Friday, March 21, 2014

একদিন ভোর হবেই

একদিন ভোর হবেই

মুঠোভর্তি কিছু স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন...

Friday, October 26, 2012

সেই আড্ডা

স্কুলে থাকাকালীন খুব একটা বেশি আড্ডা হতোনা। তবে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে ফলাফল বের হওয়ার আগ পর্যন্ত যে সময়টা ছিল এক্কেবারে ফাঁকা তখন ধুমিয়ে আড্ডা দেয়া হতো। পুরনো ঢাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদের উপরে উঁচু একচিলতে জায়গায় বসে চলতো সেই মহাড্ডা। সবে বিঁড়ি ধরেছি তখন, বিষয়বস্তুহীন সেই আড্ডার ফাঁকে ফাঁকে ধুম্রশলাকা জ্বালিয়ে চরম ভাব নিতাম। কতো কি নিয়েই না চলতো কথোপকথন। মোড়ের পুরির দোকানে আলু কম কি বেশি, এই থেকে শুরু করে আম্রিকার গুষ্ঠিশুদ্ধ আলাপে চলে আসতো। বেশ বড়সড় একটা দল ছিলো তখন। কেউ গান গাইতো, কেউবা নিজের একদম নতুন ব্যর্থ ভাব বিনিময়ের কাহিনী শোনাত। হতো সবই। তারপরে রাত বাড়তেই গুটিগুটি পায়ে যে যার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরতো। আড্ডার শুরুতে যোগ দেয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের হাঁটাটা যত দ্রুত থাকতো, ফেরার পথে থাকতো ততোটাই ধীর। সেই দিনগুলো চলে গেল খুব দ্রুত। এখনও মনে পড়ে সেই নোনায় ধরা ছাদ, তাতে গাদাগাদি করে বসে থাকা, মন কষাকষি। কখনো ঐ ছোট্ট ছাদেই লর্ডসের ক্রিকেট, কিংবা রঙ্গিন ঘুড়ি। পাশের বাসার মেয়েটির সাথে একটু চোখাচোখি, সলজ্জ হাসি। এসবই অতীত।

কলেজের প্রথমবর্ষে থাকাকালীন আড্ডার রেশটা তখনও ভালোভাবে আসেনি। নটরডেম এর হঠাৎ চিড়েচ্যাপ্টা হওয়া যাওয়া জীবন, সাথে "জীবনে দৌড় ছাড়া কিছু নেই" এর প্রথম উপলব্ধি। তখন কোনমতে ক্লাস শেষ করে বাসায় আসতে পারলেই যেন বাঁচা যেত। তার উপরে সাপ্তাহিক পরীক্ষা, স্যার এর পড়া আরও আরও কতো কি! কিন্তু তবুও ধীরে ধীরে আড্ডা জমলো। তাছাড়া উপায়ই বা কি? এক ক্লাস শেষ হয়ে আরেক ক্লাস শুরুর মাঝের যে কিছু মুহূর্ত মাত্র, ঐটুকু সময়েই কি কথাই না বলতাম আমরা! আর ছিলো মধ্যবিরতির সেই মূল্যবান দশ-পনের মিনিট। প্রাণখুলে আড্ডা হতো। ছোট ছোট দলে কিংবা মাত্র দু-তিনজনে। বন্ধুত্ব গাড় হচ্ছিলো এভাবেই।

দেখতে দেখতে দ্বিতীয়বর্ষ। ততদিনে শিখে গেছি কি করে সবকিছুকে উপেক্ষা করে নিজের মতো করে চলতে হয়। পরীক্ষা আছে? তাতে কি, ওতো থাকবেই। পড়া আছে? তাতেই বা কি, ওরকম তো থাকেই। তখন আমরা মাত্র স্বাধীন। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ক্লান্ত-শ্রান্ত আমরা তখন আড্ডা দিতাম রাস্তার মোড়ের চা-সিগারেটের দোকানে কিংবা আরামবাগ কলোনিতে বন্ধুর মেসের ছোট্ট একটা ঘরে। কখনো হেঁটে যেতাম বেইলি রোড পর্যন্ত, কখনও বা রিকশায় টি.এস.সি। দিনগুলো চলে যাচ্ছিল খুব খুব দ্রুত। কলেজে উঠার আগে কেউ একজন বলেছিল, "দেখো, কলেজের দুইবছর চোখের পলকে চলে যাবে"। সত্যিই তাই! আড্ডায় উজির মেরে মাত্রই রাজাকে কব্জা করে এনেছি তখন দেখলাম হঠাৎ একদিন সব বদলে গেল। সবাই খুব মনোযোগী হয়ে উঠলো, ফালতু সময় নষ্ট করার মতো হাতে বাড়ন্ত সময় কারো কাছেই আর রইলো না। স্রোতের টানে আমিও হাবুডুবু খেতে খেতে এগিয়ে চললাম। জীবনের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে মেলাতে আমি হাঁফিয়ে উঠতাম কখনো কখনো। তখন ছুটে যেতাম আরামবাগ কলোনির সেই ছোট্ট ঘরে, যেখানে তিন চারজন মানুষ তাদের মূল্যহীন জীবনের কিছু মূল্যবান সময় হেলায় নষ্ট করে দিতাম। তারপরে আবার সেই দৌড়,দৌড়।

এরপরে বদলে গেল সবকিছু। দেশ ছেড়ে আরেকদেশে পড়তে গিয়ে দেখলাম, আশেপাশের মানুষগুলো ঠিক আগের মতো নয়। চলনে-বলনে কাছাকাছি হলেও এরা আমার মতো নয়। এরা জীবনকে চেনে অঙ্কের হিসেবে, নিক্তিতে মেপে নেয় সময়। এরা আড্ডাকে ফালতু সময় নষ্ট বলে মনে করে! কখনও একসাথে বসলেও ঘুরেফিরে প্রকৌশলী হয়ে মোটা অঙ্কের মাইনের একটা চাকরি ছাড়া এদের আর কোন কিছু নিয়েই কথা বলার থাকেনা। জীবন যান্ত্রিক, বুঝতে সময় লাগেনা মোটেও। তবুও খুঁজে নিলাম গুটিকয়েক আমার মতো ফাঁকিবাজ মানুষকে যারা ঘন্টার পর ঘন্টা বাজে বকে যেতে পারে অনায়াসে, বিনা ক্লেশে। ধীরে ধীরে ঐ নতুন পরিবেশেও মানিয়ে নেয়ার যুদ্ধটা আর যুদ্ধ রইলোনা।

তখন আড্ডা হতো ছাত্রাবাসের অনির্দিষ্ট কোন ঘরে, যখন যেমন। ঘর হতে দুরে এসে অপরিচিতের আপন হতে সময় লাগেনা। তাই দুই টাকার সিঙ্গারার সাথে চা হোক কিংবা শুধু চাটনি, আমরা লেগে থাকতাম, তর্ক করতাম, অযথা চিৎকার করে উঠতাম। কিন্তু প্রথমবর্ষ চলে যেতেই আবার ছিটকে গেল একেকজন, ছাত্রাবাসগুলোর একেক অংশে। তখন দল ছোট হয়ে কয়েকজন নির্দিষ্ট মানুষেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেল, তাতে নতুন মুখ যোগ দিতো কদাচিৎ। আমরা তখনও রাজা-উজির মারতাম। গভীর রাতে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায় কিংবা ভলিবলের মাঠে, কখনোবা বাস্কি-গ্রাউন্ড। যেই রাতগুলোতে বিদ্যুৎ থাকতো না সেই রাতগুলোতে চলে যেতাম ছাদে কিংবা যমুনার উপরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পুরনো সেতুতে। সেই রাতগুলোতে আমরা যান্ত্রিকতা ছেড়ে স্বপ্নবিলাসী হয়ে উঠতাম। আমাদের ভেতরের দ্বিতীয় স্বত্তারা সব বের হয়ে আসতো কবি, গায়ক,তার্কিক কিংবা শুধুই শ্রোতা হিসেবে। হোক না মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্যই।

সব বদলে যায়। তাই পরিচিত মুখগুলো বদলে গেল। সবাই জীবনকে সাজানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। জীবনের তাগিদে জীবনকে দেয়ার মতো ফুসরত কারো কাছেই আর রইলোনা। সবাই ইঁদুর দৌড়ে সামিল হয়ে একজন একজন করে সৈনিক হয়ে গেল। আমি তখনও হতে পারিনি কিছুই। তাই সময়ের অভাব ছিলোনা আমার। আমি তখনও হেঁটে যেতাম পাঠাগারের বারান্দায়, ভলিবলের মাঠে, বাস্কি-গ্রাউন্ডে কিংবা ভাঙ্গা সেতুতে, একা। এক সময় এই অধ্যায়েরও শেষ হলো। আমি পরাজিত আর একাই থেকে গেলাম।

দেশে ফিরে আর আগের মত আড্ডা জমেনা। সবাই ব্যস্ত নিজের জীবন নিয়ে। "আমরা" থেকে সবাই এখন "আমি" কে নিয়ে ব্যস্ত। রাস্তায় এখন হাঁটা দায়। গলির মুখে দাঁড়ালেও ধুলো আর ধোঁয়ার চোটে প্রাণ ওষ্ঠাগত। আমার আড্ডা দেয়ার পুরনো জায়গাগুলো আর নেই, নেই পুরনো মুখগুলোও। সরল থেকে জীবনের জটিল সমীকরণগুলো মেলাতে মেলাতে গোপনে কখন নিজেরাই জটিল হয়ে গেছি। তাই কদাচিৎ একসাথে হলেও আমরা এখন আর আগের মতো গান গাইনা, হুল্লোড় করিনা। আমাদের অনির্দিষ্ট হাঁটার পথগুলোর দৈর্ঘ্য এখন অনেক কম।

বাড়ির ছাদে উঠা নিষেধ! তাই টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে ইট আর লোহার জঙ্গলের মাঝে যে ছোট্ট এক টুকরো আকাশ দেখা যায় সেটাই প্রাকৃতিক বিনোদন।আকাশচুম্বী দালান বানাতে গিয়ে আকাশটাই আজ ঢেকে গেছে, চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। যন্ত্র দিয়ে ঘেরা জীবন যান্ত্রিক হবে এটাই অবশ্যম্ভাবী। তাই সব কিছুর পেছনে আমরা শক্ত কারণ খুঁজি। অহেতুক কিছু করার মতো ছেলেমানুষী আমাদের আর পোষায় না।

আমি তারপরেও নিয়ম করে অহেতুক আড্ডা দিই। গভীর রাতে, তারাদের সাথে, একা।

Tuesday, October 23, 2012

অতীতের সন্ধানে কজন বোহেমিয়ান

এক মধ্যরাতে দীপ্রর ফোন থেকেই ঘটনার শুরু। মরমী সাধক লালনের জন্মউৎসবে যোগ দিতে কুষ্টিয়া যাওয়া হবে এটাই তার ইচ্ছা। আমিও কোন ধুনফুন না করে এক কথায় রাজি। তবে দুজনের মাথাতেই অন্যচিন্তা, যখন যাওয়া হচ্ছেই তখন শুধু কুষ্টিয়াতেই হয়তো সফর সীমাবদ্ধ থাকবেনা। তাহলে কি আগে থেকেই ঠিক করা হবে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়, নাহ সেটাও পছন্দসই সিদ্ধান্ত হলোনা দুজনেরই। গিয়েই দেখা যাক পথ চলতে চলতে ঠিক কোথায় গিয়ে শেষ হয় আমাদের এই অনির্দিষ্ট যাত্রা। ভবঘুরে-যাযাবর হওয়ার স্বাদ, নাহয় জীবনে একবার আস্বাদন করেই দেখা যাক। সাথে যোগ দিলো অভিজিৎ আর পার্থ।

আমি আর দীপ্র ছোট্ট দুখানা ঝোলা ঝুলিয়ে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ডের সামনে অপেক্ষা করছি বাকি দুজনের জন্য। বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করানোর পর বুয়েটের হল থেকে শেষপর্যন্ত অভিজিৎ আর পার্থ হাজির, তবে সাথে কোন ব্যাগ-ফ্যাগ নেই। অভিজিৎ এর অফিসে ছুটি মাত্র একদিনের তাই পরেরদিন সকালেই ফেরৎ আসতে হবে আর পার্থ নাকি খাঁটি বোহেমিয়ান হয়ে ঘুরে বেড়াবে তাই এক কাপড়েই ভরসা!

গাবতলী গিয়ে কুষ্টিয়ার কোন ভালো পরিবহনের এর টিকিট পাওয়া যাচ্ছেনা। শেষমেষ হন্তদন্ত হয়ে একটা স্বল্প পরিচিতি কিংবা অপরিচিত বাসের টিকিট পাওয়া গেল তাও ঠিক সামনের চারটা সিট। আমাদের তাতেই চলবে। কিন্তু বাস খুঁজে বের করতে গিয়ে যখন তার টিকির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা তখন হেলপারের কাছ থেকেই জ্ঞান নিতে হলো যে, বাসের অগ্রভাগে লেখা ইংরেজির এস আর ডি দিয়ে "সুমন ডিলাক্স"ই একমাত্র বোঝা উচিত ছিলো!! তবে এটা ঠিক এই প্রথমবার দেশের কোন একটা পরিবহনে স্পিডমিটার এর কাঁটা ঠিক কাজ করতে দেখলাম! কোন অযাচিত ঝামেলা ছাড়াই পাটুরিয়া ফেরিঘাট হয়ে ঠিক ভোরবেলা হালকা কুয়াশায় ঢাকা, কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছে গেলাম।চলতে চলতেই শহরে ঢোকার কিছুটা আগে খোকসার পরেই সাতসকালে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বাউলদের দেখা মিললো।

অনেকে ছেউড়িয়ার উদ্দেশ্যে ভ্যানে চেপেছেন কেউবা হেঁটেই চলেছেন।সাধক লালনের জন্মবার্ষিকীর দিনটি ছিলো বুধবার, এই উপলক্ষে মেলা দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। আমরা ঠিক করেছিলাম রাতের বেলা গানের আসরে যোগ দিবো। তাই সকালটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, কাঙ্গাল হরিনাথের ছাপাখানা আর মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ি দেখার জন্য ছিলো।

[b]আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহলভরে ![/b]

প্রথমেই ইঞ্জিনচালিত নৌকায় জনপ্রতি পাঁচ টাকা ভাড়া দিয়ে পার হলাম গরাই নদী। সেখান থেকে আবার শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নসিমনে করে প্রায় ১০ কি.মি। কুঠিবাড়ির রাস্তায় ঢুকতেই দূর থেকে প্রধান ভবনটি চোখে পড়ে। সাদামাটা ধরনের বাড়ি কিন্তু এখনও বোঝা সম্ভব অতীতে একসময় যথেষ্ঠ জৌলুসপূর্ণ ছিলো। বাড়িটি এখন জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হলেও বিশেষ জিনিসপত্র কিছুই অবশিষ্ট নেই। রবি ঠাকুরের বিভিন্ন বয়সের কিছু ছবি আর কিছু চিত্রকর্মের নকল দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে। আছে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত কিছু আসবাবপত্র। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম তার সবগুলোতেই অতি উৎসাহী দর্শকরা নিজেদের নাম আবার কেউ কেউ "করিম+সাথী" এরকম করে দাগ কেটে রেখে গেছে। অবাক হলাম এদের বুদ্ধি দেখে আর রক্ষনাবেক্ষনের এরকম দশা দেখে।

2
[কুঠিবাড়ির অগ্রভাগ]

উপরে ছাদে দুটো ধাতুর তৈরী নৌকা রাখা আছে, নিচের ঘরে আছে একটা পালকি। সবকিছুতেই যত্নের দারুন অভাব। তবে দোতলার বারান্দার একাংশে দাঁড়ালে সামনে থেকে অনেকদুর পর্যন্ত দৃষ্টি যায়, আশপাশও অনেকটা চোখে পড়ে। এখনও বাগান কিছুটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সাথে আছে কয়েকটা পুকুর, বাঁধানো ঘাট।

1
[দোতলার বারান্দা থেকে]

বাড়ি থেকে বের হয়ে ডান দিকের যে প্রধান ঘাট তার একপাশে স্থানীয় গায়কদলের গানের আসর চলছে, দর্শনার্থীদের কেউ কেউ সেখানে। এই ঘাটেই রবি ঠাকুরের বজরাটি এনে রাখা হয়েছে। আমরা বেশ কিছুক্ষণ পেছনের পুকুর পাড়ে গিয়ে বসলাম। গাছের ছায়ার নিচে, মৃদুমন্দ বাতাস, চারিদিক এই সকালবেলাতেও নিস্তব্দ। দারুন একটা পরিবেশ। প্রশান্তিতে আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

3
[পুকুর পাড়ে]

44
[সেই বজরা]

[b]অরূপের রূপের ফাঁদে....[/b]

এরপরে ব্যাটারিচালিত ছোট্ট গাড়িতে করে কাঙ্গাল হরিনাথের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু হলো। গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। তবে বাড়ি খুঁজে পেতে একটু অসুবিধা হলো, অনেকেই বুঝতে পারলেননা কোথায় যেতে চাচ্ছি। পরে স্থানীয় একজনকে প্রশ্ন করতেই নিজে আমাদের সাথে এসে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলেন।

কাঙ্গাল হরিনাথ "ফকিরচাঁদ বাউল" হিসেবেও পরিচিত ছিলেন, ভালো নাম ছিলো "হরিনাথ মজুমদার"। কুষ্টিয়া জেলার এই কৃতিসন্তান লালনের একজন শিষ্যও ছিলেন। "কাঙ্গাল ফকির চন্দ্র দল" নামে তাঁর একটি বাউল দলও ছিলো একসময়। তাঁর করা বিভিন্ন গান এবং সুরের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রের কাজে। এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষটিই ইংরেজ শাসনামলে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র ছাপানো শুরু করেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পৃষ্টপোষকতায়। "সংবাদ প্রভাকর" নামের এই সংবাদপত্রটিই সর্বপ্রথম দৈনিক বাংলা সংবাদপত্র। এটি প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে শুরু হলেও পরবর্তিতে আট বছরের ব্যবধানে এটি দৈনিক সংবাদপত্রে রুপান্তরিত হয়। তৎকালীন সমাজে এর গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম। সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যচর্চা এই সংবাদপত্রের মাধ্যমেই শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের নীলকুঠি ও সাহেবদের নানা অত্যাচারের বিরুদ্ধেও সংবাদ প্রকাশিত হতো এখানে।

ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই স্থানটির চরম ভগ্নদশা দেখে আমরা চারজনই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। ছাপাখানাটি ধ্বসে পড়েছে স্থানে স্থানে। কোনমতে টিকে আছে মূল কাঠামোটি। দরজাগুলো ভেঙ্গে গেছে। এরই ফাঁকফোকর দিয়ে আমরা বাংলার প্রথম ছাপার যন্ত্রটি দেখার চেষ্টা করছি তখন। পেছনের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। তিনি আমাদের বিভিন্ন প্রশ্ন করার একপর্যায়ে জানতে পারলাম তিনি কাঙ্গাল হরিনাথের নাতি। আমাদের উৎসাহ দেখে নিজেই তালা খুলে নিয়ে গেলেন ছাপাখানাটি দেখাতে। তার কাছ থেকে জানলাম আরও কিছু তথ্য আর হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখলাম অতীতকে।

4
[ছাপাখানার সামনের দেয়াল]

5
[ভগ্নদশা]

কাঙ্গাল হরিনাথ এই যন্ত্রটি কিনে নেন মাত্র ৬০০ টাকা দিয়ে কোলকাতা থেকে। দুটো ছাপার যন্ত্র তখন আসছিলো কোলকাতায়। পথে ডাকাতের কবলে পড়ে
বেহাত হয়ে যায়। নানা হাত ঘুরে স্থান পায় হরিনাথের ছাপাখানাতে। সেসময় কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রায় অর্ধশতাধিক নীলকুঠি ছিলো। আর তার প্রধান দপ্তর ছিলো এখানে। হরিনাথ তখন ইংরেজদের নানা অত্যাচারের খবর তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই ছাপাখানার উপরে বোমাবর্ষণ করা হলে ছাদ ধ্বসে পড়ে। এরপরে কোনমতে সেটি ঠিক করা হয়। পরবর্তিতে নানা সময়ে এটি সংস্কার ও সংরক্ষণের নানা প্রতিশ্রুতি আসলেও কোন কিছুই হয়নি, শুধু ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ছবি তোলা ছাড়া। এই ঐতিহাসিক ছাপার যন্ত্রটি জাদুঘরেও নেয়ার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তিনি ঘুরে দেখালেন আগেকার যন্ত্রটি, অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স। জানতে পারলাম মীর মশাররফ হোসেনের "বিষাদসিন্ধু" এই ছাপাখানাতেই ছাপানো হয়েছিল সর্বপ্রথম। মীর মশাররফ হোসেন ছিলেন হরিনাথের একজন গুনমুগ্ধ ভক্ত। হরিনাথের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কয়েকবার এসেছিলেন।

6
[ছাপার যন্ত্রটি]

7
[যন্ত্রাংশ সাথে ভিত্তিপ্রস্তরের দুখন্ড]

8
[অক্ষরের ব্লক আর কালির বাক্স]

9
[পুরনো কাগজ]

একপর্যায়ে তিনি নিয়ে এলেন কাঙ্গাল হরিনাথের নিজ হাতে লেখা গানের একটি পান্ডুলিপি। এই সেই বিখ্যাত গান "দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো, পার করো আমায়" যা সত্যজিৎ রায় তাঁর "পথের পাঁচালি" চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেছিলেন। এই বিখ্যাত গানটির আসল পান্ডুলিপিটি দেখে আমরা বাকরুদ্ধ। এটিও সংরক্ষণের কোন পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়নি।

11
[গানের পান্ডুলিপি]

10
[কাঙ্গাল হরিনাথের সমাধিস্থান]

এই উপমহাদেশে বাংলা ভাষায় সাংবাদিকতার প্রবাদপুরুষ, একজন গুনী বাউলসাধক, সুরকার এবং গায়ক, একজন নিবেদিতপ্রাণ সমাজকর্মীর জন্মস্থান থেকে তাঁর ধ্বসে পড়া অতীতচিহ্ন দেখে যখন আমরা ফিরে আসছি তখন সবার মন কিছুটা হলেও ভারাক্রান্ত ছিলো। কানে বাজছে তাঁর নাতির কথাগুলো, "সবাই তো আসে, ছবি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কেউ রক্ষা করার জন্য কিছুই করেনা বাবা"। আমাদের অতীতকে আমরা মর্যাদা দিতে শিখিনি।

এরপরে যাওয়া হলো মীর মশাররফ হোসেন এর জন্মভিটায়। সেটি এখন বিদ্যালয়ে রুপান্তর করা হয়েছে। পাশে একতলায় একটি ছোট জাদুঘর, তাতে তাঁর ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী। পুরনো কোন স্থাপত্য আর নেই এখন।

[b]তিন পাগলের হলো মেলা ....[/b]

রাতের বেলা গেলাম লালনের আখড়া কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়াতে। ঢোকার মুখেই মানুষের প্রচন্ড ভিড়ে অবাক হলাম। বাংলালিংকের সৌজন্যে চলছে মেলা। আর তাতে মাঠের পাশে বড় স্ক্রিনে বাংলালিংকের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন। পুরো মাঠ জুড়ে অসংখ্য দোকান। তাতে শিকড়ের মহৌষধী থেকে শুরু করে দা-খুন্তি সব বিক্রি হচ্ছে। বুঝলাম মানুষের আগ্রহ লালনের সাধনায় নয় বরং নিজের সাংসারিক জীবন সাধনায়। অসাম্প্রদায়িক লালনের আখড়ার সামনে ধর্মব্যবসায়ীদের ভিড়ও লক্ষ্য করার মতো। ধর্মই মনে হয় এমন একটি জিনিস যা জায়গাভেদে সবক্ষেত্রেই পণ্য হিসেবে বেশ ভালো বিক্রি হয়। কিছু বিকলাঙ্গ মানুষকে দেখিয়ে টাকা তুলছে একদল আর তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে অনেক মানুষ, কেউ কেউ নিজের মোবাইলের ক্যামেরাতে ছবিও তুলে নিচ্ছে! মানুষের বিকলাঙ্গতা যে দর্শনের বস্তু হতে পারে সে সম্পর্কে নতুন করে ধারণা হলো। এরকম নানা কিসিমের মানুষের ভিড়ে ক্লান্ত হতে বেশিক্ষণ লাগেনা। শেষপর্যন্ত ভিড় ঠেলে ঢুকলাম প্রধান অংশে। দেখলাম সাধক লালনের সমাধিস্থল। এরপরে ঘুরে ফিরে অনেক রাত পর্যন্ত দেখলাম বাউলদের গান। এখানে কেউ টানছে ধুম্রশলাকা, কেউ কল্কি। কেউ এখানে ভবের পাগল, কেউবা ভাবের। এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ফিরে এলাম। অনুভূতির বাণিজ্যিকিকরণ আমাদের থেকে ভালো করে কেউ করতে পারে কি?

14
[প্রবেশদ্বার]

12
[সমাধিস্থল]

13
[মেলায় আগত সন্ন্যাসীরা]


[b]পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন....[/b]

পরের দিন ভোরে অভিজিৎ বিদায় নিলো। বাকি আমরা তিনজন চেপে বসলাম বাসে, নাটোরের উদ্দেশ্যে। বনলতা সেনকে খোঁজার আগ্রহ তো আছেই তার সাথে আছে রানী ভবানীর রাজবাড়ি আর চলনবিল দেখার আগ্রহ। ঘন্টা দুয়েক পরে নেমে পড়লাম নাটোর শহর ঢোকার মুখে। সেখান থেকে অটোরিক্সা করে রানী ভবানীর রাজবাড়ি।

রাজবাড়ি ঢোকার মুখেই বিশাল একটা পুকুর। তার শান বাঁধানো ঘাটে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। ছায়া-সুশীতল ঘাট, নিস্তরঙ্গ জল। তার পাশেই শিবমন্দির।কম করে হলেও ৩০০ বছরের পুরনো। তার সাথেও বড় পুকুর। চারিদিকে গাছপালায় ঢাকা, ছায়া ছায়া। মন্দিরের ভেতরে গমগম করছে জটাধারী সন্ন্যাসীর গলা, লাল বস্ত্র, তিলক কপালে, মন্ত্র আউড়ে যাচ্ছেন।

15
[প্রথম পুকুর]

16
[শিব মন্দির]

মন্দিরের পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে সামনে পরে কাচারী বাড়ি। এখন বন্ধ করে রাখা হয়েছে। চারিদিকে অযত্নের ছাপ। কোন রক্ষনাবেক্ষণ নেই বোঝাই যাচ্ছে। এই রাজবাড়ি রানীর মৃত্যুর পরে তার দুই ছেলের মাঝে ভাগ করে দেয়া হয়। একপাশে বড় ছেলের জমিদারি অন্যপাশে ছোট ছেলের। বাড়িগুলো জায়গায় জায়গায় ভেঙ্গে গেছে। টিকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করা হয়নি। অনেকগুলো বাড়ি পুরোপুরি ধ্বসে গেছে। এখানেও দেয়ালে নানা ধরনের লেখা। বোঝাই যাচ্ছে অতি উৎসাহীদের কাজ। বাড়িটি ঘিরে বড় বড় পাঁচটি পুকুর, অসংখ্য গাছ। কোনমতে টিকে থাকা বিশাল দালানগুলোতে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে আছে দারুন সব কাজ। কোনায় কোনায় যুগলদের ফিসফাস, হঠাৎ সামনে পড়ে যাওয়ায় বিব্রত আমরা।

17
[কাচারী বাড়ি]

18
[কাচারী বাড়ির বারান্দা থেকে সামনের পুকুর]

19
[লোহার সিড়ির ভগ্নদশা]

20
[কিছু মর্কটের ভালোবাসার আহ্ববান]

21
[ভেঙ্গে পড়া বাড়ির একাংশ]

22
[পুরাতন কুয়ো]

23
[ছোট জমিদারের দালানের একাংশ]

24
[দালানের পেছনের ঝর্না]

রাজবাড়ির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত রানী ভবানীর মহলটি। পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। মাটিতে অনেকটা দেবে গেছে প্রায় পুরো জায়গাটি। ভাঙ্গা দেয়ালে বাসিন্দাদের জামা কাপড় শুকোতে দেয়া হয়েছে। হাঁস-মুরগি আর ছাগল চড়ে বেরাচ্ছে এদিক সেদিক। বিন্দুমাত্র রক্ষনাবেক্ষণ নেই। বড় জমিদারের দালানটি এখনও টিকে আছে সব থেকে ভালো অবস্থায়। তাই বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম আর আফসোস করলাম। দরজার কপাটের ফাঁক দিয়ে ভেতরের ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। প্রবেশাধিকার নেই তাই ভেতরটা এখনও টিকে আছে দেখে ভালো লাগলো। সামনের মাঠে স্থানীয়দের ক্রিকেট খেলার জায়গা। যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাজবাড়িটি। প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো কোন প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক জায়গা এভাবে অরক্ষিতভাবে ব্যবহার করা হয় বলে আমাদের জানা ছিলোনা।

