হাইড্রোজেন ও নাপাম বোমা বনাম ফুটবল
এম এ মোমেন
প্রকাশ : ০৬ জুন, ২০১৪
ফুটবল হুলিগানিজমের আতংক যখন চারদিকে স্ট্যানলে রুজ বললেন, হাইড্রোজেন ও নাপাম বোমা যখন গোটা পৃথিবীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে ফুটবল মাঠ হচ্ছে এমন একটি স্থান যেখানে মানুষের আশা ও মানসিক সুস্থতা এখনও ধর্ষণের শিকার হয়নি।
ডাফি ডোহার্থি বললেন, ফুটবল সংস্পর্শের খেলা নয়, সংঘর্ষের। নাচ হচ্ছে সংস্পর্শের খেলা। আমেরিকান নোবেলবিজয়ী
কথা-সাহিত্যিক অস্কার ওয়াইল্ড জানালেন, ফুটবল কঠোর মেয়েদের জন্য চমৎকার একটি খেলা, কোমল ছেলেদের জন্য মোটেও নয়।
অ্যামব্রোস বিয়ার্স লিখেছেন, প্রাচীন যুগের পাঠশালায় নৈতিকতা ও দর্শনের শিক্ষা দেওয়া হতো আর এ যুগের পাঠশালায় দেওয়া হয় ফুটবলের শিক্ষা। হেনরি ব্লাহা রাগবি আর ফুটবলের তুলনা করতে গিয়ে বলেছেন, রাগবি (সকার) হচ্ছে একটি জান্তব খেলা, যা ভদ্রলোকেরা খেলে থাকেন আর আমেরিকান ফুটবল হচ্ছে জন্তুদের খেলা, যা জন্তুরা খেলে থাকে।
কার্ল মার্ক্স যেমন ধর্মকে বলেছেন অপিয়াম অব দ্য মাসেস- জনগণের আফিম, এ কালে ধর্মের চর্চা কমে ফুটবলের চর্চা বেড়ে যাওয়ায় বরং ফুটবলই হয়ে উঠেছে জনগণের আফিম।
হুলিগানিজম বা গুন্ডামি ফুটবলের সঙ্গেই খাপ খায়- ফুটবল হুলিগানিজম। ক্রিকেটে হুলিগানিজম নেই এমনকি রক্তাক্ত মুষ্টিযুদ্ধও হুলিগানিজমের সঙ্গে খাপ খায় না।
গুন্ডামির রোগটার প্রথম দিককার একটি প্রকাশ ১৮৮৫ সালে। প্রেস্টন নর্থ অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব আর্সন ভিলাকে ৫-০ গোলে হারালে লঙ্কাকাণ্ড বেধে যায়। দু’দলের খেলোয়াড় আহত হলেন। আতংকে ভিটেবাড়ি ছাড়া মানুষ। লুটপাট চলল স্টেডিয়ামের চারদিকে। পেরুর রাজধানী লিমায় ১৯৬৪ সালের ফুটবল-দাঙ্গায় নিহত হলেন কমপক্ষে ৩০০ জন, আহতের সংখ্যাও ৫০০-র কম নয়।
ফুটবলের সঙ্গে অসংকোচে জাতীয়তার বিষয়টি আলোচনা করা যায় না। ফুটবল জাতীয়বাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সজ্ঞায় ঠাঁই পায়নি, কিন্তু এটা এতই বাড়াবাড়ি রকমের যে তা ফ্যাসিজমের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। ফুটবল গুন্ডামি বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার মধ্যে বেশি হতে পারে, বাংলাদেশও কিন্তু গুন্ডামিমুক্ত নয়।
অ্যাডোয়ার্ড অ্যালবি বলেছেন, আধুনিক শিল্পনির্ভর সমাজে ফুটবল, সকার ও বাস্কেটবলসহ অন্যান্য আবেগঘেরা খেলার উদ্দেশ্য একঘেয়েমি, হতাশা, রাগ ও প্রচণ্ড ক্রোধ সামাজিকভাবে গ্রহণীয় দ্বন্দ্বে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া। এটা হচ্ছে যুদ্ধের সাময়িক বিকল্প- এই যুদ্ধ জাতীয়তাবাদের জন্য, নিজেদের চেয়ে বড় কিছুর সঙ্গে নিজেদের শনাক্ত করার জন্য।
ফুটবল যে সহিংসতা ও ঘৃণার জন্মদেয় তা যদি বিবেচনায় আনা হয় এরমা বোমবেক মনে করেন, একজন মানুষ যদি পরপর তিনটি ফুটবল ম্যাচ দেখে ফেলেন, তাকে আইনগতভাবে মৃত ঘোষণা করা উচিত। ফ্রাঙ্ক গিলফোর্ড বলেছেন, ফুটবলমুখীনতা আণবিক যুদ্ধের মতোই- এখানে কেউ বিজয়ী নেই, আছে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ। বিল শ্যাঙ্কলে মজা করে বলেছেন, অনেকেই মনে করেন ফুটবল আসলে জীবনমৃত্যুর মতোই একটি বিষয়; আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি ফুটবল তার চেয়েও বেশি।
আলবেয়র কামু বলেছেন, নৈতিকতার শিক্ষা তিনি ফুটবলের কাছে পেয়েছেন। এর জবাবে ওরহান পামুক বলেছেন, ফুটবল আর যাই শেখাক নৈতিকতা শেখাতে পারে না। মার্ভলেভি সঙ্গে যোগ করেছেন, ফুটবল চরিত্র গঠন করে না, চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ করে দেয়। একজন অজ্ঞাতনামা লেখক ফুটবল খেলার একটি প্রেসক্রিপশন দিয়েছেন : তোমার মাকে খুন করলে তোমার মনে যে ক্রোধ আর জিঘাংসার সৃষ্টি হবে তা নিয়েই তোমাকে ফুটবল মাঠে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হবে।
আলফ্রেড হিচকক বিপ্লবীদের ঠাট্টা করতেই সম্ভবত বলেছেন : ফুটবল আর বিপ্লবের মধ্যে অনেক তফাৎ। ফুটবল বিপ্লবের চেয়ে বেশি সময় টিকে থাকে আর অংশগ্রহণকারীরা ইউনিফর্ম পরে।
হের্ডড ব্রাউন বলেছেন, জেলখানায় যাওয়ার ভয় নেই, তোমার সব আগ্রাসি কর্মকাণ্ড ফুটবল মাঠে চালিয়ে যাও। পুরুষ মানুষের ফুটবল আসক্তি দেখে রজার সিমন বলেছেন, ঈশ্বর যদি সত্যিই চাইতেন নারী তার পুরুষকে বুঝুক তাহলে ফুটবল কখনও আবিষ্কার হতো না।
অজ্ঞাত একজন লেখক ফুটবল লড়াইয়ের মূল কারণটি আবিষ্কার করেছেন : ২২ জন খেলোয়াড়ের জন্য মাত্র একটি বল হবে কেন? প্রত্যেককে একটি করে বল দিয়ে দাও, বলের জন্য মরামারি থেমে যাবে।
ফুটবল কোচ ভিন্স বোমবার্দির মৃত্যুর পর তাকে শ্রদ্ধা জানাতে ফুটবলার হেনরি জর্ডান মন্তব্য করেন : তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ। আমাদের সবার সঙ্গে তার ছিল একই আচরণ- কুকুরের মতো।
আলবেয়র কামু আলজেরীয় জাতীয় দলের গোলরক্ষক ছিলেন বলে বাড়াবাড়ি ধরনের একটি প্রচারণা রয়েছে। তিনি আসলে আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় জুনিয়ার্স দলের গোলরক্ষক ছিলেন, তাও দীর্ঘসময় নয়। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হলে তাও থেমে যায়। জ্যা পল সার্ত্রে, আর্থার কোনান ডয়েল, অ্যান্থনি বার্জেন্স, জর্জ অরওয়েল, সালমান রুশদী, জুলিয়ান বার্নস কেউই এমনকি মাঝারি মাপের ফুটবলারও ছিলেন না, ফুটবল নিয়ে একটি-দুটি মন্তব্য করেছেন এই যা। মার্কিন লেখকরা ফুটবল নিয়ে যা বলেছেন বলে উদ্ধৃত হচ্ছে তার অধিকাংশই মূলত আমেরিকান ফুটবল নিয়ে- যাতে হাত-পা-কাঁধ সবই ব্যবহার করা যায়। আমেরিকান ফুটবলের যে কোনো স্বাভাবিক বিষয় ফিফা অনুমোদিত ফুটবলে রেফারিকে নিদেনপক্ষে ফাউল ঘোষণা করতে হতো। তারপর হলুদ কার্ড এবং এমনকি লাল কার্ডও দেখাতে হতো।
বিশ্বকাপে পা ও মাথার সঙ্গে হাতের ব্যবহারের নজিরও আছে। ১৯৮৬-তে মেক্সিকোতে বিশ্বকাপের প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা মাথার উপর দিয়ে ছুটে যাওয়া একটি বলের উপর হাত চালিয়ে প্রতিপক্ষের জালে ঢুকিয়ে দিলেন। কথা ছিল হ্যান্ডবল হওয়ার, কিন্তু রেফারি গোলের বাঁশি বাজিয়ে দিলেন। ম্যারাডোনাকে জিজ্ঞেস করা হলে বললেন, ওটা ঈশ্বরের হাত!
ওরহান পামুক বলেছেন, ফুটবল শব্দের চেয়েও দ্রুতগামী। তিনি আরও বলেছেন, একটি জাতির ফুটবল আচরণ সে জাতিকে ব্যাখ্যা করে। সাবেক পর্তুগিজ স্বৈরশাসক (আন্তনিও) সানাজার তার শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ফুটবলকে ব্যবহার করতেন। তিনি মনে করতেন ফুটবল জনগণের আফিম- এটাই শান্তি রক্ষার পথ। আমাদের দেশে যদি তেমনটা হতো ভালোই ছিল। কিন্তু এখানে ফুটবল আফিম নয়, বরং জাতীয়তাবাদ উৎপাদনের একটি মাধ্যম, যা অন্যদেশীয়দের ঘৃণা করার একচ্ছত্রবাদী চিন্তার উৎস। আমি আরও মনে করি, ফুটবলে বিজয় নয়, বরং পরাজয়ই জাতীয়তাবাদকে উস্কে দেয়। ভূমিকম্প থেকে হোক কি যুদ্ধে পরাজয় থেকে হোক জাতীয়তাবাদের উদ্ভব হয় বিপর্যয় থেকে। তলস্তয় বলেছেন, নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে রাশিয়ার চাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ৮-০ গোলে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজয় তুরস্কের জন্য তেমনি একটি বিপর্যয়। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকেই বিজয়ী দেশ শত্র“দেশে পরিণত হয়।
আচরণের প্রশ্নে খেলোয়াড়ের উগ্রতাকে তুচ্ছ করে এগোয় সমর্থকের উগ্রতা। খেলোয়াড়কে দমিয়ে রাখার জন্য হলুদ আর লাল কার্ড আছে, কিন্তু উগ্র দর্শক দমাবেন কেমন করে?
৩১ মে, ১৯৭০ বিশ্বকাপের প্রথম পর্বের মেক্সিকো বনাম ডিএসএসআর খেলায় রুশ খেলোয়াড় লোভচেভকে বিশ্বকাপের প্রথম হলুদ কার্ডটি দেখানো হয়। আর বিশ্বকাপের প্রথম লালকার্ড দেখানো হয় জার্মানিতে ১৯৭৪-এ চিলির কার্লোস ক্যাসলেকে।
সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বকাপ জ্বর এখন গোটা বিশ্বকেই পেয়ে বসেছে। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা তো থাকছে আরও ক’টি দেশের পতাকায় ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। বাংলাদেশের পতাকাও উড়বে এটুকু আশাবাদ না থাকলেই নয়।
No comments:
Post a Comment