প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে...
এম এম আকাশ
দূরের মানুষ সরদার ভাই
১৯৭২-’৭৫ এই সময়টা ছিল এক স্বপ্নেভরা সময়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা একগুচ্ছ স্বপ্নেবিভোর কিশোর-তরুণ-যুবক দেশে ফিরে এসেছি। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তখন সদ্য প্রকাশিত পোস্টারই তৈরি করে দিয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। সেই অনিন্দ্য সুন্দর পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘লাখো শহীদের মৃত্যুতে মুক্ত স্বদেশ এসো দেশ গড়ি!’
এ রকম একটা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়তে পড়তে প্রথম সর্দার ভাইকে দেখি এবং তাঁর কথা শুনি। তবে তখন তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। কিন্তু ইতিহাসে তখনই তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। পাকিস্তানী আমলের দুঃসহ কঠিন সময়ে মুসলিম ধর্মালম্বী পরিবার থেকে যে গুটিকয়েক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী যুবক সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক একটি ‘লাইটহাউস’ হিসেবে সমাজে দীর্ঘকাল আলো বিকিরণ করে গেছেন, এখনও যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সরদার ভাইও একজন। মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, কেজি মুস্তফা, মোঃ ইমদুল্লাহ্- এই একগুচ্ছ মুসলিম পরিবার থেকে আগত যুবক দেশভাগের পর ‘দাদাদের’ তথা প্রবীণ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সাম্যবাদী আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ রণেশ দাশগুপ্তের ভাষায় শেষ পর্যন্ত ‘জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়ে, সাম্যবাদী আন্দোলন থেকে অবসর নিয়েছিলেন।’ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও সাম্যবাদী রাজনীতি এবং তার পথিকৃৎ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এঁদের প্রত্যেকেরই যোগাযোগ পরবর্তীতে সব সময়ই ছিল কম-বেশি সজীব এবং সহানুভূতিপূর্ণ। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে ছিলাম, তাঁদের কাছে পার্টির প্রাক্তন এসব মানুষ ছিল কিছুটা ‘দূরের মানুষ।’ আমাদের সামনে তখন ‘আদর্শ কমিউনিস্ট’ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে বিরাজ করতেন পার্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত সব ত্যাগী দাদা : কমরেড মণি সিংহ, কমরেড অনিল মুখার্জী, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিমা দি, হেনা দি, এঁরা। আরও প্রত্যক্ষভাবে আমরা তখন যুক্ত ছিলাম ষাট দশকের উজ্জ্বল সর্বক্ষণিক কর্মী ছাত্র তারকাদের সঙ্গে- মোঃ ফরহাদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, প্রমুখ দ্বিতীয় সারির কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে আমরা দাদাদের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছাতাম। এরপর তৃতীয় সারিতে ছিলেন আরও তরুণ আরও টগবগে আরও উজ্জ্বল মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, আয়েশা আপা, রীনা আপা প্রমুখ নেতা। তাঁরা ছিলেন গণসংগঠনে কর্মরত কমিউনিস্ট। আমার বিশ বছর বয়সের তদানীন্তন স্মৃতি যতটুকু মনে আছে, তাতে তখন সরদার ভাইকে মনে হতো কমিউনিস্ট পার্টির পরিবারভুক্ত সদস্য না হলেও, কমিউনিস্ট পার্টির পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। নিজের নয় কিন্তু তাই বলে দূরেরও নয়। অনেক পরে অবশ্য সরদার ভাইকে যখন নিজের করে জেনেছি, তখন জেনেছি যে, তিনি হচ্ছেন সেই বরিশালের কৃষক সন্তান, যিনি একদিন ডেকার স্ট্রিটে অবস্থিত সিপিআই অফিসে হাজির হয়ে কাকাবাবুর (কমরেড মোজাফ্ফর আহ্মদ) সামনে বিলেত গমনের ছাড়পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন সেই সরদার ভাই, যিনি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে বছরের পর বছর মাথায় হুলিয়া নিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিরাপদ সংসার পরিত্যাগ করে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বছরের পর বছর কাটিয়েছেন কারান্তরালে, হাঙ্গার স্টাইক করে কারাগারের ভেতরে কাটিয়ে দিয়েছেন দিনের পর দিন। আবার তিনিই হচ্ছেন সেই সরদার ভাই, যিনি পূর্ববঙ্গের বঙ্গীয় গণপরিষদে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসেবে অনায়াসে নির্বাচিত হয়েছেন। আমার সরদার ভাই হচ্ছেন, সেই সরদার ভাই, যিনি সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বের একটা বড় সময় ধরে পাকহানাদার বাহিনীর কারাগারের বন্দী অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনে কালাতিপাত করেছেন। সরদার ভাইয়ের অনেক উজ্জ্বল পরিচয় আছে, তা আমি আরও পরে উদ্ঘাটনের প্রয়াস পাব। কিন্তু আমি যেই সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ১৯৭২-’৭৫ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথা। তখন যখন এসব কিছুই আমার জানা ছিল না, সরদার ফজলুল করিম তখনও পর্যন্ত আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত কমরেড সরদার ফজলুল করিম হননি। তখনও তিনি আমার কাছে একজন নিভৃতচারী অধ্যাপক মাত্র, অবসরগ্রহণকারী বামপন্থী যার সঙ্গে পার্টির একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। যিনি থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ফুলার রোডের একটি বাড়িতে এবং যে বাড়িতে ‘সাম্যবাদের ভূমিকা এবং ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতে খড়ি’র লেখক কমরেড অনিল মুখার্জী নিয়মিত যাতায়াত করেন। অনিল দা তখন আমাদের জন্য একজন ‘আইকন।’ অনিল দা নিয়মিত ‘সরদার ভাই’-এর বাসায় যান। এটাই তখন আমাদের জন্য ছিল তাঁর প্রতি অনুরাগ ও কৌতূহল সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। সেই যুগে ব্যাপারগুলো এভাবেই ঘটত। এরই ফাঁকে ফাঁকে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকল। দূরের সরদার ভাই আস্তে আস্তে আমার মনের কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করলেন। ১৯৭৩ সালে হাতে পেলাম সরদার ভাইয়ের অসামান্য সৃষ্টি ‘দর্শন কোষ।’ এত সহজ-সুন্দর, সাবলীল বাংলায় দর্শনের দুর্বেধ্য ‘ক্যাটাগরি’ বা প্রত্যয়ের সংজ্ঞায়ন দুই বাংলা মিলিয়ে দ্বিতীয় একটি আর পাওয়া যাবে না। এই মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই পরিচয় হলো, তাঁর কন্যা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী স্বাতীর সঙ্গে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক, স্বাতী এবং তাঁর একঝাঁক উজ্জ্বল সপ্রতিভ বন্ধু মিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তখন গড়ে তুলেছিলেন একটি শক্তিশালী পাঠচক্র-আন্দোলন। সেখানে যাওয়া আসার সুবাদেই স্বাতী ও শাকিলের সঙ্গে পরিচয় এবং স্বাতীর বাবা সরদার ভাই এবং সরদার ভাইয়ের কন্যা স্বাতী এই পরিচয়টাও তখন প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের চোখের সামনে প্রবীণ কমিউনিস্ট হিসেবে তখনও যাঁরা বিরাজমান ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন সংসারহীন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো। তাঁরা ছিলেন অকৃতদার। অত্যন্ত স্বল্পভোগী এবং নিরহঙ্কার প্রকৃতির মানুষ। কঠোর কৃচ্ছ্রতা তাঁদের শরীর এবং মনে এক ধরনের ত্যাগী আভা তৈরি করে দিয়েছিল, যার বিচ্ছুরণে আমরা তরুণরা ছিলাম আপ্লুত এবং কিছুটা সম্মোহিত। পার্টির ভেতরে এই প্রায় দেবতাসুলভ কমিউনিস্টদের তুলনায় সরদার ভাইদের মতো প্রাক্তন কমিউনিস্টদের (পরে অবশ্য সরদার ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি এবং বিশ্বাসও করি যে, একজন ব্যক্তি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও কমিউনিস্ট নাও হতে পারেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও একজন কমিউনিস্ট হতে পারেন।) তখন আমরা কিছুটা দূরের লোক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। তবে এঁদেরও বন্ধুই ভাবতাম, শত্রু ভাবতাম না। মনে আক্ষেপ ছিল, কেনই বা তাঁরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে আবার সক্রিয় হচ্ছেন না? আসলে তখন প্রাণে উচ্ছ্বাস ছিল প্রচুর। ভাবতাম বাংলাদেশই হবে বিশ্বের বুকে ১৭তম সমাজতান্ত্রিক দেশ। এখন পরিণত বয়সে মনে হয় কে যে কাছের, কে যে দূরের তা বলা কঠিন। বিপ্লবও যে একটি চলমান প্রক্রিয়া সেটাও সরদার ভাইয়ের কাছে পরে শিখেছি। তিনি প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশে বিপ্লব তো হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটা একটা বড় বিপ্লব। আর বাংলাদেশের নারীরা এই মুসলিম প্রধান একটি দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে মুক্ত হরিণীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে, এটাও কোন অংশে বিপ্লবের চেয়ে কম কিছু নয়। এই চলমান প্রক্রিয়ায় বিপ্লব আগায় অর্কেস্টার মতো নানা বাদকের-গায়কের নানা ধরনের সুর মূর্ছনার অপূর্ব সংশ্লেষণের মাধ্যমে। এখানে সর্বত্যাগী জ্ঞান চক্রবর্তীর যেমন দরকার- তেমনি সরদার ভাইয়েরও রয়েছে অমূল্য ভূমিকা। জ্ঞান চক্রবর্তী প্রবীণ বিপ্লবীদের মধ্যে একজন অত্যন্ত আদর্শ স্থানীয় কমিউনিস্ট ছিলেন- তাঁকে দেখেছি ‘বলাকা ব্লেড’ দিয়ে দুই-দুইবার দাড়ি না কামানো পর্যন্ত ব্লেডটা ফেলে দিতেন না। এ রকম ‘স্পার্টান’ কঠিন মানুষ আমার ৫৩ বছর বয়সে খুব বেশি দেখতে পাইনি। আবার নিজের অবাধ্য ছেলের প্রতি অন্ধ অপত্য স্নেহে নিজের শ্রম-মেধা-অর্থ সবই ঢেলে দিচ্ছেন, এ রকম একজন দুর্বল পিতা হিসেবে নরম মানুষ সরদার ভাইকেও দেখেছি। আবার এই সরদার ভাইকে দেখেছি, আশি উত্তীর্ণ বয়সে রিক্সা থেকে লাঠি ভর করে নামতে- কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করতেও তাঁকে দেখেছি। তাই মনে হয় কৃচ্ছ্র বা ভোগের প্রতি বিরূপতা এবং নিজের ব্যাপারে সাহায্যবিমুখতা এটি এই উত্তাল চল্লিশের গৃহী বিপ্লবী সরদার ভাই এবং সন্ন্যাসী বিপ্লবী জ্ঞান চক্রবর্তী উভয়েরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বটে। কিন্তু গৃহী বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে মায়ার বাঁধনে লতায় পাতায় জড়িয়ে সংসারের বাস্তবতা বিদ্যমান থাকায় সেখানে কিছু মানবিক দুর্বলতাও(?) যুক্ত হয়েছে। তবে ব্যক্তি মানুষের জন্য সে বিপ্লবী হলেও সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এদের একজন কঠিনকে ভালবাসেন আরেকজন নরম এবং দুর্বলকে ভালবাসেন কিন্তু উভয়ের মিল এক জায়গায়। ভালবাসায় মমতায় মানবপ্রেমে মানবিকতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সার্থক হওয়ার সাধানায় এঁরা উভয়েই ছিলেন এক। কিন্তু বিলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রটা একেকজনের জন্য একেক রকম। সরদার ভাই যা কিছু করেছেন কোনটাই কোনদিনই একান্ত নিজের জন্য করেননি। এমনকি ছেলেমেয়েদের ভালবাসার ক্ষেত্রেও সরদার ভাই বেছে নিয়েছেন সেই সন্তানটিকেই যার সাফল্য সবচেয়ে কম, যে তুলনামূলকভাবে একটু পিছিয়ে পড়েছে এবং যার সাহায্যের প্রয়োজনও হয়ত অন্যদের তুলনায় বেশি। এখানেও দুর্বলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন নীতিবোধ হয়ত অজান্তে তাঁর ভেতরে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। যদিও পরিবারের অন্য সদস্যরা এ জন্য তাঁকে হয়ত একজন স্নেহান্ধ পিতা হিসেবেই দেখেছেন। সংসারে সকলের প্রতি সমান কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে। তবে বিপ্লবীদের জন্য এটুকু মানবিক দুর্বলতা বিরাট কোন অপরাধ নয়। জ্ঞান দাও সারাজীবনে যা কিছু করেছেন একান্ত নিজের জন্য তা করেননি। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে জ্ঞান চক্রবর্তীরা বিশ্বাস করতেন না। সমস্ত শ্রম মেধা প্রজ্ঞা যা কিছু তাঁদের ছিল, তা ছড়িয়ে দিয়েছেন পার্টির ভেতরে বাইরে বৃহত্তর জন-মানুষের মধ্যে পার্টিই ছিল তাঁদের ঘর, তাঁদের পরিবার। ঘরের মানুষের প্রতি ভালবাসা ও বাইরের মানুষের প্রতি ভালবাসা দুই-ই বা তাঁদের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের ছিল এবং অনেক বেশি পরিমাণেই ছিল। জ্ঞান দা, অনিলদা, সুনীল দা, প্রমুখ প্রবীণ বিপ্লবীরা আজীবন অকৃতদার ছিলেন। আবার অন্য দিকে কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড রবি নিয়োগী এঁরা বিবাহিত ছিলেন এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিও ছিল। কিন্তু এঁদের কেউই কারও চেয়ে কম আত্মত্যাগী ছিলেন বলে মনে হয় না। এসব সমস্যা নিয়ে চেগুয়েভারার একটি অবিস্মরণীয় উক্তি এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। চে লিখেছেন, ‘বিপ্লবী নেতাদের শিশুসন্তান রয়েছে। যারা সবেমাত্র আধো আধো কথা বলতে শুরু করেছে, যারা এখন বাবা ডাকটি বলতে শেখেনি, রয়েছে তাদের প্রিয়তমা বধূরা, এঁদের সকলকেই বিপ্লবের ভবিষ্যতের জন্য, বিপ্লবদের জীবনদানের অংশ হিসেবে আত্মত্যাগ করতে হয়। বিপ্লবীদের বন্ধুমহল হয় সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ, বিপ্লবী সাথীদের নিয়েই গড়ে ওঠে তাঁদের সমগ্র জীবন। সেই সঙ্কীর্ণ বৃত্তের বাইরে তাঁদের অন্য জীবন প্রায়ই থাকে না। এই অবস্থায় একজন বিপ্লবীর মধ্যে অবশ্যই উপমাত্রার মানবিকতা বোধ থাকতে হবে, থাকতে হবে উচ্চমাত্রার ন্যায়বোধ এবং সততা যাতে তিনি ‘গোঁড়ামি’ বা ‘চরমপন্থা’ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। শীতল যুক্তিবাদ বা এক ধরনের গণবিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যও এটা দরকার। বিপ্লবীদের প্রতিদিন সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে যাতে জীবন্ত মানবতার জন্য বিপ্লবীদের যে অফুরন্ত ভালবাসা রয়েছে সেটি বাস্তব কাজে রূপান্তরিত হয়। এমন কাজে যা হবে দৃষ্টান্তস্থানীয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক [(চে গুয়েভারা, ‘সমাজতন্ত্র এবং কিউবা দেশের মানুষ’ (১৯৬৫)]। আমি ১৯৭১ সালে ভারতে মুক্তিযুদ্ধে ক্যাম্পে থাকাকালে জ্ঞান দাকে দেখেছি কিভাবে তিনি সবচেয়ে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাটির খাবারের ব্যাপারেও তীব্র মনোযোগী ছিলেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থী গেরিলার জন্য ছিল তার সমান যতœ ও ভালবাসা। আবার সরদার ভাইকে দেখেছি চলতি পথে প্রতিটি রিক্সাচালকের সঙ্গে অপার অকৃত্রিম ভালবাসা ও বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে। নিজের বাড়ি রাজাবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজাবাজার থেকে নিউমার্কেট যখনই তিনি কোন রিক্সায় উঠতেন তখনই তাদের সঙ্গে তাঁর চলত নানা সুখ-দুঃখের অবিরাম আলাপ। কখনই ভাড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে তাঁর কোন দ্বন্দ্ব হয়নি। তারাও এই সাধাসিধে লাঠিতে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান ভদ্রলোকটিকে কখনও ঠকানোর চেষ্টা করেননি। রিক্সায় উপবিষ্ট সরদার ভাইকে দেখে আমার সবসময় মনে হয়েছে যে তিনি যেন সহাস্য বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’
দূরের লোক কাছের হলো- কাছের
লোক দূরে সরে গেল
আশির দশকের শেষে এসে আমাদের দেশের সোভিয়েত ঘরানার কমিউনিস্ট শিবিরে এক টাল-মাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয়েছিল যে, সব চিন্তা, সব বিশ্বাস বুঝি শিথিল হয়ে যাবে। ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়েই যেন নতুন করে নানা প্রশ্নের ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল। কেউ কেউ বলতে থাকেন ‘সমাজতন্ত্রের কোনই সুকৃতি নেই।’ ‘ইতিহাসে অক্টোবর বিপ্লব একটি দুর্ঘটনা মাত্র।’ ‘পুঁজিবাদই টিকে আছে, টিকে থাকবে’ এবং সমাজতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। এই সময় আমাদের পার্টির মূল নেতৃত্বই কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন। বহু সমাজতান্ত্রিক কর্মী তখন মানসিকভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েন। কেউ কেউ একদম বসে যান। কেউ কেউ বিলোপবাদীদের খুন করার জন্য উগ্র উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর কেউ কেউ হতভম্ব হয়ে ভাবতে থাকেন কী করা যায়। অন্তত একজন কর্মী ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তখন খবর পেয়েছিলাম। সেদিনের সেই দিনগুলোতে আমরা অনুজ কয়েকজন নতুন প্রজন্মের মানুষ খুব অসহায়ভাবে ‘কমিউনিস্ট’ পার্টিকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। সেই অসহায় অবস্থায় লক্ষ্য করলাম যাঁরা বহুদিন কাছাকাছি থেকে কমিউনিস্ট পার্র্টি করেছেন বা যাঁদের জীবনের ঐহিক সাফল্যে সোভিয়েতের কমিউনিস্ট পার্টির অবদান যথেষ্টই উঁচুমাত্রার ছিল তাঁদের অনেকেই সমাজতন্ত্রবিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য ‘নবায়িত সমাজতন্ত্রের’ ধারণা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন এবং চাইলেন ‘কট্টরপন্থী’ অপবাদের চক্র থেকেও মুক্ত থাকতে এবং ‘বিলোপবাদের’ বিরুদ্ধেও লড়াই অব্যাহত রাখতে। এ রকম একটা সংস্কারমুক্ত কিন্তু সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তখন খুব সাবধানে পা ফেলছিলেন অনেকে। ইতিহাসের এই জটিল সময়টা ছিল কমিউনিস্টদের জন্য সবচেয়ে সঙ্কটজনক সময় সবচেয়ে অসহায় মুহূর্ত। এর আগেও এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন কখনও কখনও সঙ্কটে পতিত হয়েছে। অতীতেও কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হয়েছে- যেমন ষাট দশকে চীন-মস্কো বিভেদের সময় সরদার ভাইরাই ছিলেন সেই সময়কার বিভেদের সাক্ষী। কিন্তু তখন পার্টিতে বিভেদ তৈরি হয়েছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে নয়, বরং কে বেশি খাঁটি সমাজতন্ত্রী সেটা নিয়েই ছিল বিতর্ক। ফলে তখন কমিউনিস্টরা এতটা অসহায় বোধ করেননি, বরং তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন তখন কম-বেশি সামনেই এগিয়ে গেছে। যদিও তাতে দুই কেন্দ্রের অন্ধ অনুকরণবৃত্তির প্রভাবই ছিল বেশি।
কিন্তু এবারকার এই ভিন্নধর্মী সঙ্কট মুহূর্তে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, কাছের লোকরা দূরে চলে গেলেও আমাদের বহু পুরনো ঘুমন্ত সমর্থক এবং বিশেষত বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত, যাঁদের ঠিক কমিউনিস্ট বলা যাবে না। যাঁদের চলতি রাজনীতির ভাষায় ‘রেডিকেল ডেমোক্র্যাট’ বা ‘বিপ্লবী গণতন্ত্রী’ বলে ডাকা হয়, তারাই বরং সদল বলে এগিয়ে এসে কমিউনিস্ট পার্টি রক্ষার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, অনেক অপরিচিত হাত এসে শক্ত হাতে লাল জান্তা আঁকড়ে ধরছে। এছাড়া পার্টির অগণিত সাধারণ ছাত্র-শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুর সদস্য-সমর্থকরা সকলেই পার্টিকে রক্ষার পক্ষেই মূলত অবস্থান গ্রহণ করলেন। যাই হোক তারপরেও দুঃখজনকভাবে আমাদের পার্টি ও পার্টির সম্পত্তি সেই সময় দু’ভাগে বিভক্ত করা হলো। যদিও আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘিষ্ঠ কমিউনিস্ট সদস্যরা একত্রেই কংগ্রেস করতে চেয়েছিলাম এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত যাই হোক, তা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং সে জন্য সারাদেশে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দুটো দলিলও প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু তারপর শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে বিলোপবাদীরা শেষ পর্যন্ত একত্রে কংগ্রেস করতে চাননি। আর আমরা ভাড়া করা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশঙ্কায় শান্তিপূর্ণ বিভক্তির পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলাম বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যদিও এ জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের সমর্থকরা আমাদের অনুযোগ করে থাকেন।
এত ইতিহাসের কথা এখানে লিখলাম এই জন্য যে, এই সময় আমাদের মতো যাঁরা সাম্যবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে রক্ষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের জন্য একটা অত্যন্ত বড় অনুপ্রেরণার স্থলে ছিলেন সরদার ভাইয়ের মর্মভেদী দৃঢ় উচ্চারণমালা। সরদার ভাই প্রথম আমাকে বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের কোন বিপর্যয় হয়নি। বিপর্যয় কথাটা তোমরা শুধু শুধু ব্যবহার করেছ। এই কথাটা ব্যবহার করা উচিত নয়। সরদার ভাই-ই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি খবরের কাগজে লিখেছিলেন। ‘সমাজতন্ত্র যদি দশ লক্ষ বছর লাগে তাহলেও!’ সরদার ভাই-এর আরেকটি প্রিয় উক্তি ছিল ‘সমাজতন্ত্র তো আছেই- নাই কে বলছে? প্রতিটি পরিবার চলে সমাজতন্ত্রের আদি নিয়মটি অনুসরণ করে। ‘ফ্রম ইচ এ্যাকটিং টু হিজ ক্যাপাসিটি এ্যান্ড টু ইচ এ্যাকটিং টু হিজ নিডস’্ অর্থাৎ প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী এটাই প্রতিটি পরিবারের প্রাথমিক সংবিধান। সরদার ভাইয়ের মুখ থেকে প্রথম যখন এই বক্তব্যটি শুনেছিলাম, তখন এর অন্তর্নিহিত গভীরতায় এবং আশ্চর্য সরলতায় পুরোপুরি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যই তো সব পরিবারই একার্থে সমাজতন্ত্রের এক একটি জীবকোষের মতো সংগঠন। ‘পণ্যকে’ যেমন কার্ল মার্কস গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পুঁজিবাদের একক ইউনিট হিসেবে, কোষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, তেমনি সরদার ভাইয়ের ‘পরিবার’সংক্রান্ত এই ধারণাটি মধ্যে লুকিয়ে আছে আরেকটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি। গভীরভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে-
১. পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত মালিকানা বলে কিছু নেই। একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র বাদ দিলে বাকি সব কিছুই সেখানে পরিবারের যৌথ সম্পত্তি। কাগজ-কলমে দলিলে হয়ত ব্যক্তির নামেই সম্পত্তি লেখা থাকে কিন্তু কার্যত সম্পত্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে পরিবারে সকল সদস্যই কম-বেশি ভূমিকা রাখেন।
২. পরিবারের শিশু বা বৃদ্ধদের যেহেতু কাজ করার সামর্থ্য নেই, সেহেতু তাদের সচরাচর কোন কঠিন কাজ করতে বলা হয় না। কিন্তু তাদের খাদ্য বস্তু, সেবা, চিকিৎসা, বিশ্রামের প্রয়োজনটুকু পরিবারের সামর্থ্যবান অন্য সদস্যদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকেই মেটানো হয়। যাঁরা সক্ষম তাঁরা পরিশ্রম করে সম্পদ উৎপাদন করেন এবং নিজের প্রয়োজনটুকু রেখে বাকিটুকু পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ব্যয় করেন। এতে কোন দুঃখবোধ তাদের হয় না, এই প্রয়োজনটা তাদের জন্য কোন দুঃখজনক প্রয়োজন নয়, এটি নৈতিক এবং আনন্দদায়ক দায়িত্ব পালন মাত্র!
৩. পরিবারে শ্রম বিভাজনের সময় সদস্যদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যোগ্যতা ও সামর্থ্য, বয়স, ইত্যাদি স্বাভাবিক উপাদানগুলোকেই গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। কোন বাধ্যতামূলক শারীরিক দাসত্ব বা মজুরির বিনিময়ে দাসত্ব পরিবারের অভ্যন্তরে সাধারণত সম্ভব হয় না।
৪। পিতৃতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী পরিবারগুলোর কথা বাদ দিলে আজকাল আধুনিক সভ্য পরিবারগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিও হয় গণতান্ত্রিক এবং অংশীদারিত্বমূলক। ফলে কর্তৃত্ববাদ বা একনায়কত্ব এখানে চলে না।
ওপরে সভ্য মনুষ্য পরিবারের যে উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, তা হয়ত অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি বিদ্যমান পরিবারের মধ্যে পরিলক্ষিত হবে না কিন্তু এর পরেও সরদার ভাইয়ের কথার মূল সত্যটি এই জায়গায় নিহিত যে, প্রতিটি পরিবারের আর্দশরূপকল্পটি হচ্ছে অনেকটাই এ রকম। সুতরাং সরদার ভাই যখন বলেন, সমাজতন্ত্র তো আছেই এবং তা খুঁজে পাওয়ার জন্য দূরে তাকানোর দরকার নেই আশপাশে মানুষের সৃষ্ট মানবিক পরিবারগুলোর ভেতরের মানবিক সম্পর্কের দিকে তাকালেই তাকে ধরা যাবে, দেখা যাবে, তখন তিনি আসলে একটি গভীরতর সত্যের প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এভাবে বঝুতে পারলে হতাশা আমাদের কখনই স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না। আমরা বুঝতে সক্ষম হব যে, ব্যক্তি মানুষের সামাজিক স্বভাবধর্মই হচ্ছে সমাজতন্ত্র। তবে ছোট মানুষদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে তার সামাজিকতার মাত্রা পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র জাতি এবং অবশেষে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে যেতে এখনও পারেনি। কিন্তু একদিন তা অবশ্যই বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হবে। সামাজিকতার আবেদন যে কত গভীরে প্রোথিত তা বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বিশ্বধর্মগুলোর মর্মবাণীর দিকে তাকালে। এ যাবত প্রণীত সব ধর্মগ্রন্থই মূলত মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হিসেবেই বর্ণনা করে গেছেন। সরদার ভাই তাই যখন পরিবারের পারস্পারিক সৌহার্দ্যরে মধ্যে সমাজতন্ত্রের বীজকে আবিষ্কার করেন, তখন সেটা তাঁর গভীর দার্শনিক বোধেরই প্রকাশ ঘটায়।
সরদার ভাইয়ের কাছ থেকেই আমি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির কথা শুনতে পেয়েছিলাম। সরদার ভাই নিজেও তাজউদ্দীন আহমদের মতোই নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মুক্তার অক্ষরে তাঁর ডায়েরি মেইনটেইন করেন। তাঁর এই অভ্যাসের কথাটা আমার জানা ছিল। আজও তাই খুবই কৌতূহল রয়েছে তার অসংখ্য ডায়েরি পাঠ করার। যদিও এই অন্যায় আবদার আমি তাঁর কাছে কখনই করিনি, করাটা উচিতও হবে না। তবু আমার ধারণা এগুলো যদি কোনদিন প্রকাশিত হয়, তাহলে তা থেকে বাংলাদেশের জন্ম, বিকাশ ও অগ্রগতির ক্রমোন্মোচনশীল একটি বর্ণনা ও ব্যাখ্যার সাক্ষাত পাওয়া যাবে। সরদার ভাই নিজের ডায়েরির কথা তেমন একটা না বললেও মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়েরির থেকে একটি দিনের কথা আমাকে এত আগ্রহ ভরে বর্ণনা করেছিলেন যে, তা আজও আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। তিনি গান্ধী প্রসঙ্গে আলোচনাকালে একদিন আমাকে বলেছিলেন যে, গান্ধী যেদিন আততায়ীর হাতে নিহত হন, সেদিন তাজউদ্দীন আহমেদের দিনলিপিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে, তাঁর কাছে যেন সব কিছু খালি খালি লাগছে এবং মনে হচ্ছে যেন আপন পিতৃবিয়োগের বেদনার মতো বেদনা অনুভব করছেন তিনি। সেদিন পথে পথে উড়ান্তের মতো ঘুরে বহু রাতে হলে ফিরে ছিলেন জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। এই কথাগুলো বলার সময় সরদার ভাইয়ের গভীর আবেগপূর্ণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করেছিলাম যে, মহাত্মা গান্ধী বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনগণনন্দিত নেতাদের ব্যাপারে তাঁর দরদি দৃষ্টি ভঙ্গিটি ঠিক আমাদের মতো অঙ্ক কষে নিরাসক্তভাবে তিনি স্থির করেননি। আমরা যেমন এসব নেতাকে ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দিক মিলিয়ে শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নে অভ্যস্ত, তিনি ঠিক তেমনভাবে তা করেন না। এসব ক্ষেত্রে তার এক ধরনের প্রাজ্ঞ ইতিবাচক অবস্থান রয়েছে, যা সাধারণ জনগণ বা তাজউদ্দীন আহমদের মতো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অধিকতর মিলে যায়। এ রকম উদার মনোভঙ্গির পেছনে নিশ্চয়ই বাস্তব কারণ আছে। আমার বিশ্বাস সরদার ভাইদের প্রজন্ম সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন এবং আয়ত্ত করেন। সেই তুলনায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ফাঁকি বা অসাম্য বা শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সে সম্পর্কে তাদের আগ্রহ ও একাত্মতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। যেহেতু তাদের জীবনটাই অতিবাহিত হয়েছে ঐ সব বড় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেহেতু শ্রেণী সংগ্রামের উচ্চতর পর্যায়ে উন্নততর শ্রেণী সমাবেশ সম্পর্র্কে মনোযোগ দেয়ার অবকাশ তাদের হয়নি। অবশ্য সেই লড়াইটা এখনও পর্যন্ত ঠিকমতো আমরা শুরুও করতে পারিনি। সমাজও কতটুকু প্রস্তুত তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। হয়ত এখনও পর্যন্ত দুটো লড়াই-ই পরস্পর পরিপূরকভাবে অগ্রসর হবে। কমিউনিস্টদের সঙ্গে বুর্জোয়াদের অসাম্প্রদায়িক অংশের ঐক্য না হলে সরদার ভাইদের প্রজন্ম অধিকাংশ সময়ই মনোক্ষুণ্ন বোধ করতেন। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমি যেহেতু তাদের এই মনোক্ষুণ্নতার বাস্তব ভিত্তিটি জানি, তাই এ নিয়ে কখনও তাঁর সঙ্গে তর্ক করিনি। শুধু অপেক্ষা করে থেকেছি, কখন আপন অভিজ্ঞতায় নিজেই তিনি বুঝতে পারবেন বুর্জোয়াদের মেকি অসাম্প্রদায়িকতার দেউলিয়াত্ব। সৌভাগ্যবশত চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলী খুব শীঘ্রই বুর্জোয়া দলগুলোর দেউলিয়াত্বটুকু উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্নেও সরদার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের নবপ্রজন্মের কমিউনিস্টদের দূরত্ব অনেকখানি কমে আসতে শুরু করেছে, তবে সরদার ভাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত থাকলেও সব সময়ই একটি গভীর সত্য কথা বলে এসেছেন। তিনি বলেছেন যে, কমিউনিস্টরা সম্প্রতি যে ‘হাসিনা-খালেদার’ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে কখনও হাসিনার পক্ষে জিন্দাবাদ কখনও মুর্দাবাদ দিচ্ছে- তা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বরাবর তিনি বলেছেন, এই দ্বন্দ্বের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, রিক্সাওয়ালা, বস্তিবাসী এদের জীবনের মাঝে কমিউনিস্টদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে তাদের প্রতি, গড়ে তুলতে হবে, মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টদের সঙ্গে শ্রমজীবীদের অঙ্গাঙ্গি যোগাযোগ। শ্রমজীবীদের জীবনের দ্বন্দ্বকে রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত করতে হবে। সরদার ভাইয়ের এই পরামর্শকে আমি সঠিক মনে করি। এই সঙ্গে আরেকটি কথা সরদার ভাই প্রায়ই বলেন, তা হচ্ছে, ‘ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডিতে চিন্তা করলে হবে না- চিন্তা করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। এটিও খুবই মূল্যবান কথা। ‘ক্যাডাররা’ এখন খুবই কম পড়াশোনা করে থাকে- এটাও সরদার ভাইয়ের একটা তীব্র ক্ষোভ। কমিউনিস্ট পার্টির সোমেন-তাজুল পাঠাগার উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যে বই পাঠ করা হয় না- সে বইকে বই বলা অর্থহীন।’ এই পাঠাগারের বইগুলো পার্টির তরুণ পাঠকরা সত্যই ভাজা ভাজা করে পড়ে ফেলবেন নাকি দিনের পর দিন এগুলোর ওপর খালি ধুলোর আস্তরণ জমা হতে থাকবে- এ নিয়ে তাঁর মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল এবং সেই সংশয় অযৌক্তিকও ছিল না।
এই সব অবিরাম দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে কখন যে সরদার ভাই এবং আমি একই লড়াইয়ের কাফেলার সহযাত্রীতে পরিণত হয়েছিলাম- পরস্পর অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিলাম- একাত্ম হয়েছিলাম- তা আর আজ মনে নেই। কিন্তু এভাবেই ইতিহাসের : ধারায় হয়ত দূরের মানুষরা নিকট মানুষে পরিণত হয় এবং নিকট মানুষরা দূরে হারিয়ে যায়।
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
এমন এক সময় ছিল, যখন পথে-ঘাটে, নানা অনুষ্ঠানে, গাছতলায়, পাঠকচক্র, আজিজ সুপার মার্কেটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকে, টিচার্স লাউঞ্জে, ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে, ক্যাসেটের দোকানে, নিউমার্কেট, বাজারে, বিদ্যুতের বিল শোধের দীর্ঘ লাইনে, সর্বত্রই বৃদ্ধ সরদার ভাইকে দেখা যেত। একজন শীর্ণকায় মানুষ লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে কারও সাহায্য ছাড়াই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই সক্রেটিসের শিষ্যদের মতো সরদার ভাইকেও তাঁর শিষ্যরা ঘিরে পরিবেষ্টিত করে ফেলেছে। তিনিও আনন্দের সঙ্গে প্রশ্ন করছেন, জবাব দিচ্ছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম পথে-প্রান্তরেই তৈরি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের জন্য হীরা-জহরত-মণি-মুক্তার মতো রাশি রাশি মূল্যবান চিন্তারাজি। এ রকম একটা চলন্ত বিদ্যালয় পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। কখনও কখনও এই বিদ্যালয়কে অনুসরণ করার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। সেই সর্বব্যাপী সরদার ভাইয়ের বয়স আস্তে আস্তে বাড়ছে। দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। আগের মতো শরীরের যন্ত্রগুলো আর স্বনিয়ন্ত্রণে নেই। বাধ্য হয়েই ঘরেই তাঁকে এখন থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। তাঁর জন্য চার দেয়ালের মধ্যে এভাবে বন্দী হয়ে থাকাটা যে কতখানি দুঃসহ একটি ব্যাপার তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বার্ধক্যের অমোঘ নিয়ম তাঁকেও ক্ষমা করেনি।
তাঁর কন্যা স্বাতী আমার কাছে অভিযোগ করেছে- ‘বাবা কারও কথা শোনেন না- নিজে নিজেই গোপনে বাড়ি থেকে বের হয়ে হয়ত একাই সিএনজিতে চেপে রওনা হয়ে যান, সেই সুদূর টিকাটুলীতে অবস্থিত সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের পানে। কিন্তু এতে পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় ভোগেন। পথে কিছু একটা দুর্ঘটনা হলে কে দেখবে সরদার ভাইকে?
কিন্তু সরদার ভাই যতক্ষণ বাধ্য হয়ে শয্যাশয়ী না হচ্ছেন, ততক্ষণ এসব কথা মানেন না। ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সুদূরের পানে ছুটে যান। আমরা যাঁরা তাঁর ভক্ত, সাথী, বন্ধু তাঁরাও এত ব্যস্ত যে, নিয়ম করে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে সবসময় পেরে উঠি না। তাঁর অভাবটা বুঝি কিন্তু অভাবটা পূরণের জন্য যে সময়টা বের করা দরকার তা সবসময় বের করা সম্ভব হয় না। আজ-কাল-পরশু করতে করতে একটি ব্যস্ত মুহূর্তের সঙ্গে আরেকটি ব্যস্ত মুহূর্ত যুক্ত হতে হতে, একসময় হঠাৎ মনে হয় মেঘে মেঘে কত বেলাই না পার হয়ে গেল- সরদার ভাইকে অনেকদিন দেখিনি, অনেক মাস দেখিনি। ভয় হয়, এখন দেখা করতে গেলে এই অভিমানী বিপ্লবী মুখ ফিরিয়ে নেবেন না তো? এই ভয়ে আরও যাওয়াটা ক্রমাগতই পেছাতে থাকে। কিন্তু সরদার ভাইকে দেখতে যাব- এই প্রতিজ্ঞাটা প্রাণের ভেতরে থেকেই যায়। সংসারের নানা টানা-পোড়েন প্রতিটি প্রাজ্ঞ মুহূর্তে তাঁকে নিজের মাঝে নিজেই আবার ফিরে পাই। মনে হয়, তিনি তো আমার চারপাশেই আছেন। হয়ত অনেকদিন তাঁর শরীরের সঙ্গে দেখা হয় না, এই যা। কিন্তু তাঁকে তো আমি ভুলিনি। তাঁর উজ্জ্বল বাক্যগুলো আজও ঘুরছে আমার মননে। তাঁকে ভোলা অসম্ভব। রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে :
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল গানে।
আছে সে নয়ন তারায় আলোক ধারায়, তাই না হারায়-
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক্ পানে।
সরদার ভাই, সত্য হচ্ছে এই যে, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়, দেখা হচ্ছে, দেখা হবে, একদিন, এক জায়গায় নয়। বহুদিন, বহু জায়গায়, বহুবার, বহুভাবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৭২-’৭৫ এই সময়টা ছিল এক স্বপ্নেভরা সময়। দেশ স্বাধীন হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ শেষে আমরা একগুচ্ছ স্বপ্নেবিভোর কিশোর-তরুণ-যুবক দেশে ফিরে এসেছি। ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তখন সদ্য প্রকাশিত পোস্টারই তৈরি করে দিয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। সেই অনিন্দ্য সুন্দর পোস্টারে লেখা হয়েছে :
‘লাখো শহীদের মৃত্যুতে মুক্ত স্বদেশ এসো দেশ গড়ি!’
এ রকম একটা সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবর্ষে পড়তে পড়তে প্রথম সর্দার ভাইকে দেখি এবং তাঁর কথা শুনি। তবে তখন তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। কিন্তু ইতিহাসে তখনই তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেছে। পাকিস্তানী আমলের দুঃসহ কঠিন সময়ে মুসলিম ধর্মালম্বী পরিবার থেকে যে গুটিকয়েক উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী যুবক সাম্যবাদী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং এক একটি ‘লাইটহাউস’ হিসেবে সমাজে দীর্ঘকাল আলো বিকিরণ করে গেছেন, এখনও যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সরদার ভাইও একজন। মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, কেজি মুস্তফা, মোঃ ইমদুল্লাহ্- এই একগুচ্ছ মুসলিম পরিবার থেকে আগত যুবক দেশভাগের পর ‘দাদাদের’ তথা প্রবীণ বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে সাম্যবাদী আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ রণেশ দাশগুপ্তের ভাষায় শেষ পর্যন্ত ‘জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয়ে, সাম্যবাদী আন্দোলন থেকে অবসর নিয়েছিলেন।’ সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও সাম্যবাদী রাজনীতি এবং তার পথিকৃৎ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে এঁদের প্রত্যেকেরই যোগাযোগ পরবর্তীতে সব সময়ই ছিল কম-বেশি সজীব এবং সহানুভূতিপূর্ণ। আমরা যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে ছিলাম, তাঁদের কাছে পার্টির প্রাক্তন এসব মানুষ ছিল কিছুটা ‘দূরের মানুষ।’ আমাদের সামনে তখন ‘আদর্শ কমিউনিস্ট’ হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে বিরাজ করতেন পার্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত সব ত্যাগী দাদা : কমরেড মণি সিংহ, কমরেড অনিল মুখার্জী, কমরেড জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিমা দি, হেনা দি, এঁরা। আরও প্রত্যক্ষভাবে আমরা তখন যুক্ত ছিলাম ষাট দশকের উজ্জ্বল সর্বক্ষণিক কর্মী ছাত্র তারকাদের সঙ্গে- মোঃ ফরহাদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, রাশেদ খান মেনন, মতিয়া চৌধুরী, প্রমুখ দ্বিতীয় সারির কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে আমরা দাদাদের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছাতাম। এরপর তৃতীয় সারিতে ছিলেন আরও তরুণ আরও টগবগে আরও উজ্জ্বল মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আব্দুল কাইয়ুম মুকুল, আয়েশা আপা, রীনা আপা প্রমুখ নেতা। তাঁরা ছিলেন গণসংগঠনে কর্মরত কমিউনিস্ট। আমার বিশ বছর বয়সের তদানীন্তন স্মৃতি যতটুকু মনে আছে, তাতে তখন সরদার ভাইকে মনে হতো কমিউনিস্ট পার্টির পরিবারভুক্ত সদস্য না হলেও, কমিউনিস্ট পার্টির পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। নিজের নয় কিন্তু তাই বলে দূরেরও নয়। অনেক পরে অবশ্য সরদার ভাইকে যখন নিজের করে জেনেছি, তখন জেনেছি যে, তিনি হচ্ছেন সেই বরিশালের কৃষক সন্তান, যিনি একদিন ডেকার স্ট্রিটে অবস্থিত সিপিআই অফিসে হাজির হয়ে কাকাবাবুর (কমরেড মোজাফ্ফর আহ্মদ) সামনে বিলেত গমনের ছাড়পত্রটি ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন সেই সরদার ভাই, যিনি আন্ডারগ্রাউন্ড জীবনে বছরের পর বছর মাথায় হুলিয়া নিয়ে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিরাপদ সংসার পরিত্যাগ করে গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বছরের পর বছর কাটিয়েছেন কারান্তরালে, হাঙ্গার স্টাইক করে কারাগারের ভেতরে কাটিয়ে দিয়েছেন দিনের পর দিন। আবার তিনিই হচ্ছেন সেই সরদার ভাই, যিনি পূর্ববঙ্গের বঙ্গীয় গণপরিষদে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে কমিউনিস্ট প্রার্থী হিসেবে অনায়াসে নির্বাচিত হয়েছেন। আমার সরদার ভাই হচ্ছেন, সেই সরদার ভাই, যিনি সমগ্র মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বের একটা বড় সময় ধরে পাকহানাদার বাহিনীর কারাগারের বন্দী অবস্থায় মৃত্যুর প্রহর গুনে কালাতিপাত করেছেন। সরদার ভাইয়ের অনেক উজ্জ্বল পরিচয় আছে, তা আমি আরও পরে উদ্ঘাটনের প্রয়াস পাব। কিন্তু আমি যেই সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ ১৯৭২-’৭৫ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের কথা। তখন যখন এসব কিছুই আমার জানা ছিল না, সরদার ফজলুল করিম তখনও পর্যন্ত আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত কমরেড সরদার ফজলুল করিম হননি। তখনও তিনি আমার কাছে একজন নিভৃতচারী অধ্যাপক মাত্র, অবসরগ্রহণকারী বামপন্থী যার সঙ্গে পার্টির একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। যিনি থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা ফুলার রোডের একটি বাড়িতে এবং যে বাড়িতে ‘সাম্যবাদের ভূমিকা এবং ‘শ্রমিক আন্দোলনের হাতে খড়ি’র লেখক কমরেড অনিল মুখার্জী নিয়মিত যাতায়াত করেন। অনিল দা তখন আমাদের জন্য একজন ‘আইকন।’ অনিল দা নিয়মিত ‘সরদার ভাই’-এর বাসায় যান। এটাই তখন আমাদের জন্য ছিল তাঁর প্রতি অনুরাগ ও কৌতূহল সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। সেই যুগে ব্যাপারগুলো এভাবেই ঘটত। এরই ফাঁকে ফাঁকে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকল। দূরের সরদার ভাই আস্তে আস্তে আমার মনের কাছাকাছি চলে আসতে শুরু করলেন। ১৯৭৩ সালে হাতে পেলাম সরদার ভাইয়ের অসামান্য সৃষ্টি ‘দর্শন কোষ।’ এত সহজ-সুন্দর, সাবলীল বাংলায় দর্শনের দুর্বেধ্য ‘ক্যাটাগরি’ বা প্রত্যয়ের সংজ্ঞায়ন দুই বাংলা মিলিয়ে দ্বিতীয় একটি আর পাওয়া যাবে না। এই মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই পরিচয় হলো, তাঁর কন্যা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী স্বাতীর সঙ্গে। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক, স্বাতী এবং তাঁর একঝাঁক উজ্জ্বল সপ্রতিভ বন্ধু মিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে তখন গড়ে তুলেছিলেন একটি শক্তিশালী পাঠচক্র-আন্দোলন। সেখানে যাওয়া আসার সুবাদেই স্বাতী ও শাকিলের সঙ্গে পরিচয় এবং স্বাতীর বাবা সরদার ভাই এবং সরদার ভাইয়ের কন্যা স্বাতী এই পরিচয়টাও তখন প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের চোখের সামনে প্রবীণ কমিউনিস্ট হিসেবে তখনও যাঁরা বিরাজমান ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই ছিলেন সংসারহীন সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো। তাঁরা ছিলেন অকৃতদার। অত্যন্ত স্বল্পভোগী এবং নিরহঙ্কার প্রকৃতির মানুষ। কঠোর কৃচ্ছ্রতা তাঁদের শরীর এবং মনে এক ধরনের ত্যাগী আভা তৈরি করে দিয়েছিল, যার বিচ্ছুরণে আমরা তরুণরা ছিলাম আপ্লুত এবং কিছুটা সম্মোহিত। পার্টির ভেতরে এই প্রায় দেবতাসুলভ কমিউনিস্টদের তুলনায় সরদার ভাইদের মতো প্রাক্তন কমিউনিস্টদের (পরে অবশ্য সরদার ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি এবং বিশ্বাসও করি যে, একজন ব্যক্তি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও কমিউনিস্ট নাও হতে পারেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও একজন কমিউনিস্ট হতে পারেন।) তখন আমরা কিছুটা দূরের লোক হিসেবেই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম। তবে এঁদেরও বন্ধুই ভাবতাম, শত্রু ভাবতাম না। মনে আক্ষেপ ছিল, কেনই বা তাঁরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে আবার সক্রিয় হচ্ছেন না? আসলে তখন প্রাণে উচ্ছ্বাস ছিল প্রচুর। ভাবতাম বাংলাদেশই হবে বিশ্বের বুকে ১৭তম সমাজতান্ত্রিক দেশ। এখন পরিণত বয়সে মনে হয় কে যে কাছের, কে যে দূরের তা বলা কঠিন। বিপ্লবও যে একটি চলমান প্রক্রিয়া সেটাও সরদার ভাইয়ের কাছে পরে শিখেছি। তিনি প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশে বিপ্লব তো হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটা একটা বড় বিপ্লব। আর বাংলাদেশের নারীরা এই মুসলিম প্রধান একটি দেশে ঘর থেকে বেরিয়ে মুক্ত হরিণীর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে, এটাও কোন অংশে বিপ্লবের চেয়ে কম কিছু নয়। এই চলমান প্রক্রিয়ায় বিপ্লব আগায় অর্কেস্টার মতো নানা বাদকের-গায়কের নানা ধরনের সুর মূর্ছনার অপূর্ব সংশ্লেষণের মাধ্যমে। এখানে সর্বত্যাগী জ্ঞান চক্রবর্তীর যেমন দরকার- তেমনি সরদার ভাইয়েরও রয়েছে অমূল্য ভূমিকা। জ্ঞান চক্রবর্তী প্রবীণ বিপ্লবীদের মধ্যে একজন অত্যন্ত আদর্শ স্থানীয় কমিউনিস্ট ছিলেন- তাঁকে দেখেছি ‘বলাকা ব্লেড’ দিয়ে দুই-দুইবার দাড়ি না কামানো পর্যন্ত ব্লেডটা ফেলে দিতেন না। এ রকম ‘স্পার্টান’ কঠিন মানুষ আমার ৫৩ বছর বয়সে খুব বেশি দেখতে পাইনি। আবার নিজের অবাধ্য ছেলের প্রতি অন্ধ অপত্য স্নেহে নিজের শ্রম-মেধা-অর্থ সবই ঢেলে দিচ্ছেন, এ রকম একজন দুর্বল পিতা হিসেবে নরম মানুষ সরদার ভাইকেও দেখেছি। আবার এই সরদার ভাইকে দেখেছি, আশি উত্তীর্ণ বয়সে রিক্সা থেকে লাঠি ভর করে নামতে- কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখ্যান করতেও তাঁকে দেখেছি। তাই মনে হয় কৃচ্ছ্র বা ভোগের প্রতি বিরূপতা এবং নিজের ব্যাপারে সাহায্যবিমুখতা এটি এই উত্তাল চল্লিশের গৃহী বিপ্লবী সরদার ভাই এবং সন্ন্যাসী বিপ্লবী জ্ঞান চক্রবর্তী উভয়েরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য বটে। কিন্তু গৃহী বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে মায়ার বাঁধনে লতায় পাতায় জড়িয়ে সংসারের বাস্তবতা বিদ্যমান থাকায় সেখানে কিছু মানবিক দুর্বলতাও(?) যুক্ত হয়েছে। তবে ব্যক্তি মানুষের জন্য সে বিপ্লবী হলেও সেটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এদের একজন কঠিনকে ভালবাসেন আরেকজন নরম এবং দুর্বলকে ভালবাসেন কিন্তু উভয়ের মিল এক জায়গায়। ভালবাসায় মমতায় মানবপ্রেমে মানবিকতায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সার্থক হওয়ার সাধানায় এঁরা উভয়েই ছিলেন এক। কিন্তু বিলিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রটা একেকজনের জন্য একেক রকম। সরদার ভাই যা কিছু করেছেন কোনটাই কোনদিনই একান্ত নিজের জন্য করেননি। এমনকি ছেলেমেয়েদের ভালবাসার ক্ষেত্রেও সরদার ভাই বেছে নিয়েছেন সেই সন্তানটিকেই যার সাফল্য সবচেয়ে কম, যে তুলনামূলকভাবে একটু পিছিয়ে পড়েছে এবং যার সাহায্যের প্রয়োজনও হয়ত অন্যদের তুলনায় বেশি। এখানেও দুর্বলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন নীতিবোধ হয়ত অজান্তে তাঁর ভেতরে কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। যদিও পরিবারের অন্য সদস্যরা এ জন্য তাঁকে হয়ত একজন স্নেহান্ধ পিতা হিসেবেই দেখেছেন। সংসারে সকলের প্রতি সমান কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে তাদের রয়েছে। তবে বিপ্লবীদের জন্য এটুকু মানবিক দুর্বলতা বিরাট কোন অপরাধ নয়। জ্ঞান দাও সারাজীবনে যা কিছু করেছেন একান্ত নিজের জন্য তা করেননি। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে জ্ঞান চক্রবর্তীরা বিশ্বাস করতেন না। সমস্ত শ্রম মেধা প্রজ্ঞা যা কিছু তাঁদের ছিল, তা ছড়িয়ে দিয়েছেন পার্টির ভেতরে বাইরে বৃহত্তর জন-মানুষের মধ্যে পার্টিই ছিল তাঁদের ঘর, তাঁদের পরিবার। ঘরের মানুষের প্রতি ভালবাসা ও বাইরের মানুষের প্রতি ভালবাসা দুই-ই বা তাঁদের প্রজন্মের কমিউনিস্টদের ছিল এবং অনেক বেশি পরিমাণেই ছিল। জ্ঞান দা, অনিলদা, সুনীল দা, প্রমুখ প্রবীণ বিপ্লবীরা আজীবন অকৃতদার ছিলেন। আবার অন্য দিকে কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, কমরেড রবি নিয়োগী এঁরা বিবাহিত ছিলেন এবং তাঁদের সন্তান-সন্ততিও ছিল। কিন্তু এঁদের কেউই কারও চেয়ে কম আত্মত্যাগী ছিলেন বলে মনে হয় না। এসব সমস্যা নিয়ে চেগুয়েভারার একটি অবিস্মরণীয় উক্তি এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। চে লিখেছেন, ‘বিপ্লবী নেতাদের শিশুসন্তান রয়েছে। যারা সবেমাত্র আধো আধো কথা বলতে শুরু করেছে, যারা এখন বাবা ডাকটি বলতে শেখেনি, রয়েছে তাদের প্রিয়তমা বধূরা, এঁদের সকলকেই বিপ্লবের ভবিষ্যতের জন্য, বিপ্লবদের জীবনদানের অংশ হিসেবে আত্মত্যাগ করতে হয়। বিপ্লবীদের বন্ধুমহল হয় সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যে আবদ্ধ, বিপ্লবী সাথীদের নিয়েই গড়ে ওঠে তাঁদের সমগ্র জীবন। সেই সঙ্কীর্ণ বৃত্তের বাইরে তাঁদের অন্য জীবন প্রায়ই থাকে না। এই অবস্থায় একজন বিপ্লবীর মধ্যে অবশ্যই উপমাত্রার মানবিকতা বোধ থাকতে হবে, থাকতে হবে উচ্চমাত্রার ন্যায়বোধ এবং সততা যাতে তিনি ‘গোঁড়ামি’ বা ‘চরমপন্থা’ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেন। শীতল যুক্তিবাদ বা এক ধরনের গণবিচ্ছিন্নতা এড়ানোর জন্যও এটা দরকার। বিপ্লবীদের প্রতিদিন সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে যাতে জীবন্ত মানবতার জন্য বিপ্লবীদের যে অফুরন্ত ভালবাসা রয়েছে সেটি বাস্তব কাজে রূপান্তরিত হয়। এমন কাজে যা হবে দৃষ্টান্তস্থানীয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক [(চে গুয়েভারা, ‘সমাজতন্ত্র এবং কিউবা দেশের মানুষ’ (১৯৬৫)]। আমি ১৯৭১ সালে ভারতে মুক্তিযুদ্ধে ক্যাম্পে থাকাকালে জ্ঞান দাকে দেখেছি কিভাবে তিনি সবচেয়ে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাটির খাবারের ব্যাপারেও তীব্র মনোযোগী ছিলেন। প্রতিটি প্রশিক্ষণার্থী গেরিলার জন্য ছিল তার সমান যতœ ও ভালবাসা। আবার সরদার ভাইকে দেখেছি চলতি পথে প্রতিটি রিক্সাচালকের সঙ্গে অপার অকৃত্রিম ভালবাসা ও বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে। নিজের বাড়ি রাজাবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বা রাজাবাজার থেকে নিউমার্কেট যখনই তিনি কোন রিক্সায় উঠতেন তখনই তাদের সঙ্গে তাঁর চলত নানা সুখ-দুঃখের অবিরাম আলাপ। কখনই ভাড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে তাঁর কোন দ্বন্দ্ব হয়নি। তারাও এই সাধাসিধে লাঠিতে ভর দিয়ে দণ্ডায়মান ভদ্রলোকটিকে কখনও ঠকানোর চেষ্টা করেননি। রিক্সায় উপবিষ্ট সরদার ভাইকে দেখে আমার সবসময় মনে হয়েছে যে তিনি যেন সহাস্য বলেছেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক।’
দূরের লোক কাছের হলো- কাছের
লোক দূরে সরে গেল
আশির দশকের শেষে এসে আমাদের দেশের সোভিয়েত ঘরানার কমিউনিস্ট শিবিরে এক টাল-মাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তখন মনে হয়েছিল যে, সব চিন্তা, সব বিশ্বাস বুঝি শিথিল হয়ে যাবে। ‘সমাজতন্ত্র’ নিয়েই যেন নতুন করে নানা প্রশ্নের ঢেউ সৃষ্টি হয়েছিল। কেউ কেউ বলতে থাকেন ‘সমাজতন্ত্রের কোনই সুকৃতি নেই।’ ‘ইতিহাসে অক্টোবর বিপ্লব একটি দুর্ঘটনা মাত্র।’ ‘পুঁজিবাদই টিকে আছে, টিকে থাকবে’ এবং সমাজতন্ত্র বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। এই সময় আমাদের পার্টির মূল নেতৃত্বই কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন। বহু সমাজতান্ত্রিক কর্মী তখন মানসিকভাবে একদম ভেঙ্গে পড়েন। কেউ কেউ একদম বসে যান। কেউ কেউ বিলোপবাদীদের খুন করার জন্য উগ্র উত্তেজনায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর কেউ কেউ হতভম্ব হয়ে ভাবতে থাকেন কী করা যায়। অন্তত একজন কর্মী ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তখন খবর পেয়েছিলাম। সেদিনের সেই দিনগুলোতে আমরা অনুজ কয়েকজন নতুন প্রজন্মের মানুষ খুব অসহায়ভাবে ‘কমিউনিস্ট’ পার্টিকে রক্ষা করার জন্য দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। সেই অসহায় অবস্থায় লক্ষ্য করলাম যাঁরা বহুদিন কাছাকাছি থেকে কমিউনিস্ট পার্র্টি করেছেন বা যাঁদের জীবনের ঐহিক সাফল্যে সোভিয়েতের কমিউনিস্ট পার্টির অবদান যথেষ্টই উঁচুমাত্রার ছিল তাঁদের অনেকেই সমাজতন্ত্রবিরোধী শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য ‘নবায়িত সমাজতন্ত্রের’ ধারণা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা শুরু করার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন এবং চাইলেন ‘কট্টরপন্থী’ অপবাদের চক্র থেকেও মুক্ত থাকতে এবং ‘বিলোপবাদের’ বিরুদ্ধেও লড়াই অব্যাহত রাখতে। এ রকম একটা সংস্কারমুক্ত কিন্তু সমাজতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তখন খুব সাবধানে পা ফেলছিলেন অনেকে। ইতিহাসের এই জটিল সময়টা ছিল কমিউনিস্টদের জন্য সবচেয়ে সঙ্কটজনক সময় সবচেয়ে অসহায় মুহূর্ত। এর আগেও এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন কখনও কখনও সঙ্কটে পতিত হয়েছে। অতীতেও কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হয়েছে- যেমন ষাট দশকে চীন-মস্কো বিভেদের সময় সরদার ভাইরাই ছিলেন সেই সময়কার বিভেদের সাক্ষী। কিন্তু তখন পার্টিতে বিভেদ তৈরি হয়েছিল সমাজতন্ত্র নিয়ে নয়, বরং কে বেশি খাঁটি সমাজতন্ত্রী সেটা নিয়েই ছিল বিতর্ক। ফলে তখন কমিউনিস্টরা এতটা অসহায় বোধ করেননি, বরং তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলন তখন কম-বেশি সামনেই এগিয়ে গেছে। যদিও তাতে দুই কেন্দ্রের অন্ধ অনুকরণবৃত্তির প্রভাবই ছিল বেশি।
কিন্তু এবারকার এই ভিন্নধর্মী সঙ্কট মুহূর্তে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম, কাছের লোকরা দূরে চলে গেলেও আমাদের বহু পুরনো ঘুমন্ত সমর্থক এবং বিশেষত বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত, যাঁদের ঠিক কমিউনিস্ট বলা যাবে না। যাঁদের চলতি রাজনীতির ভাষায় ‘রেডিকেল ডেমোক্র্যাট’ বা ‘বিপ্লবী গণতন্ত্রী’ বলে ডাকা হয়, তারাই বরং সদল বলে এগিয়ে এসে কমিউনিস্ট পার্টি রক্ষার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, অনেক অপরিচিত হাত এসে শক্ত হাতে লাল জান্তা আঁকড়ে ধরছে। এছাড়া পার্টির অগণিত সাধারণ ছাত্র-শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুর সদস্য-সমর্থকরা সকলেই পার্টিকে রক্ষার পক্ষেই মূলত অবস্থান গ্রহণ করলেন। যাই হোক তারপরেও দুঃখজনকভাবে আমাদের পার্টি ও পার্টির সম্পত্তি সেই সময় দু’ভাগে বিভক্ত করা হলো। যদিও আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যালঘিষ্ঠ কমিউনিস্ট সদস্যরা একত্রেই কংগ্রেস করতে চেয়েছিলাম এবং সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্ত যাই হোক, তা মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং সে জন্য সারাদেশে প্রথমে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে দুটো দলিলও প্রচারিত হয়েছিল, কিন্তু তারপর শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ কংগ্রেস করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত ভোটে হেরে যাওয়ার ভয়ে বিলোপবাদীরা শেষ পর্যন্ত একত্রে কংগ্রেস করতে চাননি। আর আমরা ভাড়া করা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আশঙ্কায় শান্তিপূর্ণ বিভক্তির পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলাম বা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যদিও এ জন্য এখন পর্যন্ত আমাদের সমর্থকরা আমাদের অনুযোগ করে থাকেন।
এত ইতিহাসের কথা এখানে লিখলাম এই জন্য যে, এই সময় আমাদের মতো যাঁরা সাম্যবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে রক্ষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের জন্য একটা অত্যন্ত বড় অনুপ্রেরণার স্থলে ছিলেন সরদার ভাইয়ের মর্মভেদী দৃঢ় উচ্চারণমালা। সরদার ভাই প্রথম আমাকে বলেছিলেন, সমাজতন্ত্রের কোন বিপর্যয় হয়নি। বিপর্যয় কথাটা তোমরা শুধু শুধু ব্যবহার করেছ। এই কথাটা ব্যবহার করা উচিত নয়। সরদার ভাই-ই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি খবরের কাগজে লিখেছিলেন। ‘সমাজতন্ত্র যদি দশ লক্ষ বছর লাগে তাহলেও!’ সরদার ভাই-এর আরেকটি প্রিয় উক্তি ছিল ‘সমাজতন্ত্র তো আছেই- নাই কে বলছে? প্রতিটি পরিবার চলে সমাজতন্ত্রের আদি নিয়মটি অনুসরণ করে। ‘ফ্রম ইচ এ্যাকটিং টু হিজ ক্যাপাসিটি এ্যান্ড টু ইচ এ্যাকটিং টু হিজ নিডস’্ অর্থাৎ প্রত্যেকের কাছ থেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এবং প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী এটাই প্রতিটি পরিবারের প্রাথমিক সংবিধান। সরদার ভাইয়ের মুখ থেকে প্রথম যখন এই বক্তব্যটি শুনেছিলাম, তখন এর অন্তর্নিহিত গভীরতায় এবং আশ্চর্য সরলতায় পুরোপুরি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। সত্যই তো সব পরিবারই একার্থে সমাজতন্ত্রের এক একটি জীবকোষের মতো সংগঠন। ‘পণ্যকে’ যেমন কার্ল মার্কস গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে পুঁজিবাদের একক ইউনিট হিসেবে, কোষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, তেমনি সরদার ভাইয়ের ‘পরিবার’সংক্রান্ত এই ধারণাটি মধ্যে লুকিয়ে আছে আরেকটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি। গভীরভাবে ভেবে দেখলে বোঝা যায় যে-
১. পরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত মালিকানা বলে কিছু নেই। একান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসপত্র বাদ দিলে বাকি সব কিছুই সেখানে পরিবারের যৌথ সম্পত্তি। কাগজ-কলমে দলিলে হয়ত ব্যক্তির নামেই সম্পত্তি লেখা থাকে কিন্তু কার্যত সম্পত্তি ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণে পরিবারে সকল সদস্যই কম-বেশি ভূমিকা রাখেন।
২. পরিবারের শিশু বা বৃদ্ধদের যেহেতু কাজ করার সামর্থ্য নেই, সেহেতু তাদের সচরাচর কোন কঠিন কাজ করতে বলা হয় না। কিন্তু তাদের খাদ্য বস্তু, সেবা, চিকিৎসা, বিশ্রামের প্রয়োজনটুকু পরিবারের সামর্থ্যবান অন্য সদস্যদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন থেকেই মেটানো হয়। যাঁরা সক্ষম তাঁরা পরিশ্রম করে সম্পদ উৎপাদন করেন এবং নিজের প্রয়োজনটুকু রেখে বাকিটুকু পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই ব্যয় করেন। এতে কোন দুঃখবোধ তাদের হয় না, এই প্রয়োজনটা তাদের জন্য কোন দুঃখজনক প্রয়োজন নয়, এটি নৈতিক এবং আনন্দদায়ক দায়িত্ব পালন মাত্র!
৩. পরিবারে শ্রম বিভাজনের সময় সদস্যদের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যোগ্যতা ও সামর্থ্য, বয়স, ইত্যাদি স্বাভাবিক উপাদানগুলোকেই গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। কোন বাধ্যতামূলক শারীরিক দাসত্ব বা মজুরির বিনিময়ে দাসত্ব পরিবারের অভ্যন্তরে সাধারণত সম্ভব হয় না।
৪। পিতৃতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী পরিবারগুলোর কথা বাদ দিলে আজকাল আধুনিক সভ্য পরিবারগুলোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিও হয় গণতান্ত্রিক এবং অংশীদারিত্বমূলক। ফলে কর্তৃত্ববাদ বা একনায়কত্ব এখানে চলে না।
ওপরে সভ্য মনুষ্য পরিবারের যে উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্যগুলোর বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে, তা হয়ত অক্ষরে অক্ষরে প্রতিটি বিদ্যমান পরিবারের মধ্যে পরিলক্ষিত হবে না কিন্তু এর পরেও সরদার ভাইয়ের কথার মূল সত্যটি এই জায়গায় নিহিত যে, প্রতিটি পরিবারের আর্দশরূপকল্পটি হচ্ছে অনেকটাই এ রকম। সুতরাং সরদার ভাই যখন বলেন, সমাজতন্ত্র তো আছেই এবং তা খুঁজে পাওয়ার জন্য দূরে তাকানোর দরকার নেই আশপাশে মানুষের সৃষ্ট মানবিক পরিবারগুলোর ভেতরের মানবিক সম্পর্কের দিকে তাকালেই তাকে ধরা যাবে, দেখা যাবে, তখন তিনি আসলে একটি গভীরতর সত্যের প্রতিই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এভাবে বঝুতে পারলে হতাশা আমাদের কখনই স্পর্শ করতে সক্ষম হবে না। আমরা বুঝতে সক্ষম হব যে, ব্যক্তি মানুষের সামাজিক স্বভাবধর্মই হচ্ছে সমাজতন্ত্র। তবে ছোট মানুষদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতার কারণে তার সামাজিকতার মাত্রা পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে সমগ্র জাতি এবং অবশেষে সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ছড়িয়ে যেতে এখনও পারেনি। কিন্তু একদিন তা অবশ্যই বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হবে। সামাজিকতার আবেদন যে কত গভীরে প্রোথিত তা বোঝা যায় বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত বিশ্বধর্মগুলোর মর্মবাণীর দিকে তাকালে। এ যাবত প্রণীত সব ধর্মগ্রন্থই মূলত মানবজাতিকে একই পরিবারভুক্ত সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হিসেবেই বর্ণনা করে গেছেন। সরদার ভাই তাই যখন পরিবারের পারস্পারিক সৌহার্দ্যরে মধ্যে সমাজতন্ত্রের বীজকে আবিষ্কার করেন, তখন সেটা তাঁর গভীর দার্শনিক বোধেরই প্রকাশ ঘটায়।
সরদার ভাইয়ের কাছ থেকেই আমি প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরির কথা শুনতে পেয়েছিলাম। সরদার ভাই নিজেও তাজউদ্দীন আহমদের মতোই নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিদিন মুক্তার অক্ষরে তাঁর ডায়েরি মেইনটেইন করেন। তাঁর এই অভ্যাসের কথাটা আমার জানা ছিল। আজও তাই খুবই কৌতূহল রয়েছে তার অসংখ্য ডায়েরি পাঠ করার। যদিও এই অন্যায় আবদার আমি তাঁর কাছে কখনই করিনি, করাটা উচিতও হবে না। তবু আমার ধারণা এগুলো যদি কোনদিন প্রকাশিত হয়, তাহলে তা থেকে বাংলাদেশের জন্ম, বিকাশ ও অগ্রগতির ক্রমোন্মোচনশীল একটি বর্ণনা ও ব্যাখ্যার সাক্ষাত পাওয়া যাবে। সরদার ভাই নিজের ডায়েরির কথা তেমন একটা না বললেও মৃত্যু-পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়েরির থেকে একটি দিনের কথা আমাকে এত আগ্রহ ভরে বর্ণনা করেছিলেন যে, তা আজও আমার মস্তিষ্কে গেঁথে আছে। তিনি গান্ধী প্রসঙ্গে আলোচনাকালে একদিন আমাকে বলেছিলেন যে, গান্ধী যেদিন আততায়ীর হাতে নিহত হন, সেদিন তাজউদ্দীন আহমেদের দিনলিপিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে, তাঁর কাছে যেন সব কিছু খালি খালি লাগছে এবং মনে হচ্ছে যেন আপন পিতৃবিয়োগের বেদনার মতো বেদনা অনুভব করছেন তিনি। সেদিন পথে পথে উড়ান্তের মতো ঘুরে বহু রাতে হলে ফিরে ছিলেন জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। এই কথাগুলো বলার সময় সরদার ভাইয়ের গভীর আবেগপূর্ণ চেহারার দিকে তাকিয়ে আমি অনুভব করেছিলাম যে, মহাত্মা গান্ধী বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনগণনন্দিত নেতাদের ব্যাপারে তাঁর দরদি দৃষ্টি ভঙ্গিটি ঠিক আমাদের মতো অঙ্ক কষে নিরাসক্তভাবে তিনি স্থির করেননি। আমরা যেমন এসব নেতাকে ইতিবাচক-নেতিবাচক উভয় দিক মিলিয়ে শ্রেণী দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নে অভ্যস্ত, তিনি ঠিক তেমনভাবে তা করেন না। এসব ক্ষেত্রে তার এক ধরনের প্রাজ্ঞ ইতিবাচক অবস্থান রয়েছে, যা সাধারণ জনগণ বা তাজউদ্দীন আহমদের মতো গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে অধিকতর মিলে যায়। এ রকম উদার মনোভঙ্গির পেছনে নিশ্চয়ই বাস্তব কারণ আছে। আমার বিশ্বাস সরদার ভাইদের প্রজন্ম সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করেন এবং আয়ত্ত করেন। সেই তুলনায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ফাঁকি বা অসাম্য বা শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সে সম্পর্কে তাদের আগ্রহ ও একাত্মতা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। যেহেতু তাদের জীবনটাই অতিবাহিত হয়েছে ঐ সব বড় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে, সেহেতু শ্রেণী সংগ্রামের উচ্চতর পর্যায়ে উন্নততর শ্রেণী সমাবেশ সম্পর্র্কে মনোযোগ দেয়ার অবকাশ তাদের হয়নি। অবশ্য সেই লড়াইটা এখনও পর্যন্ত ঠিকমতো আমরা শুরুও করতে পারিনি। সমাজও কতটুকু প্রস্তুত তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। হয়ত এখনও পর্যন্ত দুটো লড়াই-ই পরস্পর পরিপূরকভাবে অগ্রসর হবে। কমিউনিস্টদের সঙ্গে বুর্জোয়াদের অসাম্প্রদায়িক অংশের ঐক্য না হলে সরদার ভাইদের প্রজন্ম অধিকাংশ সময়ই মনোক্ষুণ্ন বোধ করতেন। এটাই স্বাভাবিক কিন্তু আমি যেহেতু তাদের এই মনোক্ষুণ্নতার বাস্তব ভিত্তিটি জানি, তাই এ নিয়ে কখনও তাঁর সঙ্গে তর্ক করিনি। শুধু অপেক্ষা করে থেকেছি, কখন আপন অভিজ্ঞতায় নিজেই তিনি বুঝতে পারবেন বুর্জোয়াদের মেকি অসাম্প্রদায়িকতার দেউলিয়াত্ব। সৌভাগ্যবশত চলমান রাজনৈতিক ঘটনাবলী খুব শীঘ্রই বুর্জোয়া দলগুলোর দেউলিয়াত্বটুকু উদ্ঘাটিত করে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্নেও সরদার ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের নবপ্রজন্মের কমিউনিস্টদের দূরত্ব অনেকখানি কমে আসতে শুরু করেছে, তবে সরদার ভাই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রতি অনুরক্ত থাকলেও সব সময়ই একটি গভীর সত্য কথা বলে এসেছেন। তিনি বলেছেন যে, কমিউনিস্টরা সম্প্রতি যে ‘হাসিনা-খালেদার’ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে কখনও হাসিনার পক্ষে জিন্দাবাদ কখনও মুর্দাবাদ দিচ্ছে- তা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। বরাবর তিনি বলেছেন, এই দ্বন্দ্বের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে কৃষক, শ্রমিক, ক্ষেতমজুর, রিক্সাওয়ালা, বস্তিবাসী এদের জীবনের মাঝে কমিউনিস্টদের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। মনোযোগ দিতে হবে তাদের প্রতি, গড়ে তুলতে হবে, মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টদের সঙ্গে শ্রমজীবীদের অঙ্গাঙ্গি যোগাযোগ। শ্রমজীবীদের জীবনের দ্বন্দ্বকে রাজনীতির প্রধান দ্বন্দ্বে পরিণত করতে হবে। সরদার ভাইয়ের এই পরামর্শকে আমি সঠিক মনে করি। এই সঙ্গে আরেকটি কথা সরদার ভাই প্রায়ই বলেন, তা হচ্ছে, ‘ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডিতে চিন্তা করলে হবে না- চিন্তা করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে। এটিও খুবই মূল্যবান কথা। ‘ক্যাডাররা’ এখন খুবই কম পড়াশোনা করে থাকে- এটাও সরদার ভাইয়ের একটা তীব্র ক্ষোভ। কমিউনিস্ট পার্টির সোমেন-তাজুল পাঠাগার উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘যে বই পাঠ করা হয় না- সে বইকে বই বলা অর্থহীন।’ এই পাঠাগারের বইগুলো পার্টির তরুণ পাঠকরা সত্যই ভাজা ভাজা করে পড়ে ফেলবেন নাকি দিনের পর দিন এগুলোর ওপর খালি ধুলোর আস্তরণ জমা হতে থাকবে- এ নিয়ে তাঁর মনে সংশয় তৈরি হয়েছিল এবং সেই সংশয় অযৌক্তিকও ছিল না।
এই সব অবিরাম দৈনন্দিন চিন্তা-ভাবনার বিনিময়ের মধ্য দিয়ে কখন যে সরদার ভাই এবং আমি একই লড়াইয়ের কাফেলার সহযাত্রীতে পরিণত হয়েছিলাম- পরস্পর অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিলাম- একাত্ম হয়েছিলাম- তা আর আজ মনে নেই। কিন্তু এভাবেই ইতিহাসের : ধারায় হয়ত দূরের মানুষরা নিকট মানুষে পরিণত হয় এবং নিকট মানুষরা দূরে হারিয়ে যায়।
প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
এমন এক সময় ছিল, যখন পথে-ঘাটে, নানা অনুষ্ঠানে, গাছতলায়, পাঠকচক্র, আজিজ সুপার মার্কেটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকে, টিচার্স লাউঞ্জে, ঢাকা শহরের আনাচে-কানাচে, ক্যাসেটের দোকানে, নিউমার্কেট, বাজারে, বিদ্যুতের বিল শোধের দীর্ঘ লাইনে, সর্বত্রই বৃদ্ধ সরদার ভাইকে দেখা যেত। একজন শীর্ণকায় মানুষ লাঠি হাতে ঠুকঠুক করে কারও সাহায্য ছাড়াই দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই সক্রেটিসের শিষ্যদের মতো সরদার ভাইকেও তাঁর শিষ্যরা ঘিরে পরিবেষ্টিত করে ফেলেছে। তিনিও আনন্দের সঙ্গে প্রশ্ন করছেন, জবাব দিচ্ছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম পথে-প্রান্তরেই তৈরি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের জন্য হীরা-জহরত-মণি-মুক্তার মতো রাশি রাশি মূল্যবান চিন্তারাজি। এ রকম একটা চলন্ত বিদ্যালয় পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। কখনও কখনও এই বিদ্যালয়কে অনুসরণ করার সৌভাগ্য আমারও হয়েছে। সেই সর্বব্যাপী সরদার ভাইয়ের বয়স আস্তে আস্তে বাড়ছে। দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। আগের মতো শরীরের যন্ত্রগুলো আর স্বনিয়ন্ত্রণে নেই। বাধ্য হয়েই ঘরেই তাঁকে এখন থাকতে হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। তাঁর জন্য চার দেয়ালের মধ্যে এভাবে বন্দী হয়ে থাকাটা যে কতখানি দুঃসহ একটি ব্যাপার তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বার্ধক্যের অমোঘ নিয়ম তাঁকেও ক্ষমা করেনি।
তাঁর কন্যা স্বাতী আমার কাছে অভিযোগ করেছে- ‘বাবা কারও কথা শোনেন না- নিজে নিজেই গোপনে বাড়ি থেকে বের হয়ে হয়ত একাই সিএনজিতে চেপে রওনা হয়ে যান, সেই সুদূর টিকাটুলীতে অবস্থিত সেন্ট্রাল উইমেনস কলেজের পানে। কিন্তু এতে পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় ভোগেন। পথে কিছু একটা দুর্ঘটনা হলে কে দেখবে সরদার ভাইকে?
কিন্তু সরদার ভাই যতক্ষণ বাধ্য হয়ে শয্যাশয়ী না হচ্ছেন, ততক্ষণ এসব কথা মানেন না। ঝুঁকি মাথায় নিয়েই সুদূরের পানে ছুটে যান। আমরা যাঁরা তাঁর ভক্ত, সাথী, বন্ধু তাঁরাও এত ব্যস্ত যে, নিয়ম করে তাঁর সঙ্গে তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে সবসময় পেরে উঠি না। তাঁর অভাবটা বুঝি কিন্তু অভাবটা পূরণের জন্য যে সময়টা বের করা দরকার তা সবসময় বের করা সম্ভব হয় না। আজ-কাল-পরশু করতে করতে একটি ব্যস্ত মুহূর্তের সঙ্গে আরেকটি ব্যস্ত মুহূর্ত যুক্ত হতে হতে, একসময় হঠাৎ মনে হয় মেঘে মেঘে কত বেলাই না পার হয়ে গেল- সরদার ভাইকে অনেকদিন দেখিনি, অনেক মাস দেখিনি। ভয় হয়, এখন দেখা করতে গেলে এই অভিমানী বিপ্লবী মুখ ফিরিয়ে নেবেন না তো? এই ভয়ে আরও যাওয়াটা ক্রমাগতই পেছাতে থাকে। কিন্তু সরদার ভাইকে দেখতে যাব- এই প্রতিজ্ঞাটা প্রাণের ভেতরে থেকেই যায়। সংসারের নানা টানা-পোড়েন প্রতিটি প্রাজ্ঞ মুহূর্তে তাঁকে নিজের মাঝে নিজেই আবার ফিরে পাই। মনে হয়, তিনি তো আমার চারপাশেই আছেন। হয়ত অনেকদিন তাঁর শরীরের সঙ্গে দেখা হয় না, এই যা। কিন্তু তাঁকে তো আমি ভুলিনি। তাঁর উজ্জ্বল বাক্যগুলো আজও ঘুরছে আমার মননে। তাঁকে ভোলা অসম্ভব। রবিঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে :
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে,
তাই হেরি তায় সকল গানে।
আছে সে নয়ন তারায় আলোক ধারায়, তাই না হারায়-
ওগো তাই দেখি তায় যেথায় সেথায়
তাকাই আমি যে দিক্ পানে।
সরদার ভাই, সত্য হচ্ছে এই যে, আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়, দেখা হচ্ছে, দেখা হবে, একদিন, এক জায়গায় নয়। বহুদিন, বহু জায়গায়, বহুবার, বহুভাবে।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/
No comments:
Post a Comment