Monday, June 30, 2014

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের ৭৫৭ কর্মচারী

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত রাষ্ট্রের ৭৫৭ কর্মচারী
সাঈদ আহমেদ
প্রকাশ : ০১ জুলাই, ২০১৪
প্রজাতন্ত্রের ৭৫৭ কর্মচারী দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে এসব কর্মচারী অভিযুক্ত হন। খুব শিগগিরই এদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হবে। অবৈধভাবে অর্থ আয়ের জন্য এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন। এদের জন্য সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে।
গত তিন বছরে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রজাতন্ত্রের এক হাজার ২৭৪ কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। এর মধ্যে ৪৮৪টি মামলার চার্জশিট হয়েছে। এতে ৭৫৭ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে এদের বিচার হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা ব্যাপক হারে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। অসাধু সচিব থেকে পিয়ন পর্যন্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন তার প্রমাণ বহন করছে এসব মামলা বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
দুদক চেয়ারম্যান মোঃ বদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতির সুযোগ যেমন সবচেয়ে বেশি, তাদের ধরা পড়ার হার বেশি। দুদক দুর্নীতি দমনে কাজ করছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি রোধেও হাত দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মচারী হোক, বেসরকারি হোক কোনোভাবেই রেহাই পাবে না। দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, যার সামান্যতম ক্ষমতা থাকে তিনি সেই ক্ষমতাকে অর্থে রূপান্তর করেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা এ দেশেরই অংশ। শাস্তি পাওয়ার ভয় যতক্ষণ না থাকবে ততক্ষণ দুর্নীতির বিস্তার রোধ করা কঠিন। কাজেই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে অন্যরা শাস্তির ধরন দেখে ভয় পায়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছেন, তেমনি খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পিছিয়ে নেই। বিশেষ করে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ডেসকো, ওয়াসা, ভূমি অফিস, স্থানীয় প্রকৌশল, রেলওয়ে, যোগাযোগ, নৌ-বাণিজ্য, আইন মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, ভূমি, বন, পরিবেশ, স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িয়ে পড়ছেন দুর্নীতির সঙ্গে। যাদের দায়িত্ব জনগণ তথা রাষ্ট্রের অর্থ সম্পদ সুরক্ষার-তারাই এসব লুট করছেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এসব সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের ধরন প্রায় অভিন্ন। ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ অর্জন, দুদক আইন-২০০৪ এর ২৬(২) ধারায় সম্পদের তথ্য গোপন বা সম্পদের মিথ্যা তথ্য প্রদান, ২৭(১) ধারায় জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, দণ্ডবিধির ১০৯, ৪০৮, ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৬, ৪৬৭ ধারায় এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন উৎস থেকে দুদকে অভিযোগ আসে কিংবা জমা পড়ে। প্রাপ্ত অভিযোগ কমিশনের হাত হয়ে যাচাই-বাছাই কমিটিতে আসে। অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত হলে কমিটি অনুসন্ধানের সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিন সদস্যের কমিশন অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণে অভিযোগের সত্যতা প্রতীয়মান হলে প্রযোজ্য ধারায় মামলা রুজুর সুপারিশ করেন। সুপারিশ অনুযায়ী কমিশন মামলা রুজু কিংবা অভিযোগ নথিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত দেন। মামলার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে কমপক্ষে একজন উপ-সহকারী পরিচালককে বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলার তদন্ত হয়। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হলেও চার্জশিট প্রদানের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। কমিশন প্রতিবেদন অনুমোদন করলে সেটি চার্জশিট আকারে আদালতে দাখিল করা হয়। সব প্রক্রিয়া শেষ করে প্রজাতন্ত্রের ৭৫৭ কর্মচারীকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন বাকি আনুষ্ঠানিকতার পর তাদের বিচার শুরু হবে।
সূত্র মতে, প্রভাব খাটিয়ে একাধিক প্লট গ্রহণের অভিযোগে একজন পূর্ণাঙ্গ সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তার বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগও অনুসন্ধান চলছে। খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের একজন কানুনগোর বিরুদ্ধে চলছে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের অনুসন্ধান। এছাড়া হলমার্ক কেলেংকারির মতো চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির সঙ্গেও সংশ্লিষ্টতা মিলছে সরকারি কর্মকর্তাদের। ১৫ জুন হলমার্কের সহযোগী ৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ১০ মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। তাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ১১ কর্মকর্তা আসামি।
সূত্র জানায়, দুর্নীতিতে পিছিয়ে নেই খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারাও। দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দুই উপপরিচালককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয় ১১ মে। ১৭ জুন ভুয়া সম্পদ বিবরণী নোটিশ দিয়ে ৩৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয় উপপরিচালক জাহিদ হোসেন ও গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে। এর আগে ২০১২ সালে দুদকের ১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি দেয়া হয় দুর্নীতির অভিযোগে। গত বছর শাস্তি দেয়া হয়েছে ২০ জনকে। ২০০৮-২০০৯ সালে ট্রুথ কমিশনে (পরে অবৈধ ঘোষিত) দুর্নীতির দোষ স্বীকার করেন ৪৯১ ব্যক্তি। এর মধ্যে ৩০৩ জনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
দুদকের এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১১ সালে রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদ লুটের দায়ে ২৯৪ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ২০১২ সালে মামলা করা হয়েছে ৪১৯ জনের বিরুদ্ধে। গত বছর মামলা করা হয়েছে ৪৫৩ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এছাড়া চলতি বছর মে পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় অন্তত ১০৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করা হয়েছে।
চলতি বছর মার্চ পর্যন্ত দুদক ২৭২টি মামলার চার্জশিট দেয়। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৪৬৪ জন। মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৩৩৬ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। চলতি বছর জানুয়ারিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ৫৭টি চার্জশিট হয়। এর মধ্যে ৫১টি চার্জশিট অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত। মামলাগুলোতে অভিযুক্ত ১১০ জনের মধ্যে ৬৮ জন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ফেব্র“য়ারিতে অনুমোদিত ৫৭ মামলার চার্জশিটের মধ্যে অর্থ আত্মসাতের মামলা রয়েছে ৪১টি। মামলায় অভিযুক্ত ৬৮ জনের মধ্যে ৩৮ জন সরকারি চাকরিজীবী। এর আগে গত বছর ডিসেম্বরে ৫৬টি মামলার মধ্যে অর্থ আত্মসাতের মামলা রয়েছে ৩৯টি। মামলায় ১৩৬ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৯১ জন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। গত নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন ২৮টি মামলার চার্জশিট দেয়। এর মধ্যে অর্থ আত্মসাতের মামলা ১৭টি। এসব মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা ৬১ জন। যার মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৪১ জন। ফেব্র“য়ারিতে দায়েরকৃত ৪১ মামলার মধ্যে অর্থ আত্মসাতের মামলা ২৯টি। এসব মামলায় আসামি করা হয় ১০৯ জনকে। এদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫০। একইভাবে গত বছর ফেব্র“য়ারি মাসে দুদক ২২টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন করে। এর মধ্যে অর্থ আত্মসাতের মামলা হয় ১৭টি। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ৫৪ জনকে। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ৩৬ জন। সে বছর জানুয়ারি মাসে দুদক ১১টি মামলার চার্জশিট অনুমোদন করে। এর মধ্যে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা মামলার সংখ্যা ১০টি। এছাড়া এসব মামলায় মোট অভিযুক্ত ২৬ জন। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১২ জন।
চলতি বছর মার্চে ৩৭টি মামলা দায়ের করে দুদক। আসামি করে ৫৯ জনকে। এর মধ্যে ৩৪ জনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ মাসে দাখিলকৃত ৩৭ চার্জশিটে ৯২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৪৮ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে ওঠা প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, অপরাধ-অনিয়মগুলোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ার পেছনে কাজ করছে বিচারহীনতা। দুর্নীতির পেছনে আমরা রাজনীতিক-ব্যবসায়ী-প্রশাসনের ত্রিমুখী যোগসাজশ লক্ষ্য করি। দুর্নীতি রাজনৈতিক সুরক্ষা পাচ্ছে। ফলে সরকারি কর্মচারীরা ক্রমেই দুর্নীতিপ্রবণ হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং অপরাধকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তি নিশ্চিত করলেই কেবল এ প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে। হোসেন হাওলাদারসহ ভুয়া প্রতিষ্ঠানটির মালিকদের অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/07/01/117417#sthash.g93nl2Qi.dpuf

No comments:

Post a Comment