Thursday, June 5, 2014

অদ্ভুত দাঁড়কাক ॥ ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’-এর লেখক ড্যান ব্রাউন

অদ্ভুত দাঁড়কাক ॥ ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’-এর লেখক ড্যান ব্রাউন
মোঃ আরিফুর রহমান
বর্তমান জামানায় অতি পরিচিত একটি নাম ড্যান ব্রাউন। লিখেছেন হাতেগোনা কয়েকটি বই। কিন্তু জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। থ্রিলারধর্মী বইগুলোতে এনেছেন অভিনত্ব। আর সেই অভিনবত্বই তাঁকে বেস্ট সেলিং থ্রিলার লেখকের মর্যাদা এনে দেয়। তাঁর থ্রিলারের অভিনবত্বই হলো এ্যাকশনধর্মিতার পরিবর্তে কোডস ব্রেকিং, সংকেত উদ্ধার, গুপ্ত সংগঠন ও তাদের কার্যক্রমসহ অনেক দুর্বোধ্য বিষয়ের রহস্যে উন্মোচন। রহস্যের অনুসন্ধানের পিছনেই যেন ঘুরঘুর করতে থাকে তার থ্রিলারগুলো। এছাড়া তিনি ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞানকে একসুতোয় নিয়ে এসেছেন থ্রিলারে।
তাঁর রচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু সিম্বল। সিম্বলিক জটের সমাধানই বইগুলোর উপজীব্য হয়ে ওঠে। লেখায় অনবরত দৃশ্যমানের সঙ্গে অদৃশ্যমানের খেলা চলতে থাকে। লিখতে গিয়ে ব্রাউন যেন ধর্ম আর বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব খেলায় মেতে ওঠেন। আর সেই খেলায় দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বাস্তবতার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার এক চমৎকার মিশেলে তাঁর লেখাগুলো হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত। হয়ে ওঠে অনবদ্য এক একটি থ্রিলার।
ব্রাউন তাঁর বইগুলোতে খ্রীস্ট ধর্মের অনেক গোপন কথা তুলে ধরেন। অনেক ঐতিহাসিক সত্যকে গল্পের ঢংয়ে হাজির করেন পাঠকের সামনে। গুপ্ত সংগঠনগুলোর গোপন ক্রিয়া-কর্ম, ষড়যন্ত্র, হত্যার মধ্যে দিয়ে তিনি পাঠককে ঐতিহাসিক সত্যর কাছাকাছি নিয়ে যান। রবার্ট ল্যাঙডন চরিত্রটিই এই নিয়ে যাওয়ার কাজটি করে থাকে। ধর্মতত্ত্ব আর ইতিহাসের মারপ্যাঁচের একঘেয়েমির হাত থেকে তিনি পাঠককে উদ্ধার করেন কোডব্রেকিং, সিম্বলিক সমস্যার জট খোলার মধ্যে দিয়ে। তাঁর সফলতা উপস্থাপনার ভঙ্গিতে। তিনি এমনভাবে সিম্বলিক জটগুলোকে পাঠকের সামনে হাজির করেন যে, পাঠক নিজেই যেন বসে যান রহস্যের জট খুলতে। তাঁর সফলতা এখানেই।
২০০৩ সালে দ্য ডা ভিঞ্চি কোড উপন্যাসটির মধ্যে দিয়ে তিনি খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করেন। এছাড়া লেখেন ডিজিটাল ফোরট্রেস, ডিসেপশন পয়েন্ট, এ্যাঞ্জেলস এ্যান্ড ডেমোনস, দ্য লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো নামক থ্রিলার। এই প্রতিটি বই বেস্ট সেলারের মর্যাদা অর্জন করে। এই বইগুলোর পাঠকপ্রিয়তা একদিকে ড্যান ব্রাউনকে বিখ্যাত করে তোলে, আর অন্যদিকে নিয়ে আসে প্রচুর টাকা কড়ি। তার বইগুলো অনূদিত হয়েছে বিশ্বের প্রায় বায়ান্নটি ভাষায়। বিক্রয় হয়েছে দু’শ’ মিলিয়নেরও বেশি কপি। এই সংখ্যাটি যেকোন লেখকের কাছেই পরম পাওয়া, পরম সাফল্য।
পরম সাফল্য অর্জনকারী এই লেখক আমেরিকার নিউ হ্যাম্পাশায়ারের ফিলিপস এক্সটার একাডেমিতে ২২ জুন, ১৯৬৪ তে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রিচার্ড জে ব্রাউন ঐ একাডেমির বিখ্যাত গণিত শিক্ষক। সেই সুবাদেই তাঁর বেড়ে ওঠা ফিলিপস এক্সটার একাডেমির চৌহদ্দির মধ্যে। বাবা-মা দুজনেই সঙ্গীত শিল্পীও ছিলেন। মা চার্চে অর্গান বাজাতেন।
সেই ছোট্ট বয়সে তিন ভাইবোন মায়ের সঙ্গে চার্চে গিয়ে ঐকতান সঙ্গীত গাইতেন। চার্চের পরিবেশে ব্রাউনের বেড়ে ওঠা। ধম্ম কম্মের নানান বিষয় পরবর্তীতে তাঁর লেখনীকে প্রভাবিত করে। এক্সটার একাডেমিতে তিনি ধর্ম আর বিজ্ঞানের আপাতবিরোধী পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখেন যা পরবর্তীতে তার লেখনীকে প্রভাবিত করে।
শৈশব থেকেই তাঁর নানা রকম পাজল, ক্রসওয়ার্ড সমাধানের প্রতি ঝোঁক ছিল। এ্যানাগ্রাম আর ক্রসওয়ার্ড পাজলের সমাধান করতে করতে কাটিয়ে দিতেন অনেকটা সময়। ছুটির দিনে বাবা তাদের তিন ভাই-বোনকে নিয়ে ট্রেজার হান্ট খেলতেন। কাগজে লেখা সংকেতসূত্র ধরে গিফট আইটেম খুঁজতে যেত নিজের বাড়ির আশপাশ, এমনকি শহরের আশপাশেও। ছোট্ট বেলার সেই ট্রেজার হান্ট খেলা তাঁর লেখনীকে পরবর্তীতে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
ড্যান ব্রাউন ফিলিপ এক্সটারের লেখাপড়া শেষ করে আর্মহেস্ট কলেজে যোগদান করেন। সেই সময় তিনি সাঁই আপসাইলন নামক ভ্রাতৃসংঘের সদস্য হোন। এই সদস্য থাকাটা তাঁর মাঝে বিভিন্ন সংঘ সম্পকে ধারণা সৃষ্টি করেছিল। ঐ সময়টাতে স্কোয়াশ খেলা আর আর্মহেস্ট গ্লি ক্লাবে গান গাওয়া তাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। ঐ আর্মহেস্ট কলেজে থাকাকালীন সময়ই তিনি ঔপন্যাসিক এ্যালান লেলচাকের সহযোগী হিসেবে তাঁর লেখালেখিতে সহযোগিতা করেন। বাইশ বছর বয়সে ব্রাউন স্নœাতক সম্পন্ন করে সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার চিন্তা করেন। প্রথমেই বের করেন শিশুতোষ ক্যাসেট সিন্থ এ্যানিমেলস। এই ক্যাসেটটির মাত্র কয়েক শ’ কপি বিক্রি হয়। এরপর একে একে তিনি হ্যাপী ফ্রগস, সুজুকি এলিফ্যান্টস ক্যাসেট বের করেন। ঐগুলোও কয়েক শ’ কপি বিক্রি হয়। নব্বই সালের দিকে তিনি নিজের রেকর্ড কোম্পানি ডেলিয়্যান্স প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ কোম্পানি থেকে প্রকাশ করেন র্পাসপেকটিভ নামক গানের ক্যাসেট। এটিও ব্যর্থ হয়। পরপর এতগুলো গানের ক্যাসেট ব্যর্থ হলেও তিনি হতাশ না হয়ে সঙ্গীতকেই ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ার স্বপ্ন দেখেন। আর তাই একানব্বইতে তিনি হলিউডে যান সঙ্গীত শিল্পী, সঙ্গীত লেখক ও পিয়নিস্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য। ঐ সময়টাতে তাঁকে বেশ আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। তিনি সঙ্গীতের পাশাপাশি বেভারলী হিলস প্রিপারেটরি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
