Thursday, June 5, 2014

সাহিত্যের কালো গোলাপ আর নেই

মায়া অ্যাঞ্জেলো

সাহিত্যের কালো গোলাপ আর নেই

শামস আরেফিন
প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, 'তিনি আমেরিকার সবচেয়ে বিস্ময়কর মহিলা। বাল্যকালের ভোগান্তি হয়তো তাঁর কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে সাময়িকভাবে, কিন্তু এতে করে তিনি যে নতুন স্বর পেয়েছেন, আমেরিকার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তা মেঘশেষে রংধনুর মতো। আর তা পুরো আমেরিকাবাসীকে স্বক্ষেত্রে বিখ্যাত হওয়ার প্রেরণা জোগাবে।' এতে বোঝা যায়, সত্যি মায়া অ্যাঞ্জেলো সাহিত্যের সমুদ্রে ভেসে ওঠা কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দ্বীপ নয়। তিনি যেমন ছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন, ঠিক তেমনি বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সর্বাধিক সক্রিয়। ৮৬ বছরের এই জীবনে তিনি ৩০টিরও বেশি বই লিখেছেন। দু'হাতে সব্যসাচীর মতো কবিতা, গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। আর পাঠকের মনের ক্ষুধা মেটাতে তিনি তাঁর ছয়টি আত্মজীবনীমূলক বই রচনা করেন। জীবদ্দশায় তিনি গদ্য ও পদ্যের জন্য তিন বার 'গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড' লাভ করেন। তিনিই হলিউডের প্রথম কৃষ্ণাজ্ঞ মহিলা পরিচালক। যৌবনে মার্টিন লুথার কিং-এর আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আর ১৯৯৩ সালে বিলক্লিনটনের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে অভিষেক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রিত হন। বিখ্যাত কবি রবার্ট ফ্রস্টের পর তিনিই দ্বিতীয় কবি হিসেবে এই সম্মান লাভ করেন। অভিষেক অনুষ্ঠানে পঠিত কবিতাটি 'অন দ্য পালস অব মর্নিং' ছিল আমেরিকার বিভিন্ন সমপ্রদায়ের মানুষের আশা ও প্রত্যাশার প্রতিবিম্ব। যাতে তিনি বলেন, 'চোখ তুলে তাকাও/ দেখো দিনগুলো তোমার জন্যই ভেঙে যায়/ আবার পুনর্জন্ম নাও স্বপ্ন দেখার জন্য'। ২০১১ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার কাছ থেকে আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক পুরস্কার 'প্রেসিডেন্ট মেডেল অব ফ্রিডম' পুরস্কার লাভ করেন। 

১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মৃতিকথামূলক উপন্যাস 'আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস' ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। তাঁর শৈশবে দেখা বর্ণবাদের হিংস্রতা ও ভয়বহতা এতে চিত্রিত হয়েছে। তিনি একাধারে গান, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। আত্মজীবনী 'আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস'-এ স্বীয় জীবনের উত্থানের কাহিনি তুলে ধরেন। স্টেনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এমিরিটাস অধ্যাপক আরনল্ড র্যামপেরসাড বলেন, ' তিনি কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার উভয়সংকট, ভয়ঙ্কর বাস্তবতা ও জীবনযুদ্ধের চিত্র তাঁর কালের সকল লেখক থেকে অন্যন্যরূপে উপস্থাপন করেছেন। আত্মজীবনীতে তিনি সাহস, সংগ্রাম ও সততার প্রতিবিম্ব হয়ে উদ্ভাসিত হয়েছেন।'

তিনি ১৯২৮ সালের ৪ এপ্রিল সেন্ট লুইসের মিসেসৌরির ম্যারগুইতে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকালে সেন্ট লুইসে ভাই ও দাদির সাথে বসবাস করতেন। মাত্র আট বছর বয়সে মায়ের বন্ধু তাঁর শ্লীনতাহানি করে। তাঁর চাচা এতে ক্ষিপ্ত হয়ে পশুটিকে হত্যা করে। এরপর থেকে পাঁচ বছরের জন্য তার মুখ দিয়ে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। কিন্তু মনের ভাব প্রকাশের জন্য শব্দ ব্যবহারের এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়। তিনি কৃষ্ণাঙ্গ লেখক লংস্টন হাফ, ডব্লিউ ই বি ডু বয়েস, পল লরেন্স সেই সাথে উইলিয়াম শেক্সপিয়র, চার্লস ডিকেন্স এবং এডগার অ্যালান পো-তে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষত বাল্যকালে তিনি মিসেস ফ্লাওয়ারের রচিত 'অ্যা মোমেন্ট অব ফ্রেন্ডশিপ' পাঠ করে কবিতাপ্রেমি হয়ে পড়েন। বারো বছর বয়সে তিনি আবার কথা বলতে শুরু করেন। অ্যাঙ্গোলা জর্জওয়াশিংটন হাই স্কুলে কিছুটা সময় অধ্যয়ন করে। ১৭ বছর বয়সে স্কুলজীবন শেষ করার পূর্বেই তিনি এক পুত্র সন্তানের জননী হন।

কর্মজীবনের প্রাথমিক দিকে তিনি সানফ্রান্সিসকোতে ট্রামের কন্ডাক্টরের চাকরি করেন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে সেই কঠিন সময়গুলোর চিত্র তুলে ধরেছেন। আত্মজীবনীর তৃতীয়খণ্ডে তিনি বলেন—সেই সময় তিনি নাইট ক্লাবের নর্তকী হিসেবেও কাজ করেছেন, হামবার্গার তৈরি করেছেন। আবার ক্রেলিও রেস্টুরেন্টে রাতে বাবুর্চির চাকরি নিয়েছেন। আবার কখনো ইলেকট্রনিক্স দোকানে, অটোমোবাইল দোকানে গাড়ির রং করেছেন। আর এসবই করেছেন তাঁর পুত্রের জীবিকা নির্বাহ করার জন্য। তিনি মনে করেন, এত অল্প বয়সে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে না হলে তিনি এভাবে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না। হয়তো এত বড়ো লেখকও হতে পারতেন না। তাই তিনি বলেন, 'আমার পুত্রটি আমার কাছে আজও এক বিস্ময়। ও আমার আশীর্বাদ ও প্রেরণাস্বরূপ।' 

১৯৫০ সালে তিনি অবসরপ্রাপ্ত এক ক্যাপ্টেনের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সর্ম্পক তাঁদের বেশি দিন টেকেনি। সর্ম্পকছেদের পর অ্যাঞ্জেলো আবার নিউ ইর্য়ক সিটিতে নৃত্যকলায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৫৪ সালে সানফ্রান্সিসকোতে অবস্থান করার সময় আবার গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। এই সময় হাওয়াইন ও ওয়েস্ট কোস্টের নাইটক্লাবে তিন গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১৯৫০-এর শেষ দিকে লেখক সংগঠন 'হারলেম রাইটার গিল্ড'-এর সাথে যুক্ত হন। এই সংগঠনের মাধ্যমেই তিনি পরিচিত হন মার্টিন লুথার কিংয়ের সাথে। মার্টিন লুথার কিংয়ের বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন—কৃষ্ণাঙ্গের নাগরিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবেন। মার্টিন লুথার কিংয়ের সাথে কাজ করতে গিয়ে ১৯৬২ সালে কায়রো ঘানাসহ পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ করেন। এ সময় তিনি ফ্রিল্যান্সার রাইটার ও আফ্রিকান রিভিউ পত্রিকার ফিচার এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর জেমস বাল্ডউইন ও রেনডম হাউস প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক রবার্ট ব্রাউস তাঁকে আত্মজীবনী লিখতে উত্সাহিত করেন। 'আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস' ছয় খণ্ডের আত্মজীবনীর প্রথম অংশ। আমেরিকার অনেক স্কুলে এটি এখনো পাঠ্য। তবে বইটি অতিরিক্ত বর্ণবাদ, যৌন নিগ্রহ ও দাঙ্গার চিত্রময় বর্ণনার কারণে সমালোচিতও হয়েছে। তাঁর গদ্য লেখার কৌশল কথ্যভাষার মতো। অধিকাংশ সমালোচক 'আই নো হোয়াই দ্য কেজড বার্ড সিংস' অন্য পাঁচটি আত্মজীবনীর তুলনায় শ্রেষ্ঠ বলেছেন। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় আত্মজীবনী 'গ্যাদার টুগেদার ইন মাই নেম'-এ সতের বছর বয়সে মা হওয়া ও মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন। এরপর ইউরোপ ও আফ্রিকার অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন 'সিঙ্গিন অ্যান্ড সুইঙ্গিন অ্যান্ড গেটিন; 'ম্যারি লাইক ক্রিসমাসে'। আর ১৯৮১ সালে প্রকাশিত 'পর্গি অ্যান্ড বেস'; 'দ্য হার্ট অব উইমেন'-এ নাট্যজীবন, লেখকজীবন ও নিউ ইর্য়কে অবস্থানকালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের উত্তপ্তদিনগুলো প্রাধান্য পায়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত 'অল গডস চিলড্রেন নিড ট্রাভেলিং শো'-তে তিনি পশ্চিম আফ্রিকা ও আমেরিকাতে ফিরে আসার জীবন তুলে ধরেন। অবশেষে ১৫ বছর সময় নিয়ে আত্মজীবনী 'অ্যা সং ফ্লাং আপ টু হেভেন' ২০০২ সালে রচনা করেন। এই বইয়ে তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল অর্থাত্ মার্টিন লুথার কিংয়ের মৃত্যু ও তাঁর প্রথম বই রচনা করার পূর্ব পর্যন্ত জীবনের বাস্তবতার চিত্রায়ণ করেন। এই বইটি লিখতে তিনি অনেক সময় নেন। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, 'এ সময় অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। মার্টিন লুথার কিংকে হত্যা করা হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ দাঙ্গা শুরু হয়। ... আর এই অবস্থায় কিভাবে এই কঠিন বাস্তবতা আমি তুলে ধরতে পারি। এই ভাবনা নিয়েই লিখতে বসি।' 

অ্যাঞ্জেলোর লেখার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে হ্যারি পটারের জনপ্রিয় লেখক জে কে রাউলিং শুধু তাঁর উক্তি দিয়ে এক টুইট বার্তায় জানান, 'আমি শিখেছি, লোকজন খুব সহজেই ভুলে যায় আপনার যেকোনো কাজ বা কথা। কিন্তু তারা কখনো ভোলে না আপনি তাদের অনুভূতিতে কিভাবে আঘাত করেছেন, তা।' অ্যাঞ্জেলো একজন কবিও। তাঁর কবিতা অসংখ্যবার আমেরিকাতে আবৃত্তি হয়েছে। একে বলা যায়, কালো গোলাপের ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য। তাঁর কবিতা কখানো নারীর শক্তি, মানবিক উত্কর্ষ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমালোচনায় মুখর। আবার কখনো সমাজের সর্বস্তরের জনগণের জন্য সামাজিক ন্যায়বিচারের আভায় প্রজ্জ্বলিত করে পাঠকের বিবেক। তাঁর কবিতার বই 'জাস্ট গিভ মি এ কুল ড্রিঙ্ক অব ওয়াটার; ফরে আই ডিই' ১৯৭২ সালে পুলিত্জারের জন্য মনোনীত হয়। সমালোচকদের মতে—এই বইয়ের প্রথম ২০টি কবিতা ভালোবাসার পরিপূর্ণ বিস্তার। যাতে আবেগতাড়িত ভালোবাসাকে আবিষ্কার ও হারানোর তীব্র বেদনা প্রকাশ পেয়েছে। আর অন্যান্য কবিতায় তিনি ১৯৬০ সালে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের দুঃসহ জীবনসংগ্রাম ও দাসত্বের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। শব্দ নিয়ে খেলার পারদর্শিতা রয়েছে তাঁর কবিতায়। এক সাক্ষাত্কারে বলেন, 'আমি মনে করি, শব্দ নিয়ে কাজ করাটাই লেখকের গুরুদায়িত্ব। পৃথিবীর সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শব্দ।... শব্দ নিয়ে নিজের মনমতো খেলে একজন লেখক। এই শব্দকে লেখক বলের মতো ছুড়ে মারেন কল্পনার দেয়ালে। আর বলের মতো বাউন্স করে তা আবার ফিরে আসে লেখকেরই কাছে।' এই কীর্তিমান লেখক সাহিত্যে এভাবেই দখল করে নিয়েছেন অনন্য স্থান। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে তিনিই বলতে পারেন, 'আপনি যদি সব সময় সাধারণ মানুষ হতে চান, তাহলে আপনি টেরও পাবেন না কত মহত্ মানুষে আপনি রূপান্তরিত হয়েছেন।' 

তাঁর মৃত্যুতে শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্ব-সাহিত্য হারালো এক মহত্ কবি ও আত্মজীবনী লেখককে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন পাঠক হূদয়ে মানবতার প্রতিবিম্ব হয়ে।
The Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment