সনাতন ধর্ম-বৌদ্ধ ধম্ম-মতুয়া ধর্ম
প্রবর্তকঃ- পূর্ব বুদ্ধ,-গৌতম বুদ্ধ,- হরিচাঁদ ঠাকুর সাধারণত এটাই প্রচার করা হয় যে, হিন্দু ধর্মের আদি বা অতিপ্রাচীন নাম হচ্ছে সনাতন ধর্ম । কিন্তু এই প্রচার কতটা ঠিক বা যুক্তি সংগত, সেটা আলোচনা করা যাক খৃষ্ট পূর্ব ১৫০০ অব্দে বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল এবং ছলে বলে কৌশলে এ দেশের অধিবাসি অর্থাৎ মূলনিবাসীদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল । তারপর থেকে ধীরে ধীরে যুক্তি বিজ্ঞান রহিত অলীক ভাবনা চিন্তা সকল মূলনিবাসীদের ভিতর প্রবেশ করতে থাকে । বৈদিক ধর্মের পূর্বে ভারতবর্ষে যে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল তার নাম 'সনাতন' ধর্ম । আর এই ধর্মের মূল ধর্ম গ্রন্থ ছিল 'আদিপুরাণ' । আর বৈদিক ব্রাহ্মণেরা যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল তখন ছিল ওরা অসভ্য, বর্বর, অর্ধনগ্ন এক মানবগোষ্ঠী । ওরা লিপির ব্যবহার তো জানতই না, এমনকী কৃষিকাজ, গৃহনির্মাণ এসবও ওরা বুঝত না । যাযাবর জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিল । সভ্য সংস্কৃতি বলতে ওদের মধ্যে কিছুই ছিলনা । ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধের জন্মের পূর্বে ২৭ জন বুদ্ধ জন্মগ্রহন করেছিলেন । এরা সকলেই জন্মেছিলেন ভারতবর্ষে বৈদিক ব্রাহ্মণদের আগমনের পূর্বে এরাই পূর্ববুদ্ধ নামে খ্যাত । এদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ হলেন কাশ্যপ বুদ্ধ । এই কাশ্যপ বুদ্ধের পৌত্র মনুর সময়ে ভারতবর্ষে বৈদিক আগমন ঘটেছিল । কিন্তু এদের ধর্মকে বৌদ্ধ ধর্ম বলা হত না । বৈদিকেরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর থেকে ধর্মকে যে দৃষ্টিতে দেখা শুরু হল বৈদিকপূর্ব ভারতের মূলনিবাসীরা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্মকে দেখত না । তারা জানত ধর্ম হচ্ছে প্রকৃতিগত ব্যাপার, যা সৃষ্টির শুরু থেকে চলে আসছে কিছু নিয়ম কানুন এবং নীতিবোধের মধ্য দিয়ে । তাই তাদের ধর্মের নাম ছিল সনাতন ধর্ম ।আর এই সকল নিয়ম কানুন এবং নীতিবোধকে সার্বজনীন উৎকর্ষতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র জ্ঞানানুশীলন । তাই তারা বিশেষ বিশেষ জ্ঞানী ব্যক্তিদের 'বুদ্ধ' নামে আখ্যায়িত করে তাদের স্মরণীয় করে রাখত । সুতরাং ধর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে কোন গোষ্ঠীবদ্ধতা বা সংকীর্ণতা ছিল না । তাদের সেই সহজ সরল উদারনীতির সুযোগ নিয়েই তো বৈদিক নর্ডিক গোষ্ঠী ভারতবর্শে প্রবেশ করতে এবং প্রভাব ফেলতে পেরেছিল । গৌতম বুদ্ধ ও ওই সকল পূর্ব বুদ্ধদের ধারা অনুসরণ করেছিলেন । তাই তিনি নিজেই সিদ্ধার্থ নাম গ্রহন করেছিলেন । কারণ, সিদ্ধার্থ নামে একজন পূর্ববুদ্ধ ছিলেন । এখন প্রশ্ন হচ্ছে- সেটা যদি হবে তবে গৌতম বুদ্ধ তাঁর প্রচারিত ধর্মের নাম সনাতন ধর্ম না করে বৌদ্ধধম্ম(বৌদ্ধধর্ম নয়) কেন করলেন ? নর্ডিকদের নিজস্ব কোন সভ্য সংস্কৃতি ছিল না তারা ছিল যাযাবর বন্যজাতি । মনের মধ্যে বা ভাবনা চিন্তায় লালন করে চলত কেবল ধূর্তামি ভরা কল্পনাশ্রিত অলৌকিকতাকে । তারা যখন ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিল তখনও তাদের ধর্মীর কোন নামকরণ ছিল না । তাই মূলনিবাসীয়দের অনূকরণে নিজেদেরকে সনাতন ধর্মী বলে প্রচার করতে থাকে । বেদ তৈরি হবার পর থেকে তাদের ধর্মের নাম বৈদিক ধর্ম হল ঠিকই, কিন্ত পাশাপাশি তারা সনাতন নামটিকেও আটকে রাখল । অর্থাৎ বৈদিক ধর্মকে সনাতন ধর্ম বলেই দাবি করতে থাকল । এটা ছিল বৈদিকদের মূল ভারতীয়দেরকে বৈদিক ধর্মে জড়িয়ে নেবার একটা কূট-কৌশল । তাই গৌতম বুদ্ধ মূলনিবাসী ভারতীয়দের পুনঃ জাগরিত ধর্মের নাম রাখলেন সনাতন ধর্ম নামের পরিবর্তে বৌদ্ধ ধম্ম । এখানে একটা কথা জানিয়ে রাখি যে, পূর্ব বুদ্ধদের সৃষ্ট যে আদিপুরাণ সেটা কিন্ত বৈদিকেরা ধ্বংস করে দিয়েছে । সেখান থেকে ওদের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু মাত্র স্থানান্তরিত করে বিভিন্ন বৈদিক গ্রন্থের ভিতর রেখে দিয়েছে । তাই পূর্ব বুদ্ধদের মস্তিষ্ক প্রসূত ভাবনার সুসংবদ্ধ তেমন কোন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি । তবে বিভিন্ন গবেষণা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্য দিয়ে আজ এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, তাদের ভাবনায় কল্পনাশ্রিত অলীক কোন ধ্যানধারণার স্থান ছিল না । তারা ছিল পুরাপুরিভাবে মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল। তাই সনাতন ধর্ম ছিল যুক্তি ও জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত । অর্থাৎ জ্ঞানের ধর্ম । আর অনাত্মাবাদী-অবস্তুবাদী বৌদ্ধ দর্শনের যে বিশ্বব্যাপী সার্বজনীনতা সেটা বুদ্ধ গৌতমের একক মস্তিষ্কের কৃতিত্ব । আমরা এতক্ষন জানলাম সনাতান ধর্মের বিষয়ে এবং সনাতন ধর্ম থেকে কিভাবে বৌদ্ধধম্ম হোল । এবার আমরা দেখি কিভাবে বৌদ্ধ ধম্ম থেকে ঠাকুর হরিচাঁদ মতুয়া ধর্ম সৃষ্টি করলেন । হরিলীলামৃত গ্রন্থে আমরা দেখতে পাই যে, বুদ্ধের কামনা পরিপূর্ণ করতেই ঠাকুর হরিচাঁদের জন্ম । অর্থাৎ বুদ্ধের দর্শন পুনঃ প্রতিষ্ঠার সংকল্পেই তাঁর আবির্ভাব । বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণ জন্য । যশোমন্ত গৃহে হরি হৈল অবতীর্ণ ।। বুদ্ধের কামনা পরিপূর্ণ করার জন্যই যদি ঠাকুর হরিচাঁদের জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চই বলা যায় মতুয়া দর্শন হলো বৌদ্ধ দর্শনের এক পরিস্রুত রুপ । তবে এখানে আবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন এসে যায়, নিজেদের অতীত