ফ্ল্যাট নেই টাকাও নেই
ওবায়েদ অংশুমান
প্রকাশ : ২৯ জুন, ২০১৪
ফ্ল্যাট কিনে সীমাহীন প্রতারণার শিকার হয়েছেন ঢাকার লক্ষাধিক মানুষ। টাকা পরিশোধের পর কয়েক বছর চলে গেলেও বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না তাদের ফ্ল্যাট। পাশাপাশি ফেরত পাচ্ছেন না পরিশোধিত টাকাও। বরং টাকা ফেরত চাওয়ায় তাদের হত্যার হুমকি দিচ্ছে এসব ফ্ল্যাট বিক্রেতারা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়েই আইনের আশ্রয় নিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
মামলা করার পরও শেষ হয়নি ফ্ল্যাট ক্রেতাদের ভোগান্তি। আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও গ্রেফতার হচ্ছেন না প্রভাবশালী ফ্ল্যাট বিক্রেতারা। পাশাপাশি বছরের পর বছর নিষ্পত্তি হচ্ছে না এসব মামলা। আইনজীবী ও আদালত সংশ্লিষ্টদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও তারা বুঝে পাচ্ছেন না ফ্ল্যাট কিংবা জমা দেয়া সমুদয় টাকাও।
গত এক যুগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত (সিএমএম), ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এবং ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন ফ্ল্যাটের দখলস্বত্ব ঘোষণা ও প্রতারণা সংক্রান্ত করা লক্ষাধিক মামলার নথি পর্যালোচনা এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে উল্লেখিত সব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, নামসর্বস্ব আবাসিক প্রতিষ্ঠানের চটকদার বিজ্ঞাপন কিংবা দালালের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ফ্ল্যাট কেনেন মধ্যবিত্ত ঘরানার মানুষ। টাকা লেনদেনের ক্ষেত্রে নিবন্ধন না করেই জীবনের সর্বশেষ পুঁজি তুলে দেন প্রতারক ফ্ল্যাট বিক্রেতাদের হাতে। প্রতারক কোম্পানিদের কথিত প্যাডের মাধ্যমে টাকা জমা দেন ক্রেতারা। যার দালিলিক কোনো মূল্য নেই। টাকা পরিশোধের পরও প্রতারক ভূমিদস্যুরা ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেন না। বছরের পর বছর ঘোরাতে থাকেন গ্রাহকদের। পরে টাকা কিংবা ফ্ল্যাট দেয়ার কথা বললেই হত্যার হুমকিসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয় ক্রেতাদের।
জানতে চাইলে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সাধারণ সম্পাদক মো. ওয়াহিদুজ্জামান শুক্রবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘এটা সত্য কথা যে, ব্যাঙের ছাতার মতো নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে অনেকে প্রতারণা করছে। এরা কেউ রিহ্যাবের সদস্য নয়। রিহ্যাবের তালিকাভুক্ত কোম্পানি ফ্ল্যাট নিয়ে প্রতারণা করে না। এরপরও যদি কোনো কোম্পানি গ্রাহকদের সঙ্গে অনিয়ম করে, তাদের তালিকা পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকা শহরের ভূমির দালালরা ডেঞ্জারাস (বিপজ্জনক)। এদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আইন নেই। এরাই মূলত ফ্ল্যাট কিংবা জমি নিয়ে প্রতারণা করে থাকে। সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। নামিদামি আবাসন কোম্পানির কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনার পরামর্শ দেন রিহ্যাব সাধারণ সম্পাদক।
মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, রাজধানীর পুরান ঢাকার স্বামীবাগে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে গ্রীন ডেল্টা হাউজিং কোম্পানির কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনেন পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের মতিঝিল শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক হীরা ভূষণ দেব। গত চার বছরেও বুঝে পাননি তার ফ্ল্যাট। পরে কোম্পানিটির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন ও ব্যবস্থপনা পরিচালক বেলালের কাছে টাকা ফেরত চান তিনি। উল্টো হীরাকে হত্যার হুমকি দেন নুরুল ও বেলাল। নিরুপায় হয়ে ২০১০ সালে কোম্পানির এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঢাকার সিএমএম আদালতে মামলা করেন হীরা। সেই মামলায় নুরুল ও বেলালের বিরুদ্ধে আদালত পরোয়ানা জারি করেন।
জানতে চাইলে প্রতারিত ব্যাংক কর্মকর্তা হীরা ভূষণ দেব যুগান্তরকে বলেন, ‘জীবনের সঞ্চিত সব অর্থ তুলে দিয়েছিলাম গ্রীন ডেল্টার কাছে। ভেবেছিলাম, শেষ জীবনে নিজের ফ্ল্যাটে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সুখেই বসবাস করব। কিন্তু চার বছর ধরে জীবনের হুমকি নিয়ে বসবাস করছি। আদালতই আমাদের শেষ ভরসা।’
সিএমএম আদালতে বিচারাধীন মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ফ্ল্যাট দেয়ার কথা বলে ব্যাংক কর্মকর্তা হীরা ভূষণসহ ৩৭ জন ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন গ্রীন ডেল্টা কোম্পানি। প্রতারণার শিকার হয়েছেন আরেক গ্রাহক চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম। তিনি ২১ লাখ টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কেনেন। কিন্তু ফ্ল্যাট কিংবা টাকা কিছুই পাননি তিনি।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রাতুল প্রোপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খানসহ কোম্পানির ১০ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিয়াজুর রহমান মানিক নামের ব্যক্তি সিএমএম আদালতে মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, কোম্পানিটি ৫২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা নিলেও ১/১ নয়াপল্টনের ১/৪ নম্বর ৪০৮ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিচ্ছেন না আসামিরা। দ্য বেঙ্গল ওয়ান ক্রিয়েশন লিমিটেডের মালিক মুহাম্মাদ সোহেল রানা রামপুরার বনশ্রী প্রজেক্টের বি-১৬/এ, ব্লক-বি, রোড নম্বর-৬ এর একটি অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির নামে সীমাহীন প্রতারণা করেছেন। তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন আলহাজ ফরহাদ মিয়া। রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন ১৯৫/২ তেজকুনী এলাকায় একটি ফ্ল্যাট বিক্রির নামে ৪১ লাখ ৫৭ হাজার ২শ’ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে জেটস ডেভেলপমেন্টের মালিক জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে মামলা করেন ফাতেমাতুজ জান্নাত। ধানমণ্ডির ৬৮/২ এবং ৬৮/২ এ ‘এভারেস্ট রাইয়ান প্রকল্পের আট তলার বি-৭ ফ্ল্যাটটি ২৬ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। টাকা দিলেও ফ্ল্যাট বুঝিয়ে না দেয়ায় এভারেস্ট হোল্ডিংয়ের চেয়ারম্যান আবু বোরহান ছিদ্দিক চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেন ক্রেতা কামাল। একইভাবে শেরেবাংলা নগরের বাড়ি নম্বর-১৩/২, রোড নম্বর-২ শ্যামলী এলাকার ‘গ্রান্ডরুবি’ নামের প্রকল্পের ষষ্ঠ তলায় ৫-বি-এর ফ্ল্যাট ৪২ লাখ টাকা দিয়ে কেনেন সেবাবুর রহমান বকুল। ফ্ল্যাট না পেয়ে ওয়াল মের্কার্সের চেয়ারম্যান ফয়সাল আজিজের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। একইভাবে টাকা দিয়েও ফ্ল্যাট না পাওয়ার কারণে কৌনিক প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আবদুল আলীম খান চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এমএ আকবর। ঢাকার ভাটারা এলাকায় রোড নম্বর-২০, ব্লক-এফ, বাড়ি নম্বর-৬৬১, ফ্ল্যাট নম্বর-৩ এর দখলস্বত্ব ঘোষণা চেয়ে ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালতে ওয়েগা বিল্ডার্সের চেয়ারম্যান দেলোয়ার রহমানসহ কোম্পানির ৫ কর্মকর্তাকে বিবাদী করে মামলা করেছেন আবু শফিক খন্দকার। যা বিচারাধীন।
No comments:
Post a Comment