সমাজ সংস্কৃতিতে নারী নির্মাণ ও আধুনিক নাৎসিবাদী সৌন্দর্য্যবোধ
তারিখ: ৩১ মে ২০১৪
প্রাচীন ভারতে বাৎস্যায়নের কামসূত্রে নারীকে তিন ক্যাটাগরিতে বিভক্ত করা হয়েছিল। মৃগী, বড়রা ও হস্তিনি। পরবর্তিতে, কাশ্মিরের পন্ডিত কোক, বাৎস্যায়নের কামসূত্রেরআলোকে তার ‘রতিরহস্য’ গ্রন্থে নারীকে চার ভাগে বিভক্ত করেন, সাথে একটা সাংস্কৃতিক মানদন্ড যুক্ত করে। কল্যাণমল্ল তার ‘অন্তরঙ্গ’ পুস্তকে ‘রতিরহস্যকে’ই ভিত্তি ধরে তাকেই উপজীব্য করেন। নারী বিভাজনের এই যে ধারা, সেটা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় বৈবাহিক প্রশ্নে নারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজ করেছে দীর্ঘ সময় ধরে। যে বিভাজনের নামকরণ আমরা কম-বেশি অনেকেই জানি। পদ্মিনী,চিত্রিনী, শঙ্খনি ও হস্তিনী। নারী বিভাজনের এই ক্যাটাগরিতে ভারতীয় সমাজের নারীরা চার ভাগে বিভিক্ত হয়ে যায় সেই প্রাচীন কাল থেকে। যারা চর্চা হয়েছে শত শত বছর ধরে। ভারতীয় সমাজে নারী বিভাজনের এই তরিকার সাথে পুরুষের লিঙ্গের পরিমাপসহ নারীর দেহাঙ্গের প্রকারণ, তাদের মানসিকতা, চাল-চলন-হাবভাবকে যুক্ত করা হয়েছিল। যা এক পর্যায়ে সমাজের অনুশাসন হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। এবং গ্রামীন সমাজে বিকৃতি আকারে ছড়িয়ে পড়ে।
খুব সাদামাটাভাবে যদি বিষয়টি বুঝতে চাই, তাহলে সমাজে তার চর্চার ধরণ অনুসন্ধান করলে একটা চিত্র পাওয়া সম্ভব। যেমন: নারী দীর্ঘাঙ্গী হলে, তার ভাব প্রকাশে চঞ্চলতা প্রকাশ পেলে, কিংবা মুখোরা হলে - সেই নারী গ্রামীন ভাষায় ‘খাড়ানি’, ‘থাড়ানি’, ‘হস্তিনি’, ‘মাগি’ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আজও গ্রামীন সামাজে এগুলি খুবই সাধারন ভাষা। কিন্তু এই ভাষা পাঠের মধ্যেই নারীকে নির্মাণ ও নিয়ন্ত্রনের যাবতীয় ব্যবস্থা ছিল ও আছে। এমন কি একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এগুলি পারিবারিক ‘ভ্যালুজ’ হিসাবে ক্রিয়া করেছে। যে ‘ভ্যালুজ’-কে ভিত্তি করে গ্রামীণ সমাজে প্রাক বৈবাহিক অনুষ্ঠানের সময় বাড়ির উঠানে পানি ঢেলে তার উপরে নারীকে হাটানো হত। নারীর হাঁটাচলা,পদক্ষেপ,পায়ের পাতা ফেলার শব্দের ভিত্তিতে তার চরিত্র অনুসন্ধান-অনুমান করে নেওয়া হত। আর অভিজ্ঞজনেরা পায়ের কিছুটা কাপড় উঠিয়ে নারীর পায়ের গোছা পরীক্ষা করতেন। যে পরীক্ষার সাথে স্বামী নামের পুরুষটির বাঁচা-মরার প্রশ্নটি যুক্ত ছিল। কোনো নারীর পায়ের গোছা মোটা হলে তাকে সোজা ভাষায় ‘ভাতার খাগি’ হিসাবেই চিহ্নিত করার রেওয়াজ ছিল। নারীর দেহজ পশমের সাথে দেহজ কামনার পরিমাপ যুক্ত ছিল। মুখের ‘হা’ পরিমাপের সাথে আনুমানিক ‘যৌনাঙ্গের’ মাপ নির্ণয়ের একটা রেওয়াজ ছিল। খাবার গ্রহণের প্রক্রিয়ার সাথে শিষ্টাচারের পরিমাপ করা হত। হাতের নরম গড়নের সাথেকমনীয়তা-নমনীয়তা;এভাবে একটা দীর্ঘ তালিকা এখনে উত্থাপন করা সম্ভব। তবে আজকের দিনে তার খুব একটা প্রয়োজনীয়তা নাই। কারন আমরা এখন সবাই আধুনিক যুগের বাসিন্দা। গ্রামীন সমাজেও তার প্রভাব রয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমানের আধুনিক সমাজ কি নারীর সৌন্দর্য্য নির্মাণ থেকে মুক্ত?বিজ্ঞজনেরা বলবেন, বিষয়টি প্রকৃত অর্থে এত সহজ সরল নয়। তারা এই প্রশ্নে প্রথমেই যে মানদণ্ডটি হাজির করেন সেটা হলো বর্ণবাদ নামের একটা ক্যাটাগরি। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে, এটা একটা সীমাবদ্ধ ক্যাটাগরি। যা দিয়ে প্রকৃত বাস্তবতা উন্মোচন হয় না। বোঝাও যায় না। বরং নাৎসিজম বা নাৎসিবাদ দিয়ে বিষয়টিকে আরো ভালভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব।
ইতিহাসে হিটলার নামের এক অধ্যায় রয়েছে। যাকে আমরা দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতার আলোকে বিচার করি। হিটলারের শাসনামলে তার দেশে ‘মার্সি কিলিং’ নামে এক চিকিৎসা বিজ্ঞান গড়ে তোলা হয়েছিল। যা ‘শারীরিক’ খুঁতের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ ঘোষনা করে। হিটলার এই তরিকা অবশ্য ধার করেছিল প্রাচীন গ্রিক সমাজ থেকে। কিন্তু তার মার্সি কিলিং এর বেশ কিছু ব্যতিক্রম ছিল। কিন্তু তার দর্শন আজ বিশ্বজনীন।
হিটলারের সময়ে ‘স্বাস্থ্যবান’ ও ‘নিখুঁত’ প্রত্যঙ্গের অধিকারী হওয়াটা জার্মানের জাতীয় কর্তব্য বলেই গণ্য হত। যে মানদণ্ড থেকে খাদ্যের পরিমানই শুধু নয় খাদ্য সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হত। ফলে হিটলারের সমাজে যারা অসুস্থ্য এবং দুর্বল,তাদের পিছনে খাদ্য ব্যয়কে জাতীয় সম্পদের অপচয় ও অনুৎপাদক কাজ হিসাবেইবিবেচনা করা হয়েছে। যা পরবর্তিতে খুঁতহীন শরীরকেন্দ্রিক এক সৌন্দর্য্য চর্চা হয়ে দাঁড়ায়। আর নারী এই দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে। তৎকালীন এই নাৎসি দর্শন থেকে খুতহীন দেহ নির্মাণে ‘অসুন্দর’, ‘অনাকাঙ্খিত’ নারীকে পুনঃনির্মাণের নামে ইউজেনিক্স নামের বিজ্ঞানের একটা শাখা গড়ে ওঠে জার্মানে। যা নারীকে কৃশ হওয়ার, তন্বী হওয়ার,শরীর থেকে বাড়তি মেদ ঝরিয়ে ফেলার জন্য ‘ফ্যাটলেস ডায়েট’ তৈরি করে তথাকথিত বিজ্ঞানকে ভিত্তি করে। যা সৌন্দর্য চর্চার দার্শনিকতার আলোকে জার্মান নারিদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়। সহজ ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে বিষয়টি ছিল নারীর প্রাণশক্তি ঝরিয়ে ফেলে ‘সেক্সযন্ত্র’ হিসাবে গড়ে তোলা এক প্রক্রিয়া। বিষয়টি শুধু এখানেই থেমে ছিল না। হিটলারের সময়ে শারীরিক প্রতিবন্ধি শিশু জন্মালে ডাক্তারের ভাষায় তাকে ওই সমাজের জন্য ‘আনফিট’ হিসাবে গণ্য করা হত। তাদের শরীরে বিষ ভর্তি সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। সরকারি ভাষায় তার একটা মধুর নামকরণ ছিল ‘Put to sleep’, অর্থাৎ মৃত্যু নয়, ঘুম পাড়িয়ে দেয়া। হিটলারের সময় নারীর দেহ ঘিরে ভয়ঙ্কর একটা ব্যবচ্ছেদ শিল্প গড়ে উঠেছিল। নারীর ‘অঙ্গ সৌষ্ঠব’, ‘লালিত্য বর্ধণ’, ‘নিতম্বের ও স্তনের’ সৌষ্ঠব,পুনঃনির্মানই ছিল এ শিল্পের কাজ-কারবার। অসংখ্য নারী তখন গিনিপিগের মত ব্যবহার হয়েছে জার্মানে। কিন্তু প্রশ্ন হলো বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় সৌন্দর্য্য চর্চা আসলে কোন দার্শনিকতার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে? সেটা কি মানদন্ড হিসাবে নাৎসিবাদকেই ধারণ করে না? বর্তমানে নারী শরীরের ঠিক কোন কোন প্রত্যঙ্গ যৌন সম্ভোগের জন্য যথেষ্ট উত্তেজক নয়, সুন্দর নয়, তা বতলে দিচ্ছে আমাদের নন্দনতত্ত্ব। যার আলোকে নারীর মেদ, মাংস, মজ্জা, অস্থিকে কাটা-ছেড়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞান কি গড়ে ওঠেনি?সেটা কি হিটলারের নাৎসিবাকেই ধারণ করে না? আর্থিকভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন নারীরা কি তার নিজস্বতা হারিয়ে Photographic Reimagingপ্রযুক্তির পণ্য হয়ে উঠছে না? তার শিক্ষা,দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে শারীরিক গড়নটা বাধ্যতামূলক হয়ে যাচ্ছে না? আর যদি সেটাই বাস্তবতা হয়ে থাকে, তাহলে নারীর অতিরিক্ত সৌন্দর্য্যই কী তার শিক্ষা, দীক্ষা,মেধার সাথে যুক্ত হয়েই পুরুষের সমকক্ষ করে তুলছে না?
বর্তমানের বিশ্বসভ্যতা একটা হীনম্যতাবোধ নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে তার শরীরের বিরুদ্ধে, তার নিজস্বতার বিরুদ্ধে আত্মঘাতী করে তুলেছে। নারীর ওপরে আরোপিত এই সৌন্দর্য্যের আলোকে সমাজ তাকে প্রতিনিয়ত নির্মাণ করছে। ভোগ্যপণ্যের মত কৃত্রিম চাহিদা তৈরি করে, সেটাই গোটা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যার সাথে সম্পর্কিত হয়ে একটা সুক্ষ্ম ধারার কসমেটিক সার্জারির বাজার এখন গোটা বিশ্বজুড়েই বিস্তৃত। এর ফলে এখন এক আমেরিকাতেই চামড়া সফেদ করার ক্রিম ইন্ডাস্ট্রির বৎসরিক মুনাফা হলো ১৫০ মিলিয়ন ডলার। শুধু মাত্র তন্বী নারী তৈরির ডায়েট ইন্ডাস্ট্রি, ফ্যাটলেস খাদ্যে ব্যবসার সুবাদে মুনাফা করে বছরে ৩৫ মিলিয়ন ডলার। ব্রেস্ট ইমপ্লান্ট ইন্ডাস্টির মুনাফা বছরে ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর বাইরেটিকালো নাক, শক্ত চোয়াল, নীল এবং বাদামী চোখের কারবার তো রয়েছে। এ হিসাবটা শুধুমাত্র আমেরিকার বাজারের। আমেরিকাতে Higher mans income, the low his wife’s weightকথাটি অনেক আগে থেকেই প্রবাদ বাক্যের মত দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু তাই নয় কোকড়া চুল সোজা করার হিড়িকের একটা বিশাল বাজার ওই দেশে রয়েছে। এখন পৃথিবীর প্রতিটি দেশের বিত্তবান নারীরা কি নাৎসিবাদ নির্মিত ওই বাজারের গ্রাহক নন? আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে নারী বিভাজনের ক্যাটাগরিতে সবচেয়ে সুন্দর বলে বিবেচিত হত পদ্মিনী ক্যাটাগরির নারীরা। তারা আজও আলোচিত এই মনোভঙ্গির বাইরে নন। ফলে সৌন্দর্য্য চর্চার নামে আজ নাৎসিবাদেরই জয়জয়কার চারিদিকে।।
২৮ মে, ২০১৪ সাল, ঢাকা।
No comments:
Post a Comment