25
[রানীর মহলের অবস্থা]

26
[বড় জমিদারের মহলের ভেতরে, কপাটের ফাঁক দিয়ে তোলা]

27
[বড় জমিদারের মহল সামনের রাস্তা থেকে, মাঠে স্থানীয়রা ক্রিকেট খেলছে]

বের হয়ে আসার সময় টিকিট কাউন্টারে প্রশ্ন করলাম টাকা নেয়া হচ্ছে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে কিন্তু কোন যত্ন নেই কেন? তাদের সোজা উত্তর, "আমাদের বলে লাভ নেই, অফিসে বলুন"। অফিসের দেয়ালে লেখা পাঠাগার, কিন্তু ভেতরে একটা টেবিল আর কখানা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই! একটা ক্রোধ জন্মালো
মনের মধ্যে অযথাই।

সেখান থেকে গেলাম নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা চেখে দেখার জন্য। তবে সেটারও খুব একটা সুবিধাজনক স্বাদ পেলামনা। এবার যাত্রা চলন বিলের উদ্দেশ্যে। বাসে করে নাটোর মাদ্রসা মোড় থেকে প্রায় আধাঘন্টার দুরত্ব। ভর দুপুরে নামলাম শিঙ্গা মোড়। সেখান থেকে প্রায় ঘন্টাখানেক হেঁটে গেলাম বিলের নৌকা ঘাটে। মাত্র ৮০ টাকায় ঠিক করা হলো একটা ছিপ নৌকা। মাঝি বয়সে তরুণ, হাসিখুশি দারুন ব্যবহার। ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো বিলের এদিক সেদিক। প্রচন্ড রোদে প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগলেও পরে ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়ে উঠলো পরিবেশ। চারিদিকে জল তার মাঝে মাঝে একটা দুটো গ্রাম। নৌকাই এখানের প্রধান বাহন। চারিদিকে ধান লাগানো হয়েছে। মাঝি জানালো সব বাড়িতেই বিদ্যুৎ এর সংযোগ আছে, আছে ক্যাবল টিভির সংযোগ। হাসিমুখে জানালেন ঢাকা শহরে কাজ করেছিলেন ৭ বছর, তার থেকে অনেক ভালো আছেন এখন নিজের গ্রামে।

28
[নৌকা থেকে]

29
[বিলের অগভীর জায়গায় শস্যের ক্ষেত্]

30
[বিলের মাঝখানে একটুকরো চর]

31
[নৌকার মাঝি]

32
[পেতে রাখা মাছ ধরার জাল]

প্রচুর মাছ ধরা হয় এখানে। মৌসুমে ৭০-৮০ মন মাছ উঠে এক এক নৌকায়। এখন ধান চাষ করা হচ্ছে। আর কদিন পরেই জল এসে উচ্চতা বেড়ে গেলে জেগে উঠা ছোট ছোট চর ঢেকে যাবে। বিভিন্ন জায়গায় মাছ ধরার জাল লাগিয়ে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে আমাদের নৌকার দিকে উৎসুক মানুষের দৃষ্টি। একটা ছোট চরে নেমে পড়লাম অল্প কিছুক্ষণের জন্য। জায়গাটা দারুন সুন্দর। চারপাশে জল তার মাঝখানে একটুখানি মাটি। প্রায় ঘন্টা দেড়েক ঘুরে বেড়ানো হলো নৌকায় আর মাঝির সাথে চললো নানা বিষয়ে গল্প। মাঝির একটাই কথা, শহরের মানুষ যে দূষণে থাকে তার থেকে তারা অনেক ভালো আছেন, শান্তিতে আছেন। দুপুরে তাদের বাড়িতে খাওয়ার জন্যও বললেন কয়েকবার। বিল দেখা শেষ করে এবার আবার ফিরে এলাম নাটোর শহরে। রেলস্টেশন থেকে ট্রেন ধরে যেতে হবে জয়পুরহাট। উদ্দেশ্য পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার দর্শন। খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো জয়পুরহাট থেকেই আমাদের জন্য সুবিধা হবে। শেষ বিকেলের আলোয় ট্রেনে চেপে বসলাম। আরেকটি দিনের জন্য কিছুটা বিষাদগ্রস্ত মন নিয়েই যাত্রা শেষ হলো, নতুন গন্তব্যে রওনা হলাম।


রাতের দিকে পৌঁছালাম জয়পুরহাট শহরে। সেখানে হোটেলে উঠে বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারের খোঁজে বের হলাম। দারুন আতিথেয়তায় খাবার খেলাম, অসাধারণ রান্না। অনেকদিন পর ফরমালিনমুক্ত খাবার খেয়ে যারপরনাই খুশি আমরা। পরের দিন সকালে রওনা হবো পাহাড়পুরে।

সকালে নাস্তার পরে ঘুরে এলাম জয়পুরহাট সুগার মিলস। যতদূর জানি এটাই এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্বয়ংসম্পূর্ন চিনির কল। আখ মাড়াই করে এখানে চিনি তৈরী করা হয়। আখের ছোবরা দিয়েই জ্বালানির চাহিদা পূরণ করা হয়ে থাকে। জায়গায় জায়গায় আখের ক্ষেত। কারখানাতে ঢোকা গেলনা। ৩৫ বছর ধরে গার্ডপোস্টে চাকরি করা মানুষটি শোনালেন এই কারখানার নানা কাহিনী। দুঃখ প্রকাশ করলেন কারখানা বন্ধ থাকায় ঘুরিয়ে দেখাতে পারলেননা বলে। জানা গেল প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতির মধ্য দিয়েই চলছে। ৪১ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই কারখানাটি সঠিক পরিচালনা এবং সংরক্ষণ জরুরি।

দুপুরে রওনা হলাম পাহাড়পুরের উদ্দেশ্যে। ১০০ টাকা ভাড়ায় অটোরিক্সা করে প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরে পৌঁছালাম সেখানে। পথে অসাধারণ সবুজের মেলা।চারপাশে শস্যের ক্ষেত, নীল আকাশ, মন উদাস করা বাতাস। ছোট ছোট গ্রাম, শিশুদের খেলা। অনেকদিন পরে গ্রামের রাস্তায় চলতে গিয়ে মন নিজের অজান্তেই নানা স্মৃতিচারণ শুরু করলো।

[b]জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক....[/b]

পাহাড়পুর বিহারটি অতীতকাল থেকেই বেশ অযত্নে রয়েছে। বৌদ্ধ শাসকদের হটিয়ে সেন রাজারা যখন দখল করে তখন তারাও এটিকে যত্ন করেনি। নানা যুদ্ধ-বিগ্রহে বারবার পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এর নানা অংশ। তারপরেও কোনমতে টিকে আছে এখন।

33
[ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার, সামনে থেকে]

পাহাড়পুরে যখন ঢুকলাম তখন সূর্য মাথার উপরে। রোদ মাথায় নিয়েই ঘুরতে শুরু করলাম। অতিথি বাংলোর অংশটুকু বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। বিহারের ধবংসাবশেষ বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে আছে। তিন স্তরে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠা যায়। দেয়ালে পোড়ামাটির কাজ এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। অবাক হলাম বিহারের উপরে এক কোনে দর্শনার্থীরা মুত্র বিসর্জন করতে করতে মুত্রাগার বানিয়ে ফেলেছে দেখে। প্রাচীন স্থাপত্যের এহেন অবমাননা ভাবতেও কষ্ট লাগে। অনেক জায়গাতেই খাবারের প্যাকেট ফেলে রাখা হয়েছে, রয়েছে পানির ব্যবহৃত বোতল। এখানেও রক্ষনাবেক্ষনের অভাব। তারই মাঝে কিছু মর্কট চেষ্টা করছে দেয়াল বেয়ে একদম উপরে উঠার জন্য। অশ্রাব্য ভাষা বিনিময়ে তাদের ফুর্তি দেখে মনে হলো এটা তাদের পিকনিক গ্রাউন্ড।

34
[দেয়ালের কাজ]

35
[নানা ধরনের প্রতিকৃতি]

36
[জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা]

37
[বিহারের ভেতরের একাংশ]

38
[বিহারের পেছনদিকে]

39
[বিহারের বিস্তৃতি]

পাহাড়পুর জাদুঘরটি বেশ সমৃদ্ধ। শুধু এখান থেকে পাওয়া জিনিসেই নয় সাথে রাখা আছে আশেপাশের নানা অঞ্চল থেকে পাওয়া প্রাচীন সামগ্রী। অধিকাংশই প্রাচীন পাথরের বড় বড় পৌরানিক দেব-দেবীর মূর্তি কিংবা কাহিনীর বর্ণনা। অসম্ভব নিঁখুত এসব কাজ দেখে বেশ সময় কেটে গেল।

এরপরে আমরা ঠিক করলাম খুঁজে বের করবো "হলুদ বিহার" নামের জায়গাটিকে। এ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিলোনা। তাই স্থানীয় মানুষের মাধ্যমেই খুঁজে খুঁজে যেতে হলো। পাহাড়পুর বাজার থেকে শ্যালোইঞ্জিন চালিত টেম্পো ভাড়া করলাম ২০০ টাকা দিয়ে। এরা আমাদের নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে এখানে। যাওয়ার পথ গ্রামের ভেতর দিয়ে। খুবই খারাপ অবস্থা রাস্তার। এক মুহূর্ত স্থির বসে থাকা যাচ্ছেনা। শরীর ব্যথা হয়ে গেল ঘন্টা দেড়েক এর যাত্রায়। তবে আশেপাশের প্রত্যন্ত গ্রাম দেখে বেশ অন্যরকম অনুভূতি হলো। টেম্পো চললো "কুলি" নামক জায়গা পর্যন্ত সেখান থেকে আবার গ্রামের ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা পথ। "বদলগাছি" পর্যন্ত বাসে করে এসে "কুলি" মোড় থেকে টেম্পু নিয়েও যাওয়া যায়। গ্রামে বসেছে গরুর হাট, তারই মাঝ দিয়ে চললাম। শেষমেষ বড় একটা ধবংসাবশেষ এর কাছে গাড়ি থামলো। এটাই "হলুদ বিহার"।

43
[উঠার সিড়ি]

রাস্তার মোড়ে প্রায় ৫/৬ কি.মি আগে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক দপ্তরের একটা সাইনবোর্ড দেখেছিলাম তাও গাছের শাখাপ্রশাখায় ঢেকে আছে, এছাড়া আর কোন দিকনির্দেশনা নেই।জায়গাটা দেখে হতাশ হলাম পুরোপুরি। স্থানীয় লোকেদের তাস খেলা আর বৈকালিক বিড়ি খাওয়ার জায়গা সেটা। উঁচু ইটের ঢিবি, মাটিতে ঢেকে আছে। একটা সিড়ি মোটামুটি টিকে গেছে।নেই কোন সাইনবোর্ড কিংবা কর্মী। চারপাশে গ্রাম বিস্তার লাভ করেছে, বসেছে দোকানপাট। এদিকে শহরের লোক খুব একটা আসেনা। স্থানীয়রা খুব উৎসাহ নিয়েই আমাদের নানা অভিজ্ঞতা বলে গেল। এখানে নাকি "হলুদ রাজা" নামে কোন এক রাজা ছিলেন, তারই নামে এই অঞ্চলের নাম। তাই এই বিহারটির নামও লোকমুখে চলে এসেছে "হলুদ বিহার"। পাশেই এক দোকানে চা খেতে খেতে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। দোকানি জানালো জন্মের পর থেকেই জায়গাটি দেখছেন। তাদের বাপ-দাদারাও দেখেছে তাদের জন্মের আগে থেকেই। তিনি যখন তরুণ ছিলেন তখন এর ঢিবির উচ্চতা ছিলো অনেক। একবারে হেঁটে উপরে উঠা যেত না। কালক্রমে এটি মাটিতে বসে যাচ্ছে। আশেপাশে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা ছিলো, লোকে সাহস করতো না খুব একটা এখানে আসার। পরে লোকজন বসতি স্থাপন শুরু করলে আস্তে আস্তে জঙ্গল সাফ করা হয়। বিহারের জায়গাতেই বসতি নির্মান শুরু হয়।

