Monday, June 2, 2014

ব্যাংকে মেজর আরিফের অর্ধশত কোটি টাকা

ব্যাংকে মেজর আরিফের অর্ধশত কোটি টাকা
প্রকাশ : ০৩ জুন, ২০১৪

মোয়াজ্জেম হোসেন নাননু/রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ থেকে
র‌্যাবের সাবেক কর্মকর্তা মেজর আরিফ ও তার দুই আত্মীয়ের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবে আরিফের অর্ধশত কোটির বেশি টাকা জমা রয়েছে। রাজধানীর মিরপুর ডিওএইচএস এবং মোহাম্মদপুরে দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধানও পেয়েছে তদন্ত কর্মকর্তারা। সেনা কর্মকর্তার হিসাবে এত টাকার উৎস সম্পর্কে সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না মেজর আরিফ। বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সম্পর্কেও কিছু বলছেন না। এ সংক্রান্ত প্রশ্ন বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জে সাত অপহরণ ও খুনের মামলায় রিমান্ডে আছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা।
টাকার উৎস সম্পর্কে আরিফ নানা ধরনের কথা বলছেন। একবার বলেন, কয়েক মাস আগে কিছু জমি বিক্রি করেছি। সেখান থেকে পাওয়া মোটা অংকের টাকা ব্যাংকে রয়েছে। তবে কোন এলাকায় জমি বিক্রি করেছেন সে সম্পর্কে নিশ্চিত করে তিনি কিছু জানাতে পারেননি। গত বছরের আগস্ট এবং চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও মিরপুর ডিওএইচএস এলাকায় কেনা ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও সন্তোষজনক কোনো জবাব দেননি সাবেক এই মেজর।
তদন্ত কর্মকর্তারা মনে করছেন, সাত খুনের ঘটনায় মোটা অংকের টাকা লেনদেনের যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার বড় একটি অংশ মেজর আরিফের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। ঘটনা প্রমাণে এটি বড় সহায়ক হিসেবেও কাজ করবে। এছাড়া মেজর আরিফের নামে কেনা দুটি ফ্ল্যাটের ব্যাপারেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গ্রামের বাড়িতে নামে-বেনামে কেনা সম্পত্তি সম্পর্কেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয় পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসীতে মেজর আরিফের গ্রামের বাড়ি। সেখানেও তার নামে-বেনামে রয়েছে বিশাল সম্পত্তি। শিলাসী গ্রামের রেল লাইনের পূর্ব পাশে রয়েছে তার বিলাসবহুল একটি বাড়ি। বাড়িটি দ্বিতীয় তলার নির্মাণ কাজ চলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নির্মাণ শ্রমিক জানান, র‌্যাবের সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আরিফ হোসেনের পূর্বের বাড়ি ছিল গাজীপুর জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
গফরগাঁও উপজেলার পৌর শহরের ৯নং ওয়ার্ডের শিলাসী গ্রাম তার নানার বাড়ি। ১/১১-এর সময় মেজর আরিফ যৌথবাহিনীর ইনচার্জ হিসেবে গাজীপুর জেলার দায়িত্বে ছিলেন। ১/১১-তে গাজীপুর জেলায় যৌথবাহিনীর ইনচার্জের দায়িত্ব পালনকালে বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন এই সেনা কর্মকর্তা। সম্প্রতি পৌর শহরের প্রাণকেন্দ্র কলেজ রোডের খায়রুল্লাহ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে (ক্ষণিকা) সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকায় ১৩ শতাংশ জমি কিনে আলোচনায় আসেন এই মেজর। চরশিলাসী মৌজায় মেজর আরিফ তার মা এবং ছোট ভাইয়ের নামেও কিনেছেন প্রায় কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি। এ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। পর্যায়ক্রমে আরিফকে তার সম্পত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
এদিকে দুই দফা রিমান্ড শেষে ফের ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে র‌্যাব-১১ এর আদমজী ক্যাম্পের সাবেক ইনচার্জ লে. কমান্ডার এমএম রানাকে। রিমান্ড শেষে সোমবার বিকালে তাকে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কেএম মহিউদ্দিনের আদালতে হাজির করে ফের সাত দিনের রিমান্ড আবেদন জানায় মামলার তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। শুনানি শেষে আদালত তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আদালতে শুনানির সময় বরাবরের মতো র‌্যাব কর্মকর্তার পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াননি। এ সময় আদালতে এমএম রানাকে কিছু বলার আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, নূর হোসেনকে তিনি কোনোদিনই চিনতেন না। অপহরণের স্থান তার দায়িত্বে থাকা এলাকার মধ্যে ছিল না দাবি করে এমএম রানা বলেন, তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার।
চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ইন্সপেক্টর মামুন উর রশিদ যুগান্তরকে বলেছেন, সাবেক তিন র‌্যাব কর্মকর্তাকে রিমান্ডে এনে অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্যই পাওয়া গেছে। তবে এদের কাছ থেকে মামলায় সহায়ক তথ্য আদায় করা কঠিন কাজ। তাদের কাছ থেকে পাওয়া গত কয়েক দিনের তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
এদিকে রিমান্ডে থাকা র‌্যাব-১১ এর সাবেক অপর দুই কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ ও লে. কমান্ডার এমএম রানা ঘটনার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডের সব দায় চাপাচ্ছেন মেজর আরিফের ওপর। তারা তদন্ত কর্মকর্তাদের বারবার বলেছেন, এ ব্যাপারে মেজর আরিফ সব কিছু জানেন। আর মেজর আরিফ বলছেন, ‘আমি অর্ডার ফলো করেছি মাত্র।’ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রটি আরও বলেছে, মেজর আরিফের সঙ্গে নূর হোসেনের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। আরিফ নিজে একজন মাদকাসক্ত ছিলেন, তিনি নিয়মিত ইয়াবা সেবন করতেন। নূর হোসেন প্রতিদিনই লোক মারফত তার কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিতেন। ওই সূত্র জানিয়েছে, মেজর আরিফ জিজ্ঞাসাবাদেও একটি পর্যায়ে মাদক সেবনের বিষয়টি তদন্ত দলের কাছে স্বীকার করেছেন। এছাড়া কাঁচপুর ব্রিজের নিচে বিআইডব্লিউটিএ’র ডাম্পিং স্টেশনে নূর হোসেনের রংমহলে প্রায় প্রতি রাতেই যেতেন মেজর আরিফ। গভীর রাত পর্যন্ত তিনি ওই রংমহলেই কাটাতেন। নূর হোসেনের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোটা অংকের মাসোহারা নেয়ার তথ্য-প্রমাণও এখন তদন্ত কর্মকর্তাদের হাতে রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র বলেছে, গত কয়েক দিনে তারা চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু তথ্য পেয়েছেন। এর মধ্যে হত্যার পর লাশগুলো নদীতে ফেলার জন্য কাঁচপুর ব্রিজের নিচে শান বাঁধানো ঘাট দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় উঠানো হয় বলে তারা জানতে পেরেছেন। ওই রাতে ঘাটের আশপাশে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী দু’জনের বক্তব্যে এমন তথ্য পেয়েছে তদন্ত কর্তৃপক্ষ। প্রত্যক্ষদর্শী ওই দুই ব্যক্তি পুলিশকে বলেছেন, ২৭ এপ্রিল রাত দেড়টার দিকে তারা কয়েকজন লোককে ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় কিছু বস্তা উঠাতে দেখেছেন। ছোট্ট একটি পিকআপ ভ্যানে করে ওই বস্তাগুলো ঘাটে আনা হয়েছিল। তবে ওই বস্তায় কি ছিল তা তারা জানেন না।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে র‌্যাব সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে। ৩০ এপ্রিল ও ১ মে ইটের বস্তা দিয়ে বাঁধা তাদের লাশ ভেসে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে। লোমহর্ষক এ ঘটনার পর র‌্যাব-১১ এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, একই ব্যাটালিয়নের দ্বিতীয় অধিনায়ক মেজর আরিফ হোসেন এবং সিদ্ধিরগঞ্জ ক্যাম্প কমান্ডার নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানার দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর।
৬ কোটি টাকার বিনিময়ে র‌্যাবের ওই কর্মকর্তারা নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করা হয়। এরপর ওই তিন কর্মকর্তাকে প্রথম নিজ-নিজ বাহিনীতে ফেরত নেয়া হয়। পরে দুই সেনা কর্মকর্তাকে অকালীন অবসর এবং নৌ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। হাইকোর্টে একটি রিট পিটশনের পর আদালত আলোচিত এ মামলায় তিনজনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন।
- See more at: http://www.jugantor.com/first-page/2014/06/03/106997#sthash.MmKtE4jj.dpuf

No comments:

Post a Comment