ভূমিকম্পে কলকাতার বহুতল বাঁচবে?
মাত্রা প্রবল হলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে৷ কারণ, ঝাঁকুনি ও তাপে নরম মাটির তরল হয়ে যাওয়া৷ শহরের ইতিহাসে তার প্রমাণও আছে৷ তা সত্ত্বেও আমরা কিছু শিখেছি কি? লিখছেন তন্ময় সরকার
১১ই অক্টোবর, ১৭৩৭ ৷ ভয়ঙ্কর ঝড়, সঙ্গে বৃষ্টি আর ভূমিকম্প৷ মোহনা থেকে নদীর বুক জুড়ে ছুটে আসা সমুদ্রের জল উজানে উঠে গেল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার৷ নিমেষে জলস্তর ৪০ ফুট বেড়ে গিয়ে নদীপাড়ের জনবসতিতে প্লাবনের আস্ফালন৷ প্রচণ্ড জলোচ্ছাসের দাপটে নদীর ধারে ছিটকে গেল প্রায় ২০,০০০ ছোটো-বড়ো জাহাজ ও নৌকা৷ নদীবক্ষে ভাসমান ১৪টি বিশালাকায় ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসি জাহাজের মধ্যে অধিকাংশ হারিয়ে গেল নদীগর্ভেই৷ ৫০০ টন ওজনের দু'টি জাহাজ গিয়ে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেল নদীর থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরের গ্রামে৷ প্রবল ঢেউ ৬০ টন ওজনের জাহাজকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উজানে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল নদীপাড়ের গাছগাছালির মাথায়৷ সেই প্রবল দুর্যোগের রাত্রে কলকাতা শহরের প্রায় কোনও স্থাপত্যই অক্ষত ছিল না৷ হ্যাঁ, ছাপার ভুল নয়, সঠিক পড়েছেন৷ ১৭৩৭ সালের ১১ই অক্টোবর রাত্রের সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অকুস্থল আর কোথাও নয়, আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা ও তত্সহ অভিন্ন বঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল৷
বিভিন্ন বিবরণ থেকে হতাহতের যে আনুমানিক সংখ্যাটি পাওয়া যায় তা কমবেশি তিন লক্ষের কাছাকাছি৷ লক্ষ করার বিষয় এই যে, দুর্যোগের যে বর্ণনা আমরা পাই, তার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার 'সুনামি'-র কী আশ্চর্য মিল! বিপর্যয়ের ধরন দেখে মনে হয়, যেন কোনও সুনামি ওই রাত্রে আছড়ে পড়েছিল এই বাংলায়৷ আর সেই ভয়ঙ্কর রাতে, প্রকৃতির ধ্বংসলীলার আরও এক অদ্ভুত প্রভাবের সাক্ষী ছিল কলকাতার সেন্ট অ্যানেস্ চার্চ৷ ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন এই ২৭ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার চওড়া এই চার্চের শোভা ছিল পশ্চিম দিকের ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ যা ছিল মূলত কাঠের তৈরি এবং সম্ভবত সেটি তামা বা সিসা জাতীয় কোনও ধাতুর পাত দিয়ে মোড়া ছিল৷ এখানে বলে রাখা ভালো যে স্টিপ্ল্ হল চার্চ-এর ক্রমশ সরু হয়ে
উপর দিকে উঠে যাওয়া একটি চূড়া যা মূলত ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই চার্চের গঠনশৈলীর অংশ হয়ে ওঠে৷ ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে ল্যাম্বার্টের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্ব দিক থেকে আঁকা ছবিতে সেন্ট অ্যানেস্চার্চ এবং তার স্টিপ্ল্ পরিষ্কার ভাবেই দেখা যায়৷ ১৭৩৬ সালে ল্যাম্বার্ট ও স্কটের ফোর্ট উইলিয়ামের আরও একটি ছবি পাওয়া যায় যেটি পশ্চিম দিকের গঙ্গাবক্ষ থেকে আঁকা৷ এই ছবিতেও কেল্লার পিছনে চার্চ-এর এই স্টিপ্ল্ দেখা যায়৷ ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, এই স্টিপ্ল্টি ওই দুর্যোগের রাতে, তার পায়ের তলার মাটির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিলো৷ অর্থাত্, গোটা স্টিপ্ল্টি না ভেঙে মাটির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল৷ এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৫৪ সালে গঙ্গাবক্ষের প্রায় একই জায়গা থেকে ভন্ রায়ানের আঁকা ফোর্ট উইলিয়ামের ছবিতে যাতে কেল্লার পিছনে চার্চের এই স্টিপ্ল্ অদৃশ্য৷
প্রামাণ্য ভাবেই, এই স্টিপ্ল্টির পুনর্গঠনের কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৭৫৬ সালে এবং সম্ভবত সেই কারণেই, ১৭৫৪ সালে ভন্রায়ানের আঁকা ছবিতে সেটি অনুপস্থিত৷ প্রশ্ন হল, এটা কী ভাবে সম্ভব? কাঠের একটি ২০ মিটার লম্বা স্তম্ভ কী ভাবে এক রাতের মধ্যে না ভেঙে মাটির ভিতর ডুবে যেতে পারে? যে শক্তিশালী কাঠামোর আভাস সেন্ট অ্যানেস চার্চের ছবি এবং আয়তনের মাপ থেকে পাওয়া যায়, তাতে অত্যন্ত শক্ত ভিতের উপরই কেবলমাত্র এই ধরণের স্থাপত্য সম্ভব৷ তা হলে এটা সম্ভব হল কী ভাবে?
আপাত-অসম্ভব এই ঘটনার ব্যাখ্যায় অবশ্যম্ভাবী ভাবে একমাত্র যে কারণটি উঠে আসে, তা হল 'আনস্টেবল সয়েল' বা অস্থিত মাটিনির্মিত সমভূমির উপর ভূমিকম্পের প্রভাবের একটি রূপ- 'লিকুইফ্যাকশন' বা তরলীভবন৷ প্রবল কোনও প্রাকৃতিক দূর্যোগে 'আনস্টেবল সয়েল'-এর তরলীভবনের একটা প্রবণতা সারা পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়৷ ১৯৬৪ সালে জাপানের নিগাতা এবং আলাস্কার ভূমিকম্প, ১৯৮৯ সালে আমেরিকার লোমা প্রিয়েতার ভূমিকম্প, ১৯৯৫ সালে জাপানের হানশিনের ভূমিকম্প এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি অঞ্চলের ক্রাইস্টচার্চের ভূমিকম্পে তরলীভবনের পরিণাম পরিষ্কার ভাবে বোঝা গিয়েছে, এবং কারণও কিছুটা জানা গিয়েছে যদিও তা নিবারণের কোনও উপায় নেই৷ প্রবল ভূমিকম্প বা সুনামি জাতীয় দুর্যোগের সময়, প্রবল ঝাঁকুনি এবং তাপে 'আনস্টেবল সয়েল' তরলীভূত হয়ে যেতে পারে; এমনকী অতিরিক্ত তাপে সেই তরল মাটি ফুটতে শুরু করতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে ক্যান্টারবেরি-র ভূমিকম্পে৷ এই তরলীভূত মাটি তখন আচরণে অনেকটা চোরাবালির মতো হয়ে ওঠে৷
