Thursday, June 5, 2014

কতটা পথ হাঁটতে পারবে নারী কামরুল হাসান

কতটা পথ হাঁটতে পারবে নারী
কামরুল হাসান
নারীর অগ্রগতি উত্তর আধুনিক বিশ্বে আজ এক বিস্ময়। এভারেস্ট থেকে মহাকাশ সর্বত্র যার পদার্পণ।শিক্ষার প্রসার এবং ক্ষমতায়নের ফলে নারী অর্থনৈতিক- সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অর্বতীণ।মহাসমারোহে এগিয়ে যাচ্ছে নারীর পথ চলা। বর্তমান বিশ্বের বহু দেশেই নারী আজ রাষ্ট্র প্রধানের ভূমিকায়। সকল প্রতিকুলতার মাঝেও নিজেকে মেলে ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সভ্যতার যাত্রা। কিন্তু এতসব প্রাপ্তির পাশাপাশি নানা বিয়োগান্তক ঘটনা আমাদের মর্মাহত করছে। আমরা আজও হতবাক হচ্ছি আধুনিক বিশ্বে নারীর প্রতি নানা সহিংস ঘটনায়। সেই সঙ্গে দেশ বিদেশের বিভিন্ন নারী নির্যাতনের ঘটনাও আমাদের ক্ষুব্ধ এবং অসহায় করে তুলছে। পত্রিকার পাতায় জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রীদের পাশাপাশি আমাদের দেখতে হয় এ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া কোন তরুণীর বীভৎস শরীর। ধর্মীয় নেতার তেঁতুল তত্ত্ব কিংবা ইভটিজিংয়ের সংবাদ ছাপিয়ে শিরোনাম হয় গুলিবিদ্ধ কোন শিক্ষানুরাগী কিশোরী মালালা ইউসুফজাই। আবার মার্কিন সামরিক বহরে নারীর প্রতি সহকর্মীদের যৌন হয়রানি এক অদ্ভুত কারণে সংবাদের পাতায় ঢাকা পড়ে যায়। নারীর প্রতি এমন সহিংস ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে ভিন্ন আঙ্গিকে। একদিকে বোকো হারামের হাতে অপহৃত হচ্ছে নাইজিরিয়ার তিন শ’ ছাত্রী। অন্যদিকে সিরিয়ার যুদ্ধে বিদ্রোহীরা নারীকে সাফল্যের পুরস্কাররূপে গ্রহন করছে। চীন- ভারতে কন্যা শিশুর ভ্রণ হত্যাও চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। বর্তমানে দেশ দুটিতে কন্যা শিশুর জন্ম গ্রহণের হার হ্রাস পাচ্ছে জ্যামিতিক হারে। সৌদি আরব কিংবা ইরানে নারীর স্বাধীনতা ধর্মীয় আইনের মাঝেই সীমাবদ্ধ। আফ্রিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থা আরো করুণ।যুদ্ধ-বিগ্রহসহ নানা কারণে ক্ষত বিক্ষত এই মহাদেশে নারী যুদ্ধের বলিতে পরিণত হয়েছে। আর পশ্চিমা রাষ্ট্রে নারীর স্বাধীনতার নামের আড়ালে তাকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে যৌনবৃত্তিতে। পৃথিবীর প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে একজন নারী তার জীবদ্দশায় ধর্ষণ, অপহরণ এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। প্রতিবছর ঘরে-বাইরে অসংখ্য নারী এই সহিংসতার বলি। এই হামলার মূলে রয়েছে সেই মানসিকতা যা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান এবং অধিকার দিতে অনিচ্ছুক। মূলত ধর্ম-বর্ণ-সামাজিক অবস্থানসহ নানা কারণে নারী সামাজিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। এই ধরনের সামাজিক সীমাবদ্ধতা নারীর স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ব্যহত করছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি। রাষ্ট্রীয় আইনেও নারী তাঁর ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হয়। কর্মস্থল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র এখন নিপীড়নের শিকার নারী। এ সকল নিপীড়ন এবং উত্ত্যক্তের ফলে অনেক তরুণী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এছাড়া অপহরণ-পাচার যৌতুক বাল্য বিবাহের মতো ঘটনার কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় অসংখ্য নারী। ইদানীং গণধর্ষণের মতো ঘটনা হরহামেশা সংবাদের শিরোনামে পরিণত হয়েছে। নারী নির্যাতনের ঘটনা এখন পৃথিবীর সব প্রান্তেই ঘটছে। এ ধরনের সহিসংতা মানবাধিকারের পরিপন্থী এবং নানা উপায়ে তা সংঘটিত হচ্ছে।
এক. পুলিশ হেফাজতে নারী নির্যাতন
দুই. এ্যাসিড সন্ত্রাস এবং যৌতুকের বলি
তিন. সম্মানজনক হত্যাকা-
চার. নিজগৃহে নির্যাতন
পাঁচ. কন্যা শিশুর ভ্রণ হত্যা
ছয়. কর্মস্থলে বৈষম্য
সাত. শরণার্থী শিবিরে নির্যাতন
আট. আইনী শাসনের অপ্রতুলতা
নারী ধর্ষণের হাজার হাজার ঘটনার বিচার আজও বিভিন্ন রাষ্ট্রের আদালতে ঝুলে আছে। নির্যাতক অপরাধীরা মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। নির্যাতিত ব্যক্তিরাই অপরাধীর মতো জীবন কাটাচ্ছে। এই প্রবণতার কারণে নারী বিচারহীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় আইনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্বঘাতী সিদ্বান্ত উপনীত হচ্ছে। নারীকে নিকৃষ্টতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে একশ্রেণীর পুরুষ কেবল ধর্ম-দর্শন আর ধর্মতত্ত্বকেই ব্যবহার করছে না, তারা জীববিজ্ঞানকেও উদাহরন হিসেবে টেনে আনছে। অন্যদিকে নারী মুক্তির নামে একশ্রেণীর প্রচারমুখী নারী সংগঠিত হয়। যারা নিজ পেশায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। কিছু সভা-সমাবেশ ব্যতিরেকে তারা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। বরং ফ্যাশনেবল রমণীর মতোই কেতাদুরস্ত পোশাকে সভা-সমাবেশ বক্তব্য প্রদানেই নিজেদের কর্মকা- সামীবদ্ধ রাখে । নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু আন্দোলনের সূচনা হলেও রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে এ ব্যাপারে কোন চিন্তাভাবনা বা প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চরিত্রের মাঝে যে বৈষম্য তা চিহ্নিত না করে বরং নারী- পুরুষ দ্বন্দ্বকেই চিত্রায়িত করা হয়। তৃতীয় বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের চিত্রই মোটামুটি এক। ধর্মীয় -সামাজিক অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে উন্নয়নশীল দেশের এসব নারীরা তাদের প্রাপ্য সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ঘরের চারদেয়ালের মাঝে নারী অনেক পরিশ্রম করলেও তা কোন আর্থিক সূচকে পরিমাপ করা হয় না। বরং অবধারিতভাবে ঘরের কাজ নারীর কর্তব্য বলেই বিবেচিত হয়।
ঘরের বাইরে নারী নানা প্রতিকূলতার সম্মখুীন। গ্রামে ধর্মীয় ফতোয়া, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক কর্তৃক যৌন নিপীড়ন, কর্মস্থল কিংবা চলার পথে ইভটিজিং। আইন করে এসব বৈষম্য রোধ করা সম্ভবপর হয়ে উঠছে না শুধুমাত্র আমাদের সঠিক রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের কারণে। এই দায়িত্ববোধ পুরুষের পরিবার থেকেই শিক্ষা দেয়া উচিত।সম্প্রতি বোকোহারাম কর্তৃক তিন শত ছাত্রী অপহরণ আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য একটি ঘটনা। বোকোহারাম নাইজিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন। আত্মঘাতী বোমা হামলা, নিরীহ মানুষ হত্যা তাদের যুদ্ধপদ্ধতি। আলকায়েদার মতো চরমপন্থী এই সংগঠনটি পশ্চিমা শিক্ষা- সংস্কৃতির বিরোধী এবং নিজেদের আদর্শ বাস্তবে অত্যন্ত কঠোর। তেলসমৃদ্ধ আরব রাষ্ট্রসমূহ : সৌদি আরব, কাতার, ইউএইসহ যুক্তরাজ্যের কিছু গোষ্ঠী বোকোহারামের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে থাকে।ন্যাটোর অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা (এমআইটি) আফ্রিকায় নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতিফলন ঘটাতে এমন জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সাহায্য করে থাকে। সম্প্রতি জঙ্গী সংগঠনটি দেশটির বোর্নো রাজ্য থেকে তিন শ’র বেশি ছাত্রীকে অপহরণ করে। অপহৃত ছাত্রীদের বেশিরভাগই খ্রীস্টান। সম্প্রতি এক ভিডিওবার্তায় দেখা যায় অপহৃত ছাত্রীদের পুরো শরীর কালো পোশাকে ঢাকা এবং মাথায় হিজাব পরা। এই মেয়েরা ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে বলে ভিডিও বার্তায় জানানো হয়। পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের অপরাধে মোট ৩২৮ জন ছাত্রীকে অপহরণ করা হয়। এর মধ্যে ৫৩ ছাত্রী পালিয়ে আসতে পেরেছে। বাকি ২৭৬ জন এখনও সংগঠনটির হাতে আটক রয়েছে। অপহৃত ছাত্রীদের দাস হিসেবে বিক্রি করার ঘোষণাও দিয়েছিল জঙ্গী দলটি। এবং তাদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিশ্চুপ থাকতে বলা হয়েছে। ইতোমধ্যে আরও আট ছাত্রীকে অপহরণ করে বোকোহারাম।
সরকার কর্তৃক অপহৃত ছাত্রীদের উদ্ধারের ঘটনার পর রীতিমতো গণহত্যা চালিয়ে ৩০০-এর বেশি মানুষ হত্যা করে বোকো হারাম। অপহৃত স্কুল ছাত্রীদের উদ্ধারে ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা, চীন, নাইজিরিয়ার সরকারকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও এই সাহায্যের আড়ালে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ভিন্ন স্বার্থকেই চিহ্নিত করেছে বিশ্লেষকরা। অপহৃত ছাত্রীদের উদ্ধারের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু নারী সংগঠন সমাবেশ এবং র‌্যালির আয়োজন করে। ইৎরহম নধপশ ড়ঁৎ এরৎষং প্ল্যাকার্ড হাতে এইসব সমাবেশে অংশ নেয় আগতরা। ব্রিটেন, আমেরিকা, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে এই সংহতি প্রকাশ করা হয়। অপহৃত হওয়ার অর্ধশত দিন পার হওয়ার পর দিনে দিনে এই সংহতি বেড়ে চলেছে। টুইটার এবং ফেসবুকে এ্যাকাউন্ট এবং পেজ খোলা হয়েছে। আফ্রিকার এই অপহরণ বাণিজ্য নতুন নয়। অপহৃত ব্যক্তিদের আবার দাস হিসেবে বিক্রি করা হয়। নাইজিরিয়া, ক্যামেরুন, সেনেগালসহ প্রায় ১০টির বেশি দেশে এই দাস কেনাবেচা হয়।
অপহৃত ছাত্রীদের কেনার প্রস্তাব দেয় সেনেগাল। নারী শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করতে এবং মেয়েদের শিক্ষাবিমুখ করে ঘরের চারদেয়ালে পশ্চাৎপদ করে রাখতে চায় কিছু উগ্রবাদী জঙ্গী সংগঠন। পূর্বে পাকিস্তানেও আমরা এরূপ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠন সেই দেশের এক কিশোরীকে মাথায় গুলি করেছিল। গুলিবিদ্ধ মালালার অপরাধ সে পাকিস্তানের নারীদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বিবিসির ব্লগে একটি লেখা পোস্ট করেছিল।পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল খাইবার পাখতুন খোয়ার সোয়াত জেলার মিনগোরা শহরে এই ঘটনাটি ঘটে।
পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে তালেবানের শান্তি চুক্তি রোধ হওয়ার পর সে অঞ্চলের নারীদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় সংগঠনটি। কার্যত পুরো অঞ্চল তখন তালেবানের শাসনাধীন ছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে মালালা ইউসুফজাই তালেবান শাসনে তার জীবনযাত্রা এবং শিক্ষা ব্যহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে বিবিসি ব্লকে ছদ্মনামে একটি লেখা পাঠান। নিউইওয়ার্ক টাইমসের একজন সাংবাদিক এডাম বে মালালা ইউসুফজাইকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। যেখানে তালেবান শাসন এবং সেনা অভিযানের ফলে তাদের শিক্ষা জীবন নষ্ট হওয়ার বিষয় তুলে আনা হয়। সেই ডকুমেন্টারি ফিল্মের সুবাদে মালালা আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছিল। তালেবানের হামলার পর মালালা বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত এবং নানা পুরস্কারে ভূষিত হলেও তাঁর অনেক বন্ধু এখনো সেই তালেবান শাসনেই জীবন পার করছে। পশ্চিমা মিডিয়ার সমস্যা হলো সঙ্কট সমাধানে মনোযোগ না দিয়ে বরং আলোকপাত করার বেশি মনোযোগ দেয়। শুধু একজন মালালাকে তাঁর সাহসী পদক্ষেপের জন্য পুরস্কৃত করা যথেষ্ট নয়। বরং সেই অঞ্চলসমূহে আরো বেশি নজর দেয়া উচিত যেখানে নারীদের স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয় এবং নারী শিক্ষা বন্ধের জন্য নানা ফতোয়া জারি করা হয়। আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ অনেক দেশে এখনও নারীর শিক্ষার প্রসার ব্যহত এবং শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। বাংলাদেশের একজন ধর্মীয় শিক্ষক এই ব্যাপারে একটি মন্তব্য করার মাধ্যমে যথেষ্ট বিতর্কিত এবং সমালোচিত হয়েছেন। আল্লামা শফি তাঁর এক বক্তব্যে বলেছিলেন, মেয়েদের ক্লাস ফোর ফাইভ পড়লেই যথেষ্ট। এছাড়া নারীর কর্মসংস্থানের বিরোধিতা করে তিনি তেঁতুল তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটান। ইসলামী চিন্তা-চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত এমন অনাধুনিক বক্তব্য একজন ধর্মীয় শিক্ষককেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে না বরং ইসলাম সম্পর্কে তাঁর প্রজ্ঞাকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে। ইসলামে প্রতিটি নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আবার অন্যদিকে পবিত্র হাদিসে বলা আছে ‘জ্ঞান অর্জনের জন্য সূদূর চীন দেশে যাও’। নারীর শিক্ষা এবং কর্মসংস্থান বিরোধী এমন বক্তব্য সর্ব মহলেই নিন্দিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এবং পার্লামেন্ট কর্তৃক এমন ফতোয়া রোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরী।
মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে একমাত্র ইরান নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে। বর্তমানে দেশটির বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স কিংবা পিএইডডি ডিগ্রীধারীদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। পোশাকী বাধ্যবাধকতা ছাড়া দেশটি নারীর অধিকার আদায়ে সম্পূর্ণ সজাগ এবং সোচ্চার। সিরিয়ায় নারী এখন যুদ্ধে অংশগ্রহণের পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত হয়। আসাদবিরোধী গৃহযুদ্ধে ন্যাটো মদদপুষ্ট নানা জঙ্গী সংগঠন মেয়েদের হরহামেশা ভোগের পণ্য হিসেবেই ব্যবহার করছে। এছাড়া দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধের ফলে দেশছাড়া অসংখ্য নারী শরণার্থী শিবিরে দুর্বিষহ দিন পার করছে। ইউরোপে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য নারীর ভাগ্যে কি জুটছে তা বলা দুষ্কর। হয়ত কোন পতিতা পল্লীতেই হবে তাদের শেষ ঠিকানা। কোন দেশে যুদ্ধ-বিগ্রহ হলেই এক শ্রেণীর মানুষ ওঁৎ পেতে থাকে নারীকে ব্যবহার, ভোগ কিংবা পাচারের উদ্দেশ্যে। নারী পাচার এখন বিশ্বের অন্যতম একটি সঙ্কট। বিশ্বে প্রতিবছর ৮ লাখ নারীকে আন্তর্জাতিক সীমারেখা অতিক্রম করে অন্যত্র পাচার করা হয়। বিভিন্ন দেশের পতিতাপল্লীতেই যাদের শেষ ঠিকানা। পতিতাপল্লী ছাড়াও এ সকল নারীকে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি তৈরি, নাইটক্লাব, পার্লারসহ নানা যৌন কাজে ব্যবহার করা হয়। মূলত এশিয়া এবং আফ্রিকার নারীরাই এই পাচারের লক্ষ্যবস্তু এবং তাদের পূর্ব ইউরোপ কিংবা পশ্চিম ইউরোপে পাচার করা হয়। লোভনীয় চাকরি, বিবাহ কিংবা প্রেমের ফাঁদে ফেলে গ্রামের নারীদের এই চক্রে ফেলা হয়। উন্নয়নশীল বহু দেশেই গ্রামের অভাবগ্রস্ত নারীদের শহরে চাকরি দেয়ার লোভ দেখিয়ে পাচার করা হয়। এশিয়ার নারী পাচারের শীর্ষে রয়েছে কম্বোডিয়া। দেশটির বেশিরভাগ নারী থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার পতিতা বাজারে পাচার করা হয়। এছাড়া রাশিয়ান ফেডারেশন এবং পূর্ব ইউরোপের মেয়েদেরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো হয় এই নারীদের ঠিকানা। বিশ্বের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রের হোটেলেই জোটে তাদের কর্মসংস্থান।
বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় এক ধরনের ‘নারী অধিকার’ এবং ‘নারী মুক্তি’ কথা শোনা যায়। ঋবসরহরংঃ সড়াবসবহঃ নামক এই ধরনের নারীবাদী আন্দোলন সমাজে নারীর নানা অধিকারহীনতা, সহিংসতা এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে থাকে। এ ধরনের নারীবাদী আন্দোলন ও তৎপরতা কার্যত প্রকৃত নারী অধিকার ও মুক্তির পক্ষে বরং ক্ষতিকর এবং বিপজ্জনক। এ ধরনের আন্দোলন সাংস্কৃতিক বা চিন্তাগত ক্ষেত্রে পরিবর্তন না ঘটিয়ে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিয়ে নারীর মুক্তি ঘটাতে চায়। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন যতটা সহজ, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ততটা সহজ নয়। নারীর পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও মুক্তির পথই হলো নারী-পুরুষ সম্পর্কের বিন্যাস। স্বামী, পরিবার কিংবা সমাজ যতদিন নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মানসিকতা দূর করবে না ততদিন নারী মুক্তির আন্দোলন কার্যত বিফলেই যাবে।
পশ্চিমা বিশ্বে ফরাসী বিপ্লবের পর নারী অধিকার ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হতে থাকে। এশিয়া-আফ্রিকার মেয়েদের তুলনায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদেও আসীন হোন পশ্চিমা নারীকুল। শুধুমাত্র শিক্ষার ফলেই নানা ক্ষেত্রে তাদের এই ক্ষমতায়ন। কিন্তু সেসব দেশে নারীর সার্বিক চিত্র অত্যন্ত করুণ। রাত নামলেই রাস্তায় পতিতাদের ভিড়, পাব-ডিসকোসহ সকল নাইট ক্লাবে নারীর খোলামেলা নগ্নতা। সিনেমা, টিভিতে অবাধ যৌনতা নারীকে যৌন পণ্য হিসেবেই বিবেচনা করার শামিল। ইদানীং পশ্চিমা বিশ্বে নারী ও শিশু ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিতে। খোদ মার্কিন সেনাবাহিনীতে নারী সদস্যরা পুরুষ সহকর্মী কর্তৃক যৌন নিপীড়নের শিকার হন। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মার্কিন সেনা ছাউনিতে এ ধরনের অসংখ্য ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ এখন আর অভিযোগ আমলে নেয় না। এছাড়া আমেরিকায় ধর্ষণের হারও অন্যান্য দেশের তুলনায় সর্বাধিক। পুঁজিবাদ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার নামে তাকে পণ্যতে পরিণত করতেই বেশি ভালবাসে। টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এছাড়া আমেরিকার চারটি রাজ্যে নারী অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত নয়। বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দুই দেশ ভারত-চীনে কন্যা শিশুর ভ্রণ হত্যা অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। চীনের এক সন্তান নীতির কারণে কোন দম্পতি মেয়ে সন্তান গ্রহণে আগ্রহী নয়। বেশিরভাগ বাবা-মা চান তাদের সন্তানটি হবে ছেলে। এই কারণে গর্ভাবস্থায় কন্যা শিশুর ভ্রণ হত্যা করেন অধিকাংশ দম্পতি। এছাড়া চীনে গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় খবরদারির কারণে নারী নির্যাতনের প্রকৃত চিত্র বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে পারে না। তবে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন খুব একটা দেখা যায় না। চীনের একমাত্র রাজনৈতিক দল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চ পর্যায়েও খুব একটা নারী চোখে পড়ে না। ভারত বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এই প্রথম দেশটির কোন নারী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যদিও ভারতের বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হলেন নারী। তাছাড়া প্রধান বিরোধী দলের প্রধানও নারী। এতসব প্রাপ্তির বিপরীতে ভারতে গণধর্ষণ রাষ্ট্রটির অন্যতম মাথা ব্যথার কারণ। রাজধানী দিল্লীর রাস্তায় কিছু গণধর্ষণের ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণœ করে। আফ্রিকার পর দেশটিতে নারী পাচারের হার সবচেয়ে বেশি। বৃহৎ এই রাষ্ট্রের গ্রাম অঞ্চলে নারীকে এখনও রক্ষণশীল আবহে বেঁচে থাকতে হয়। এছাড়া কন্যা শিশুকে বলী দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটে এই রাষ্ট্রে। চীনের মতো ভারতেও কন্যা শিশুর ভ্রণ হত্যা করা হয়। এ ছাড়া কন্যা বিবাহ দিতে গিয়ে যৌতুকের বিড়ম্বনা পোহাতে হয় কন্যা দায়গ্রস্ত পরিবারকে। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গেই ভারতীয় সিনেমায় নারীকে পণ্য হিসেবে দেখার মানসিকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তালেবান অধ্যুষিত আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে নারী শিক্ষা এবং স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলাই অবান্তর। পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলে পরিবারের অমতে বিবাহ কিংবা প্রেম করার অপরাধে মেয়েদের ঐড়হড়ঁৎ শরষষরহম করা হয়। এছাড়া পাথর ছুড়ে হত্যা করার মতো ঘটনা ঘটে অহরহ। আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তানে নারীর কার্যত কোন স্বাধীনতা নেই। থমকে আছে নারী শিক্ষার প্রসার এবং অধিকার। নারীর প্রতি সহিংসতা সামাজিক সমস্যা হলেও তা মূলত মানবাধিকারের লঙ্ঘন। রাজনৈতিক-সামাজিক এবং ধর্মীয় বিবেচনায় নারীকে পদদলিত করার মানসিকতা এখন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের নারীই আজ নির্যাতনের শিকার হয়। অনেক ক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের কারণ হিসেবে নারীকেই দায়ী করা হয়। লোক-চক্ষুর কারণে নারী প্রতিবাদ করতে ভয় পায় তাই অপরাধীরা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীরাই বেশি সহিংসতা এবং নির্যাতনের শিকার । আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের কারণে আইনের কাছে আশ্রয় চেয়েও বিচার পায় না। শত প্রতিকূলতার মাঝেও নারী বীরদর্পে আজ এগিয়ে চলেছে। শিক্ষার প্রসারের ফলেই সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অভূতপূর্ব ক্ষমতায়ন ঘটেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানে বহু শাখায় নিজেকে সুউচ্চতায় মেলে ধরেছে। এই উচ্চতায় ঢাকা পড়ে যাক সব কদর্যতা, অন্যায়, অবিচার। নারী শিক্ষার বিকাশ ঘটুক সমাজের সকল শ্রেণীতে। নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বাড়ুক শিক্ষার সুযোগ। নারী হোক প্রতিটি পরিবারের অবলম্বন এবং গর্ব। সমাজের সর্বস্তরের নারীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং নিরাপত্তা বাড়ুকÑ এমনই কামনা।

http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=21&dd=2014-06-06&ni=175124

No comments:

Post a Comment