Monday, June 2, 2014

'ডাবল কেমিক্যাল' আম-লিচুতে!

'ডাবল কেমিক্যাল' আম-লিচুতে!

আবুল খায়ের
রাজধানীর প্রায় সকল ফলের দোকান ও মেলায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন কেমিক্যাল ও ফরমালিন মেশানো আম-লিচুসহ নানা মৌসুমী ফল। জানা গেছে, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবঞ্জে বাগানেই কাঁচা আম পেড়ে পাকানো হচ্ছে ক্যালশিয়াম কার্বাইড দিয়ে। পরে মেশানো হচ্ছে ফরমালিন। দিনাজপুরসহ বিভিন্ন স্থানে একই ভাবে বাগানে লিচুতে কার্বাইড ও ফরমালিন মেশানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এভাবে 'ডাবল কেমিক্যাল' মিশিয়ে বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে নানা মৌসুমী ফল। 

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও দিনাজপুরের ফল চাষীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা 'ডাবল কেমিক্যাল' মেশানোর পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। তারা জানান, প্রাকৃতিকভাবে সময়মত আম-লিচু পাকার পর বাজারে নিয়ে গেলে তেমন মূল্য পাওয়া যায় না। অসময়ে কাঁচা আম বাগান থেকে পেড়ে 'ডাবল কেমিক্যাল' মিশিয়ে পাকিয়ে বাজারজাত করলে বেশি দাম পাওয়া যায়। কি পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়-এর উত্তরে আম চাষী কালু মিয়া ও ফজলু জানান, তাদের কেমিক্যাল সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। লেখাপড়াও নেই। দ্রুত পাকানোর জন্য যে পরিমাণ দরকার সেই পরিমাণই ব্যবহার করে থাকেন। এরপর মাসের পর মাস সেই পাকানো আম-লিচু রেখে বিক্রি করার জন্য ইচ্ছানুযায়ী ফরমালিন মেশানো হয় বলে তারা স্বীকার করেন।

সময় থাকতে কেমিক্যাল ও ফরমালিনযুক্ত ফলমূল ও খাদ্যসামগ্রীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন চিকিত্সক-বিশেষজ্ঞগণ। প্রয়োজনে জড়িতদের প্রকাশ্যে 'ক্রসফায়ারে' দেয়ার পরামর্শ দেন তারা। এ ব্যাপারে নিউরোসায়েন্স ইন্সটিটিউটের যুগ্ম-পরিচালক বিশিষ্ট নিউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. বদরুল আলম বলেন, 'ডাবল কেমিক্যাল' যুক্ত ফল খেলে মানুষের দেহের নার্ভগুলো অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের শিকার হয়ে চরম দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। এটাকে বলে 'নিউরোপ্যাথি' । 

কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও প্রখ্যাত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, এসব কেমিক্যাল মেশানো যে কোন ফল খেলে কিডনি-লিভারসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধি আশংকাজনক হারে বৃদ্ধির এটা অন্যতম কারণ। দেশে অসংক্রামক ব্যাধির ব্যাপকতার জন্য বিষাক্ত কেমিক্যালযুক্ত ফলসহ খাদ্যসামগ্রীই দায়ী বলে তিনি জানান। 

এদিকে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেও ফলে কেমিক্যাল মেশানো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। গতকাল সোমবার বিএসটিআইয়ের মোবাইল কোর্ট সিদ্ধেশ্বরী মাঠে 'রাজশাহী ও চাঁপাইয়ের আম মেলা' ও সিদ্ধেশ্বরী বাগিচা মাঠে 'বিশ্বময়ী ফল ভান্ডারে' অভিযান চালায়। তাত্ক্ষণিক পরীক্ষায় আমে প্রচুর পরিমাণে ফরমালিন থাকার প্রমাণ পায় কোর্ট। পরে দুই আম মেলার মালিককে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৬০ কেজি আম ধ্বংস করা হয়।

অপর একটি মোবাইল কোর্ট এলিফ্যান্ট রোডে (নিউ মার্কেট) রাজুর ফলের দোকানে ও কলাবাগান স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে মো. লায়েক শেখের ফলের দোকানে অভিযান চালিয়ে আম ও লিচুতে ব্যাপক পরিমাণে ফরমালিন থাকার প্রমাণ পায়। শাস্তি হিসাবে ওই দুই ব্যবসায়ীকে ২৭ হাজার টাকা জরিমানা এবং ফরমালিনযুক্ত আম-লিচু ধ্বংস করে মোবাইল কোর্ট ।

রাজশাহী অফিস থেকে আনিসুজ্জামান জানান, উত্তরাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহত্তম আমের মোকাম রাজশাহীর বানেশ্বর এলাকার প্রায় সকল আড়তে ক্ষতিকর ক্যালসিয়াম কার্বাইড মিশিয়ে আম পাকানো হচ্ছে। এমনকি ফরমালিন মিশিয়ে আম সংরক্ষণ করা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। 

আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত!

আমে কেমিক্যাল মেশানো প্রতিরোধে এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ২৬ মে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন আম বাগানে পুলিশ পাহারা বসানোর জন্য পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজিকে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু আদালতের ওই নির্দেশনা কার্যকর হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ পাহারা ছাড়াই বাগান থেকে আম পাড়ছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে 'ডাবল ক্যামিক্যাল' মেশানো আম অবাধে বিক্রি হচ্ছে বাজারে। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যেই আম কিনছেন গ্রাহকরা।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আবদুল আলীম বলেন, এখন আটি, গোপাল ভোগ, ক্ষিরসাপাত, মোহনভোগ আমের পুরো মৌসুম শুরু হয়েছে। জুনের মাঝামাঝির পর থেকে ল্যাংড়া বাজারে আসতে শুরু করবে। জুনের শেষে ও জুলাইয়ের প্রথমে আসতে শুরু করবে ফজলি। জুলাইয়ের শেষের দিকে আসবে আশ্বিনা। তিনি বলেন, মৌসুমের আগে-ভাগে কোনো আম বাজারে আনলে মনে করতে হবে, সেগুলোতে ভেজাল রয়েছে। তিনি আরো বলেন, সাধারণত গাছের সব আম একসঙ্গে পাকে না। ধাপে ধাপে পরিপক্ক আম নামিয়ে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু বেশি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা সব আম একসঙ্গে নামিয়ে বিক্রি করেন। কোনো কোন ব্যবসায়ী সব আম দ্রুত পাকানোর উদ্দেশ্যে ক্যালসিয়াম কার্বাইড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করেন। আবার কোনো কোনো ব্যবসায়ী আম বিলম্বে পাকানোর উদ্দেশ্যে ফরমালিনও ব্যবহার করতে পারেন। 

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কাঁচা আম গাছ থেকে নামানোর পর সংশ্লিষ্টরা রাসায়নিকের পরিবর্তে 'ভিটামিন' ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু সচেতনতার অভাবে তা করা হয় না। 

বিএসটিআই রাজশাহী বিভাগের উপ-পরিচালক রেজাউল ইসলাম বলেন, তারা আমে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহারের তত্পরতা রুখতে সপ্তাহে দু'বার বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করছেন। কিন্তু নিজস্ব ম্যাজিস্ট্রেট ও জনবলের অভাবে চাইলেই অভিযান চালাতে পারছেন না।

The Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment