ঔপনিবেশিকোত্তর ঔপনিবেশিক মন ॥ পতাকা বহিবার শক্তিটা যেন পাই
মুনতাসীর মামুন
(গতকালের পর)
ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনের ফলে যে আদর্শ গড়ে উঠেছিল যাঁরা এর চর্চা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আদর্শগত বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল যার মধ্যে প্রধান ছিল স্ববিরোধিতা।
ঐতিহ্য আবিষ্কার করতে গিয়ে হিন্দুরা প্রাচীনকালের ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তুলেছিলেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনে যে তাঁরাই সম্প্রদায়গতভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন এ কথা তাঁরা মনে রাখলেন। লেখক-সাংবাদিকরা এ মনোভাবই ব্যক্ত করেছিলেন ঘুরেফিরেÑ আক্রমণাত্মক এবং উদ্ধতভাবে। ভারতে আগত মুসলমানদের তারা চিহ্নিত করেছিলেন আক্রমণকারীরূপে কিন্তু ইংরেজরাও যে আক্রমণকারী এবং শাসক ও লুটেরা সে সব কথা তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন।
অন্যদিকে মুসলমানরা ঐতিহ্য খুঁজতে গিয়ে নিজেদের আবিষ্কার করেছিলেন আগন্তুক হিসেবে। এবং ঔপনিবেশিক আমলে দেখা গেল, তাঁরা শুধু রায়ত এবং রায়ত হিসেবে তাঁরা কোন মর্যাদার অধিকারী নন। তখন তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজ সম্প্রদায় এবং নিজ ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছিলেন ইরান তুরানে।
পাকিস্তান বা দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক আমলেও দুই সম্প্রদায়ের মানসিকতায় তেমন একটা মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, হিন্দুরা শুধু একটু হীনবল হয়ে গিয়েছিল মাত্র। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মনে এই ধারণা বলবৎ করার চেষ্টা করা হলো যে, তারা সাচ্চা মুসলমান নয়, তারা হিন্দুঘেঁষা মসুলমান। সুতরাং সাচ্চা মুসলমান হতে হলে পাক্কা মুসলমান হতে হবে। বাঙালীদের একাংশ যে ‘সাচ্চা মুসলমান’ হতে চায়নি তা নয়। তার প্রমাণ ১৯৭১ সাল। বাঙালী মুসলমানদের একটি অংশ ও বিহারীরা পাকিস্তানী প্রভুদের হয়ে যেভাবে এ ভূখণ্ডে হত্যাকা- চালিয়েছে তার দ্বিতীয় নজির নেই। এর বিপরীত ধারা যে ছিল না তা নয়। ১৯৪৮ সালে উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক যে ধারা তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে তাই জয়লাভ করে। কিন্তু সে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আবার পাকিস্তানী ধারার প্রবর্তন হয়, যে ধারা পুষ্ট করেন জেনারেল এরশাদ ও জিয়াপত্নী খালেদা।
আরও পরে জেনারেল মইন উদ্দীন। দু’টি জেনারেশনকে সেই পাকিস্তানী ধারায় বড় হতে হয়েছে যেমনটি হতে হয়েছিল আমাদের। এর বিপরীত ধারা অগ্রসর হয়েছে বটে তবে তা আগের মতো প্রবল নয়। আদর্শিক দিক থেকেও অনেকটা সরে গেছে।
তা হলে গত ৩০০ বছরের নিট ফলটা কী ? নিট ফল হলো, এমন এক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এ ভূখণ্ডে যার মানসিক গড়নে কলোনির বাসিন্দাদের মানসিকতায় ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও বিরাজ করছে। হেজাবিরা হলো এ ধারার নেতা। এবং আমরা, যাদের অবস্থান এর বিপরীতে তাদের মনের গহীন কন্দরে হেজাবির একটি অংশ এখনও রয়ে গেছে। আমাদের মানসিকতা লক্ষ্য করুন। কয়েকটি উদাহরণ-
১. কোন দেশে জাতির পিতা বা স্বাধীনতার ঘোষক বা দেশের স্থপতিদের নিয়ে কোন নিতর্ক নেই। বাংলাদেশে আছে। এমনকি ভারত, যেখানে আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসে হত্যা করেছিলেন জাতির পিতা গান্ধীকে সেই আরএসএস সমর্থক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমেই শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন রাজঘাটে।
২. কোন দেশে বিজয়ী শক্তি পরাজিত শক্তিকে সম্মানের সঙ্গে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসায়নি। এ কাজটি করেছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত, পাকিস্তানী মানসিকতার প্রতিভূ জিয়াউর রহমান। এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।
৩. সুদীর্ঘ ২০ বছর এদেশের মানুষের একটা বড় অংশ এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষক জাতির পিতা বিতর্কে সোৎসাহে অংশ নিয়েছে।
৪. ১৯৭৫-এর ঘটনা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, এমনকি যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের একটা বড় অংশ তা মেনে নিয়েছিলেন।
৫. সরকারীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীতে আর কোন সরকার বদলায়নি।
এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। দেব না। মূল বিষয় হলো, জাতি ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া কি সম্পন্ন হয়েছিল? এমএ মুহিত লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কিন্তু পাকিস্তানী প্রভাব এখনও শক্তিশালী।”
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পূর্ব ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন করা যায়, জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সব প্রশ্নের কি নিরসন হয়েছিল? বা সে প্রক্রিয়া কি সম্পূর্ণ হয়েছিল? এমএ মুহিতের মন্তব্য বা আমি যে উদাহরণগুলো দিলাম তা বিশ্লেষণ করে কি বলা যায় না বা প্রশ্ন তোলা যায় না যে, জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সব প্রশ্নের নিরসন হয়নি বা সে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। ১৯৭৫-২০০৫ এবং ২০১২ সালের প্রাক-নির্বাচনী ঘটনাবলী আবার প্রমাণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি হয়ত তাত্ত্বিক দিক থেকে জটিল কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও বাস্তব মেলানো মাঝে মাঝে দুরূহ।
ব্রিটিশ আমলে বাঙালীর বিশেষ করে বাঙালী উচ্চবর্গের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তোষামোদ; যার অন্য অর্থ হতে পারে হীনম্মন্যতা। উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত সাপ্তাহিক গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন- “জমিদার প্রজাদিগের পিতা-মাতাস্বরূপ ও সহায়সম্পদ, ইহা সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিবেন।”
রানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন সবার মাতা। ময়মনসিংহের পরিচিত ব্রাহ্ম কালীকৃষ্ণ ঘোষ ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতসমাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করলে একটি গীত রচনা করেছিলেন, যার শেষ চারটি চরণ ছিল এ রকম-
“দয়াবতী মহারানী
মোদের জননী যিনি
রাজ রাজেশ্বরী তিনি
আর কারে করি ভয়।”
সিলেটের তৎকালীন বিখ্যাত কবি রামকুমার নন্দী পেনশন পাওয়ার পর রানী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে লিখেছিলেন-
“সেবি-বহুদিন, ভক্তি সহকারে
ভারতসম্রাজ্ঞী জননী পায়
বৃদ্ধকালে পুনঃ যাহার কৃপায়
হইল এখন জীবনোপায়।”
যে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা জমিদার ও নীলকরদের [জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেরও] বিরুদ্ধে লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তারই সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, ভাইসরয় যেন একবার পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন, কারণ তা হলে এখানকার প্রজারা সচক্ষে একবার রানীর প্রতিনিধিকে দেখতে পাবে। ভাইসরয় রিপন কলকাতা ফেরার পথে পোড়াদহ স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিলেন। তখন কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার ও তাঁর বাউল দল রিপনের জন্য বিশেষভাবে রচিত গান গাইবার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সহবাস সম্পত্তি আইনের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন কায়কোবাদ-
“কোথা গো মা ভিক্টোরিয়া, হের একবার
কোটি কোটি কন্যা তব করিছে রোদন।...
আজি এ বিপদে পড়ে ডাকি মা তোমায়,
কোথা তুমি এ সময়? দেও গো ‘অভয়’।...’’
