Thursday, June 26, 2014

ভারতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতি

ভারতে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ স্বীকৃতি
বাসবী বড়ুয়া
নেপাল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পর ভারতের হিজড়া সম্প্রদায় ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ মর্যাদায় অভিষিক্ত হলো। গত ১৫ এপ্রিল ন্যাশনাল লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির (ঘঅখঝঅ) ২০১২ সালে দায়ের করা রিট পিটিশনের ভিত্তিতে ভারতের সুপ্রীমকোর্ট এই রায় দেন। এই পিটিশনে যুক্ত ছিল হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থা এবং মুম্বাইয়ের ট্রান্সজেন্ডার রাইটস এ্যাকটিভিস্ট লক্ষ্মী ত্রিপাঠি। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে দিল্লী হাই কোর্ট ফৌজদারি দ-বিধি ধারা ৩৭৭-এর সংশোধনীর মাধ্যমে ভিন্ন যৌনসত্তার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ওই ঐতিহাসিক রায় উল্টে ২০১৩ ডিসেম্বরে ভারতের সুপ্রীমকোর্ট ভিন্ন যৌনসত্তার ব্যক্তিদের পুনরায় ‘অপরাধী’ হিসেবে আখ্যা দেন। এ রকম একটি জনসাধারণ্যে সমালোচিত রায়ের পর তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতিমূলক বর্তমান এই রায়টি অনেকের মাঝে নতুন করে আশার আলো সঞ্চার করেছে। এই রায় প্রকাশের প্রায় পরপরই সুপ্রীমকোর্ট ৩৭৭ বিষয়ে পুনরায় শুনানির আবেদন গ্রহণ করেছেন। অনেকেই এই রায়কে যৌন অধিকার আন্দোলনের সংগ্রামে আরেকটি মাইলফলক বলে মনে করেন। এই রায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ‘হিজড়া’ কারা, সেই বিষয়ে উদার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেয়া একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। আদালতের রায় মতে, ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লিঙ্গ পুনর্স্থাপন প্রক্রিয়া বা ঝজঝ (ঝবী জবধংংরমহসবহঃ ঝঁৎমবৎু) বাধ্যতামূলক নয়। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি তার জন্মনির্দেশিত লিঙ্গ পরিচয়ের বাইরে স্বীয় লিঙ্গপরিচয় বাছাইয়ের সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশের সম্প্রতি দেয়া সরকারী ঘোষণার সঙ্গে ভারতের সুপ্রীমকোর্টের এই রায়ের মিল প্রচুর। উভয় ক্ষেত্রেই হিজড়াদের সংজ্ঞায়ন অত্যন্ত ইতিবাচক, যেখানে ব্যক্তির পরিচয়ের মূলে তার যৌনসত্তার স্বীকৃতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে এসেছে। বলা হয়েছে, এই সম্প্রদায়ের সামাজিক সুযোগ-সুবিধা বিধানে ‘কোটা’ ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হবে। কিন্তু তার পরেও শঙ্কা জাগে, এই রায় কতটুকুু ভূমিকা রাখবে যৌন অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। এই আশঙ্কা প্রকাশের কারণ দুটি- একটি তাত্ত্বিক এবং আরেকটি রায়ের প্রায়োগিক সাফল্য। ভারতের আদালত এবং বাংলাদেশ সরকার খুব বেশি জোর দিয়েছে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সামাজিক অনগ্রসরতাকে, যার মূলে রয়েছে তাদের ভাষায়, হিজড়া ব্যক্তির লিঙ্গীয় অনির্দিষ্টতায় ‘শারীরিক ত্রুটি’, যেহেতু তারা ‘প্রজনন ক্ষমতাসম্পন্ন’ নন। তাই রায়ে তাত্ত্বিক অস্পষ্টতার একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই- পুরুষাঙ্গবিহীন ও পুরুষাঙ্গসহ হিজড়া ব্যক্তিকে আপত্তিজনক শব্দ নপুংসক বা খোজা হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু পুরো রায়ে মাননীয় বিচারকরা স্পষ্ট করেন- ব্যক্তিসত্তা প্রকাশের অধিকার সবচেয়ে বড় অধিকার।
প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এই রায়ের সমস্যা অর্থাৎ ঢালাওভাবে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ পরিচয় প্রয়োগ বিদ্যমান যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ আইন ও অন্যান্য পারিবারিক আইনে (যেমন : বিবাহ, উত্তরাধিকার, দত্তক আইন ইত্যাদি) কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সে বিষয়ে আদালতের কোনো নির্দেশনা নেই। আরেকটি অস্বস্তির জায়গা হচ্ছে- যে হিজড়া ব্যক্তি ‘মহিলা’ হিসেবে পরিচিত হতে চান এবং সংরক্ষিত নারী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান, সেক্ষেত্রে এই রায় প্রতিবন্ধকতা হবে কিনা। কেননা দেখা গেছে, ২০১১ সালের আদমশুমারিতে লিঙ্গ পরিচয়দানের ক্ষেত্রে ‘ড়ঃযবৎ’ নামক একটি বর্গ থাকলেও জাতীয় গৃহ নিবন্ধীকরণ নির্দেশিকাতে হিজড়া ব্যক্তিদের ‘পুরুষ’ হিসেবে গণ্য করার কথা বলা হয়েছে। ঠিক একই বছরে কর্ণাটকের ‘পুলিশ আইনে’ একটি বিশেষ ধারা যুক্ত হয়, যেটার উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- হিজড়াদের ‘বিতর্কিত’ কর্মকা- যেমন শিশু অপহরণ, ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ কর্মকা- নিরোধ করা। অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রবর্তিত ‘ঈৎরসরহধষ ঞৎরনবং অপঃ’-এর ছায়া এই ধারায় ভর করেছে। এই ধরনের প্রবিধান হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকেই তুলে ধরে।
মানবিকতা গুণসম্পন্ন ভাল আইন অনেক সময় সামাজিক আন্দোলনে প্রভাবকের মতো কাজ করে। কিন্তু যৌন অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলোর সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়ার গতি খুবই ধীর। বিরুদ্ধ সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তাই ভিন্ন যৌনসত্তার অধিকার রক্ষার্থে যে কোন ক্ষুদ্র অগ্রগতি প্রশংসার দাবি রাখে। অবিরাম সামাজিক এবং রাজনৈতিক মনোযোগ এর সফল বাস্তবায়নে অপরিহার্য।
সৌজন্যে : আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment