Monday, June 16, 2014

বিদেশেও বিশাল সম্পদের মালিক শৈলেন

বিদেশেও বিশাল সম্পদের মালিক শৈলেন
আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল ব্যুরো
প্রকাশ : ১৬ জুন, ২০১৪

বাবা ছিলেন চা-সিগারেটের দোকানি। তার ছেলে শৈলেন এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। মাত্র ৪ বছর ১১ মাস ক্ষমতা সময়কালে কেবল দেশেই নয়, দেশের বাইরেও তিনি গড়ে তুলেছেন বিশাল বাড়ি আর ব্যবসা-বাণিজ্য। সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিঞার এপিএস থাকার সুবাদে শৈলেন বনে গেছেন বিশাল বিত্তশালী। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। আটক হয়ে জেলে আছেন। দুদকের নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, মাত্র সোয়া কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাটি দায়ের হলেও কমপক্ষে আরও প্রায় ১০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে তার। সেসবের সন্ধান চলছে এখন। এত অল্প সময়ের মধ্যে কি করে শৈলেন বিশাল অর্থ সম্পদের মালিক হলেন তা নিয়ে হচ্ছে আলোচনা। সাবেক মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা পটুয়াখালীই কেবল নয়, পুরো দক্ষিণেই এখন বিষয়টি নিয়ে চলছে তোলপাড়।
তার পুরো নাম সৌমেন্দ্র চন্দ লাল শৈলেন। বাবা গৌরাঙ্গ চন্দ্র চন্দ ছিলেন পটুয়াখালী শহরের চা দোকানি। পৌর শহরের আখড়াবাড়ি এলাকায় ছিল তার দোকান। আওয়ামী লীগ করলেও পটুয়াখালী শহরে খুব একটা পরিচিতি ছিল না শৈলেনের। তবে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া বেশ পছন্দ করতেন তাকে।
লেখাপড়ায় পরিশ্রমী শৈলেন এক সময় পাস করেন আইন বিদ্যা। নবম জাতীয় সংসদে শাহজাহান মিয়া প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর তাকে নিয়োগ করেন এপিএস হিসেবে। সেই সুযোগে নিজের ভাগ্য ঘুরিয়ে ফেলেন শৈলেন। ২০০৮-এর আগে যার আয়করের ফাইল পর্যন্ত ছিল না সেই তিনি বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, মূলত প্রতিমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করেই সব কিছু করেছেন শৈলেন। পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ব্যক্তিগত জীবনে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না শাহজাহান মিয়া। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলেন এই শৈলেন। তার মোবাইলে ফোন দিয়েই কথা বলতে হতো মন্ত্রীর সঙ্গে। এ সুযোগের পুরোটাই ব্যবহার করেন তিনি। মন্ত্রীর নির্দেশ বলে বিভিন্ন জায়গা থেকে আদায় করেন তার স্বার্থ। বিনিময়ে আয় করেন কোটি কোটি টাকা। দুদক সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এপিএস থাকাকালীন আয়-ব্যয় শেষে শৈলেনের মাত্র ৬ লাখ ৬০ হাজার ৪০৩ টাকা জমা থাকার কথা থাকলেও পটুয়াখালী শহরের জুবলী রোডে তার নির্মাণাধীন বাড়িতেই প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। আটতলা ফাউন্ডেশনে ওই বাড়ির ইতিমধ্যে চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষ হয়েছে। দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, ১ কোটি ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৬৩৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে তার বিরুদ্ধে গত ২ জুন মামলা দায়ের হয় ঢাকার রমনা থানায়। পরে ৯ জুন বেইলি রোডের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুদকের কাছে তার আরও প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য এসেছে বলে জানিয়েছে নির্ভরযোগ্য সূত্র। শৈলেন ঘনিষ্ঠ পটুয়াখালী আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, ক্ষমতার আমলে মন্ত্রীর চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর ছিল এই শৈলেন। তাকে এড়িয়ে প্রতিমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাটাও ছিল কঠিন। এই সুযোগে ইচ্ছেমতো সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। ঢাকা এবং পটুয়াখালীতে নামে-বেনামে রয়েছে তার বিপুল অর্থ সম্পত্তি। প্রতিবছর হজের সময় হজ এজেন্ট নিয়োগে কোটি কোটি টাকার দালালি করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ধর্ম মন্ত্রণালয়সহ পটুয়াখালী জেলার নানা নিয়োগ বাণিজ্যেও তিনি কামিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। ঢাকায় বেইলি রোড এবং গোপীবাগে রয়েছে তার দুটি আলিশান ফ্ল্যাট। পটুয়াখালী-মির্জাগঞ্জ সড়কের দু’পাশে রয়েছে অনেকগুলো ছোট ছোট প্লট। এক সময় পায়ে হেঁটে চলা শৈলেন এখন দামি একটি পাজেরো গাড়িরও মালিক। দেশের তুলনায় ভারতে শৈলেনের বেশি সম্পদ রয়েছে বলে জানিয়েছে তার এক ঘনিষ্ঠ সূত্র। ভারতে আছে তার এক বোন ও দুই ভাই। সেখানে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছেন শৈলেন। তার এক ভাই ছিলেন বারাসাতের সামান্য দোকান কর্মচারী। বাংলাদেশ থেকে শৈলেনের পাঠানো টাকায় তিনি এখন সেখানকার বিশাল বড় ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসার মূল মালিক এই শৈলেন। সেখানে বাড়িও করেছেন তিনি। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতে শৈলেনের থাকা সম্পদের অনুসন্ধানে এখান থেকে একজন কর্মকর্তার সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেই লক্ষ্যে বর্তমানে চলছে প্রক্রিয়া। এপিএস হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালে শৈলেনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তা হল রাজধানীর মিরপুর ও কালসী এলাকায় আইনুদ্দিন হায়দার ওয়াকফ এস্টেটের প্রায় ২২০ একর জমি লিজ দেয়া। ওই এস্টেটের মোতাওয়াল্লি আবুল কালাম আনসারীর সঙ্গে মিলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে কাঠাপ্রতি মাত্র দেড় লাখ টাকা জমা দেখিয়ে পুরো ২২০ একর জমি বিভিন্ন জনের হাতে তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ২০ একর জমি দেয়া হয় একটি সমিতির নামে। আর বাকি ২০০ একর নিয়ে নেয় নামে-বেনামের ১০টি ডেভেলপার ও হাউজিং কোম্পানি। এই একটি ক্ষেত্র থেকেই বেশ কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন শৈলেন। এছাড়া হজের সময় মেডিকেল সাপ্লাই, বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসার দান-অনুদান এবং মন্ত্রণালয়ের ঠিকাদারি খাতে নির্দিষ্ট অংকের পার্সেন্টিজ দিতে হতো শৈলেনকে। সরাসরি প্রতিমন্ত্রীর নাম উল্লেখ করে এসব টাকা নিতেন তিনি। পটুয়াখালীর আমদানিমুখী একটি মেশিনারিজ ব্যবসাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে টাকা খাটানোর গুঞ্জন রয়েছে তার সম্পর্কে। পটুয়াখালীর নানা সূত্র জানায়, কম করে হলেও এখন এক থেকে দেড়শ’ কোটি টাকার সম্পদের মালিক সাবেক প্রতিমন্ত্রীর এই এপিএস। এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্য শৈলেনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ কথা বলতে রাজি হননি। সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো জানায়, তিনিও এ ব্যাপারে কিছু বলতে রাজি নন। যার কর্মফল সেই ভোগ করবে। এক্ষেত্রে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর কিছুই বলার নেই।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/06/16/111670#sthash.0jPv3zkq.dpuf

No comments:

Post a Comment