Sunday, June 29, 2014

সুখবর নেই

সুখবর নেই
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ : ৩০ জুন, ২০১৪
পানি বিদুৎ আর গ্যাস নিয়ে রোজাদারদের জন্য কোনো সুখবর নেই। বরং দুঃসংবাদের পরিমাণ বেশি। তা হল সেহরি, তারাবি আর ইফতারের সময় একসঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা পাবে না নগরবাসী। গড়ে প্রতিদিন আটশ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি, প্রতিদিন পানির ঘাটতি ২০ কোটি লিটার এবং গ্যাসের অবৈধ সংযোগের কারণে রোজায় সংকট থেকে উত্তরণের কোনো সুযোগ নেই। ফলে নগরবাসীকে অন্যান্য সময়ের মতো দুর্ভোগ মাথায় নিয়েই পার করতে হবে রোজার মাস।
শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা অর্ধেকের বেশি কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে রোজার মাসে গ্রামবাসীর দিন-রাত মিলিয়ে মাত্র কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা রোজায় দুর্ভোগ হবে এটা বলতে বা মানতে রাজি নন। তাদের মতে, বিদ্যুৎ পানি ও গ্যাসের তেমন কোন সমস্যাই হবে না। এজন্য তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছেন। বিদ্যুত বিভাগের মতে যথেস্ট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িতদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রায় একই কথা বলছেন ওয়াসা এবং তিতাসের শীর্ষ কর্মকর্তারা। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাসকিন এ খান যুগান্তরকে বলেন, রোজায় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলেও যাতে পানি উঠানো যায় সেজন্য জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী নওশাদুল ইসলাম জানান, রমজানে গ্যাসের লোড ঠিক রাখতে লোড ডিসপাস ম্যানেজমেন্ট গঠন করা হয়েছে। এরা ক্লোজলি পুরো লোড ডিসপার্স মনিটরিং করবে। যখন যেখানে লোড প্রয়োজন হবে সেখানে গ্যাস দেয়া হবে। কাজেই ইফতার, সেহরিতে গ্যাসের কোনো সমস্যা হবে না।
পিডিবির পরিচালক সাইফুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, ইতিমধ্যে রমজানে সেহরি, ইফতার এবং তারাবির নামাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে বিতরণ কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শহর এলাকার পাশাপাশি গ্রামেও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে খোদ আরইবির (রুরাল ইলেকট্রিসিটি বোর্ড) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মঈনউদ্দিন বলেছেন, এমনিতে গ্রামে লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। মে-জুন মাসে লোডশেডিং অনেক বেশি ছিল। রজমানে তা আরও বাড়বে। তিনি বলেন, চাহিদা সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু ২৭ জুন আরইবির সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়েছে ২ হাজার ৫৬৪ মেগাওয়াট। এদিন চাহিদা ছিল ৩ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াট। তিনি বলেন, আরইবির চাহিদা সারা দেশের মোট চাহিদার অর্ধেকের বেশি। উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে ৫০ শতাংশ সরবরাহ করার কথা। সেখানে কম-বেশি ৩৫ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে তারা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। আরইবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, গরম, ঈদের কেনাকাটা ও বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার জন্য বিদ্যুতের চাহিদা বেশি। এছাড়া বিতরণ লাইন ও ট্রান্সমিশন দীর্ঘদিনের পুরনো ও লক্কড়ঝক্কড়। প্রায়ই ট্রান্সফরমার ওভারলোডেড হয়ে শাটডাউন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় লোডশেডিং রোধ করা সম্ভব হবে না। রমজানে চাহিদা আরও বাড়বে। কিন্তু উৎপাদন বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
