ দুটো বন্ধ। সেখানে আবছামতো অন্ধকার।
আহা, তুমি যদি একবার তাকাতে আমার দিকে!
জ্বরের ঘোর কাটিয়ে আমি যেমন সেদিন তাকিয়েছিলাম তোমার মুখের দিকে, মৃত্যু কাটিয়ে তুমি যদি তাকাতে আমার দিকে! আল্লাহপাককে যদি আমি বলতে পারতাম, রহম করো আল্লাহ, আমার মাকে তুমি রহম করো।
এখন কোলে নেওয়ার পর আবার মনে হলো তোমার ওজন এত কমে গেছে কেন, মা?
তুমি খাওয়াদাওয়া করতে না ঠিকঠাকমতো!
নাকি আমার কথা ভেবে খাওয়া বন্ধ করেছিলে।
মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছে ছেলে! মেলাঘরে ট্রেনিং নিচ্ছে, ট্রেনিং শেষে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করছে পাকিস্তানি... ...দের বিরুদ্ধে। এ কথা তুমি জানতে। বাড়ির সবাই জানত। নিশ্চয়ই তোমার মনে হতো, সেখানে ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া হচ্ছে কি না আমার! পেটভরে তিনবেলা খেতে পাচ্ছি কি না আমি। হয়তো খেতে বসলেই আমার কথা তোমার মনে হতো আর ওসব ভেবে তুমি খেতে পারতে না।
আমি বুঝেছি মা, আমি বুঝেছি। আমার জন্যই তোমার ওজন কমে গেছে! আমার কথা ভেবেই তুমি ঠিকঠাকমতো খাওয়াদাওয়া করোনি।
কিন্তু আমি ভালো ছিলাম মা। আমি মোটামুটি ভালো ছিলাম। খাওয়াদাওয়া হতো আর কি!
দেশের এক কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে চলে গেছে ভারতে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে কী অবর্ণনীয় কষ্টে আছে তারা। অপুষ্টিতে ভুগে শিশুরা মারা যাচ্ছে প্রতিদিন। মানুষের কঙ্কালসার চেহারা। সেই তুলনায় ভালোই ছিলাম।
আমার কথা ভেবে কেন তুমি নিজেকে কষ্ট দিয়েছ, মা! বরং তোমার তো ভালো থাকার কথা ছিল। তোমার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। দেশ স্বাধীন করবে! এই নিয়ে তোমার তো অহংকার করার কথা!
অহংকার তুমি করেছ নিশ্চয়ই কিন্তু নিজের খাওয়াদাওয়ার কথা ভাবোনি।
এটা তোমার দোষ না, মা। তুমি হচ্ছো বাঙালি মায়ের প্রতীক। বাংলার প্রত্যেক মা-ই তোমার মতো। সন্তানের কথা ভেবে এমনই করেন তাঁরা।
এই দেখো মা, জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বাড়ির সামনের আঙিনা। সেখানে বাবাকে কবর দিয়েছি আমি। এখন দেব তোমার কবর। একটু একটু হাওয়া আসছে। ঝিঁঝি ডাকছে তাদের নিজস্ব নিয়মে। মাথার ওপর দিয়ে বাঁশঝাড়ের ওদিকে উড়ে গেল একটা বাদুড়। কোথায় যেন ডাকছে একটা ডাহুক পাখি।
আমাদের দিঘির ওদিকে?
হতে পারে।
আর কোনও শব্দ নেই কোথাও। শুধু অচেনা একটা ফুলের গন্ধ আসে হাওয়ায়। কোথায় কোন ঝোপে ফুটেছে বুনো ফুল, কে জানে!
মা গো, সেই কিশোর বয়সে বাবা আমাকে শিখিয়েছিলেন,
মনে রে আজ কহো যে
ভালোমন্দ যাহাই আসুক
সত্যরে লও সহজে
আমি সেকথা ভুলিনি। বাবা আর তুমি যখন যা বলেছ আমি মনে রেখেছি। যখন যা শিখিয়েছ, মনে রেখেছি। কিচ্ছু ভুলিনি।
কিন্তু আমি আমার মনকে আজ কী করে বলি, কী করে এই সত্য মেনে নিই, বাবা নেই, তুমি নেই। আমার বকুল নেই, মায়া নেই। আমার স্বপ্নের সন্তান নেই। আমার জীবনে আর কিছু নেই, কিচ্ছু নেই। আমার মতো দুঃখী মানুষ আর কে আছে, বলো মা, কে আছে!
আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে, আমার সব ভালোলাগা শেষ হয়ে গেছে। এখন থেকে আমার আর দিন থাকবে না, রাত থাকবে না। এখন থেকে বাবা থাকবে না, মা থাকবে না, বোন থাকবে না, মায়াকে নিয়ে জীবনের বাকি দিনগুলো থাকবে না!
আমি কার কাছে ফিরব, মা! কার কাছে যাব!
আমার পায়ের তলায় বাংলাদেশের মাটি থাকবে, স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি, মাথার ওপর যে আকাশটুকু থাকবে তাও আমার নিজস্ব আকাশ, বাংলাদেশের স্বাধীন আকাশ। হাওয়া থাকবে, রোদ্র ছায়া থাকবে। গ্রীষ্ম ফুরিয়ে বর্ষা আসবে, শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত আসবে। বনে বনে ফুটবে বসন্তের ফুল। গানে গানে মুখর হবে পাখিরা। তিল ফুলের মধু নিতে শস্যের মাঠে ছুটবে মৌমাছির দল, হলুদ শর্ষে ফুলে ভরে যাবে বাংলার মাঠ, ধানিবিল সবুজ সোনালি হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। বাঁশবন শনশন করবে হাওয়ায়। ফুলের গন্ধে ঘুম আসবে না। বর্ষার নিঝুম বৃষ্টিতে দিনের বেলাই অন্ধকার হবে চারদিক। কোনও ফুল ঝরে যাবে অন্ধকারে। সেই কবিতার লাইন মা, সেই কবিতার লাইন। 'কী ফুল ঝরিল অন্ধকারে'।
শরতের আকাশ তোমার শাড়ির আঁচলের মতো নির্মল হবে। নীল আকাশে ভাসবে সাদা মেঘের ভেলা। রজতরেখার তীর সাদা হবে কাশফুলে। আমার চোখের পানির মতো নিঃশব্দে ঝরবে কাশের রেণু। হেমন্তে বইবে উত্তরে হাওয়া। শীতের কুয়াশা নামবে এই বাংলায়। কুয়াশা সরিয়ে একটু বেলা করে উঠবে সূর্য। আড়মোড়া ভাঙবে গাছের পাতা আর ঝোপঝাড়, ঘাসের ডগায় জমবে শিশুর চোখের কোণে জমে থাকা কান্নার মতো একটুখানি শিশির। সেই শিশির ঝরে পড়বে মাটিতে। ভাঁড়ে করে খেজুরের রস নিয়ে আসবে গাছিরা। খেজুরের গাছে পাতা রসের হাঁড়িতে ঠোঁট ডুবাবে ভোরবেলার বুলবুলি।
স্বাধীনতা আসছে। বাংলার স্বাধীনতা। যেন এই বাংলায় আসছে দুরন্ত এক বসন্তকাল। বসন্তের হাওয়ায় দেশগ্রামের চারদিকে ভাসবে ফুলের সুবাস। বসন্ত জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হবে রাতের গ্রামবাংলা।
ওরকম জ্যোৎস্না রাতে আমি হয়তো একাকী বাড়ি ফিরতে চাইব। আমার হয়তো মনে হবে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে আমার মা, বাবা আছেন, বকুল তাকিয়ে আছে তার জানালা দিয়ে, মায়া অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছে সামনের উঠানে। বিকালের লঞ্চে আসার কথা। রাত তো হবেই। পূর্ণিমা সন্ধ্যায় এই বাড়িতে না ফিরে কি আমি পারি!
সেই অপেক্ষায় থাকবে সবাই।
মা, আজ থেকে কেউ কোথাও আমার জন্য অপেক্ষা করবে না। না বাবা, না তুমি। না বকুল, না মায়া। আমি একাকী এক দুঃখী মানুষ শ্রাবণ রাতের জ্যোৎস্না দেখে কাঁদব। আষাঢ়ের বৃষ্টি হবে চোখের পানি। যতদিন বেঁচে থাকব ততদিন আমার চোখের ভিতরটা হয়ে থাকবে বর্ষাকালের রজতরেখা।
মা, গ্রীষ্মের ছুটি হবে কয়েক দিন পর। আম কাঁঠালের ছুটি। তার আগেই এমন গরম পড়তে শুরু করেছে। বিকালের মুখে মুখে ছুটি হয়েছে স্কুল। বাড়ি থেকে তেমন দূরের পথ না। তবু ওইটুকু পথ হেঁটে এসে ভালো রকম ঘেমেছি। দরজায় দাঁড়িয়ে আছ তুমি। আমার জন্য অপেক্ষা করছ। কখন স্কুল ছুটি হবে, কখন ফিরবে তোমার ছেলেটি। যেই আমি ফিরেছি, তুমি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেছ আমাকে। কী যে মমতায় আঁচলে মুছিয়ে দিয়েছ মুখখানি! মাথাটা বুকে জড়িয়ে বলেছ, আহা রে আমার সোনা, আমার মানিক। গরমে কষ্ট পাইছ, বাজান! আসো তোমার হাতমুখ ধোয়াইয়া দেই, ভাত খাওয়াইয়া দেই।
ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার বয়স পর্যন্ত নিজ হাতে আমাকে তুমি ভাত খাইয়ে দিতে। এ নিয়ে বাবা হাসাহাসি করতেন। ছেলেটাকে তুমি বড় হতে দেবে না।
তুমি রেগে যেতে। মায়ের কাছে ছেলে আবার বড় হয় কেমনে? ছেলে সব সময়ই থাকে মায়ের আঁচলের তলায়।
মা গো, তোমার সেই আঁচল আমি কোথায় পাব! কে আমাকে ফিরিয়ে দেবে তোমার আঁচলখানি।
বড় হয়ে যাওয়ার পরও, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ি, বাড়ি এলে তুমি সেই ছেলেবেলার মতো প্রথমেই আঁচলে মুছিয়ে দিতে মুখ। আমার মাথাটা কিছুক্ষণ জড়িয়ে রাখতে বুকে।
একদিনের কথা মনে পড়েছে।
ছেলেবেলার কথা। আষাঢ় মাস। কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আমাকে নিয়ে তুমি গেছ বাগানের দিকটায়। ওদিককার কদমগাছগুলো ফুলে ফুলে ভরে গেছে। আমিই টেনে নিয়ে গেছি তোমাকে। চলো মা, কদম ফুল দেখে আসি।
তখনও বকুল হয়নি।
কত বয়স আমার! ছয় সাড়ে ছয়।
আমাকে নিয়ে তুমি কদম বাগানে গেছ। হঠাৎ নামল বৃষ্টি। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বরজ্বারি হয় না। তবু তুমি এমন দিশাহারা হলে, কী করে বৃষ্টির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করবে প্রথমে বুঝতে পারলে না। তারপর শাড়ির আঁচলে আমার মাথা ঢেকে, আমাকে জড়িয়ে ধরে দরদালানের দিকে দৌড় দিলে। যেন তোমার আঁচল বৃষ্টি থেকে বাঁচাবে আমাকে। যাবতীয় বালা মুসিবত থেকে বাঁচাবে।
বিয়ের দিনও আঁচল দিয়ে তুমি আমার মুখ মুছিয়ে দিয়েছিলে, মা।
আমাদের বিয়ে হলো ফেব্রুয়ারি মাসে। তখনও শীতকাল পুরোপুরি শেষ হয়নি। আমি শেরোয়ানি পরেছি, ঘি রঙের শেরোয়ানি। সাদা চোস্ত পায়জামা, পায়ে নাগরা, মাথায় পাগড়ি, মুখটা একটু বোধ হয় ঘেমেছিল। ওই অবস্থায় আঁচলে চেপে চেপে তুমি আমার মুখ মোছালে।
তোমার আঁচলের ছোঁয়া আমার সারা মুখে মা, তোমার আঁচলের ছায়া আমার মাথায়, আমার জীবনজুড়ে। তোমার সেই আঁচল আজ রক্তাক্ত। আমার জীবন থেকে চিরতরে সরে গেল তোমার আঁচলের ছায়া।
এই ছায়াটুকুর জন্য আমি কার কাছে যাব, মা?