মাঝে মাঝে হতাশা ব্রাউনকে আকড়ে ধরত। কিন্তু সেই দুর্দশাগ্রস্ত সময়টাতেই পরিচয় হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সংগরাইটারসের ডিরেক্টর ব্লিথ নিউলনের সঙ্গে। ব্লিথ ব্রাউনের মাঝে প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন। বুঝেছিলেন এই তরুণের মাঝে সুপ্ত হয়ে আছে প্রতিভা। সেটাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। তাই ব্লিথ ভরসা দিতেন ব্রাউনকে, স্বপ্ন দেখাতেন। এক ছুটির দিনে ব্রাউন সিডনি শেলডনের উপন্যাস দ্য ডুমস ডে কন্সপাইরেসি পড়তে গিয়ে নিজের মধ্যে লেখালেখির অনুপ্রেরণা খুঁজে পান। ব্লিথ তাকে উৎসাহ দেন লেখালেখির ব্যাপারে। দু’জনে মিলে লিখে ফেলেন হাস্যরসাত্মক বই ‘১৮৭ ম্যান টু এ্যাভেয়ড : এ সার্ভাইভাল গাইড ফর দ্য রোমান্টিক্যালি ফ্রাস্টেড ঔম্যান।’ এই বইটিতে তিনি ড্যানিয়েল ব্রাউন ছদ্মনামে লেখেন।
একটা সময় সখ্য, প্রেম-ভালবাসায় পরিণত হয়। ব্লিথ তাঁর থেকে বারো বছর বড় হলেও এটি তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি। তারা দুজনে ১৯৯৭ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্রাউনের ক্যারিয়ারের সফলতার জন্য ব্লিথের চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। ব্রাউন লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার জন্য শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের একবছর পর লেখেন ডিজিটাল ফোট্রেস নামক একটি থ্রিলারধর্মী বই। বইটির প্রচার, প্রসারের জন্য তার স্ত্রী অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু বইটি তেমন কাটতি লাভ করেনি। ঐ বছরই কয়েক মাস পর তিনি আর তাঁর স্ত্রী মিলে আরেকটি হিউমার বই ‘দ্য বাল্ড বুক’ প্রকাশ করেন। এই বইটিও যথারীতি ফ্লপ।
২০০০ সালে ড্যান ব্রাউন লেখেন ‘এঞ্জেলস এ্যান্ড ডেমোনস’ বইটি। আর তারপরের বছর প্রকাশিত হয় ‘ডিসেপশন পয়েন্ট’ বইটি। দুটি হিউমার বইয়ের মতো এই তিনটি থ্রিলার বই সফলতার মুখ দেখেনি সেই সময়টাতে। বইগুলো মাত্র দশ হাজারের মতো কপি বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু তাঁর থ্রিলারধর্মী চতুর্থ বই ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’( ২০০৩) প্রকাশ হওয়ার পরপরই বইটি বেস্ট সেলার হয়। বইটি বিশ্বজুড়ে ৮১ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়। এই বইটি থেকে তাঁর আয় হয় আড়াই শ’ মিলিয়নেরও বেশি ডলার।
এই বইটির জনপ্রিয়তা পাঠককে তাঁর রচিত অন্যান্য বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করে। হু হু করে আগের লেখা বইগুলোও বিক্রি হতে থাকে। একই সঙ্গে তাঁর থ্রিলারধর্মী চারটি বই ২০০৪ সালে নিউইর্য়ক টাইমসের বেস্ট সেলার বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই বইগুলোর সফলতা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। সেইসঙ্গে আসতে থাকে প্রচুর অর্থ। বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্ষমতাও। ২০০৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের এক শ’জন প্রভাবশালীর তালিকায় ড্যান ব্রাউন স্থান পায়। সেই বছরই ফোর্বস ম্যাগাজিনের সেলিব্রেটির তালিকায় ড্যান ব্রাউনের স্থান হয় ১২তম।
‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রায় ছয় বছর তাঁর কোন বই প্রকাশিত হয়নি। দীর্ঘ সময় পর ২০০৯ সালে তিনি হাজির হন ‘লস্ট সিম্বল’ বইটি নিয়ে। বইটি প্রকাশের প্রথম দিনই এক মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হয়। প্রথম সংস্করণে পাঁচ মিলিয়নের বেশি কপি বই বিক্রি হয়ে যায়। এরপর আবার চারবছর পর পাঠক পায় ‘ইনফার্নো’ বইটি। এটিও যথারীতি বেস্ট সেলার হয়।
