Thursday, June 26, 2014

বছরে ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে প্রতি পাতে বিষ ৩

বছরে ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে
প্রতি পাতে বিষ ৩
রশিদ মামুন ॥ উত্তরের জেলা দিনাজপুরে ২০১২ সালের জুনে বিষাক্ত লিচু খেয়ে মারা গল ১৪ শিশু। মূলত কীটনাশকের বিষক্রিয়ার শিকার হয় ওই সব শিশু। এর আগে ২০০৯ সালে রিড ফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপ কেড়ে নেয় ২৪ শিশুর প্রাণ। একই বছর ধামরাইতে কীটনাশক মেশানো সবজি খেয়ে কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে। এর ঠিক আগের বছর ২০০৮-এ নওগাঁয় একই কারণে আরও কয়েকজনের প্রাণ যায়। কীটনাশক আর রিডফার্মার প্যারাসিটামল সিরাপের ডাই ইথানল গ্লাইকল তাৎক্ষণিক প্রাণঘাতী হলেও সেøা পয়জন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে প্রতিদিনের খাদ্যকে। কিন্তু উৎপাদন থেকে সরবরাহ কোন জায়গাতে বিষাক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রণের যথেষ্ট উদ্যোগ নেই।
থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন তাঁদের হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া অর্ধেক রোগী বাংলাদেশী, এদের বেশিরভাগ লিভার, কিডনি ও প্রজনন সমস্যায় ভোগেন। এসব সমস্যার উদ্ভব হয় খাদ্যের ভেজাল ও বিষ থেকে। টিআইবি গত মার্চে প্রকাশিত নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ, সুশাসনের জন্য চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক এক গবেষণায় এ কথা বলছে।
বিশ্বখাদ্য এবং কৃষি সংস্থার তথ্যমতে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এক সেমিনারে বলা হচ্ছে, ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে প্রতিবছর তিন লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, ৫০ হাজার লোক ডায়াবেটিসে এ আক্রান্ত হয়। দুই লাখ লোক কিডনি জটিলতায় ভোগেন। প্রতিদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া ডায়রিয়া রোগের প্রধান কারণ অনিরাপদ খাদ্য এবং পানি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে ২০২০ সালের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে।
আশঙ্কার কথা হচ্ছে দেশে খাদ্যের ভেজাল নিয়ে সে রকম কোন গবেষণা হয়নি। পরীক্ষা করে খাদ্যে ভেজাল নির্ণয় করা হলেও কোন খাদ্যে আমাদের কতটুকু ক্ষতি হতে পারে এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কি তা নিয়ে কোন গবেষণা এখনও পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু খাদ্যে বিষক্রিয়া আর হেবি মেটাল মানুষের শরীরে কি কি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সচেতন করছেন খাদ্য এবং পুষ্টি বিজ্ঞানীরা।
রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক ড. মাহামুদুর রহমান বলেন, শরীরের সব অর্গানেই ভেজাল ও ফরমালিন মিশ্রিত খাদ্যের প্রভাব পড়ে। এসব খাদ্য নীরব ঘাতক। কিন্তু খাদ্যে কি পরিমাণ বিষাক্ত পদার্থ থাকলে আমাদের কি পরিমাণ ক্ষতি হবে সে বিষয়ে এখনও কোন গবেষণা হয়নি। তিনি বলেন, খাদ্যে সীসা, আর্সেনিক, অ্যালড্রিন, ডিডিটি মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। ফরমালিনকে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করছেন কিন্তু ফরমালিন খাদ্যের প্রিজারভেটিভই নয়। এ কারণে সামান্য পরিমাণ ফরমালিনও খাদ্যে ব্যবহার করা কোন অবস্থাতে উচিত নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আগে ভেজাল খাদ্যের ফলে মানুষের কিডনি এবং লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এমনটি বলা হতো। এখন মানুষের হৃদরোগে আক্রান্তর জন্যও ভেজাল খাদ্যকে দায়ী করা হচ্ছে। গবেষণায় হৃদরোগে আক্রান্তদের রক্তে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিষক্রিয়ার অস্তিত্ব মিলেছে। দেশের সরকারী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে রোগীর মৃত্যুর প্রধান পাঁচটি কারণের অন্যতম হার্ট এ্যাটাক। জেলা হাসপাতালে এ অবস্থান দ্বিতীয় এবং উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চতুর্থ। আর সরকারের একমাত্র বিশেষায়িত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে হৃদরোগের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি রোগীদের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক রোগীই আসে হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্ত হয়ে। দেশীয় গবেষণায়ও হার্ট এ্যাটাকে আক্রান্তদের রক্তে ক্ষতিকর রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত বিষক্রিয়ার উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ফলে খাদ্যগ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার বিকল্প নেই। গবেষণায় দেখা গেছে অসংক্রামক রোগের কারণে বিশ্বে বছরে তিন কোটি ৬০ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন। ভেজাল খাদ্য দক্ষিণ এশিয়ায় অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে বছরে ৭৯ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে।
অথচ এতকিছুর পরও নিরাপদ খাদ্যর মান নিয়ন্ত্রণে দেশে পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেই। খাদ্য পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য কাজের চাপ অনুযায়ী পরীক্ষাগারে রয়েছে জনবল সঙ্কট। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পিএইচএলের পরীক্ষাগারে সর্বমোট অনুমোদিত পদ হচ্ছে ৩৪টি। স্বাধীনতা উত্তরকালে ১৯৫৩ সালে পরীক্ষাগার স্থাপনের সময় থেকে একই জনবল নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চলছে। এর মধ্যে পরীক্ষাগারের মৌলিক পদ হচ্ছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে একজন পাবলিক এ্যানালিস্ট, দুইজন প্রধান সহকারী এবং ছয়জন ল্যাব সহকারী। এ পরীক্ষাগারে প্রতিমাসে দেশের স্যানেটারি ইন্সপেক্টররা ৭০০ থেকে ৮০০ নমুনা পাঠায় কিন্তু জনবল সঙ্কটে এর অর্ধেকও পরীক্ষা করা হয় না। শুধু এ পরীক্ষাগারই নয় দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোতেও রয়েছে পৃথক পরীক্ষাগার তবে এসব পরীক্ষাগারে বাজার থেকে ভেজাল পণ্য ধরা হলেও পরীক্ষার পর অদৃশ্যকারণে পণ্যের মান যথাযথ দেখিয়ে সার্টিফিকেট দেয়া হয়।
নিরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআই কাজের পরিধি ও ভৌগোলিক আওতা বিবেচনায় মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় জনবলের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টরদের কাজের এলাকা দেশের ৬৪ জেলা ও ৪৮৭ উপজেলা বিস্তৃত। নিরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সারাদেশে ৫৬৬ জন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর রয়েছে। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী সব পদ পূরণ থাকলেও তাদের কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি বিবেচনায় এ জনবল যথেষ্ঠ নয়।
নরাপদ খাদ্যের তদারকি কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও বিএসটিআইয়ের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী জনবলের ঘাটতি রয়েছে। বর্তমানে দেশের ৩১৯টি পৌরসভা ও ১১টি সিটি কর্পোরেশনে অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী ৩৭০টি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদ রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ৭৮ কর্মরত আছে। অর্থাৎ বেশিরভার পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পদ ফাঁকা রয়েছে। আবার সিটি কর্পোরেশনগুলোতে প্রয়োজনের তুলনায় স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের স্বল্পতা লক্ষণীয়। উদাহরণস্বরূপ- জনসংখ্যারভিত্তিতে দেশের বৃহৎ ৩টি সিটি কর্পোরেশনের (ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন) স্যানিটারি ইন্সপেক্টর সংখ্যা খুবই অপ্রতুল।
ইম্প্রুভিং ফুড সেফটি অব বাংলাদেশ প্রকল্পর সিনিয়র ন্যানশাল এ্যাডভাইজার অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা পরীক্ষায় খাদ্যে নানা বিষাক্ত ক্যামিক্যালের অস্তিত্ব পেয়েছি। সরকারকে আমরা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করার সুপারিশ করেছি। খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। আশা করছি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন হলে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন মাঠ পর্যায় থেকে মানুষের রান্নাঘরে ঢোকা পর্যন্ত যে বিশাল সরবরাহ নেটওয়ার্ক সেখানের প্রতিটি জায়গাতে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। কৃষক মাঠে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক, এন্টিবায়োটিক এবং ভেজাল সার ব্যবহার করছেন। এ মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কৃষককে সচেতন করে তোলার যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। আবার ভেজাল সার আমদানি বন্ধেও কঠোরতা নেই। উৎপাদন পর্যায়ের পর সরবরাহ পর্যায়ের দিকে তাকালে দেখা যায়, ফরমালিনের মতো বিভিন্ন নিষিদ্ধ রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। ফলে নিরাপদ খাদ্য মানুষের কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠছে। অনিরাপদ বিষাক্ত খাদ্য মানুষের শরীর সহ্য করতে না পারায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছে।
রোগতত্ত্ব ও রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুস্তাক হোসেন মনে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় পরীক্ষা করে দেখেছি কীটনাশকের প্রভাবে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়। দিনাজপুর, ধামরাই এবং আত্রাইতে শিশু মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে পেটের পীড়ার মতো সমস্যা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তার শরীরে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হয়। স্বাসতন্ত্র এবং লিভার আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি কোন কোন ক্ষেত্রে ক্যান্সার পর্যন্ত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, কেমিক্যাল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত রাসায়নিক এবং মাত্রা মেনে ব্যবহার করতে হবে। তবে সব থেকে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে অনঅনুমোদিত কীটনাশক এবং রাসায়নিক ব্যবহার করা। ড. মুস্তাক মনে করেন খাদ্যের উৎপাদন পর্যায় থেকে সরবরাহ সবক্ষেত্রেই যথাযথ নিয়ম না মানলে রোগাক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কোন অবস্থাতে কমবে না।
http://allbanglanewspapers.com/janakantha/

No comments:

Post a Comment