ফটোসাংবাদিক আলহাজ জহিরুল হকের ইন্তেকাল
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ : ১৬ জুন, ২০১৪
টানা ৪৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন স্বনামধন্য ফটো সাংবাদিক আলহাজ জহিরুল হক (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি স্ত্রী, ১ ছেলে, ২ মেয়ে, বহু স্বজন, অনুরাগী ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। রোববার সকাল ৬টা ৫৭ মিনিটে দিল্লির ইন্সটিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলুরিয়াল সায়েন্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে। এ সময় তার শরীর থেকে লাইফ সাপোর্টের যন্ত্রপাতি খুলে ফেলা হয়। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
আলহাজ জহিরুল হক হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত হলে ১৩ মে তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেখতে যান এবং খোঁজখবর নেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য পারিবারিক সিদ্ধান্তে তাকে ৫ জুন দিল্লির ইন্সটিটিউট অব লিভার অ্যান্ড বিলুরিয়াল সায়েন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসার প্রাথমিক পর্যায়ে তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও ৯ জুন থেকে কিডনি, লিভার ও ফুসফুস ক্রমেই নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তার হৃদযন্ত্রও খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই শুক্রবার থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়।
আলহাজ জহিরুল হকের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকবার্তায় তিনি মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। ন্যায়পরায়ণতা, ধর্মনিষ্ঠা ও বিনয়ী আচরণের জন্য সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের শ্রদ্ধেয় এবং সাংবাদিক সমাজের প্রিয় ‘জহির ভাই’য়ের মৃত্যুতে রাজধানীসহ সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক প্রকাশ করেন সাংবাদিকদের প্রতিটি সংগঠন।
জহিরুল হকের মরদেহ রোববার সকালে দিল্লির হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে নিয়ে গোসল দেয়া হয় ও কাফনের কাপড় পরানো হয়। এরপর সেখানে প্রথম নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম জানাজা শেষে তার মরদেহ দিল্লির এইমস হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়। আজ বিকাল ৪টায় মরদেহ জেট এয়ারলাইনসে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছবে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে লাশবাহী কফিন নিয়ে যাওয়া হবে মরহুমের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডের বাসায়। সেখানে দ্বিতীয় নামাজে জানাজা শেষে বাদ মাগরিব সহকর্মী ও সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে। সেখানে তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে মরহুমের নিজ বাড়ি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার নবীগঞ্জে। সেখানে শেষবারের মতো জানাজার পর পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : আলহাজ জহিরুল হকের জন্ম নারায়ণগঞ্জে। তিনি চাঁদপুরের ঐতিহ্যবাহী মতলব হাইস্কুল থেকে এসএসসি, তোলারাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন। ছাত্রকালেই তার ফটো সাংবাদিকতা শুরু। কর্মজীবনের শুরুতে ষাটের দশকে তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় যোগদান করেন। পরে বাংলাদেশ অবজারভার, বাংলার বাণী ও বাংলাদেশ টাইমসে ফটো সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বর্তমানে ভারতের কলকাতায় প্রকাশিত দৈনিক আজকালের বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধির দায়িত্ব ও ফটো সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
পেশাগত জীবনে সাফল্যের সঙ্গে তিনি কাজ করেন। পেশাগত প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব দেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাচিত কোষাধ্যক্ষসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে এবং ঐক্যবদ্ধ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ছিলেন বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বর্তমানে তিনি অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত নির্বাহী সদস্য পদে দায়িত্বরত ছিলেন।
সদালাপী পরোপকারী, দানশীল আলহাজ জহিরুল হক পেশাগত দায়িত্ব পালন পর্যায়ে ইউরোপ, আমেরিকা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। তিনি ৩৮ বার পবিত্র হজব্রত পালন করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে প্রতি বছর দৈনিক যুগান্তরসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ও টিভি চ্যানেলে হজের বিশেষ সংবাদ কভার করতেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন এবং সাংগঠনিক কর্তব্য হিসেবে জাতীয় প্রেস ক্লাব, সাংবাদিক ইউনিয়ন, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের উন্নয়নে তিনি সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন স্বীয় ব্যক্তি মাধুর্য দিয়ে। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার ঐতিহাসিক সাক্ষী ছিলেন। আবাহনী লিমিটেডের সহ-সভাপতি হিসেবেও কাজ করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, মন্ত্রী থেকে শুরু করে সবার কাছে যেমন সুপরিচিত ছিলেন, তেমনি খেলার মাঠেও ছিলেন সবার প্রিয় জহির ভাই।
বিভিন্ন সংগঠনের শোক : আলহাজ জহিরুল হকের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল এবং মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, অপর অংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ এবং মহাসচিব এমএ আজিজ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের সভাপতি আলতাফ মামুহদ এবং সাধারণ সম্পাদক কুদ্দুস আফ্রাদ, অপর অংশের সভাপতি আবদুল হাই শিকদার এবং সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রধানসহ বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিশেয়ন, জাতীয় প্রেস ক্লাব কর্মচারী ইউনিয়ন এবং আরও বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা শোক প্রকাশ করেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন সপ্তাহব্যাপী শোক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলাসহ বিভিন্ন সংগঠন তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছে।
No comments:
Post a Comment