সৌদি রাজতন্ত্র বনাম মুসলিম ব্রাদারহুড
ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমিরিটাস মন্ট পলমার লিখেছেন, ‘স্পষ্টতই আরব জাহান জয় করার জন্য ব্রাদারহুডের অস্ত্র ছিল গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বড় ভয় সৌদি আরবের। মিশর ও তিউনিসিয়ার মত সৌদি আরবে যদি একবার অবাধ নির্বাচন হয়, তবে সৌদি রাজতন্ত্র ইতিহাসের পাদটীকায় পরিণত হবে।’
এশিয়া টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত Egypt becomes battleground for Arab world
শিরোনামের এক নিবন্ধে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। মন্ট পলমার বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির দা সেন্টার ফর আর্যাবব অ্যান্ড মিডল ইস্টার্ন স্টাডিসের সাবেক পরিচালক এবং দা আল আহরাম সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো।
তার লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো;
সৌদি রাজতন্ত্র মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ মুসলিম ব্রদারহুড সুন্নী মুসলিম বিশ্বে একটি ব্যাপক জনপ্রিয় দল। তার শাখা প্রশাখা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্বজোড়া বিস্তৃত।সৌদি রাজতন্ত্র শুধু ব্রাদারহুডকে শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠনই বলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং এটাকে তালিকার শীর্ষে রেখেছে। এমনকি সৌদি সরকারের কাছে আল কায়েদাও ব্রাদারহুডের চেয়ে ভয়াবহ নয়।
সম্ভবত সৌদি আরবের কাছে এর বিকল্পও কিছু নেই। ২০১১ সালের আরব বসন্তের ফলশ্রুতিতে মিশর ও তিউনিসিয়ায় ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। এতে রাজ পরিবার ভয় পেয়ে যায় যে, হয়তো সৌদি হবে পরবর্তী টার্গেট। এটা হচ্ছে সম্পদশালী কিন্তু দুর্বল শাসকগোষ্ঠীর ভয়। কারণ তারা মুক্ত গণমাধ্যম ও নির্বাচন দিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত শোনার ক্ষমতা রাখে না।
মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে লড়ার করার জন্য সৌদি রাজতন্ত্র মিশরকেই রণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর পেছনে কারণটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিশরেই এবং এর সর্বোচ্চ পথপ্রদর্শকরা সবাই মিশরীয়। আঞ্চলিক প্রতিনিধিরাই সাধারণত এর শাখা প্রশাখাগুলোর দায়িত্বে থাকে কিন্তু এর নীতি এবং সিদ্ধান্ত প্রবাহিত হয় মিশর থেকে।
এ কারণে সৌদি আরব এটা ভালো করেই জানে যে, শাখাগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা বৃথা। কারণ মিশর থেকেই এর নেতৃত্ব জারি থাকে। তাছাড়া ব্রাদারহুডের শাখাগুলোতে হামলা করলে সৌদির বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতি হতে পারে। জর্দান, কুয়েত এবং অন্যান্য জোটভুক্ত দেশগুলোতেও ব্রাদারহুডের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। তার চেয়ে মিশরেই ব্রাদারহুডকে শেষ করে দিতে পারলে তার অন্তরাত্মা মরে যাবে। এর ফলে দূর থেকেই যুদ্ধ শেষ হবে এবং স্বঘোষিত ইসলামের হেফাজতকারী সৌদি রাজতন্ত্রের হাতে রক্তের দাগ লাগবে না। কার্যত মিশরীয় জেনারেলদের ভাড়া করে তারা নিজেরা লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত না থেকেও পারছেন।
শুধু ব্রাদারহুডকর্মীরাই যে সৌদি রাজতন্ত্রকে আতঙ্কে ফেলে দিয়েছিল তাই নয়, বরং নির্বাচিত হয়ে ব্রাদারহুড যে নীতি অনুসরণ করে সেটাও ছিল সৌদি আতঙ্কের কারণ। সৌদি রাজতন্ত্রীদের মতে ব্রাদারহুড মিশরীয় সরকারের মাধ্যমে আরব জাহানে বাস্তবধর্মী ও প্রগতিশীল ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।এটা সৌদি রাজতন্ত্র এবং ইসলামের কট্টরপন্থি ওয়াহাবি মতবাদ-উভয়ের জন্যই ছিল সরাসরি হুমকি। এর ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে সৌদি রাজতন্ত্র। সুন্নী মুসলিম বিশ্বে সৌদি রাজতন্ত্রের সুরক্ষা দিচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদ। ব্রাদারহুড যতই মধ্যপন্থি ও বাস্তবভিত্তিক ইসলামের প্রসার ঘটাতে পারবে সৌদি রাজতন্ত্র ততই দুর্বল হবে।
মুসলিম বিশ্বের ওপর সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বিপদের কারণ আল-আজহার। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্রাদারহুডের ইসলামের বাস্তবভিত্তিক ও প্রগতিশীল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।
সৌদি আরব মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান মক্কা ও মদীনা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ব্রাদারহুড মুসলিম বিশ্বে সুন্নী ইসলামের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আল আজহার নিয়ন্ত্রণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
উপসাগরে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষক কাতার উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের আধিপত্য ভাঙার জন্য ব্রাদারহুডের নিয়ন্ত্রণকে কাজে লাগাতে চায়। তবে এটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাধাও রয়েছে। সৌদি আরবের অর্থায়নে পরিচালিত মিশরের ব্রাদারহুড বিরোধী গণমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালায় যে, ব্রাদারহুড আল আজহার নিয়ন্ত্রণ করছে।আল আজহারে ব্রাদারহুডকে শক্তিশালী করতে কাজ করছে কাতার। কাতার চাচ্ছে উপসাগরীয় অন্যান্য দেশে ব্রাদারহুডের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করতে। সৌদি আরব এখনো অভিযোগ করে, সেখানে মসজিদে ব্রাদারহুডের মতবাদ প্রচারে কাতার সহায়তা করছে।
কাতার ছাড়াও সৌদি আরবের আরেক মাথাব্যথা তুরস্ক। তুরস্ক চাচ্ছে মিশর হবে মধ্যপন্থি ও বাস্তববাদী ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু। কাতার ও তুরস্ক চাচ্ছে সুন্নী ও শিয়া ইসলামের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বে সংহতি প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ গড়তে।
এটা সৌদি আরবের জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি। দেশটির সঙ্গে শিয়া ইরানের শীতল যুদ্ধ চলছে। ওটা সৌদির ওয়াহাবি মতবাদের জন্যও সমানভাবে হুমকি যা কিনা শিয়াদের নাস্তিক বলে মনে করে। মিশরের সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালায় যে, ব্রাদারহুড মিশরকে শিয়া ইসলামের দেশে পরিণত করবে।
তুর্কি প্রভাবের জবাবে ব্রাদারহুড তার এক বছরের শাসনকালে মিশরে উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করে। দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও গণমাধ্যম ছিল স্বাধীন, অবাধে বিক্ষোভ সমাবেশ করা যেত এবং জিহাদী ও চরম বামপন্থিদেরও রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেয়া হয়।শুধু তাই নয়, ব্রাদারহুড মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ডাক দেয়। এতে সৌদি আরবের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
স্পষ্টতই আরব জাহান জয় করার জন্য ব্রাদারহুডের অস্ত্র ছিল গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বড় ভয় সৌদি আরবের। মিশর ও তিউনিসিয়ার মত সৌদি আরবে যদি একবার অবাধ নির্বাচন হয়, তবে সৌদি রাজতন্ত্র ইতিহাসের পাদটীকায় পরিণত হবে।
ব্রাদারহুডের গণতন্ত্রের ডাকে সাড়া দিয়েছিল কুয়েত ও জর্ডানের ব্রাদারহুড শাখা। মিশরের এই স্বাধীনতার বিরল প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তুরস্কের উৎসাহে তারা মিশরের অধিকতর মধ্যপন্থার প্রশংসা করে। পশ্চিমাদের কাছে সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের বিপরীতে ব্রাদারহুডের নীতি অনেক বেশি বাস্তববাদী। ওয়াহাবি মতবাদ চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের জন্ম দিচ্ছে বলে অভিযোগ ওয়াশিংটনের।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বুঝতে পেরেছে, ইসলাম আরব জনগণের মনের এতো গভীরে প্রোথিত যে ইসলামী প্রতিনিধিত্ব ছাড়া আরবে কোনো স্থিতিশীল সরকার হতে পারে না।
আমার লেখা ‘দা আরব সাইকি অ্যান্ড দা আমেরিকান ফ্রাস্ট্রেশন’ বইয়ে এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। ব্রাদারহুড শুধু যে সৌদি রাজতন্ত্রের বৈধতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাই নয়, দেশটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক দুর্বল করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।সৌদি আরবের সহায়তায় প্রতি-বিপ্লবে মিশরে ব্রাদারহুড শাসনের ইতি ঘটলেও সৌদি রাজতন্ত্রের ভীতি দূর হয়নি। বিপরীতে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাতে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতাই প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশটি বিশৃঙ্খলার অতলে নিপতিত হয়েছে। ব্যাপক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে হোসনি মোবারকের আমলের মত স্থিতিশীলতা দেশটিতে আদৌ ফিরে আসবে কিনা।
এর কারণ ব্রাদারহুডের ঘোর বিরোধী বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন এখন মিশরের অফিসারদের হত্যা করছে এবং সিনাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মিনি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করছে।
সৌদি আরবের ব্রাদারহুডকর্মী এবং সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে ফেরত আসা জিহাদীরা যখন একযোগে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেবে তখন সৌদি রাজতন্ত্রের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম . সৌদি আরব জানিয়েছে, সিরিয়া থেকে ৬০০ সৌদি জিহাদী ফিরে এসেছেন। কুয়েত বলছে, তার দেশে সিরিয়া ফেরত জিহাদীর সংখ্যা ২০,০০০। সংখ্যা যাই হোক ব্রাদারহুড সমর্থক ও জিহাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের যে হুমকি সৌদি বাদশাহ দিয়েছেন, তাতেই বোঝা যায় এখানে রাজতন্ত্র কতটা হুমকির মুখে।
এই ভীতি থেকেই সৌদি আরব এবং তাদের উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলো মিশরে শত শত কোটি ডলার ঢালছে এই আশায় যে, মিশরের সর্বশেষ স্বৈরশাসক নিজভূমিতেই ব্রাদারহুডকে বিনাশ করে দিতে সক্ষম হবেন। আরো শত শত কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
মিশরের সামরিক বাহিনী যদি ব্রাদারহুডকে শেষ করে দিতে সক্ষম হয়, তবে সবকিছুই হবে সৌদি পরিকল্পনা মাফিক। তখন সৌদি-ইসরাইল-মিশর জোটের কিন্দ্রবিন্দু হবে মিশর। এই জোট আবার আরব জাহানকে ২০১১ সালের আরব বসন্তের পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের যুগে নিয়ে যাবে।
এভাবেই পুরো অঞ্চলে ‘স্থিতিশীলতা’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় মিশর সরকার। তারা ব্রাদারহুডের সমর্থনপুষ্ট হামাসকে কোণঠাসা করতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় জিহাদীদের। মিশরের সৌদি অর্থায়নপুষ্ট সেনাবাহিনী ইয়েমেন, লিবিয়া ও অন্যান্য দেশের ব্রাদারহুডের ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলতে চায়।
মিশরে ব্রাদারহুড গণতন্ত্রের আশা বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এ অঞ্চলে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বিলীন হয়ে যাবে এবং তখন সৌদি ওয়াহাবি মতবাদ আল আজহার দখল করবে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের অস্তিত্ব না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবারো স্বৈরশাসকদের সমর্থনদানের পুরনো ভূমিকায় ফিরে যাবে। তখন মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তিপূর্ণ নিপীড়নের যুগে’ ফিরে যাবে সৌদি রাজতন্ত্র।
প্রশ্ন উঠেছে, সৌদির টাকায় মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দারিদ্র পীড়িত একজন স্বৈরশাসক বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবেন কিনা।
এটা সম্ভব হতে পারে তখনই যখন পুরো অঞ্চলকে কিনে নিতে সক্ষম হবে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা।
এখন পর্যন্ত সৌদি রাজতন্ত্র ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে ছেড়েছে। এখন মিশরের পালা। এমনকি মিশরের সর্বশেষ ফারাও (ফেরাউন) ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তা আল-সিসি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, মিশরের অবস্থার উন্নতি হওয়ার আগে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে।
http://www.rtnn.net// newsdetail/detail/8/40/80234#. UzemjM6_iSo
http://www.atimes.com/atimes/ Middle_East/MID-01-240314.html
http://www.rtnn.net// newsdetail/detail/8/40/80234#. UzemjM6_iSo
ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমিরিটাস মন্ট পলমার লিখেছেন, ‘স্পষ্টতই আরব জাহান জয় করার জন্য ব্রাদারহুডের অস্ত্র ছিল গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বড় ভয় সৌদি আরবের। মিশর ও তিউনিসিয়ার মত সৌদি আরবে যদি একবার অবাধ নির্বাচন হয়, তবে সৌদি রাজতন্ত্র ইতিহাসের পাদটীকায় পরিণত হবে।’
এশিয়া টাইমস অনলাইনে প্রকাশিত Egypt becomes battleground for Arab world
শিরোনামের এক নিবন্ধে তিনি এই মন্তব্য করেছেন। মন্ট পলমার বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির দা সেন্টার ফর আর্যাবব অ্যান্ড মিডল ইস্টার্ন স্টাডিসের সাবেক পরিচালক এবং দা আল আহরাম সেন্টার ফর পলিটিক্যাল অ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো।
তার লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো;
সৌদি রাজতন্ত্র মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অথচ মুসলিম ব্রদারহুড সুন্নী মুসলিম বিশ্বে একটি ব্যাপক জনপ্রিয় দল। তার শাখা প্রশাখা ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্বজোড়া বিস্তৃত।সৌদি রাজতন্ত্র শুধু ব্রাদারহুডকে শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসী সংগঠনই বলেই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং এটাকে তালিকার শীর্ষে রেখেছে। এমনকি সৌদি সরকারের কাছে আল কায়েদাও ব্রাদারহুডের চেয়ে ভয়াবহ নয়।
সম্ভবত সৌদি আরবের কাছে এর বিকল্পও কিছু নেই। ২০১১ সালের আরব বসন্তের ফলশ্রুতিতে মিশর ও তিউনিসিয়ায় ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। এতে রাজ পরিবার ভয় পেয়ে যায় যে, হয়তো সৌদি হবে পরবর্তী টার্গেট। এটা হচ্ছে সম্পদশালী কিন্তু দুর্বল শাসকগোষ্ঠীর ভয়। কারণ তারা মুক্ত গণমাধ্যম ও নির্বাচন দিয়ে সাধারণ মানুষের মতামত শোনার ক্ষমতা রাখে না।
মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে লড়ার করার জন্য সৌদি রাজতন্ত্র মিশরকেই রণক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। এর পেছনে কারণটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। মুসলিম ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মিশরেই এবং এর সর্বোচ্চ পথপ্রদর্শকরা সবাই মিশরীয়। আঞ্চলিক প্রতিনিধিরাই সাধারণত এর শাখা প্রশাখাগুলোর দায়িত্বে থাকে কিন্তু এর নীতি এবং সিদ্ধান্ত প্রবাহিত হয় মিশর থেকে।
এ কারণে সৌদি আরব এটা ভালো করেই জানে যে, শাখাগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা বৃথা। কারণ মিশর থেকেই এর নেতৃত্ব জারি থাকে। তাছাড়া ব্রাদারহুডের শাখাগুলোতে হামলা করলে সৌদির বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর ক্ষতি হতে পারে। জর্দান, কুয়েত এবং অন্যান্য জোটভুক্ত দেশগুলোতেও ব্রাদারহুডের কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। তার চেয়ে মিশরেই ব্রাদারহুডকে শেষ করে দিতে পারলে তার অন্তরাত্মা মরে যাবে। এর ফলে দূর থেকেই যুদ্ধ শেষ হবে এবং স্বঘোষিত ইসলামের হেফাজতকারী সৌদি রাজতন্ত্রের হাতে রক্তের দাগ লাগবে না। কার্যত মিশরীয় জেনারেলদের ভাড়া করে তারা নিজেরা লড়াইয়ের ময়দানে উপস্থিত না থেকেও পারছেন।
শুধু ব্রাদারহুডকর্মীরাই যে সৌদি রাজতন্ত্রকে আতঙ্কে ফেলে দিয়েছিল তাই নয়, বরং নির্বাচিত হয়ে ব্রাদারহুড যে নীতি অনুসরণ করে সেটাও ছিল সৌদি আতঙ্কের কারণ। সৌদি রাজতন্ত্রীদের মতে ব্রাদারহুড মিশরীয় সরকারের মাধ্যমে আরব জাহানে বাস্তবধর্মী ও প্রগতিশীল ইসলামকে ছড়িয়ে দিয়েছিল।এটা সৌদি রাজতন্ত্র এবং ইসলামের কট্টরপন্থি ওয়াহাবি মতবাদ-উভয়ের জন্যই ছিল সরাসরি হুমকি। এর ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে সৌদি রাজতন্ত্র। সুন্নী মুসলিম বিশ্বে সৌদি রাজতন্ত্রের সুরক্ষা দিচ্ছে ওয়াহাবি মতবাদ। ব্রাদারহুড যতই মধ্যপন্থি ও বাস্তবভিত্তিক ইসলামের প্রসার ঘটাতে পারবে সৌদি রাজতন্ত্র ততই দুর্বল হবে।
মুসলিম বিশ্বের ওপর সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বিপদের কারণ আল-আজহার। বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন এই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়টি ব্রাদারহুডের ইসলামের বাস্তবভিত্তিক ও প্রগতিশীল দর্শন দ্বারা প্রভাবিত।
সৌদি আরব মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র ধর্মীয় স্থান মক্কা ও মদীনা নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু ব্রাদারহুড মুসলিম বিশ্বে সুন্নী ইসলামের প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আল আজহার নিয়ন্ত্রণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল।
উপসাগরে সৌদি আরবের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ও ব্রাদারহুডের পৃষ্ঠপোষক কাতার উপসাগরীয় অঞ্চলে সৌদি আরবের আধিপত্য ভাঙার জন্য ব্রাদারহুডের নিয়ন্ত্রণকে কাজে লাগাতে চায়। তবে এটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে বাধাও রয়েছে। সৌদি আরবের অর্থায়নে পরিচালিত মিশরের ব্রাদারহুড বিরোধী গণমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালায় যে, ব্রাদারহুড আল আজহার নিয়ন্ত্রণ করছে।আল আজহারে ব্রাদারহুডকে শক্তিশালী করতে কাজ করছে কাতার। কাতার চাচ্ছে উপসাগরীয় অন্যান্য দেশে ব্রাদারহুডের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করতে। সৌদি আরব এখনো অভিযোগ করে, সেখানে মসজিদে ব্রাদারহুডের মতবাদ প্রচারে কাতার সহায়তা করছে।
কাতার ছাড়াও সৌদি আরবের আরেক মাথাব্যথা তুরস্ক। তুরস্ক চাচ্ছে মিশর হবে মধ্যপন্থি ও বাস্তববাদী ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু। কাতার ও তুরস্ক চাচ্ছে সুন্নী ও শিয়া ইসলামের মধ্যে কয়েক শতাব্দী ধরে চলা সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বে সংহতি প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ গড়তে।
এটা সৌদি আরবের জন্য একটি বড় ধরনের হুমকি। দেশটির সঙ্গে শিয়া ইরানের শীতল যুদ্ধ চলছে। ওটা সৌদির ওয়াহাবি মতবাদের জন্যও সমানভাবে হুমকি যা কিনা শিয়াদের নাস্তিক বলে মনে করে। মিশরের সৌদি অর্থায়নে পরিচালিত গণমাধ্যমগুলো প্রচারণা চালায় যে, ব্রাদারহুড মিশরকে শিয়া ইসলামের দেশে পরিণত করবে।
তুর্কি প্রভাবের জবাবে ব্রাদারহুড তার এক বছরের শাসনকালে মিশরে উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক কৌশল অবলম্বন করে। দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেও গণমাধ্যম ছিল স্বাধীন, অবাধে বিক্ষোভ সমাবেশ করা যেত এবং জিহাদী ও চরম বামপন্থিদেরও রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দেয়া হয়।শুধু তাই নয়, ব্রাদারহুড মধ্যপ্রাচ্যে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ডাক দেয়। এতে সৌদি আরবের মাথা খারাপ হয়ে যায়।
স্পষ্টতই আরব জাহান জয় করার জন্য ব্রাদারহুডের অস্ত্র ছিল গণতন্ত্র। আর এই গণতন্ত্রকেই সবচেয়ে বড় ভয় সৌদি আরবের। মিশর ও তিউনিসিয়ার মত সৌদি আরবে যদি একবার অবাধ নির্বাচন হয়, তবে সৌদি রাজতন্ত্র ইতিহাসের পাদটীকায় পরিণত হবে।
ব্রাদারহুডের গণতন্ত্রের ডাকে সাড়া দিয়েছিল কুয়েত ও জর্ডানের ব্রাদারহুড শাখা। মিশরের এই স্বাধীনতার বিরল প্রশংসা করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তুরস্কের উৎসাহে তারা মিশরের অধিকতর মধ্যপন্থার প্রশংসা করে। পশ্চিমাদের কাছে সৌদি ওয়াহাবি মতবাদের বিপরীতে ব্রাদারহুডের নীতি অনেক বেশি বাস্তববাদী। ওয়াহাবি মতবাদ চরমপন্থা ও সন্ত্রাসের জন্ম দিচ্ছে বলে অভিযোগ ওয়াশিংটনের।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বুঝতে পেরেছে, ইসলাম আরব জনগণের মনের এতো গভীরে প্রোথিত যে ইসলামী প্রতিনিধিত্ব ছাড়া আরবে কোনো স্থিতিশীল সরকার হতে পারে না।
আমার লেখা ‘দা আরব সাইকি অ্যান্ড দা আমেরিকান ফ্রাস্ট্রেশন’ বইয়ে এ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করা হয়েছে। ব্রাদারহুড শুধু যে সৌদি রাজতন্ত্রের বৈধতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে তাই নয়, দেশটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সম্পর্ক দুর্বল করার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে।সৌদি আরবের সহায়তায় প্রতি-বিপ্লবে মিশরে ব্রাদারহুড শাসনের ইতি ঘটলেও সৌদি রাজতন্ত্রের ভীতি দূর হয়নি। বিপরীতে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে ব্রাদারহুড যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে তাতে দলটির সাংগঠনিক সক্ষমতাই প্রকাশিত হয়েছে এবং দেশটি বিশৃঙ্খলার অতলে নিপতিত হয়েছে। ব্যাপক আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে হোসনি মোবারকের আমলের মত স্থিতিশীলতা দেশটিতে আদৌ ফিরে আসবে কিনা।
এর কারণ ব্রাদারহুডের ঘোর বিরোধী বিভিন্ন জিহাদী সংগঠন এখন মিশরের অফিসারদের হত্যা করছে এবং সিনাইসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মিনি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করছে।
সৌদি আরবের ব্রাদারহুডকর্মী এবং সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশ থেকে ফেরত আসা জিহাদীরা যখন একযোগে গণঅভ্যুত্থানের ডাক দেবে তখন সৌদি রাজতন্ত্রের টিকে থাকার সম্ভাবনা কম . সৌদি আরব জানিয়েছে, সিরিয়া থেকে ৬০০ সৌদি জিহাদী ফিরে এসেছেন। কুয়েত বলছে, তার দেশে সিরিয়া ফেরত জিহাদীর সংখ্যা ২০,০০০। সংখ্যা যাই হোক ব্রাদারহুড সমর্থক ও জিহাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সন্ত্রাসবাদের যে হুমকি সৌদি বাদশাহ দিয়েছেন, তাতেই বোঝা যায় এখানে রাজতন্ত্র কতটা হুমকির মুখে।
এই ভীতি থেকেই সৌদি আরব এবং তাদের উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলো মিশরে শত শত কোটি ডলার ঢালছে এই আশায় যে, মিশরের সর্বশেষ স্বৈরশাসক নিজভূমিতেই ব্রাদারহুডকে বিনাশ করে দিতে সক্ষম হবেন। আরো শত শত কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
মিশরের সামরিক বাহিনী যদি ব্রাদারহুডকে শেষ করে দিতে সক্ষম হয়, তবে সবকিছুই হবে সৌদি পরিকল্পনা মাফিক। তখন সৌদি-ইসরাইল-মিশর জোটের কিন্দ্রবিন্দু হবে মিশর। এই জোট আবার আরব জাহানকে ২০১১ সালের আরব বসন্তের পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের যুগে নিয়ে যাবে।
এভাবেই পুরো অঞ্চলে ‘স্থিতিশীলতা’ প্রতিষ্ঠা করতে চায় মিশর সরকার। তারা ব্রাদারহুডের সমর্থনপুষ্ট হামাসকে কোণঠাসা করতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় জিহাদীদের। মিশরের সৌদি অর্থায়নপুষ্ট সেনাবাহিনী ইয়েমেন, লিবিয়া ও অন্যান্য দেশের ব্রাদারহুডের ঘাঁটি ধ্বংস করে ফেলতে চায়।
মিশরে ব্রাদারহুড গণতন্ত্রের আশা বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে এ অঞ্চলে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা বিলীন হয়ে যাবে এবং তখন সৌদি ওয়াহাবি মতবাদ আল আজহার দখল করবে।
মুসলিম ব্রাদারহুডের অস্তিত্ব না থাকলে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন আবারো স্বৈরশাসকদের সমর্থনদানের পুরনো ভূমিকায় ফিরে যাবে। তখন মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তিপূর্ণ নিপীড়নের যুগে’ ফিরে যাবে সৌদি রাজতন্ত্র।
প্রশ্ন উঠেছে, সৌদির টাকায় মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দারিদ্র পীড়িত একজন স্বৈরশাসক বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারবেন কিনা।
এটা সম্ভব হতে পারে তখনই যখন পুরো অঞ্চলকে কিনে নিতে সক্ষম হবে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা।
এখন পর্যন্ত সৌদি রাজতন্ত্র ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলা বাধিয়ে ছেড়েছে। এখন মিশরের পালা। এমনকি মিশরের সর্বশেষ ফারাও (ফেরাউন) ফিল্ড মার্শাল আবদেল ফাত্তা আল-সিসি হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, মিশরের অবস্থার উন্নতি হওয়ার আগে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে।
http://www.rtnn.net//
http://www.atimes.com/atimes/
http://www.rtnn.net//
__._,_.___
No comments:
Post a Comment