ড্যান ব্রাউন লেখালেখির অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন সিডনি শেলডনের লেখা পড়ে। কিন্তু সিডনি শেলডন ছাড়াও অন্যান্য অনেক লেখকের লেখাও তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। বিশেষ করে ছয়জনের বই দ্বারা তিনি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হন। তারা হলেন ডগলাস হফসটেডরের ‘গোডেল, ইশ্বচার, ব্যাচ’ বইটি, ফ্রেড রিক্সনের ‘কোডস সাইফারস এ্যান্ড আদার ক্রিপটিক’ এবং ‘ক্লান্ডেস্টাইন কমিউনিকেশন’, জন স্টেইনব্যাকের ‘অফ মাইস এ্যান্ড ম্যান’, জন ল্যাঙ্গডনের ‘ওয়ার্ডপ্লে : এ্যাম্বিগ্রামস রিফ্লেকশনস অন দ্য আর্ট অব এ্যাম্বিগ্রামস’ এবং শেক্সপীয়রের ‘মাচ এ্যাডো এ্যাবাউট নাথিং’ এবং জেমস ব্যামফোর্ডের ‘দ্য পাজল প্যালেস’ বইটি। একজন লেখকের নাম এখনও বলা হয়নি। তিনি হচ্ছেন দান্তে। তাঁর ডিভাইন কমেডি বইটির প্রভাব বেশ ভালভাবেই দেখা যায় ইনফার্নো বইটিতে।
ড্যান ব্রাউনের বইগুলোর মধ্যে এ্যাঞ্জেলস এ্যান্ড ডেমোনস, দ্য ভিঞ্চি কোড, দ্য লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো এই চারটি বইয়েরই প্রধান চরিত্র রবার্ট ল্যাঙডন। এক সাক্ষাতকারে ব্রাউন ল্যাঙডনকে নিয়ে আরও বারোটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন। ব্রাউনের বইয়ের চরিত্রগুলো মূলত তার জীবন থেকেই নেয়া। রবার্ট ল্যাঙডন চরিত্রটি জন ল্যাঙডন নামক একজন আর্টিস্টের নাম অনুসারে। এই আর্টিস্ট ব্রাউনের এ্যাঞ্জেলস এ্যান্ড ডেমোনস সিডির এমবিগ্রাম করেছিল। এছাড়াও তাঁর বইয়ের বিভিন্ন চরিত্র তার বাস্তব জীবন থেকেই নেয়া।
ব্রাউনের লেখা প্রথম থ্রিলার বই হলো ‘ডিজিটাল ফোরট্রেস।’ বইটির মূল উপজীব্য হলো সরকার কর্তৃক মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের উপর ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে নজরদারি করা। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা চলে ‘ব্যক্তিগত জীবনের ওপর আড়িপাতা।’ আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এক দুর্বোধ্য কোডের সম্মুখীন হয়। ডিজিটাল ফোরট্রেস নামক এক জটিল কোড ভাঙতে পারে না কোড ব্রেকিং সুপার কম্পিউটারও। দায়িত্ব দেয়া হয় ক্রিপ্টোগ্রাফার সুসান ফ্লেচারকে। সুসান অনেক চেষ্টায় ভাঙ্গে সেই কোড। কোডের সংকেতে যে ভয়াবহতার ছাপ লুকিয়ে আছে তা দেখে কেঁপে ওঠে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি। কোডটি লিখেছে এনসেই তানকেডো নামক ঐ সংস্থার একজন প্রাক্তন কর্মচারী। সে ঐ সংস্থাটির গোপন নজরদারির বিষয়টি পছন্দ করত না। ঐ কোডটির মাধ্যমে ঐ সংস্থাটিকে জিম্মি করা হয়েছে। ডিজিটাল ফোরট্রেস নামক এই কোডটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সুসান ফ্লেচার আর তার বাগদত্তা ডেভিড বেকার নেমে পড়ে এই কোডের রহস্যে উদ্ধারে। কোড ব্রেকিং আর রহস্যের সমাধানের জটিলতার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় ডিজিটাল ফোরট্রেস বইটির কাহিনী।
এঞ্জেলস এ্যান্ড ডেমন্স বইটি প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। এই উপন্যাসের মূল চরিত্র রবার্ট ল্যাঙডন। একজন বিজ্ঞানী খুন হলে তার বুকে পাওয়া যায় সাংকেতিক লেখাসমৃদ্ধ একটি কাগজ। সেই লেখার পাঠোদ্ধার করে বিশ্বখ্যাত সিম্বলজিস্ট রবার্ট ল্যাঙডন। পাঠোদ্ধার করে শঙ্কিত হয়ে পড়ে ল্যাঙডন। শুধু বিজ্ঞানীই নয়,আরও চারজন কার্ডিনাল সদস্য খুন হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেকের বুকেই পাওয়া যায় সেই সংকেত খচিত কাগজ। সেই লেখার পাঠোদ্ধারে ল্যাঙডন জানতে পারে ইলুমিনিটি নামক ভাতৃসংঘের ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা। এরা ক্যাথলিক চার্চকে উড়িয়ে দিতে চায়। ভ্যাটিকান সিটিকে ধ্বংসের জন্য নব্য আবিষ্কৃত এন্টিম্যাটার ব্যবহারের পরিকল্পনা করে ইলুমিনিটির সদস্যরা। রবার্ট ল্যাঙডন আর আর সুন্দরী পর্দাথবিদ-জীববিজ্ঞানী ভিক্টোরিয়া ভেট্টা ভ্যাটিকানকে রক্ষার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় রোমে। এ্যান্টিমেটারটি উদ্ধার করার জন্য ল্যাঙডন চষে বেড়ায় পুরো রোমসহ পুরো ভ্যাটিকান সিটি। ভ্যাটিকান সিটির পরিত্যক্ত ক্যাথেড্রাল, বদ্ধ কবরখানা, বড় বড় গির্জার আনাচে কানাচে খুঁজতে খুঁজতে একটা সময় তারা খুঁজে পায় পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন ভল্টটি। খুঁজে পায় ইলুমিনিটির গোপন মিটিংয়ের স্থান। ক্যাথলিক চার্চকে রক্ষার জন্য ল্যাঙডন আর ভেট্টার এ্যাডভেঞ্চার নিয়েই বইটির কাহিনী এগিয়ে গেছে। এই বইটির কাহিনীকে নিয়ে ফিল্মও তৈরি করা হয়েছে।
ড্যান ব্রাউনের ‘ডিসেপশন পয়েন্ট’ বইটি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। এই বইটির কাহিনী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতে রচিত হয়। আর্কটিক সার্কেলে একটি উল্কার পতন ঘটে। সেই পতনই প্রমাণ করে পৃথিবীর বাইরেও জীবন আছে। কিন্তু এই তথ্য প্রকাশ পেলে কারও কারও রাজনীতি হুমকির মুখ পড়ে যাবে। তাই এই তথ্য জনসমক্ষে না আনার চেষ্টা করে ষড়যন্ত্রকারীরা। একের পর এক খুন হতে থাকে। আর্কটিক সার্কেলে উল্কার পতনের ঘটনা অনুসন্ধান করতে ইন্টেলিজেন্স এনালিস্ট র‌্যাচেল সেক্সটনকে আর আরও চারজন নাসার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সেখানে পাঠান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। নাসা প্রমাণ করে পৃথিবীর বাইরেও প্রাণ আছে। কিন্তু কেউ একজন চায় না নাসা সফল হোক। শুরু হয় ষড়যন্ত্র। দৃষ্টি চলে যায় র‌্যাচেলের বাবা সিনেটর সেজউইক সেক্সটনের দিকে। সে একজন প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যান্ডিডেট। সেক্সটন চেয়েছে নাসাকে বিলুপ্ত করে সেই অর্থ পাবলিক স্কুলে ব্যয় করতে। নাসার ব্যর্থতাকে তিনি তাঁর ক্যাম্পেইনে কাজে লাগাতে চান। আর অন্যদিকে এই আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে নাসা তাদের ব্যর্থতার গ্লানি মুছে দিতে চায়। সন্দেহ, পাল্টা সন্দেহ, রাজনীতির মারপ্যাঁচের মধ্যে দিয়ে ডিসেপশন পয়েন্ট বইটির কাহিনী এগিয়ে যায়।
ড্যান ব্রাউন যে বইয়ের জন্য জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন সেই বইটি ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড।’ এই বইটিতে রবার্ট ল্যাঙডনকে দ্বিতীয়বারের মতো হাজির করা হয়। রবার্ট ল্যাঙডন আর তার সঙ্গী ক্রিপ্টোলজিস্ট সোফিই নেভিউ প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে একটি খুনের তদন্ত করতে গিয়ে খুঁেজ পায় প্রায়রি অব সিয়ন আর অপাস ডাই এর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্ব ম্যারি মাগদালিনকে নিয়ে। খ্রীস্টান ধর্মের ইতিহাসে ম্যারি মাগদালিনের ভূমিকা এবং হলিগ্রেইল সম্পর্কিত বিষয়ের আলোকেই বইটির কাহিনী ডালপালা মেলেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এক সত্যকে চিরতরে নিমূর্ল করার জন্য প্যারিসে একই দিনে হত্যা করা হয় চারজন বিখ্যাত ব্যক্তিকে। হত্যা করা হয় ধর্মের ভিত নড়ে যাবে বলে। সিক্রেট সোসাইটি সেই সত্যটি হাজার বছর ধরে সঙ্গোপনে লালন করে আসছিল। সেই সিক্রেট সোসাইটির সদস্য ছিলেন আইজ্যাক নিউটন, ভিক্টর হুগো, বত্তিচেল্লি, লিওনার্দো ডা ভিঞ্চির মতো মানুষেরাও। উগ্র ক্যাথলিক সংগঠন ওপাস দাঁই সেই অতি গোপন সত্যকে সংঘের বাইরের একজনের কাছে ফাঁস করে দেয়। সেই সত্যেকে খুঁজে পান রবার্ট ল্যাঙডন। জেসাস ক্রাইস্ট ম্যারি ম্যাগদালেনকে বিয়ে করেছেন এই সত্যটি কোড ব্রেকিং আর অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে ল্যাঙডনের কাছে ধরা দেয়। সেই সঙ্গে ধরা দেয় ভয়ঙ্কর বিপদ। ধর্ম, কোডব্রেকিং, সিক্রেটস সোসাইটির ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বাস্তব-অবাস্তব, ধর্ম-বিজ্ঞানের অপূর্ব এক সমন্বয়ে রচিত এই বই। এই বইটি নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি।
২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘দ্য লস্ট সিম্বল’ বইটি। বইটির কাহিনী বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিক্রেট সোসাইটি ফ্রীম্যাসন হাজার হাজার বছর ধরে এক সিক্রেট জ্ঞান পালন করে আসছিল। সেই জ্ঞান ভুল কারও হাতে পড়লে অপরিমেয় ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এমন সময়ই সিম্বলিস্ট রবার্ট ল্যাঙডন ক্যাপিটাল বিল্ডিং-এ পাঁচটি সিম্বলযুক্ত একটি বস্তু আবিষ্কার করেন যা আসলে প্রাচীন গুপ্তসংঘে আহ্বানের প্রতীক। সেই সিম্বলই তাঁকে তার বন্ধু পিটার সলোমনসকে খুঁজে পেতে সহায়তা করে। পিটারকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। ল্যাঙডন বুঝতে পারে বন্ধুকে বাঁচাতে হলে রহস্যময় প্রতীকটি কি নির্দেশ করছে তার সমাধান বের করতে হবে। সিম্বলের সূত্র ধরেই ল্যাঙডন বন্ধুকে উদ্ধার করতে যায়। আর সেই সময়ই বাইবেলের এক গুপ্ত কথনের খোঁজ পায় ল্যাঙডন। এই বইটিও বেস্ট সেলারের মর্যাদা পায়।
গতবছর ড্যান ব্রাউন পাঠকের সামনে হাজির হয়েছেন ‘ইনফার্নো’ বইটির মাধ্যমে। এই বইটিরও মূল চরিত্র রবার্ট ল্যাঙডন। এবার সে ফ্লোরেন্সে। এক উন্মাদ বিজ্ঞানী চাচ্ছে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে মেরে ফেলতে। কারণ তার ধারণা আগামী এক শ’ বছরের মধ্যে মানব প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই বিলুপ্তির কারণ হিসেবে উন্মাদ বিজ্ঞানী জনসংখ্যা বিস্ফোরণকে দায়ী করছেন। তার ধারণা, অর্ধেক মানুষকে না মেরে ফেললে পৃথিবী একটা সময় নরককু- হয়ে পড়বে। তাই পৃথিবীকে রক্ষার উদ্দেশ্যে পাগলা এই বিজ্ঞানী ভয়াবহ এক মহামারীর জীবাণু ছড়িয়ে দেয়ার সব আয়োজন শেষ করে। আর নিজে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। জীবাণুগুলোকে সে টাইম বোমার মতোই সেট করে রাখে বাক্সে। একটি নির্দিষ্ট সময় পড়ে বাক্স থেকে জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়বে। জীবাণুগুলো ছড়িয়ে পড়ার আগেই ল্যাঙডন খুঁজছে বাক্সটা। সঙ্গে আছে সুন্দরী সিয়েনা। এই দু’জনের জীবাণুর বাক্সটি অনুসন্ধানের এ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে দিয়ে ‘ইনফার্নো’ বইটির কাহিনী এগিয়ে গেছে। এই বইটিও নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার হয়।
আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অধিকারী ড্যান ব্রাউনকে জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে আইনী লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে অনেক সমালোচনা। ২০০৫ সালে লিউস পার্ডিও ড্যান ব্রাউনের বিরুদ্ধে দ্য ভিঞ্চি কোড বইটির বিরুদ্ধে প্লেগারিজম আইনে মামলা করেন। তিনি দাবি করেছিলেন, তার দি ডা ভিঞ্চি লিগ্যাসি (১৯৮৩) এবং ডটার অব গড (২০০০) বই থেকে ধার নিয়ে দ্য ডা ভিঞ্চি কোড লেখা হয়েছে। কিন্তু তার এই মামলা ধোপে টিকেনি। মামলায় জয়ী হন ড্যান ব্রাউন। এরপর মাইকেল বেইগেন্ট এবং রিচার্ড লাই কপিরাইট আইনে ব্রাউনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। তাদের দাবি ছিল, দ্য ভিঞ্চি কোড বইটি তাদের ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হলি ব্লাড হলি গ্রেইল থেকে নকল করা। এই মামলাতেও ব্রাউন জয় লাভ করে।
আইনী লড়াইয়ে জিতেও সমালোচকদের মুখ থামাতে পারেননি তিনি। তাঁর কোন বই প্রকাশ হওয়া মানেই সমালোচকরা নতুন করে সমালোচনা করার ঝাঁপি খুলে বসে। সমালোচকরা সবসময়ই বলে বেড়ান ড্যান ব্রাউনের লেখা জবরজং। একই কাহিনীর অর্থহীন পুনরাবৃত্তি ঘটে তাঁর লেখায়। তার লেখাগুলো গুপ্ত রহস্যের বাইরে বের হতে পারে না। সালমান রুশদী ব্রাউনের সমালোচনা করে বলেন, ‘দ্য ভিঞ্চি কোড বইটি খুবই নিম্নœমানের কিন্তু একে ভালভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ আমেরিকার গ্রামারিয়ান মার্ক লিবারমেন ব্রাউনকে ‘সাহিত্যের ইতিহাসে খারাপ স্টাইলিস্টদের অন্যতম’ বলে অভিহিত করেন। এছাড়া ক্যাথলিকরা ব্রাউনকে ব্লাসফেমির দায়ে অভিযুক্ত করেন। তাদের অভিযোগ, ব্রাউন তাদের বিশ্বাসকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ‘দ্য ডা ভিঞ্চি কোড’ প্রকাশিত হওয়ার পর ভ্যাটিকান সিটি তাঁকে তিরস্কার করেছিল। ড্যান ব্রাউনকে এইসব সমালোচনা, এতসব প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি, পারছেও না। এই বিষয়ে ড্যান ব্রাউন নিজে বলেন, ‘অনেকেই সমালোচনা করছেন, তবে আমি সন্তুষ্ট এই কারণে যে, বাইবেল বেত্তা আর ইতিহাসবিদরা যতই যুদ্ধ করুক না কেন, গোপন ধর্মীয় ইতিহাস, গুপ্ত সংঘ, কোড ব্রেকিং নিয়ে আমার লেখা বইগুলো মানুষ পছন্দ করেছে।’ এই বিষয়টিই তাঁকে আরও বেশি করে লেখায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি জানেন,পাঠকরা তার সঙ্গে আছেন। থাকবেও।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=37&dd=2014-06-06&ni=175149

No comments:

Post a Comment