বামপন্থী নামধারীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব
তারিখ: ০৯ নভে ২০১৩
ট্যাগসমূহ: আনু মুহাম্মদ, আবিদুল ইসলাম, কমিউনিজম, কমিউনিস্ট রাজনীতি, ক্রুশ্চেভ, খালেকুজ্জামান, ডুমা নির্বাচন, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বামপন্থী, বাসদ, বিপ্লবী রাজনীতি, মার্ক্সবাদ,মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, লিবারেল ডেমোক্রেট, লেজুরবৃত্তি, লেনিনবাদ,লেফট এন্ড লিবারেল, সংশোধনবাদ, সর্বহারা শ্রেণী, সিপিবি, সুবিধাবাদ
লিখেছেন: আবিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের বামপন্থী, এমনকি কমিউনিস্ট নামে পরিচিত অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অবস্থানগত দেউলিয়াত্ব এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা নিয়ে কথাবার্তা বলাটাও খুব যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার। এই অবস্থানগত দেউলিয়াত্ব তাদের তাত্ত্বিক দেউলিয়াপনা থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। বর্তমানে এই চরম দেউলিয়াত্বপ্রাপ্ত রাজনীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের দায়িত্ব নিয়েছে সিপিবি-বাসদ ঐক্যজোট। তারা যে সমস্ত কাজকারবার করে বেড়াচ্ছে তা যে কেবল তাদেরকে সচেতন মহলের কাছে হাসির পাত্রে পরিণত করেছে তা-ই নয়, এসব দেখেশুনে দেশে বিপ্লবী পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষী লোকজনের মনে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা তাদের এই সমস্ত কর্মকাণ্ড বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলোর বিকাশের পথে একরকম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এই বিষয়গুলো নিয়ে আগেও অনেকবার কথাবার্তা হয়েছে। এখনো সেই সমস্ত আলোচনা চালু রয়েছে। ১৯৯৯ সালে আনু মুহাম্মদ ‘সিপিবির রাজনীতি ও লেজুড়বাদ’শীর্ষক এক নিবন্ধ রচনা করে সিপিবির সংশোধনবাদী রাজনীতির গোড়া বেশ ভালোভাবেই উন্মোচন করেছিলেন। এরপর বুড়িগঙ্গা নদী শুকিয়ে মরে যাওয়ার কারণে সেখানে বেশি জল গড়াতে না পারলেও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত সিপিবি‘র অধঃপতন আরো অনেকদূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছে। এখন তাদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। বাসদ তাদের বর্তমান অবস্থানে উপনীত হওয়ার প্রস্তুতি যে আগেই সম্পন্ন করেছিল তার একটা বহিঃপ্রকাশ ছিল গত বছরের নভেম্বরে ভ্যানগার্ডে প্রকাশিত “বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট কাটাতে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রামে এগিয়ে আসুন” শীর্ষক একটি লেখা। ঐ লেখায় তারা ‘লেফট অ্যান্ড লিবারেল’ নামক যে তত্ত্ব হাজির করেছিলেন তার মাধ্যমে এ দেশে সাম্রাজ্যবাদের চিহ্নিত এজেন্টদের ‘উদারপন্থী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের সাথে ঐক্য গড়ার এক অজুহাত দাঁড়া করানো হয়েছিল। বর্তমানে তাদের কর্মকাণ্ডও সেই পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছে।
একটা দল যখন নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে ঘোষণা করে তখন তাদের প্রধান কর্তব্য কী দাঁড়ায়? বিদ্যমান বুর্জোয়া একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই-সংগ্রাম পরিচালনা করা, ঐ রাষ্ট্রের উচ্ছেদ সাধন করে তাকে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের রাষ্ট্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা - নাকি সেই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার জন্য তটস্থ থাকা, রাষ্ট্রের মালিক-মোক্তারদের সাথে সমঝোতার জন্য দেনদরবার করা? দ্বিতীয়োক্ত কাজের কুশীলবরা কি নিজেদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী হিসেবে দাবি করতে পারেন? এদেরকে শাসক শ্রেণীর বাম-লেজুড় ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?বাংলাদেশের এই ‘কমিউনিস্ট‘রা এখন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের যাবতীয় তৎপরতা কেন্দ্রীভূত করেছে। নির্বাচনকে ঘিরে শাসক গোষ্ঠীর দুই জোট বর্তমানে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে এবং দেশে এক সংঘর্ষজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে দেশে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের তাবেদার যেকোনো একটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজেদের শোষণ প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্ন রাখাই সাম্রাজ্যবাদী, বিশেষত মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের প্রধান লক্ষ্য। এই বিষয়ে ঐক্যমত্যে আসার জন্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত ভারতে গিয়ে তাদের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে সাক্ষাত করেছেন।
দেখা যাচ্ছে, সাম্রাজ্যবাদীদের হয়ে এই কর্ম সম্পাদনের জন্যই যেন সিপিবি-বাসদ এখন মাঠে নেমেছে! তাদের নিজেদেরই ঘোষিত ‘বাম-বিকল্প গড়ার কর্মসূচি’ শিকেয় উঠিয়ে তারা শেখ হাসিনাকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করা এবং বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার হিতোপদেশ প্রদানের জন্য তাদের সাথে বৈঠকের নামে দেনদরবার করছে। বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে জনগণ শাসক শ্রেণীর এই প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এবং তাদের জোটের হাত থেকে মুক্তি চান। তারা বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু সেটি হলেও তাদের সামনে যথার্থ বিকল্পের অভাবেই তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই দুই দল ও তাদের নেতৃত্বাধীন জোটের একটিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসতে বাধ্য হন। কিন্তু এই নির্বাচনকে ঘিরে তাদের জন্য উৎফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ বরাদ্দ নেই।
বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থার মাধ্যমে যে এই দুষ্টচক্রের মধ্যে পরিবর্তন সাধনের কোনো সম্ভাবনা নেই সেটা বিপ্লবী কর্মীদের কাছে স্পষ্ট। তাহলে কীসের জন্য বাসদ-সিপিবি’র এই দেনদরবার? সংঘর্ষের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কোনো ‘অগণতান্ত্রিক’ শক্তি যাতে ক্ষমতায় চড়ে বসতে না পারে সেটিই হলো তাদের কর্মকাণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাহলে বেনামে যে সামরিক সরকার গত নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় আরোহণ করেছিল তেমন কোনো কিছু ভবিষ্যতের জন্য ঠেকানোই এই বামপন্থীদের লক্ষ্য? কিন্তু কেন সেই বেনামী সামরিক সরকার সে সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল সে বিষয়ে কি কোনো বিশ্লেষণ তাদের আছে? গতবার নির্বাচনকে ঘিরে যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল এবং বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী তাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নিরসনের পথ না পেয়ে যেভাবে বেসামাল হয়ে পড়েছিল তা থেকে তাদের নিষ্কৃতি দেয়ার জন্য এবং কিছুটা সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ দেয়ার জন্যই কি তাদের আবির্ভাব হয় নি? এ কথা কে অস্বীকার করবে যে শেখ হাসিনা সেই মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং তাকে নিজেদের আন্দোলনের ফল হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন?
কিন্তু নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্থিতির পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও সিপিবি-বাসদ মার্কা বামপন্থীরা নির্বাচন-অন্তঃপ্রাণ। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে তারা রাশিয়ায় জারের শাসনামলে লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণের কথা বলে থাকেন। বলশেভিক পার্টির বয়কট এবং তাদের অব্যাহত প্রচারণার কারণে জারের পদসেবায় নিয়োজিত ১৯০৫ সালের বুলিগিন ডুমা অকার্যকর হয়েছিল এবং জার সেই ডুমা ভেঙে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তী ডুমাও বলশেভিক পার্টি বয়কট করলেও তৃতীয় ডুমার নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং সেখানে তাদের পাঁচজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ডুমায় এই বলশেভিক প্রতিনিধিবৃন্দের কাজ ছিল অব্যাহত তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জার-নিয়ন্ত্রিত সরকারের গণবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের স্বরূপ উন্মোচন করে জনগণের সামনে তা তুলে ধরা। নিবার্চনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা লেনিনের কখনোই ছিল না। কারণটা বোঝাও সহজ। বলশেভিক পার্টির লক্ষ্য ছিল বিদ্যমান শোষণ শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে উপড়ে ফেলে তাকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব দ্বারা প্রতিস্থাপন করা। শোষক সামন্ত-বুর্জোয়া শ্রেণী তাদের স্বার্থের পাহারাদার রাষ্ট্রের উচ্ছেদ কখনোই মেনে নেবে না। একে রক্ষার জন্য তারা প্রথমে প্রয়োগ করবে নিজেদের রচিত আইন-কানুন, প্রচারযন্ত্র,বিচারালয়কে। এতে ব্যর্থ হলে শেষতক আশ্রয় নেবে বন্দুক, কামান, সশস্ত্র সেনাবাহিনীর। গুলি-বন্দুক-কামানের হিংস্র থাবার সামনে শান্তির অমিয় বাণী যে কোনো কাজে দিতে পারে না সে কথা যেকোনো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই বোঝে।
বর্তমান নির্বাচনী পরিস্থিতিতে নির্বাচনকে ঘিরে অতি তৎপর বামপন্থীদের জয় লাভ করার কোনো সম্ভাবনা তো নেই-ই, একটি আসনও লাভের আশা নেই। শুধু তাই নয়,যতোগুলো আসনে তারা নিজেদের প্রার্থী দাঁড় করাবে তার সব কয়টি আসনেই তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। সুতরাং সংসদে গিয়ে নিজেদের বক্তব্য পেশ করার কোনো সুযোগ তাদের নেই। ১৯০৫ সালের বলশেভিক পার্টির সাথে তার সাংগঠনিক অবস্থাও কোনোভাবেই তুলনীয় হতে পারে না। তারপরও সংসদীয় রাজনীতির মোহ তাদের কাটছে না। এই মোহে আবিষ্ট রেখেই তারা তাদের তরুণ কর্মীদেরকেও ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে এবং তাদের কর্মোদ্যমের অপব্যয় ঘটাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো এই কমিউনিস্ট ও সমাজতন্ত্রী নামধারী বামপন্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করতে চায় কেন? লেনিনের বলশেভিক পার্টির মতো নির্বাচন ও ডুমাকে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের রণনৈতিক মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা নয়, তাদের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থানই নির্বাচনকেন্দ্রিক। তাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ব্যতীত তারা নিজেদের বিপন্ন বোধ করে, এই কাজের জন্য নিজেদের ঘোষিত কর্মসূচি স্থগিত রাখতেও তাদের সমস্যা নেই।
তাদের রাজনৈতিক অবস্থান যে এখন চরম দেউলিয়াত্বের শিকার তার প্রমাণ দেখা গেল গতকাল ০৮ নভেম্বর সোহরাওয়াদী উদ্যানে সিপিবি-বাসদের জনসভায়। ঐ সভায় বাসদের ‘লেফট অ্যান্ড লিবারেল’ পলিসি অনুযায়ী আওয়ামী লীগের পাত্রে জল খাওয়া মাহমুদুর রহমান মান্না’র নাগরিক ঐক্য এবং ড. কামালের গণফোরামও উপস্থিত ছিল(সম্ভব হলে তারা হয়তো ড. ইউনূসকেও সঙ্গে নিতেন! হাজার হলেও ‘লিবারেল’ তো!)। সমাবেশ থেকে ঘোষণা দিয়ে তারা শাসক গোষ্ঠীর দুই জোটকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন! এর মধ্যে বিএনপিকে আগামি রবি-মঙ্গলবার আহূত তিনদিনের হরতাল প্রত্যাহার এবং আওয়ামী লীগকে সংলাপে বসার জন্য তারা অনেক হম্বি-তম্বি করেছেন। মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, “আপনারা যদি সমাধান না করেন তাহলে বিশিষ্ট নাগরিকদের নিয়ে, সিপিবি-বাসদ-গণফোরাম-নাগরিক ঐক্য লাখো মানুষকে নিয়ে আমরা ঢাকার রাস্তায় বসে যাব। আমরা বলব, হয় তোমরা সমস্যার সমাধান করো,নয়তো আমাদের কথা শোনো।”
বিশ্বস্ত সূত্র হতে খবর নিয়ে জানা গেছে, তাদের এই ‘ধমকি’তে আওয়ামী লীগ-বিএনপির অন্দরমহলে প্রবল ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে!!
সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন,“যদি নির্বাচন কমিশনের টাকায় পোস্টার ক্যাম্পেইন করে দেয়া হতো, যদি এর বাইরে প্রার্থীদের কোনো খরচ করতে দেয়া না হতো, তাহলে আগামী নির্বাচনে সিপিবি-বাসদ-নাগরিক ঐক্য-গণফোরামসহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তি ৩০০ আসনে ৩০০ আসন পেত।”
এই নাহলে দেশের সর্ববৃহৎ ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র সভাপতির উপর্যুক্ত মন্তব্য! তাদের দ্বারা বিএনপি-আওয়ামী লীগকে দেয়া আল্টিমেটাম এবং উক্ত বক্তব্য এদের কতোটা হাসির খোরাকে পরিণত করেছে সে বিষয়ে আর না গিয়ে অন্য একটা প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা করব। বাসদ নিজেদের বলে সমাজতন্ত্রী দল এবং সিপিবি নিজেদের কমিউনিস্ট দাবি করে। সমাজতন্ত্র নিয়ে অনেক ঘোরালো আলোচনা আছে। লেনিনের আমলে রাশিয়ায় চৌদ্দরকম সমাজতন্ত্রী ছিল। লেনিনকে তাদের তত্ত্বমতকে খারিজ করেই নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। সমাজতন্ত্রের নাম নিয়ে বিগত শতাব্দে বিশ্বের বহু শাসকই হাজার রকম অপকর্ম সম্পাদন করেছে। নিজ নিজ দেশে ক্ষমতায় আরোহণের সময় হিটলার-মুসোলিনিও ‘সমাজতন্ত্রী’-ই ছিলেন!!! কিন্তু একটি দল নিজেকে কমিউনিস্ট হিসেবে দাবি করার মানে হলো তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পথেই পরিচালিত হবেন। আর তা হলো, কেবল বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রটি দখল করাই নয়, কেবল বুর্জোয়া শ্রেণীর ওপরে সর্বহারার বিজয় অর্জনই নয়, বরং ক্ষমতা হাতে নিয়ে তাকে সেই রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙেচুড়ে ফেলতে হবে, তাকে প্রতিস্থাপন করতে হবে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা- যার উল্লেখ বর্তমান আলোচনায়ই ইতোপূর্বে একাধিকবার করা হয়েছে। এই রাষ্ট্রযন্ত্র ভাঙার কাজটি আবশ্যক কেন?কারণ বুর্জোয়াদের দ্বারা সৃষ্ট এবং তাদের পদসেবায় নিয়োজিত সামরিক-বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার উপযোগী নয়। অন্তর্বস্তুর দিক থেকে তা হলো শ্রমিক স্বার্থের পরিপন্থী। সুতরাং যে কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্যমান রাষ্ট্রের উচ্ছেদের কর্মসূচি ঘোষণা করে, রাষ্ট্রব্যবস্থা অতি অবশ্যই তার দিকে বন্দুক তাক করে, ভেতর এবং বাহির থেকে তাকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বুর্জোয়া শ্রেণীর মালিকানাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থার গঠনটাই এমন যে তা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু তাদেরকেই ক্ষমতায় আসতে দ্যায় যারা এই শ্রেণীর স্বার্থরক্ষায় সবচেয়ে পারঙ্গম। বর্তমানে বাংলাদেশে চরম গণবিরোধী শাসক শ্রেণীর অধীন রাষ্ট্রে কেবল নির্বাচন কমিশনের টাকায় পোস্টার-ক্যাম্পেইন করলে এবং প্রার্থীদের এর বাইরে খরচ করা থেকে বিরত রাখলেই যারা ৩০০ আসনের মধ্যে ৩০০টিই লাভ করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন (?) বলে নিজেদের দাবি করেন, সেই দল বা গোষ্ঠী নিশ্চয় বর্তমান শাসকদের চেয়েও এই শ্রেণীর স্বার্থ আরো অধিক মাত্রায় সংরক্ষণে সক্ষম!!! তা নাহলে এতোটা শান্তিপূর্ণ পথে তারা কীভাবে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখতে পারেন কেবল নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছার ভেলায় চড়ে?
সুতরাং আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, এই দলগুলোই ১৯৭২ সালের সংবিধানকে প্রগতিশীল হিসেবে আখ্যায়িত করে, তৎকালীন আওয়ামী লীগ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্র মনে করে তার প্রেমে মশগুল থাকে। তাদের কাছে সমাজতন্ত্রের ধারণা নিছক শিল্পকারখানার রাষ্ট্রায়ত্তকরণের বাইরে কিছু নয়। শেখ মুজিবকে বাকশাল গঠনের ফরমুলাও তারাই যোগান দিয়েছিল। এই দলগুলোই আজ শ্লোগান দ্যায় “ধর্ম যার যার,রাষ্ট্র সবার” এবং এই কথা লিখে দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারে। তারা বলে থাকে যেহেতু এই শ্লোগানের মাধ্যমে ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে তাই এটি অতিশয় প্রগতিশীল শ্লোগান! কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই তারা রাষ্ট্রকে সব জনগণের মালিকানাধীন ব্যবস্থা হিসেবে হাজির করে জনগণের চোখে ধুলো দেয়ার চেষ্টা করে। “রাষ্ট্র সবার” এই সবক তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের কোথায় পেয়েছেন?লেনিন তার ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থে স্পষ্টভাবেই রাষ্ট্র প্রসঙ্গে মার্কসীয় মূলনীতিগুলোর ব্যাখ্যা এবং এ বিষয়ে বিপ্লবী পার্টির কর্তব্যসমূহ উপস্থিত করেছেন। না, মার্কস-লেনিন কেউই রাষ্ট্র বিষয়ে বুর্জোয়াদের মতো করে জনগণকে ধোঁকা দেন নি, বরং এই ধোঁকায় আচ্ছন্ন জনগণের চিন্তাভাবনাকে পরিচ্ছন্ন করার কাজেই নিজেদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করেছেন। এই প্রতারণামূলক বক্তব্যের গোড়া নিহিত রয়েছে ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের মধ্যে। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২২তম কংগ্রেসে নিকিতা ক্রুশ্চেভ সমাজতন্ত্রে সর্বহারা একনায়কত্বের রাষ্ট্রের ধারণাকে পরিত্যাগ করেন এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলনীতির চরম বিকৃতি ঘটিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘সব জনগণের রাষ্ট্র‘ হিসেবে ঘোষণা করেন।
ক্রুশ্চেভীয় সংশোধনবাদের পথ ধরে অধঃপতনের সর্বনিম্ন স্তরে নামার প্রক্রিয়ায় এখন তাদের যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে তা দেখলে তাদের সংশোধনবাদী তত্ত্বগুরুও সম্ভবত লজ্জায় মুখ লুকোতেন। সুতরাং শেষাবধি যে তারা তদ্বির-সংলাপ-বৈঠকের মাধ্যমে শাসক শ্রেণীর পদসেবা এবং বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কাজেই নিয়োজিত হবে- এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। স্বাধীনতা-পরবর্তী তাদের ইতিহাস এ কথাই বলে। এ কারণেই ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে শহিদ মতিউল-কাদেরের রক্তের ওপর পথ মাড়িয়ে গণভবনে গিয়ে ত্রিদলীয় ‘দেশপ্রেমিক’ ঐক্যজোট গঠন করতে তাদের অসুবিধা হয় নি। এ কারণেই গত ১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের কোর্ট পয়েন্ট চত্বরে ছাত্রলীগের ‘সোনার ছেলে’দের হাতে মার খেয়েও তা খুব শিগগিরই তারা হজম করে ফেলতে পেরেছেন,কোনো বদহজম হয় নি।
তাদের এসব সুশীল নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতায় শাসক শ্রেণীর কিছু যায় আসে না,সাম্রাজ্যবাদের অঙ্গুলিহেলনে এবং নিজেদের দলীয় স্বার্থচিন্তার দ্বারা তাড়িত হয়েই তারা নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। কিন্তু শাসক শ্রেণীর কিছু না হলেও এতে সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনাকাঙ্ক্ষী তরুণ কর্মীদের সমস্যা আছে। যারা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থেই পরিবর্তন করতে চান, তাদের জন্য এ দেশে সিপিবি-বাসদ মার্কা ‘কমিউনিজম-চর্চা’ এক বিড়ম্বনার বিষয়। তাদের কর্মকাণ্ডের দায়ভার অনেক সময়েই সকল বামপন্থী এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের কাঁধে বর্তায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে যেহেতু এরাই এখন পর্যন্ত কিছুটা দৃশ্যমান তাই এদের কারণে জনগণ গড়পড়তা সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলকেই বুর্জোয়া, বিশেষত আওয়ামী-লেজুড় হিসেবে গণ্য করে এবং এই দলগুলির প্রতি তাদের আচরণও হয় তদনুযায়ী।
কিন্তু সিপিবি-বাসদ মার্কা রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের দায়ভার কেন অন্য রাজনৈতিক দল গ্রহণ করবে? তাদেরকে বলতে হবে, তারা তাদের ‘লিবারেল-ডেমোক্রেটিক’ কর্মসূচি বহাল রাখুক, কিন্তু শরীর থেকে কমিউনিজম-সমাজতন্ত্রের নামগন্ধ ঝেড়ে ফেলুক। “দুনিয়ার মজদুর এক হও” শ্লোগান দিয়ে বুর্জোয়া-লেজুড়বৃত্তির মারফত নিজ দেশের শ্রমজীবী জনগণের সাথে প্রতারণার রাজনীতি আর কতো? এখন সময় এসেছে, তাদের জবাবদিহি করতেই হবে। নাচতে নেমে ঘোমটা দেয়ার মতো রাজনৈতিক অসাধুতার দিন বিশেষ অবশিষ্ট নেই।।
No comments:
Post a Comment