আম্বেদকার, গান্ধী এবং বর্ণ বিরোধী সংগ্রাম
অরুন্ধতী রায়: জাতি বর্ণের নাশ (ANNIHILATION OF CASTE), ৮০ বছরের পুরান একটা বক্তব্যের লিখিত রূপ, যে বক্তব্য কখনও রাখা হয়নি।* যখন আমি প্রথম লেখাটা পড়ি, মনে হয়েছিল অন্ধকার ঘরের মধ্যে কেউ একজন হেঁটে গিয়ে বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিচ্ছে। ডাক্তার ভীমরাও রামজি আম্বেদকার পড়ার মধ্যে দিয়ে বেশিরভাগ ভারতীয় যেভাবে ভাববার শিক্ষা পায় এবং আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতায় যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তার মধ্যে একটা সেতু গড়ে ওঠে।
অরুন্ধতী রায়: জাতি বর্ণের নাশ (ANNIHILATION OF CASTE), ৮০ বছরের পুরান একটা বক্তব্যের লিখিত রূপ, যে বক্তব্য কখনও রাখা হয়নি।* যখন আমি প্রথম লেখাটা পড়ি, মনে হয়েছিল অন্ধকার ঘরের মধ্যে কেউ একজন হেঁটে গিয়ে বন্ধ জানালাগুলো খুলে দিচ্ছে। ডাক্তার ভীমরাও রামজি আম্বেদকার পড়ার মধ্যে দিয়ে বেশিরভাগ ভারতীয় যেভাবে ভাববার শিক্ষা পায় এবং আমাদের প্রতিদিনের বাস্তবতায় যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়, তার মধ্যে একটা সেতু গড়ে ওঠে।
আমার বাবা একজন হিন্দু, ব্রাহ্ম। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার আগে পর্যন্ত তার সাথে আমার পরিচয় ছিল না। কমিউনিস্ট শাসিত কেরালার ছোট্ট গ্রাম আয়েমেনেম-এ এক সিরিয়ান খ্রিষ্টান পরিবারে, আমি আমার মায়ের কাছে বড় হয়েছি। আর হ্যাঁ, আমার চারদিকটা জাতি-বর্ণের ফাটল দিয়ে ঘেরা ছিল। আয়েমেনেম-এর নিজস্ব একটা ‘পারায়ান’ চার্চ ছিল, যেখানে ‘পারায়ান’ যাজকেরা ‘অচ্ছুত’ জন সমবায় বলে পরিচিত ছিল। বর্ণ মানুষের পরিচয় নামের মধ্যে দিয়েই পরোক্ষভাবে ফুটে উঠত। যে কাজ তারা করত, যে জামাকাপড় তারা পড়ত, যেভাবে তাদের বিয়ের আয়োজন হত এবং যে ভাষায় আমরা কথা বলি, সেসবের উপর ভিত্তি করেই একে অপরকে সম্বোধন করত।
যদিও স্কুলের কোনও পাঠ্যপুস্তকেই আমি বর্ণ ব্যবস্থার বিরোধিতা পাই নি। আম্বেদকার পাঠই এই মহাবিশ্বের মধ্যে থাকা একটা বিরাট বড় শূন্যস্থানের বিষয়ে আমায় সতর্ক করে। তাকে পাঠের মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হল কেন এই শূন্যস্থান বিরাজ করে এবং যতদিন না ভারতীয় সমাজে একটি মৌলিক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, ততদিন এই শূন্যস্থান কেন রয়ে যাবে।
বিপ্লবের সুচনা প্রায়শই পড়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হতে পারে।
আম্বেদকার একজন উঁচুমাপের লেখক হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গান্ধী, নেহেরু বা বিবেকানন্দর মত লাইব্রেরীতে বা বইয়ের দোকানে তার বই প্রদর্শিত হতে দেখা যায় না।
তার আরও অনেক রচনার মধ্যে জাতি বর্ণের নাশ (ANNIHILATION OF CASTE) লেখাটি সবচাইতে প্রগতিশীল মৌলিক রচনা। এই লেখার যুক্তিগুলো কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী বা চরমপন্থীদের উদ্দেশ্য করে নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্যে যারা নিজেদের মধ্যপন্থী বলে দাবী করেন, আম্বেদকার যাদের বলেছেন ‘হিন্দুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ - এবং শিক্ষাবিদরা যাদের ‘বামপন্থী হিন্দু’ বলে থাকেন। আম্বেদকারের বক্তব্য হল একই সাথে হিন্দু শাস্ত্রে বিশ্বাস করা এবং নিজেকে মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী বলে দাবী করা আসলে স্ববিরোধীতারই নামান্তর।
যখন “জাতি বর্ণের নাশ” লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন ‘হিন্দুদের মধ্যে মহত্তম’ বলে যাকে ডাকা হত, সেই মহাত্মা গান্ধী, আম্বেদকারের প্ররোচনায় সাড়া দেন। তাদের এই বিতর্ক নতুন ছিল না। দুই জন ব্যক্তিই তাদের প্রজন্মের গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক দ্বন্দ্বগুলির মুখ্য প্রচারক, যার শুরু হয়েছে অনেক আগে, এবং এখনও যা অসমাপ্ত।
২০০-১০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে শুরু হওয়া বর্ণ প্রথা বিরোধী বুদ্ধিজীবী ধারার উত্তরসুরী ছিলেন অচ্ছুৎ আম্বেদকার। ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্ত থেকে এই বর্ণ প্রথার সূচনাকাল বলে মনে করা হয় (১২০০-৯০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। এই প্রথা প্রথম বার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পরে প্রায় হাজার বছর বাদে, যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা কে কোন বর্ণের না দেখে জাতপাতের ভেদরেখা ভেঙে সব্বাইকে সংঘে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেয়। তারপরও বর্ণ প্রথা টিকে গেল এবং এগিয়ে চলল। দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় দক্ষিণ ভারতে বাসব এর নেতৃত্বে বীরাশৈবাস বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, এবং অল্পদিনের মধ্যেই ব্যর্থ হয়। চতুর্দশ শতকের পর থেকে স্বনামধন্য ভক্তি কবি ও সন্তরা - কোখামেলা, রবিদাস, কবীর, তুকারাম, মীরা, জানাবাই, এরা বর্ণ প্রথা বিরোধী ধারার কবি হিসাবে উঠে এলেন এবং রয়ে গেলেন। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ায় পশ্চিম ভারতে এগিয়ে এলেন জ্যোতিরাও ফুলে এবং তার সত্যসাধক সমাজ; ভারতের সম্ভবত প্রথম নারীবাদী পণ্ডিতা রমাবাই একজন মারাঠি ব্রাক্ষ্মণ যিনি হিন্দুত্ব ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষা নেন; স্বামী অচ্যুতানন্দ হরিহর, যিনি আদি হিন্দু আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ভারতীয় অচ্ছুৎ মহাসভার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতের প্রথম দলিত পত্রিকা ‘অচ্ছুৎ’-এর সম্পাদনার কাজ করেন; আভ্যঙ্কালী এবং শ্রী নারায়ণ গুরু, মালাবার এবং ত্রিবাঙ্কুরের পুরনো ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন; আর কালাপাহাড় ইয়োথী থাস তামিল জগতে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে খর্ব করেছিলেন। আম্বেদকারের সমসাময়িকদের যারা বর্ণবাদবিরোধী ধারার প্রতিনিধি, তাদের মধ্যে ই.ভি. রামস্বামী নাইক্কর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে ‘পেরিয়ার’ বলে পরিচিত; যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বাংলার; এবং বাবু মাঙ্গু রাম, যিনি পাঞ্জাবে আদ ধর্ম আন্দোলনের প্রবক্তা, এই আন্দোলন শিখ এবং হিন্দু দুই ধর্মকেই বর্জন করে। এরাই হলেন আম্বেদকারের নিজের লোক।