বিয়ের পর মায়াকে নিয়ে বাড়িতে ফিরেছি। খেজুরতলায় গিয়ে অপেক্ষা করছিল বকুল কদম বুয়া পারুল আশপাশের বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়ে অনেকেই। বারেকও ছিল। বিকালবেলা। ঢাকা থেকে আসতে হয় সদরঘাট থেকে লঞ্চে মুন্সীগঞ্জ। মুন্সীগঞ্জ থেকে রিকশায় কাটাখালী। কাটাখালী থেকে লঞ্চের মতো ছোট ছোট স্পিডবোট আসে দীঘিরপার পর্যন্ত। মাঝখানে পুরা খেজুরতলায় আরও কোথাও কোথাও থামে।
খেজুরতলা থেকে বাড়ি এলাম আমরা।
মায়ার জন্য পালকির ব্যবস্থা ছিল। মায়া এলো পালকি চড়ে, আমি সবার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে। বাড়ি আসার পর বউকে পালকি থেকে কী নামাবে তুমি, ছুটে এলো আমার কাছে। সেই ছেলেবেলার মতো আঁচলে আমার মুখ মুছিয়ে দিতে লাগলে। যেন ভুলেই গেলে ছেলে তোমার বিয়ে করেছে এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে। ঘটা করে বিয়ে হয়েছে ঢাকায়। তোমরা সবাই তখন ঢাকাতেই ছিলে। দুই বোনের ছেলেমেয়েতে বিয়ে হচ্ছে। এক বাড়িতেই সবকিছু, বিয়ের অনুষ্ঠান, বৌভাত। দুই বোনের তো একই বাড়ি।
তারপর কয়েক দিন ঢাকায় থেকে তোমরা চলে এসেছিলে বাড়িতে। মায়াকে নিয়ে আমি এলাম আরও কয়েক দিন পর।
বউ বাড়ির উঠানে, তখনও বসে আছে পালকিতে আর তুমি আঁচলে মুছাচ্ছ ছেলের মুখ, পালকিতে বসেই মায়া হাসতে লাগল। বাবা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, এই বয়সে এভাবে ছেলের মুখ মোছাতে হবে না। পালকি থেকে বউ নামাও।
তখন তোমার খেয়াল হলো, আরে তাই তো! তুমি মায়াকে নিয়ে ব্যস্ত হলে।
কিন্তু মা, আমার ভালো লেগেছিল। আমার খুব ভালো লেগেছিল। যত বড়ই হয়ে থাকি, তোমার কাছে এলেই আমি শিশু। মনে মনে অপেক্ষা করি আমার মাথাটা তুমি বুকে জড়িয়ে ধরো। ঘাম না থাকলেও মুখটা আঁচলে মুছিয়ে দাও।
মায়া এই বাড়িতে, ওই তো বিয়ের পরের ওই দিলগুলোর কথাই বলছি। সকালবেলা আমরা সবাই নাশতা করতে বসেছি, বাবা হাসতে হাসতে বললেন, রবি বড় হয়েছে, বাড়িতে বউ এসেছে, এখন আর ছেলে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।
তুমি বাবার দিকে তাকালে। কিয়ের বাড়াবাড়ি?
ওই যে আঁচলে মুখটুখ মোছানো!
তুমি একটু রাগলে। আমার ছেলের মুখ আমি মোছাইয়া দিলে অন্য কেউর কোনও অসুবিধা আছে?
না তা নেই, কিন্তু ছেলে বড় হয়েছে তো!
তখন তুমি একটা গল্প বললে। ছেলে বিয়ে করিয়ে বাড়িতে বউ এনেছেন এক মা। ছেলের ঘরে নাতিও হয়েছে। ছেলের বউ এক রোদেলা দিনে ছেলেকে বলল, উঠানের কোণে আমি ফুলের চারা লাগাব, মাটি পরিপাটি করো।
বউয়ের কথায় কাজে লেগে গেল ছেলে। কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে ফুলের চারা লাগাবার উপযুক্ত করতে লাগল উঠানের এক কোণ। গরমের দিন। কোদাল চালাতে চালাতে ঘেমে একেবারে নেয়ে গেল ছেলে।
মা তাকিয়ে তাকিয়ে এই দৃশ্য দেখছিলেন। একটা সময়ে তাঁর আর সহ্য হলো না। বউ ছেলের ঘরে ঘুমাচ্ছে তাদের ছোট্ট শিশুটি। তিনি সেই ঘরে ঢুকে নাতিকে কোলে নিয়ে উঠানের রোদে এলেন। শিশুটিকে শুইয়ে দিলেন রোদে গরমে ভেসে যাওয়া উঠানের মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘর থেকে চিৎকার করে ছুটে এলো ছেলের বউ। হায় হায়, এটা কী করেছেন আম্মা। আমার ছেলে তো গরমে অস্থির হয়ে যাবে।
শাশুড়ি বললেন, তোমার ছেলে ছেলে! আমার ছেলে ছেলে না! সে যে রোদে গরমে কষ্ট পাচ্ছে এটা আমি সহ্য করি কেমন করে? তুমি তো এক মিনিট নিজের ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারলে না!
সেই ছেলে বউয়ের কথায় বাড়ির উঠানে কোদাল চালাচ্ছিল, বউ মোরগফুল, দোপাটি বেলি এসবের চারা লাগাবে। আর আমি কোদাল চালাচ্ছি আমার মায়ের কবর খোঁড়ার জন্য। হায় রে আমার নিয়তি।
মনে আছে, মা। তোমার বলা গল্পটা আমার মনে আছে।
গল্প শুনে বকুল তাকিয়েছিল মায়ার দিকে। মায়ের গল্পের অর্থ বুঝেছ, মায়াপা! তোমাকে কিন্তু যা বোঝাবার বুঝিয়ে দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ছেলেকে কষ্ট দিয়ো না।
মায়া মাথা নিচু করে বসে রইল।
আরে, দেখো মা আমি কী করেছি! তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে কতটা সময় চলে গেছে খেয়ালই করিনি। তোমার কবরের পাশে নিজের অজান্তেই খুঁড়ে ফেলেছি বকুলের কবর। দুটো কবরের কাজ শেষ করেছি। ঘামে জবজব করছে মুখ, গলা বুক পিঠ। মা গো, ওই তো তোমার আঁচল লুটাচ্ছে উঠানের মাটিতে। আমার মুখটা একটু মুছিয়ে দাও না, মা! আমার মাথাটা একটুখানি জড়িয়ে ধরো না তোমার বুকে।
মা গো, স্কুল মাঠের দক্ষিণ কোণে বিশাল বটগাছ। টিফিন পিরিয়ডে সেই বটের ছায়ায় বসে কত দুপুর গল্প করে কাটিয়েছি আমি আর বাচ্চু। বড় হয়ে, কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় কোনও কোনও জ্যোৎস্না রাতে কদমকে নিয়ে চলে গেছি ওদিকটায়। রজতরেখার তীরেও ঘুরে বেরিয়েছি। আজকের পর সেই জীবনে আমার আর কখনও ফেরা হবে না।
এই যে এখন আমি তোমাকে কবরে শোয়াচ্ছি মা, আমার বুক ফেটে যায়, চোখ ফেটে যায়। তোমার রক্ত মাখা আঁচলে আমি আমার মুখটা একটু মুছি, মা? আমার চোখের পানিটা একটু মুছি?
মা গো, স্কুল মাঠের বটতলায় গেলে আমি দেখতে পাব তোমার আঁচলের ছায়া। বটের তলায় শুয়ে পড়লে মনে হবে আমি চলে গেছি আমার শিশু বয়সে, শুয়ে আছি তোমার আঁচলের তলায়। আমার তখন চোখ ভেসে যাবে চোখের পানিতে। স্বাধীন বাংলার রোদেলা দুপুরে বটের ছায়ায় শুয়ে তোমার জন্য চোখের পানিতে ভাসব আমি।
কোনও কোনও বিষণ্ন বিকালে রজতরেখার তীরে একাকী হাঁটতে হাঁটতে নদীর হাওয়ায় পাব তোমার আঁচলের ছোঁয়া। আমার বুক হু হু করবে, চোখ ভেসে যাবে। নদীটি তোমার মতো গভীর মমতায় তার হাওয়ায় আঁচলে মুছিয়ে দেবে চোখের পানি।
তুমি নেই, আমার জন্য রইল আমার বাংলা মা।
যেসব বই ও পত্রপত্রিকার সাহায্য নেওয়া হয়েছে
১. 'মুক্তিযুদ্ধে নারী'- মালেকা বেগম
২. '২ নম্বর সেক্টর এবং কে ফোর্স কমান্ডার খালেদের কথা'- সম্পাদনা : মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
৩. 'একাত্তরের কন্যা জায়া জননীরা'- মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
৪. 'একাত্তরের বধ্যভূমি'- মো. জয়নাল আবেদীন সম্পাদিত
৫. 'একাত্তরের গণহত্যা ও নারী নির্যাতন'- আসাদুজ্জামান আসাদ
৬. ফতেহ আলী চৌধুরীর ভাষ্য- 'মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়'- জহিরুল ইসলাম
৭. জহির উদ্দিন জালালের ভাষ্য- 'মুক্তিযুদ্ধে মেজর হায়দার ও তাঁর বিয়োগান্ত বিদায়'- জহিরুল ইসলাম
৮. 'সোহাগপুরের বিধবাদের চোখে আনন্দাশ্রু'- প্রথম আলো, ১০ মে ২০১৩
৯. 'চুকনগর গণহত্যা দিবস'- সুরঞ্জিত বৈদ্য, দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ মে ২০১৩
১০. 'মুক্তিযুদ্ধে বিক্রমপুর'- মো. জয়নাল আবেদীন
১১. 'দেশকে ভালোবাসা ইমানি দায়িত্ব'- মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান, প্রথম আলো, ২৯ মার্চ ২০১৩
বাংলা শুধুই বাংলা: আমার মায়ের আঁচলখানি ইমদাদুল হক মিলন >>>>> Download Now
ReplyDelete>>>>> Download Full
বাংলা শুধুই বাংলা: আমার মায়ের আঁচলখানি ইমদাদুল হক মিলন >>>>> Download LINK
>>>>> Download Now
বাংলা শুধুই বাংলা: আমার মায়ের আঁচলখানি ইমদাদুল হক মিলন >>>>> Download Full
>>>>> Download LINK