40
[হলুদ বিহার]

41
[খননকার্যের জায়গাটি]

42
[উপরের অংশ]


কিছু বিদেশী মানুষ নাকি এসেছিলেন এখানে। খোড়াখুড়ি চলেছিলো বেশ কিছুদিন। কয়েকটা মাটির তৈজসপত্র পাওয়া গিয়েছিলো। এর পরে আর কিছু কাজ হয়নি। মাটি খুড়ে বিহারের ভিত্তি পর্যন্ত কোন হদিস পাওয়া যায়নি তাই কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে বছরের পর বছর ধরে ধুলো ময়লা জমে গর্ত বন্ধ হয়ে যায়। পাশেই একটা পুকুর দেখলাম। ধারণা হলো নিচের মাটি বেশ নরম তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে জায়গাটি। একসময় হয়তো আর যা আছে তাও অবশিষ্ট থাকবেনা। একটি প্রাচীন জায়গায় অন্তত সরকারী একটা দেখভালের ব্যবস্থা করা যেত। অতীতকে এতোটা অবহেলা করার কোন মানে আছে বলে মনে হয়না।

ফেরার পথে অন্য রাস্তা ধরলো গাড়ি। অন্ধকার রাস্তা তার উপরে কুয়াশা। গাড়ির হেডলাইট কাজ করেনা। অন্ধকারেই কোনমতে চলছে। একবার দুর্ঘটনা হতে হতে বাঁচলো। রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ একটা স্পিডব্রেকার। মাথায় ব্যথা পেল পার্থ। পরে নোকিয়া ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে পথ দেখে দেখে চললো ঘন্টাখানেক! ভয় হচ্ছিল কখন গাড়ি রাস্তা ছেড়ে অন্ধকারের মধ্যে ক্ষেত কিংবা জলাশয়ে গিয়ে নামে! কোনমতে ফিরে এলাম পাহাড়পুর বাজারে। সেখান থেকে রাতের শেষ বাসে জয়পুরহাট শহরে। সেদিন রাতের ট্রেন ছিলো ১২টায়।

ট্রেন ধরার সময় আরেক ঘটনা। আমাদের জায়গা ছিলো "ঠ" বগিতে। খুঁজতে গিয়ে দেখি গাড়ির শেষে "ঠ" বগিই নেই! আমাদের টিকেট চেকার বললো ওটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাই ওখানে বসা যাবেনা। ভালো কথা কিন্তু তার ঘোষণা তো দেয়া উচিত আমরা এখন কোথায় বসি? প্রশ্ন করতেই বললেন, যেখানে খুশি! তো আমাদের টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য কে ফেরৎ দিবে এই প্রশ্নে সে নিরব। শেষে যখন অন্য বগিতে উঠতে যাচ্ছি তখন ট্রেন ছেড়ে দিলো। কোন মতে দৌড়ে গিয়ে ঝুলে ঝুলে ট্রেনে উঠে পড়লাম।

কয়েকদিনের কিছু অপার্থিব মুহূর্ত আর ভালোলাগা-মন্দলাগা নিয়ে ফিরে এলাম যান্ত্রিক শহর ঢাকাতে। পুরো সফরে স্থানীয় মানুষদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছি। তাদের সরল ব্যবহারের কাছে নিজেদের অন্যরকম লেগেছে। নিজের দেশে এতোটা অমায়িক আচরণের অভিজ্ঞতা আমাদের সবার কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিলো। এই মুহুর্তগুলো মনে দাগ কেটে রইলো।

map
[সম্পূর্ণ সফরের যাত্রাপথ]

কিছু উপলব্ধি হলো একই সাথে। আমরা অধিকাংশ সময় নিজেদের সমাজ,সংস্কৃতি,ঐতিহ্য ধবংসের জন্য নানা রকম আগ্রাসনকে দায়ী করি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজেদের দায়বদ্ধতার কথা। নিজের চোখে দেখলাম কিভাবে অনাদরে-অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে শত শত বছরের পুরনো সব স্থাপত্য। কিভাবে আমরা নিজেরা নষ্ট করছি আমাদের অতীত স্মৃতিকে। আমরা যদি আমাদের অতীতকে মর্যাদা দিতে না পারি, যদি তাদের আগলে রেখে রক্ষা করতে না পারি তাহলে এরজন্য দায়ী কে? অপরের দিকে আঙ্গুল তোলার আগে নিজেদের দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করছি কিনা সেই প্রশ্নটার আগে সমাধান হওয়া উচিত বলে মনে করি।


[লেখাটি প্রিয় বন্ধু, সহব্লগার তারেক অনুর ( আমাদের ঘনুদা) জন্য। এই মানুষটি আমার কাছে একটি রহস্য, মনে হয় অন্যগ্রহের প্রাণীর সাথে নির্ঘাত যোগাযোগ আছে!]
http://arfias.blogspot.in/2012_10_01_archive.html

No comments:

Post a Comment