১৫ ইউনিয়নেই মাদকের আগ্রাসন
প্রকাশ : ১৭ জুন, ২০১৪
তোহুর আহমদ, দাউদকান্দি, কুমিল্লা থেকে ফিরে
দাউদকান্দি উপজেলায় মাদকের আগ্রাসন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শত শত হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবক মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দিন দিনি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা। মাদকের আগ্রাসন শুধু উপজেলা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি ছড়িয়ে গেছে ১৫টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। সন্ধ্যা নামলেই গ্রামেগঞ্জে প্রকাশ্যে চলছে মাদক সেবন। মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে অনেক পরিবারই এখন দিশেহারা। মাদক বেচা-কেনা ও সেবন প্রকাশ্যে চললেও নির্বিকার গোটা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর যোগসাজশে নির্বিঘ্নে চলছে মাদকসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। এমনকি স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি তার নিকট আত্মীয়কে দিয়ে গোটা দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করাচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করেছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এই তালিকা তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সরকারের এই দুই প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। যদিও পুলিশের দাবি, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, থানায় নথিভুক্ত হওয়া মামলায় স্থান পাওয়া মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যার তুলনায় প্রকৃত মাদক ব্যবসী কয়েকগুণ বেশি।
দাউদকান্দি উপজেলা সদর ও এর ১৫ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় থানা পুলিশের নথি থেকেও আঁচ করা যায় দাউদকান্দির মাদক পরিস্থিতির ভয়াবহতা। মডেল থানায় মার্চ, এপ্রিল ও মে- এ তিন মাসে মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে যথাক্রমে ১৬, ১৫ ও ১১টি। এই সময়ে মাদক ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে মোট ৫৬ জন। অভিযোগ রয়েছে লোক দেখানোর জন্য পুলিশ মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও মাদক নির্মূলে পুলিশের তৎপরতা পর্যাপ্ত নয়। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলায় মোট ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। স্থানীয় সরকারের এই ১৬ কাঠামোতেই মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন ঘটেছে। সীমান্তবর্তী জেলা কুমিল্লার খুব কাছের উপজেলা হওয়ায় এখানে মাদকের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে।
সরেজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রি হচ্ছে হোম সার্ভিস ডেলিভারির মাধ্যমে। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে মোবাইল ফোনে। এরপরই নিরাপদে ডেলিভারি। যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মাদকের বিস্তার দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দাউদকান্দি উত্তর, সুন্দলপুর ইউনিয়ন, বারপাড়া, গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ও দক্ষিণ, মোহাম্মদপুর পশ্চিম, মালিগাঁও, মারুকা, বিটেশ্বর, দৌলতপুর, পাঁচগাছিয়া, গোয়ালমারী, জিংলাতলী, দাউদকান্দি পৌরসভার তুজারভাঙ্গা, দোনারচর, টোল প্লাজা, শহীদনগর, সুন্দলপুর, রায়পুর, ইলিয়টগঞ্জ, মলয় বাজার, নৈয়াইর বাজার, পালের বাজার, পাঁচগাছিয়া, কনাছোঁয়া, জুরানপুর, হাসানপুর, মোহাম্মদপুর, বারোপাড়া, চারিপাড়া, জিয়ারকান্দি, আমিরাবাদ, লক্ষ্মীপুর, শ্রীকান্তদি, শ্রীরায়েরচর, হামিদ্দি, সবজিকান্দি, বিশ্বরোড, পেন্নায়, গুপচর, চক্রতলা, পিতামুদ্বি ও চৌধুরীপাড়া।
যারা মাদক ব্যবসায়ী
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী মোট ১৬ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী দাউদকান্দিতে মদ, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছে। এদের অধীনে কাজ করছে আরও কয়েকশ খুচরা মাদক বিক্রেতা। তালিকা অনুযায়ী সাহাপাড়া মন্দিরের কাছে চোলাই ও বিদেশী মদ বিয়ারের ব্যবসা করছেন রবীন্দ্র সাহা ও সেন্টু সাহা। দাউদকান্দি উপজেলা কার্যালয়ের সামনে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী মদের ব্যবসা করছেন অশোক সাহা। গৌরীপুর বাজারে চোলাই মদ ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন হেলাল উদ্দীন। ইলিয়টগঞ্জ বাজারের মাদক ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন রামলাল, নাজমা ও ফারুক। এরা দীর্ঘদিন ধরে চোলাই মদের ব্যবসা করে আসছেন। চান্দিনা এলাকায় চোলাই মদের ব্যবসা করছেন কার্তিক বাবু। দাউদকান্দি পাখির মোড়ে বিদেশী বিয়ার ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন রিয়াদ হোসেন, হোমনা বাজারের মাদক ব্যবসায়ী ইন্দ্রজিৎ ও বিমল। হোসেনদী বাজারখানের গেট এলাকার বিদেশী বিয়ার ও চোলাই মদের ব্যবসায়ী ফারুক। নায়েরগাঁও এলাকার মাদক ব্যবসায়ী খোকন। সবজিকান্দি ও বারোপাড়া পাগলার মাজারের সামনে দীর্ঘদিন ধরেই মাদক ব্যবসা করছেন আনিছ ও রোশন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ছাড়াও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও এ অঞ্চলের কয়েকশ ব্যক্তিকে বড় ধরনের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তালিকা অনুযায়ী ইলিয়টগঞ্জের ভিকতলায় নিষিদ্ধ ভারতীয় ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন মঙ্গল, পুতুল, নাজমা, আক্তার ও মোহন মিয়া। গৌরীপুর বাজার, কানাচোয়া বাসস্ট্যান্ড, তুজারভাঙ্গা, সবজিকান্দি, জুরানপুর, মলয়বাজার, শ্রীরায়ের চর ও দৌলতপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য ইয়াবা সম্রাট সালাউদ্দীনের। তার অধীনে অর্ধশতাধিক খুচরা মাদক বিক্রেতা মোবাইল ফোনে মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে। নুয়ৈইয়ের বাজার এলাকায় অবৈধ বিদেশী বিয়ারের ব্যবসা করছে আবদুল লতিফ সরকার। শ্রীকান্দি গ্রামে চোলাই মদ ও বিয়ারের ব্যবসা করছেন ইলিয়াস দর্জি। দাউদকান্দি পৌর এলাকায় গাঁজা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন কহিনুর বেগম। জুরানপুর এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সাহস পুলিশের নেই। কারণ এ এলাকায় স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ভাতিজা ইকবাল ভূইয়া প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করছেন। ওই জনপ্রতিনিধির ক্ষমতার জোরে ইকবাল ভুঁইয়া জুরানপুর এলাকায় মাদকের বড়সড় আখড়া গড়ে তুলেছেন। সূত্র জানিয়েছে, তার এই আখড়ায় ঢাকা থেকেও মাদকসেবীদের দল নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। সূত্র মতে, তুজারভাঙ্গা এলাকার ফেনসিডিল সম্রাট নাদিম ওরফে ফেন্সি নাদিক। সবজিকান্দি এলাকার পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ল্যাংড়া মিলন। সিরায়েরচর এলাকার মাদক ব্যবসায়ী বাতেন ওরফে ফেন্সি বাতেন ও ফেন্সি জনি। তিনচিটা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করছেন কবির ওরফে ইয়াবা কবির। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের নিজস্ব খুচরা বিক্রেতারা মোবাইল ফোনে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপনে মাদক পৌঁছে দেয়।
জানতে চাইলে দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি ছালাম মিয়া যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, তারা মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছেন। কিছুদিন পরপরই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।
দাউদকান্দিতে মাদকের থাবা ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। এর কারণ হিসেবে জনবল স্বল্পতার কথা বলছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কুমিল্লা উপ-অঞ্চলের উপ পরিচালক একেএম শওকত ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কুমিল্লা উপ-অঞ্চলে তিনিসহ মাত্র ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে একজন তত্ত্বাবধায়ক, মাত্র দুজন পরিদর্শক ও দুজন এএসআই এবং ছয়জন সিপাই। তিনি বলেন, এত স্বল্প লোকবল দিয়ে বিশাল এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। তারপরও মাদক নির্মূলে তিনি দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন বলে তার দাবি।
জনপ্রতিনিধিরা যা বললেন
দাউদকান্দি ও এর আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ মাদকের বিস্তার নিয়ে উদ্বিঘ্ন এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার পেছনে আইনশৃংখলা বাহিনীকে দায়ী করেছেন। কেউবা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। আবারও কেউ কেউ বলেছেন, স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি তার ভাতিজাকে দিয়ে গোটা দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণেই পুলিশের পক্ষে তেমন জোরালো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পারুল আক্তার যুগান্তরকে বলেন, এই মাদক পরিস্থিতির জন্য আমাদেরই দায় নিতে হবে। কারণ আমরা তো এর প্রতিকার করতে পারছি না। তিনি বলেন, এই মাদক ব্যবসার পেছনে কারা বা কাদের হাত আছে এটা আমি না জানলেও এখানকার অনেকেই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ্য মাদক ব্যবসা দেখে তার খারাপ লাগে। তিনি মনেপ্রাণে চান এটা বন্ধ হোক। কিন্তু পেরে উঠছেন না। তিনি বলেন, মাসিক আইনশৃংখলা সভায় মাদকের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এরপর দুএকদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। এ পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হলে আগামীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ইলিয়টগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, তার এলাকায় বিদেশী মদ-বিয়ার, দেশীয় চোলাই মদ ও ফেনসিডিলের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ এসব মাদক ব্যবসা হচ্ছে সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায়। দাউদকান্দি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মাদকের বিস্তার ঘটেছে গৌরীপুর এলাকায়।
গৌরীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাশেম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এসব মাদক ব্যবসা চলছে। মাঝে মাঝে পুলিশ মোবাইল কোর্ট করে দুএকজনকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এতে তেমন কোনো কাজ হয় না। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রভাবশালীর হাত থাকার প্রশ্নে তিনি বলেন, মাদক ব্যবসা করতে হলে যে পুঁজির দরকার হয় তা নিশ্চয় কেউ না কেউ জোগান দিচ্ছে। যিনি অর্থের জোগান দিচ্ছেন তিনি নিশ্চয় প্রভাবশালী।
- See more at: http://www.jugantor.com/last-page/2014/06/17/112101#sthash.03tV5cko.dpufদাউদকান্দি উপজেলায় মাদকের আগ্রাসন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শত শত হতাশাগ্রস্ত বেকার যুবক মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে দিন দিনি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয় ও অপরাধ প্রবণতা। মাদকের আগ্রাসন শুধু উপজেলা শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি ছড়িয়ে গেছে ১৫টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। সন্ধ্যা নামলেই গ্রামেগঞ্জে প্রকাশ্যে চলছে মাদক সেবন। মাদকাসক্ত সন্তানকে নিয়ে অনেক পরিবারই এখন দিশেহারা। মাদক বেচা-কেনা ও সেবন প্রকাশ্যে চললেও নির্বিকার গোটা প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
আইনশৃংখলা রক্ষা বাহিনীর যোগসাজশে নির্বিঘ্নে চলছে মাদকসংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম। এমনকি স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি তার নিকট আত্মীয়কে দিয়ে গোটা দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করাচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করেছে পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এই তালিকা তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে সরকারের এই দুই প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীতে তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। যদিও পুলিশের দাবি, মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, থানায় নথিভুক্ত হওয়া মামলায় স্থান পাওয়া মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যার তুলনায় প্রকৃত মাদক ব্যবসী কয়েকগুণ বেশি।
দাউদকান্দি উপজেলা সদর ও এর ১৫ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্থানীয় থানা পুলিশের নথি থেকেও আঁচ করা যায় দাউদকান্দির মাদক পরিস্থিতির ভয়াবহতা। মডেল থানায় মার্চ, এপ্রিল ও মে- এ তিন মাসে মাদকসংক্রান্ত মামলা হয়েছে যথাক্রমে ১৬, ১৫ ও ১১টি। এই সময়ে মাদক ব্যবসার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে মোট ৫৬ জন। অভিযোগ রয়েছে লোক দেখানোর জন্য পুলিশ মাঝে মাঝে অভিযান চালালেও মাদক নির্মূলে পুলিশের তৎপরতা পর্যাপ্ত নয়। কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলায় মোট ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা। স্থানীয় সরকারের এই ১৬ কাঠামোতেই মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন ঘটেছে। সীমান্তবর্তী জেলা কুমিল্লার খুব কাছের উপজেলা হওয়ায় এখানে মাদকের বিস্তার দিন দিন বাড়ছে।
সরেজমিন বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা বিক্রি হচ্ছে হোম সার্ভিস ডেলিভারির মাধ্যমে। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ হচ্ছে মোবাইল ফোনে। এরপরই নিরাপদে ডেলিভারি। যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি মাদকের বিস্তার দেখা গেছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- দাউদকান্দি উত্তর, সুন্দলপুর ইউনিয়ন, বারপাড়া, গৌরীপুর, ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ও দক্ষিণ, মোহাম্মদপুর পশ্চিম, মালিগাঁও, মারুকা, বিটেশ্বর, দৌলতপুর, পাঁচগাছিয়া, গোয়ালমারী, জিংলাতলী, দাউদকান্দি পৌরসভার তুজারভাঙ্গা, দোনারচর, টোল প্লাজা, শহীদনগর, সুন্দলপুর, রায়পুর, ইলিয়টগঞ্জ, মলয় বাজার, নৈয়াইর বাজার, পালের বাজার, পাঁচগাছিয়া, কনাছোঁয়া, জুরানপুর, হাসানপুর, মোহাম্মদপুর, বারোপাড়া, চারিপাড়া, জিয়ারকান্দি, আমিরাবাদ, লক্ষ্মীপুর, শ্রীকান্তদি, শ্রীরায়েরচর, হামিদ্দি, সবজিকান্দি, বিশ্বরোড, পেন্নায়, গুপচর, চক্রতলা, পিতামুদ্বি ও চৌধুরীপাড়া।
যারা মাদক ব্যবসায়ী
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তালিকা অনুযায়ী মোট ১৬ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী দাউদকান্দিতে মদ, ইয়াবা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছে। এদের অধীনে কাজ করছে আরও কয়েকশ খুচরা মাদক বিক্রেতা। তালিকা অনুযায়ী সাহাপাড়া মন্দিরের কাছে চোলাই ও বিদেশী মদ বিয়ারের ব্যবসা করছেন রবীন্দ্র সাহা ও সেন্টু সাহা। দাউদকান্দি উপজেলা কার্যালয়ের সামনে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী মদের ব্যবসা করছেন অশোক সাহা। গৌরীপুর বাজারে চোলাই মদ ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন হেলাল উদ্দীন। ইলিয়টগঞ্জ বাজারের মাদক ব্যবসায়ীরা হচ্ছেন রামলাল, নাজমা ও ফারুক। এরা দীর্ঘদিন ধরে চোলাই মদের ব্যবসা করে আসছেন। চান্দিনা এলাকায় চোলাই মদের ব্যবসা করছেন কার্তিক বাবু। দাউদকান্দি পাখির মোড়ে বিদেশী বিয়ার ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন রিয়াদ হোসেন, হোমনা বাজারের মাদক ব্যবসায়ী ইন্দ্রজিৎ ও বিমল। হোসেনদী বাজারখানের গেট এলাকার বিদেশী বিয়ার ও চোলাই মদের ব্যবসায়ী ফারুক। নায়েরগাঁও এলাকার মাদক ব্যবসায়ী খোকন। সবজিকান্দি ও বারোপাড়া পাগলার মাজারের সামনে দীর্ঘদিন ধরেই মাদক ব্যবসা করছেন আনিছ ও রোশন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ছাড়াও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও এ অঞ্চলের কয়েকশ ব্যক্তিকে বড় ধরনের মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তালিকা অনুযায়ী ইলিয়টগঞ্জের ভিকতলায় নিষিদ্ধ ভারতীয় ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন মঙ্গল, পুতুল, নাজমা, আক্তার ও মোহন মিয়া। গৌরীপুর বাজার, কানাচোয়া বাসস্ট্যান্ড, তুজারভাঙ্গা, সবজিকান্দি, জুরানপুর, মলয়বাজার, শ্রীরায়ের চর ও দৌলতপুরে একচ্ছত্র আধিপত্য ইয়াবা সম্রাট সালাউদ্দীনের। তার অধীনে অর্ধশতাধিক খুচরা মাদক বিক্রেতা মোবাইল ফোনে মাদকসেবীদের কাছে ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে। নুয়ৈইয়ের বাজার এলাকায় অবৈধ বিদেশী বিয়ারের ব্যবসা করছে আবদুল লতিফ সরকার। শ্রীকান্দি গ্রামে চোলাই মদ ও বিয়ারের ব্যবসা করছেন ইলিয়াস দর্জি। দাউদকান্দি পৌর এলাকায় গাঁজা ও ফেনসিডিলের ব্যবসা করছেন কহিনুর বেগম। জুরানপুর এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর সাহস পুলিশের নেই। কারণ এ এলাকায় স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির ভাতিজা ইকবাল ভূইয়া প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করছেন। ওই জনপ্রতিনিধির ক্ষমতার জোরে ইকবাল ভুঁইয়া জুরানপুর এলাকায় মাদকের বড়সড় আখড়া গড়ে তুলেছেন। সূত্র জানিয়েছে, তার এই আখড়ায় ঢাকা থেকেও মাদকসেবীদের দল নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। সূত্র মতে, তুজারভাঙ্গা এলাকার ফেনসিডিল সম্রাট নাদিম ওরফে ফেন্সি নাদিক। সবজিকান্দি এলাকার পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ল্যাংড়া মিলন। সিরায়েরচর এলাকার মাদক ব্যবসায়ী বাতেন ওরফে ফেন্সি বাতেন ও ফেন্সি জনি। তিনচিটা গ্রামে দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসা করছেন কবির ওরফে ইয়াবা কবির। এসব মাদক ব্যবসায়ীদের নিজস্ব খুচরা বিক্রেতারা মোবাইল ফোনে সরাসরি ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপনে মাদক পৌঁছে দেয়।
জানতে চাইলে দাউদকান্দি মডেল থানার ওসি ছালাম মিয়া যুগান্তরের কাছে দাবি করেন, তারা মাদকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছেন। কিছুদিন পরপরই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা এখন অনেকটাই কমে এসেছে।
দাউদকান্দিতে মাদকের থাবা ভয়াবহ আকার ধারণ করলেও তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের। এর কারণ হিসেবে জনবল স্বল্পতার কথা বলছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কুমিল্লা উপ-অঞ্চলের উপ পরিচালক একেএম শওকত ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কুমিল্লা উপ-অঞ্চলে তিনিসহ মাত্র ১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে একজন তত্ত্বাবধায়ক, মাত্র দুজন পরিদর্শক ও দুজন এএসআই এবং ছয়জন সিপাই। তিনি বলেন, এত স্বল্প লোকবল দিয়ে বিশাল এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণ প্রায় অসম্ভব। তারপরও মাদক নির্মূলে তিনি দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন বলে তার দাবি।
জনপ্রতিনিধিরা যা বললেন
দাউদকান্দি ও এর আশপাশের এলাকায় ভয়াবহ মাদকের বিস্তার নিয়ে উদ্বিঘ্ন এলাকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে মাদক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়ার পেছনে আইনশৃংখলা বাহিনীকে দায়ী করেছেন। কেউবা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে সরকারি দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলেছেন। আবারও কেউ কেউ বলেছেন, স্থানীয় একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি তার ভাতিজাকে দিয়ে গোটা দাউদকান্দিতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণেই পুলিশের পক্ষে তেমন জোরালো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান পারুল আক্তার যুগান্তরকে বলেন, এই মাদক পরিস্থিতির জন্য আমাদেরই দায় নিতে হবে। কারণ আমরা তো এর প্রতিকার করতে পারছি না। তিনি বলেন, এই মাদক ব্যবসার পেছনে কারা বা কাদের হাত আছে এটা আমি না জানলেও এখানকার অনেকেই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খুলবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রকাশ্য মাদক ব্যবসা দেখে তার খারাপ লাগে। তিনি মনেপ্রাণে চান এটা বন্ধ হোক। কিন্তু পেরে উঠছেন না। তিনি বলেন, মাসিক আইনশৃংখলা সভায় মাদকের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়। এরপর দুএকদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। আবার সবকিছু আগের মতো চলতে থাকে। এ পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না হলে আগামীতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
ইলিয়টগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, তার এলাকায় বিদেশী মদ-বিয়ার, দেশীয় চোলাই মদ ও ফেনসিডিলের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। কিন্তু পুলিশ এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। কারণ এসব মাদক ব্যবসা হচ্ছে সরকারদলীয় স্থানীয় নেতাকর্মীদের ছত্রছায়ায়। দাউদকান্দি উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মাদকের বিস্তার ঘটেছে গৌরীপুর এলাকায়।
গৌরীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল হাশেম বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এসব মাদক ব্যবসা চলছে। মাঝে মাঝে পুলিশ মোবাইল কোর্ট করে দুএকজনকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এতে তেমন কোনো কাজ হয় না। মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় প্রভাবশালীর হাত থাকার প্রশ্নে তিনি বলেন, মাদক ব্যবসা করতে হলে যে পুঁজির দরকার হয় তা নিশ্চয় কেউ না কেউ জোগান দিচ্ছে। যিনি অর্থের জোগান দিচ্ছেন তিনি নিশ্চয় প্রভাবশালী।
No comments:
Post a Comment