অনুমান করা যায় যে চার্চের ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ না ভেঙে, মাটিতে বসে যাওয়ার কারণ তরলীভবন হওয়া অসম্ভব নয়৷ তরলীভূত মাটির ভিতরে কোন নির্মাণ কতটা ডুববে, তা মূলতঃ নির্ভর করে দু'টি বিষয়ের উপর- তরল মাটির ঘনত্ব এবং একক পরিমাণ ভূমির উপর নির্মাণের চাপ৷ স্বাভাবিক ভাবেই, অনুভূমিক প্রসারণ বা 'হরাইজন্টাল এক্সপ্যানশন' থেকে উল্লম্ব প্রসারণ বা 'ভার্টিকাল এক্সপ্যানশন'-এর ক্ষেত্রে একক পরিমাণ ভূমির উপর নির্মাণের চাপ অনেক বেশি এবং সেই কারণেই সম্ভবত যেখানে ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ না ভেঙে মাটির ভিতর ডুবে গিয়েছিল, সেখানে একই স্থানে থাকা সত্ত্বেও সেন্ট অ্যানেস্ চার্চের ২৭ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার চওড়া মূল অংশের প্রায় কোনও ক্ষতিই হয়নি৷
১৭৩৭ সালে কলকাতা শহরের জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ২০,০০০ মাত্র৷ ফলে মূল কলকাতা শহরে প্রাণহানি অপেক্ষাকৃত কমই হয়েছিল এবং তা ছিল আনুমানিক ৩০০০-এর কাছে৷ সওয়া তিনশো বছর পার করে আজকের কল্লোলিনী তিলোত্তমার বাসিন্দা প্রায় ১,৪১,১২,৫৩৬ (২০১১ সালের আদমসুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী)৷ অঙ্কের হিসাবে সে দিনের তুলনায় প্রায় ৭০৫ গুণ৷ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতে, বহরে বেড়ে জমিদার গিন্নির কলেবর ধারণ করেও কুলাতে না পেরে কলকাতা এখন আকাশমুখী৷ আত্মবিস্মৃত জাতির বিস্মরণের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা দেখলে তাজ্জব বনতে হয়৷ ইতিহাস থেকে যে আমরা কিছুমাত্র শিক্ষা নিয়ে থাকি তা আমাদের সিদ্ধান্তের রকম দেখলে মালুম হয় না৷
পাশের সারণীতে বর্তমান কলকাতার কিছু গগনচুম্বী অট্টালিকার পরিসংখ্যান রইল৷ এই সারণীতে কেবল সেই সব অট্টালিকাই আছে যাদের উচ্চতা অন্তত ৭২ মিটার অর্থাত্ প্রায় ১৭/১৮ তলা৷ আর এই তিন ধরনের বহুতল মিলিয়ে শহরে মোট ৫৫৭টি হাইরাইজ ও স্কাইস্ক্র্যাপার আছে বা তৈরি হবে৷ প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, কলকাতা শহরের ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কাছে যে সর্বোচ্চ মই আছে তার উচ্চতা জানতে পারিনি৷ কিন্ত্ত, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ পৃথিবীর যে সর্বোচ্চ মই নথিভুক্ত আছে তার উচ্চতা জানা গিয়েছে এবং তা হল ৪১.১৫ মিটার৷ আশ্বস্ত হওয়ার মতো খবর বটে! আর, সেন্ট অ্যানেস্ চার্চের কাঠের তৈরি যে স্টিপ্ল্টি ডুবে গিয়েছিল তার উচ্চতা যেন কত ছিল? যত দূর মনে পড়ছে ২০ মিটার, তাই না?
যে কোনও বড়ো বিপর্যয়ে কলকাতা শহরের এই বহুতলগুলির অবস্থা কী হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়৷ সন্দেহ নেই, কলকাতার মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ শহরে সেই বিপর্যয় মহামারীর আকার নেবে৷ বর্তমান কলকাতার জনঘনত্বের স্বরূপ উঠে এসেছে কেএমডিএ-র ১৯৯৬-৯৭ সালের সোশিয়ো-ইকোনমিক সার্ভে রিপোর্টে৷ এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা শহরের মোট পরিবারের ৪৯% বসবাস করেন এক কামরার ঘরে৷ আর কলকাতা মেট্রোপলিটান এরিয়ার ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩৭.২%৷ বাড়িতে মাথাপিছু জায়গার হিসাবে কলকাতা শহরের ৩২.৫% মানুষের জন্য বরাদ্দ জায়গা মাত্র ২.৭৮ বর্গমিটার এবং আরও ১৯.৪% মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে পান ২.৭৯ থেকে ৪.৬৫ বর্গমিটার জায়গা৷ ২.৭৮ বর্গমিটার মানে সহজ অঙ্কের হিসাবে যার অর্থ প্রায় পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট৷ বড়ো কোনও বিপর্যয়ে কেবলমাত্র জনঘনত্বের কারণেই শহরে হতাহতের সংখ্যা কল্পনাতীত বেশি হতে পারে৷
প্রকৃতির উপর মানুষের নির্ভরতা সহজে যাওয়ার নয়৷ তবুও, যা মানুষের হাতের বাইরে সে ক্ষেত্রে অসহায়তার একটা কারণ পাওয়া যায়৷ কিন্ত্ত যে ক্ষতি এড়ানো যায়, সেই ক্ষতির কবলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া খুব একটা বুদ্ধির কাজ বলে মনে হয় না৷ প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা আটকাতে পারি না৷ নবীন পলিনির্মিত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অস্থিত মাটি যদি কয়েক মিনিটে গলে কাদা হয়ে যায় তা আটকানোর কোনও রাস্তাও আমাদের জানা নেই৷ কিন্ত্ত সেই ফুটন্ত গরম তরল মাটিতে জীবন্ত সমাধিলাভের থেকে বাঁচার কোনও উপায়ই কি আমাদের হাতে নেই?
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/CAN-KOLKATA-ESCAPE-THE-EFFECTS-OF-EARTHQUAKE/articleshow/37314684.cms
মাত্রা প্রবল হলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে৷ কারণ, ঝাঁকুনি ও তাপে নরম মাটির তরল হয়ে যাওয়া৷ শহরের ইতিহাসে তার প্রমাণও আছে৷ তা সত্ত্বেও আমরা কিছু শিখেছি কি? লিখছেন তন্ময় সরকার
১১ই অক্টোবর, ১৭৩৭ ৷ ভয়ঙ্কর ঝড়, সঙ্গে বৃষ্টি আর ভূমিকম্প৷ মোহনা থেকে নদীর বুক জুড়ে ছুটে আসা সমুদ্রের জল উজানে উঠে গেল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার৷ নিমেষে জলস্তর ৪০ ফুট বেড়ে গিয়ে নদীপাড়ের জনবসতিতে প্লাবনের আস্ফালন৷ প্রচণ্ড জলোচ্ছাসের দাপটে নদীর ধারে ছিটকে গেল প্রায় ২০,০০০ ছোটো-বড়ো জাহাজ ও নৌকা৷ নদীবক্ষে ভাসমান ১৪টি বিশালাকায় ব্রিটিশ, ওলন্দাজ ও ফরাসি জাহাজের মধ্যে অধিকাংশ হারিয়ে গেল নদীগর্ভেই৷ ৫০০ টন ওজনের দু'টি জাহাজ গিয়ে আছড়ে পড়ে চুরমার হয়ে গেল নদীর থেকে প্রায় ৩০০ মিটার দূরের গ্রামে৷ প্রবল ঢেউ ৬০ টন ওজনের জাহাজকে প্রায় ১০ কিলোমিটার উজানে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলল নদীপাড়ের গাছগাছালির মাথায়৷ সেই প্রবল দুর্যোগের রাত্রে কলকাতা শহরের প্রায় কোনও স্থাপত্যই অক্ষত ছিল না৷ হ্যাঁ, ছাপার ভুল নয়, সঠিক পড়েছেন৷ ১৭৩৭ সালের ১১ই অক্টোবর রাত্রের সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অকুস্থল আর কোথাও নয়, আমাদের প্রিয় শহর কলকাতা ও তত্সহ অভিন্ন বঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল৷
বিভিন্ন বিবরণ থেকে হতাহতের যে আনুমানিক সংখ্যাটি পাওয়া যায় তা কমবেশি তিন লক্ষের কাছাকাছি৷ লক্ষ করার বিষয় এই যে, দুর্যোগের যে বর্ণনা আমরা পাই, তার সঙ্গে আমাদের অভিজ্ঞতার 'সুনামি'-র কী আশ্চর্য মিল! বিপর্যয়ের ধরন দেখে মনে হয়, যেন কোনও সুনামি ওই রাত্রে আছড়ে পড়েছিল এই বাংলায়৷ আর সেই ভয়ঙ্কর রাতে, প্রকৃতির ধ্বংসলীলার আরও এক অদ্ভুত প্রভাবের সাক্ষী ছিল কলকাতার সেন্ট অ্যানেস্ চার্চ৷ ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন এই ২৭ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার চওড়া এই চার্চের শোভা ছিল পশ্চিম দিকের ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ যা ছিল মূলত কাঠের তৈরি এবং সম্ভবত সেটি তামা বা সিসা জাতীয় কোনও ধাতুর পাত দিয়ে মোড়া ছিল৷ এখানে বলে রাখা ভালো যে স্টিপ্ল্ হল চার্চ-এর ক্রমশ সরু হয়ে
উপর দিকে উঠে যাওয়া একটি চূড়া যা মূলত ৬০০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই চার্চের গঠনশৈলীর অংশ হয়ে ওঠে৷ ১৭৩০ খ্রিস্টাব্দে ল্যাম্বার্টের ফোর্ট উইলিয়ামের পূর্ব দিক থেকে আঁকা ছবিতে সেন্ট অ্যানেস্চার্চ এবং তার স্টিপ্ল্ পরিষ্কার ভাবেই দেখা যায়৷ ১৭৩৬ সালে ল্যাম্বার্ট ও স্কটের ফোর্ট উইলিয়ামের আরও একটি ছবি পাওয়া যায় যেটি পশ্চিম দিকের গঙ্গাবক্ষ থেকে আঁকা৷ এই ছবিতেও কেল্লার পিছনে চার্চ-এর এই স্টিপ্ল্ দেখা যায়৷ ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, এই স্টিপ্ল্টি ওই দুর্যোগের রাতে, তার পায়ের তলার মাটির মধ্যে নিমজ্জিত হয়েছিলো৷ অর্থাত্, গোটা স্টিপ্ল্টি না ভেঙে মাটির মধ্যে ডুবে গিয়েছিল৷ এবং তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৭৫৪ সালে গঙ্গাবক্ষের প্রায় একই জায়গা থেকে ভন্ রায়ানের আঁকা ফোর্ট উইলিয়ামের ছবিতে যাতে কেল্লার পিছনে চার্চের এই স্টিপ্ল্ অদৃশ্য৷
প্রামাণ্য ভাবেই, এই স্টিপ্ল্টির পুনর্গঠনের কাজ সম্পূর্ণ হয় ১৭৫৬ সালে এবং সম্ভবত সেই কারণেই, ১৭৫৪ সালে ভন্রায়ানের আঁকা ছবিতে সেটি অনুপস্থিত৷ প্রশ্ন হল, এটা কী ভাবে সম্ভব? কাঠের একটি ২০ মিটার লম্বা স্তম্ভ কী ভাবে এক রাতের মধ্যে না ভেঙে মাটির ভিতর ডুবে যেতে পারে? যে শক্তিশালী কাঠামোর আভাস সেন্ট অ্যানেস চার্চের ছবি এবং আয়তনের মাপ থেকে পাওয়া যায়, তাতে অত্যন্ত শক্ত ভিতের উপরই কেবলমাত্র এই ধরণের স্থাপত্য সম্ভব৷ তা হলে এটা সম্ভব হল কী ভাবে?
আপাত-অসম্ভব এই ঘটনার ব্যাখ্যায় অবশ্যম্ভাবী ভাবে একমাত্র যে কারণটি উঠে আসে, তা হল 'আনস্টেবল সয়েল' বা অস্থিত মাটিনির্মিত সমভূমির উপর ভূমিকম্পের প্রভাবের একটি রূপ- 'লিকুইফ্যাকশন' বা তরলীভবন৷ প্রবল কোনও প্রাকৃতিক দূর্যোগে 'আনস্টেবল সয়েল'-এর তরলীভবনের একটা প্রবণতা সারা পৃথিবী জুড়েই দেখা যায়৷ ১৯৬৪ সালে জাপানের নিগাতা এবং আলাস্কার ভূমিকম্প, ১৯৮৯ সালে আমেরিকার লোমা প্রিয়েতার ভূমিকম্প, ১৯৯৫ সালে জাপানের হানশিনের ভূমিকম্প এবং সর্বশেষ ২০১১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্যান্টারবেরি অঞ্চলের ক্রাইস্টচার্চের ভূমিকম্পে তরলীভবনের পরিণাম পরিষ্কার ভাবে বোঝা গিয়েছে, এবং কারণও কিছুটা জানা গিয়েছে যদিও তা নিবারণের কোনও উপায় নেই৷ প্রবল ভূমিকম্প বা সুনামি জাতীয় দুর্যোগের সময়, প্রবল ঝাঁকুনি এবং তাপে 'আনস্টেবল সয়েল' তরলীভূত হয়ে যেতে পারে; এমনকী অতিরিক্ত তাপে সেই তরল মাটি ফুটতে শুরু করতে পারে, যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে ক্যান্টারবেরি-র ভূমিকম্পে৷ এই তরলীভূত মাটি তখন আচরণে অনেকটা চোরাবালির মতো হয়ে ওঠে৷
অনুমান করা যায় যে চার্চের ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ না ভেঙে, মাটিতে বসে যাওয়ার কারণ তরলীভবন হওয়া অসম্ভব নয়৷ তরলীভূত মাটির ভিতরে কোন নির্মাণ কতটা ডুববে, তা মূলতঃ নির্ভর করে দু'টি বিষয়ের উপর- তরল মাটির ঘনত্ব এবং একক পরিমাণ ভূমির উপর নির্মাণের চাপ৷ স্বাভাবিক ভাবেই, অনুভূমিক প্রসারণ বা 'হরাইজন্টাল এক্সপ্যানশন' থেকে উল্লম্ব প্রসারণ বা 'ভার্টিকাল এক্সপ্যানশন'-এর ক্ষেত্রে একক পরিমাণ ভূমির উপর নির্মাণের চাপ অনেক বেশি এবং সেই কারণেই সম্ভবত যেখানে ২০ মিটার লম্বা স্টিপ্ল্ না ভেঙে মাটির ভিতর ডুবে গিয়েছিল, সেখানে একই স্থানে থাকা সত্ত্বেও সেন্ট অ্যানেস্ চার্চের ২৭ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার চওড়া মূল অংশের প্রায় কোনও ক্ষতিই হয়নি৷
১৭৩৭ সালে কলকাতা শহরের জনসংখ্যা ছিল আনুমানিক ২০,০০০ মাত্র৷ ফলে মূল কলকাতা শহরে প্রাণহানি অপেক্ষাকৃত কমই হয়েছিল এবং তা ছিল আনুমানিক ৩০০০-এর কাছে৷ সওয়া তিনশো বছর পার করে আজকের কল্লোলিনী তিলোত্তমার বাসিন্দা প্রায় ১,৪১,১২,৫৩৬ (২০১১ সালের আদমসুমারির পরিসংখ্যান অনুযায়ী)৷ অঙ্কের হিসাবে সে দিনের তুলনায় প্রায় ৭০৫ গুণ৷ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সামলাতে, বহরে বেড়ে জমিদার গিন্নির কলেবর ধারণ করেও কুলাতে না পেরে কলকাতা এখন আকাশমুখী৷ আত্মবিস্মৃত জাতির বিস্মরণের ব্যাপ্তি এবং গভীরতা দেখলে তাজ্জব বনতে হয়৷ ইতিহাস থেকে যে আমরা কিছুমাত্র শিক্ষা নিয়ে থাকি তা আমাদের সিদ্ধান্তের রকম দেখলে মালুম হয় না৷
পাশের সারণীতে বর্তমান কলকাতার কিছু গগনচুম্বী অট্টালিকার পরিসংখ্যান রইল৷ এই সারণীতে কেবল সেই সব অট্টালিকাই আছে যাদের উচ্চতা অন্তত ৭২ মিটার অর্থাত্ প্রায় ১৭/১৮ তলা৷ আর এই তিন ধরনের বহুতল মিলিয়ে শহরে মোট ৫৫৭টি হাইরাইজ ও স্কাইস্ক্র্যাপার আছে বা তৈরি হবে৷ প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, কলকাতা শহরের ফায়ার সার্ভিস ডিপার্টমেন্টের কাছে যে সর্বোচ্চ মই আছে তার উচ্চতা জানতে পারিনি৷ কিন্ত্ত, গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড-এ পৃথিবীর যে সর্বোচ্চ মই নথিভুক্ত আছে তার উচ্চতা জানা গিয়েছে এবং তা হল ৪১.১৫ মিটার৷ আশ্বস্ত হওয়ার মতো খবর বটে! আর, সেন্ট অ্যানেস্ চার্চের কাঠের তৈরি যে স্টিপ্ল্টি ডুবে গিয়েছিল তার উচ্চতা যেন কত ছিল? যত দূর মনে পড়ছে ২০ মিটার, তাই না?
যে কোনও বড়ো বিপর্যয়ে কলকাতা শহরের এই বহুতলগুলির অবস্থা কী হতে পারে ভেবে আতঙ্কিত হতে হয়৷ সন্দেহ নেই, কলকাতার মতো ঘন জনবসতিপূর্ণ শহরে সেই বিপর্যয় মহামারীর আকার নেবে৷ বর্তমান কলকাতার জনঘনত্বের স্বরূপ উঠে এসেছে কেএমডিএ-র ১৯৯৬-৯৭ সালের সোশিয়ো-ইকোনমিক সার্ভে রিপোর্টে৷ এই রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা শহরের মোট পরিবারের ৪৯% বসবাস করেন এক কামরার ঘরে৷ আর কলকাতা মেট্রোপলিটান এরিয়ার ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩৭.২%৷ বাড়িতে মাথাপিছু জায়গার হিসাবে কলকাতা শহরের ৩২.৫% মানুষের জন্য বরাদ্দ জায়গা মাত্র ২.৭৮ বর্গমিটার এবং আরও ১৯.৪% মানুষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসাবে পান ২.৭৯ থেকে ৪.৬৫ বর্গমিটার জায়গা৷ ২.৭৮ বর্গমিটার মানে সহজ অঙ্কের হিসাবে যার অর্থ প্রায় পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট৷ বড়ো কোনও বিপর্যয়ে কেবলমাত্র জনঘনত্বের কারণেই শহরে হতাহতের সংখ্যা কল্পনাতীত বেশি হতে পারে৷
প্রকৃতির উপর মানুষের নির্ভরতা সহজে যাওয়ার নয়৷ তবুও, যা মানুষের হাতের বাইরে সে ক্ষেত্রে অসহায়তার একটা কারণ পাওয়া যায়৷ কিন্ত্ত যে ক্ষতি এড়ানো যায়, সেই ক্ষতির কবলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাওয়া খুব একটা বুদ্ধির কাজ বলে মনে হয় না৷ প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমরা আটকাতে পারি না৷ নবীন পলিনির্মিত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অস্থিত মাটি যদি কয়েক মিনিটে গলে কাদা হয়ে যায় তা আটকানোর কোনও রাস্তাও আমাদের জানা নেই৷ কিন্ত্ত সেই ফুটন্ত গরম তরল মাটিতে জীবন্ত সমাধিলাভের থেকে বাঁচার কোনও উপায়ই কি আমাদের হাতে নেই?
http://eisamay.indiatimes.com/editorial/post-editorial/CAN-KOLKATA-ESCAPE-THE-EFFECTS-OF-EARTHQUAKE/articleshow/37314684.cms
No comments:
Post a Comment