স্তরবদ্ধ সমাজে শোষণ ও শাসনের কেন্দ্রমূল কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে যায়। ফলে, দূরবর্তী শাসক/শোষক, নিকটবর্তী শাসক/শোষক থেকে অধিকতর মহিমান্বিত ও মানবিক গুণসম্পন্ন বলে প্রতিভাত। সেই ঐতিহ্য, সেই দাসসুলভ মনোভাব, স্টাবলিশমেন্ট প্রীতি এখনও অক্ষুণ্ন। সব আমলের মন্ত্রিবর্গ তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আচরণ দেখুন। কয়েকদিন আগে এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ যেভাবে তারেক রহমান ও তাঁর ‘সম্পাদিত বইয়ের’ গুণকীর্তন করলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে লজ্জা হয় যে, তিনি এক সময় আমাদের উপাচার্য ছিলেন। সবাই জানে যে, যে অর্বাচীন ঐ তরুণের কোন ক্ষমতা নেই একটি বই সম্পাদনা করার বা লেখার। সেটি জেনেও যখন কেউ এমন বলেন তখন কিভাবে বলি মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে?
এসব কিছু মিলে আমরা এমন এক মনোজগৎ সৃষ্টি করেছি, যেখানে পরস্পরবিরোধিতা, ধর্ম, কলোনির মানসিকতাÑসব মিলিয়ে একটি বিভ্রান্ত বা গোলমেলে মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এর ওপর লিবারেল শিক্ষাব্যবস্থা সংকোচন, জাতীয় ইতিহাস না পড়ানো বা উপেক্ষা করা আরও হীনম্মন্যতা, শিকড়হীনতা তৈরি করেছে। ১৯৭২ সালে কেউ দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্তু যদি পাশ্চাত্য ও আমেরিকা ভিসা উঠিয়ে দেয় তা হলে বাংলাদেশ জনশূন্য হয়ে যাবে।
শেকড়হীন, নিরাপত্তাহীন, রক্ষণশীলতা, হেজাবি/কলোনি মানসিকতার ঐতিহ্য সব মিলিয়ে এমন এক মনোজগৎ তৈরি হয়েছে যা থেকে মুক্তি না পেলে ৬ ভাগ জিডিপি বৃদ্ধিতে কিছুই আসে যাবে না। বাড়তি জনসংখ্যা গর্বের বিষয়, বলেন নীতিনির্ধারকরা। হতে পারে। কিন্তু বলার সময় ভাবেন না দেশটি কতটুকু, সম্পদ কতটুকু। সাধারণ শ্রমিক প্রেরণ, ভৃত্য প্রেরণ, ঝাড়দার-ঝাড়ুদারনী প্রেরণে আমরা উল্লসিত হয়ে উঠি- কী জনসংখ্যা রফতানি করছি। উল্লসিত হতাম যদি বলতে পারতাম পেশাদারদের [ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রভৃতি] রফতানি করছি। এগুলো কিন্তু সেই মানসিকতারই ফল।
আজ অন্য দেশের ফ্ল্যাগ বা পতাকা উড়িয়ে উল্লসিত হচ্ছে জনগণ, বলতে পারেন তা স্পোর্টস ম্যানিয়া। কিন্তু তা যে পুরোপুরি নয়, আগেই তা উল্লেখ করছি। আমাদের এখানে এক সময় ফুটবল ছিল রমরমা। এখন নেই। এখন ক্রিকেটের রমরমা। এই ক্রিকেটকে ধরে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে চায়, আশা করে। কিন্তু মিডিয়ার কারণে অতি মূল্যায়িত বাংলাদেশী ক্রিকেটাররা এইসব ভক্তকে এবং সাধারণকে অপমানই করেন। আমরা তো কোথাও সম্মানিত হই না। রাজনীতিবিদরা তাঁদের কর্মকা-ের মাধ্যমে আমাদের অপমানিত করেন, আমলারা অপমানিত করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপমানিত করেন, খেলোয়াড়রা অপমান করেন আর ব্যবসায়ীরা বিষমিশ্রিত খাবার খাইয়ে গণহত্যায় যোগ দেন। এসব কিছু এমন মানসিকতা তৈরি করে যা নিজ দেশ থেকে বাইরের সব কিছু তার কাছে ভাল লাগে, সম্মানজনক মনে হয়, গৌরবের মনে হয়। সব সময় যে এক ধরনের অনিরাপত্তায় ভোগা ও অন্যকে আঁকড়ে নিরাপত্তা পেতে চায়। বিদেশে সবাই যে অর্থনৈতিক কারণে অভিবাসী হচ্ছে তা তো নয়। রাজনীতিবিদ, আমলা বা ব্যবসায়ীরা যে মালয়েশিয়া বা কানাডায় টাকা পাচার করে সেকেন্ড হোমের সার্র্টিফিকেট কিনেছেন তা এই মানসিকতারই কারণে।
তবে, সবাই একই মানসিকতায় আবদ্ধ তা নয়। এই মানসিকতা থেকে বেরুবার চেষ্টাও অনেকে করেন, করছেন, না হলে তো ভৌগলিকভাবেই দেশটি উপনিবেশ হয়ে যেত। যেমন, চরম গড্ডলিকা প্রবাহের সময়ও যশোরের জেলা প্রশাসক পতাকা নামিয়ে ফেলার আদেশ জারি করেছিলেন। এই তরুণকে চিনি না কিন্তু সাহসের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তাকে হয়ত বদলি করা হবে, খানিকটা নাজেহালও হতে হবে কিন্তু মানুষ হিসেবে সমাজ তাকে জায়গা করে দেবে। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোকাম্মেল এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি করতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি টিনের ঘরে এখনও বসবাস করেন। এবং তা অগৌরবের মনে করেন না। আসলে এসব মানুষ প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্রয় পেলে হয়ত খানিকটা পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতো মানসিকতায়।
আমরা পতাকা পেয়েছি, পতাকা বহিবার শক্তিটা যেন পাই এবং তা যেন অক্ষুণ্ন থাকে-এই কামনাই করি শেষ বয়সে।
ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনের ফলে যে আদর্শ গড়ে উঠেছিল যাঁরা এর চর্চা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আদর্শগত বেশ কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল যার মধ্যে প্রধান ছিল স্ববিরোধিতা।
ঐতিহ্য আবিষ্কার করতে গিয়ে হিন্দুরা প্রাচীনকালের ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করে তুলেছিলেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনে যে তাঁরাই সম্প্রদায়গতভাবে প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন এ কথা তাঁরা মনে রাখলেন। লেখক-সাংবাদিকরা এ মনোভাবই ব্যক্ত করেছিলেন ঘুরেফিরেÑ আক্রমণাত্মক এবং উদ্ধতভাবে। ভারতে আগত মুসলমানদের তারা চিহ্নিত করেছিলেন আক্রমণকারীরূপে কিন্তু ইংরেজরাও যে আক্রমণকারী এবং শাসক ও লুটেরা সে সব কথা তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন।
অন্যদিকে মুসলমানরা ঐতিহ্য খুঁজতে গিয়ে নিজেদের আবিষ্কার করেছিলেন আগন্তুক হিসেবে। এবং ঔপনিবেশিক আমলে দেখা গেল, তাঁরা শুধু রায়ত এবং রায়ত হিসেবে তাঁরা কোন মর্যাদার অধিকারী নন। তখন তিনি আবিষ্কার করেছিলেন নিজ সম্প্রদায় এবং নিজ ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছিলেন ইরান তুরানে।
পাকিস্তান বা দ্বিতীয় ঔপনিবেশিক আমলেও দুই সম্প্রদায়ের মানসিকতায় তেমন একটা মৌলিক পরিবর্তন হয়নি, হিন্দুরা শুধু একটু হীনবল হয়ে গিয়েছিল মাত্র। এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের মনে এই ধারণা বলবৎ করার চেষ্টা করা হলো যে, তারা সাচ্চা মুসলমান নয়, তারা হিন্দুঘেঁষা মসুলমান। সুতরাং সাচ্চা মুসলমান হতে হলে পাক্কা মুসলমান হতে হবে। বাঙালীদের একাংশ যে ‘সাচ্চা মুসলমান’ হতে চায়নি তা নয়। তার প্রমাণ ১৯৭১ সাল। বাঙালী মুসলমানদের একটি অংশ ও বিহারীরা পাকিস্তানী প্রভুদের হয়ে যেভাবে এ ভূখণ্ডে হত্যাকা- চালিয়েছে তার দ্বিতীয় নজির নেই। এর বিপরীত ধারা যে ছিল না তা নয়। ১৯৪৮ সালে উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক যে ধারা তৈরি হয়েছিল ১৯৭১ সালে তাই জয়লাভ করে। কিন্তু সে ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আবার পাকিস্তানী ধারার প্রবর্তন হয়, যে ধারা পুষ্ট করেন জেনারেল এরশাদ ও জিয়াপত্নী খালেদা।
আরও পরে জেনারেল মইন উদ্দীন। দু’টি জেনারেশনকে সেই পাকিস্তানী ধারায় বড় হতে হয়েছে যেমনটি হতে হয়েছিল আমাদের। এর বিপরীত ধারা অগ্রসর হয়েছে বটে তবে তা আগের মতো প্রবল নয়। আদর্শিক দিক থেকেও অনেকটা সরে গেছে।
তা হলে গত ৩০০ বছরের নিট ফলটা কী ? নিট ফল হলো, এমন এক জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে এ ভূখণ্ডে যার মানসিক গড়নে কলোনির বাসিন্দাদের মানসিকতায় ক্ষুদ্র একটি অংশ হলেও বিরাজ করছে। হেজাবিরা হলো এ ধারার নেতা। এবং আমরা, যাদের অবস্থান এর বিপরীতে তাদের মনের গহীন কন্দরে হেজাবির একটি অংশ এখনও রয়ে গেছে। আমাদের মানসিকতা লক্ষ্য করুন। কয়েকটি উদাহরণ-
১. কোন দেশে জাতির পিতা বা স্বাধীনতার ঘোষক বা দেশের স্থপতিদের নিয়ে কোন নিতর্ক নেই। বাংলাদেশে আছে। এমনকি ভারত, যেখানে আরএসএস সদস্য নাথুরাম গডসে হত্যা করেছিলেন জাতির পিতা গান্ধীকে সেই আরএসএস সমর্থক নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমেই শ্রদ্ধা অর্পণ করেছেন রাজঘাটে।
২. কোন দেশে বিজয়ী শক্তি পরাজিত শক্তিকে সম্মানের সঙ্গে ডেকে এনে ক্ষমতায় বসায়নি। এ কাজটি করেছেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত, পাকিস্তানী মানসিকতার প্রতিভূ জিয়াউর রহমান। এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।
৩. সুদীর্ঘ ২০ বছর এদেশের মানুষের একটা বড় অংশ এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষক জাতির পিতা বিতর্কে সোৎসাহে অংশ নিয়েছে।
৪. ১৯৭৫-এর ঘটনা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, এমনকি যাঁরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁদের একটা বড় অংশ তা মেনে নিয়েছিলেন।
৫. সরকারীভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য পৃথিবীতে আর কোন সরকার বদলায়নি।
এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। দেব না। মূল বিষয় হলো, জাতি ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া কি সম্পন্ন হয়েছিল? এমএ মুহিত লিখেছেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কিন্তু পাকিস্তানী প্রভাব এখনও শক্তিশালী।”
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পূর্ব ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন করা যায়, জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সব প্রশ্নের কি নিরসন হয়েছিল? বা সে প্রক্রিয়া কি সম্পূর্ণ হয়েছিল? এমএ মুহিতের মন্তব্য বা আমি যে উদাহরণগুলো দিলাম তা বিশ্লেষণ করে কি বলা যায় না বা প্রশ্ন তোলা যায় না যে, জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত সব প্রশ্নের নিরসন হয়নি বা সে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। ১৯৭৫-২০০৫ এবং ২০১২ সালের প্রাক-নির্বাচনী ঘটনাবলী আবার প্রমাণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। বিষয়টি হয়ত তাত্ত্বিক দিক থেকে জটিল কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তত্ত্ব ও বাস্তব মেলানো মাঝে মাঝে দুরূহ।
ব্রিটিশ আমলে বাঙালীর বিশেষ করে বাঙালী উচ্চবর্গের চরিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তোষামোদ; যার অন্য অর্থ হতে পারে হীনম্মন্যতা। উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের বিখ্যাত সাপ্তাহিক গ্রামবার্তা প্রকাশিকায় কাঙাল হরিনাথ লিখেছিলেন- “জমিদার প্রজাদিগের পিতা-মাতাস্বরূপ ও সহায়সম্পদ, ইহা সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিবেন।”
রানী ভিক্টোরিয়া ছিলেন সবার মাতা। ময়মনসিংহের পরিচিত ব্রাহ্ম কালীকৃষ্ণ ঘোষ ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতসমাজ্ঞী উপাধি গ্রহণ করলে একটি গীত রচনা করেছিলেন, যার শেষ চারটি চরণ ছিল এ রকম-
“দয়াবতী মহারানী
মোদের জননী যিনি
রাজ রাজেশ্বরী তিনি
আর কারে করি ভয়।”
সিলেটের তৎকালীন বিখ্যাত কবি রামকুমার নন্দী পেনশন পাওয়ার পর রানী ভিক্টোরিয়ার উদ্দেশে লিখেছিলেন-
“সেবি-বহুদিন, ভক্তি সহকারে
ভারতসম্রাজ্ঞী জননী পায়
বৃদ্ধকালে পুনঃ যাহার কৃপায়
হইল এখন জীবনোপায়।”
যে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা জমিদার ও নীলকরদের [জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারেরও] বিরুদ্ধে লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তারই সম্পাদক হরিনাথ মজুমদার লিখেছিলেন, ভাইসরয় যেন একবার পূর্ববঙ্গ সফরে আসেন, কারণ তা হলে এখানকার প্রজারা সচক্ষে একবার রানীর প্রতিনিধিকে দেখতে পাবে। ভাইসরয় রিপন কলকাতা ফেরার পথে পোড়াদহ স্টেশনে কিছুক্ষণের জন্যে থেমেছিলেন। তখন কাঙাল হরিনাথ ওরফে হরিনাথ মজুমদার ও তাঁর বাউল দল রিপনের জন্য বিশেষভাবে রচিত গান গাইবার জন্য স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সহবাস সম্পত্তি আইনের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন কায়কোবাদ-
“কোথা গো মা ভিক্টোরিয়া, হের একবার
কোটি কোটি কন্যা তব করিছে রোদন।...
আজি এ বিপদে পড়ে ডাকি মা তোমায়,
কোথা তুমি এ সময়? দেও গো ‘অভয়’।...’’
স্তরবদ্ধ সমাজে শোষণ ও শাসনের কেন্দ্রমূল কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে যায়। ফলে, দূরবর্তী শাসক/শোষক, নিকটবর্তী শাসক/শোষক থেকে অধিকতর মহিমান্বিত ও মানবিক গুণসম্পন্ন বলে প্রতিভাত। সেই ঐতিহ্য, সেই দাসসুলভ মনোভাব, স্টাবলিশমেন্ট প্রীতি এখনও অক্ষুণ্ন। সব আমলের মন্ত্রিবর্গ তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আচরণ দেখুন। কয়েকদিন আগে এক সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমেদ যেভাবে তারেক রহমান ও তাঁর ‘সম্পাদিত বইয়ের’ গুণকীর্তন করলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে লজ্জা হয় যে, তিনি এক সময় আমাদের উপাচার্য ছিলেন। সবাই জানে যে, যে অর্বাচীন ঐ তরুণের কোন ক্ষমতা নেই একটি বই সম্পাদনা করার বা লেখার। সেটি জেনেও যখন কেউ এমন বলেন তখন কিভাবে বলি মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে?
এসব কিছু মিলে আমরা এমন এক মনোজগৎ সৃষ্টি করেছি, যেখানে পরস্পরবিরোধিতা, ধর্ম, কলোনির মানসিকতাÑসব মিলিয়ে একটি বিভ্রান্ত বা গোলমেলে মানসিকতা তৈরি হয়েছে। এর ওপর লিবারেল শিক্ষাব্যবস্থা সংকোচন, জাতীয় ইতিহাস না পড়ানো বা উপেক্ষা করা আরও হীনম্মন্যতা, শিকড়হীনতা তৈরি করেছে। ১৯৭২ সালে কেউ দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্তু যদি পাশ্চাত্য ও আমেরিকা ভিসা উঠিয়ে দেয় তা হলে বাংলাদেশ জনশূন্য হয়ে যাবে।
শেকড়হীন, নিরাপত্তাহীন, রক্ষণশীলতা, হেজাবি/কলোনি মানসিকতার ঐতিহ্য সব মিলিয়ে এমন এক মনোজগৎ তৈরি হয়েছে যা থেকে মুক্তি না পেলে ৬ ভাগ জিডিপি বৃদ্ধিতে কিছুই আসে যাবে না। বাড়তি জনসংখ্যা গর্বের বিষয়, বলেন নীতিনির্ধারকরা। হতে পারে। কিন্তু বলার সময় ভাবেন না দেশটি কতটুকু, সম্পদ কতটুকু। সাধারণ শ্রমিক প্রেরণ, ভৃত্য প্রেরণ, ঝাড়দার-ঝাড়ুদারনী প্রেরণে আমরা উল্লসিত হয়ে উঠি- কী জনসংখ্যা রফতানি করছি। উল্লসিত হতাম যদি বলতে পারতাম পেশাদারদের [ডাক্তার, প্রকৌশলী প্রভৃতি] রফতানি করছি। এগুলো কিন্তু সেই মানসিকতারই ফল।
আজ অন্য দেশের ফ্ল্যাগ বা পতাকা উড়িয়ে উল্লসিত হচ্ছে জনগণ, বলতে পারেন তা স্পোর্টস ম্যানিয়া। কিন্তু তা যে পুরোপুরি নয়, আগেই তা উল্লেখ করছি। আমাদের এখানে এক সময় ফুটবল ছিল রমরমা। এখন নেই। এখন ক্রিকেটের রমরমা। এই ক্রিকেটকে ধরে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে চায়, আশা করে। কিন্তু মিডিয়ার কারণে অতি মূল্যায়িত বাংলাদেশী ক্রিকেটাররা এইসব ভক্তকে এবং সাধারণকে অপমানই করেন। আমরা তো কোথাও সম্মানিত হই না। রাজনীতিবিদরা তাঁদের কর্মকা-ের মাধ্যমে আমাদের অপমানিত করেন, আমলারা অপমানিত করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপমানিত করেন, খেলোয়াড়রা অপমান করেন আর ব্যবসায়ীরা বিষমিশ্রিত খাবার খাইয়ে গণহত্যায় যোগ দেন। এসব কিছু এমন মানসিকতা তৈরি করে যা নিজ দেশ থেকে বাইরের সব কিছু তার কাছে ভাল লাগে, সম্মানজনক মনে হয়, গৌরবের মনে হয়। সব সময় যে এক ধরনের অনিরাপত্তায় ভোগা ও অন্যকে আঁকড়ে নিরাপত্তা পেতে চায়। বিদেশে সবাই যে অর্থনৈতিক কারণে অভিবাসী হচ্ছে তা তো নয়। রাজনীতিবিদ, আমলা বা ব্যবসায়ীরা যে মালয়েশিয়া বা কানাডায় টাকা পাচার করে সেকেন্ড হোমের সার্র্টিফিকেট কিনেছেন তা এই মানসিকতারই কারণে।
তবে, সবাই একই মানসিকতায় আবদ্ধ তা নয়। এই মানসিকতা থেকে বেরুবার চেষ্টাও অনেকে করেন, করছেন, না হলে তো ভৌগলিকভাবেই দেশটি উপনিবেশ হয়ে যেত। যেমন, চরম গড্ডলিকা প্রবাহের সময়ও যশোরের জেলা প্রশাসক পতাকা নামিয়ে ফেলার আদেশ জারি করেছিলেন। এই তরুণকে চিনি না কিন্তু সাহসের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তাকে হয়ত বদলি করা হবে, খানিকটা নাজেহালও হতে হবে কিন্তু মানুষ হিসেবে সমাজ তাকে জায়গা করে দেবে। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোকাম্মেল এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি করতে পেরেছিলেন। কারণ তিনি টিনের ঘরে এখনও বসবাস করেন। এবং তা অগৌরবের মনে করেন না। আসলে এসব মানুষ প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্রয় পেলে হয়ত খানিকটা পরিবর্তন আনতে সহায়ক হতো মানসিকতায়।
আমরা পতাকা পেয়েছি, পতাকা বহিবার শক্তিটা যেন পাই এবং তা যেন অক্ষুণ্ন থাকে-এই কামনাই করি শেষ বয়সে।
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment