উচ্চাভিলাষের প্রাধান্য : বাস্তবায়ন হবে কঠিন
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ : ০৬ জুন, ২০১৪
বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে দুটি বিষয় বিবেচনায় আসে। প্রথম আমি যে আকার নির্ধারণ করেছি তার অর্থ সংগ্রহ করতে পারব কিনা। অর্থায়নের সূত্রগুলোর বিভাজন বাজেটে দেয়া থাকবে। অর্থায়নের বড় উৎস রাজস্ব কর। বাজেটে এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব করের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এটি অর্জন করা দুরূহ হবে। বাজেটের বিষয়ে যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, অর্থায়নের আরেকটি উৎস হচ্ছে বৈদেশিক সহায়তা। বাজেটে ২৮ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বিগত সময়গুলোর অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বৈদেশিক সহায়তা সর্বোচ্চ ১৪ হাজার কোটি টাকা এসেছে। ফলে ১৪ থেকে ২৮ হাজার কোটি টাকা যাওয়ায় একশ’ শতাংশ বাড়বে। কেউ কেউ বলতে পারে ১৯শ’ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক সহায়তা পাইপলাইনে আছে। কিন্তু পাইপলাইনের অর্থ ব্যবহার করতে হলে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে যে প্রশাসনিক দক্ষতা, তা আমাদের নেই। কাজেই এক বছরে একশ’ শতাংশ বাড়ানো এটিও দুরূহ। আমি মনে করি প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থায়নে ঘাটতি হবে।ড. ইসলাম বলেন, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ৮০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা। প্রকৃতপক্ষে বাস্তবায়ন হবে ৫২ থেকে ৫৩ হাজার কোটি টাকার। এ হিসাব থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান যে প্রশাসনিক কাঠামো হয়েছে এবং সক্ষমতা আছে, এক বছরের মধ্যে এমন সক্ষমতা বাড়েনি যে, এডিপি ৫০ শতাংশ বাড়াতে হয়েছে। তিনি বলেন, এই এডিপি বাস্তবায়ন নিয়ে আমি সন্দিহান।
তিনি বলেন, যে কোনো বাজেটে উচ্চাভিলাষ থাকা দরকার। কিন্তু এই উচ্চাভিলাষ যদি বাস্তবভিত্তিক না থাকত, শুধু জনসম্মুখে প্রচারের জন্য একটি বাজেট দিলাম। এটি বাস্তবায়ন না হলে এর গুণগত মান ও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হবে। নতুন বাজেটে উচ্চাভিলাষিতাই প্রাধান্য পেয়েছে, বস্তুনিষ্ঠতা খুব একটা বিবেচনায় আনা হয়নি। যার ফলে এই বাজেট বাস্তবায়ন হবে কঠিন।
ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, ঘাটতি বাজেট বিনিয়োগে আঘাত করবে। বিদেশী সহায়তা যা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন হবে না। ফলে বাজেটে ব্যাংক ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবে আরও বেশি হচ্ছে। সরকার ব্যাংক ঋণ বেশি নিলে সুদের হার বাড়বে এবং প্রাইভেট খাতে ঋণপ্রবাহ কমবে। এতে মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। তিনি জানান, সরকার ২০১০-১১ অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করে। এর ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি বিরাজ করছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ঋণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। সঞ্চয়পত্রে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ এবং ব্যাংক ঋণ ৬ থেকে ৭ শতাংশ সুদ দিতে হয়। বৈদেশিক সহায়তার সুদ ১ শতাংশ দেয়া হয়। ফলে সুদের চাপ বাজেটের ওপর পড়ে। অনুন্নয়ন বাজেটের ২০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সুদের পেছনে। এ ব্যয়ের ৯০ শতাংশ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ও ১০ শতাংশ ব্যয় করা হচ্ছে বৈদেশিক সুদের পেছনে। সুদের পেছনে ব্যয় করার কারণে জনকল্যাণমূলক অন্য কাজের পেছনে ব্যয় সীমিত হয়ে আসে।
‘নতুন বাজেটে রাজস্ব আয় অর্জন দুঃসাধ্য হবে’- মন্তব্য করে ড. ইসলাম বলেন, চলতি বাজেটে কাটছাঁট করে ১২৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছে। সব মিলে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি আয় হতে পারে। এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। রাজস্ব আদায় সার্বিক অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। এ বছর আয়কর আদায় কমেছে। ভ্যাট আদায় কমেছে। সার্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ভালো ছিল না। আগামী অর্থবছরে খুব বড় পরিবর্তন হবে মনে হচ্ছে না। কাজেই চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি অর্জন কঠিন হবে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য কিছু কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ট্যাক্স হলিডের সময় ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে। করের হার কমানো হয়েছে। কিন্তু বাজেটের বাইরে যে নির্ণায়ন বিনিয়োগ তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে যদি অগ্রগতি না হয় তাহলে ট্যাক্স হলিডেসহ অন্যান্য সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির ক্রমাবনতি যদি রোধ করা না যায় তাহলে বিনিয়োগ বাড়বে না।
বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে খুব একটা বিপদসঙ্কুল বলে মনে করেন না ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, বর্তমান মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। বাজেটে কর ব্যবস্থা ও ঘাটতি বাজেট কিভাবে অর্থায়ন করবে তার ওপর নির্ভর করবে মূল্যস্ফীতি। কর ব্যবস্থায় আকার বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এটি দরকার আছে। এর একটি স্বল্পকালীন হলেও প্রভাব পড়বে। এর বাইরে সরকার যদি ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নেয় তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ অর্জন হবে না। চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ১২ শতাংশ জোর করে বাড়ানো হয়েছে। কোনো সূচক দিয়ে আমি প্রমাণ করতে পারিনি আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ শতাংশ অর্জন হবে।
No comments:
Post a Comment