বায়ান্নতে সাফল্যের কারণ দলমত নির্বিশেষে একাত্ম হওয়া
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪
আপনার শৈশব কেমন কেটেছিল? আপনি তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। খান সরওয়ার মুরশিদ তো আপনার এলাকার লোক ছিলেন।
: শৈশব তো আমার গ্রামে কেটেছে। আমার পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাব-ডিভিশন, নবীনগর থানায়। ছেলেবেলাটায় গ্রামে থাকতাম। এটা বলা ঠিক নয়, তবু বলছি যে আমার বাবা মেঘনার ঝড়ে নৌকাডুবিতে মারা যান। তখন আমার বয়স এক কি দেড় বছর হবে। আর আমি ছিলাম আমাদের পরিবারের কনিষ্ঠ সন্তান। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর অবিন্যস্ত সংসার। আমার পরবর্তীকালের বিশ্লেষণ এই যে, একটু অযত্ন না হলেও অবহেলার মধ্যে বড় হয়েছি। সেই কারণেই কি-না জানি না, হয়তো প্রকৃতিগত কিংবা বৈশিষ্ট্যগত কারণে আমি একটু নিসঙ্গতা প্রিয় এবং একটু একাকিত্বে থাকতে ভালোবাসি। আর একটা বিষয় হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাকে ভীষণ টানত। আমি অনেক সময় একলা বসে মেঘনা নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বিশেষ করে শীতকালে শস্য ফুলের ক্ষেত আমার খুব ভালো লাগত। পারিবারিক ওই অবস্থার কারণে পড়ালেখাটা তাই একটু পরেই হল ।
আপনি ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত গ্রামে ছিলেন, এর পরে নড়াইলে আপনি চলে যান ওই পেক্ষাপটটা জানতে চাই।
: আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার বড় ভাই যশোরে কাজ করতেন। উনি বললেন যে, দুই জায়গায় থাকা তো একটু ব্যয়সাধ্য। তাই আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলেন যশোরে। তখন ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি সময়। তখনকার দিনে যাতায়াতের অবস্থা ভয়ঙ্কর রকম খারাপ ছিল। নড়াইল পৌঁছতে আমাদের দেড় দিন লেগেছিল। যদিও আামার গ্রাম ছেড়ে যেতে ভালো লাগছিল না। নড়াইল শহরটি তখন রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার এখনও মনে পড়ে নড়াইল আমার কৈশরের স্বর্ণময় মুহূর্ত। ওখানে আমি প্রথমে মক্তবে ভর্তি হই। তারপরে স্কুলে। স্কুলটা নামকরাই ছিল, রূপনগরে। জমিদারদের করা স্কুল, কলেজ। আমাদের চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের এলাকা। আমি ওই স্কুলে ভর্তি হই। তখন ওই শহর ছিল হিন্দুপ্রধান শহর। তখন রাজনৈতিকভাবে ছিল কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, প্রজাপার্টি আর কয়েকজন বামপন্থী সমর্থক ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার যে পরিস্থিতি ছিল তা আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন? বিশ্বযুদ্ধ আপনার সাহিত্য ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় কোনো প্রভাব ফেলতে পেরেছিল?
: হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে আমার দুটি বিষয়ের ওপর বেশ আগ্রহ তৈরি হল। একটা হল রাজনীতি, অপরটি হল সাহিত্য। আমি এখনও একটু অহংকারের সঙ্গে বলি আমি পাকিস্তানের রাজনীতি করিনি। মুসলিম লীগের রাজনীতি করিনি। আমি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি করেছি। আমাদের সময়ে পুরো ক্লাসে মাত্র তিনজন মুসলিম ছাত্র ছিল। তার মধ্যে আমি একজন বহিরাগত। আর দুজন ওরা স্থানীয়। এর থেকে বুঝা যাবে যে ওই সময়ের সামাজিক বিন্যাসটা কেমন ছিল। ওই সময়ে কংগ্রেসের প্রভাবটা বেশি ছিল। আমি ১৯৪৬ সালে বর্ধমানে যে ছাত্র সম্মেলন হল ওখানে গিয়েছিলাম। এর মাঝখানে ৪৬ সালের কলকাতার মহাহত্যাযজ্ঞের বিন্দুমাত্র প্রভাব আমাদের সমাজে পড়েনি। এরও আগে ১৯৪১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর কংগ্রেস পার্টি তাদের লাইন পরিবর্তন করল। যেহেতু সমাজতন্ত্রবিরোধী চেতনার কাজ করছিল বিশ্বে। যুদ্ধের সময় আমি একটা লোককে দেখলাম যে, ফ্যাসিস্ট বাহিনী কতদূর অগ্রসর হল বা মিত্রবাহিনীরা কি করল তিনি পিন মেরে মেরে চিহ্নিত করতেন। ফলে ওই সময়ে ওই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছিল। এ পরিস্থিতির মধ্যেই আমার বড় হওয়া। আমি তখন রবীন্দ্রনাথের চেয়েও নজরুলকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি স্বাদেশিকতার জন্য। যে জন্য আমি কলকাতা থেকে পোস্টে করে বই কিনি। ওটা ছিল নজরুলের অগ্নিবীণা। অগ্নিবীণা কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। এ বইটি ১৯৪৫ সালে আমি এনেছিলাম। আমি তখন নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ পড়তাম, তবে আরও দুজন লেখকের বই আমার খুব টানত। আমি তখন ফার্স্ট বয় ছিলাম। ফলে শিক্ষকরা খুবই স্নেহ করত। তখন আমাদের লাইব্রেরি থেকে একটি বই নিই সিলেকটেড বুক অব শেলি আর ওমর খৈয়ামের কবিতার বই। পরে আমি ওমর খৈয়ামের কিছু অনুবাদ করি। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল, দেবব্রত বসু। আমি ও সে মিলে একবার রূপনগরের মেলায় গেলাম। ওখান থেকে দুটি বই কিনেছিলাম। একটা হল নৌকাডুবি, আরেকটা হল গোরা। আমার ভাগ্যে পড়েছিল গোরা। ফলে রবীন্দ্রনাথের গোরা বইটি আমি খুব ভালোভাবে পড়ে ফেলি। গোরা ওই বয়সে পড়া খুব কষ্টকর ছিল। চিত্রানদীর পাড়ে একটা বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বসে বইটি পড়েছি কোনো লোক যাতে না দেখে। উপন্যাস পড়ছি ওই বয়সে! স্বভাবতই ওখানে বসে পড়া। গোরার তমিজ চরিত্রটি আমার বেশ ভালো লেগেছিল। আর আমি নড়াইলের ওই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তখন পরীক্ষায় যুক্তবঙ্গে আমি স্ট্যান্ড করেছিলাম। আমার কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। কিন্তু আমার বড় ভাই খরচের কথা চিন্তা করে বললেন যে, কলকাতায় পড়াতে পারব না। ফলে স্বভাবতই খারাপ লেগেছিল যে প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো এত বিখ্যাত কলেজে আমার পড়া হল না। ওই দিক দিয়ে দেশভাগ হয়ে গেল। দেবব্রতও চলে গেলেন কলকাতায়। এর পর আমরা গ্রামে আসি। আট-দশ বছর পর গ্রামে এসে দেখি গ্রামের চেহেরা পুরোটা বদলে গেল। তখন এক মুরব্বি ছিলেন, তিনি বলেন, পাকিস্তান হলে দেশের চেহারা একদম পাল্টে যাবে। রেজাউদ্দি নাম উনার। পরে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি চাচা পাকিস্তান হওয়াতে আমাদের কি লাভ হয়েছে?
চাচা আর কথা বলে না, বলে বাবা আর বল না। আমার এক চাচা কলকাতা থেকে মুন্সীগঞ্জে চাকরি নিল। তখন আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইন্টারমিডিয়েট সম্পন্ন করলাম। হরগঙ্গা কলেজ ওই সময়ে খুব নামকরা কলেজ ছিল। ওটা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারে। ওখানে আমার একটি স্মৃতি মনে পড়ে সেটা হল, কংগ্রেসের অজয় রায়ও তখন আমার এক বছরের সিনিয়র। ওরা একটা ছাত্র সংগঠন করার চেষ্টা করেছিল, যাতে কমিউনিস্ট পার্টির গুণ্ডাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে। ১৯৪৮ সালেও যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সেখানেও এর প্রভাব পড়েছিল। শামছউদ্দিন সাংবাদিক ছিল। আরেকজন ছিল সে হল সফিউদ্দিন। সে কমিউনিস্ট করত। কিন্তু পরে তাকে জোর করে মুসলিম লীগে ভিড়ানো হল। তখন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর অনেক কড়া নিয়ম-কানুন ছিল। তারা সফিউদ্দিকে বলল, তুমি কারও সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। ছাত্র কেমন করে না দেখা করে থাকে। অরবিন্দ পোদ্দার নামে আমাদের একজন ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। উনার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। উনার ময়মনসিংহ বাড়ি। উনি পরবর্তীতে ‘বঙ্কিম মানুষ’ বই লিখে খুব বিখ্যাত হয়েছিলেন। আমি উনাকে বললাম বঙ্কিমচন্দ্র যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন তার সাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয়। উনি আমাকে বললেন, আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা পেপার জমা দিয়েছি। এর নাম হল বঙ্কিম মানুষ। ওটা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অব দ্য রেকর্ড। আমাকে বলল, কাউকে বলো না। যাই হোক ওইভাবে আমার সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগ। তখন কলকাতা থেকে চতুরঙ্গ, আনন্দবাজার পত্রিকাগুলো আসত। তখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেণ ঘোষের বই এলেই শেষ হয়ে যেত। এর পর চিত্রানদী, ধলেশ্বরী থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে এসে পৌঁছে গেলাম। মানে আমি ঢাকায় চলে এলাম। তখনকার সময়ে ছাত্রছাত্রীদের মেডিকেল ছিল এক নম্বর পছন্দ, যেহেতু আমার ভাই ইঞ্জিনিয়ার উনি চাইতেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি। আমার ইচ্ছা ছিল কেমেস্ট্রি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স করা। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ছিলেন এক ইংরেজ ভদ্রলোক জার্নিক সাহেব। আমি তার কাছে নিয়ে আমার কাগজপত্র জমা দিই। কিছু না বলে তিনি ওগুলো সই করে দিল। আমি চলে এলাম, আমি ভাবলাম আমার হয়ে গেছে। কিছুদিন পরে দেখি আমার নাম সিলেকটেড হয়েছে কিন্তু নন-রেসিডেনসিয়াল। অন্যদিকে ভাইয়ের চাপাচাপিতে আমি মেডিকেল কলেজের ফরমও কিনি এবং জমা দিয়ে ফেলি। যেহেতু ঢাকায় আমার কেউ নেই। তা হলে কেমন করে হবে। আমি একজনকে রাগ করে বললাম, আমার মার্কশিট তো কথা বলে। রাগ করে কেমেস্ট্রি ছেড়ে দিলাম। কাজেই গিয়ে দেখি মেডিকেলের লিস্টে আমার নাম আছে, তাই মেডিকেলেই ভর্তি হয়ে গেলাম। একটা কথা বলি যেটা হল আজকালকার মানুষ বলে যে এই মানুষটি অনেক ক্যারিয়ারিস্ট। আমি এই হব, ওই হব আমার এই রকম কোনো লক্ষ্য ছিল না। লক্ষ্য না থাকা খারাপ। এর ফলে অনেক কিছুই হয়নি আবার অনেক কিছুই হয়েছে। আমি সে াতে ভাসিয়ে দিয়েছি, যেখানে গিয়ে শেষ হয়। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে মেডিকেল কলেজে পড়তে হয়েছে। তখন তো নীলক্ষেত ব্যারাকে প্রায় তিন মাস কাটিয়েছি। আর কখনও নাজিরাবাজার, নিলখেত এখানে-ওখানে করে প্রায় ছয় মাস কাটিয়েছি। যখন হোস্টেল হল তখন ওখানে উঠলাম। ওখানকার পরিবেশ আমার ভালো লেগেছে। তখনকার ছেলেমেয়েরা এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো বই নিয়ে পড়ে থাকত না। তখন নাচ, গান, লেখা, সাহিত্যকর্ম এসব বিষয়ে ভীষণ আগ্রহ ছিল ছেলেদের। আমাদের ওখানে সব সময় মঞ্চনাটক, মঞ্চ তো ছিল না; অডিটরিয়ামে নাটক হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকেও ছাত্ররা নাটক করত। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এগিয়ে ছিল। আরেকটা ছিল রাজনীতি। তখন রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা কথা প্রচলিত ছিল, যে মেডিকেল ব্যারাক বাম রাজনীতির ঘাঁটি। কিন্তু এখনকার মতো মারামারি কাটাকাটি ছিল না। পরমতসহিষ্ণুতা ছিল। এটার কারণে যে প্রস্তুতি পর্ব মানে পরবর্তীতে যা বায়ান্নতে পৌঁছাল, এর সাফল্যের কারণ কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সব ছাত্রের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা এবং একাত্ম হওয়া।
১৯৪৮ সালের কথা বললেন, আমি জানতে চাচ্ছি যে এরও আগে দেশ ভাগের ফলে যে সংবিধান রচনা করার কথা তা ভারত এক-দুই বছরের ভেতর করে ফেলে কিন্তু পাকিস্তান আলোচনা করতে করতে প্রায় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত গড়ায় তাদের সংবিধানে পৌঁছাতে, তখন উল্লেখ ছিল যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই নাকি প্রথম বাংলা ভাষার কথা প্রথম উত্থাপন করেন, যা কি-না ওই পাকিস্তান সরকার মেনে নেয়নি। এটাকে আপনি কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
: ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচিতে সম্মেলনে কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি উপস্থাপন করেন। মুসলিম লীগের রাজনীতি তখন এত ফ্যাসিস্ট ছিল যে তখন মোজাফফ্র আহমেদ সাহেব সম্ভবত তার সঙ্গে মুনসুর হাবিব এসেছিলেন। নাজিমুদ্দিন তখন মুখ্যমন্ত্রী। তখন জংশন রোডে কমিউনিস্ট দমন করা হতো।
ওই সময়ে তো মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল যে যদি কমিউনিস্টকে দমন করা যায় তাহলে তাদের স্বার্থ হাসিল করা যাবে।
: তার চেয়েও বড় কথা হল যে তারা মনে করত তারা ভারতের দালাল। জিন্নাহ সাহেব ১৯৪৮ সালের ভাষণেও বলেছেন যে কমিউনিস্টরা ভারতের চর। এদের প্রতিহত করতে হবে। ওই দিকে লিয়াকত আলী আর আমাদের নূরুল আমিন, তমিজউদ্দিন সাহেব তার কথা সমর্থন করেছিল। এর ফলেই ৪৮ সালের আন্দোলন। আমি অস্বীকার করব না যে ওই আন্দোলনে তমিজউদ্দিন সাহেবদের ভূমিকা ছিল। তারাই আবার ৪৮ এর আন্দোলনকে দমিত করার চেষ্টা করেছিল। জিন্নাহ উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিয়ে গেলেন।
১৯৫২ সালে ভাষার দাবিতে জানুয়ারি থেকে যে লাগাতার আন্দোলন শুরু হয় এবং পরবর্তীতে ২২ ফেব্র“য়ারিতে যে গায়েবি জানাজা হয় ওই সময়ের প্রেক্ষাপট জানতে চাই।
: ১৯৫২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিনের কথা বলব। যার অবদান অতুলনীয়। যিনি লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিলেন। আমাদের মতো কিছু মানুষের চেষ্টায় ওটা এগিয়ে গেছে। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পল্টন ময়দানে যখন বলা হল যে রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন সারা শহর অন্যরকম রূপ নেয়। এ অবস্থার মধ্যেই কিন্তু ৪ ফেব্র“য়ারি ছাত্রদের মিটিং হল। তখন ২১ তারিখে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে ওই দিন হরতাল, মিটিং দেশব্যাপী বিক্ষোভ শোভাযাত্রা সমাবেশ করা হবে। এরও আগে ৩১ তারিখে যে সমাবেশ হল সেখানে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হল। এ কর্মসূচি পালন করার ব্যাপারেও তারা অনেক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিল। আমার এখনও চোখে ভাসে ২০ ফেব্র“য়ারি বিকাল বেলায় সচিবালয়ের দিক থেকে একটি ঘোড়ার গাড়ি সেখান থেকে মাইকে ১৪৪ ধারা ঘোষণা এলো। ওই ঘোষণা শুনে ঢাকা হল, ফজলুল হক হল, আমাদের হোস্টেল হয়ে সবাই চলে গেল ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য। ফলে আর কাউকে বলতে হয়নি যে তোমরা ১৪৪ ধারা ভাঙ। এটা শুনে কিন্তু সাধারণ ছাত্ররাও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল যে ১৪৪ ধারা মানি না। কাউকে বা কোনো নেতাকে বলে দিতে হয়নি। মুজিবুল হক, হেদায়েত উদ্দিন চৌধুরী এই দু’জন আবার এর বিরোধিতা করেছিল। সাধারণ ছাত্রদের জন্যই ১৪৪ ধারা ভাঙা হল। ১৪৪ ধারা ভাঙা না হলে ২১ ফেব্র“য়ারি হতো না এবং আমি বলব যে, এর পুরোপুরি কৃতিত্ব সাধারণ ছাত্রদের। ২০ ফেব্র“য়ারি যে মিটিং হল, মওলানা ভাসানী ছিলেন না বলে এখানে আবুল হাসিম সাহেব, আতাউর রহমান, খন্দকার মোশতাক এবং ছাত্রদের একটা অংশ শামসুল হক সাহেবসহ সবাই বিরোধিতা করেন। আগামীতে নির্বাচন সামনে, কাজেই সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেলে নির্বাচন বন্ধ হবে। কাজেই ১৪৪ ধারা ভাঙা যাবে না। এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাত্র তিনজন দাঁড়াল যুবলীগের অলি আহাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন এবং আমাদের কলেজের গোলাম মাওলা- এই তিনজন ১৪৪ ধারা ভাঙার কথা বললেন। উনারা খুব ঘোর আপত্তি তোলেন এবং উনারা চিল্লিয়ে সভা মাত করে ফেলেন। ঠিক হল যে ২১ তারিখে আমতলার সিদ্ধান্তই কার্যকর হবে। আবুল হাসিম সাহেব বলেন, আজকের গণতান্ত্রিকভাবে নেয়া সিদ্ধান্ত যদি ভাঙা হয় তাহলে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ বিলুপ্ত হবে। আমি অবাক হলাম যে সাধারণ একটি মিটিং-এ সভাপতি কি করে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উনি এই অগণতান্ত্রিক কাজটি করলেন। উনি ওই তিনজনের ওপর রাগ করেই এ কথা বললেন। কিন্তু পরে যখন গুলি চলল তখন উনার রাগ থেমে গেল। কামরুউদ্দিন সাহেব, গোলাম মাহবুব চৌধুরীসহ এটা কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা মানেনি। পরের দিন সকাল বেলায় আমতলায় মিটিং, গাজীউল হক সভাপতি। আমিও সেখানে উপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম পরিষদের আবদুল মতিন যখন ভাষণ দিলেন তখন সবাই হাত তুলে বললেন আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙব। দশজন দশজন করে মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভাঙা হল। আমাদের প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানরা প্রথম মিছিলে ছিলেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আন্দোলনের মধ্যে থাকব আমি মিছিলে যাব না। মিছিল তো আর হয়নি, লাঠিপেটার চোটে। জগন্নাথ হলের সামনে জড়ো হওয়া। ওখান থেকে স্লোগান উঠল চল চল ১৪৪ ধারা ভাঙব। সেই জমায়েতের প্রায় সবাই ছিল ছাত্র। বাহিরের কিছু সংখ্যক লোকও ছিল। শহীদ আবদুল সালাম না হলে কে। আমি বলব যে পুলিশ তখন বিনা প্ররোচনায় ২৬ রাউন্ড গুলি ছুড়ে। ফলে প্রথম শহীদ হল রফিক, দ্বিতীয় শহীদ হল জাব্বার। আর বরকতের উরুতে গুলি লাগে। তখনকার দিনে চিকিৎসা ব্যবস্থা এতটা উন্নতা ছিল না। না হলে মনে হয় বরকতকে বাঁচানো যেত। আর বাকি যে দুজন তাদের মর্গে রাখা হল। আমরা দেহ পাইনি। এজন্য তাদের আর কবর দেয়া হল না। সেই দিন কথা ছিল যে পরের দিন লাশ নিয়ে মিছিল হবে। ফলে গায়েবি জানাজা হল। শোক সভা হল। সেখান থেকে বিশাল মিছিল হয়। তখন তারা ইপিআর নামায়। ২২ ফেব্র“য়ারি জনারণ্যে পরিণত হল। যদিও ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পুরান ঢাকার লোকজন এর বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু পরে তারাও একাÍতা ঘোষণা করল। সেখানে ২২ তারিখের মিছিলে সফিউর রহমান, আবদুল আওয়াল মারা যান।
আচ্ছা মোট কতজন শহীদ হয়েছিল ২১ ও ২২ তারিখে এ বিষয়ে আপনার কোনো সুনির্দিষ্ট মতামত বা বক্তব্য আছে কি?
: কিন্তু বেশ কয়েকজনকে নিশ্চিত করা যায়নি, আসলে কতজন শহীদ। তবে আমরা দেখি ১২ জন। রফিকউদ্দিন, রবকত, জব্বার, সালাম, সফিউর, আবদুল আওয়াল। আমি মোটামুটি ধরে নিয়েছি বারজন। আমি অনেক চেষ্টা করেছি। এনএসআইকে ধরেও পারা গেল না। আমি নিজে আজিমপুর কবরস্থানে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছি। ওখানে তখন সুরুজউদ্দিন নামে যে লাশ ধোয়ায় তার সঙ্গে আলাপ করেছি এবং মাওলানা গফুর এদের ইন্টারভিউ আমি করেছিলাম। এদের ধারণার সঙ্গে আমার ধারণা প্রায় মিলে যায়। ওরা বলল একজন শিশুকেও আমরা দাফন করেছি আবার একজন অবাঙালিকেও আমরা দাফন করেছি। এভাবে আমরা যদি ধরি তাহলে বলতে হয় একুশে মোট শহীদের সংখ্যা ১২ জন কিংবা তার বেশি। এ গুলি এবং মৃত্যু কিন্তু বাংলাদেশকে আলোড়িত করে। এ গুলি চলা এমন এক আবেগের সৃষ্টি করল দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল।
আপনারা কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ২৩ ফেব্র“য়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে যে শহীদ মিনার নির্মাণ করলেন, সেইসময়ে আপনার অন্যতম ভূমিকা ছিল। এবং ২৬ তারিখে আপনাদের তৈরি করা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়। ওই সময়ের পেক্ষাপট জানতে চাই।
: ২২ তারিখে কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, সর্বস্তরে বাংলা চালু কর, শহীদ স্মৃতি অমর হোক স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে চারদিক। ফলে শহীদ স্মৃতি অমর করার জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম শহীদ মিনার নির্মাণের। আমাদের সিনিয়র বদরুল আলমকে বললাম নকশা করতে ও নকশা করল। নির্মাণ করতে তো ইট, সিমেন্ট লাগবে। সিমেন্ট কিন্তু গোডাউনে আটকানো। তখন আমার এক বন্ধু আলী আসগর। আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু এখন সে অসুস্থ, শয্যাশায়ী। ও আর আমি আমাদের হোস্টেলের খুব কাছেই হোসেনি দালান ওখানে গিয়ে তালা আর ভাঙলাম না আমরা। আমরা তালা না ভেঙে ওখানকার পিয়ারু সর্দারের কাছে গিয়ে চাবি চাইলাম, ভদ্রলোক কোনো কথা না বলেই চাবি দিয়ে দিল। তিনি আবার বললেন যে কয় বস্তা সিমেন্ট লাগে তা নিয়ে যাতে চাবিটা ফিরত দিয়ে যাই। পরে আমরা চাবি ফিরত দিয়ে আসি। কিন্তু আজকালকার ছেলেরা হলে কি করত আমি জানি না। আমরা সবাই হাতে হাতে ইট নিয়ে যাই শহীদ মিনার করার জন্য। তখন আমার বয়স ২৩ বছর। আমার হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। সারা রাতের পরিশ্রমে আমরা ১০ ফুট বাই ৪ ফুট শহীদ মিনার নির্মাণ করি। আমাদের ছেলেরা সবাই। মুর্তজা বশির, আমিনুল ইসলাম এরাও কিন্তু অনেক পরিশ্রম করেছে। এছাড়াও জিয়া হাসান, বদরুল হাসান এরা সবাই পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে ফেলে পুরো ঢাকা শহর। এরা প্রত্যেকে প্রচুর কষ্ট করেছে। পরের দিন মনে হল ঢাকা শহর পোস্টার ও ফেস্টুনের নগরী। এটা ফেব্র“য়ারি মাসের পুরো সময়ে ছিল। তখন নুরুল আমিন রেডিও ভাষণে বলেন, আন্দোলন তো ছাত্ররা করছে না করছে ভারত। এরা ভারতের দালাল। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নুরুল আমিন যেটা করল যে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বন্ধ করে দিল, ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেল। স্টেটম্যান পত্রিকার শিরোনাম হল- ডিউ ক্লোজ সানডাই মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল। আর এ অবস্থায় তো আন্দোলন চলে না। এজন্য মার্চের ৫ তারিখে যে হরতাল ডাকা হল সেটা আংশিক হল। তখনও মফস্বল শহরে আন্দোলন আরও বেশ কিছু দিন চলল। এভাবে ভাষা আন্দোলন সফল পরিণতির দিকে পৌঁছায়। এরপর ১৯৫৩ সালে ব্যাপক আন্দোলন হয়। আন্দোলন ১৯৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬ সালেও হয়। ২৩ তারিখে শহীদ মিনার নির্মাণের পর মানুষের ঢল দেখে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ চিন্তিত হল। ফলে ২৬ তারিখে শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে তারা। এ শহীদ মিনারের প্রেরণায়ই পরে শহীদ মিনার হল। ৫৬ সালে সংবিধান হওয়ার সময় উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হল।
গত বছর আপনি এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন বিপন্ন বাংলা ভাষা, যার কারণ হচ্ছে আমাদের হীনমন্যতা, ব্যক্তিস্বার্থ, ইচ্ছার অভাব আপনার কাছে কেন এমন মনে হচ্ছে?
: কারণ, আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই পাশাপাশি রাজবন্দিদের মুক্তি চাই এই স্লোগানটিও ছিল। তখন তো বেশিরভাগ রাজবন্দিই ছিল কমিউনিস্ট। এদের মধ্যে রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন দাও ছিল। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। সংবিধানে যেটা বলা হল, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমাদের যদি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয় তবে জাতীয় পর্যায়ে সর্বত্র বাংলা হওয়ার কথা। পৃথিবীর সব জাতিসত্তাভিত্তিক যেসব দেশ আছে তারা নিজেদের ভাষা বাদ দিয়ে অন্য ভাষা গ্রহণ করেনি। সেখানেই আমাদের দুর্ভাগ্য, আমাদের হীনমন্যতা। পৌনে দুইশ’ বছরের ইংরেজ শাসনের ফলে আমরা ইংরেজিকে বাদ দিতে পারলাম না। শুধু বাদ দেয়া নয়, এতে সমাজকে দু’ভাগে ভাগ করা হল। ফলে আমরা ইংরেজিও ভালোভাবে শিখলাম না আবার বাংলাও ভালোভাবে শিখলাম না। যার ফলে বিকৃত উচ্চারণ, অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভুল বানান আমরা ব্যবহার করছি। এটা কি মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে! যা কিনা আমাদের জাতীয় ভাষা। এক্ষেত্রে রাজনীতিকরা উদাসীন। তখন তো আন্দোলন করার উপলক্ষ ছিল, এখন তো আন্দোলন করার উপলক্ষ নেই। এজন্য আমরা বলি দরকার আরেকটি ভাষা আন্দোলনের দরকার আরেকটি সামাজিক আন্দোলনের। আমি এটা বিশ্বাস করি যে সমাজ পরিবর্তন না হলে কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা লাভ করবে না সমাজতন্ত্র তো দূরের কথা। বাংলা ভাষার যে প্রয়োজনীয়তা এটা উপলব্ধি করতে হবে। এটা আমাদের ভাষা সংগ্রামীদের বিশাল আক্ষেপ।
আমরা ফেব্র“য়ারি এলেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি, সারা বছর আমাদের কোনো খবর থাকে না। কেন এমন হচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?
: এর দুটো কারণ আছে, প্রথমত হল আমাদের মানুষিকতা। আরেকটি বিষয় হল জীবিকার সঙ্গে কিন্তু মানুষের একটা সম্পর্ক আছে। আমাদের জীবিকার ভাষা হচ্ছে ইংরেজি। তাই সবাই চাইবে যে ইংরেজি ভাষা অধ্যায়ন করতে। যেহেতু বিজ্ঞান শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি। এর ফলে জীবিকার সঙ্গে বাংলা ভাষাকে বিচ্ছিন্ন করার কারণে বাংলা প্রতি উদাসীনতা বা অবহেলা ঘটেছে।
আপনার কি মনে হয় এরকম কোনো প্রদক্ষেপ করা যায় কিনা যেটা রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য মঙ্গলজনক হবে?
