পোর্ট্রেইট অব এ্যা ‘ফ্রিডম ফাইটার’
রাখাল চন্দ্র মিত্র
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের দিন থেকেই নয়া পাকি ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালীর স্বাধিকার ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের তথা মুক্তি সংগ্রামের সূচনা। আটচল্লিশের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলন (বায়ান্নর চূড়ান্ত বিজয়) থেকে শুরু হয়ে চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্ন-আটষট্টি দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক একটি মাইলফলক। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম ও ইতিহাস দুটি কালপর্বে বিভক্ত। প্রথমটি সাতচল্লিশ থেকে সত্তর যা রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামের পর্ব। দ্বিতীয়টি একাত্তর পর্ব (২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত) বা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর্ব।
কথিত এবং স্বীকৃত এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প বয়ান করব যার অস্তিত্ব এবং উপস্থিতি সমগ্র মুক্তি সংগ্রাম পর্বের (৪৭ থেকে ৭০) কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না। এমনকি ৭ মার্চ মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যা শুরু পর্যন্ত যিনি ছিলেন অদৃশ্যমান। অবশ্য সমগ্র জাতি যখন যার যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত তখন এই ভদ্রলোককে দেখা যাবে পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা (আইএসআই) অফিসার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জাহাজ এমভি সোয়াত থেকে গণহত্যায় ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র খালাসের উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে। পথিমধ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ব্যারিকেডের মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ‘ডব জবাড়ষঃ’-এর ঘোষণা দেন যা ছিল তাঁর আত্মরক্ষার বাহানা মাত্র। ঐ রাতের পরের ঘটনা আরও রহস্যজনক ও মর্মান্তিক। একদিকে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালী সৈনিকরা সদলবলে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। এই সময় রাত ১টা থেকে ১.৩০ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. ক. জানজুয়া তার অধস্তন টুআইসি মেজরকে যে কোন কৌশলে বাঙালী সৈনিকদের বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। বসের নির্দেশ পেয়ে পাক সেনা গোয়েন্দা দফতরের বিশ্বস্ত ও চৌকস অফিসার সেই মেজর সাহেব তাঁর অধীন সৈনিকদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেন এবং বলেন, বিদ্রোহের সময় এখনও আসেনি। সময় এবং প্রয়োজন হলে তাঁর নেতৃত্বেই বিদ্রোহ হবে। সুতরাং আপনারা অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করে বিশ্রামে যান। সৈনিকরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করে অস্ত্র সংবরণ করে ঘুমাতে যান। পরে রাত ২টা থেকে ২.৩০টার মধ্যে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত ১৮০০ বাঙালী সৈনিকের ওপর মাত্র ৫০০ বালুচ ও পাঞ্জাবী সৈন্য অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এবং সর্বমোট ১২০০ এর অধিক সৈনিক তাঁদের পরিবার ও শিশুসহ নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন। আর মেজর সাহেব কতিপয় বিশ্বস্ত সৈনিক নিয়ে ঐ রাতে চট্টগ্রাম রণাঙ্গন থেকে পলায়ন করেন। এ যেন পলাশীর সেই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি। যেখানে মীর মদন-মোহনলালরা প্রচ- বিক্রমে ইংরেজ সেনাদের (ক্লাইভ বাহিনী) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ঠিক সেই সময় নবাবের সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ একইভাবে বিশ্রামের অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধ বিরতির আদেশ দিয়ে সৈন্যদের ব্যারাকে পাঠান। সেই সুযোগে ক্লাইভ বাহিনী গভীর রাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে বিশ্রামরত ও ঘুমন্ত নবাব বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ও তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব ধ্বংস করার লক্ষ্যে মুজিব নগর সরকারকে উৎখাত করে তদস্থলে ওসমানী ও তার নেতৃত্বে ‘ধিৎ ঈড়ঁহপরষ’ গঠনের মাধ্যমে সামরিক ক্যু করে মুক্তিযুদ্ধের সামরিকীকরণের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু ওসমানীর অনীহা এবং খালেদ মোশারফসহ অন্য সেক্টর কমান্ডারদের প্রবল বিরোধিতার কারণে সেই ষড়যন্ত্র ভেসে যায়। তবে পরবর্তীকালে ’৭৫-এর আগস্টে তিনি তাঁর সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন।
যে কোন যুদ্ধে পঞ্চম বাহিনীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পৌরাণিক যুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধ সর্বক্ষেত্রেই এদের দেখা মেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্ব ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় বাঙালী অফিসার ‘পঞ্চম বাহিনী’ হিসেবে যোগ দেন। ফারুক-রশিদ-ডালিমসহ এই অফিসাররা কথিত ঐ মেজর মুক্তিযোদ্ধার শেলটারে অবস্থান করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নামে নানা রকম ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেবশকারী সকল পাকি গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধকে সাবোটাজ করার জন্য তার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারকে চ্যালেঞ্জ করায় কথিত মুক্তিযোদ্ধা মেজরও একই অপরাধে অপরাধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় তিনি অবধারিত কোর্টমার্শালের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। আর স্বাধীনতা ঘোষণা? বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যতীত স্বাধীনতা ঘোষণা এমনকি ঘোষণাপত্র পাঠের পরিণাম হতো সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সেনা বিদ্রোহের অপরাধে অবধারিত কোর্টমার্শাল।
শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন, যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর কর্মকাণ্ডে পাকি গুপ্তচর বৃত্তির সাক্ষ্য মিলবে। এ সাক্ষ্যের একটি পটভূমি জেনে নেয়া যাক। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ কালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদম্ভ ঘোষণা করেছিলেন যে পূর্ব রণাঙ্গনে কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করা হলেও পশ্চিম রণাঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। একপর্যায়ে পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল বিভ্রান্ত জুনিয়র সেনা অফিসারদের দ্বারা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের পাক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। সামনে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক এবং কতিপয় মেজর থাকলেও পেছনের ষড়যন্ত্রকারী মদদদাতা ছিলেন গল্পের নায়ক সেই মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল ফারুক-রশিদের সাক্ষাতকার ও জবানবন্দী থেকে জানা যায়, তিনি প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং বলেছিলেন ‘গো এ্যাহেড।’ সফল হলে তিনি তাঁদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের প্রক্রিয়া থেকে রেহাই দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার জন্য বিএনপি নামক দলটি গঠন করা হয়। ‘আইএসআই’-এর নেপথ্য প্রযোজনায় পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক জামায়াতে ইসলামী, পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, চীনা ঘরানার উগ্র বামপন্থী সর্বহারা গোষ্ঠী, পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন কিছু বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা পাকি গুপ্তচর (পঞ্চম বাহিনী) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন- এই দলটির ব্যানারে সংঘবদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত হয়।
লেখক : শিক্ষক।
কথিত এবং স্বীকৃত এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প বয়ান করব যার অস্তিত্ব এবং উপস্থিতি সমগ্র মুক্তি সংগ্রাম পর্বের (৪৭ থেকে ৭০) কোথাও আবিষ্কার করা যাবে না। এমনকি ৭ মার্চ মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক, অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যা শুরু পর্যন্ত যিনি ছিলেন অদৃশ্যমান। অবশ্য সমগ্র জাতি যখন যার যার অবস্থান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত তখন এই ভদ্রলোককে দেখা যাবে পাকিস্তান সেনা গোয়েন্দা (আইএসআই) অফিসার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জাহাজ এমভি সোয়াত থেকে গণহত্যায় ব্যবহারযোগ্য অস্ত্র খালাসের উপলক্ষে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে। পথিমধ্যে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ব্যারিকেডের মুখে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ‘ডব জবাড়ষঃ’-এর ঘোষণা দেন যা ছিল তাঁর আত্মরক্ষার বাহানা মাত্র। ঐ রাতের পরের ঘটনা আরও রহস্যজনক ও মর্মান্তিক। একদিকে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ইপিআর বাহিনী প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালী সৈনিকরা সদলবলে বিদ্রোহ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। এই সময় রাত ১টা থেকে ১.৩০ মিনিটের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. ক. জানজুয়া তার অধস্তন টুআইসি মেজরকে যে কোন কৌশলে বাঙালী সৈনিকদের বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেন। বসের নির্দেশ পেয়ে পাক সেনা গোয়েন্দা দফতরের বিশ্বস্ত ও চৌকস অফিসার সেই মেজর সাহেব তাঁর অধীন সৈনিকদের অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেন এবং বলেন, বিদ্রোহের সময় এখনও আসেনি। সময় এবং প্রয়োজন হলে তাঁর নেতৃত্বেই বিদ্রোহ হবে। সুতরাং আপনারা অবিলম্বে অস্ত্র সমর্পণ করে বিশ্রামে যান। সৈনিকরা তাঁর কথায় বিশ্বাস করে অস্ত্র সংবরণ করে ঘুমাতে যান। পরে রাত ২টা থেকে ২.৩০টার মধ্যে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত ১৮০০ বাঙালী সৈনিকের ওপর মাত্র ৫০০ বালুচ ও পাঞ্জাবী সৈন্য অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এবং সর্বমোট ১২০০ এর অধিক সৈনিক তাঁদের পরিবার ও শিশুসহ নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন। আর মেজর সাহেব কতিপয় বিশ্বস্ত সৈনিক নিয়ে ঐ রাতে চট্টগ্রাম রণাঙ্গন থেকে পলায়ন করেন। এ যেন পলাশীর সেই ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি। যেখানে মীর মদন-মোহনলালরা প্রচ- বিক্রমে ইংরেজ সেনাদের (ক্লাইভ বাহিনী) বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ঠিক সেই সময় নবাবের সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ একইভাবে বিশ্রামের অজুহাত দেখিয়ে যুদ্ধ বিরতির আদেশ দিয়ে সৈন্যদের ব্যারাকে পাঠান। সেই সুযোগে ক্লাইভ বাহিনী গভীর রাতে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে বিশ্রামরত ও ঘুমন্ত নবাব বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়ও তিনি প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। যুদ্ধকালীন রাজনৈতিক ও বেসামরিক নেতৃত্ব ধ্বংস করার লক্ষ্যে মুজিব নগর সরকারকে উৎখাত করে তদস্থলে ওসমানী ও তার নেতৃত্বে ‘ধিৎ ঈড়ঁহপরষ’ গঠনের মাধ্যমে সামরিক ক্যু করে মুক্তিযুদ্ধের সামরিকীকরণের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু ওসমানীর অনীহা এবং খালেদ মোশারফসহ অন্য সেক্টর কমান্ডারদের প্রবল বিরোধিতার কারণে সেই ষড়যন্ত্র ভেসে যায়। তবে পরবর্তীকালে ’৭৫-এর আগস্টে তিনি তাঁর সেই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হন।
যে কোন যুদ্ধে পঞ্চম বাহিনীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। পৌরাণিক যুদ্ধ থেকে বিশ্বযুদ্ধ সর্বক্ষেত্রেই এদের দেখা মেলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্ব ডিসেম্বরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় বাঙালী অফিসার ‘পঞ্চম বাহিনী’ হিসেবে যোগ দেন। ফারুক-রশিদ-ডালিমসহ এই অফিসাররা কথিত ঐ মেজর মুক্তিযোদ্ধার শেলটারে অবস্থান করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নামে নানা রকম ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। এ সব ঘটনা প্রমাণ করে তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেবশকারী সকল পাকি গুপ্তচর। মুক্তিযুদ্ধকে সাবোটাজ করার জন্য তার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারকে চ্যালেঞ্জ করায় কথিত মুক্তিযোদ্ধা মেজরও একই অপরাধে অপরাধী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বদান্যতায় তিনি অবধারিত কোর্টমার্শালের হাত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। আর স্বাধীনতা ঘোষণা? বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যতীত স্বাধীনতা ঘোষণা এমনকি ঘোষণাপত্র পাঠের পরিণাম হতো সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও সেনা বিদ্রোহের অপরাধে অবধারিত কোর্টমার্শাল।
শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় কেন, যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর কর্মকাণ্ডে পাকি গুপ্তচর বৃত্তির সাক্ষ্য মিলবে। এ সাক্ষ্যের একটি পটভূমি জেনে নেয়া যাক। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ কালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদম্ভ ঘোষণা করেছিলেন যে পূর্ব রণাঙ্গনে কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসরণ করা হলেও পশ্চিম রণাঙ্গনে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। একপর্যায়ে পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল বিভ্রান্ত জুনিয়র সেনা অফিসারদের দ্বারা সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধারের পাক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। সামনে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক এবং কতিপয় মেজর থাকলেও পেছনের ষড়যন্ত্রকারী মদদদাতা ছিলেন গল্পের নায়ক সেই মুক্তিযোদ্ধা। বঙ্গবন্ধুর খুনী কর্নেল ফারুক-রশিদের সাক্ষাতকার ও জবানবন্দী থেকে জানা যায়, তিনি প্ল্যান সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন এবং বলেছিলেন ‘গো এ্যাহেড।’ সফল হলে তিনি তাঁদের রক্ষা করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। দায়মুক্তির অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের প্রক্রিয়া থেকে রেহাই দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগকে মোকাবেলা করার জন্য বিএনপি নামক দলটি গঠন করা হয়। ‘আইএসআই’-এর নেপথ্য প্রযোজনায় পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক জামায়াতে ইসলামী, পাক হানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, চীনা ঘরানার উগ্র বামপন্থী সর্বহারা গোষ্ঠী, পাকিস্তানী ধ্যানধারণায় আচ্ছন্ন কিছু বিভ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা যাঁরা পাকি গুপ্তচর (পঞ্চম বাহিনী) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন- এই দলটির ব্যানারে সংঘবদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশকে দ্বিজাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত হয়।
লেখক : শিক্ষক।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-06-03&ni=174849
No comments:
Post a Comment