নগদ তুলে নিল জালিয়াতির হাজার কোটি টাকা
দেলোয়ার হুসেন ও মনির হোসেন
প্রকাশ : ০৩ জুন, ২০১৪
প্রচলিত নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করে বেসিক ব্যাংকের তিনটি শাখা থেকে ঋণের হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে নগদ আকারে। নিরক্ষর ব্যক্তিরা চেকে স্বাক্ষর করে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন এমন নজিরও আছে। শাখা থেকে মাইক্রোবাসে করে এসব টাকা নেয়া হয়েছে। ১৩টি প্রতিষ্ঠান এভাবে নগদ টাকা তুলে নিয়েছে। তবে তারা টাকা নিয়ে কোথায় রেখেছে বা বিনিয়োগ করেছে সে সম্পর্কে ব্যাংক যেমন কিছুই জানে না, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকও সে তথ্য উদ্ধার করেনি। এখন পর্যন্ত এ সম্পর্কে জানার জন্য কোনো পক্ষ থেকেই কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এত বিপুল অংকের টাকা নগদ আকারে দেয়া-নেয়ার মাধ্যমে ব্যাংক এবং গ্রাহক দুই পক্ষই মানি লন্ডারিং আইন ভঙ্গ করেছে। একই সঙ্গে তারা ভঙ্গ করেছে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধি-বিধানও। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন ও সরেজমিন অনুসন্ধান করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এত টাকা নগদ নেয়ার মানে হচ্ছে আর ফেরত দিতে হবে না। দেশের নিরাপত্তার জন্যও এটা হুমকিস্বরূপ। এ ঘটনার তদন্ত হওয়া উচিত। টাকা কোথায় গেল তাও খুঁজে বের করা উচিত।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুস সোবাহান যুগান্তরকে বলেন, নগদ পেমেন্টের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার বিষয়টি আমার নজরে আসেনি। তবে ব্যাংকের সামগ্রিক বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখছি। ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের টাস্কফোর্সের পাশাপাশি আমরা নিজস্ব একটি কমিটি গঠন করেছি। পর্যায়ক্রমে ১৬৮টি শাখায় অডিট করা হবে। কোনো অনিয়ম পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনে কাজ করার চেষ্টা করছি। তবে তিনি বলেন, আমি গ্রাহকদের বলতে পারি- এটি একটি শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, সরকারই এর গ্যারান্টি। ফলে আমানত নিয়ে গ্রাহকদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।
সূত্র জানায়, ব্যাংক থেকে অনুমোদন করা ঋণের টাকা ২০০৯ সাল পর্যন্ত অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তোলার নজির পাওয়া গেছে। ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টাকার একটি অংশ তোলা হয়েছে পে-অর্ডারের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ায় টাকা তুললে প্রকৃত সুবিধাভোগী কে তা তদন্তের মাধ্যমে বের করা সম্ভব। আর নগদ আকারে নিলে ঋণ অনুমোদনের পরে ব্যাংকিং তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত সুবিধাভোগীকে বের করা সম্ভব নয়। কেননা নগদ আকারে নেয়ার পর ঋণগ্রহীতা ছাড়া ব্যাংকে আর কোনো রেকর্ড থাকে না। এ কারণেই প্রকৃত সুবিধাভোগীকে আড়াল করার জন্য বেনামি কোম্পানির অনুকূলে ঋণ অনুমোদন করে তা নগদ আকারে তুলে নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ঋণের টাকা নগদ আকারে নেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঋণের টাকা নেয়ার আগেই শাখা ওইসব টাকা নগদ সংগ্রহ করে রাখত। ব্যাংকের প্রধান শাখা থেকে ওইসব টাকার জোগান দেয়া হতো। কয়েকটি মাইক্রোবাসে করে ওইসব টাকা শাখায় পৌঁছে দেয়া হতো। শাখা থেকে বিশেষ করে বিকালে বা সন্ধ্যার পর একাধিক পাজেরো জিপে করে ওইসব টাকা নিয়ে যাওয়া হতো অজ্ঞাত স্থানে। টাকা তোলার চেকে এমন সব ব্যক্তির স্বাক্ষর রয়েছে যা দেখলেই বোঝা যায় তারা নিরক্ষর। এমন ব্যক্তিরা কিভাবে পাজেরো জিপে করে শত শত কোটি টাকা নিয়ে গেলেন। এ প্রশ্ন অনেকের। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকের দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখায়।
ঋণের টাকা সাধারণত ব্যবসায়ীরা তাদের চলতি হিসাবে রাখেন। ওখান থেকে চাহিদা মতো খরচ করেন। এর বড় অংশই খরচ হয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। কিন্তু বেসিকে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, নগদ লেনদেন ১০ লাখ টাকার বেশি হলেই তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) হিসাবে। এতে কোনো সন্দেহ থাকলে তা অবশ্যই সন্দেহজনক লেনদেন (এসটিআর) হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানাতে হবে। কোনো ব্যাংক এসব তথ্য গোপন করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে জরিমানা করার বিধান রয়েছে। মানি লন্ডারিং এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক সংস্থা এগমন্ট গ্র“পের সঙ্গে কাজ করছে। এর অংশ হিসেবেই ব্যাংকগুলো থেকে এখন সিটিআর বা এসটিআরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। আমেরিকা, মালয়েশিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে এই ধরনের বিধান রয়েছে। এই বিধান ভঙ্গ করার দায়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংককে জারিমানা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ১০ লাখ টাকার বেশি নগদ লেনদেন করলেই সিটিআর করতে হয়। তবে ঋণের টাকা এক অ্যাকাউন্ট থেকে আরেকটি অ্যাকাউন্টে জমা রেখে সেখান থেকে ক্যাশ তোলা যায়। কিন্তু পরের মাসের ২১ তারিখের মধ্যে অবশ্যই সিটিআর করার নিয়ম রয়েছে। এই লেনদেনে কোনো সন্দেহ থাকলে তা এসটিআর করতে হবে। কোনো ব্যাংক সিটিআর বা এসটিআর না করলে তা অপরাধ। এই অপরাধে জরিমানার বিধান রয়েছে।
যারা নগদে টাকা নিল : ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে ৪টি শিপিং কোম্পানির নামে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে এস সুহি শিপিংলাইন ৪৫ কোটি, এসজিএফ শিপিংলাইন ৭৫ কোটি, শিফান শিপিংলাইন ৫৮ কোটি এবং এস রিসোর্ট শিপিংলাইনের নামে ২৭৪ কোটি টাকা। এসব ঋণ প্রস্তাবে যেমন অনিয়ম ছিল, তেমনি প্রস্তাব ছাড়াই ঋণ প্রধান কার্যালয় থেকে অনুমোদন করা হয়েছে। পর্ষদে এই ঋণের ব্যাপারে ইতিবাচক কোনো মন্তব্য শাখা থেকে পাঠানো হয়নি। ঋণের এসব টাকা দ্রুত ছাড় হওয়ার পর নগদ আকারে তুলে নেয়া হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নগদে টাকা তোলার বিপরীতে ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনো সিটিআর বা এসটিআর রিপোর্ট পাঠানো হয়নি।
ব্যাংকের শান্তিনগর শাখা থেকে ফিয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামে পাওয়া ঋণের টাকার বড় অংশই তুলে নেয়া হয়েছে নগদ আকারে। এই টাকার কোনো এসটিআর দেয়া হয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এদের নামে শাখায় ১৫২ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। যার বিপরীতে নামমাত্র জামানত রয়েছে। ব্যাংক থেকে সাধারনত ট্রাস্ট এগেনস্ট রিসিপ্টের (এলটিআর) মাধ্যমে ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য ঋণ দেয়া হয়। এই ঋণ এলসির দেনা শোধে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু শাখায় এলটিআরের টাকাও নগদ আকারে তুলে নেয়ার নজির রয়েছে। একই মালিকের আরও একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে ঋণ রয়েছে। এটির নাম অটো ডিফাইন। এটির ঋণসীমা ছিল ১৬৩ কোটি টাকা। এই ঋণের টাকার একটি বড় অংশ তুলে নেয়া হয়েছে নগদে। এতে কোম্পানির মালিকানা পরিবর্তন করে জালিয়াতির ঘটনাও ঘটেছে। একই মালিকের প্রতিষ্ঠান এবি ট্রেড লিংককে ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে প্রস্তাব পাঠানোর আগেই প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ওই টাকাও নগদে তুলে নেয়া হয়েছে।
এসব ঋণ অনুমোদনে যেমন প্রচলিত নিয়ম মানা হয়নি। তেমনি ঋণের টাকা তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি। এসব কাজে বেসিক ব্যাংক শুধু জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ অনুমোদনই করেনি। ঋণের টাকা ছাড় করার ক্ষেত্রেও জালিয়াতি করেছে। সবচেয়ে বড় জালিয়াতি করেছে ঋণের টাকা নগদ আকারে নেয়ার পর এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ লেনদেনের রিপোর্ট (সিটিআর) এবং সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট (এসটিআর) কোনোটিই করেনি।
ঋণ বিতরণের আবেদন, আবেদন প্রক্রিয়াকরণ, শাখার ঋণ কমিটির মূল্যায়ন, প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ, প্রধান কার্যালয়ের ঋণ কমিটির মূল্যায়ন, মাঠ পর্যায়ের প্রতিবেদন, পর্ষদে ঋণ অনুমোদন, ঋণ বিতরণ, নগদ আকারে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেন তথ্য, সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য, ঋণের কোনো কিস্তি আদায় না করেই সুদ আয় খাতে নেয়ার মতো এমন পদে পদে জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা, সুপারিশন কোনো কিছুই নিয়মের মধ্যে নিয়ে হয়নি। এক কথায় সব কিছু ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, বড় ধরনের নগদ লেনদেনের পর সিটিআর না করাটা গর্হিত কাজ। আর এ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, সবাই অপরাধী। দ্রুত এদের বিচার করতে হবে। তিনি বলেন, ৩টি শাখার ঘটনা প্রকাশ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো শাখা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব ব্যাংকটির বোর্ড পুনর্গঠন করতে হবে। তিনি বলেন, দেশে সৎ, যোগ্য অনেক লোক রয়েছে। সরকারের ইচ্ছা থাকলে মুহূর্তের মধ্যে ব্যাংকের অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। আর টাকা আদায় করতে হলে পুনর্গঠনের বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেসিক ব্যাংকের চারটি শাখায় তদন্ত করা হয়েছে। শাখাগুলো হচ্ছে- রাজধানীর গুলশান, শান্তিনগর, দিলকুশা শাখা এবং রাজশাহীর প্রধান শাখা। এছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিচ্ছিন্নভাবে আরও কিছু শাখায় তদন্ত করা হয়েছে। এসব তদন্তে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। এর মধ্যে এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানির নামে বিদেশে টাকা পাচার, এক কোম্পানির নামে ঋণ নিয়ে অন্য কোম্পানিতে স্থানান্তর, মন্দ ঋণ কেনা, ঋণের টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে স্থানান্তর, বস্তায় ভরে গাড়িতে করে ঋণের টাকা নগদ আকারে নেয়ার মতো অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ ঘটনাও ঘটেছে। যা শুনলে গা শিউরে উঠে।
সূত্র জানায়, সবচেয়ে বড় জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ব্যাংকের গুলশান শাখায়। এর পরেই রয়েছে শান্তিনগর ও রাজশাহী শাখা। এর মধ্যে গুলশান শাখায় জালিয়াতির পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
No comments:
Post a Comment