: সেটা তো আমরা অনেক আগেই চেষ্টা করেছি। একটা উদাহরণ দিই, আমি জাহিদ হায়দার, শুভাগত চৌধুরী মিলে বাংলা একাডেমির স্পন্সরশিপে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য ওদের বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছিলাম। কিন্তু ট্রাজেডি হল আমি যখন ব্যক্তিগতভাবে মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে গিয়ে বললাম বইগুলো পড়ে আছে গুদামে, আপনারা আনছেন না কেন। এতে ছেলেমেয়েরা সহজে বুঝতে পারবে বাংলায় রূপান্তর করাতে। এটাও বলেছি যে আপনারা বিকল্প প্রশ্ন পদ্ধতি করতে পারেন যে ছেলেমেয়েরা চাইলে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায়ও উত্তর দিতে পারবে। এর কোনো প্রস্তাবে বা কাজে প্রিন্সিপাল বা অধ্যাপকরা রাজি হননি। রাজি না হওয়ার কারণ তাদের আবার পরিশ্রম করে পড়তে হবে। তার চেয়ে ভালো ওই সময়টাতে দুই পয়সা উপার্জন করা যাবে।
আপনার লেখা ‘রবীন্দ্র-সাহিত্যের নায়িকারা দ্রোহ ও সমর্পণে’ প্রসঙ্গে আপনি রবীন্দ্রনাথের ভেতর যে বৈপরীত্য কাজ করত তা তুলে ধরেছেন। আপনার কেন এমন মনে হল?
: আমি মনে করি যে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে দুটো ধারার বৈপরীত্য কাজ করত। তার তারুণ্যে থেকে শুরু করে সব সময়ে। তিনি ১৭ বছরে যখন বিলেত গিয়ে ওখানকার মেয়েদের অবস্থা দেখে উল্লোসিত হয়ে চিঠি আকারে লিখলেন নারী স্বাধীনতার পক্ষে। সেই একই লোক পরে তার মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিলেন। কিন্তু তার লেখা দেনা-পাওনা যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লেখা কি অসাধারণ গল্প। কাবুলিওয়লার কাছ থেকে টাকা ধার এবং তার বন্ধু প্রিয়নাথের কাছে টাকা ধার করে তার মেয়েদের বিয়ে দিলেন ১০ কিংবা ১১ বছর বয়সে।
জীবনানন্দ দাশের উপর ‘সময় সমাজ ও প্রেম’ বই সম্পর্কে জানতে চাই, যেখানে জীবনানন্দ দাসের অন্তর্মুখী মানস ফুটে তুলেছিলেন ।
: হ্যাঁ, জীবনানন্দের মানস বৈশিষ্ট্য ছিল ভীষণ অন্তর্মুখী এবং তিনি ছিলেন আবেগপ্রবণ। তার জীবনেও অন্তর্মুখীতার কারণে তার জীবনে প্রেম ও অপ্রেমের অপ্রাপ্তি এত বেশি। তার দিনপুঞ্জিতে লেখা আছে লাবণ্য’স লেটার (ছরিকাঘাত)। মানসিক দিক থেকে পীড়িত এই জীবনানন্দ দাসের নেতিবাচক দিকগুলো প্রবল হয়ে উঠেছিল। তাই তিনি বাস্তবতার মধ্যেও স্বপ্নের জগৎ তৈরি করলেন। ইয়েটস এর মতো অদ্ভুত রকমের ভুবন তৈরি করলেন যে ভুবনে ক্লেশ নেই আঘাত নেই, রক্তক্ষরণ নেই। বেলা-অবেলা কাল বেলায় এগুলো নিয়ে কবিতা আছে যে-তিনি সূর্যের প্রত্যাশী। তার ট্রাংকে রাখা উপন্যাসগুলো বেরিয়ে প্রমাণ করেছে যে কবিতায় যে প্রকাশ তা উপন্যাসে আরও তীব্রতর হয়েছে।
আপনার জীবনের সেরা মুহূর্ত কোনটি, আপনার কি মনে হয়?
: আমার জীবনের সেরা মুহূর্ত ভাষা আন্দোলন।
আপনার কাছে জীবনটাকে কেমন মনে হয় মানে জীবনবোধটা আসলে কি?
: আমি একথা বহু জায়গায় বলেছি যে আমি ভক্তিবাদী ও প্রগতিশীল রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি মান্য করি। মানবিক রবীন্দ্রনাথ এবং মানুষ রবীন্দ্রনাথকে অনেক বেশি শ্রদ্ধা করি। তিনি বলেন যে ‘প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আমার ধর্ম নয়।’ আমিও জীবনে ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছি অনেক আগে থেকেই মানুষের প্রতি বৈষম্য দেখে। মানুষের মনুষ্যত্বই বড় ধর্ম।
No comments:
Post a Comment