হাসিবুর রহমান।। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তবে স্বাধীনতার ঘোষক বা প্রথম রাষ্ট্রপতি এ বিষয়টি একেবারেই হাস্যকর ও অনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। একইসাথে তাঁরা বঙ্গবন্ধু-জিয়ার তুলনাকেও অবান্তর বলে মত দিয়েছেন।
দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়া না বঙ্গবন্ধু? এ আলোচনা ইতোমধ্যেই বেশ ডালপালা মেলেছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তর্কযুদ্ধে লিপ্ত-একদল বলছে জিয়া মুক্তিযোদ্ধাই ছিল না আর অন্য দল বলছে জিয়াউর রহমান শুধু মুক্তিযোদ্ধাই ছিল না দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতিও তিনি।
সাম্প্রতিক এ বিতর্কের বিষয়ে নিউজনেক্সটবিডি ডটকমের সাথে কথা হয় দেশের বিশিষ্টজনদের। তাদের বক্তব্য এ আলোচনা বা বিতর্কে হয়তো আমাদের কিছুটা আলোর সন্ধান দেবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসাইন বলেন, “নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা দেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। যে সরকারে প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে জিয়াউর রহমানের প্রশ্ন কোথা থেকে আসে। জিয়া দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এটা একইসাথে হাস্যকর ও অনৈতিক বক্তব্য”।
তিনি আরো বলেন, “উপরন্তু, পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা জিয়া দেশের ক্ষমতা দখল করে যা ছিল অসাংবিধানিক। যা বর্তমানে স্বীকৃতি পেলেও তিনি দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এটা রাজনৈতিক ফাঁকাবুলি ছাড়া আর কিছুই নয়।”
অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. এ কে মনোয়ার উদ্দিন বলেন, “জিয়াউর রহমান নিজে কখনো স্বাধীনতার ঘোষক বা রাষ্ট্রপতি দাবি করেননি। এমনকি তিনি ২৬ মার্চ যখন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন, তখন তিনি বলেছেন ‘on the behalf of our great leader Shekh Mujibur Rahman’। এরপর তো আর কোন কথা থাকতে পারে না। তাছাড়া কেউ রেডিও বা টেলিভিশনে নিজেকে রাষ্ট্রপতি দাবি করলেই তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে যান না।”
প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশ স্বাধীনের পেছনে একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে- এটা একদিনে হয়নি, একদিনে হয়ও না। আর স্বাধীনতার রাজনৈতিক আন্দোলনের কোথাও জিয়াউর রহমান ছিলেন না, দেশের জনগণ তাকে জানত না। তিনি হঠাৎ করে একটি ঘোষণা দিয়েই দেশের প্রধান হয়ে যাবেন– এটা সম্ভব না।”
“বঙ্গবন্ধুর সাথে জিয়ার তুলনা হল রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সাথে নেংটি ইঁদুরের তুলনার শামিল”
তিনি আরো বলেন, “একাত্তরের আগ পর্যন্ত যত রাজনৈতিক ঘটনা আছে তা একটু একটু করে শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত করেছে। তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল গোটা দেশ। তিনি ৭ মার্চ তা অনেকাংশে পূরণ করেন আর ২৫ মার্চ রাতে তিনি না পালিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে তা সম্পূর্ণ করেন।”
বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশীদ বলেন, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মূলত সেনাবাহিনীর শৃংখলা ভঙ্গ করেছিলেন, এ অপরাধে তার কোর্ট মার্শাল হতে পারত। ১৮৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করায় এক মেজরের কোর্ট মার্শাল হয়েছিল। একই অপরাধ জিয়াউর রহমান করেও বেঁচে গেছেন যে তার কোর্ট মার্শাল হয়নি। কেননা তারা যে কাজটি করেছেন তার কোন বৈধ অধিকার বা আইনগত ভিত্তি তাদের ছিল না। তবে তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।”
প্রথম রাষ্ট্রপতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেশের প্রথম সাংবিধানিক সরকার হল ৭০ এর নির্বাচনে জয়ী প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত মুজিবনগর সরকার। যে সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জিয়ার এখানে রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রশ্নই অবান্তর। আর রাষ্ট্রপতি হয়ে কি দেশ তিনি একাই চালিয়েছিলেন? রাষ্ট্রপতি হওয়া তো দূরে থাক তার তো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার বৈধতাই ছিল না।”
রফিকুল ইসলামের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হারুন অর রশীদ বলেন, “এটা একটা দলকানা ব্যাখ্যা যার কোন ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক ভিত্তি নাই। তিনি মূলত তার নেত্রীর বলা একটা মিথ্যাকে ঢাকতে আরো একগাদা ভুল কথা বলেছেন।”
প্রসঙ্গত, বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তারেক রহমান ২৬ মার্চ লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে বলেন, জিয়াউর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। এর একদিন পর ঢাকায় জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের এক অনুষ্ঠানে তার মা ও দলটির প্রধান খালেদা জিয়াও একই দাবি তোলেন। আর শুক্রবার সকালে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যরিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়াঁ এক মানববন্ধনে খালেদা জিয়া ও তারেকের বক্তব্যের স্বপক্ষে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
নিউজনেক্সটবিডি ডটকম/এইচআর/রক
No comments:
Post a Comment