শহর এলাকায় বিদ্যুৎ সমস্যার কারণে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। গ্যাস সংকটও থাকবে সমান তালে। তবে এর প্রভাব একসঙ্গে পুরো রাজধানীতে পড়বে না। কিছু কিছু এলাকায় পানি ও গ্যাস সংকট থাকবে রমজান মাসজুড়ে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, সেহরি, ইফতার এবং তারাবির নামাজে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকবে। ১৫ রমজান পর্যন্ত রাত ৮টার পরিবর্তে সাড়ে ৯টায় দোকান বন্ধ রাখা হবে। আর ১৬ রমজান থেকে যতক্ষণ ক্রেতা থাকবে ততক্ষণ দোকান খোলা থাকবে। রমজানে ইফতারের সময় সব দোকানের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ থাকবে। কোথাও আলোকসজ্জা করা যাবে না।
সূত্র জানায়, রমজানে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সাম্প্রতিক বৈঠকেও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উৎপাদনকারী এবং সরবরাহকারীদের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করতে বলা হয়েছে। কোথাও যান্ত্রিক সমস্যা সৃষ্টি হলে দ্রুত তা সমাধানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এজন্য ট্রলি ট্রান্সফরমার প্রস্তুত রাখতে হবে। কোথাও ট্রান্সফরমার বিকল হলে তা লাগিয়ে সরবরাহ স্বাভাবিক করে মূল ট্রান্সফরমার ঠিক করতে বলা হয়। দোকান মালিক সমিতিকে ১৫ রমজান পর্যন্ত রাত ৮টায় দোকান বন্ধ রাখার বিধান মেনে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে। যদিও তারা ওই শর্তে রাজি হয়নি। এছাড়া দেশের মানুষের ভোগান্তির কথা মাথায় রেখে সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারের অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
দোকান মালিক সমিতির চেয়ারম্যান এসএ কাদের কিরণ বলেন, তারা ১৫ রমজান পর্যন্ত রাত সাড়ে ৯টায় দোকান বন্ধ আর ১৬ রমজান থেকে ক্রেতা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণই দোকান খোলা রাখার নির্দেশনা পেয়েছেন।
বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে (সান্ধ্যকালীন) সাত হাজার ২০৬ মেগাওয়াট। প্রাথমিক ব্যবহার এবং সঞ্চালন ক্ষতি বাদ দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ৬ হাজার ৫৩৬ মেগাওয়াট। উৎপাদন ও সরবরাহ চাহিদা চেয়ে আটশ থেকে এক হাজার মেগাওয়াট কম। এ পরিস্থিতিতেও সেহরি ও তারাবির সময় বিদ্যুৎ সুবিধা স্বাভাবিক রাখতে সন্ধ্যায় ও গভীর রাতে শিল্প-কারখানার আংশিক বন্ধ রাখা হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে। এই সময় শিল্পকারখানা বন্ধ থাকছে কিনা তা সংশ্লিষ্ট বিতরণ কোম্পানিগুলো তদারকি করবে। এছাড়া সপ্তাহে এলাকাভিত্তিক শিল্পকারখানা বন্ধ রাখার নিয়ম কঠোরভাবে প্রতিপালন করা হবে। অন্যদিকে সিএনজি স্টেশনে গ্যাস রেশনিং বলবৎ থাকায় রমজানে বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট হবে না বলে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন।
কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার সান্ধ্যকালীন যে চাহিদার কথা বলছে, বাস্তবে তা আরও বেশি। একই সঙ্গে উৎপাদনের যে হিসাব দিচ্ছে বাস্তবে উৎপাদনও হচ্ছে এর চেয়ে অনেক কম। জানা গেছে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আছে (বিশেষ করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল) যাদের অনেক ইউনিট বন্ধ থাকলেও প্রতিদিন সেগুলো থেকে শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভুয়া উৎপাদন দেখানো হচ্ছে। এভাবে কোটি কোটি টাকা লোপাট হচ্ছে।
পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমত উল্লাহ জানান, দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের চাহিদা আর উৎপাদনে বিরাট ফারাক আছে। সত্যিকার অর্থে চাহিদা আর উৎপাদন কত এটা কেউ জানে না। তবে এটা সত্য সরকার যা বলছে চাহিদা ও তার চেয়ে বেশি একই ভাবে উৎপাদনের পরিমাণও সরকারের হিসাবের চেয়ে কম। কাজেই বর্তমান অবস্থায় কোনোভাবেই রজমানকে সামাল দেয়া যাবে না। সেহরি, ইফতার ও তারাবির সময় লোডশেডিং মুক্ত করা সম্ভব হবে না।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাসকিন এ খান যুগান্তরকে জানান, ঢাকা ওয়াসা বর্তমানে চারটি পানি শোধনাগার ও ৬৭১টি গভীর নলকূপের সাহায্যে নগরীতে পানি সরবরাহ করছে। রমজান উপলক্ষে আরও ১০টি গভীর নলকূপ চালু করা হবে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের সময় পানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য ৪০৫টি জেনারেটর দেয়া হবে। এছাড়া ২১৫টি পানির পাম্পে রয়েছে বৈদ্যুতিক দ্বৈত সংযোগ। রমজানে ৪৬টি পানির গাড়ি ও ১৯টি ট্রাক্টর কাজ করবে পানি পরিবহনে। ইফতার ও সেহরির সময় টার্মিনাল ও জনবহুল এলাকায় প্লাস্টিক পানির ট্যাংক ও ট্রলির মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হবে। পানি সরবরাহ পরিস্থিতি তদারকি করতে ১১টি ভ্রাম্যমাণ দল কাজ করবে নগরীতে। কাজেই ঢাকা ওয়াসা আগামী রমজানে রাজধানীবাসীকে পানির সমস্যায় পড়তে হবে না। কিন্তু সরেজমিন নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এর কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। নগরবাসীর অভিযোগ, এখনই চাহিদার তুলনায় উৎপাদন কম। রাজধানীর অর্ধেক এলাকায় পানি সংকট চলছে। মিরপুরসহ পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় পানি নেই। এসব এলাকার সমস্যা এতটাই প্রকট এগুলো জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করা যাবে না। ডেবে যাওয়া ও সরু হয়ে যাওয়া লাইনে পানি যাচ্ছে না। রজমানে এসব এলাকার মানুষজনকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার একাধিক কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ২০ থেকে ৩০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি রয়েছে। ৫ কোটি লিটার পানি তোলা যাচ্ছে না বিদ্যুৎ সংকটের কারণে। সব মিলিয়ে ২০ কোটি লিটার পানির ঘাটতি আছে প্রতিদিন। বর্তমানে পানি সংকটের ৬০ ভাগ কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ সংকট। ওয়াসার দাবি অনুযায়ী পানি উৎপাদন হলেও কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুতের কারণে তা সাপ্লাই পাইপে দেয়া যাচ্ছে না। বারবার বিদ্যুতের অফ-অন হওয়ায় পানি ওয়াসার লাইনে যেতে পারছে না। এ কারণে বাসাবাড়ির পাানির লাইন শুকিয়ে যায়। তাছাড়া অধিকাংশ গভীর নলকূপে জেনারেটর বসানো হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকলে তাৎক্ষণিক জেনারেটর চালিয়ে পানি উঠানোর নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু পাম্পম্যানরা জেনারেটর না চালিয়ে তেল চুরি করছে। বর্তমানে নগরীর মিরপুর, লালবাগ, হাজারীবাগ, ঝিগাতলা, মনেশ্বর রোড, গণকটুলি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, শেখেরটেক, বিজলী মহল্লা, ছাপরা মসজিদ, আজিজ মহল্লা, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার এলাকায় পানির তীব্র সংকট চলছে বলে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন। মিরপুর কাজীপাড়া, সাংবাদিক কলোনি এলাকার বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, সকালে, দুপুরে আর সন্ধ্যার সময় কলে পানি থাকে না। বিকালে আর রাত ১২টার পর যে পানি পাওয়া যায় সেটা ধরে রেখে পানির কাজ সারতে হচ্ছে। রমজান মাসেও এই সংকট অব্যাহত থাকবে।
মিরপুরের সাংবাদিক কলোনি, মুসলিম বাজার, কাজীপাড়া, দ ব্লক, পীরেরবাগ, শেওরাপাড়া, আনসার ক্যাম্পে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে। এছাড়া পুরান ঢাকার অনেক এলাকায় গ্যাস সংকট চলছে দীর্ঘদিন ধরে। রমজানে এই সংকট আরও বাড়বে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ অব্যাহত থাকায় বৈধ গ্রাহকরা গ্যাস পাচ্ছে না। এলাকাবাসী অভিযোগ করেন ফজরের পর গ্যাসের চাপ একটু বেশি থাকে তখন বাসার রান্নার কাজ হতো। কিন্তু রোজায় সেটা চলবে না। সবাই একসঙ্গে সেহেরি খাবেন। সব বাড়িতে একই সঙ্গে গ্যাস ব্যবহার হবে। এমনিতেই মধ্য রাতে গ্যাসের চাপ থাকে না। রোজায় তাদের দুর্ভোগ কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে তা কেউ অনুমানও করতে পারছেন না।
তিতাসের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মীর মশিউর রহমান জানান, অবৈধ গ্রাহকদের চিহ্নিত করতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তিতাসের অভিযানে অনেক গ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, পুরনো লাইন ঠিক করতে তিতাসের প্রকল্প রয়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পুরনো লাইন ঠিক করা হচ্ছে।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/06/30/116985#sthash.bA9AZIUJ.dpuf

No comments:

Post a Comment