Monday, June 16, 2014

বিলেতের ফুটবল এজেন্ট সই করাল খুদে রাজীবকে

rajib
ম্যান ইউয়ের ড্রেসিংরুমে রাজীব।
এই সময়: দেড় যুগ আগে ইংল্যান্ডের মাঠে রাজত্ব শুরু করেছিলেন বেহালার মহারাজ৷ বাংলার ফুটবলে সুসন্দেশ এল সেই বিলেত থেকেই৷ সোনাগাছির অন্ধকার গলিতে সুবাতাস বইয়ে এক যৌনকর্মীর সন্তানকে সই করাল ব্রিটিশ ফুটবল এজেন্সি৷ ১০৭/এ দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটে বেড়ে ওঠা বছর ষোলোর রাজীব রায় তাক লাগিয়েছিল ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড সকার স্কুলে ট্রেনিংয়ের সুযোগ ছিনিয়ে নিয়ে৷ এ বার এল ফিফা অনুমোদিত 'এলিট ইন্টারন্যাশনালের' চুক্তিপত্র৷

চুক্তি বলছে, সোনাগাছির খুদের হয়ে ক্লাব খোঁজার দায়িত্ব এজেন্সির৷ এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তা না-হচ্ছে, তার আর্থিক দায় তাদেরই৷ ইতিমধ্যেই রাজীবের সদ্য খোলা অ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে ওই এজেন্সি৷

রাজীবের খোঁজ কী ভাবে পেল সংস্থাটি? এক বেসরকারি সংস্থার স্কুল টুর্নামেন্টে নজরকাড়া ১১ জন ফুটবলারকে ওল্ড ট্যাফোর্ডে নিয়ে যায় ওয়েন রুনিদের ক্লাব৷ এপ্রিলের শেষাশেষি সেই সফরে বাংলা থেকে রাজীবের সঙ্গে গিয়েছিল বরানগরের অর্ক দে-ও৷ পিতৃহারা অর্কর সংসার চলে মায়ের তেলেভাজা দোকানের টাকায়৷ কুঁড়ে থেকে দুই কুঁড়ির বিলেতযাত্রার সেই খবর ফলাও করে ছাপা হয়েছিল ইংল্যান্ডের কাগজেও৷ রাজীবে উত্‍সাহিত হয়ে যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটিতে ফোন করে এলিট ইন্টারন্যাশনাল৷ যে এজেন্সি আদতে 'আত্তিয়াহ্ লোন অ্যাসোসিয়েটস'-এর সঙ্গী-সংস্থা৷ এজেন্সির মাথা নাইম লোন ইংল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্টের সলিসিটর৷ লোন ই-সাক্ষাত্‍কারে 'এই সময়'কে বলেন, 'যৌনপল্লির মতো একটা জায়গায় বড় হয়েও দুরন্ত প্রতিভা ছেলেটির৷ ক্লাব পেতে আমাদের সমস্ত যোগাযোগ ব্যবহার করব৷ আপাতত ওর জন্য স্পনসর খুঁজছি আমরা, যাতে অর্থ কোনও সমস্যা হয়ে না-দাঁড়ায়৷' ট্রেনিং-পর্বে রাজীবের পারফরম্যান্স কেমন ছিল, তা জানতে ম্যান ইউকে চিঠি লিখেছেন লোন৷ রিপোর্ট এলেই ক্লাব খুঁজতে ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁর এজেন্সি৷

ম্যাঞ্চেস্টারের ট্রেনিং সেরে ফিরেই এমন হাতেগরম সুযোগ পেয়ে খুশিতে ভাসছে রাজীব৷ মোহনবাগানে খেলার খুব শখ৷ পছন্দের ক্লাবের দুর্গাপুরের অ্যাকাডেমিতে ট্রায়ালও দিয়ে এসেছে৷ প্রাথমিক পর্বে ছাড়পত্র একরকম পাকাই৷ কিন্ত্ত তা বলে একেবারে বিলেতের এজেন্সির চুক্তিপত্র! রাজীবের কথাতেই, 'এ রকম সুযোগ আসবে, স্বপ্নেও ভাবিনি৷ ভালো একটা ক্লাব পেলে মাকে নিয়ে এখান থেকে ভালো কোথাও গিয়ে উঠব৷'

পেশা ছেড়ে ব্যাগের কারখানায় কাজ করা রাজীবের মা অবশ্য চেয়েছিলেন পড়াশোনা করে অনেক বড় হোক ছেলে৷ কিন্ত্ত পরীক্ষার খাতায় স্কেল বসিয়ে কম্পাস টানার চেয়ে রাইট উইং পজিশনটাই বেশি টানে বারুইপুরের রামনগর হাইস্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রকে৷ ম্যাঞ্চেস্টারের মাঠে যদিও রাজীবকে সব পজিশনেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খেলিয়েছেন কোচিং স্টাফেরা৷ দু'বেলা প্র্যাক্টিস, ২৫ ঘণ্টার ফুটবল ক্লাস, বাংলাদেশের সঙ্গে প্রীতি-ম্যাচ মোড় এনে দিয়েছে রাজীবের ফুটবল-জীবনে৷ রুনি-পার্সিদের স্টেডিয়াম, ড্রেসিংরুম, মিউজিয়াম-দর্শন আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে একঝটকায়৷ ছেলের এমন উত্থানে খুশি মা-ও৷ বলেন, 'ওর জন্য গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে৷ আরও নাম করুক, আমায় দেখুক, আর কী চাই!'

রাজীবের সাফল্যের ভাগ রয়েছে দুর্বারের ফুটবল শাখারও৷ বারুইপুরে দুর্বারের হোমে যৌনকর্মীর সন্তানদের ফুটবলের অ-আ-ক-খ শেখান প্রশিক্ষক বিশ্বজিত্‍ মজুমদার৷ তার হাত থেকে বেরোনো দুই প্রতিভা বিশ্বজিত্‍ নন্দী, সুরজিত্‍ ভট্টাচার্য গত বছর পোল্যান্ডে খেলে এসেছে 'হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ'৷ বিশ্বজিত্‍বাবুর কথায়, 'এখানকার ছেলেদের স্বপ্ন দেখিয়ে, প্র্যাক্টিস করিয়ে, প্রাপ্তির জায়গায় পৌঁছে দিলে তবেই আকর্ষণ তৈরি করানো যায়৷ তাই এটা আমাদের হাড়ভাঙা খাটুনিরও সাফল্য৷' দুর্বারের মুখ্য উপদেষ্টা স্মরজিত্‍ জানাও বলেন, 'আমরা যৌনকর্মী ও যৌনকর্মীর সন্তানদের উত্‍সাহ দিয়ে মূল স্রোতে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি৷ রাজীব বড় ক্লাবে সুযোগ পেলে অন্যরাও অনুপ্রেরণা পাবে৷'

রাজীব যে বছর জন্মায়, তার ঠিক দু'বছর পর ইংল্যান্ডের বারি এফসিতে খেলতে গিয়েছিলেন বাইচুং ভুটিয়া৷ সেই ট্রেন্ড অনেকদিন পর ফিরে আসে আমেরিকার কানসাস সিটি উইজার্ডসে সুনীল ছেত্রী খেলতে গেলে৷ এখন ডেনমার্কের এফসি ভাইকিংসে খেলছেন সোদপুরের সুব্রত পাল৷ নিজেকে প্রমাণ করতে পারলে রাজীবের সামনেও আসবে বিদেশে খেলার সুযোগ৷

সোনাগাছি থেকে যে পথ অনেকটা৷ শুধু দূরত্ব দিয়ে মাপা যায় না৷

No comments:

Post a Comment