গান্ধী বৈশ্য, জন্ম তার গুজরাটি বেনিয়া পরিবারে। উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ সংস্কারকদের এবং সংগঠনগুলির মধ্যে তিনি সর্বশেষ সংযোজন: ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন; স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আর্য সমাজ; ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন; এছাড়াও সমসাময়িক আরও কিছু সংস্কারবাদী সংগঠনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
যারা সেই ইতিহাস ও তার নায়কদের সাথে অপরিচিত, আম্বেদকার-গান্ধী বিতর্ক ঘুরপথে তাদের পৃথক রাজনৈতিক আবর্তে নিয়ে যেতে চাইবে। কারণ এটা দুজন ভিন্নমতের মানুষের তাত্ত্বিক বিতর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। দুজনের প্রত্যেকেই দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্যের গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং ভারতের জাতীয় আন্দোলনের হৃদয়ে তাদের যুদ্ধ উদ্ঘাটিত হয়েছিল। তারা যা বলেছিলেন এবং যা করেছিলেন, তা সমকালীন রাজনীতিতে অপরিমেয় তাৎপর্য বহন করে চলেছে। তাদের পার্থক্যগুলির মধ্যে কোন সন্ধি হওয়া সম্ভব ছিল না (এখনও সম্ভব নয়)। দুজনেই তাদের অনুগামীদের থেকে গভীর ভালবাসা লাভ করেছিলেন, এবং দুজনের অনুগামীরাই তাদের দেবতুল্য মনে করত। অপর জনের গল্প বলা দুজনের একজনেরও সমর্থক গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করত না, যদিও তারা পরস্পরের সাথে অলঙ্ঘ্যনীয়ভাবে জড়িত। আম্বেদকার ছিলেন গান্ধীর প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তাকে শুধু রাজনৈতিক বা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন নি, নৈতিকতার প্রশ্নেও করেছিলেন। গান্ধীর গল্প থেকে আম্বেদকারকে বিচ্ছিন্ন করা যে গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেটা একটা হাস্যকর বিকৃতি। একইভাবে আম্বেদকারকে নিয়ে লেখার সময় গান্ধীকে উপেক্ষা করার অর্থ হল আম্বেদকারের অপকার করা, কারণ অবিস্ময়করভাবে গান্ধী, আম্বেদকারকে বিবিধভাবে ঘিরে আছেন।
আমরা জানি যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একটা বড় মাপের জুয়ার দান ছিল। এমনকি এটা হলিউডের এক ব্লক বাস্টার সিনেমার মুখ্য বিষয় হয়ে সেটাকে ৮ খানা অস্কার এনে দিয়েছিল। ভারতে সময় কাটানোর জন্য আমরা বিভিন্ন মতামত সমীক্ষা, বই বা পত্রিকা পাঠ করে থাকি, যেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা নক্ষত্র তুল্য পিতাদের (মায়েরা সেখানে জায়গা পান না) বিভিন্ন চেহারায়, বিভিন্ন গুরুত্বে, উল্টে পাল্টে, উপর নিচ করে নানা ভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। গান্ধীর প্রতি তিক্ত সমালোচনা থাকলেও, তিনি চার্টের উপরের দিকে স্থান পেয়ে যান। অন্যরা মুখ দেখানোর সুযোগ পেলেও জাতির জনককে আলাদা করে জায়গা দেওয়া হয়, পৃথক শ্রেণীতে রাখা হয় তাকে। মহাত্মা গান্ধীর পর সবচেয়ে মহান ভারতীয় কে বলুন দেখি?
আম্বেদকার (যিনি বিস্ময়কর ভাবে রিচার্ড অ্যাটেনবার্গের ‘গান্ধী’ সিনেমাতেও কোনও ভূমিকাতে নেই, যদিও সিনেমাটি ভারত সরকারের যৌথ অনুদানে তৈরি) কিন্তু এই প্রশ্নে প্রথম সারিতে থাকবেন। এক্ষেত্রে রাজনীতির চাইতেও ভারতের সংবিধানের খসরা রচনায় তার ভূমিকা এবং তার জীবন ও ভাবনার বিষয়বস্তু বেশি প্রাধান্য পাবে। এই তালিকায় তার স্থান পাওয়া আপনাকে অবশ্যই একটা অনুভূতি দেবে, যে তার তালিকায় থাকার কারণে একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে, সেটা হল রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার প্রয়াশ। বিচারের বাণী গুঞ্জন করতেই থাকবে: ‘সুযোগসন্ধানী’ (কারণ ব্রিটিশ ভাইসরয়ের এক্সেকিউটিভ কাউন্সিলে তিনি ১৯৪২-১৯৪৬ পর্যন্ত লেবার মেম্বার হিসাবে কাজ করেছেন), ‘ব্রিটিশের হাতের পুতুল’ (কারণ ১৯৩০ সালে যখন কংগ্রেস কর্মীরা লবণ আইন ভেঙে জেলে যাচ্ছিলেন, তখন প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণ তিনি স্বীকার করেছিলেন), ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ (কারণ তিনি অচ্ছুতদের জন্য পৃথক নির্বাচন চেয়েছিলেন), এবং ‘জাতীয়তাবিরোধী’ (কারণ তিনি পাকিস্তান প্রশ্নে মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিলেন এবং তিনি জম্মু ও কাশ্মীরকে তিন ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন)।
যদিও আমরা বিশেষণগুলো ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু গান্ধী বা আম্বেদকার কেউই কিন্তু তাদের ‘সাম্রাজ্যবাদপন্থী’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ বলে নির্দিষ্ট লেবেল সাঁটানোর সুযোগ আমাদের দেন না। তাদের দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে আমাদের বোঝাপড়াকে জটিল করে তোলে, যদিও এর মধ্যে দিয়ে আমরা সাম্রাজ্যবাদকে উপলব্ধি করতে পারি এবং সংগ্রাম করতে পারি তার বিরুদ্ধে।
ইতিহাস গান্ধীর প্রতি দয়ালু। তিনি তার জীবিতাবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বারা দেবজ্ঞানে পূজিত হয়েছেন। তার দেবত্ব বিশ্বময়তা লাভ করে এবং শাশ্বত বিস্ময় বলে প্রতিভাত হয়। এমনটা শুধু এমন নয় যে রূপক মানুষটা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। এটা তার সমগ্র অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছিল (এই কারণে গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনার অর্থ সমস্ত গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা নয়)। গান্ধী সমস্ত মানুষের কাছে সমস্ত কিছু হয়ে উঠেছেন। ওবামা তাকে ভালোবাসেন, একই ভাবে ভালোবাসেন অকুপাই আন্দোলনকারীরাও। নৈরাজ্যবাদীরা তাকে ভালোবাসেন, তাকে ভালোবাসে প্রতিষ্ঠানও। নরেন্দ্র মোদী তাকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন রাহুল গান্ধীও। দরিদ্ররা তাকে ভালোবাসেন, একই ভাবে ধনীরাও।
(চলবে....)
অনুবাদ: রক্তিম ঘোষ
যদিও স্কুলের কোনও পাঠ্যপুস্তকেই আমি বর্ণ ব্যবস্থার বিরোধিতা পাই নি। আম্বেদকার পাঠই এই মহাবিশ্বের মধ্যে থাকা একটা বিরাট বড় শূন্যস্থানের বিষয়ে আমায় সতর্ক করে। তাকে পাঠের মধ্য দিয়েই পরিষ্কার হল কেন এই শূন্যস্থান বিরাজ করে এবং যতদিন না ভারতীয় সমাজে একটি মৌলিক ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, ততদিন এই শূন্যস্থান কেন রয়ে যাবে।
বিপ্লবের সুচনা প্রায়শই পড়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হতে পারে।
আম্বেদকার একজন উঁচুমাপের লেখক হওয়া সত্ত্বেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে, গান্ধী, নেহেরু বা বিবেকানন্দর মত লাইব্রেরীতে বা বইয়ের দোকানে তার বই প্রদর্শিত হতে দেখা যায় না।
তার আরও অনেক রচনার মধ্যে জাতি বর্ণের নাশ (ANNIHILATION OF CASTE) লেখাটি সবচাইতে প্রগতিশীল মৌলিক রচনা। এই লেখার যুক্তিগুলো কিন্তু হিন্দু মৌলবাদী বা চরমপন্থীদের উদ্দেশ্য করে নয়, বরং তাদের উদ্দেশ্যে যারা নিজেদের মধ্যপন্থী বলে দাবী করেন, আম্বেদকার যাদের বলেছেন ‘হিন্দুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ - এবং শিক্ষাবিদরা যাদের ‘বামপন্থী হিন্দু’ বলে থাকেন। আম্বেদকারের বক্তব্য হল একই সাথে হিন্দু শাস্ত্রে বিশ্বাস করা এবং নিজেকে মধ্যপন্থী বা উদারপন্থী বলে দাবী করা আসলে স্ববিরোধীতারই নামান্তর।
যখন “জাতি বর্ণের নাশ” লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়, তখন ‘হিন্দুদের মধ্যে মহত্তম’ বলে যাকে ডাকা হত, সেই মহাত্মা গান্ধী, আম্বেদকারের প্ররোচনায় সাড়া দেন। তাদের এই বিতর্ক নতুন ছিল না। দুই জন ব্যক্তিই তাদের প্রজন্মের গভীর রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দার্শনিক দ্বন্দ্বগুলির মুখ্য প্রচারক, যার শুরু হয়েছে অনেক আগে, এবং এখনও যা অসমাপ্ত।
২০০-১০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে শুরু হওয়া বর্ণ প্রথা বিরোধী বুদ্ধিজীবী ধারার উত্তরসুরী ছিলেন অচ্ছুৎ আম্বেদকার। ঋগ্বেদের পুরুষ সুক্ত থেকে এই বর্ণ প্রথার সূচনাকাল বলে মনে করা হয় (১২০০-৯০০ খ্রিষ্টপূর্ব)। এই প্রথা প্রথম বার প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পরে প্রায় হাজার বছর বাদে, যখন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা কে কোন বর্ণের না দেখে জাতপাতের ভেদরেখা ভেঙে সব্বাইকে সংঘে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেয়। তারপরও বর্ণ প্রথা টিকে গেল এবং এগিয়ে চলল। দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি সময় দক্ষিণ ভারতে বাসব এর নেতৃত্বে বীরাশৈবাস বর্ণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, এবং অল্পদিনের মধ্যেই ব্যর্থ হয়। চতুর্দশ শতকের পর থেকে স্বনামধন্য ভক্তি কবি ও সন্তরা - কোখামেলা, রবিদাস, কবীর, তুকারাম, মীরা, জানাবাই, এরা বর্ণ প্রথা বিরোধী ধারার কবি হিসাবে উঠে এলেন এবং রয়ে গেলেন। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের গোড়ায় পশ্চিম ভারতে এগিয়ে এলেন জ্যোতিরাও ফুলে এবং তার সত্যসাধক সমাজ; ভারতের সম্ভবত প্রথম নারীবাদী পণ্ডিতা রমাবাই একজন মারাঠি ব্রাক্ষ্মণ যিনি হিন্দুত্ব ত্যাগ করে খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষা নেন; স্বামী অচ্যুতানন্দ হরিহর, যিনি আদি হিন্দু আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, ভারতীয় অচ্ছুৎ মহাসভার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতের প্রথম দলিত পত্রিকা ‘অচ্ছুৎ’-এর সম্পাদনার কাজ করেন; আভ্যঙ্কালী এবং শ্রী নারায়ণ গুরু, মালাবার এবং ত্রিবাঙ্কুরের পুরনো ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন; আর কালাপাহাড় ইয়োথী থাস তামিল জগতে ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে খর্ব করেছিলেন। আম্বেদকারের সমসাময়িকদের যারা বর্ণবাদবিরোধী ধারার প্রতিনিধি, তাদের মধ্যে ই.ভি. রামস্বামী নাইক্কর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সীতে ‘পেরিয়ার’ বলে পরিচিত; যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বাংলার; এবং বাবু মাঙ্গু রাম, যিনি পাঞ্জাবে আদ ধর্ম আন্দোলনের প্রবক্তা, এই আন্দোলন শিখ এবং হিন্দু দুই ধর্মকেই বর্জন করে। এরাই হলেন আম্বেদকারের নিজের লোক।
গান্ধী বৈশ্য, জন্ম তার গুজরাটি বেনিয়া পরিবারে। উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ সংস্কারকদের এবং সংগঠনগুলির মধ্যে তিনি সর্বশেষ সংযোজন: ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন; স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী ১৮৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আর্য সমাজ; ১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ মিশন; এছাড়াও সমসাময়িক আরও কিছু সংস্কারবাদী সংগঠনের উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি।
যারা সেই ইতিহাস ও তার নায়কদের সাথে অপরিচিত, আম্বেদকার-গান্ধী বিতর্ক ঘুরপথে তাদের পৃথক রাজনৈতিক আবর্তে নিয়ে যেতে চাইবে। কারণ এটা দুজন ভিন্নমতের মানুষের তাত্ত্বিক বিতর্ক ছাড়া আর কিছু নয়। দুজনের প্রত্যেকেই দুটি ভিন্ন উদ্দেশ্যের গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতেন এবং ভারতের জাতীয় আন্দোলনের হৃদয়ে তাদের যুদ্ধ উদ্ঘাটিত হয়েছিল। তারা যা বলেছিলেন এবং যা করেছিলেন, তা সমকালীন রাজনীতিতে অপরিমেয় তাৎপর্য বহন করে চলেছে। তাদের পার্থক্যগুলির মধ্যে কোন সন্ধি হওয়া সম্ভব ছিল না (এখনও সম্ভব নয়)। দুজনেই তাদের অনুগামীদের থেকে গভীর ভালবাসা লাভ করেছিলেন, এবং দুজনের অনুগামীরাই তাদের দেবতুল্য মনে করত। অপর জনের গল্প বলা দুজনের একজনেরও সমর্থক গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করত না, যদিও তারা পরস্পরের সাথে অলঙ্ঘ্যনীয়ভাবে জড়িত। আম্বেদকার ছিলেন গান্ধীর প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি তাকে শুধু রাজনৈতিক বা বুদ্ধিমত্তার দিক দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন নি, নৈতিকতার প্রশ্নেও করেছিলেন। গান্ধীর গল্প থেকে আম্বেদকারকে বিচ্ছিন্ন করা যে গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি, সেটা একটা হাস্যকর বিকৃতি। একইভাবে আম্বেদকারকে নিয়ে লেখার সময় গান্ধীকে উপেক্ষা করার অর্থ হল আম্বেদকারের অপকার করা, কারণ অবিস্ময়করভাবে গান্ধী, আম্বেদকারকে বিবিধভাবে ঘিরে আছেন।
আমরা জানি যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একটা বড় মাপের জুয়ার দান ছিল। এমনকি এটা হলিউডের এক ব্লক বাস্টার সিনেমার মুখ্য বিষয় হয়ে সেটাকে ৮ খানা অস্কার এনে দিয়েছিল। ভারতে সময় কাটানোর জন্য আমরা বিভিন্ন মতামত সমীক্ষা, বই বা পত্রিকা পাঠ করে থাকি, যেখানে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা নক্ষত্র তুল্য পিতাদের (মায়েরা সেখানে জায়গা পান না) বিভিন্ন চেহারায়, বিভিন্ন গুরুত্বে, উল্টে পাল্টে, উপর নিচ করে নানা ভাবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। গান্ধীর প্রতি তিক্ত সমালোচনা থাকলেও, তিনি চার্টের উপরের দিকে স্থান পেয়ে যান। অন্যরা মুখ দেখানোর সুযোগ পেলেও জাতির জনককে আলাদা করে জায়গা দেওয়া হয়, পৃথক শ্রেণীতে রাখা হয় তাকে। মহাত্মা গান্ধীর পর সবচেয়ে মহান ভারতীয় কে বলুন দেখি?
আম্বেদকার (যিনি বিস্ময়কর ভাবে রিচার্ড অ্যাটেনবার্গের ‘গান্ধী’ সিনেমাতেও কোনও ভূমিকাতে নেই, যদিও সিনেমাটি ভারত সরকারের যৌথ অনুদানে তৈরি) কিন্তু এই প্রশ্নে প্রথম সারিতে থাকবেন। এক্ষেত্রে রাজনীতির চাইতেও ভারতের সংবিধানের খসরা রচনায় তার ভূমিকা এবং তার জীবন ও ভাবনার বিষয়বস্তু বেশি প্রাধান্য পাবে। এই তালিকায় তার স্থান পাওয়া আপনাকে অবশ্যই একটা অনুভূতি দেবে, যে তার তালিকায় থাকার কারণে একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে, সেটা হল রাজনৈতিকভাবে সঠিক থাকার প্রয়াশ। বিচারের বাণী গুঞ্জন করতেই থাকবে: ‘সুযোগসন্ধানী’ (কারণ ব্রিটিশ ভাইসরয়ের এক্সেকিউটিভ কাউন্সিলে তিনি ১৯৪২-১৯৪৬ পর্যন্ত লেবার মেম্বার হিসাবে কাজ করেছেন), ‘ব্রিটিশের হাতের পুতুল’ (কারণ ১৯৩০ সালে যখন কংগ্রেস কর্মীরা লবণ আইন ভেঙে জেলে যাচ্ছিলেন, তখন প্রথম গোল টেবিল বৈঠকে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণ তিনি স্বীকার করেছিলেন), ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ (কারণ তিনি অচ্ছুতদের জন্য পৃথক নির্বাচন চেয়েছিলেন), এবং ‘জাতীয়তাবিরোধী’ (কারণ তিনি পাকিস্তান প্রশ্নে মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিলেন এবং তিনি জম্মু ও কাশ্মীরকে তিন ভাগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন)।
যদিও আমরা বিশেষণগুলো ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু গান্ধী বা আম্বেদকার কেউই কিন্তু তাদের ‘সাম্রাজ্যবাদপন্থী’ বা ‘সাম্রাজ্যবাদবিরোধী’ বলে নির্দিষ্ট লেবেল সাঁটানোর সুযোগ আমাদের দেন না। তাদের দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যবাদ সম্বন্ধে আমাদের বোঝাপড়াকে জটিল করে তোলে, যদিও এর মধ্যে দিয়ে আমরা সাম্রাজ্যবাদকে উপলব্ধি করতে পারি এবং সংগ্রাম করতে পারি তার বিরুদ্ধে।
ইতিহাস গান্ধীর প্রতি দয়ালু। তিনি তার জীবিতাবস্থায় লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বারা দেবজ্ঞানে পূজিত হয়েছেন। তার দেবত্ব বিশ্বময়তা লাভ করে এবং শাশ্বত বিস্ময় বলে প্রতিভাত হয়। এমনটা শুধু এমন নয় যে রূপক মানুষটা তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে। এটা তার সমগ্র অভিব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছিল (এই কারণে গান্ধীর বিরুদ্ধে কোনও সমালোচনার অর্থ সমস্ত গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা নয়)। গান্ধী সমস্ত মানুষের কাছে সমস্ত কিছু হয়ে উঠেছেন। ওবামা তাকে ভালোবাসেন, একই ভাবে ভালোবাসেন অকুপাই আন্দোলনকারীরাও। নৈরাজ্যবাদীরা তাকে ভালোবাসেন, তাকে ভালোবাসে প্রতিষ্ঠানও। নরেন্দ্র মোদী তাকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন রাহুল গান্ধীও। দরিদ্ররা তাকে ভালোবাসেন, একই ভাবে ধনীরাও।
(চলবে....)
অনুবাদ: রক্তিম ঘোষ
হি.শা
http://satkahan.com/2013-12-11-22-26-16/1012-2014-03-09-14-35-02
বাংলা শুধুই বাংলা: আম্বেদকার, গান্ধী এবং বর্ণ বিরোধী সংগ্রাম >>>>> Download Now
ReplyDelete>>>>> Download Full
বাংলা শুধুই বাংলা: আম্বেদকার, গান্ধী এবং বর্ণ বিরোধী সংগ্রাম >>>>> Download LINK
>>>>> Download Now
বাংলা শুধুই বাংলা: আম্বেদকার, গান্ধী এবং বর্ণ বিরোধী সংগ্রাম >>>>> Download Full
>>>>> Download LINK