ধর্ম রহস্য উদঘাটন করেও ঠাকুর হরিচাঁদের কেন মতুয়া ধর্ম প্রবর্তনের প্রয়োজন হয়েছিল, যদি মতুয়া দর্শনই হয় বৌদ্ধ ধর্শনের পরিস্রুত রুপ ? কারণ হলো, বৌদ্ধ ধম্মের পতনের পর বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বৌদ্ধ ধম্মকে বৈদিকি করণের দ্বারা জনমানুষের কাছ থেকে তার ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চার বৈজ্ঞানিক মহাভূতের মহাসত্যকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বুদ্ধকে যেমন বিষ্ণুর অবতার রূপে ঘোষণা করে, তেমনি বৌদ্ধ ধম্মকে বৈদিক ধর্মের অংশ রূপেও প্রকাশ করে । তাই ভারতীয় অবৈদিক ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চার বৈজ্ঞানিক মহাভূতের মহাসত্যের ধর্মকে পুনঃ প্রতিষ্ঠার মানসে বুদ্ধের দর্শনকে আরও সরলীকরণ করে মতুয়ারূপী ভিন্ন নামে ঠাকুর হরিচাঁদের প্রয়োজন হয় অবৈদিক এই মতুয়াধর্ম প্রবর্তনের । তিনি ভারতের মূল ধর্ম সনাতন ধর্ম, যাকে বৈদিকেরা আপনার বলে প্রচার করেছে তার সঙ্গে সূক্ষ্ম কথাটা যুক্ত করে বৈদিকদের থেকে আলাদা করে নিয়ে এলেন এবং তিনি তার অনুগামীদের অর্থাৎ মতুয়াদের সূক্ষ্ম সনাতন গার্হস্থ্য জীবন যাপনের নির্দেশ দিলেন । যা ছিল আদি ভারতীয়দের মূল আদর্শ, তাকেই হরিচাঁদ মতুয়াধর্মেরও মূল আদর্শ বলে ঘোষণা করলেন । অতএব বলা যায়, মতুয়ারা হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে মতুয়াধর্মে প্রবেশ করছেন না, তাঁরা নিজ ধর্মের সন্ধান পেয়ে ধর্মহীনতার গ্লানিময় জীবন থেকে মুক্ত হতে সেখানেই ফিরে যাচ্ছেন । আশা করি, বিষয়টি আপনাদের কাছে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা গেল । (এবিষয়ে ডাঃ মণিন্দ্রনাথ বিস্বাস-এর প্রশ্নোত্তরে মতুয়া দর্শন বই এর পৃঃ নং ২৮ থেকে আ৩১ এবং ৪৬ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছ । এবং মতুয়া গবেষক মনি মোহন বৈরাগীর লেখা 'এক অভিন্ন অবৈদিক সনাতনী দর্শন বৌদ্ধ ও মতুয়া দর্শন ' বইএর পৃঃ নং ৭৪ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে) |
বাঙালির সম্পূর্ণ ভূগোল,ইতিহাস,সংস্কৃতি,সাহিত্য, শিল্প,অর্থ,বাণিজ্য,বিশ্বায়ণ,রুখে দাঁড়াবার জেদ, বৌদ্ধময় ঐতিহ্য, অন্ত্যজ ব্রাত্য বহিস্কৃত শরণার্থী জীবন যাপনকে আত্মপরিচয়,চেতনা,মাতৃভাষাকে রাজনৈতিক সীমানা ডিঙিয়ে আবিস্কার করার প্রচেষ্টা এই ব্লগ,আপনার লেখাও চাই কিন্তু,যে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযাগ নেই,তাঁদের খোঁজে এই বাস্তুহারা তত্পরতা,যেখবর মীডিয়া ছাপে না, যারা ক্ষমতার, আধিপাত্যের বলি প্রতিনিয়তই,সেই খবর,লেখা পাঠান,খবর দিন এখনই এই ঠিকানায়ঃpalashbiswaskl@gmail.com
Monday, June 16, 2014
সনাতন ধর্ম-বৌদ্ধ ধম্ম-মতুয়া ধর্ম
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment