Thursday, June 5, 2014

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ কামু এবং ওয়ালিউল্লাহ সাজিদ উল হক খান আবির

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ কামু এবং ওয়ালিউল্লাহ
সাজিদ উল হক খান আবির
বিশ শতকের শুরুতে দর্শন আর সাহিত্য এগিয়ে চলেছে হাতে হাত রেখে। যান্ত্রিক সভ্যতার কাছে ক্রমশ নতি স্বীকার করতে থাকা মানুষের গগণচুম্বী লোভের নির্লজ্জ বহির্প্রকাশে মাত্র বিশ বছরের ব্যবধানে সংঘটিত হয় দু’দুটো প্রলয়ঙ্করী বিশ্বযুদ্ধ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ৩ থেকে ১৫ মিলিয়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ হারায় ৬০ মিলিয়নেরও অধিক সংখ্যক মানুষ, যা সেই মুহূর্তে গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যার আড়াই শতাংশ!
এই সময়টাতে মানুষ খুব বেশি করে শঙ্কিত হয়ে পড়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। যেখানে প্রতিদিনের জীবনযাপন আর আগের মত থাকছে না, প্রতি মুহূর্তেই মানুষ ভুগছে নিজের অথবা প্রিয়জনের মৃত্যুর আশঙ্কায়, আকাশ থেকে বৃষ্টির বদলে বোমাবর্ষণ হয়ে তছনছ করে দিচ্ছে শহর, ঘরবাড়ি তখন স্বাভাবিকভাবেই সমষ্টিগত জনগোষ্ঠী নিয়ে চিন্তা করার কোন অবকাশই থাকে না। কে বুর্জোয়া আর কে প্রলিতারিয়েত সে চিন্তা বাদ দিয়ে সবাই নিজ নিজ ব্যক্তিসত্ত্বাকে লক্ষ্য করতে থাকে আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে।
গণমানুষের এই চিন্তাধারার প্রভাব পড়ে দার্শনিকদের কর্মপন্থায়। তাই তারা মানব সভ্যতার এই ক্রান্তিকালে- “পৃথিবীর জন্ম কেন এবং কোথা হতে?”, “মানুষ সৃষ্টির কারণ কি?”, অথবা “পরম সত্য কি এবং মানুষের পক্ষে পরম সত্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব কিনা?”- এইসব ধোঁয়াটে প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া বাদ দিয়ে এমন সব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে ন্যস্ত হয়, যা মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেমন- “আমি কে?” , “অস্তিত্ব কি?” এবং “ মানুষ নিজের পরিচয় স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে কি?”- এই সমস্ত প্রশ্ন তখন প্রাধান্য পেতে থাকে। অতিশয় শঙ্কাকুল একটি মুহূর্তে অস্তিত্ববাদ এগিয়ে আসে এমন একটি দর্শন হিসেবে, যা মানুষকে সমষ্টিগতভাবে বিবেচনা না করে প্রতিটি মানুষের অস্তিদত্বকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করে, প্রত্যেক ব্যক্তিসত্ত্বা যে বা যারা নিজ অস্তিত্বের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে তাকে এবং তাদের দেয় বীরের মর্যাদা।
অস্তিত্ববাদের নেই কোন নির্ধারিত সংজ্ঞা। একেকজনের কাছে এর অর্থ একেক রকম। তবে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে অস্তিত্ববাদ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত- আস্তিক্যবাদী এবং নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদ। সোরেন কিয়ের্কেগার্দ আস্তিক্যবাদী এবং ফ্রেডরিখ নীটশে, জ্যা পল সার্ত নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদের পুরোধা হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত।
জনসাধারণের বোঝার সুবিধার জন্য অস্তিত্ববাদের কিছু অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে একমত হন আধুনিক দার্শনিকরা। প্রথমত, অস্তিত্ববাদী দর্শনের একদম কেন্দ্রে থাকে ব্যক্তি অস্তিত্ব। অস্তিত্ববাদের গবেষণার বিষয় হচ্ছে ব্যক্তি অস্তিত্বের ভয়ভীতি, দুর্বলতা এবং অন্যান্য মানসিক অবস্থার পর্যালোচনা করা। দ্বিতীয়ত, অস্তিত্ববাদ মানবজাতিকে সার্বজনীনভাবে বিবেচনা করে না। অর্থাৎ, ঠিক-বেঠিক, সত্য-মিথ্যা, ভুল-ভ্রান্তির কোন সর্বজনগৃহীত সংজ্ঞা প্রদান না করে প্রতিটি মানুষের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে কোন সিদ্ধান্তের যথার্থতা বিবেচনা করাকে অনুপ্রাণিত করে। তৃতীয়ত, অস্তিত্ববাদ মানুষের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়াকে অনপ্রাণিত করে এবং চতুর্থত, অস্তিত্ববাদ বলে- যেকোন স্বাধীন সিদ্ধান্তের দায়ভার নিতে হবে সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তির, যিনি সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন।
এই সাধারণ আলোচনাটুকুর পর আমরা দেখতে পারি, অস্তিত্ববাদ কিভাবে পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্য- উভয়াঞ্চলের সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে।
পাশ্চাত্যে বিংশ শতাব্দীর অস্তিত্ববাদী দর্শনকে সাহিত্যে প্রবেশ করানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন নোবেল বিজয়ী ফ্রেঞ্চ সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং দার্শনিক আলবেয়ার কামু, যদিও তিনি সবসময়ই বলে এসেছেন, তিনি অস্তিত্ববাদী চিন্তাধারার পথিক নন। তিনি সাহিত্যে যে ধারাটির শক্তিশালী প্রবর্তন ঘটিয়েছেন তার নাম এ্যাবজার্ডিজম বা অদ্ভুতবাদ। এ্যাবজার্ডিজম- নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদের একটি শ্রেণীবিশেষ। এই ধারার মতে মানুষ জন্মের পরপরই লক্ষ্য করে যে তার তথাকথিত স্বাধীন সত্ত্বা সমাজের বিবিধ টানাপোড়েনে বন্দী এবং জীবনের শেষ প্রান্তে অমোঘ পরিণতি হিসেবে অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু। এটা উপলব্ধি করার পর সে তার স্বাধীন অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নিবিষ্ট হয়। এমতাবস্থায় যদি সে তার আলাদা ব্যক্তি অস্তিত্ব নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সাধনায় ব্যর্থ হয়, তবে সে সত্তা পরিণত হয় এক এ্যাবজার্ড সত্তায়।
আলবেয়ার কামু তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দা আউটসাইডারে অস্তিত্ববাদের সূত্রগুলোর মানবিক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মারসল্ট। স্বল্প আয়ের অতি সাধারণ একজন মানুষ। বাঁধা মাইনের অফিসে চাকরি করা ছাড়া ছুটিছাঁটার দিনগুলো কাটে গার্লফ্রেন্ডের সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটিয়ে, প্রতিবেশীর সাথে ভদ্রতাসুলভ বাক্যালাপ করে, আর জানালার পাশে বসে মানুষজনের চলাফেরা লক্ষ্য করে।
উপন্যাসের শুরুতে মারসল্টকে দেখা যায় তার মৃত মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে। উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে হঠাৎ তার জীবন একটা বড় ধরনের মোড় নেয় যখন সে এবং তার বন্ধু অনাকাক্সিক্ষতভাবে একদল আরবের সাথে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং মারসল্ট ঘটনাক্রমে খুন করে ফেলে এক আরবকে। আদালতে তার ফাঁসির আদেশ হয়। মূল ঘটনা এতটুকুই। কিন্তু এরকম অতি সাধারণ একজন মানুষের একঘেয়ে দৈনন্দিন জীবনের মাঝেই কামু যে এ্যাবজার্ড এক্সিস্টেনশিয়ালিজমের নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন এটাই তাঁর সাহিত্যকর্মের সার্থকতা। উপন্যাসটির একদম শুরুর প্যারাটি লক্ষ্য করা যাক- “মা হয়ত আজ মারা গেছেন, অথবা গতকাল- আমার ঠিক জানা নেই। বৃদ্ধাশ্রম থেকে টেলিগ্রাম করা হয়েছে- ‘তোমার মা মারা গেছেন, আগামীকাল শেষকৃত্য’- অর্থহীন এক টেলিগ্রাম।‘ প্রথম প্যারা থেকেই কামু বলতে গেলে একদম ধাক্কা দিয়ে পাঠককে প্রবেশ করান মুখ্য চরিত্র মারসল্টের এ্যাবজার্ড পৃথিবীতে। নিজের মায়ের মৃত্যুতে মারসল্টের অতি শীতল অনুভূতি পাঠককে বিস্মিত করে। ম্যারি কর্ডোনা, মারসল্টের প্রেমিকা, যার সাথে মারসল্ট নিয়মিতই বিছানা ভাগ করে, সে একপর্যায়ে তাদের সম্পর্ককে একটা স্থায়ী সম্পর্কে রূপ দিতে চায়, বিয়ে করতে চায় মারসল্টকে। মারসল্ট তখন বলে- “সে (ম্যারি) জানতে চাইছিল আমি তাকে ভালবাসি কিনা, আমি উত্তর দিলাম ভালবাসার কোন বিশেষ গুরুত্ব নেই আমার কাছে, কিন্তু যদি একান্তই একটা উত্তর দিতে হয়, তবে আমার উত্তর হবে নেতিবাচক (যা প্রমাণ করে মারসল্টের ম্যারির প্রতি আকর্ষণ ছিল শুধুই শারীরিক)।’ ‘তবে আমায় বিয়ে করবে কেন তুমি?’- ম্যারি জিজ্ঞেস করতে আমি উত্তর দিলাম, আমার কাছে বিয়েও খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, তবে যদি তুমি চাও, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারি।”
এবার আসা যাক উপন্যাসের সেই অংশে, যা মারসল্টের জীবন বদলে দেয় চিরতরে। বন্ধুর সাথে ছুটি কাটাতে গিয়ে একরকম হাতাহাতিই লেগে যায় তাদের সাথে একদল আরবের সাথে। ঘটনার ফলে মারসল্ট গুলি করে বসে এক আরবকে। তারপর সে তার অনুভূতি ব্যক্ত করে- “আমি অনুভব করলাম, দিনের যে এক সুশৃঙ্খল ভারসাম্য, আমি তাকে নষ্ট করে ফেলেছি। সমুদ্রতটের যে এক প্রশান্তিমাখা পরিবেশ তাও আর নেই। আমি আবারও গুলি করলাম , পরপর চারবার......।‘
উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি ঘটনা আমাদের মুখ্য চরিত্র মারসল্টের মানসিকতার ওপর আলোকপাত করতে সাহায্য করে। তার একঘেয়ে জীবন প্রণালীর ফলে তার স্নায়ুতন্ত্রও কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলছিল ক্রমাগত। প্রচলিত অর্থে ‘মানবিক গুণাবলী’ বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না তার মধ্যে কিছুই। মায়ের থেকে দীর্ঘদিনের দূরে থাকার কারণে মায়ের মৃত্যুর খবর তাকে নাড়া দেয় না; নিতান্ত শারীরিক কারণেই তার একজন প্রেমিকার প্রয়োজন, মানসিক বন্ধন এবং বিয়ে ইত্যাদি তার কাছে কোন বিশেষ অর্থবহন করে না এবং একজন মানুষকে হত্যা করার পর বন্দুকের গুলির আওয়াজে আশপাশের নীরবতা বিনষ্ট হওয়াটা তাকে বেশি নাড়া দেয়।
জেলের মধ্যে মারসল্ট একজন ‘স্বাধীন’ মানুষের মতো চিন্তা করার অবকাশ পেয়ে সচেতন হয়ে ওঠে তার অস্তিদত্ব সম্পর্কে- ‘যখন আমি কল্পনা করতাম সমুদ্রতীরে সমুদ্রের পানির গর্জন করে এসে আমার শরীরে ঝাপটা দিচ্ছে, আমি উপলব্ধি করতাম দারুণ এক স্বাধীনতা, আর আমি নতুন করে আবিষ্কার করতাম যে জেলের গরাদের পেছনে আমি কী ভীষণরকম বন্দী!’
এই সদ্য অস্তিত্বের স্বাদ পাওয়া লোকটি অবাক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে, বাদীপক্ষের উকিল তার মায়ের শেষকৃত্যে তার গাছাড়া ভাবলেশহীন উপস্থিতিকে মারসল্টের মানবিক গুণাবলী বিবর্জিত হবার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করছে। বিচারক সে যুক্তি গ্রহণ করে মারসল্টের মৃত্যুদণ্ডাদেশও দিয়ে দেন। অথচ মারসল্টের মায়ের শেষকৃত্যের সাথে সেই আরবদের সাথে বিবাদে জড়ানোর কোন সম্বন্ধই নেই, দুটো ঘটনা ঘটেছে সম্পূর্ণ ভিন্নদুটি প্রেক্ষিতে। এই দুটো ঘটনাকে একত্র করে বিচারকের চরম সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর অবিচার মারসল্ট মেনে নিতে পারে না। তাই যখন চার্চের ফাদার এসে মারসল্টকে তার কৃতকর্মের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বলে, মারসল্ট রূঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে তাকে- ‘সে (চার্চের ফাদার) তো নিজেই জানেনা যে সে বেঁচে আছে কিনা। তার অবস্থা জীবন্মৃতের। আমি আমার অস্তিত্বের ব্যাপারে সচেতন। আমি অন্তত এটা জানি যে আমার জন্যে দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করে আছে মৃত্যু।’
এভাবে, মারসল্টের অস্তিত্বের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সচেতন হয়ে ওঠাকে ফুটিয়ে তোলার পর কামু তার সংক্ষিপ্ত এ উপন্যাসের ইতি টানেন।
অস্তিত্বের স্বাধীনতা ফুটিয়ে তোলার একই রকম প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যায়। উপন্যাসটি তাঁর অস্তিত্ববাদী উপন্যাসত্রয়ীর (লালসালু, চাঁদের অমাবস্যা এবং কাঁদো নদী কাঁদো) দ্বিতীয়টি।
মূল চরিত্র যুবক শিক্ষক আরেফ আলী গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করে, লজিং মাস্টার হিসেবে থাকে সেই গ্রামের প্রভাবশালী দাদা সাহেবের বাড়িতে। একরাতে প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গিয়ে বাঁশঝাড়ের আড়ালে অর্ধউলঙ্গ এক যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখতে পায়। পরক্ষণেই সেখানে দাদা সাহেবের ছোট ভাই কাদেরের উপস্থিতি লক্ষ্য করে আরেফ। সে বোঝে, এই নারীকে হত্যা করেছে কাদের। উপন্যাসের বাকি অংশ জুড়ে লেখক অঙ্কিত করেছেন যুবক শিক্ষকের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই- দরিদ্র শিক্ষক আরেফ কী এই হত্যাকাণ্ডের একমাত্র দর্শক হয়েও চুপ করে থাকবে, নাকি মুখ খুলবে এই অপরাধের বিরুদ্ধে, রুখে দাঁড়াবে শক্তিশালী বড়বাড়ির বিপরীতে?
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ একদম নিখুঁতভাবে চিত্রায়িত করেন আরেফ আলীর অস্তিত্ব সঙ্কটের মুহূর্তগুলো। মৃতদেহ দেখার পর আরেফকে গ্রাস করে নেয় তীব্র ভীতি। উপন্যাসেই ফিরে যাওয়া যাক- “আলো অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধউলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়...... তারপর কোথাও তীব্রভাবে বাঁশি বাজতে শুরু করে... তখন থেকে সে উ™£ান্তের মতো ছোটাছুটি করছে... চরকির মত, লেজে কেরোসিনের টিন বেঁধে দিলে কুকুর যেমন ঘোরে তেমন।’
আরেফের ভয়টা অন্যকিছু নিয়ে নয়, তার অস্তিত্ব নিয়ে। কারণ বড়বাড়ির দাদা সাহেবের আপন ছোট ভাই কাদেরের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তা হবে প্রভাবশালী বড় বাড়ির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণার স্বরূপ- ‘যুবতী নারীর মৃত্যুর বীভৎসতা সে কিছুক্ষণের জন্য বোধ করলেও তার প্রতি কোন দুঃখ হয় নাই বা তার প্রতি গভীর অন্যায়টির সুবিচার হোক তার প্রয়োজন বোধ করে নাই। সে শুধু ভয়ই বোধ করেছে, নিজের জীবনের জন্য ভয়।’ কিন্তু নানা ঘটন-অঘটনের পর নিজের মনের সাথে দীর্ঘ যুক্তিতর্কে অবতীর্ণ হয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, যা হবার হবে, সে কাদেরের অপরাধ গোপন রাখবে না। যুবক শিক্ষক আরেফ নিমজ্জিত হয় নিজের অস্তিত্বকে স্বাধীন অস্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠার আনন্দে- “তার মনের তৃপ্তির কারণ সে বুঝতে পেরেছে তার তৃপ্তির কারণ এই যে, মনে মনে সে যে সব সম্ভাবনা দেখেছিল তা সত্যে পরিণত হয়ে তার সিদ্ধান্তকে অর্থপূর্ণ করেছে... সে সংগ্রাম পরের বিরুদ্ধে মনে হলেও আসলে নিজের বিরুদ্ধেই ছিল, সে সংগ্রাম সে জয়লাভ করেছে।’
আরেফ প্রস্তুত হয় নিজের চরম পরিণতির জন্য। কেননা, পুলিশের কাছে বিচার পৌঁছানর পর পুলিশ বড়বাড়ির বিরুদ্ধে নয়, আরেফকেই খুনী দেখিয়ে মামলা দায়ের করে আরেফের নামেই।
কিন্তু আরেফ এর মাঝেই খুঁজে পায় নিজের অস্তিত্বের যথার্থতা- ‘শাস্তিটার অর্থ যখন মৃত যুবতির কাছে পৌঁছাবে না, তখন কে শাস্তি পাবে তাতে আর কী এসে যাবে?... যুবক শিক্ষক যদি ভুল করে শাস্তিটা নিজের ওপরেই টেনে আনে, যুবতী নারীর মৃত্যুর জন্য সে-ই যদি অবশেষে শাস্তি পায়, তবে শাস্তিটা আসলে যার উদ্দেশ্যে সেখানে তা পৌঁছাবে।’ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ এভাবে নিতান্তই গ্রাম বাংলার পটভূমিতে পাশ্চাত্যের ভাবধারায় উপনিবিষ্ট দর্শন অস্তিত্ববাদের যথার্থ রূপায়নের দ্বারা এই দর্শনের সার্বজনীনতা নিশ্চিত করেন।
এভাবেই অস্তিত্ববাদ ছড়িয়ে পড়ে শুধুপ্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সাহিত্যে নয়-পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাহিত্যিকদের সাহিত্য কর্মে। একটি দার্শনিক চিন্তাধারা যখন অনুপ্রবেশ ঘটে সাহিত্যের জগতে, তখন আর তা সমাজের বিশেষ কোন শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট থাকে না, তা হয়ে ওঠে গণমানুষের হাতিয়ার। তাই যদিও মার্ক্সবাদীদের কেউ কেউ অস্তিত্ববাদকে অভিহিত করেছেন বুর্জোয়া দর্শন টিকিয়ে রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে, আখ্যা দিয়েছেন আত্মিকতার মহাযজ্ঞ হিসেবে, তবুও অস্তিত্ববাদ টিকে আছে মাথা উঁচু করে।
অস্তিত্ববাদ টিকে থাকবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচণ্ড প্রেষণের বিপরীতে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠাকরণের এক বলিষ্ঠ দার্শনিক প্রচেষ্টা হিসেবে।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=37&dd=2014-06-06&ni=175142

1 comment:

  1. বাংলা শুধুই বাংলা: সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ কামু এবং ওয়ালিউল্লাহ সাজিদ উল হক খান আবির >>>>> Download Now

    >>>>> Download Full

    বাংলা শুধুই বাংলা: সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ কামু এবং ওয়ালিউল্লাহ সাজিদ উল হক খান আবির >>>>> Download LINK

    >>>>> Download Now

    বাংলা শুধুই বাংলা: সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ কামু এবং ওয়ালিউল্লাহ সাজিদ উল হক খান আবির >>>>> Download Full

    >>>>> Download LINK

    ReplyDelete