যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জটিলতা ও অচলাবস্থা
শাহরিয়ার কবির
’৭১-এর গণহত্যাকারী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গঠন করা হয়েছে ২০১০-এর ২৫ মার্চ। এর এক বছর পর দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। প্রথমদিকে প্রয়োজনীয় রসদ, দক্ষ জনশক্তি এবং অন্য সীমাবদ্ধতার কারণে আইসিটির কার্যক্রম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও ২০১৩ সালে ট্রাইব্যুনাল অনেকটা স্বাভাবিক গতি প্রাপ্ত হয়েছে। এ বছর দুই ট্রাইব্যুনালে নয়টি মামলায় ১০ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন বা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মামলার আপিলেরও নিষ্পত্তি হয়েছে এ বছর এবং ট্রাইব্যুনালের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি বৃদ্ধি করে আপিলের রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে, যা গত ডিসেম্বর (২০১৩) কার্যকর হয়েছে।
২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অকল্পনীয় বিজয়ের পর মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল হয়েছে। মহাজোটের আগের মন্ত্রিসভার অনেকে বাদ পড়েছেন, অনেক নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়েছি। গত মন্ত্রিসভায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দুজন মন্ত্রী ছিলেন। প্রবীণ আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ছিলেন পূর্ণ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা, রাজপথের আন্দোলনে অভিজ্ঞ সংগঠক এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন থেকে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে সাফল্য তার সিংহভাগ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হলেও তাঁর এ দুই মন্ত্রীর আগ্রহ ও আন্তরিকতা অস্বীকার করা যাবে না।
ট্রাইব্যুনালের স্থান নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ঘাটতি সম্পর্কে অনেক সময় এ মন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের তর্ক হয়েছে, তাঁদের সমালোচনা করেছি, কিন্তু বিচারের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করেননি। দেরিতে হলেও ট্রাইব্যুনালের অনেক অপূর্ণতা তারা পূরণ করেছেন এবং ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন কার্যক্রম ক্রমশ গতিপ্রাপ্ত হয়েছে।
২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে বাদ দেয়া হয়েছে, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞ হলেও রাজনীতিতে নবাগত এ্যাডভোকেট আনিসুল হককে, যিনি তাঁর পিতা এ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। প্রথমবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভের পর আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হলে তাঁর সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে হবে। পূর্বপরিচয়ের কারণে তিনিও শপথগ্রহণের পর পরই সৌজন্যবশত আমাদের টেলিফোন করেছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। আমরা আমাদের ষোলআনা সহযোগিতা তাঁকে নিশ্চিত করেছি।
নতুন আইনমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রসিকিউশনের কেউ কেউ খবরের কাগজে বলা শুরু করেছেন, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে আওয়ামী লীগের সদস্য ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না। তাঁরা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে এবং নির্দিষ্টভাবে নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তুরিনের মতো একজন দক্ষ ও মেধাবী আইনজীবী প্রসিকিউশনে যুক্ত হোক এটা এঁরা কখনও চাননি, যেমনটি চায়নি জামায়াত। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মামলায় তাকে যখন প্রসিকিউশনের ব্যর্থতার জন্য ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেনি, যার প্রতিবাদে শাহবাগে তরুণ অনলাইন ব্লগারদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার মহাঅভ্যুত্থান ঘটেছিল তারই প্রেক্ষাপটে আইসিটির আইন সংশোধন করা হয়, ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিষয়টি আইনে সংযুক্ত হয়। একই সঙ্গে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে প্রসিকিউশনে এডিশনাল এ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয় প্রধানত কাদের মোল্লার আপিল এবং গোলাম ও জামায়াতে ইসলামীর বিচারের জন্য।
ট্রাইব্যুনালের গত এক বছরের বিচার কার্যক্রমে তুরিন আফরোজের মেধা ও দক্ষতার প্রমাণ রয়েছে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। আড়াই বছর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক শুনানিতে জামায়াত কর্তৃক নিযুক্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে তুরিন কিভাবে তুলোধুনো করেছেন, উপস্থিত সবাই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ফোরাম থেকে ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, আইসিটির গঠন ও বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে জামায়াতের অর্থপুষ্ট মহল যে অপপ্রচার করছে, যেসব প্রশ্ন তুলছে তুরিন আফরোজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খণ্ডন করছেন এবং আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার মান ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরছেন, যা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর দূরের কথা সরকারের নীতি নির্ধারকরাও অনেক ক্ষেত্রে পারেননি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যেমন দুই দিন আগে বললেন, কাদের মোল্লার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁকে নাকি দেশের বাইরে কথা শুনতে হয়েছে। তিনি নতুন বলে সম্ভবত এসব সমালোচনার উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি, আমরা দেশে-বিদেশে জামায়াত ও সহযোগীদের যাবতীয় অপপ্রচার ও প্রশ্নের জবাব লাগাতার দিয়ে যাচ্ছি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তিন দিন আগে এ মুহূর্তে জামায়াতের বিচার করা যাবে না বলে যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে-
‘২৯ ও ৩০ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর চলমান বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন তা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ১) আইসিটির আইনে সংগঠনের বিচারের কথা বলা হলেও শাস্তির কোনও উল্লেখ না থাকার কারণে এ মুহূর্তে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা যাবে না, ২) সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন থাকায় এ মুহূর্তে আইসিটিতে জামায়াতের বিচার করা হলে ওই মামলায় প্রভাব পড়তে পারে এবং ৩) জামায়াতের যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাদের কয়েকজনের বিচার ও শাস্তি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার তাদের শাস্তি হলে আগের শাস্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এসব বিবেচনায় আইনমন্ত্রী এখনই জামায়াতের বিচার না করার পক্ষে তার অভিমত গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
‘একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। আমরা মনে করি ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততার কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইসিটিতে যে বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে আইনমন্ত্রীর অজ্ঞতাপ্রসূত ও বিভ্রান্তিকর এ বক্তব্যের কারণে তা বিঘিœত হবে। একই সঙ্গে গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিলম্বিত করার জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশে-বিদেশে যে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য সেক্ষেত্রেও ইন্ধন যোগাবে।
‘আমরা জানি মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে এ বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা সব সময় উল্লেখ করেছেন। গত ২২ বছর ধরে আমরা ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য দলের বিচারের কথা বলছি। ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সংগঠন এবং এসব দলের ঘাতক বাহিনীসমূহের বিচার না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি প্রহসনে পরিণত হবে। ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যেসব নেতার বিচার হয়েছে তারা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপরাধ করেছেন। জামায়াতের দলীয় দর্শন গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। দলের বিচারের ক্ষেত্রে শাস্তি কি হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারকদের, আইনমন্ত্রীর নয়। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য অপরাধী সংগঠনের বিচার কিভাবে হয়েছে, কিভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে যদি আইনমন্ত্রী জ্ঞাত থাকতেন তাহলে এ ধরনের মন্তব্য তিনি করতে পারতেন না। সুপ্রীমকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত আপিলের সঙ্গে আইসিটিতে যে অপরাধে জামায়াতের বিচার হবে তার কোন সম্পর্ক নেই। চট্টগ্রামের আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচার চলাকালে আইসিটিতে তার বিচার চলমান ছিল। জামায়াতের আইনজীবী কখনও বলেননি এক ব্যক্তির দুই আদালতে এক সঙ্গে বিচার হতে পারে না। কোন সংগঠন যদি একাধিক অপরাধ করে থাকে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হতে পারে, এটি সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এর জন্য আইনজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের কাছে বিচারপ্রত্যাশী সমগ্র জাতি, বিশেষভাবে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের আকুল আহ্বান হচ্ছে- যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সব বাধা ও বিভ্রান্তি দ্রুত অপসারণ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং অঙ্গীকার পূরণ করুন। এ বিচারের ক্ষেত্রে যেকোন ধরনের কালক্ষেপণ জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অবস্থান শক্তিশালী করবে এবং একই সঙ্গে তা আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে।’
গণমাধ্যম এবং আমাদের সমালোচনার কারণে আইনমন্ত্রী তাঁর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে বলেছেন, তিনি জামায়াতের বিচারের বিরুদ্ধে নয়, আইন সংশোধনের পর দ্রুত এ বিচার আরম্ভ হবে।
জামায়াতের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যের আগে ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হায়দার আলী তুরিন অফরোজকে বলেছেন, জামায়াতের মামলার যাবতীয় কাগজপত্র তাকে হস্তান্তর করার জন্য। তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে সাতজন প্রসিকিউটরের একটি দলকে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গত ২৭ মার্চ ২০১৪ তারিখে জামায়াতে ইসলামীর মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে সরকারের নির্দেশে তদন্ত সংস্থা ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত আরম্ভ করে তাদের প্রতিবেদন গত ২৭ মার্চ (২০১৪) প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছে।
সরকারের নির্দেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত আরম্ভ হলেও যে কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত হয়েছে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে জামায়াত নিবন্ধন মামলা থাকার কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলা শুরু করার ক্ষেত্রে অসুবিধে হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করার জন্যই জামায়াত সুপ্রীমকোর্টে তাদের একটি আপিল ঝুলিয়ে রেখেছে এবং আমাদের ধারণা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তারা তা ঝুলিয়ে রাখবে, যাতে তারা বলতে পারে ওই মামলার নিষ্পত্তি না হলে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের মামলার শুনানি করতে পারবে না। কথাটা জামায়াত বলত ট্রাইব্যুনালে তুরিনরা যখন জামায়াতের মামলার শুনানির জন্য যেতেন। জামায়াত বলার আগেই আইনমন্ত্রী জামায়াতের বক্তব্যটিকে নিজের বক্তব্য হিসেবে বাজারে ছাড়লেন। এর পর সরকার পক্ষ কখনও যদি ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের মামলার শুনানি করতে চান জামায়াতের আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে মামলার শুনানি বন্ধ করতে না পারলেও বিলম্বিত অবশ্যই করতে পারবেন। আগেই বলেছি ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত ও বিঘ্নিত করার জন্যই জামায়াত এবং তাদের সহযোগীদের যাবতীয় কর্মতৎপরতা, যার ফাঁদে আমরা না বুঝেই মাঝে মাঝে পা দিচ্ছি।
জামায়াতের আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিএনপির নেতারা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আইনমন্ত্রী সঠিক কথা বলেছেন। যদিও প্রাক্তন আইনমন্ত্রীসহ দেশের প্রবীণ ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, বর্তমান আইনেই সংগঠনের বিচার ও শাস্তি সম্ভব।
জামায়াতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিরুদ্ধে বিষোদগার গত ২২ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। হালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের দুই জন প্রসিকিউটর যাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক তুরিন আফরোজ ও অভাজন এ লেখক। গত ১ জুন (২০১৪) দৈনিক যুগান্তর-এ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঃ বিভক্ত প্রসিকিউটররা’ শিরোনামের এক সংবাদে বলা হয়েছে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, চিফ প্রসিকিউটর বয়সের ভারে কোন কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ফলে তার নাম ভাঙিয়ে জেয়াদ আল মালুমসহ কয়েকজন প্রসিকিউটর ফায়দা লোটার পাশাপাশি গোলমাল তৈরির চেষ্টা করছেন। ড. তুরিনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখানে একজন বাম বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রসিকিউটর কাজ করছেন। মিডিয়ায় কথা বলা ও ঝামেলা তৈরি ছাড়া তিনি আর কোন কাজই জানেন না। তিনি ও তার মতো দুয়েকজন ছাড়া আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই।
‘মোহাম্মদ আলী বলেন, ড. তুরিন আফরোজ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করতে আসেননি। মূলত শাহরিয়ার কবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ট্রাইব্যুনালে অনুপ্রবেশ করেছেন। আমাদের তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।’
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রসিকিউশনের এ ব্যক্তিটিই নিজামীর মামলার জন্য সময় প্রার্থনা ও পুনঃশুনানির কথা বলেছিলেন, যেটি বলার কথা ছিল জামায়াতের আইনজীবীদের এবং যার বিরোধিতা করার কথা সরকার পক্ষের। প্রসিকিউশনের এ ব্যক্তিটিই গণমাধ্যমে একাধিকবার বলেছেন, প্রসিকিউশনে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না।
জামায়াত সমর্থক একটি অনলাইন পত্রিকা নতুনবার্তা ডটকম-এর ২০ মে ২০১৪ তারিখে সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, ‘প্রসিকিউশনের আইন না মেনে তুরিন আফরোজ স্বেচ্ছাচারিতা করছেন। যখন খুশি প্রসিকিউশন কার্যালয়ে আসেন আবার যখন খুশি চলে যান। অফিসিয়াল কোন সময় তিনি মেনে চলছেন না।’
আইনমন্ত্রী বলেছেন, প্রসিকিউশনের কোন্দল মেটাবেন, ঢেলে সাজাবেন। আমরা তাঁর সদিচ্ছার প্রতি এখনও আস্থা রাখতে চাই। আমরা দেখতে চাই প্রসিকিউশনে তিনি কাদের বাদ দিয়ে কাদের রাখেন। মোহাম্মদ আলীর মতো প্রসিকিউটররা ট্রাইব্যুনালে থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে শেষ হবে ভেবে গভীর শঙ্কা বোধ করছি। প্রসিকিউশনের সমালোচনা করা ট্রাইব্যুনাল বা সরকারের সমালোচনা করা নয়। এমনকি সরকারের সমালোচনাও ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা নয়। নির্বাহী বিভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে আইনমন্ত্রীকে জানতে হবে তাঁর কোনও বক্তব্য ‘বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ’ বলার সুযোগ প্রতিপক্ষ পাবে কিনা। শাস্তি বিচারক দেবেন, আইনমন্ত্রী নয়। ট্রাইব্যুনাল কাকে কি শাস্তি কিভাবে দেবেন সেটি সম্পূর্ণভাবে বিচারকদের এখতিয়ারের বিষয়। জামায়াতের বিচারের শুরুতেই বিচার ও শাস্তি সম্পর্কে সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কারণে বিচার প্রক্রিয়ার স্থবিরতা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লখ শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বিচারপ্রার্থ গোটা জাতিকে হতাশ করবে।
২ জুন, ২০১৪।
২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অকল্পনীয় বিজয়ের পর মন্ত্রিসভায় ব্যাপক রদবদল হয়েছে। মহাজোটের আগের মন্ত্রিসভার অনেকে বাদ পড়েছেন, অনেক নতুন মুখ মন্ত্রিসভায় যুক্ত হয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা নতুন মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানিয়েছি। গত মন্ত্রিসভায় আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে দুজন মন্ত্রী ছিলেন। প্রবীণ আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ছিলেন পূর্ণ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মহানগরের নেতা, রাজপথের আন্দোলনে অভিজ্ঞ সংগঠক এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন থেকে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে যে সাফল্য তার সিংহভাগ কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হলেও তাঁর এ দুই মন্ত্রীর আগ্রহ ও আন্তরিকতা অস্বীকার করা যাবে না।
ট্রাইব্যুনালের স্থান নির্বাচন থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ঘাটতি সম্পর্কে অনেক সময় এ মন্ত্রীদের সঙ্গে আমাদের তর্ক হয়েছে, তাঁদের সমালোচনা করেছি, কিন্তু বিচারের প্রতি তাঁদের দায়বদ্ধতা ও সদিচ্ছা সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করেননি। দেরিতে হলেও ট্রাইব্যুনালের অনেক অপূর্ণতা তারা পূরণ করেছেন এবং ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন কার্যক্রম ক্রমশ গতিপ্রাপ্ত হয়েছে।
২০১৪ সালে মহাজোট সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায় ব্যারিস্টার শফিক আহমেদকে বাদ দেয়া হয়েছে, এ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামকে খাদ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আইনজীবী হিসেবে অভিজ্ঞ হলেও রাজনীতিতে নবাগত এ্যাডভোকেট আনিসুল হককে, যিনি তাঁর পিতা এ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান কৌসুলি হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। প্রথমবার জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়েই একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভের পর আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম, কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে হলে তাঁর সঙ্গেই আমাদের কাজ করতে হবে। পূর্বপরিচয়ের কারণে তিনিও শপথগ্রহণের পর পরই সৌজন্যবশত আমাদের টেলিফোন করেছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আমাদের সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। আমরা আমাদের ষোলআনা সহযোগিতা তাঁকে নিশ্চিত করেছি।
নতুন আইনমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রসিকিউশনের কেউ কেউ খবরের কাগজে বলা শুরু করেছেন, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিমে আওয়ামী লীগের সদস্য ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না। তাঁরা ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিকে এবং নির্দিষ্টভাবে নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজকে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যে পরিণত করেছেন। তুরিনের মতো একজন দক্ষ ও মেধাবী আইনজীবী প্রসিকিউশনে যুক্ত হোক এটা এঁরা কখনও চাননি, যেমনটি চায়নি জামায়াত। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার মামলায় তাকে যখন প্রসিকিউশনের ব্যর্থতার জন্য ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিতে পারেনি, যার প্রতিবাদে শাহবাগে তরুণ অনলাইন ব্লগারদের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার মহাঅভ্যুত্থান ঘটেছিল তারই প্রেক্ষাপটে আইসিটির আইন সংশোধন করা হয়, ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচারের বিষয়টি আইনে সংযুক্ত হয়। একই সঙ্গে ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে প্রসিকিউশনে এডিশনাল এ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদায় নিয়োগ দেয়া হয় প্রধানত কাদের মোল্লার আপিল এবং গোলাম ও জামায়াতে ইসলামীর বিচারের জন্য।
ট্রাইব্যুনালের গত এক বছরের বিচার কার্যক্রমে তুরিন আফরোজের মেধা ও দক্ষতার প্রমাণ রয়েছে শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলার রায়ে, গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। আড়াই বছর আগে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক শুনানিতে জামায়াত কর্তৃক নিযুক্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে তুরিন কিভাবে তুলোধুনো করেছেন, উপস্থিত সবাই এ বিষয়ে সাক্ষ্য দেবেন। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও ফোরাম থেকে ’৭৩-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন, আইসিটির গঠন ও বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে জামায়াতের অর্থপুষ্ট মহল যে অপপ্রচার করছে, যেসব প্রশ্ন তুলছে তুরিন আফরোজ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে খণ্ডন করছেন এবং আইন ও বিচার প্রক্রিয়ার মান ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরছেন, যা ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর দূরের কথা সরকারের নীতি নির্ধারকরাও অনেক ক্ষেত্রে পারেননি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যেমন দুই দিন আগে বললেন, কাদের মোল্লার বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তাঁকে নাকি দেশের বাইরে কথা শুনতে হয়েছে। তিনি নতুন বলে সম্ভবত এসব সমালোচনার উপযুক্ত জবাব দিতে পারেননি, আমরা দেশে-বিদেশে জামায়াত ও সহযোগীদের যাবতীয় অপপ্রচার ও প্রশ্নের জবাব লাগাতার দিয়ে যাচ্ছি।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তিন দিন আগে এ মুহূর্তে জামায়াতের বিচার করা যাবে না বলে যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছে-
‘২৯ ও ৩০ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর চলমান বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে যে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন তা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, ১) আইসিটির আইনে সংগঠনের বিচারের কথা বলা হলেও শাস্তির কোনও উল্লেখ না থাকার কারণে এ মুহূর্তে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা যাবে না, ২) সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগে জামায়াতের রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন থাকায় এ মুহূর্তে আইসিটিতে জামায়াতের বিচার করা হলে ওই মামলায় প্রভাব পড়তে পারে এবং ৩) জামায়াতের যেসব নেতা মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তাদের কয়েকজনের বিচার ও শাস্তি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার তাদের শাস্তি হলে আগের শাস্তির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। এসব বিবেচনায় আইনমন্ত্রী এখনই জামায়াতের বিচার না করার পক্ষে তার অভিমত গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
‘একাত্তরের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যে আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছি। আমরা মনে করি ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সম্পৃক্ততার কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইসিটিতে যে বিচার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে আইনমন্ত্রীর অজ্ঞতাপ্রসূত ও বিভ্রান্তিকর এ বক্তব্যের কারণে তা বিঘিœত হবে। একই সঙ্গে গোটা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিলম্বিত করার জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশে-বিদেশে যে বহুমাত্রিক তৎপরতা চালাচ্ছে আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য সেক্ষেত্রেও ইন্ধন যোগাবে।
‘আমরা জানি মহাজোট সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ফোরামে এ বিচারের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা সব সময় উল্লেখ করেছেন। গত ২২ বছর ধরে আমরা ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য দলের বিচারের কথা বলছি। ব্যক্তির পাশাপাশি দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি সংগঠন এবং এসব দলের ঘাতক বাহিনীসমূহের বিচার না হলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার একটি প্রহসনে পরিণত হবে। ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের যেসব নেতার বিচার হয়েছে তারা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অপরাধ করেছেন। জামায়াতের দলীয় দর্শন গণহত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। দলের বিচারের ক্ষেত্রে শাস্তি কি হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারকদের, আইনমন্ত্রীর নয়। নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধের জন্য অপরাধী সংগঠনের বিচার কিভাবে হয়েছে, কিভাবে শাস্তি দেয়া হয়েছে সে বিষয়ে যদি আইনমন্ত্রী জ্ঞাত থাকতেন তাহলে এ ধরনের মন্তব্য তিনি করতে পারতেন না। সুপ্রীমকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল সংক্রান্ত আপিলের সঙ্গে আইসিটিতে যে অপরাধে জামায়াতের বিচার হবে তার কোন সম্পর্ক নেই। চট্টগ্রামের আদালতে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিচার চলাকালে আইসিটিতে তার বিচার চলমান ছিল। জামায়াতের আইনজীবী কখনও বলেননি এক ব্যক্তির দুই আদালতে এক সঙ্গে বিচার হতে পারে না। কোন সংগঠন যদি একাধিক অপরাধ করে থাকে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হতে পারে, এটি সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, এর জন্য আইনজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের কাছে বিচারপ্রত্যাশী সমগ্র জাতি, বিশেষভাবে ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের আকুল আহ্বান হচ্ছে- যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সব বাধা ও বিভ্রান্তি দ্রুত অপসারণ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত এবং অঙ্গীকার পূরণ করুন। এ বিচারের ক্ষেত্রে যেকোন ধরনের কালক্ষেপণ জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধীদের অবস্থান শক্তিশালী করবে এবং একই সঙ্গে তা আওয়ামী লীগ ও মহাজোট সরকারের জন্য আত্মঘাতী হবে।’
গণমাধ্যম এবং আমাদের সমালোচনার কারণে আইনমন্ত্রী তাঁর অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে বলেছেন, তিনি জামায়াতের বিচারের বিরুদ্ধে নয়, আইন সংশোধনের পর দ্রুত এ বিচার আরম্ভ হবে।
জামায়াতের বিচার সম্পর্কে আইনমন্ত্রীর নেতিবাচক মন্তব্যের আগে ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর হায়দার আলী তুরিন অফরোজকে বলেছেন, জামায়াতের মামলার যাবতীয় কাগজপত্র তাকে হস্তান্তর করার জন্য। তুরিন আফরোজের নেতৃত্বে সাতজন প্রসিকিউটরের একটি দলকে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু গত ২৭ মার্চ ২০১৪ তারিখে জামায়াতে ইসলামীর মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে সরকারের নির্দেশে তদন্ত সংস্থা ২০১৩ সালের ১৮ আগস্ট থেকে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত আরম্ভ করে তাদের প্রতিবেদন গত ২৭ মার্চ (২০১৪) প্রসিকিউশনে জমা দিয়েছে।
সরকারের নির্দেশে জামায়াতের বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত আরম্ভ হলেও যে কারণ দেখিয়ে তা স্থগিত হয়েছে সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। আইনমন্ত্রী বলেছেন, সুপ্রীমকোর্টের আপিল বিভাগে জামায়াত নিবন্ধন মামলা থাকার কারণে ট্রাইব্যুনালে মামলা শুরু করার ক্ষেত্রে অসুবিধে হতে পারে। ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত ও বিলম্বিত করার জন্যই জামায়াত সুপ্রীমকোর্টে তাদের একটি আপিল ঝুলিয়ে রেখেছে এবং আমাদের ধারণা রোজ কেয়ামত পর্যন্ত তারা তা ঝুলিয়ে রাখবে, যাতে তারা বলতে পারে ওই মামলার নিষ্পত্তি না হলে ট্রাইব্যুনাল জামায়াতের মামলার শুনানি করতে পারবে না। কথাটা জামায়াত বলত ট্রাইব্যুনালে তুরিনরা যখন জামায়াতের মামলার শুনানির জন্য যেতেন। জামায়াত বলার আগেই আইনমন্ত্রী জামায়াতের বক্তব্যটিকে নিজের বক্তব্য হিসেবে বাজারে ছাড়লেন। এর পর সরকার পক্ষ কখনও যদি ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের মামলার শুনানি করতে চান জামায়াতের আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে মামলার শুনানি বন্ধ করতে না পারলেও বিলম্বিত অবশ্যই করতে পারবেন। আগেই বলেছি ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিলম্বিত ও বিঘ্নিত করার জন্যই জামায়াত এবং তাদের সহযোগীদের যাবতীয় কর্মতৎপরতা, যার ফাঁদে আমরা না বুঝেই মাঝে মাঝে পা দিচ্ছি।
জামায়াতের আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিএনপির নেতারা আইনমন্ত্রীর বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আইনমন্ত্রী সঠিক কথা বলেছেন। যদিও প্রাক্তন আইনমন্ত্রীসহ দেশের প্রবীণ ও বিশিষ্ট আইনজীবীরা আইনমন্ত্রীর যুক্তি নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, বর্তমান আইনেই সংগঠনের বিচার ও শাস্তি সম্ভব।
জামায়াতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বিরুদ্ধে বিষোদগার গত ২২ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। হালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ট্রাইব্যুনালের দুই জন প্রসিকিউটর যাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক তুরিন আফরোজ ও অভাজন এ লেখক। গত ১ জুন (২০১৪) দৈনিক যুগান্তর-এ ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঃ বিভক্ত প্রসিকিউটররা’ শিরোনামের এক সংবাদে বলা হয়েছে প্রসিকিউটর মোহাম্মদ আলী বলেন, চিফ প্রসিকিউটর বয়সের ভারে কোন কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ফলে তার নাম ভাঙিয়ে জেয়াদ আল মালুমসহ কয়েকজন প্রসিকিউটর ফায়দা লোটার পাশাপাশি গোলমাল তৈরির চেষ্টা করছেন। ড. তুরিনকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখানে একজন বাম বুদ্ধিজীবীর উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য একজন প্রসিকিউটর কাজ করছেন। মিডিয়ায় কথা বলা ও ঝামেলা তৈরি ছাড়া তিনি আর কোন কাজই জানেন না। তিনি ও তার মতো দুয়েকজন ছাড়া আমাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই।
‘মোহাম্মদ আলী বলেন, ড. তুরিন আফরোজ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনা করতে আসেননি। মূলত শাহরিয়ার কবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য ট্রাইব্যুনালে অনুপ্রবেশ করেছেন। আমাদের তাদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে।’
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রসিকিউশনের এ ব্যক্তিটিই নিজামীর মামলার জন্য সময় প্রার্থনা ও পুনঃশুনানির কথা বলেছিলেন, যেটি বলার কথা ছিল জামায়াতের আইনজীবীদের এবং যার বিরোধিতা করার কথা সরকার পক্ষের। প্রসিকিউশনের এ ব্যক্তিটিই গণমাধ্যমে একাধিকবার বলেছেন, প্রসিকিউশনে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না।
জামায়াত সমর্থক একটি অনলাইন পত্রিকা নতুনবার্তা ডটকম-এর ২০ মে ২০১৪ তারিখে সৈয়দ হায়দার আলী বলেছেন, ‘প্রসিকিউশনের আইন না মেনে তুরিন আফরোজ স্বেচ্ছাচারিতা করছেন। যখন খুশি প্রসিকিউশন কার্যালয়ে আসেন আবার যখন খুশি চলে যান। অফিসিয়াল কোন সময় তিনি মেনে চলছেন না।’
আইনমন্ত্রী বলেছেন, প্রসিকিউশনের কোন্দল মেটাবেন, ঢেলে সাজাবেন। আমরা তাঁর সদিচ্ছার প্রতি এখনও আস্থা রাখতে চাই। আমরা দেখতে চাই প্রসিকিউশনে তিনি কাদের বাদ দিয়ে কাদের রাখেন। মোহাম্মদ আলীর মতো প্রসিকিউটররা ট্রাইব্যুনালে থাকলে যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রক্রিয়া কোথায় গিয়ে শেষ হবে ভেবে গভীর শঙ্কা বোধ করছি। প্রসিকিউশনের সমালোচনা করা ট্রাইব্যুনাল বা সরকারের সমালোচনা করা নয়। এমনকি সরকারের সমালোচনাও ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা নয়। নির্বাহী বিভাগের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে আইনমন্ত্রীকে জানতে হবে তাঁর কোনও বক্তব্য ‘বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ’ বলার সুযোগ প্রতিপক্ষ পাবে কিনা। শাস্তি বিচারক দেবেন, আইনমন্ত্রী নয়। ট্রাইব্যুনাল কাকে কি শাস্তি কিভাবে দেবেন সেটি সম্পূর্ণভাবে বিচারকদের এখতিয়ারের বিষয়। জামায়াতের বিচারের শুরুতেই বিচার ও শাস্তি সম্পর্কে সরকারের নীতি নির্ধারকদের বিভ্রান্তিকর বক্তব্যের কারণে বিচার প্রক্রিয়ার স্থবিরতা মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লখ শহীদ পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বিচারপ্রার্থ গোটা জাতিকে হতাশ করবে।
২ জুন, ২০১৪।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-06-03&ni=174847
No comments:
Post a Comment