আওয়ামী লীগকে পরামর্শ দিয়ে লাভ কী?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ঢাকা থেকে আমার বয়োকনিষ্ঠ এক কলামিস্ট আমাকে একটি চিঠি লিখেছেন। তাঁর অনুরোধেই নামটা প্রকাশ করলাম না। তিনি লিখেছেন, ‘আপনার লেখা পড়ে মাঝে মাঝেই সমালোচনা করে লিখতে ইচ্ছে করে। লিখি না এই কারণে যে, আপনি দূরে থাকেন। আওয়ামী লীগকে সমর্থন জানিয়ে দীর্ঘকাল ধরে লিখছেন। এই বয়সে আপনার মত পাল্টানো যাবে না। তাই এই চিঠি লিখছি। যদি আমার নাম প্রকাশ না করে প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়ে একটি কলাম লেখেন, তাহলে খুশি হব।’
চিঠিটা পড়ে আমিও খুশি হয়েছি। ফয়েজ আহমদ তো মারা গেছেন আগেই। সম্প্রতি বন্ধুবর এবিএম মূসা মারা যাওয়ার পর আমার লেখার নিন্দা-প্রশংসা করে কলামিস্ট বন্ধুদের আর কেউ টেলিফোন করেন না। আমার বয়সী কলামিস্টদের তেমন আর কেউ বেঁচেও নেই। মূসা বেঁচে থাকতে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দু’বার তাঁর টেলিফোন পেতাম। কখনও আমার লেখার প্রশংসা করতেন। আবার কখনও বলতেন, ‘এটা কী লিখেছেন? হাসিনা সরকারকে বেশি প্রশ্রয় দেবেন না, তাহলে কেবল ভুল করতে থাকবে।’
সেই মূসাও আর নেই। আমাকে এতটা সম্মান ও ভালবাসার সঙ্গে তিরস্কার ও প্রশংসা করার আর কোন সাংবাদিক বন্ধু বেঁচে নেই। মাঝে মাঝে পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে ঢাকায় সাংবাদিকতা করার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ফয়েজ, মূসা ও এমআর আখতার মুকুলের সঙ্গে আরও অনেকের কথা। আমাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ কম হয়নি। কিন্তু তার মধ্যেও ছিল এক অনাবিল বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই তাঁদের বিয়োগ-ব্যথায় বুকে শূন্যতার হাহাকার শুনি। আমারও তো বিদায় বেলা ঘনিয়ে এলো। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের গানের কলি আওড়াই :
‘চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা,
তখনি চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা।’
লিখতে বসে ভাবাবেগে প্রসঙ্গের বাইরে চলে এসেছি। এ জন্য সহৃদয় পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাই। আমার অনুজপ্রতিম এক কলামিস্টের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে মনে এই ভাবাবেগ জেগে উঠেছিল। তিনি আমাকে লিখেছেন, ‘আপনি তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের কেউ আপনার লেখা পড়েন (তাদের কোন কিছু পড়ার অভ্যাস আছে কি?) কিংবা তাতে কর্ণপাত করেন? যদি নাই পড়েন, নাই কিছু করেন তাহলে দিনের পর দিন এসব লিখছেন কেন? এই বিরামহীন লেখা দ্বারা আপনি কার উপকার করছেন? দলটির, না দেশের, না আপনার নিজের? আপনার কাছ থেকে এই প্রশ্নটির উত্তর চাই।’
কলামিস্ট পত্রলেখক সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি কি মনে করেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোঁদাদের বিচার বর্তমানের ঝুলন্ত অবস্থা থেকে শীঘ্রই মুক্ত হবে এবং দ-িতদের শাস্তি কার্যকর করা হবে? জামায়াতকে বিচার করা নিয়ে আইনী তর্কের এই কূটকৌশল গ্রহণ করা কেন? তা নিয়ে আইনমন্ত্রী এক কথা বলেছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী বলছেন আরেক কথা। এই বিতর্ক সৃষ্টির আড়ালে যারা যুদ্ধাপরাধীদের এবং জামায়াতীদের বিচার চায়, তাদের ওপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। গোটা ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সরকার কি তাহলে জামায়াতের বিচারও চায় না? জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দূরের কথা!
পত্রলেখক লিখেছেন, ‘জামায়াতের বিচার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির এখন কী দরকার ছিল? নাকি প্রধানমন্ত্রী জনমত বাজিয়ে দেখার জন্য আইনমন্ত্রীকে দিয়ে কথাটা বলিয়েছেন? আমার সামান্য আইনজ্ঞান আছে। তা বলে, প্রচলিত আইনেই জামায়াতকে বিচার করা যায়। যদি না যায় তাহলে একটি আইনপ্রণয়নের অসুবিধা কী? সংসদে সরকারী দল তো এখন একমেবাদ্বিতীয়ম।’
আমি পত্রলেখক বন্ধুর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানিতে পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৬৯ বছর পরেও নাৎসি দলের স্বস্তিকা চিহ্ন ধারণ এবং হাই হিটলার স্লোগান দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের নাৎসি দল জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে না চান, তাদের বিচারের জন্য নতুন ও কার্যকর আইন পাস করতে পারেন। তা না করে এই গড়িমসি কেন? নাকি হেফাজতীদের মতো জামায়াতীদের প্রতিও সরকারের মনে গোপন দুর্বলতা আছে বলে জনমনের যে সন্দেহ তা সঠিক?
পত্রলেখক লিখেছেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও ঝুলে গেছে। মনে হয় এই বিচার শেষ করার ব্যাপারেও সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে অথবা কোন প্রকার দেশী অথবা বিদেশী চাপের মধ্যে সরকার আটকে আছে। এই বিচার শেষ করা এবং দ-িত অপরাধীদের দ্রুত শাস্তিদানের পক্ষে বিশাল জনমত ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাবের সময়ে। সরকার কাদের পরামর্শে এই মঞ্চ ভেঙ্গে দেয়া এবং হেফাজতীদের সঙ্গে গোপন আপোস করার নীতি গ্রহণ করল তা কি আপনি জানেন? সরকার ’৭২-এর সেক্যুলার সংবিধান সম্পূর্ণ চালু করা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানের অঙ্গীকার থেকে ক্রমশ পিছু হটছে। সিভিল এ্যান্ড মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির একটা অংশের ওপর এই সরকার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ফলে আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে করে রাখা হয়েছে ঝাঁপিবদ্ধ নির্বিষ সাপের মতো। আপনি কি মনে করেন এই আপোসনীতি, পশ্চাদপসরণের নীতি এই সরকারকে শেষ রক্ষা দিতে পারবে?’
তরুণ কলামিস্ট এই প্রশ্নগুলো তাঁর কলামে না তুলে আমাকে কেন করেছেন, তা লেখেননি। হয়ত ভেবেছেন, এর সদুত্তরগুলো আমার ভাল জানা আছে। তাঁকে সবিনয়ে জানাতে চাই, এই কথাগুলো এবং প্রশ্নগুলো আমারও। এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমি আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু সবসময় মেলাতে পারি না। আমার ধারণা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- দানের ব্যাপারে শেখ হাসিনা আগ্রহী ও আন্তরিক। কিন্তু তিনি যে সরকারে নেতৃত্বে রয়েছেন, সেই সরকার আন্তরিক নয়। এই সরকারে কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন, যাঁরা সামনে দেখান, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর জি হুজুরের দলে। কিন্তু তলে তলে প্যাঁচ কষেন। এস্টাবলিশমেন্টের একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সঙ্গে এদের যোগাযোগ এবং তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন। এ ছাড়া এঁদের পেছনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্রীরা তো রয়েছেই।
পত্রলেখক কলামিস্ট আমাকে প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কি পারতেন না, তাঁর সংগঠনটিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে? তাঁর দলে এমন একজন সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তরুণ নেতা কি নেই, যিনি বর্তমান নিষ্ক্রিয় ও অনিচ্ছুক সাধারণ সম্পাদকের বদলে ওই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন এবং দলটিকে তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করে তুলতে পারেন? আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো- বিশেষ করে ছাত্রলীগের অবস্থা আরও খারাপ। এই সংগঠনে ভাল ও সৎকর্মী ও নেতা নেই তা নয়; কিন্তু তাঁরা দলে কোণঠাসা। নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। জেলায় জেলায় এঁরা সংগঠনের কমিটি গঠনের নামে কমিটি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন। (পত্রলেখকের এই অভিযোগ সম্পর্কে আমারও তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিবাদ মেটাতে এসে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কার্যকলাপ দেখে।)
দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির জন্য আওয়ামী লীগের যত দুর্নাম, তার বারো আনার জন্য দায়ী এই ছাত্রলীগের একশ্রেণীর কর্মী ও নেতা। এই সংগঠনটির কি রাস টেনে ধরা যায় না? পত্রলেখক বন্ধু প্রশ্ন তুলেছেন, লিখেছেন, ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন এবং তার ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকায় ফিরিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কেন ব্যর্থতা ও অক্ষমতা দেখাচ্ছেন, এটা তার বোধগম্য নয়। পত্রলেখকের এই প্রশ্নের একটি জবাব আমার জানা। একশ্রেণীর মন্ত্রী ও এমপি ছাত্রলীগকে এখন তাঁদের লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগে দুর্বৃত্তায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছাত্রলীগকে সংস্কার ও পুনর্গঠন করতে হলে এই মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা হয়ত তিনি পারছেন না। বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে কোন বিরোধী দল নয়, ছাত্রলীগই আওয়ামী লীগ সরকারকে কর্দমে টেনে নামাবে এবং তার বিপর্যয় ঘটাবে আশঙ্কা হয়। আমি পত্রলেখকের এই অভিমতের সঙ্গেও সহমত পোষণ করি।
এবার তাঁর প্রশ্নের জবাবে নয়। আমার নিজের একটি কথা বলি। যে কথা আমি আগেও লিখেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের রেকর্ড অসাধারণ। কিন্তু উন্নয়ন দেখিয়ে জনসমর্থন ধরে রাখা যাচ্ছে না। কারণ, দেশে আইনের শাসন নেই। দেশের মানুষের মনে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ নেই। গুম-খুন-অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা পড়ছে না অথবা তাদের ধরা হচ্ছে না। অনেক খুন-অপহরণ ক্ষমতাসীন দলে লুটেরা রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলও। প্রধানমন্ত্রী কঠোর হতে পারছেন না। পদ্মা সেতুসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার সময় তিনি তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকে অপসারণের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন এবং এখন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মন্ত্রী মায়াকে পদত্যাগে বাধ্য করেননি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগুলো সরকারের দুর্বলতা অথবা অক্ষমতার পরিচয় প্রকাশ করছে।
বঙ্গবন্ধু এ দুর্বলতা দেখাননি। তাঁর এমপিদের মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতেই তিনি চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রভাবশালী এমপি আখতারুজ্জামান বাবুকে এবং শ্রমিক লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল বা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে একাধিক নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠন থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তি। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে হলে আওয়ামী লীগকে নিজের ঘর আগে গোছাতে হবে।
এখন আমার কলামিস্ট বন্ধুর মূল প্রশ্নটির জবাব দেই। আওয়ামী লীগ আমার পরামর্শ শোনে না এবং শুনবে না জেনেও কেন পরামর্শ দেই? বর্তমানে দেশের ডানে বামে যেদিকেই তাকাই আওয়ামী লীগের বিকল্প কোন দল দেখি না। শেখ হাসিনার বিকল্প কোন নেতা-নেত্রী দেখি না। বামেও নয়, ডানেও নয়। তাই আওয়ামী লীগ সমর্থন করতে হয়। নইলে দেশ সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী দানবের কব্জায় যাবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের একমাত্র রক্ষাকবচ। এই কবচটি যাতে একেবারেই মলিন ও অব্যবহার্য না হয়ে যায় সেজন্য নিজের জ্ঞান ও বিবেক অনুযায়ী যতটা সম্ভব পরামর্শ দেই।
যতদিন দেশে নতুন রাজনীতি ও নতুন নীতি এবং নেতৃত্বের অভ্যুদয় না ঘটবে, ততদিন আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য পরামর্শ দিয়ে যেতে হবেই। আওয়ামী লীগ যদি তা না শোনে, তাতে তাদের পতন তো হবেই, দেশের ক্ষতি হবে। ভারতে কংগ্রেসের পতন থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেয়া উচিত। আমার মতো ভারতেরও কয়েকজন প্রবীণ বয়সের কলামিস্ট, দিনের পর দিন কংগ্রেস ও কংগ্রেস সরকারের জন্য অবিরাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। সোনিয়া-রাহুল-মনমোহন তা কানে তোলেননি। রুষ্ট গণদেবতা তার শোধ নিয়েছে শুধু ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে নয়; লোকসভাতেও একেবারে অকেজো করে দিয়ে।
বাংলাদেশের এখন যা অবস্থা, তাতে মনে হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ এত ভাল ভাল কথা বলছে, তাদের নেতারাও কোনদিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এমনকি বিএনপিও না। বিএনপি এখন হালভাঙ্গা দিশাহীন নাবিক। দেশে যদি ক্ষমতার হাতবদল হয় তাহলে ক্ষমতায় আসবে হয়ত উগ্র মৌলবাদী দল এবং তার নেতা। এই আশঙ্কায় আওয়ামী লীগকে অবিরাম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। হয়ত আমৃত্যু দিয়ে যাব।
লন্ডন, মঙ্গলবার ॥
৩ জুন ২০১৪।
চিঠিটা পড়ে আমিও খুশি হয়েছি। ফয়েজ আহমদ তো মারা গেছেন আগেই। সম্প্রতি বন্ধুবর এবিএম মূসা মারা যাওয়ার পর আমার লেখার নিন্দা-প্রশংসা করে কলামিস্ট বন্ধুদের আর কেউ টেলিফোন করেন না। আমার বয়সী কলামিস্টদের তেমন আর কেউ বেঁচেও নেই। মূসা বেঁচে থাকতে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার দু’বার তাঁর টেলিফোন পেতাম। কখনও আমার লেখার প্রশংসা করতেন। আবার কখনও বলতেন, ‘এটা কী লিখেছেন? হাসিনা সরকারকে বেশি প্রশ্রয় দেবেন না, তাহলে কেবল ভুল করতে থাকবে।’
সেই মূসাও আর নেই। আমাকে এতটা সম্মান ও ভালবাসার সঙ্গে তিরস্কার ও প্রশংসা করার আর কোন সাংবাদিক বন্ধু বেঁচে নেই। মাঝে মাঝে পঞ্চাশের ও ষাটের দশকে ঢাকায় সাংবাদিকতা করার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ফয়েজ, মূসা ও এমআর আখতার মুকুলের সঙ্গে আরও অনেকের কথা। আমাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ কম হয়নি। কিন্তু তার মধ্যেও ছিল এক অনাবিল বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক। মাঝে মাঝেই তাঁদের বিয়োগ-ব্যথায় বুকে শূন্যতার হাহাকার শুনি। আমারও তো বিদায় বেলা ঘনিয়ে এলো। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের গানের কলি আওড়াই :
‘চাহি না রহিতে বসে ফুরাইলে বেলা,
তখনি চলিয়া যাব শেষ হলে খেলা।’
লিখতে বসে ভাবাবেগে প্রসঙ্গের বাইরে চলে এসেছি। এ জন্য সহৃদয় পাঠকদের কাছে ক্ষমা চাই। আমার অনুজপ্রতিম এক কলামিস্টের কাছ থেকে চিঠি পেয়ে মনে এই ভাবাবেগ জেগে উঠেছিল। তিনি আমাকে লিখেছেন, ‘আপনি তো দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কি মনে করেন আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীদের কেউ আপনার লেখা পড়েন (তাদের কোন কিছু পড়ার অভ্যাস আছে কি?) কিংবা তাতে কর্ণপাত করেন? যদি নাই পড়েন, নাই কিছু করেন তাহলে দিনের পর দিন এসব লিখছেন কেন? এই বিরামহীন লেখা দ্বারা আপনি কার উপকার করছেন? দলটির, না দেশের, না আপনার নিজের? আপনার কাছ থেকে এই প্রশ্নটির উত্তর চাই।’
কলামিস্ট পত্রলেখক সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, ‘আপনি কি মনে করেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোঁদাদের বিচার বর্তমানের ঝুলন্ত অবস্থা থেকে শীঘ্রই মুক্ত হবে এবং দ-িতদের শাস্তি কার্যকর করা হবে? জামায়াতকে বিচার করা নিয়ে আইনী তর্কের এই কূটকৌশল গ্রহণ করা কেন? তা নিয়ে আইনমন্ত্রী এক কথা বলেছেন। সাবেক আইনমন্ত্রী বলছেন আরেক কথা। এই বিতর্ক সৃষ্টির আড়ালে যারা যুদ্ধাপরাধীদের এবং জামায়াতীদের বিচার চায়, তাদের ওপর সরকার নির্যাতন চালাচ্ছে। গোটা ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সরকার কি তাহলে জামায়াতের বিচারও চায় না? জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা দূরের কথা!
পত্রলেখক লিখেছেন, ‘জামায়াতের বিচার নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির এখন কী দরকার ছিল? নাকি প্রধানমন্ত্রী জনমত বাজিয়ে দেখার জন্য আইনমন্ত্রীকে দিয়ে কথাটা বলিয়েছেন? আমার সামান্য আইনজ্ঞান আছে। তা বলে, প্রচলিত আইনেই জামায়াতকে বিচার করা যায়। যদি না যায় তাহলে একটি আইনপ্রণয়নের অসুবিধা কী? সংসদে সরকারী দল তো এখন একমেবাদ্বিতীয়ম।’
আমি পত্রলেখক বন্ধুর সঙ্গে সহমত পোষণ করি। ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর নাৎসি দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জার্মানিতে পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৬৯ বছর পরেও নাৎসি দলের স্বস্তিকা চিহ্ন ধারণ এবং হাই হিটলার স্লোগান দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশের নাৎসি দল জামায়াতকে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে না চান, তাদের বিচারের জন্য নতুন ও কার্যকর আইন পাস করতে পারেন। তা না করে এই গড়িমসি কেন? নাকি হেফাজতীদের মতো জামায়াতীদের প্রতিও সরকারের মনে গোপন দুর্বলতা আছে বলে জনমনের যে সন্দেহ তা সঠিক?
পত্রলেখক লিখেছেন, ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও ঝুলে গেছে। মনে হয় এই বিচার শেষ করার ব্যাপারেও সরকার দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে অথবা কোন প্রকার দেশী অথবা বিদেশী চাপের মধ্যে সরকার আটকে আছে। এই বিচার শেষ করা এবং দ-িত অপরাধীদের দ্রুত শাস্তিদানের পক্ষে বিশাল জনমত ও রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল গণজাগরণ মঞ্চের আবির্ভাবের সময়ে। সরকার কাদের পরামর্শে এই মঞ্চ ভেঙ্গে দেয়া এবং হেফাজতীদের সঙ্গে গোপন আপোস করার নীতি গ্রহণ করল তা কি আপনি জানেন? সরকার ’৭২-এর সেক্যুলার সংবিধান সম্পূর্ণ চালু করা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ-দানের অঙ্গীকার থেকে ক্রমশ পিছু হটছে। সিভিল এ্যান্ড মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির একটা অংশের ওপর এই সরকার সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। ফলে আওয়ামী লীগকে সংগঠন হিসেবে করে রাখা হয়েছে ঝাঁপিবদ্ধ নির্বিষ সাপের মতো। আপনি কি মনে করেন এই আপোসনীতি, পশ্চাদপসরণের নীতি এই সরকারকে শেষ রক্ষা দিতে পারবে?’
তরুণ কলামিস্ট এই প্রশ্নগুলো তাঁর কলামে না তুলে আমাকে কেন করেছেন, তা লেখেননি। হয়ত ভেবেছেন, এর সদুত্তরগুলো আমার ভাল জানা আছে। তাঁকে সবিনয়ে জানাতে চাই, এই কথাগুলো এবং প্রশ্নগুলো আমারও। এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমি আন্দাজ করতে পারি, কিন্তু সবসময় মেলাতে পারি না। আমার ধারণা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দ- দানের ব্যাপারে শেখ হাসিনা আগ্রহী ও আন্তরিক। কিন্তু তিনি যে সরকারে নেতৃত্বে রয়েছেন, সেই সরকার আন্তরিক নয়। এই সরকারে কিছু মন্ত্রী ও উপদেষ্টা আছেন, যাঁরা সামনে দেখান, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর জি হুজুরের দলে। কিন্তু তলে তলে প্যাঁচ কষেন। এস্টাবলিশমেন্টের একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল অংশের সঙ্গে এদের যোগাযোগ এবং তাঁরা প্রধানমন্ত্রীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছেন। এ ছাড়া এঁদের পেছনে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্রীরা তো রয়েছেই।
পত্রলেখক কলামিস্ট আমাকে প্রশ্ন করেছেন, প্রধানমন্ত্রী কি পারতেন না, তাঁর সংগঠনটিকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে? তাঁর দলে এমন একজন সাংগঠনিক শক্তির অধিকারী তরুণ নেতা কি নেই, যিনি বর্তমান নিষ্ক্রিয় ও অনিচ্ছুক সাধারণ সম্পাদকের বদলে ওই পদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন এবং দলটিকে তৃণমূল পর্যায় থেকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করে তুলতে পারেন? আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো- বিশেষ করে ছাত্রলীগের অবস্থা আরও খারাপ। এই সংগঠনে ভাল ও সৎকর্মী ও নেতা নেই তা নয়; কিন্তু তাঁরা দলে কোণঠাসা। নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে দুর্নীতিপরায়ণ। জেলায় জেলায় এঁরা সংগঠনের কমিটি গঠনের নামে কমিটি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য করেন। (পত্রলেখকের এই অভিযোগ সম্পর্কে আমারও তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের বিবাদ মেটাতে এসে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কার্যকলাপ দেখে।)
দেশে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির জন্য আওয়ামী লীগের যত দুর্নাম, তার বারো আনার জন্য দায়ী এই ছাত্রলীগের একশ্রেণীর কর্মী ও নেতা। এই সংগঠনটির কি রাস টেনে ধরা যায় না? পত্রলেখক বন্ধু প্রশ্ন তুলেছেন, লিখেছেন, ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন এবং তার ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রামী ভূমিকায় ফিরিয়ে নিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী কেন ব্যর্থতা ও অক্ষমতা দেখাচ্ছেন, এটা তার বোধগম্য নয়। পত্রলেখকের এই প্রশ্নের একটি জবাব আমার জানা। একশ্রেণীর মন্ত্রী ও এমপি ছাত্রলীগকে এখন তাঁদের লেঠেল হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগে দুর্বৃত্তায়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ছাত্রলীগকে সংস্কার ও পুনর্গঠন করতে হলে এই মন্ত্রী ও এমপিদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা হয়ত তিনি পারছেন না। বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাতে কোন বিরোধী দল নয়, ছাত্রলীগই আওয়ামী লীগ সরকারকে কর্দমে টেনে নামাবে এবং তার বিপর্যয় ঘটাবে আশঙ্কা হয়। আমি পত্রলেখকের এই অভিমতের সঙ্গেও সহমত পোষণ করি।
এবার তাঁর প্রশ্নের জবাবে নয়। আমার নিজের একটি কথা বলি। যে কথা আমি আগেও লিখেছি। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের রেকর্ড অসাধারণ। কিন্তু উন্নয়ন দেখিয়ে জনসমর্থন ধরে রাখা যাচ্ছে না। কারণ, দেশে আইনের শাসন নেই। দেশের মানুষের মনে স্বস্তি ও নিরাপত্তাবোধ নেই। গুম-খুন-অপহরণ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা ধরা পড়ছে না অথবা তাদের ধরা হচ্ছে না। অনেক খুন-অপহরণ ক্ষমতাসীন দলে লুটেরা রাজনীতির অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলও। প্রধানমন্ত্রী কঠোর হতে পারছেন না। পদ্মা সেতুসংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার সময় তিনি তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রীকে অপসারণের ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন এবং এখন নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় মন্ত্রী মায়াকে পদত্যাগে বাধ্য করেননি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় এগুলো সরকারের দুর্বলতা অথবা অক্ষমতার পরিচয় প্রকাশ করছে।
বঙ্গবন্ধু এ দুর্বলতা দেখাননি। তাঁর এমপিদের মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতেই তিনি চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রভাবশালী এমপি আখতারুজ্জামান বাবুকে এবং শ্রমিক লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল বা জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে একাধিক নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠন থেকে দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ব্যক্তি। রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনতে হলে আওয়ামী লীগকে নিজের ঘর আগে গোছাতে হবে।
এখন আমার কলামিস্ট বন্ধুর মূল প্রশ্নটির জবাব দেই। আওয়ামী লীগ আমার পরামর্শ শোনে না এবং শুনবে না জেনেও কেন পরামর্শ দেই? বর্তমানে দেশের ডানে বামে যেদিকেই তাকাই আওয়ামী লীগের বিকল্প কোন দল দেখি না। শেখ হাসিনার বিকল্প কোন নেতা-নেত্রী দেখি না। বামেও নয়, ডানেও নয়। তাই আওয়ামী লীগ সমর্থন করতে হয়। নইলে দেশ সাম্প্রদায়িক এবং মৌলবাদী দানবের কব্জায় যাবে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগই এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ও সেক্যুলারিজমের একমাত্র রক্ষাকবচ। এই কবচটি যাতে একেবারেই মলিন ও অব্যবহার্য না হয়ে যায় সেজন্য নিজের জ্ঞান ও বিবেক অনুযায়ী যতটা সম্ভব পরামর্শ দেই।
যতদিন দেশে নতুন রাজনীতি ও নতুন নীতি এবং নেতৃত্বের অভ্যুদয় না ঘটবে, ততদিন আওয়ামী লীগকে সঠিক পথে ধরে রাখার জন্য পরামর্শ দিয়ে যেতে হবেই। আওয়ামী লীগ যদি তা না শোনে, তাতে তাদের পতন তো হবেই, দেশের ক্ষতি হবে। ভারতে কংগ্রেসের পতন থেকে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শিক্ষা নেয়া উচিত। আমার মতো ভারতেরও কয়েকজন প্রবীণ বয়সের কলামিস্ট, দিনের পর দিন কংগ্রেস ও কংগ্রেস সরকারের জন্য অবিরাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। সোনিয়া-রাহুল-মনমোহন তা কানে তোলেননি। রুষ্ট গণদেবতা তার শোধ নিয়েছে শুধু ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে নয়; লোকসভাতেও একেবারে অকেজো করে দিয়ে।
বাংলাদেশের এখন যা অবস্থা, তাতে মনে হয় যে ‘সুশীল সমাজ’ এত ভাল ভাল কথা বলছে, তাদের নেতারাও কোনদিন ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এমনকি বিএনপিও না। বিএনপি এখন হালভাঙ্গা দিশাহীন নাবিক। দেশে যদি ক্ষমতার হাতবদল হয় তাহলে ক্ষমতায় আসবে হয়ত উগ্র মৌলবাদী দল এবং তার নেতা। এই আশঙ্কায় আওয়ামী লীগকে অবিরাম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। হয়ত আমৃত্যু দিয়ে যাব।
লন্ডন, মঙ্গলবার ॥
৩ জুন ২০১৪।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-06-04&ni=174905
No comments:
Post a Comment