Monday, June 16, 2014

আতংকের নগরী চট্টগ্রাম তিন বছরে খুন ৩০৭

আতংকের নগরী চট্টগ্রাম তিন বছরে খুন ৩০৭
নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ : ১৬ জুন, ২০১৪

খুন, গুম ও গুপ্তহত্যা বেড়ে যাওয়ায় আতংকিত দিন কাটছে এখন চট্টগ্রামবাসীর। নগরীতে গত সাড়ে তিন বছরে খুন হয়েছে ৩০৭ জন। ওই সময় ১০৬ জন অপহরণের অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে খুন হয়েছেন ৪৯ জন। অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে ১৪১টি। একই সময়ে ২৬ ব্যক্তি অপহরণের শিকার হয়েছেন। অপহৃত অধিকাংশ ব্যক্তির এখনও খোঁজ পাননি স্বজনরা। সাড়ে তিন বছরে নগরীর থানাগুলোতে বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৭টি। নগরীতে একের পর এক খুন-গুমের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ কিছুই করতে পারছে না। এতে আতংকিত সাধারণ মানুষ ভয়ে ঘর থেকে একা বের হতে সাহস পাচ্ছেন না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউআইটিএসের ছাত্র কায়সারুল ইসলাম নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর তার লাশ কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ধার করেছে সদরঘাট থানা পুলিশ। এক সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কায়সারের মৃত্যু রহস্য উদঘাটন করা যায়নি। এর দুদিন পর মঙ্গলবার দুপুরে পাহাড়তলী থানার সমুদ্র উপকূলীয় ঝাউতলা এলাকা থেকে সাইফুল ইসলাম নামের এক ব্যবসায়ীর মস্তকবিহীন লাশ উদ্ধার করলেও এখনও খণ্ডিত মস্তক উদ্ধার করতে পারেনি। কি কারণে ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছে তারও রহস্য বের করতে পারেনি পুলিশ। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ মিলছে না চকবাজার এলাকার সোনা ব্যবসায়ী দুলাল ধরের।
সিএমপি সূত্র জানান, নগরীতে গত সাড়ে তিন বছরে খুন হয়েছে ৩০৭ জন, নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৮২৭ জন, অপহরণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৬৬ জন নারী ও শিশু। ওই সময়ে নগরীর থানাগুলোতে অন্যান্য অভিযোগসহ মামলা দায়ের হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৭টি। এছাড়া চলতি বছরের গত ৫ মাসে খুন হয়েছে ৪৫ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ১৫, ফেব্র“য়ারিতে ৬, মার্চে ৬, এপ্রিলে ১২ ও মে মাসে ১০ জন। ওই ৫ মাসে অপহরণের ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে ৩১টি। নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ১৩২টি। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ২৮ নারী শিশু। পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সী লোকজন নিখোঁজের ঘটনায় নগরীর থানাগুলোতে প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫টি করে হারানো ডায়েরি করা হচ্ছে। নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার অধিকাংশের বছরের পর বছর ধরে সন্ধান মিলছে না। নিখোঁজ ও অপহরণের শিকার ব্যক্তিরা এখনও বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন তাও বলতে পারছেন না। অন্যদিকে আনজুমানে মফিদুল ইসলাম নগরীতে পাঁচ মাসে অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার করেছে ১৪১টি। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৫টি, ফেব্র“য়ারিতে ২৯টি, মার্চে ২৮টি, এপ্রিলে ২০টি ও ২১ মে পর্যন্ত ১৮টি। নগরীতে প্রতি সপ্তাহে একটি কিংবা দুটি করে ঘটছে অপহরণ, খুন ও গুপ্তহত্যার ঘটনা। নগরীতে গত ক’মাসে একাধিক চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনটি জোড়া খুনের ঘটনা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। সংঘটিত চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনার মধ্যে গত ২১ ফেব্র“য়ারি কোতোয়ালি থানাধীন ফিরিঙ্গি বাজার এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অজ্ঞাত এক যুবককে। এখন পর্যন্ত নিহত যুবকের পরিচয় মেলেনি। বের করা যায়নি হত্যারহস্য। গত ২৫ মার্চ আগ্রাবাদ এলাকায় বাসায় ঢুকে খুন করা হয় মা রিজিয়া খাতুন ও মেয়ে নাজনীন নিশাতকে। এ ঘটনায় পুলিশ দু’জনকে গ্রেফতার করলেও আর কারা জড়িত রয়েছে এ ব্যাপারে পুলিশ কোনো ক্লু বের করতে পারেনি। গত ৬ মার্চ পাহাড়তলী কৈবল্যধামের নিজ বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় রাজীব শীল ও তার স্ত্রী সঙ্গীতা শীলের লাশ। রাজীব চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত একটি স্কুলের শিক্ষক। সঙ্গীতা খাগড়াছড়ির খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ছিলেন। পরিবারের দাবি ওই দম্পতিকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ১৬ মার্চ নগরীর ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনের সেপটিক ট্যাংক থেকে দুই বন্ধু এমইএস কলেজছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই হত্যাকাণ্ডেরও কোনো রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ। সংঘটিত অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পুলিশ ব্যর্থ হওয়ায় তাদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না। নগরীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন মিলছে বেওয়ারিশ লাশ।
এ প্রসঙ্গে মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, সরকারের বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যদি ভাড়ায় গুম-খুনে জড়িয়ে পড়ে তাহলে গুম-খুন কখনও বন্ধ হবে না। বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা যাতে এসব অপরাধে সম্পৃক্ত হতে না পারে সে জন্য বাহিনীতে সংস্কার আনা জরুরি। আর সরকার যদি সংস্কারে আগ্রহী না হয় তাহলে বিশেষ ফোর্সের (র‌্যাব) সংঘটিত দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। সংস্কারের জন্য সরকার চাইলে বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত দক্ষ কিছু ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করতে পারে। কমিশন থেকে যেসব সুপারিশ আসবে সরকার চাইলে তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, গুম-হত্যা জঘন্য অপরাধ। সঠিক তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার মাধ্যমে গুম-হত্যা দূর করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং বিচার হলে এ ধরনের অপরাধ অবশ্যই কমে আসত। চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রশিদ বলেন, রাজনীতিতে প্রতিহিংসা বেড়ে যাওয়ায় খুন-গুমের মতো ঘটনা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি আইনশৃংখলা বাহিনীর কিছু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে এসব অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার খবরও আমরা শুনছি। আইনশৃংখলা বাহিনীর যেসব সদস্য শৃংখলা ভঙ্গ করে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার। আর যেসব অপরাধ ভাড়াটে সন্ত্রাসী করে থাকে সেসব খুন-গুম বন্ধ করতে আইনশৃংখলা বাহিনীকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।
সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার জানান, সংঘটিত অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। অপহরণের সঙ্গে জড়িত অনেককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। আর যেসব অজ্ঞাত লাশ পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো অন্যস্থান থেকে এনে ফেলে রাখা হচ্ছে।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/06/16/111668#sthash.gvWKNZKE.dpuf

No comments:

Post a Comment