Tuesday, June 3, 2014

আইন কর্তাদের কারণে ১৮৯ হত্যার বিচার বন্ধ

আইন কর্তাদের কারণে ১৮৯ হত্যার বিচার বন্ধ
ওবায়েদ অংশুমান
প্রকাশ : ০৪ জুন, ২০১৪
রাজধানীর হাজারীবাগের একটি বাড়ির মালিকানা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব আফজাল হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে আসামি হুমায়ুন কবিরের গোলমাল চলছিল। এর আগে সচিব আফজালকে ওই বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করে কবির। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। পরে সচিবকে খুনের পরিকল্পনা করে কবির ও তার আত্মীয়স্বজন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০০১ সালের ১৩ আগস্ট ফকিরাপুল হোটেল মুনের সামনে সন্ধ্যায় তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।
সিনিয়র সহকারী সচিব আফজাল হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে এভাবেই হত্যার বিবরণ দেয়া হয়েছে। মামলাটি ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে আলোচিত এ হত্যা মামলার বিচারকাজ ১০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এ হত্যা মামলার মতো ১৮৯টি হত্যা মামলার বিচার পুরোপুরি বন্ধ। এসব হত্যার বিচার কবে শেষ হবে বা আদৌ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে বিচার সংশ্লিষ্টদের। মামলাগুলো চালু করতে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস ও ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয় কখনও পদক্ষেপ নেয়নি। কত মামলার বিচার বন্ধ তাও জানেন না রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম ও ঢাকা মহানগরের প্রধান আইন কর্মকর্তা (পিপি) আবদুল্লাহ আবু। ঢাকার ৩১টি নিু আদালতে বিচারাধীন মামলার নথি পর্যালোচনা, আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
এ প্রসঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সোমবার টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, আমি নিজেই জানি না, স্থগিতাদেশের কারণে কত মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। কারণ মামলাগুলোর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে ঢাকা মহানগরের কোনো পিপি আমার কাছে আসেননি। তিনি আরও বলেন, হত্যা মামলার বিচার বন্ধের জন্য আমি নিজেও দায়ী। শুধু আমি না, ঢাকা মহানগরের পিপিরাও সমানভাবে দায়ী। অব্যবস্থাপনার জন্য এসব হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। আমরা কেউ এর দায়ভার এড়াতে পারব না।
অপরদিকে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু যুগান্তরকে বলেন, কোন আদালতে এসব হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ তা আমার জানা নেই। তবে, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের দায়িত্বও নয়। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্ব, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা। তিনি আরও বলেন, বন্ধ থাকা হত্যা মামলার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে সরবরাহ করব। তবে উদ্যোগ নিতে হবে, অ্যাটর্নি জেনারেলকে। বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার ও সেরেস্তাদারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কোনো মামলার বিচারকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশই হল স্থগিতাদেশ। হাইকোর্ট ও সুপ্রিমকোর্ট এ আদেশ দিয়ে থাকেন। স্থগিতাদেশ দেয়ার পর ওই আদালতের পিপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। কিন্তু কোনো পিপি এ কাজটি করেন না, বরং আসামি পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হন অনেক পিপি, এমন অভিযোগও আছে।
দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের যে কোনো মামলা ১৩৫ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান আছে সংশ্লিষ্ট আইনে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থগিতাদেশ থাকায় ঢাকার চারটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৩৪টি হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে বছরের পর বছর। প্রথম দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ১৪, দ্বিতীয়টিতে ১৩, তৃতীয়টিতে ৫ ও চতুর্থটিতে ২টি হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও ঢাকার পাঁচটি অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ৫৫, ঢাকার ১০টি বিশেষ জজ আদালতে ৪৮, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ ও ঢাকার নয়টি অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে ৪৩ এবং ঢাকার পরিবেশ আদালতে ৯টি হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন সাংবাদিক মনিরুল আলম হত্যা মামলা। ১৯৭৫ সালে হাতিরঝিলে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয়। এ মামলার বাদী মোহাম্মদ আলী যুগান্তরকে বলেন, ২০০৪ সালে আসামিরা হাইকোর্ট থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আসে। সেই থেকে বিচারকাজ বন্ধ। পিপির কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছি, স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করতে। কেউ কথা রাখেনি।
উত্তরার নবম শ্রেণীর ছাত্রী উম্মে দদী তন্বী হত্যা মামলার নথি পর্যালোচনা করে জানা যায়, তন্বী তার মায়ের সঙ্গে উত্তরা থানাধীন ৭ নম্বর সেক্টরের ২০ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাসায় বসবাস করত। ২০০২ সালের ৪ আগস্ট তন্বীর সৎবাবা সালাহউদ্দিন মাহমুদ জাহিদ তার মা কাজী ফাবিয়া আক্তারকে গুলি করেন। গুলির শব্দ শুনে মায়ের কাছে আসামাত্র জাহিদ তন্বীর বুকে গুলি করে। এরপর তন্বীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। তন্বীর সৎবাবা জাহিদের বিরুদ্ধে উত্তরা থানা পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৩ সালের ৮ এপ্রিল তৎকালীন ঢাকার মহানগর দায়রা জজ জাহিদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করে। পরে মামলাটি বিচারের জন্য এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে আসামি জাহিদের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের ৬ ফেব্র“য়াটি হাইকোর্ট মামলার বিচারকাজ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন।
আলোচিত যেসব হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ : ধানমণ্ডির সজল হত্যা মামলা, মামলা নম্বর ২৭/০৩, মালিবাগ মোড়ের মিছিলে রশিদ, জসিম ও নাজমা বেগম হত্যা মামলা, মামলার নম্বর ১/০৩ ও শিশু মিশেল হত্যা মামলা, মামলার নম্বর ৪/০৪ বিচারাধীন। ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার সাইদুর রহমান নিউটন হত্যা মামলা। মামলাটি ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। মামলার নম্বর ২৮/০৪। এ ছাড়া একই আদালতে ঢাকার ওয়ার্ড কমিশনার বিনা হত্যা মামলা, মামলা নম্বর ৪/০৬। এছাড়াও ধানমণ্ডি ক্লাবের সভাপতি খায়রুল আনোয়ার পিয়ার হত্যা মামলা, যার নম্বর ১২/০৫, যা এক নম্বর আদালতে বিচারাধীন। ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে উত্তরার কমিশনার শাহাদাত হোসেন হত্যা মামলা, মামলা নম্বর ২৮/০৪ ও হাজী মিজানুর রহমান মেম্বার হত্যা মামলা, মামলা নম্বর ৩/০৫। ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বিচারকাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার দুই নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ৩৫/০৩, ৩৬/০৩, ৩৭/০৩, ০৩/০৪, ৪/০৬, ৭/০৬, ৩/০৮ ও ২/১০ মামলার বিচারকাজ বন্ধ। অপরদিকে ঢাকার এক নম্বরে ৩১/০৩, ৩২/০৩, ৩৯/০৩, ৫/০৬, ১/০৬, ১৭/০৬ ও ৪/০৮ হত্যা মামলার বিচারকাজ পুরোপুরি বন্ধ।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/06/04/107364#sthash.6Ab6FXAX.dpuf

No comments:

Post a Comment