Friday, June 27, 2014

দক্ষিণের জেলে পল্লীতে ॥ জলদস্যু আতঙ্ক ০ ‘দস্যু পাস’ সংগ্রহ করেও রেহাই নেই ০ মুক্তিপণ না পেলে হত্যা ০ দস্যু দমনে জোরালো অভিযান হয় না

দক্ষিণের জেলে পল্লীতে ॥ জলদস্যু আতঙ্ক
০ ‘দস্যু পাস’ সংগ্রহ করেও রেহাই নেই 
০ মুক্তিপণ না পেলে হত্যা
০ দস্যু দমনে জোরালো অভিযান হয় না
খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলে শুরু হয়েছে ইলিশ ধরার মৌসুম। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবছরের মতো এবারও একমাত্র জলদস্যু আতঙ্ক বিরাজ করছে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলেপল্লীগুলোতে। প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে একের পর এক জলদস্যু হামলার শিকার হয়ে শত শত জেলে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। জলদস্যুদের কাছ থেকে যেসব জেলে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা মূল্যের আগাম ‘দস্যু পাস’ সংগ্রহ করবেন, তাঁদের অপহরণ করবে না বলে তাগিদ দিচ্ছে দস্যুবাহিনী। কিন্তু দস্যুদের দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর কোন পদক্ষেপ না নেয়ার অভিযোগ করেছেন জেলেরা। কয়েক সপ্তাহ পূর্বে বঙ্গোপসাগরে তালতলীর ১১ জেলেকে অপহরণ করে জলদস্যুরা। পরে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাঁদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ জুন রাতে বরগুনার তালতলী উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের নিন্দ্রাছকিনার চরসংলগ্ন এলাকায় একটি মাছ ধরার ট্রলারে হামলা চালিয়ে জলদস্যুরা জাল ও মাছসহ প্রায় ৫০ হাজার টাকার মালামাল লুটে নিয়েছে। দস্যুরা তালতলী এলাকার শহিদুল ইসলামের মালিকানাধীন ওই ট্রলারের মাঝি গোলাম মোস্তফাকে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করে নিয়ে যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক জেলে অভিযোগ করেন, জলদস্যুরা জেলেদের অপহরণ করে যে মুক্তিপণের টাকা আদায় করছে তার সিংহভাগই চলে যায় কতিপয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসাধু কর্মকর্তাদের পকেটে। যে কারণেই তাঁরা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে জোরালো কোন অভিযান পরিচালনা করছেন না।
বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল মান্নান মাঝি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে ইলিশ মৌসুমে কম-বেশি ইলিশ পড়তে শুরু করেছে সাগরে। যে কারণে বিকাশের মাধ্যমে পাস সংগ্রহে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা যাচ্ছে সুন্দরবনের জলদস্যুদের কাছে। পাথরঘাটার জেলে রহিম মিয়া জানান, আগে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুদের উৎপাত কম ছিল। বর্তমানে দস্যুরা নতুন নিয়ম করে তাদের কাছ থেকে আগাম কার্ড সংগ্রহ করার তাগিদ দিচ্ছেন। নতুবা প্রতিবছরের ন্যায় এবারও অপহরণের পর মুক্তিপণ না পেলে হত্যা করবে বলেও হুমকি দিয়ে আসছে। ট্রলার মালিক কবির মোল্লা বলেন, আমার ট্রলারের জেলেদের মধ্যে সম্প্রতি তিনজনকে অপহরণ করেছিল জলদস্যুরা। পরে আমি নিজের জমি বিক্রি করে দস্যুদের দাবিকৃত মুক্তিপণ দিয়ে তাদের ছাড়িয়ে এনেছি। উপকূলীয় বরগুনা জেলা মৎস্য ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী জানান, প্রতি ইলিশ মৌসুমে জলদস্যু বাহিনীগুলোর কাছ থেকে জেলেদের ট্রলারপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করে সাগরে যেতে হয়। গত বছর ইলিশ মৌসুমে পাথরঘাটার জেলেরা সরকারী নিরাপত্তায় সাগরে মাছ ধরার প্রতিশ্রুতির কারণে দস্যুদের পাস সংগ্রহ করেননি। এ কারণে ওই মৌসুমে পাথরঘাটার ২৬ জেলেকে দস্যুদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। এ জন্য চলতি মৌসুমে সব ট্রলার মালিক ‘দস্যু পাস’ সংগ্রহ করে দেয়ার পর জেলেরা সাগরে যাচ্ছেন। এ ব্যাপারে পাথরঘাটার কোস্টগার্ড স্টেশন কমান্ডার এম আরিফ হোসেন জানান, জলদস্যুদের দমনে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে কিছুটা লোকবলের কমতি রয়েছে, তার পরেও সাগরে জলদস্যু দমনের অভিযানে সব সময় তাঁরা তৎপর রয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন।
জলদস্যুরা আইলার চেয়েও ভয়ঙ্কর ॥ আইলা, বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও দক্ষিণাঞ্চলের জেলেদের কাছে ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু। মেহেন্দীগঞ্জের ভাষানচর এলাকার জেলেপল্লীর বাসিন্দা বজলুর রহমান জানান, ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, কিন্তু জলদস্যুদের কোন আলামত পাওয়া যায় না। হঠাৎ করে এসে দস্যুরা জেলেদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে যায়। বজলুর রহমানের স্ত্রী আজিমোন নেছা জানান, মৎস্য শিকারে যাওয়ার পর ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বামীর চিন্তায় তিনি অস্থির থাকেন। আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তাঁর উৎকণ্ঠা। না জানি কখন জলদস্যুরা হানা দিয়ে কেড়ে নেয় তাঁর স্বামীর সবকিছু। জাল-বৈঠা নিয়ে ক্ষান্ত হবে তো! নাকি তাঁর স্বামীকে মারধর করে গাঙ্গে ফেলে দেবে। এ চিন্তা শুধু আজিমোনের একারই নয়; উপকূলের জেলে পরিবারের সকল বধূ ও তাঁদের পরিবারের। কারণ মেঘনা নদী থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারিদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় জলদস্যু নামের একদল হায়না। জেলেদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন নদীগুলোতে নৌ-ডাকাতির সঙ্গে জড়িত জলদস্যুদের অধিকাংশই থাকে সুন্দরবনের গহীন অরণ্যে। আরও কয়েকটি গ্রুপ থাকে লক্ষ্মীপুর, মনপুরা ও চরফ্যাশনের দূরবর্তী কালকিনি এলাকায়। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ওইসব দস্যু নৌপথে চলাচল করে। গত কয়েক বছর পূর্বে ওইসব দস্যু জেলেদের জাল, নৌকা এমনকি শিকার করা ইলিশ ও ট্রলারের ইঞ্জিন পর্যন্ত তারা খুলে নিয়ে যেত। গত দু’বছর ধরে ডাকাতির পরিবর্তে উপকূলের জলদস্যুরা সোমালিয়ার জলদস্যুদের মতো জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করে আসছে। জলদস্যুদের কাছ থেকে টোকেন ক্রয় করে জেলেদের নদী বা সাগরে জাল ফেলতে হয়। অসংখ্য গ্রুপ টোকেন বিক্রি করায় নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকায় এ টোকেন ক্রয় করেও অধিকাংশ সময় রক্ষা পাওয়া যায় না। এক গ্রুপের টোকেন ক্রয় করে মাছ শিকারে গিয়ে অন্য গ্রুপের হাতে পড়লে আর রক্ষা নেই। ফের অপহরণ এবং মুক্তিপণ।
