দক্ষিণ-পশ্চিমের ৬ জেলায় ব্যাপক চাঁদাবাজি
হেদায়েৎ হোসেন, মাওয়া থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৮ জুন, ২০১৪
আর বলেন না ভাই, পুলিশ, নেতাদের চামচা (সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের অনুসারী) আর ঘাট নেতাদের কারণে ন্যায়ভাবে চলার কোনো সুযোগ নেই। টাকা দিলে হয় না এমন কোনো কাজ নেই। ভালো-মন্দ বিচারের প্রয়োজন নেই। কাজ করতে হলে পুলিশসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ দিতেই হবে। টাকা না দিলে সেটা যত ভালো কাজই হউক না কেন তা আটকে যাবে। কথাগুলো বললেন মাওয়া ঘাট থেকে খুলনা রুটের এক মাইক্রোবাস চালক আবদুস সালাম। মাওয়া ঘাট থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের ৬ জেলায় ভাড়ায় যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস ও ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহনে চলছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। এ কারণে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা রয়েছে ক্ষুব্ধ। এ ক্ষোভ ফুটে উঠেছে মাইক্রোবাস চালক সালামের কথাতেও। বিভিন্ন পরিবহনের শ্রমিক নেতাদের বক্তব্যেও এমন ক্ষোভ প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আবদুর রহিম বকস দুদু যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন স্থানে পরিবহন শ্রমিকরা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা হচ্ছে ফেরিঘাটগুলোতে। মাওয়াসহ বিভিন্ন ঘাটে নেতাদের দাপটের কারণে পুলিশকে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঈদের আগে এই চাঁদার হার বেড়ে যাবে। ৬টি জেলা হচ্ছে- খুলনা, বাগেহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও বরিশাল। এই ৬টি জেলার ৯টি থানা পুলিশ এই বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়াও গোপালগঞ্জের বেতগ্রামে রয়েছে সরকারি দলের সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক কতিপয় নেতার অনুসারী বা চামচাদের তৎপতা। মাওয়া ঘাটেও এই শ্রেণীর লোকের তৎপরতা রয়েছে ব্যাপক। মাওয়া ঘাটে এরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অর্থ আদায় করছে ভাড়ায় যাত্রীবাহী মাইক্রোবাসসহ বিভিন্ন পরিবহন শ্রমিকদের কাছ থেকে। মাওয়া ঘাটে মাইক্রোবাস সিন্ডিকেটের কারণে পরিবহন চলাচলেও বাধা সৃষ্টি হয়। অংসখ্য যাত্রী সমাগম থাকা সত্ত্বেও মাওয়া থেকে খুলনা ও বরিশাল অভিমুখে একাধিক পরিবহন চলাচল করতে পারে না। এ কারণে কয়েকটি পরিবহন ঢাকার সঙ্গে লিঙ্ক রেখে খুলনা ও বরিশালের যাত্রীবহন করছে। তবে তাদেরও মাসোহারা বা উৎকোচ না দিয়ে মুক্তি মেলে না। মাওয়া-খুলনা রুটের ২০টি স্থানে ট্রাক প্রতি ১শ’ টাকা থেকে ৩শ’ টাকা পর্যন্ত অর্থ আদায় করা হয়। স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে : খুলনার বাইপাস সড়কের জিরোপয়েন্ট, বটিয়াঘাটা ও লবণচরা, রূপসার কুদির বটতলা, বাগেরহাটের কাটাখালি, ফকিরহাট, গোপালগঞ্জ সদর মোকছেদপুর থানাসহ ৪টি এলাকা, ফরিদপুরের ভাঙ্গাসহ ৪টি স্থান। থানা ও হাইওয়ে পুলিশ এবং স্থানীয় নেতাদের অনুসারীরা জোর করেই এসব স্থান থেকে অর্থ আদায় করছে। বিভিন্ন পরিবহন থেকেও অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ মাওয়া ঘাটে সিরিয়াল পাওয়া নিয়ে ১ হাজার টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে হয়। এখানে অর্থ না দিয়ে ট্রাক ঘাট পার হতে পারে না। মাওয়া থেকে খুলনা রুটে ৪০টি মাইক্রোবাস চলাচল করছে। প্রতি মাসে মাইক্রো প্রতি ১ হাজার ৭শ’ টাকা করে পুলিশকে দিতে হয়। যা মাইক্রোবাসের মালিকরাই নির্ধারিত দিনে পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার হাতে দিয়ে থাকে। তবে এমপিদের মাইক্রোবাস এ হিসাবের বাইরে থাকে। আদায়কৃত অর্থ খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলা ও ৬টি থানা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে বণ্টন হয়ে থাকে। এ ছাড়া গোপালগঞ্জের বেতগ্রামে চেয়ার পেতে বসে এমপি ও রাজনৈতিক নেতাদের অনুসারী মাইক্রোবাস প্রতি দৈনিক ৫০ টাকা হারে আদায় করে। মাওয়া ঘাটে প্রতিটি মাইক্রোবাস থেকে আদায় করা হয় ৪শ’ থেকে ৮শ’ টাকা। যা এমপি, রাজনীতিবিদ, ঘাট নেতাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। মাওয়া-খুলনা রুটে চলাচলকারী মাইক্রোবাসের মধ্যে ১২টিই হচ্ছে মাদারীপুর ও খুলনার ২ জন সংসদ সদস্যের। মাওয়া ও রূপসার মাইক্রো স্ট্যান্ড থেকে এই দুই নেতার গাড়িতে কিছুটা ছাড় দেয়া হয়। পাশাপাশি মাওয়া-কালনা, মাওয়া-টেকেরহাট, মাওয়া-বরিশাল রুটে আর শতাধিক মাইক্রোবাস চলাচল করছে। এসব গাড়ি থেকে ব্যাপক হারে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এ অবস্থার কারণে এসব রুটে মাইক্রোবাসের ভাড়াও হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। ৩ বছর আগে মাওয়া-খুলনা রুটে মাইক্রোবাসের ভাড়া ছিল জনপ্রতি দেড়শ’ টাকা। বর্তমানে নেয়া হচ্ছে ৩শ’ টাকা। ৩ বছর আগে মাওয়া টেকেরহাট রুটে ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। বর্তমানে নেয়া হচ্ছে ১শ’ থেকে ১২০ টাকা। মাওয়া-বরিশাল রুটে আগে ভাড়া ছিল ১শ’ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ২শ’ টাকা। খুলনার-রূপসা ঘাট, মাদারীপুরের টেকেরহাট, গোপালগঞ্জের কালনা, বরিশালের মাইক্রো স্ট্যান্ড থেকেও নেতাদের চামচারা তাদের চাহিদামতো অর্থ নিয়ে তবে মাইক্রোবাস ছাড়ে। এসব স্থানে গড়ে উঠেছে বড় ধরনের সিন্ডিকেট। যা স্থানীয় এমপি ও রাজনীবিদরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
No comments:
Post a Comment