Monday, June 2, 2014

অপরিকল্পিত নগরায়নে সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার

অপরিকল্পিত নগরায়নে সৌন্দর্য হারাচ্ছে কক্সবাজার
জসীম চৌধুরী সবুজ
প্রকাশ : ০৩ জুন, ২০১৪

পর্যটন নগরী কক্সবাজার এখন যেন অভিভাবকহীন। এখানকার সুখ-দুঃখ, অভাব অভিযোগ, সমস্যা সম্ভাবনা এসব দেখার কেউ নেই। যে যার মতো যেভাবে খুশি সেভাবেই যত্রতত্র নির্মাণ করে যাচ্ছে বহুতল হোটেল মোটেল, স্টুুডিও অ্যাপার্টমেন্টসহ নানা ধরনের স্থাপনা। এসব ভবনের গুণগত মান বা প্ল্যান দেখার কেউ নেই। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ কিছু কিছু ভবনের নির্মাণ কাজের অনুমতি দিয়ে দায় সারছে। পৌর এলাকার বাইরে যেসব স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে তাদের কোনো অনুমতি নেই বা নিয়মনীতি পালনের কোনো বালাইও নেই। একদা পরিচ্ছন্ন শহর কক্সবাজার হালে পরিণত হয়েছে নোংরা ময়লা-আবর্জনার শহরে। মূল শহরের প্রধান সড়কগুলো এবং অলিগলি এখন এবড়োখেবড়ো। অসংখ্য খানাখন্দে ভর্তি এসব সড়ক উপসড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল যেমন মারাÍক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে তেমনি সাধারণ মানুষের হেঁটে চলাও দুষ্কর। শহরটিতে যানবাহন চলাচলেও নেই কোনো শৃংখলা। ব্যাটারিচালিত টমটমে ছেয়ে গেছে পুরো শহর। পর্যটকদের আকর্ষণে এখানে নেই কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা। সন্ধ্যার পর শহরের অধিকাংশ এলাকা চলে যায় ছিনতাইকারীদের নিয়ন্ত্রণে। গত ক’বছরে ছিনতাইকারীদের হাতে হতাহত হয়েছেন বেশ ক’জন পর্যটক। কক্সবাজার পৌর কর্তৃপক্ষ পৌরকর আদায়ের কাজ ছাড়া গত ক’বছরে শহরের উন্নয়ন কাজে কোনো হাতই দেয়নি। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকতকে বুকে ধারণ করা এ কক্সবাজারে অপরিকল্পিত নগরায়ন বন্ধে সরকার কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে পৃথক একটি সংস্থা গড়ার সিদ্ধান্ত নিলেও তার কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রতিনিধিদের নিয়ে আপাতত একটি কমিটি করা হলেও সেটি কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। হোটেল মোটেল জোন কলাতলিতে গত ক’বছরে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা অসংখ্য হোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজসহ নানা ভবন নির্মাণের কারণে বর্তমানে পর্যটন এলাকার বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। অপরিকল্পিত এসব স্থাপনার কারণে দিন দিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পাশাপাশি সৃষ্টি হয়েছে রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা। প্রধান সড়ক, বিচ রোড বা হোটেল মোটেল জোনের কোনো সড়কে নেই নালা-নর্দমা। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় হোটেলের ময়লা-আর্বজনার পানি এসে পড়ছে সড়কের ওপর। অধিকাংশ সময় সড়কগুলো ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে। পর্যটন এলাকার লাবনী পয়েন্ট থেকে সি-ইন পয়েন্ট পর্যন্ত সড়কটির আরও বেহাল অবস্থা। ওই এলাকার তারকা মানের হোটেলগুলোরও নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সড়কগুলোই যেন বর্জ্য ফেলার ভাগাড়। নোংরা বর্জ্যরে দুর্গন্ধে সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয় মুখে রুমাল চেপে। প্রতিটি সড়কের বিশাল অংশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় খানাখন্দের। যে কারণে যানবাহন চলাচল দূরের কথা মানুষের হেঁটে চলাও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। খানাখন্দে পড়ে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, দীর্ঘকাল ধরে পর্যটন এলাকার সি গ্যাল পয়েন্ট, লাবনী পয়েন্ট, ছাতা মার্কেট, হোটেল মোটেল গেস্ট হাউস এলাকার লাইট হাউস পাড়া, সৈকত পাড়াসহ প্রধান সড়কের পাশাপাশি উপসড়কগুলোর বেহাল অবস্থা হলেও কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা প্রশাসনের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণেও নেই কোনো তদারকি। যে কারণে যে যার মতো অপরিকল্পিতভাবে স্থাপনা তৈরির সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। পর্যটন নগরী ও বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত হিসেবে খ্যাত কক্সবাজার থেকে সরকার বছরে পর্যটন খাতে ২০০ কোটি টাকার উপরে রাজস্ব আদায় করলেও এই শহরের উন্নয়নে নেই কোনো বিশেষ বরাদ্দ। শহরের প্রধান সড়কটির বেহাল অবস্থা দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না এটি পর্যটন নগরী। অপরিকল্পিত ভবন গড়ে ওঠার কারণে এবং রাস্তার কোনো পাশেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় একটু বৃষ্টি হলেই শহরটির মূল সড়কগুলো তলিয়ে যায় পানির নিচে। পর্যটন এলাকায় গড়ে উঠা ২ শতাধিক হোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজের মধ্যে কোথাও ড্রেনেজ ব্যবস্থার মাধ্যমে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না রাখায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ সুযোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অসাধু মালিক পক্ষ সেপটিক ট্যাংক ছেড়ে দিয়ে বর্জ্য ময়লা আর্বজনা রাস্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের চরম বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। শহরের প্রধান সড়কে ফুটপাত না থাকার কারণে ভয়াবহ যানজটের দৃশ্য নিত্যদিনের। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি নিষ্কাসনের ব্যবস্থা না থাকায় সড়কসহ পুরো শহর পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
কক্সবাজার সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লুৎফর রহমান কাজল যুগান্তরকে জানান, কক্সবাজার থেকে সরকার বছরে ২০০ কোটি টাকার উপরে রাজস্ব আদায় করছে। কিন্তু পর্যটন খাতের উন্নয়নে বা পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে সরকারের কোনো বিশেষ বরাদ্দ এখানে নেই। পর্যটন নগরী হিসেবে যে পরিমাণ রাস্তাঘাট প্রয়োজন তা যেমন নেই তেমনি ফুটপাত নালা নর্দমা কিছুই নেই। সরকারের কোনো নীতিমালা না থাকায় এখানে অপরিকল্পিত নগরায়ন হচ্ছে সরকার, প্রশাসন জনপ্রতিনিধি মিলে এ ব্যাপারে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোঃ রুহুল আমিন জানান, যা হয়ে গেছে সে ব্যাপারে আপাতত করার কিছু নেই। তবে, নতুনভাবে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সব কিছু পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
পর্যটন এলাকার হোটেল সামস প্লাজার পরিচালক এইচএম নুরুল আলমসহ একাধিক হোটেল মালিকের অভিযোগ তারা প্রতিনিয়ত পৌরকর পরিশোধ করলেও পৌর কর্তৃপক্ষ সড়ক উন্নয়নে কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। যে কারণে তারা সর্বদাই দেশী-বিদেশী পর্যটকের পাশাপাশি বিশ্বের কাছে এ পর্যটন শহরের রাস্তাঘাট নিয়ে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন। কক্সবাজার প্রধান সড়কের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সংবাদপত্র এজেন্ট মোহাম্মদ হাশিম বলেন, শহরের যত্রতত্র ভবন নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। কিন্তু পরিকল্পিত নয়। কক্সবাজারে যারা বেড়াতে আসেন তাদের জন্য নেই কোনো বিনোদন ব্যবস্থা। সন্ধ্যার পর সৈকত থেকে হোটেল রুমে ফিরে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। ফলে একদিনের বেশি কোনো পর্যটক এখানে থাকতে চান না।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র সরওয়ার কামাল জানান, প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাবে রাস্তার উন্নয়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া হোটেল, মোটেলসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো পৌরকরও পরিশোধ করে না বলে পৌরসভা তহবিল সংকটে কোনো কাজে হাত দিতে পারছে না।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/06/03/107008#sthash.rZzQoYEy.dpuf

No comments:

Post a Comment