Sunday, June 29, 2014

সু. সে. গু’র সংখ্যালঘু তত্ত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন

সু. সে. গু’র সংখ্যালঘু তত্ত্ব ও স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব

 মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন



টাকার বস্তাসহ ধরাপড়া সর্বসাধারণ্যে কালোবিড়ালমন্ত্রী হিসেবে ধিকৃত সু. সে. গু. (সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত) ২৫ এপ্রিল (২০১৪) ঢকায় যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে বাংলাদেশ-বিরোধী চারটি মারাত্মক অভিযোগ ফুটে উঠেছে। এগুলো হলো: ১. সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচার জন্য হিন্দু সমপ্রদায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি; ২. দেশে দিনে দিনে হিন্দু সমপ্রাদায়ের লোক কমে যাচ্ছে; ৩. রাষ্ট্রের প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বস্তরে হিন্দু সমপ্রদায়কে সংখ্যালঘু করেই রাখা হয়েছে দাবি করে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা (হিন্দু সমপ্রদায়) অবহেলিত রয়ে গেছে; এবং ৪. রাজনৈতিকভাবে পরিকল্পনা করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে।
((http://www.amardeshonline.com/pages/details/2014/04/26/242288#.U4Mj4nZXjl)

তার বক্তব্য দৈনিক আমার দেশ (অনলাইন সংস্করণ)সহ ঢাকার অন্যান্য দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। তার তৃতীয় অভিযোগ যে অসার ও ভিত্তিহীন সে নিরীখে ‘বাংলাদেশের হিন্দুরা কী সুবিধাবঞ্চিত — না কী সর্বাধিক সুবিধাপ্রাপ্ত’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ ইতোমধ্যে লিখেছিলাম। সু. সে. গু’র আপত্তিকর মন্ত্রব্যের প্রথমটি (সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচার জন্য হিন্দু সমপ্রদায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি) সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা করাই বক্ষমান নিবন্ধের শানে নজুল।

‘সংখ্যালঘু হয়ে বাঁচার জন্য হিন্দু সমপ্রদায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি’ তার এমন খেদোক্তি পর্যবেক্ষকদের মতে অশনি সংকেত বিশেষ। পর্যবেক্ষকমহল সু. সে. গু’র বক্তব্য প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলেছেন: তা হলে সু. সে. গু’রা কী হবার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন? মুক্তিযুদ্ধে তারা কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন? তাদের অংশ গ্রহণের ধরনটি কেমন ছিল? সেটা কি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সরাসরি অংশগ্রহণ, না কী গৃহত্যাগ তথা পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা? না কী তারা মুক্তিযুদ্ধের অমূলক শিকারে পরিণত হয়েছিলেন?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর পরিষ্কার হওয়া অত্যন্ত জরুরী। সু. সে. গু’র মন্তব্যে মনে হয়, হিন্দুরা মুক্তিযুদ্ধের কারণেই সংখ্যালঘু হয়ে গেছেন (এবং তাই তার ভাষায় ইঙ্গিত রয়েছে যে, তারা সংখ্যালঘু হয়ে থাকতে চান না। তা হলে তারা কী হতে চান?) । উপমহাদেশে বিশেষতঃ বাংলায় ইসলামের ইসলামের আবির্ভাব হওয়ার বহু আগ থেকেই হিন্দুরা সংখ্যালঘু ছিল। বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হলে ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ অব্রাহ্মণ হিন্দুরা দলে দলে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। পুরো উপমহাদেশ বৌদ্ধদের দখলে চলে যায়। কিন্তু ব্রাহ্মণদের কূটচক্রান্ত্রের কারণে বৌদ্ধরা কেবল শাসনক্ষমতাই হারায় নি, নির্যাতন মাধ্যমে ব্যাপক সংখ্যক বৌদ্ধকে হয়তো পুনরায় হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে নেয়া হয়, কিংবা নিশ্চিন্ন করা হয়। কিন্তু বাংলায় বৌদ্ধদের সংখ্যা এমন ব্যাপক ছিল যে, হিন্দুরা এখানে তেমন সুবিধা করতে পারে নি। পালবংশের পতনের পর বৌদ্ধরা শাসন ক্ষমতা হারালে সেনদের (ব্রাহ্মণ হিন্দু) হাতে বৌদ্ধরা চরমভাবে নিষেমষিত হয়। এ অবস্থা থেকে রেহাই পাবার জন্য বৌদ্ধরা মুসলমানদের বাংলায় আগমনের আমন্ত্রণ করে, আর তারা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করে। এভাবে বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগুরু হয়ে যায় এবং হিন্দুরা সংখ্যালঘুই থেকে যায়। (বিস্তারিত জানান জন্য দেখুন: The Rise And Fall of Buddhism in South Asia; by Dr. M. Abdul Mu’min Chowdhury, London Institute of South Asia, 3 Blacklands Drive, Hayes (Middlesex), UB4 8EU, United Kingdom; www.lisauk.com)

১৯৪৭ সনে উপমহাদেশ বিভক্তির সময় ব্রিটিশ-শাসিত বাংলায় হিন্দুরা সংখ্যালঘুই ছিল। সুতরাং হিন্দুদের সংখ্যালঘিষ্ঠতা নতুন কিছু নয়। এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ও মীমাসিংত বাস্তবতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে হিন্দুদের সংখ্যালঘুত্ব কমানোর কিংবা সংখ্যালঘু না থাকার কোন উপায় সংক্রান্ত কোন ফর্মূলা ছিল না। এমন আজগুবী দাবীও কেউ কোন দিন করেও নি, যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হিসেবে থাকতে চায় না। বাংলাদেশে সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েও ‘হিন্দুরা সংখ্যালঘু হিসেবে বাঁচতে চায় না’ এমন ঘোষণা দিয়ে সু. সে. গু. কী বলতে চেয়েছেন? তিনি বা তারা কী হিসেবে থাকতে চান? অনতিবিলম্বে সু. সে. গু’কে ধরে জিজ্ঞাসা করা হোক তিনি কী বলতে চেয়েছিলেন? কিভাবে হিন্দুদেরকে সংখ্যালঘুত্ব হতে উদ্ধার করা যায়, এ প্রসঙ্গে তার পরামর্শ কী? কীভাবে এ পরামর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব এ ধরনের সবকিছু সু. সে. গু’র কাছ থেকে জানতে চাওয়া হোক।
তবে তার বক্তব্যের ধরন শুনে মনে হয়, সু. সে. গু বাংলাদেশের ভিত্তি তথা অস্তিত্বের ওপর হাত দিয়েছেন। ১৯৫২ সন হতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টিকারীদের কেউই মুক্তি সংগ্রামের কোন পর্যায়ে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে এ ধরনের জঘন্য কথা বলেন যে বাংলাদেশের কোন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সংখ্যালঘুত্ব হতে মুক্ত করতে হবে। এটা কী ধরনের কথা, কেমন আজগুবি বক্তব্য? কীভাবে একটা দেশের ৯০% মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিপরীতে অবস্থানকারী ৮% সংখ্যালঘু হিন্দু সমপ্রদায় তাদের সংখ্যলঘুত্ব দূর করার কথা ভাবতে পারে, কিংবা বলতে পারে? এটা তো সরাসরি বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিলীন করার পূর্বাভাষ। বাংলাদেশকে স্বাধীন অস্তিত্বকে অক্ষুণ্ন রেখে সু. সে. গু’র এ বাসনা পূরণ করা সম্ভব নয়। শতকরা ৯০% মুসলমানের দেশকে কমপক্ষে ৪৯% মুসলমাদের কমিয়ে এনে ৫১% হিন্দুদের দেশে পরিণত করা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়। শতকরা হিসেবের হেরফের থাকে পারে। তাই সংখ্যার দিকে তাকাই। ২০১১ সনের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৪,২৩,১৯,০০০।
(http://en.wikipedia.org/wiki/2011_Bangladesh_census )
এদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা হলো ১কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার। (http://en.wikipedia.org/wiki/Hinduism_in_Bangladesh) ।

এখন সু. সে. গু. তথা হিন্দুদের সংখ্যালঘুত্ব দূর করতে হলে তাদের সংখ্যা মুসলমানদের থেকে বেশী করতে হবে। অর্থাত্ মুসলমানদের বর্তমান সংখ্যাকে হ্রাস করে এককোটির নিচে নিয়ে আসতে হবে। এমন প্রায়-অসম্ভব একটি কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হলে এদেশের সাড়ে ১২ কোটি মুসলমান মেরে ফেলতে হবে কিংবা তাদেরকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। অথবা সাড়ে ১২ কোটি মুসলমানকে হিন্দু হয়ে যেতে হবে। অন্যান্য পন্থা হচ্ছে ভারত থেকে ১৪ কোটি হিন্দু বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা রাতারাতি বেড়ে দাঁড়াবে কমপক্ষে ৩০ কোটি। আরো সহজ পন্থা হলো বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিলীন করে দেয়া, অর্থাত্ বাংলাদেশকে ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হবে। তখনই সর্বভারতের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের হিন্দুরা সংখ্যালঘুত্ব ঘুছাতে পারে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাথে সংখ্যালঘু তত্ত্বের কোন সম্পর্ক আছে এমন কোন তথ্য কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের সৃষ্ট। এখানে হিন্দুদের কোন অবদানই নেই। ’৭১’এর পূর্ববর্তী কোন আন্দোলনে হিন্দুদের কোন প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। ’৫২ থেকে ’৬৯ পর্যন্ত কোন গণআন্দোলনে কোন হিন্দু নিহত হয়েছে, এমন নজির নেই। অথচ কিছু মতলবি এবং ভাড়াটে ভারতীয় চর তথাকথিত বুদ্ধিজীবী প্রতিটি ক্ষেত্রেই হিন্দুদের টেনে আনতে মরিয়া। এটা যেন তাদের দায়িত্ব। আমাদের প্রতিটি আন্দোলনে তারা তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার প্রলেপ লাগাতে চায়, যা মোটেই সত্যি নয়। আর তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা মানে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা হিন্দুরা সংখ্যালঘুত্ব বিলোপ করা নয়?

পর্যবেক্ষকদের মতে, সু. সে. গু তেমন সম্ভবনার কথাই বলতে চেয়েছেন। তিনি যেন বলতে চেয়েছেন, বাংলাদেশকে তো ভারতের বাইরে স্বাধীন রাখার জন্য ভারত তথা হিন্দুরা মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করে নি, এদেশ ভারতের সাথে মিশে যাবে, এমন প্রত্যাশা নিয়েই ভারত আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। আর বাংলাদেশ ভারতের সাথে মিশে গেলেই তো হিন্দুরা আর সংখ্যালঘু থাকে না। এটাই হলো স. সে. গু’র বক্তব্যের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও রহস্য। হিন্দু মহাসভা, গান্ধী, নেহেরুরা এ স্বপ্নই আজীবন পোষণ করে আসছিলেন যে, তারা উপমহাদেশে মুসলিম আবাসভূমি তথা পাকিস্তানের আবির্ভাব সাময়িকভাবে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু তাদের দুরভিসন্ধি ছিল পাকিস্তানের অংশগুলোকে একদিন অবশ্যই ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হবে। ১৯৪৭ সনের ৭ আগষ্ট বোম্বাইয়ে নেহেরুসহ তত্কালীন হিন্দু নেতৃবৃন্দ রুদ্ধদ্বার বৈঠকে পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার এমন সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সনের আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ইন্দিরা গান্ধীরা উপমহাদেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের হাজার বছরের প্রতিশোধ হিসেবে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছিল। তা’হলে বুঝুন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হিন্দুরা কী হিসেবে, কিসের জন্য ব্যবহার করেছিল? সে উদ্দেশ্যেই ১৯৭১ সনে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত কেবল সহযোগিতাই করে নি, আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সৈন্যদেরকে পাকিস্তানী সৈন্যমুক্ত বাংলাদেশে বসিয়ে এদেশকে অঘোষিতভাবে দখলে রাখা। ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ হতে ফেরত যাবার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে নি। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিব জীবিত অবস্থায় (যা ভারত কল্পনাও করতে পারে নি) পাকিস্তান থেকে ফেরত আসায় ভারতের সে প্রচষ্টা ভেস্তে যায়। শেখ মুজিব বাংলাদেশে এসেই অনতিবিলম্বে ভারতীয় সৈন্য ফেরত নিতে ভারতকে আহ্বান জানালে সে আহ্বানে সাড়া না দিয়ে ভারতের অন্য কোন বিকল্প ছিল না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস শেখ মুজিব জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশে ফেরত না আসলে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশ হতে আর কখনোই ফেরত যেতো না। মুজিব নিহত হবার এটাও ছিল অন্যতম কারণ। এবং এর পেছনে ভারতেরও সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

শেখ মুজিবের ইচ্ছানুযায়ী ভারতীয় সৈন্য সরিয়ে নেয়া হলেও ভারত বারবার বাংলাদেশে সৈন্য প্রেরণের চক্রান্ত করেছে। কিন্তু সেসব পাঁয়তারা সফল হয় নি। জিয়াহত্যা কিংবা বিডিআর বিদ্রোহ ছিল ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়ার অন্যতম চক্রান্ত। সেগুলোও ব্যর্থ হয়। বর্তমানে ভারতের অন্যতম প্রকল্প হলো বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলতে হলে এখানে ভারতপন্থী লোকদের সংখ্যা বাড়াতে হবে, তাদেরকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখতে হবে, ক্ষমতার শীর্ষে তাবেদারদের বসাতে হবে। তাদেরকে দিয়েই বাংলাদেশের ভেতরে গোলমাল বাধাতে হবে, যাতে সে অজুহাতে ভারতীয় সৈন্যদেরকে বাংলাদেশে আবার ঢোকানো যায়।

মুজিব তনয়ার মাধ্যমে ভারত এখন আরো সুবিধাজনক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। অসংখ্য ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় বসানো হয়েছে। শেখ হাসিনার সাথে এমন ধরনের চুক্তি হয়েছে যার প্রেক্ষিতে প্রণব মুখার্জি প্রকাশ্যে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে কোনভাবে বিব্রত (অর্থাত্ ক্ষমতাচ্যুত) করা হলে ভারত ‘চুপচাপ বসে’ থাকবে না। এ উদ্দেশ্যে ভারতীয় বিমান বাহিনী তথা সৈন্যরা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য প্রস্তত, এমন ঘোষণা ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেই এসেছে।

ভারত কোনভাবেই বাংলাদেশকে তার হাতের মুঠা হতে বেরিয়ে যেতে দেবে না। সে লক্ষ্যে একটা ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা নিয়ে ভারত শেখ হাসিনার উপর ভর করে এগুচ্ছে। ভারতীয় সৈন্যরা এ দেশে যেন বিনা বাধায় অবস্থান করতে পারে সে লক্ষ্যে বিভিন্ন পন্থায় বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। ১৯৭২ সন থেকেই এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। দেশপ্রেমিক নিধনের পাশাপাশি বর্তমানে মনস্তাত্তিক যুদ্ধ চালনো হচ্ছে। মনস্তাত্তিক যুদ্ধের অংশ হিসেবেই সু. সে. গু তার ভারতীয় প্রভুদের বহুযুগের লালিত স্বপ্ন-চক্রান্তের কথাই প্রকাশ করেছেন। গত ৪৩ বছরের ভারতীয় কার্যক্রম প্রমাণ করেছে যে, ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকার জন্য আমাদের মুক্তি সংগ্রামে সহযোগিতা করে নি, সহযোগিতা করেছে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য, যা এদেশকে গ্রাস করার মাধ্যমেই সফল হতে পারে । আর সু. সে. গু’দের স্বপ্ন এবং ইচ্ছাও তা-ই — সংখ্যালঘু হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য নয়, তারা তো মুক্তিযুদ্ধে নেমেছিলেন ভারতের সাথে মিশে যাবার জন্য।

সু. সে. গু’রা যদি সংখ্যালঘুত্ব ঘুচানোর (অর্থাত্ বাংলাদেশকে ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলার) উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে থাকেন, তবে ঐ সময়ে এদেশের সাতকোটি মুসলমান কেন পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য যুদ্ধ করেছিল? স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য — নাকি ভারতের সাথে মিশে যাবার জন্য — সু. সে. গু..দের এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সু. সে. গু’কে জবাব দিতে হবে সংখ্যাগুরু মুসলমানদেরকে তারা কোন অবস্থানে নিয়ে যেতে চান?

এখন দেখা যাক, মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরা কোন পর্যায়ে কীভাবে অংশ নিয়েছিল। রণাঙ্গনে কতোখানি সরাসরি সক্রিয় ছিল? আগেই উল্লেখ করেছি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করতে ’৫২ থেকে ’৬৯ পর্যন্ত কোন গণআন্দোলনে কোন হিন্দু সক্রিয় ছিল কিংবা নিহত হয়েছে, এমন নজির নেই।
’৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধে সু. সে. গু’রা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে অংশ গ্রহণ করে নি। পাকিস্তানী সৈন্যরা যদি হিন্দুদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন না করে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করতো তা হলে কোন হিন্দুই ভারতে যেতো না। হিন্দুদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হত্যা-নির্যাতন এবং তা থেকে রক্ষা পাবার জন্যই হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতে আশ্রয় নেয়া আর মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া কিংবা যুদ্ধ করা কোনভাবেই এককথা নয়। সু. সে. গু. হিন্দুদের ভারতে পালিয়ে যাওয়াকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ তথা সরাসরি যুদ্ধ করা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, যা বাস্তব অর্থে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। পালিয়ে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার উদ্দেশ্য ছিল আত্মরক্ষার আর আর জীবনের বাজি রেখে সরাসরি যুদ্ধ উদ্দেশ্য ছিল দেশকে স্বাধীন করার । সশস¿ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়া, এবং যুদ্ধের শিকার হওয়া কিংবা যুদ্ধে সহযোগিতা করা এক কথা নয়। কারণ যারা সরাসরি যুদ্ধ করেছেন তারা মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যুদ্ধের সময় কোন অজুহাতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন নি। সুতরাং দুটোকে কোনভাবেই এক করার একভাবে দেখার সুযোগ নেই। ভারতে পালিয়ে যাওয়াই যদি মুক্তিযোদ্ধা হবার কিংবা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের মাপকাঠি হয়ে থাকে তবে ঐ সময়ে হিন্দু সমপ্রদায়ের এক মাসের বাচ্চারাও মুক্তিযোদ্ধা।

সু . সে. গু. মনে হয় এ কথাই বলতে চেয়েছেন, তারা সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কথার ঢং দেখে তা-ই মনে হয়। মনে হচ্ছে হিন্দুরাই দেশটাকে স্বাধীন করেছে, যা মোটেই সত্যি নয়। পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা-নির্যাতনের মুখে ভারতে পালিয়ে গিয়েই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করা অমূলক। এ ধরনের লোকদের বলা হয় শরণার্থী, এরা মুক্তিযোদ্ধা নয়। সু. সে. গু’রা আমার গ্রামের প্রিয়লালের মতো ‘মাসীর বাসায় বসে থাকা’ মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি প্রশিক্ষণ নিয়েও জীবনের ভয়ে যারা যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে না ঢুকে ভারতে অবস্থান করেছিলেন তাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মেনে নিতে যেকোন দেশপ্রেমিকের বিবেকে লাগা উচিত।

বাস্তবতা ছিল হিন্দুরা গণহারে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে তথা রণাঙ্গনে ছিল না। হাতে গোণা দু-চারজন ছাড়া হিন্দুরা গণহারে মুসলমানদের মতোই সরাসরি যুদ্ধ করেছিল, এমন প্রমাণ নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা বিভিন্ন সময়ে দেয়া হয়েছে, তা কোনভাবেই সঠিক নয়, এটা কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই নয়, নানা ধরনের ভূয়া মুক্তিযোদ্ধার চাকরি ও নানাবিধ সুবিধা আদায়ের ছাড়পত্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কপূর্ণ দিক হলো ভারতে গিয়েছে কিন্তু যুদ্ধে অংশ নেয় নি, এমন ভূয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ভিড়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে যাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটা কাগজ সংগ্রহ করেই অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। আর ভারত থেকে যে বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা দেয়া হয়েছে, তাতে আমাদের গ্রামের প্রিয়লালও বীরমুক্তিযোদ্ধা। অথচ সে আমার সাথে ভারতে গিয়ে “মাসি’কে দেখে আসি” বলে যে হাওয়া হয়ে গেছে, পুরো যুদ্ধের সময় তাকে আর বাংলাদেশে পাওয়া যায় নি। এমন বহু তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধাকে আমি চিনি যারা, ভারতে গিয়েছেন, কিন্তু যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করেন নি, এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশেও আসেন নি । এখন তারাও ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’।

সু. সে. গু’দের এই বাস্তবতা স্বীকার করতেই হবে, বাঙালী মুসলমানরা অস¿ হাতে না নিলে সব হিন্দুরা ভারতে চলে গেলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। মুসলমানরা ভারতে গিয়েছে প্রশিক্ষণের জন্য, যুদ্ধ করার জন্য, দেশকে স্বাধীন করার জন্য। আর হিন্দুরা গিয়েছে আত্মরক্ষার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য। তাদের অনেকেরই সিদ্ধান্ত ছিল স্বাধীন হলে দেশে ফিরে আসবে, আর স্বাধীন না হলে ভারতে থেকে যাবে। সুতরাং উভয় সমপ্রদায়ের উদ্দেশ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল ।

আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেছে এ সত্যতাকে আমরা অস্বীকার করতে চাই না। কিন্তু এ সহযোগিতাকে হিন্দুদের সহযোগিতা হিসেবে কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। একে সু.সে. গু’দের অবদান হিসেবে বিবেচনা করার কোন সুযোগ নেই। পাকিস্তান ভেঙ্গে ফেলার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে পুর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা, হিন্দুরা নয়। মুসলমানরা বাংলাদেশ স্বাধীন করতে না চাইলে হিন্দুরা এমনকি ভারত শত বছর যুদ্ধ করেও পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত করতে পারতো না।

অন্যদিকে ভারত সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এমন দাবি মোটেই সত্যি নয়। ভারত সরাসরি না জড়ালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতো, এ কথাই সত্য, কিন্তু স্বাধীন হতো না, এমন উপসংহার কোনভাবে আমরা মেনে নেবো না । আমরা পাকিস্তানকে পরাজয়ে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসার পরই ভারত আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভারতের সুবিধামাফিক চুক্তিতে সই করতে তাজউদ্দিন আহমদদের বাধ্য করে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করেছে।

সুতরাং বাংলাদেশ একান্তভাবেই মুসলমানদের সৃষ্টি। এ অঞ্চলের মুসলমানরা ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বলেই আমরা স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলাম। ১৯৪৭ সনে মুসলমানরা পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে ভারতে যোগ দিলে ১৯৭১ সনে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতো না। আমরা পাকিস্তানে যোগ দিয়েছিলাম হিন্দুদের অত্যাচার, শোষণ ও কর্তৃত্ব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য। আবার পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমাদের স্বার্থ, স্বাতন্ত্র্য, সংস্কৃতি, সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে স্বাধীন থাকার জন্য। ভারতের ছায়ারাষ্ট্রে পরিণত হওয়া কিংবা ভারতের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য নয়। ভারত, তথা হিন্দুরা পাকিস্তানকে মেনে নিতে চায় নি. বাংলাদেশকেও মেনে নিতে চায় না। তাই বাংলাদেশবিরোধী যতো চক্রান্ত। 

বাংলাদেশকে ভারতে ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়ার অসংখ্য চক্রান্ত। আর ভারতের সাথে না মিশে গেলে সু. সে. গু’রা কখনোই তাদের সংখ্যালঘুত্ব গুচাতে পারবেন না । এ কারণে সু. সে. গু’রা কীভাবে বাংলাদেশকে ভারতের সাথে মিশিয়ে ফেলা যায়, সে মিশন নিয়ে কাজ করছেন। এ কারণেই সু. সে. গু’রা ভারতের বাংলাদেশবিরোধী কোন অপকর্মের কোন প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন এমন কোন নজির স্থাপন করতে পারেন নি। আন্তর্জাতিক নদীসমূহের পানি হতে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করা, সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা করা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া, ভারতের ভিতরে মুসলিম নিধন করা, বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালানো, বাংলাদেশের অন্তর্ঘাতমূলক সন্ত্রাসী দুষ্কর্ম চালিয়ে এর অর্থনীতিকে পঙ্গু করা, সর্বোপরি বাংলাদেশকে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট বঙ্গভূমি আন্দোলন, হিন্দুল্যান্ড প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, চাকমাদের দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দখলের প্রচেষ্টাসহ নানা ধরনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ভারতীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে সু. সে. গু’রা কোন দিন একটি কথাও বলেন নি — ভারতীয় অপকর্মের প্রতিবাদে কোন মানব-বন্ধন, প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ, ভারতীয় দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান, কিংবা ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও করার কর্মসূচী তো দূরের কথা। এমনকি সুব্রামনিয়াম সোয়ামীরা বাংলাদেশের সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত এক-তৃতীয়াংশ ভারতকে দিয়ে দেয়ার প্রকাশ দাবী করলেও সু. সে. গু’রা নীরব ছিলেন। এগুলো তাদের মনে কোন ধরনের দাগ কাটে না, তাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে না, তাদের দেশপ্রেমে আঘাত লাগে না। কারণ আসলে সু. সে. গু’রর বাংলাদেশের স্বার্থ, পৃথক অস্তিত্ব তথা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে অন্তর থেকেই বিশ্বাস করেন না। বরং তারা অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন কখন বাংলাদেশ ভারতের সাথে মিশে যাবে এবং তাদের সংখ্যালঘুত্ব দূরীভূত হবে। সু.সে.গু’র চক্রান্ত-প্রসূত স্বপ্ন বাংলাদেশের মুসলমানদের সংখ্যালঘুতে এবং হিন্দুদেরকে সংখ্যাগুরুতে পরিণত করা ।

 সু. সে. গু’দের এ চক্রান্ত মোকাবিলা করতে সব দেশপ্রেমিককে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে । * (পরবর্তী প্রবন্ধ সু সে গু’র বক্তব্যের আরেকটি সূত্র ধরেই লেখার আশা রাখি )


No comments:

Post a Comment