পুলিশ ও বনকর্মীদের হয়রানি ॥ সমুদ্র থেকে মাছ শিকার করে বরিশালের মোকামে নিয়ে আসার পথে নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ, বন বিভাগের কর্মী ও চাঁদাবাজদের হয়রানির শিকার হয় জেলেরা। মোরেলগঞ্জ, মংলা, নলি, শরণখোলা, পাথরঘাটা, নেয়ামতি, চর মোন্তাজ, রায়ন্দাসহ ঢালচর, পাতিলা ও কুকুরী-মুকুরীসহ কিছু পয়েন্টে বনরক্ষী অথবা পুলিশকে প্রতি ট্রিপে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয়। যে অঞ্চলে জেলেরা মাছ ধরতে যায় সে অঞ্চলের বন বিভাগ থেকে পাস সংগ্রহ করার নিয়ম রয়েছে। সরকারী নিয়মানুসারে এক সপ্তাহ মাছ ধরা বাবদ বন বিভাগের সীমানায় মাছ ধরতে ২৫০ টাকা ও প্রতিমণ মাছের জন্য এক শ’ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু এর বাইরেও জেলেদের বাড়তি উৎকোচ দিতে হয়। এছাড়াও পুলিশ কিংবা বন কর্মকর্তাদের পছন্দের মাছটি তাদের হাতে তুলে দিতে হয় জেলেদের।
দাদন খুবলে খাচ্ছে জেলেদের ॥ দাদন নামের অভিশাপের জাঁতাকলে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে জেলেদের জীবন। নয়া কাবুলিওয়ালা নামে পরিচিত এ দাদন ব্যবসায়ীরা জেলেদের কাছে ভয়ঙ্কর। মেঘনার হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ থেকে শুরু করে সাগরের তীরবর্তী পদ্মা স্লুইস পর্যন্ত উপকূলের বিভিন্নস্থানে রয়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের অসংখ্য আড়ত বা মোকাম। জেলেদের কাছে আড়তগুলো ফিশিংঘাট হিসেবেই পরিচিত। সূত্রমতে, নবেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত সাগর কিংবা নদীতে ইলিশ থাকে না। সাগরে কিছু রূপচাঁদা ধরা পড়লেও নদী থাকে একেবারেই ফাঁকা। তখন জেলেপাড়াগুলোতে চলে দুর্দিন। এ সুযোগটিকে বেছে ৯ দাদন ব্যবসায়ী মহাজন। চড়া সুদের ঋণের করুণার কাছে জেলেরা হেরে যান। অনেক সময় মাছের দরটি তখনই বেঁধে দেয়া হয়। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে নিরুপায় দরিদ্র জেলেরা এ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করে ইলিশ মৌসুমের। জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলে পরিবারগুলো। তখন জালের ফাঁকে ইলিশ আটকালেও ভাগ্যের ফাঁক দিয়ে সেই ইলিশ চলে যায় মহাজনের মোকামে। ইলিশভর্তি জেলেনৌকা ঘাটে ভেড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাজপাখির মতো ছোঁ মারে মহাজনের লোকরা। দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী। প্রতিবাদের শক্তি নেই জেলেদের। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখেন। মেঘনা, তেঁতুলিয়া, কালাবদর, আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত দাদন ব্যবসার পসরা বসিয়েছেন চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জের কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের দাদন ব্যবসায়ী সাধু কর্মকার এবার দাদন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা। ৩০ লাখ টাকা দাদন দিয়েছেন চাঁদপুরের জহির খান। ইলিশ মৌসুম শুরুর আগেই তাঁরা ছুটে এসেছেন মেঘনার তীরবর্তী জেলেপল্লীকে ঘিরে গড়ে ওঠা পাইকার-আড়তদারদের কাছে। মুন্সীগঞ্জ বা চাঁদপুরের এসব দাদন ব্যবসায়ীর এ জেলায় নিজস্ব কোন আড়ত না থাকলেও তাঁরা হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ থেকে শুরু করে ভোলার বঙ্গেরচর ও ঢালচর হয়ে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে জেলেদের দাদন দিয়ে থাকেন। দাদনের বিনিময়ে সরাসরি মাছ চলে যায় তাঁদের চাঁদপুর অথবা মুন্সীগঞ্জের আড়তে।
কষ্টের সঙ্গে নিবিড় আলিঙ্গন ॥ সাগর কিংবা উপকূলের নদীতে এখন আর আগের মতো জেলে নৌকার বহর দেখা যায় না। জেলেপাড়ায় চলছে দুর্দিন। মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিওদের চড়া সুদের ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেক জেলেরাই এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। হিজলার বেড়িবাঁধের ওপর বসে কথা হয় আব্দুর রশিদ মাঝির সঙ্গে। তাঁর চোখেমুখে হতাশার ক্লান্তি আর দুর্ভোগের ছাপ স্পষ্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালেন, ইলিশের সেইদিন আর নেই। একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পড়ত। ৫-৬ জন মিলে জাল টেনে নৌকায় তোলা হতো। দিন শেষে গাংপাড়ের চায়ের দোকানের আড্ডাটা জমত জমজমাট। সেই দিন হারাইয়া গ্যাছে। এ্যাহন আর গাঙ্গে (নদীতে) আগের মতো মাছ নাই। তার ওপরে একের পর এক প্রাকৃতিক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যেন আসমানী বালার মতো গজব নেমে আসছে জেলেপাড়াগুলোতে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পর জলদস্যু ও দাদন ব্যবসায়ীরা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে জেলে পরিবারগুলোর সর্বস্ব।
জীবনভর একই আবর্তে ॥ উপকূলভাগের ইলিশ শিকারের সঙ্গে যুক্ত পরিবারের মানুষগুলো জন্মের পরই সাগরের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সাগর এদের বাঁচায় আবার সাগরই এদের জীবন কেড়ে নেয়। এদের কাছে জলই জীবন-জলই মরণ। ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করে এঁদের জীবন চলে। যে জলে ইলিশ আহরণ করে তাঁরা জীবন ধারণ করেন, সে জলেই তাঁরা প্রাণ হারান। প্রিয়জনরা তাঁর লাশটি পর্যন্ত খুঁজে পায় না। যে মাছ শিকার করে তাঁদের জীবন চলে সে মাছের পেটেই চলে যায় তাঁদের লাশ। জেলেদের জীবন সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে ঘুরপাক খেলেও এঁদের নাটাই থাকে মতিঝিলের এসি রুমে। সেখানেই জেলেদের নিয়ে নীতিমালা তৈরি হয়। যার বাস্তবতা এসে পৌঁছে না সাগর পাড়ের মানুষের কাছে। মহাজনের কাছে এঁরা অসহায়-জিম্মি-পরাধীন। এঁদের ভাগ্যের চাকা বদলায় না। ভোজনরসিক মানুষের রসনা তৃপ্তির বাসনা পূরণের জন্য মাছ ধরতে গিয়ে একদিন তাঁরা নিজেরাই মাছের পেটে চলে যান। চাল-ডাল সঙ্গে নিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকা কিংবা ট্রলারে চেপে এঁরা হারিয়ে যান গভীর বঙ্গোপসাগরে। বেতার বার্তায় যখন ঝড়ের আভাস পান তখন তাঁরা আর কূলে ফেরার সুযোগ পান না। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মীরও ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু অসহায় জেলেদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। জেলেদের আহরণ করা মাছ বিদেশে রফতানি করে যেসব ব্যবসায়ী কোটিপতি হয়েছেন তাঁরাও জেলেদের ব্যাপারে উদাসীন। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ কিংবা বরিশাল থেকে পাথরঘাটায় গিয়ে দাদনের ব্যবসা করেন এ রকম ব্যবসায়ী রয়েছেন অনেক। তাঁরা একের পর এক বরফকল তৈরি করে ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন। কিন্তু জেলেপল্লীর বাসিন্দাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরছে উল্টোপথে। সচ্ছল হওয়ার পরিবর্তে জেলেদের বেড়েছে দরিদ্রতা।
সব হারালেও কুসংস্কার হারায়নি ॥ বরিশাল অঞ্চলের জেলেদের অতীত ঐতিহ্য ইলিশ, জাল ও নৌকা বলতে গেলে সব হারিয়ে গেছে। কিন্তু কুসংস্কার হারায়নি। তাঁরা এখনও বিশ্বাস করেন, জালে কিংবা নৌকায় জুতো নিয়ে পাড়ালে সে সাবারে (জালে) মাছ ধরা পড়ে না। ভরা মৌসুমে মাছ ধরা না পড়লে তাঁরা মিলাদ দেন, সাগরে দুধ ছিটান। কখনও বা সোনা-রুপার পানি ঢেলে দেয়া হয় জলে।
জেলেদের সেইদিন আর নেই ॥ বরিশালকে বলা হয় ইলিশের দেশ। বরিশালের এই রূপালী ইলিশ উপকূলীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশে দুষ্প্রাপ্যতার পাশাপাশি ঝড়-ঝঞ্ঝা ও জলদস্যুতা নড়বড় করে দিয়েছে জেলেদের অস্তিত্ব। দস্যুদের তাণ্ডব বেড়েছে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে মেঘনা মোহনায়। ঝড় ও ডাকাতের কবলে সর্বস্ব হারিয়ে বিপন্ন হয়ে উঠেছে জেলেদের জীবন। হিজলা বা মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার মতোই একটি উপজেলা পাথরঘাটা। পার্থক্য শুধু প্রথম দুটি উপজেলা মেঘনার তীরবর্তী আর পাথরঘাটা হচ্ছে দেশের সর্ব দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী একটি উপজেলা। তবে তিন উপজেলার মানুষের মধ্যে মিল হচ্ছে তাদের প্রধান পেশা নদী কিংবা সাগরে গিয়ে ইলিশ মাছ শিকার করা। প্রবহমান মেঘনা বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত যে গতিপথে বয়ে গেছে তার দু’তীরের বাসিন্দারাই মূলত নদী ও সাগর মোহনা থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের অথৈ জলরাশিতে ইলিশ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, বঙ্গেরচর, রাজাপুর, দৌলতখান, তজুমদ্দিন, মনপুরা, চরফ্যাশন হয়ে দেশের সর্ব দক্ষিণের পাথরঘাটা পর্যন্ত অসংখ্য জেলেপল্লী রয়েছে। প্রকৃতির রুদ্ররোষ প্রায়ই জেলেপল্লীর তাজা প্রাণগুলো কেড়ে নিয়ে যায়। জেলেদের কাছে সিডরের আগে ২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরের সামুদ্রিক ঝড় এখনও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। ওই ঝড়ে পাথরঘাটার পদ্মা স্লুইস জেলেপল্লীর ছগির, বাদশা মিয়া, ইউনুস জমাদ্দার, শাখাওয়াত আলী, নূর মোহম্মদ, রফিক, সাহাসাব, বারেক, রহমান ও নান্টু নিখোঁজ হন। নিখোঁজ জেলেদের সন্ধানে শাহজামাল, নূর আলম ও বাদল সাগরে গিয়ে তাঁরাও আর ফিরে আসেনি। সিডরে নিখোঁজ হওয়া শত শত জেলের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে উপকূলে ফিরে এলেও ১৯ সেপ্টেম্বরের নিখোঁজ হওয়া জেলেদের মতো সিডরে নিখোঁজ অসংখ্য জেলের সন্ধান আজও মেলেনি। নিখোঁজ জেলেরা কে, কোথায় ভেসে গেছেন তার কোন হদিস নেই। ঝড়ের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে জলদস্যুদের অত্যাচার। সাগর বা নদীর মোহনায় ইলিশ শিকারে গেলেই জেলেদের পড়তে হয় দস্যুদের কবলে। জেলেদের অপহরণ করে জলদস্যুদের আস্তানায় আটকে রেখে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে।
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment