Monday, June 30, 2014

ড্রাগচক্রেরশহর থেকে স্বপ্ন-উত্থান

ড্রাগচক্রেরশহর থেকে স্বপ্ন-উত্থান

james
রূপায়ণ ভট্টাচার্য সাও পাওলো

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বেঁচে থাকলে হয়তো এখান থেকেই রসদ পেতেন এক চমত্‍কার উপন্যাসের৷

সব ফুটবলার ছাত্রের মাথায় বারবার হাত বু্লিয়ে দিচ্ছিলেন পাকা চুলের কোচ৷ যেই আর এক তরুণ ছাত্র সামনে এল, তাঁকে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকলেন হোসে পেকেরমান৷ তার পর তাঁকে জড়িয়ে ধরে একসঙ্গে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন৷

মিডিয়া সেন্টারের বিশাল টিভিগুলোতে এই ছবিটা দেখানো হচ্ছিল ব্রাজিলের অন্য বাকি ১১ শহরে৷ কেন জানি না, দেখতে দেখতে ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলছিল, লাতিন আমেরিকার সেরা ফুটবলার-আবিষ্কারক পেকেরমান যেন ওই ছেলেটির মধ্যেই আবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন খুয়ান রিকেলমে, পাবলো আইমার বা খেভিয়ার সাবিওলার মতো লাতিন আমেরিকা কাঁপানো কোনও প্রতিভা৷

সিঁড়ি ভাঙার ছবিটা প্রতীকী৷

ওই ছেলেটিই জেমস রদরিগেস৷ কলম্বিয়ার নেইমার, লেখার পরে মনে হচ্ছে, এটা ঠিক হল কিনা৷ তিনি কলম্বিয়ার নেইমার কেন হবেন? বয়স একই৷ এই মুহর্তে বিশ্বকাপে নেইমারের থেকেও এগিয়ে জেমস৷ মেসির থেকেও৷ মেসির মতো তিনটি ম্যাচের সেরা হয়ে তিনিই এখন বিশ্বকাপের বেসরকারি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর৷ পয়েন্ট ৯.৭৯৷ সেখানে মেসি-নেইমার-মুলার কোথায়? আজকের খেলার আগে ফিফার র্যাঙ্কিংয়ে দেখলাম, ২ পেরিসিচ (ক্রোয়েশিয়া, ৯.৭৪), ৩ দাভিদ লুইস (ব্রাজিল, ৯.৬৯), ৪ বেঞ্জিমা( ফ্রান্স, ৯.৬৫), ৫ রবেন (নেদারল্যান্ডস, ৯.৬২)৷

রাদামেল ফালকাও যে কলম্বিয়ায় নেই, সে জন্য কলম্বিয়ান সমর্থকদের কান্নাকাটি করছে না কেউ৷ কলম্বিয়ার দেশ জোড়া এক টুর্নামেন্ট পনি ফুটবলেই প্রথম চোখে পড়েন জেমস৷ দশ বছর আগে৷ আটানব্বই সালে সেই টুর্নামেন্ট খেলেই উঠে এসেছিলেন ফালকাও৷

জেমসের জোড়া গোল ফোরলান, কাবানিদের মন্তেভিদিও পাঠিয়ে দেওয়ায় ব্রাজিল জুড়ে অনেকটাই স্বস্তি৷ যাক, উরুগুয়ে না থাকায় প.ঞ্চাশের ফাইনালের হারের শোক আর তাড়া করবে না৷ টেনশন পাথরের মতো চেপে বসবে না ফুটবলারদের উপর৷ জেমস নিজে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে জোড়া গোলের পরে সাংবাদিকদের সামনে উচ্ছ্বসিত ও গর্বিত, 'আমি য.া করেছি, তা সহজ ব্যাপার নয়৷ ছোট থেকেই বিশ্বকাপে খেলতে চেয়েছি৷ মারাকানায় গোল করা ছিল স্বপ্ন৷ সেখানে গোল করলাম, দর্শকদের হাততালি পেলাম, এটা একটা বড় ব্যাপার৷ আশা করছি, আরও দূরে যাব৷ ইতিহাস গড়তে চাই৷ আমরা ইতিহাস গড়েছিও৷' ব্রাজিলের সঙ্গে খেলার জন্য বাড়তি চাপ রয়েছে? মোনাকো ক্লাবে ফালকাওয়ের সতীর্থর মন্তব্য, 'আমার কোনও চাপ নেই৷ ব্রাজিলে অনেক ভালো ভালো ফুটবলার রয়েছে৷ ইতিহাস ওদের দিকে৷ খেলাটা সুন্দর হবে৷' কলম্বিয়া দলের প্রথম কিপার ওসপিনা তাঁর স্ত্রীর দাদা৷ টিমে তাঁর সঙ্গে ভালো জমে কলম্বিয়ার নেইমারের৷

জেমসের জন্ম হয়েছিল কলম্বিয়া-ভেনিজুয়েলার সীমান্তের ছোট্ট গ্রাম কুকুতায়৷ ছোটবেলা কলম্বিয়ার কুখ্যাত ড্রাগের শহর মেদেলিনে কেটেছে৷ যে ম্যাচে তাঁকে দেখে ড্রাগ ব্যবসায়ীর দলবল তাঁদের টিমে সই করায়, সেখানে ছিল কুখ্যাত ড্রাগ ব্যবসায়ী পাবলো এসকোবারের সহকারীরা৷ জেমসের টিমের প্রেসিডেন্ট প্রথমে অ্যারেস্ট হন ড্রাগচক্রে ধরা পড়ায়৷ পরে মারা যান গুলিতে৷ সেখানকার ফুটবলার মোনাকো কাঁপিয়ে বিশ্বকাপে এক নম্বর, সত্যি ভাবা যায় না৷ আর্জেন্তিনায় বানফিল্ডে খেলার সময় সে দেশের সবচেয়ে নামী ক্রীড়া দৈনিক 'ওলে' তাঁকে রোনাল্দোর সঙ্গে তুলনা করে লেখে 'জেমস বন্ড অফ বানফিল্ড'৷ আর্জেন্তিনা ছেড়ে পর্তুগালের পোর্তোতে নাম লেখানোর সময় তাঁর দর ছিল ৫০ লক্ষ ইউরোয়৷ দু'বছর বাদে মোনাকো তাঁকে নিয়ে যায় ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ইউরো দিয়ে৷

এই বিশ্বকাপে কলম্বিয়ানকে দেখে কেউ বলছেন ভালদারামা, কেউ বলছেন নেইমার৷ কেউ এক ধাপ এগিয়ে খুঁজছেন মারাদোনাকে৷

নয়ের দশকে তিনটি বিশ্বকাপে সাড়া ফেলা ফুটবলের পরে হারিয়ে গিয়েছিল ভালদেরামা, আসপ্রিয়া, ইগুইতার কলম্বিয়া৷ এ বার পেকেরমান-রদরিগেসের যুগলবন্দিতে তারা ফিরে এল৷ লুই স্কোলারি তখনও জানেন না, কারা প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন৷ প্রচুর প্রশংসা করছিলেন কলম্বিয়ার স্কিলের৷

আর পেকেরমান কী বলছেন জেমস সম্পর্কে? আর্জেন্তিনাকে তিন বার যুব বিশ্বকাপ দিয়েছেন পেকেরমান৷ রিকেলমে, সাবিওলা, আইমারদের পাশাপাশি তাঁর হাতে গড়া ওয়াল্টার সামুয়েল, কাম্বিয়াসো, রোমেরো, কোলোচিনি, দি'আলেসান্দ্রোরা৷ পেকেরমান কাল স্পষ্ট স্বীকার করেন, 'এতদিন যাদের পেয়েছি, তাদের সব গুণ জেমসের মধ্যে রয়েছে৷ সবচেয়ে বড় কথা, এত কম বয়সে দলের দায়িত্ব নিতে কোনও সমস্যা নেই ওর৷'

এই কলম্বিয়াতেই মেদেলিনের নাইট ক্লাবের সামনে গুলিতে মেরে ফেলা হয়েছিল বিশ্বকাপার আন্দ্রে এসকোবারকে৷ ঠিক কুড়ি বছর আগে৷ 'অপরাধ' কী ছিল? বিশ্বকাপে আমেরিকার বিরুদ্ধে বেচারা আত্মঘাতী গোল করে ফেলেছিলেন৷ ওই সময় কলম্বিয়ার ভুবনবিখ্যাত ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কুয়েসকে তাঁর ভক্তদের কেউ বলেছিলেন, তাঁদের দেশের ইতিহাসে মাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে৷ এক, ১৯৪৮ সালে বোগোতায় বিধ্বংসী রায়ট, যার নাম 'এল বোগোতাজো'৷ দুই, ১৯৬৭ সালে মার্কুয়েজের নিজের উপন্যাস, 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচ্যুড'৷ তিন, ১৯৯৩ সালে আর্জেন্তিনার বিরুদ্ধে ৫-০ গোলে জয়৷ শুনে মার্কুয়েস বলেছিলেন, 'তুমি কি জানো, য.া বললে, তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক কী? এটা একেবারে সত্যি৷'

হলুদ জার্সির জেমস রদরিগেসরা ব্রাজিলকে হারাতে পারলে, কলম্বিয়ার ইতিহাসে চতুর্থ স্মরণীয়তম ঘটনা লিখতে হবে৷ গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস শুধু জানতে পারবেন না৷ 
http://eisamay.indiatimes.com/fifa-word-cup-2014/world-cup-experience-of-rupayan-bhattacharya/articleshow/37503795.cms?

No comments:

Post a Comment