Sunday, June 15, 2014

দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন বা নববৌদ্ধ আন্দোলন



দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন বা নববৌদ্ধ আন্দোলন 

দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ভারতের বৌদ্ধ নবজাগরণের প্রতীক
[আড়াল করো]
বৌদ্ধধর্ম
Dharma Wheel.svg
মুখ্য চরিত্রাবলি
দলিত বৌদ্ধ আন্দোলন বা নববৌদ্ধ আন্দোলন (পালি : নবযান)[১] হল বিংশ শতাব্দীতে সিংহলি বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের সহায়তায় ভারতের দলিতগণকে নিয়ে গড়ে ওঠা একটি বৌদ্ধ নবজাগরণ। ভারতের দলিত আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ভীমরাও আম্বেডকর বর্ণাশ্রম ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য হিন্দুসমাজের নিন্দাপূর্বক সমস্ত দলিত অর্থাৎ শূদ্রাদি নিম্নবর্ণীয় ব্যক্তিগণকে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হতে আহ্বান করেন এবং এর ফলে এই আন্দোলন বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে।

সূচিপত্র

 [আড়ালে রাখো]

[সম্পাদনা]উদ্ভব

বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক শাক্যমুনি বুদ্ধের পরিনির্বাণলাভের অনতিকাল পরেই বৌদ্ধ ধর্ম বিপুল প্রসার লাভ করে এবং ভারতের প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। কিন্তু খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীতেইব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থান এবং ইসলামের আগমনের ফলে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম অবলুপ্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সিংহলি বৌদ্ধ ভিক্ষু অনাগরিক ধর্মপাল কর্তৃক মহাবোধি সোসাইটিপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উক্ত সংগঠনের নেতৃত্বাধীনে ভারতে পুনরায় বৌদ্ধ ধর্মের নবজাগরণ সূচিত হয়। যদিও সেইসময় মহাবোধি সোসাইটি মূলত উচ্চবর্ণীয় ব্যক্তিদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল।

[সম্পাদনা]দক্ষিণ ভারত

[সম্পাদনা]উত্তরপ্রদেশ

নিবন্ধের এই অংশটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এই অংশটিকে সমৃদ্ধ করতে পারেন

[সম্পাদনা]ভীমরাও রামজি আম্বেডকর

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে য়েবলা সম্মেলনে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেডকর ঘোষণা করেন যে তিনি কিছুতেই একজন হিন্দুধর্মাবলম্বী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন না কারণ হিন্দুধর্ম বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্য বিভেদ এবং বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ আম্বেডকরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রত্যেকেই তাঁকে স্ব স্ব ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর বিভিন্ন বৈঠকে দলিতদের ধর্মান্তরিত হওয়ার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলি আলোচিত হয়। ১৯৩৬ সালের ২২ মে লখনউতে একটি " সর্বধর্ম সম্মেলন " অনুষ্ঠিত হয়। জগজীবন রাম সহ বহু বিশিষ্ট দলিত নেতৃবর্গ উক্ত সম্মেলনে যোগদান করেন, যদিও বাবাসাহেব আম্বেডকরএই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। এই সম্মেলনে ইসলামখ্রিস্ট ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিগণ তাঁদের ধর্মের গুণাবলি দলিত নেতাদের সামনে ব্যাখ্যা করেন।
১০ জুন১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভিক্ষু লোকনাথ বাবাসাহেব আম্বেডকরের দাদরের বাসভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। পরে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে লোকনাথ জানান যেআম্বেডকর বৌদ্ধ ধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন এবং সমগ্র দলিত সম্প্রদায়কে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। ১৯৩৭ সালে লোকনাথ তাঁর সিংহলে অবস্থিত ছাপাখানা থেকে ভারতের নিপীড়িত এবং দলিত সম্প্রদায়ের উদ্দেশে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন যাতে লিখিত হয়, বৌদ্ধ ধর্ম আপনাদের মুক্তি এনে দেবে
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের প্রথমার্ধে আম্বেডকর একবার কানপুরে অবস্থিত আচার্য ঈশ্বরদত্ত মেধার্থীর বুদ্ধিপুরী বিদ্যালয়ে ভ্রমণ করেন। ইতিপূর্বেই মেধার্থী ভিক্ষু লোকনাথ কর্তৃক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ১৯৪০ সালের মধ্যভাগে তাঁরআম্বেডকরের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। দিল্লিতে কিছুদিনের জন্য আম্বেডকর আচার্য মেধার্থীর নিকটে পালি ভাষাও শিক্ষা করেন।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে কোল্হাপুরের মহারাজ চতুর্থ সাহু কর্তৃক আয়োজিত " অব্রাহ্মণ সম্মেলন "-এ আম্বেডকর প্রথমবার বোধানন্দ মহাস্থবিরের সাক্ষাৎপ্রাপ্ত হন। ১৯৪০ সালে পর পর দু'টি অনুষ্ঠানে তাঁরা পুনরায় সাক্ষাৎ করেন এবং ধর্মবিষয়ে আলোচনা করেন। মহাস্থবির আম্বেডকরের দ্বিতীয় বিবাহে আপত্তি প্রকাশ করেন কারণ তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী ছিলেন ব্রাহ্মণ কুলজাতা। পরবর্তীকালে মহাস্থবিরের অনুগামীগণ আম্বেডকরের " রিপাবলিকান পার্টি " (Republican Party)-তে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

[সম্পাদনা]আম্বেডকরের দীক্ষা

দলিতদের জন্য একমাত্র বৌদ্ধ ধর্মই মঙ্গলপ্রদ, এই তত্ত্বের উপর বহু গ্রন্থ প্রকাশের পর আম্বেডকর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ অক্টোবর নাগপুরের দীক্ষাভূমিতেআনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। তিনি একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর কাছ থেকে ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণ করেন। এরপর সেখানে উপস্থিত তাঁর ৩৮০০০০ অনুগামীও বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সেই দীক্ষানুষ্ঠানে আচার্য ঈশ্বরদত্ত মেধার্থী এবং তাঁর শিষ্য ভোজদেব মুদিত-ও উপস্থিত ছিলেন।
এর পরবর্তীকালে বহু ধর্মান্তরিত দলিত নিজেদের " আম্বেডকর বৌদ্ধ " বলে অভিহিত করেছেন কারণ আম্বেডকরের দীক্ষাগ্রহণের মাধ্যমেই এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। আবার কেউ কেউ এই আন্দোলনকে নববৌদ্ধ আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন কারণ এর ফলে ভারতে অবলুপ্তপ্রায়বৌদ্ধ ধর্মের পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল।

[সম্পাদনা]আম্বেডকর কর্তৃক গৃহীত ২২টি শপথ

স্বয়ং দীক্ষাগ্রহণের পর আম্বেডকর তাঁর অনুগামীগণকে দীক্ষাপ্রদান করেন। ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণের পর তাঁরা সম্মিলিতভাবে ২২টি শপথ গ্রহণ করেন। এরপর ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আম্বেডকর অপর একটি গণদীক্ষার আয়োজন করেন এবং সেখানেও নবদীক্ষিত বৌদ্ধগণকে নিম্নোল্লিখিত ২২টি শপথ প্রদান করেন।
  1. আমি ব্রহ্মাবিষ্ণুমহেশ্বরের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা করব না।
  2. আমি রাম এবং কৃষ্ণ, যারা ঈশ্বরের অবতার রূপে পরিচিত, তাদের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা থেকে বিরত থাকব।
  3. আমি গৌরীগণপতি সহ অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীগণের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের আরাধনা করব না।
  4. আমি ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাস করি না।
  5. আমি ভগবান বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে স্বীকার করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। আমি মনে করি এই তত্ত্বটি একটি মিথ্যা প্রচারমাত্র।
  6. আমি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এবং মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান করা থেকে বিরত থাকব।
  7. আমি সেই সমস্ত কার্যাবলি থেকে বিরত থাকব যার দ্বারা ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার অবমাননা হয়।
  8. আমি ব্রাহ্মণগণকে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পাদন করতে দেব না।
  9. আমি মানুষের মধ্যে সাম্যে এবং ঐক্যে বিশ্বাস করব।
  10. আমি মানবসমাজে সাম্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার্থ আপ্রাণ প্রয়াস করে যাব।
  11. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুসরণ করে চলব।
  12. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত দশ পারমিতা মান্য করে চলব।
  13. আমি জগতের সকল জীবের প্রতি দয়া এবং করুণা প্রদর্শন করব এবং তাদের রক্ষা করব।
  14. আমি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করব না।
  15. আমি মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করব না এবং কখনও মিথ্যাচার করব না।
  16. আমি ইন্দ্রিয়কাম চরিতার্থ করার জন্য কোন অসাধু কার্যে লিপ্ত হব না।
  17. আমি মদ্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন করব না।
  18. আমি জীবনে প্রতিনিয়ত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুশীলনের প্রয়াস করব এবং সকলের প্রতি করুণা অভ্যাস করব।
  19. আমি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করছি কারণ হিন্দুধর্ম মনুষ্যত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে মানবসমাজে বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করেছে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করেছে। তাই আমি বৌদ্ধ ধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ধর্ম হিসেবে অবলম্বন করলাম।
  20. আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম।
  21. আমি বিশ্বাস করি যে আমি জন্মান্তরিত হয়েছি।
  22. আমি এতদ্দ্বারা ঘোষণা করছি যে আমি ভবিষ্যতে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম দর্শন এবং শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করব।

[সম্পাদনা]পাদটীকা

  1.  Omvedt, Gail. Buddhism in India : Challenging Brahmanism and Caste. 3rd ed. London/New Delhi/Thousand Oaks: Sage, 2003. pages: 2, 3-7, 8, 14-15, 19, 240, 266, 271

[সম্পাদনা]বহিঃসংযোগ

আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ


{short description of image}  CENTURIES OF BUDDHISM
A Chronology of Events of the Buddha Dhamma

{Based on 624 B.C. as the D.O.B of the Buddha and 589 B.C as the year when the Buddha attained Enlightenment}

BC/ADB.EIMPORTANT EVENTS
624 B.CBirth of the Future Buddha
    The Bodhisatta or Buddha-to-be, was born in Lumbini (in present-day Nepal) as Siddhattha, a prince of the Sakya clan. He was born a prince (c. 563 BC; Kapilavastu, Nepal) into the Gautama family of the Sakya clan.
595 B.CRenunciation
     During one of his few excursions from the protection of his father's palace, Prince Siddhattha saw an old man, a sick man, a dead man, which shocked him greatly. This revelation caused him to begin a search for truth and He renounced the householder life. (age 29)
589 B.CAttainment of Buddhahood
   The Future Buddha, the ascetic Siddhattha,sat cross-legged at the foot of the Bodhi tree with the firm resolution that he would not get up from his seat until he attained the supreme wisdom of a Buddha, and went into deep meditation. On Wednesday the full moon day ofVesakha (April-May) 589 B.C., He attained the Supreme Enlightenment of a Buddha.(Age 35)
589 B.CThe First Discourse
    The Buddha went to the Deer Park at Isipatana near Benares, in Ancient India/ Nepal, about 18 yojanas (1 yojana =about 8 miles) away and preached his First Sermon, 'Dhammacakkappavattana'to this "Group of Five Disciples" before sunset on the full moon day of 'Waso'(June-July). Kondanna was established in the first noble stage of the Ariyan Path; i.e., the Sotapatti stage of Ariyahood.
589 BCThe Second Discourse
    The Second Discourse, Anattalakkhana Sutta, followed the first one. At the end of this Discourse about Anatta (soullessness), all five Ascetics attained Arahantship.
589 BCFirst Missionaries
    After the Buddha had kept his retreat at the Deer Park at Isipatana during the first rainy season, there were fully sixty Arahants besides the Blessed One. "O Bhikkhus, wander for the gain of the many, for the good of the many, for the gain and welfare of gods and men. Preach, O Bhikkhus, the doctrine which is glorious in the beginning, glorious in the middle, glorious at the end, in spirit and in letter. Proclaim the Holy Life altogether perfect and pure. There are beings with a little dust in their eyes, who, not hearing the Doctrine will fall away. There will be those who will understand the Doctrine". With this exhortation the Buddha despatched His first missionary monks abroad.
544 B.C1 B.EPARINIBBANA
     From the date of His Enlightenment, the Buddha's successful ministry lasted 45 years. When He attained His 80th year the Buddha had an attack of dysentery and lay down on a couch with its head to the north between twin sal-trees in the Sala Grove of Kusinara State.(now Kusinagar, India) (age 80)
    Just before the Buddha passed away, he made a resolute wish that, "the bones of my body may be left over as relics in small bits" so that posterity may reverence them. Then as agreed by the rulers of the eight states, Dona the Brahmin Teacher distributed the sacred relics to them. They took the relies away and placed them inside pagodas and shrines and revered them as objects of worship.
544 BC1 B.EThe First Buddhist Council
     Subhadda, who became a bhikkhu in his old age, disparaged the Buddha's Teachings on the seventh day after the Buddha had passed away. " Venerable Mahakassapa was very alarmed and concerned about the future of the Buddha's Teachings. He suggested to hold a Council of leading Arahants to collect, classify and rehearse the teachings of the Buddha in order to protect and fortify the Buddha's Teachings. King Ajatasattu was informed of the intention of the Samgha, and with his help, the First Buddhist council was held in Sattapanni Cave Pavilion at Mount Vebhara at Rajagaha with 500 Arahants, including Venerable Upali and Venerable Ananda. It started on the fifth waning day of 'Wagaung' (August) and lasted seven months. Venerable Ananda who had the special privilege of hearing all the discourses of the Buddha recited the Dhamma (Suttas), whilst the Venerable Upali recited the Vinaya, the disciplinary rules of conduct for the Samgha.
444 B.C100 B.EThe Second Buddhist Council
     The Second Council was held at Valukarama monastery, near the city of Vesali in 100 B.E. (443 B.C), during King Kalasoka. It was held because the bhikkhus of the Vajji clan from Vesali preached and practised ten unlawful modifications in the Rules of the Order (Vinaya). The seven hundred arahats led by Venerable Yasa. Venerable Sabbakami and Venerable Revata took part in that council while King Kalasoka and the people gave necessary supports to that council, it lasted eight months. The first schism of the Sangha occurs, in which the Mahasanghika school parted ways with the traditionalist Sthaviravadins.The orthodox monks said nothing should be changed while others insisted on modifying some rules. In this Second Council, only Vinaya matters were discussed and no controversy about the Dhamma was reported. But after this Council, different schools of Buddhism emerged.
270 BCKing Asoka of India
King Asoka was the third emperor of the Mauryan dynasty of India and the best known ancient ruler of India, born in 304 BC and came to the throne in 270 BC, after a power struggle that resulted in the death of one of his brothers. In 260 BC, Asoka attacked Kalinga (present day Orissa) and was successful, but resulted in a horrible loss of life. In remorse for his bloody attack on Kalinga, Asoka renounced war forever and became a Buddhist. He sent missionaries to South East Asia, Cyrene (present day Libya), Egypt, Syria, and Macedonia. His son, Mahinda, became a Theraveda monk and was sent to introduce Buddhism to Sri Lanka. Buddhism became a dominant religious force under Asoka. Some of Asoka's edicts, carved on pillars and rocks, form the earliest known epigraphs in the subcontinent and there are 20 known pillars that Asoka commissioned. These pillars display Buddhist symbols such as the wheel and the lion. Asoka had a sculpture of four lions placed on top of each of his pillars. These lions remain a national symbol of India today. He was the first powerful monarch to practice Buddhism. He united most of the subcontinent and introduced it to Buddhism.
250 BC
(308)
294 B.E
(235)
The Third Buddhist Council
    The Third Council was held at Asokarama Monastery in the city of Pataliputta in India. Sixty thousand ascetics infiltrated into the Sangha Order, polluted the Sasana by their corrupt lives and heretical views. That is the main reason why the Third Council was held by one thousand arahats in order to protect the Sasana. At this Council, differences in the Dhamma as well as the Vinaya were discussed. The President of the Council was Venerable Moggaliputta Tissa and a book called Kathavatthu was written, refuting the heretical, false views and theories held by some disciples.
     Venerable Mahamoggaliputta Tissa presided over the council and King Siridhamm Asoka of Pataliputta gave the necessary support to the council. It lasted nine months. After the Third Council, nine missions were sent to nine different places to propagate the Sasana. The mission of five arahats to Suvannabhumi, believed to be Burma (Myanmar), was led by Venerable Sona Thera and Venerable Uttara Thera. The teaching approved and accepted by this council was known as Theravada. The Abhidhamma Pitaka was also discussed and included at this Council.
3rd Century B.C.Buddhism in Afghanistan
    Buddhism was believed to have been introduced to Afghanistan in the third century B.C. by Emperor Asoka. It found fertile soil in the former Gandhara province (nowadays, East Afghanistan and North Pakistan) around the first and second centuries A.D. under the rule of the great Kushan ruler Kanishka. Buddhist monks came and went, teaching their religion along the Chinese Silk Route. In the second century AD with the ascension of Kanishka to the throne, Afghanistan became a great seat of Buddhist learning and the arts. From this pivotal centre Buddhism reached Sinkiang, China and Mongolia. Kanishka became a Buddhist. During his long and epoch-making rulership (120 to 160 AD), Buddhism and Buddhist art and culture became the life-blood of his far-flung empire.
    There were evidence of flourishing Buddhism in year 2 B.C. in Yueh-chi, the ancient Afghanistan, as a Chinese diplomat was recorded to have sent certain Buddhist Texts to China from that area. The inscriptions on urns and earthern jars reveled the donors of non-indian races, viz: Greeks, Persians, etc. The Buddhist monuments are strewn along the tract of the great highway along the Kabul Valley. The Colossal Buddha statues, the Buddhas of Bamiyan, each Buddha being over 200 feet in height (53 metre and 38 metre high, respectively), were discovered in the Bamiyan Valley, situated 230 km NW of Kabul at an altitude of 2500 metres. It was one of the major Buddhist centres from the second century up to the time that Islam entered the valley in the ninth century. Buddha of Bamiyan The two statues were hewn out of the rock (estimates of dates vary, but most probably around the fourth and fifth centuries A.D.)
     The famous Chinese pilgrim monk, Xuan Zang, visited Afghanistan in the seventh century AD. He describes that great many monasteries were ubiquitous in Bamiyan, and the smaller statue at Bamiyan. and the stupa at its feet (no longer in existence). Early in the thirteenth century, the city of Bamiyan and all its inhabitants were swept off the face of the valley by Genghis Khan, the Mongol.
     References:
     'Buddhism and Buddhist Monuments in Afghabistan', JA Will Perera,The Light of Buddha Magazine, Vol. III, Burma Buddhist Society, 1958)
     'The Buddhas of Bamiyan', JET VAN KRIEKEN-PIETERS, 2000.
3rd Century B.C.Buddhism in Sri Lanka
    Tradition has it that the Buddha visited the island three times to bless it . Their Chronicles also recorded the first immigrants from India reaching the island on the day of His parinibbana. But it was not till two centuries later that Buddhism was firmly established when theArahant Mahinda, son of emperor Asoka, came over from India, and converted King Devanampiyatissa. Emperor Asoka despatched his daughter, Sanghamitta, who had become a nun, together with a branch of the Sacred Bodhi-Tree. Dagobhas were built all over the country to enshrine the Relics of the Buddha from the main land India. It is believed that the first images of the Buddha were made in Sri Lanka. So Sri Lanka was converted to Buddhism in the 3d cent. B.C., and Buddhism has remained its national religion.
    Maha Vihara of Great Minister at Anuradhapura and Abhayagiri Vihara were famous places. The Indian Monk, Buddhaghosa spent many years at the former and wrote many Pali Commentaries on books of Tipitaka. One of his works is the Visuddhi Magga (Path of Purity). He went across to Burma, according to Burmese tradition, to help in firm establishment of Buddhism in that land.
    The Sacred Tooth Relic of the Buddha arrived in A.D. 312. From the 5th to 9th centuries, missionery monks and nuns travelled from Sri Lanka to many countries in South East Asia. In the 10th century, the order of Monks and monasteries were almost wiped out by the invading Cholas from Southern India. But King Vijayabahu I drove them away in A.D. 1055 and invited 20 elders from Burma ( then called Ramanna) to restore the Sasana in Ceylon.
     Reference:
     Dr. G.P. Malalasekara, 'Buddhism in Ceylon', The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No.8, Burma Buddhist Society, 1958) .
150 B.C First Record of the Pali Canon
     The Buddhism Canon is reduced to writing
94 B.C
(80)
450 B.E
(464)
The Fourth Buddhist Council
     The Fourth Council was held at Cave Aloka in Malaya district, Sri Lanka, in 450 B.E (94 B.C)(80 B.C by some).
     The people of Sri Lanka were hard hit by rebels, hunger and starvation for twelve years. So the Bhikkhus had to make strong efforts to maintain the Buddha's Teachings. The elder bhikkhus foresaw that if there would appear such danger in future, the bhikkhus would not be able to memorize the discourses and the disciplines by heart because of the declination of their power of mindfulness, concentration and wisdom. Therefore, they held the Fourth Great Council.
     It was during the reign of King Vattagamani Abbaya, that five hundred bhikkhus, led by Venerable Mahadhammarakkhita, inscribed the entire words of the Buddha's Teachings on palm leaves.
     The heads and elders as well as the people of Malaya district gave all-round sup port to the council. The Fourth Great Council continued for one year.
1st Century B.CMahayana Buddhism in India
     The Mahayana emerges as a definable movement in the 1st century B.C., with the appearance of a new class of literature called the Mahayana sutras. The main philosophical tenet of the Mahayana is that all things are empty, or devoid of self-nature (sunyata). Its chief religious ideal is the bodhisattva, which supplanted the earlier ideal of the arahant, and is distinguished from it by the vow to postpone entry into nirvana (although meriting it) until all other living beings are similarly enlightened and saved.

1st Century A.DBuddhism in China
     During the 1st century A.D. Buddhism entered China along trade routes from central Asia. Chinese Buddhism encountered resistance from Confucianism and Taoism.
A.D 189732 B.EBuddhism in Vietnam
     Buddhist entered Vietnam in two significant waves. The first was a missionary wave of scholars from India during the early millennia. These were primarily Mahayana scholars. The second wave of Buddhist thought occurred about two hundred years after the common era. It is probably Chinese Master Meou-Po who was responsible for introducing Buddhism into Vietnam from China in 189 A.D. and the country was ruled by China at that time. This was a style of Buddhism filtered first through China, the Theravada school. Both of these schools of Buddhist thought co-existed throughout Vietnam.
     References:
     'Buddhism in Vietnam', Mai-Tho-Truyen, The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No. 2, Burma Buddhist Society, 1958)
     'Vietnamese Buddhism', Laura Clark and Suzanne Brown.
A.D 200744 B.ENalanda University, India
     Buddhist monastic university at Nalanda flourishes; remains a world center of Buddhist study for over 1,000 years.
3rd Century A.D.Buddhism in Burma (Myanmar)
    According to the Mahavamsa, a Pali Chronicle of the fifth century Ceylon, the Emperor Asoka sent two Buddhist Monks, Sona and Uttara, to Suvannabhumi. An inscription of the Ikshavaku Dynasty of thr Andhra region, of about the 3rd century A.D. refers to the conversion of the Kiratas to Buddhism. (Kiratas were thought to be the Tibeto-Burma peoples of Burma). Early Chinese texts of about the same date speak of a "Kingdom of Liu-Yang", where all people worshipped the Buddha and there were several thousand samanas. This kingdom has been identified with a region somewhere in Central Burma. A series of epigraphic records in Pali, Sanskrit, Pyu and Mon datable in the 6th and 7th centuries, has been recovered from Central and Lower Burma (Prome and Rangoon).
    From the 11th to 13th centuries, the kings and queens of Pagan dynasty built countless numbers of stupas and temples.
     References:
     U Tha Myat, 'Buddhism in South East Asia', The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No.8, No.1, Burma Buddhist Society, 1958
A.D 372Buddhism in Korea
    It is believed that Buddhism first arrived on the Korean peninsular in 372 A.D. when a monk arrived from China bringing Chinese texts and statues. In 384 the King of Paekje was converted to Buddhism and decreed that his subjects should follow suit. It was not until 527, however, that Buddhism became established in Shilla where it flourished. In 668 A.D. Shilla conquered the other kingdoms and Korea was unified.
A.D 425969 B.EVen. Buddhaghosa
    Ven. Buddhaghosa collates the various Sinhalese commentaries on the Canon translating into Pali. He also composed the Visuddhimagga (The Path of Purity) which eventually becomes the classic Sri Lankan textbook on the Buddha's teachings.
A.D. 5th Century
Buddhism in Cambodia
    Chinese evidence suggested that Buddhism was one of the religions of Cambodia. In the 7th century it was invaded by the Chinese Army which carried off 1,350 volumes of Buddhist Texts. But in the 9th and 10th century, Buddhism had become the dominant relgion in Cambodia.
     Reference:
     U Tha Myat, 'Buddhism in South East Asia', The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No.8, No. 1, Burma Buddhist Society, 1958

A.D 5521095 B.EBuddhism in Japan
    From China and Korea, Buddhism came to Japan. Schools of philosophy and monastic discipline were transmitted first (6th cent.–8th cent.). King Seimei of Kudara, southern part of the Korean Peninsula prsented the Emperor Kimmei of Japan with a golden image of Sakyamuni, some mahayana sutras and some Abhidhamma sutras. The famous Seven Great Nara Temples were places for the study of Buddhism and were completed by the end of Nara Period (710-784).Temples were also built in the Heian Period (794-1192), and Kamakura Period (1192-1333). The famous Sects were founded by Honen ( Jodo-shu Sect, 1133-1212), Shinran (Shin-shu Sect, 1173-1262) and Nichiren (Nichiren Sect, 1222-1282). Japanese Buddhist Sects are based on Mahayana Texts translated into Chinese from the Sanskrit originals. Zen and Pure Land grew to become popular movements after the 13th cent. After World War II new sects arose in Japan, such as the Soka Gakkai, an outgrowth of the nationalistic sect founded by Nichiren (1222–82), and the Risshokoseikai, attracting many followers.
     References:
     Makoto Nagai, D. Litt.,'Buddhism in Japan', The Light of Buddha, Vol. III, Burma Buddhist Society, Mandalay, 1958.
A.D. 6001100 B.E
    Buddhism in India begins a long, slow decline from which it would never fully recover.
A.D. 6th and 7th Centuries1300 B.E
Buddhism in Thailand
    There is no record to show exactly when Buddhism came to Thailand. It is believed that Buddhism may have come to Thailand during the Dvaravati period when Nakorn Pathom was the capital. Many of Thailand's most ancient monuments still stand there today.
    Buddhism was believed to have been introduced into Thailand for the first time by missionaries sent out by King Asoka of India, namely Sona Thera and Uttara Thera.
    For the second time, Buddhism came as Mahayana Buddhism in A.D. 700 (1300 B.E).
    For the third time it was King Anurat (Anawratha) of Pagan, Burma who re-introduced Theravada Buddhism into Thailand again in A.D. 1000 (B.E. 1600). Since then there were frequent movements of Monks between Sri lanka and Thailand, strengthening Theravada Buddhism.
     References:
     Dr. Luang Suriyabongs, 'Buddhism in Thailand', The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No.1, Burma Buddhist Society, 1958
A.D. 6th and 7th Centuries
Buddhism in Indonesia
    The Chinese record indicated that the island of Bali in the 6th century was the seat of a rich and civilizes kingdom ruled by Buddhist Kings. By about the 7th century, a great wave of Buddhism seemed to have swept all over the Indonesian islands. In the 8th century, the Buddhist Sri-Vijaya dynasty was responsible for elegant Buddhist shrines as those of Dieng Plateau (Java) and the dignified structure as the stupa of Borobudur (Java).
     References:
    U Tha Myat, 'Buddhism in South East Asia', The Light of Buddha Magazine, Vol. III, No.8, No. 1Burma Buddhist Society, 1958
A.D. 7th Centuries
Buddhism in Tibet
    In the 7th century Buddhism entered Tibet, where it has flourished, drawing its philosophical influences mainly from the Madhyamika, and its practices from the Tantra.
A.D 600's1000's B.EDecline of Buddhism in India
    Buddhism in India begins a long, slow decline.
6th/ 9th Century1100-1400 B.EDhammapala of India
    Dhammapala composed commentaries on parts of the Canon missed by Buddhaghosa (such as the Udana, Itivuttaka, Theragatha, and Therigatha), along with extensive sub-commentaries on Buddhaghosa's work.

A.D 10501594 B.EAnuradhapura, Sri Lanka
     The bhikkhu and bhikkhuni communities at Anuradhapura die out following invasions from South India.
     Bhikkhus from Pagan arrive in Polonnaruwa in 1070 A.D, Sri Lanka to reinstate the obliterated Theravada ordination line on the island.
     Polonnaruwa was destroyed by foreign invasion in 1164 A.D. With the guidance of two monks from a forest branch of the Mahavihara sect, Vens. Mahakassapa and Sariputta , King Parakramabahu reunites all bhikkhus in Sri Lanka into the Mahavihara sect.
     Bhikkhus from Kañcipuram, India arrive in Sri Lanka in 1236 A.D to revive the Theravada ordination line.
11th Century A.DTheravada Buddhism in Pagan, Burma
     Theravada Buddhism was implanted at Pagan for the first time as early as the 11th century by Burmese King Anawratha (1044-1077). Shin Arahan's advice led to acquiring thirty sets of Pali scriptures from the Mon King Manuhal by force. It was to Shin Arahan more than to anybody else that Burma owes the establishment of Theravada Buddhism. Inscriptional evidence of a Theravada Bhikkhuni nunnery noted in 1279. Towards the end of the 13th century, Buddhism declined due to the invading Tartars in 1287. In 15th century, King Dhammazedi restored Buddhism as a new chapter in the history of Buddhism in Burma. Since then successive Kings contributed immensely to the practice of Buddhism, leading to the staging of the Fifth and Six Buddhist Councils in Mandalay and Rangoon, respectively. The social life of Burma, now re-named Myanmar continues to benefit under the influence of Buddhism
A.D 1192
Buddhism disappeared in India
     The fall in standards of Buddhist Monks, the split into different sects, hostility from Brahmins and a gradual assimilation of Buddhism to Hinduism.The Brahmins have never fully accepted the growth of Buddhist faith. Right from the days of the Buddha, the orthodox Brahmins have been showing a bitter hostility. Royal Persecution and decline in the royal patronage led to ill treatment of monks and destruction of holy Buddhist establishment by Hindus. The cleverly orchestrated plot by Hindus by accepting the Buddha as an incarnation of Visnu was well conceived by the people of the time and as a consequence Buddhism lost its identity. The popular practice of rites and rituals made Hinduism an integral part of everyday life in India. A combination of these causes may have contributed to the decline of Buddhism in the last half of the first millenium AD before the Muslims' final defeat in the twelfth century when Buddhism ceased to be an organized religion in India.
     Royal Persecution: 2nd Century - Brahmin King Pusvamitra (Pushyamitra) seized the throne of Magadha and had razed to the ground as many as 1600 viharas, stupa and monasteries, put to death 900 Kotis of lay adherents of Buddhism. 6th century - Hindu King Sasanka seized power in 605 A.D. He almost destroyed the Bodhi Tree at Gaya and exterminated the Buddhist monks in the area around Kusinara. 7th century - Suddhanvan, the king of Ujjain, killed the Buddhists. Nara caused the extinction of Buddhism from Kashmir. He burnt the Buddhist viharas of Kashmir and uprooted the Buddhist population.
     The Muslim invasion. The Huns who were Mohamedans by faith invaded north-west India from central Asia at the end of the 5th century A.D. They destroyed Buddhist monasteries in Afghanistan and the north-west of India. The Muslims razed the monasteries and massacred most of the monks residing in them. The monks fled in thousands to other places inside and outside India. Muslim King Mahmud Gazinavi plundered the Buddhsit shrines at Kot Kangra (Himachal Pradesh) in the 10th century A.D. and King Bakhtiaruddin Khilji destroyed the monasteries of Nalanda and other places, giving a death-blow to Buddhism bringing its downfall in north-west India. How the Buddhist priesthood perished by the sword of the Muslim invaders has been recorded by the Muslim historians themselves. From the 7th century, Buddhism began a long and slow decline. Late in the tenth century Muslim Turks penetrated to the north-east of India, the ancient homeland of Buddhism. after the Muslim invasion Buddhism practically disappeared from north-east India. Since Hinduism was so fundamentally a part of Indian life, Muslims didn't succeed in suppressing it. But when they destroyed the Buddhist monasteries and either executed or drove out the Buddhist monks, there was no-one left to take up the religion. From 1192 to the present day, Buddhism ceased to be an organized religion in India.
13th Century
     A forest-based Sri Lankan ordination line arrives in Burma and Thailand. Theravada spreads to Laos. Thai Theravada monasteries first appear in Cambodia shortly before the Thais win their independence from the Khmers.
17th Century
Buddhism in Russia
    In the early 17th century, Tibetan Buddhism spread north from Mongolia to Buryat communities of the Baikal region. The second wave came directly from Tibet.
    Buddhism in Russia,
A.D 18712415 B.E
The Fifth Buddhist Council
     The Fifth Council was convened at Mandalay in Myanmar on the first waning day of Tazaungmone, 1232 Myanmar Era, 2415 B.E (November, 1871). The scriptures inscribed on palm-leaves could not last for a long time. Besides there might be many variations in rewriting the scriptures from copy to copy. Therefore, the scriptures were inscribed on marble slabs in order to dispel these disadvantages.
    Two thousand and four hundred bhikkhus led by Venerable Jagarabhivamsa Thera (Tipitakadhara Mahadhammarajadhirajaguru) of Dakkhinarama Monastery, Mandalay, convened, to recite and approve the scriptures. King Mindon initiated and supported the Fifth Great Council to the end. The scriptures were first inscribed on seven hundred and twenty-nine marble slabs ) in the precinct of Lokamarajina Pagoda at the foot of Mandalay Hill. It took seven years, six months and fourteen days to finish this work. Then the bhikkhus recited to approve the inscriptions for five months and three days.
     After the Fifth Great Council. the Pali Texts were translated into Myanmar language, and the Doctrinal Order was promulgated to the whole country for purpose of purification and propagation of the Buddha's Teachings.
14th Century    Another forest lineage is imported from Sri Lanka to Ayudhaya, the Thai capital. A new ordination line is also imported into Burma.

A.D 1753    King Kirti Sri Rajasinha obtains bhikkhus from the Thai court to reinstate the bhikkhu ordination line, which had died out in Sri Lanka. This is the origin of the Siyam Nikaya.
A.D 1800's    Sri Lankan Sangha deteriorates under pressure from two centuries of European colonial rule.
A.D 1862     Forest monks headed by Ven. Paññananda go to Burma for reordination, returning to Sri Lanka the following year to found the Ramañña Nikaya. {9} First translation of the Dhammapada into a Western language (German).
A.D 1879
Light of Asia
     Sir Edwin Arnold publishes his epic poem 'Light of Asia', which becomes a best-seller in England and the USA, stimulating popular Western interest in Buddhism.
A.D 1880
Sasana Flag
     Helena Blavatsky and Henry Steel Olcott, founders of the Theosophical Society, arrive in Sri Lanka from the USA, embrace Buddhism, and begin a campaign to restore Buddhism on the island by encouraging the establishment of Buddhist schools. H.S. Olcott first introduced the Sasana Flag.
A.D 1881
Pali Text Society
     Pali Text Society is founded in England by T.W. Rhys Davids; most of the Tipitaka is published in roman script and, over the next 100 years, in English translation.
A.D 1891
Maha Bodhi Society of India
     Maha Bodhi Society was founded in India by the Sri Lankan lay follower Anagarika Dharmapala, in an effort to reintroduce Buddhism to India.
A.D 18992443 B.E
First Western Theravada monk
     First Western Theravada monk (Gordon Douglas) ordains, in Burma.
A.D 19072450 B.EBuddhism in the UK
     The Buddhist Philosophy had been studied in late Victorian Britain. On his return to England from Ceylon in 1864, Robert Childers compiled his famous Pali-English dicitionary. Rhys Davids contributed a great deal in the founding of the Pali Text Society in 1881. In 1907 the Buddhist Society of Great Britain and Ireland was founded . It was succeeded in 1924 by the Buddhist Society. The Founder President was the late Judge Christmas Humphreys. In 1926 the London Buddhist Vihara was established in Chiswick, West London. Venerable Sayadaw U Thittilaof Burma arrived in England in 1938 and preached Dhamma for 14 years.
A.D 1954-562498 B.E.The Six Buddhist Council, Burma
     On the full-moon day of Kason, 1316, M.E. 2498 B.E (May, 1954), the Sixth Great Council was held in the Mahapasana Great Cave, Kaba-Aye, Yangon, Myanmar.
     The country of Myanmar had been one of the British Colonies for one hundred years and during this period the Buddha Sasana had deteriorated to some extent. So the Sixth Great Council was held aiming at the purification and promotion of the Buddha Sasana. Two thousand and five hundred bhikkhus from the five countries of Theravada Buddhism participated in that council. Nyaung Yan Sayadaw, Venerable Revata (Abhidhajamaharatthaguru), presided over it; the Mahasi Sayadaw, Venerable Sobhana (Aggamahapandita), and the Mingun Sayadaw, Venerable Vicittasarabhivamsa (Tipitakadhara Dhamma-bhandhagarika) took the leading roles in that council.
     The doctrinal questions asked by the people of five Theravada Buddhist countries: Myanmar, Sri Lanka, Thailand, Laos and Cambodia were solved magnanimously. Twenty- five other countries also gave much help to that council.
     At that Council, not only the canonical Pali Texts of the Buddha but also the commentaries and sub-commentaries were reexamined.
A.D 19562500 B.EBuddha Jayanti Year
     It commemorates 2,500 years of Buddhism.
A.D 1956Mass conversion to Buddhism in India
     Dr. B. R. Ambedkar embraced Buddhism along with his followers numbering over half a million on 14th October, 1956, at Nagpur, Maharashtra State, India, under the guidance of Ven. U Chandramany Mahathera of Kusinagar Burmese Buddhist Temple.
A.D 1958Buddhist Publication Society
     Ven. Nyanaponika Thera established the Buddhist Publication Society in Sri Lanka to publish English-language books on Theravada Buddhism.
     Two Germans ordained at the Royal Thai Embassy in London, becoming the first to take full Theravada ordination in the West. }
A.D 19692512 B.EThe Return of Vipassana to India
    The coming of Sayagyi Goenka to India in 1969 marked the return of Vipassana to the country after nearly 2,000 years, with the blessing of his teacher, Sayagyi U Ba Khin, Internationally well-known Vipassana Guru, who had formally bestowed on Shri. Satya Narayan Goenka the responsibility of Vipassana-acariya (Vipassana Teacher). Sayagyi U Ba Khin told him before he departed Rangoon that India was very ripe to receive this gem of the practice of Vipassana. In 1976 'Dhamma Giri ( Hill of Dhamma) ' opened to the public for its regular Vipassana Meditation courses. Ten years later, Sayagyi Goenka (also known as Goenkaji) made his first trip outside India to spread Vipassana around the world. Twenty years later, Dhamma Giri has grown and blossomed. Now it can accomodate and cater for more than 600 resident students and yogis on a daily basis. ( Sayagyi Goenka's Dhamma Mission)
May 1998First Theravada Website, Nibbana.com, on 'Myanmar' Buddhism
    Nibbana.com, the Theravada Website starts publishing the discourses and books written by Myanmar (Burmese) monks and distinguished scholars, from London.

March 2001Destruction of Bamiyan Statues
     The Taliban, Rulers of Afghanistan, has destroyed the giant standing statues of the Buddha, ignoring the pleas from many governments. Afghanistan was a centre of Buddhist culture before the arrival of Islam more than 1200 years ago.

Notes:
    BE = Buddhist Era: Year 1 of the Buddhist Era calendar is the year of the Buddha's Parinibbana (death): 544 B.C  =  1 B.E

REFERENCES
TitleAuthor/ Publisher
The Teachings Of The Buddha (Basic Level)Ministry of thr Religious Affairs, Myanmar,1997
The Buddha and His TeachingsVenerable Narada,1964
The Light of Buddha Magazines, Vol. IIIBurma Buddhist Society, Mandalay,1958
Vipassana Pagoda, Souvenir 26th October. 97Global Vipassana Foundation, Mumbai, India,1997

{short description of image}

{short description of image}Home PageBuddhaDhammaSanghaThe Way to NibbanaNew PagesDhamma JournalBuddhism in Burma{short description of image}
Buddhism Discussion ForumQ & ADhamma in BurmeseBecoming a BuddhistBuddhist SitesGlossaryReferencesGuestbook


This page was last updated on Tuesday, May 27, 103.

--

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হিসাবে এসে ভারতে পুনর্বাসনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা

Posted by bangalnama on December 22, 2010
 
 
4 Votes
- লিখেছেন প্রভাস চন্দ্র মজুমদার
আমার জন্ম ১৯৩৪ সালে অবিভক্ত বাংলার মৈমনসিংহ জেলার এক অজ পাড়াগাঁয়ে। দেশে তখন ইংরেজ শাসন চলছে। সুতরাং জন্মসূত্রে আমি বৃটিশ ভারতীয়। ইংরেজ শাসন-মুক্ত হয়ে দেশের স্বাধীনতা লাভ ঘটে ১৯৪৭ সালে। তখন আমার বয়স তেরো বছর। তবে স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে দেশভাগের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা জড়িয়ে থাকায় আনন্দের চেয়ে বেদনা-বোধ বেশী হয়েছিল। ইংরেজ ভারত ছেড়ে যাবার সময়ে শাসন ক্ষমতা ভাগ করে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তানের দাবীর স্বীকৃতি দিয়ে যায়। সুতরাং বৃটিশ ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হয় – ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানও আবার দুই অংশে – পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভক্ত হয়ে থাকে। অবশ্য পূর্ব-পাকিস্থান শেষ পর্যন্ত পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে 'বাংলাদেশ' নামে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। সেটা ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনা।

দেশভাগের ফলে যে সব জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছিল, তাদের মধ্যে সর্বপ্রধান উদ্বাস্তু সমস্যা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কয়েক লক্ষ লোক প্রাণ হারায় আর প্রায় দু'কোটি মানুষ বাসভূমি থেকে উৎখাত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এই উদ্বাস্তু-স্রোত বহুদিন অব্যাহত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তান থেকেই অ-মুসলমানরা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ভারতে চলে আসে। আবার কিছু মুসলমানও ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে যায়। তবে সংখ্যার বিচারে ভারতে আগত উদ্বাস্তুরা ছিল অনেক বেশী।

উদ্বাস্তু হিসাবে দেশত্যাগের পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অনেক কারণ ছিল। প্রথম ও প্রধান কারণ ধন-প্রাণের নিরাপত্তার অভাব। অ-মুসলমানরা পাকিস্তানে নিরাপদে বসবাস করতে পারবে না – এই ধারণা ক্রমশ ব্যাপক হয়ে উঠছিল। পর পর কয়েকটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রবল আতঙ্কের সৃষ্টি করে। যে সব অঞ্চলে হিংসাত্মক কার্য্যকলাপ প্রবল হয়ে উঠেছিল, সেখান থেকেই বেশী সংখ্যায় উদ্বাস্তুরা দেশত্যাগ করে। যারা অনেক দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করেও থেকে যাবে বলে ভেবেছিল, তারা শেষে নিরুপায় হয়ে ভিটে মাটি ছাড়া হল।

উদ্বাস্তুদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক(socio-economic) পার্থক্যজনিত কারণে শ্রেণী-বিভাগ ছিল। শিক্ষিত ও সঙ্গতিপন্নরা সরকারী সাহায্য ছাড়াই নিজেদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে নেয়। এদের সংখ্যা ছিল অল্প। যারা হিংসা, হানাহানি, অত্যাচার ও উৎপীড়নে ধন, প্রাণ হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিল, তারাই ছিল সংখ্যায় বেশী। এরা রিফিউজি ক্যাম্প(Refugee Camp) ও জবরদখল কলোনীতে(Squatter's Colony) অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে কোনোমতে টিঁকে ছিল। সরকারী সাহায্য ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। তার থেকেও অনেকটাই দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও রাজনৈতিক দাদারা লুটে-পুটে খেয়েছে। অনাহার, অপুষ্টি ও নানা ব্যাধিতে ভুগে মারা গিয়েছে বহুসংখ্যক।

নানারকম সরকারী নিয়মকানুনের মারপ্যাঁচে অনেকের পক্ষেই উদ্বাস্তু হিসাবে পুনর্বাসনের সাহায্য পাওয়া সহজ ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের প্রতি ভারত সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণেরও অভিযোগ আছে। উদ্বাস্তু আগমন বন্ধ করা সম্ভব না হলেও যথেষ্ট হ্রাস করার জন্য নেহরু-লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে দুই দেশেরই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, জীবন ও জীবিকার গ্যারান্টী-সহ অনেক ভালো কথা বলা হয়। কিন্তু কাজের বেলায় বিশেষ কিছু হয়নি। তার পরেও পূর্ব-পাকিস্তানে অনেক বার দাঙ্গা হয়েছে। বিপন্ন সংখ্যালঘুরা দলে দলে ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে।

কলকাতা অবিভক্ত বাংলা এবং একসময় বৃটিশ ভারতের রাজধানী ছিল বলে কর্মসূত্রে ও নানা প্রয়োজনে পূর্ব বাংলার বেশ কিছু লোক দেশভাগের আগে থেকেই এদিকে বসবাস করছিলেন। তাঁদের আত্মীয় ও বন্ধুবর্গ দেশত্যাগে মনস্থির করে তাঁদের সাহায্যের আশায় এদিকে চলে আসেন। তাঁরা সাহায্য তেমন কিছু পান নি। তবু মনে কিছু বল-ভরসা পেয়েছেন। দেশভাগের সময়ে যে সব পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ পশ্চিমবঙ্গে কিংবা ভারতের অন্যত্র বসবাস করত না, তারা দলবদ্ধভাবে একসঙ্গে এদিকে আসেনি। যার যখন যেমন প্রয়োজন বা সুবিধা হয়েছে সে সেইভাবেই এসে বহু উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে কম-বেশী থিতু হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের পরিবারের অবস্থাটা ছিল একটু ভিন্ন রকম। শৈশবে আমার পিতৃ বিয়োগ হয়। জীবনযাত্রা ছিল কৃষিভিত্তিক। কিছু জোতজমির উৎপন্ন ফসলেই কায়ক্লেশে সংসার চলত। আমার বড় দাদা ছিলেন পরিবারের অভিভাবক। পোষ্য সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। পাঁচ ভাই, বিধবা মা, এক ভ্রাতৃ-বধু, চারটি ভাইপো-ভাইঝি। সব মিলিয়ে এগারো জন। আমার দুই দিদি ছিলেন। আমার অত্যন্ত শৈশবেই তাঁদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আমাদের জীবিকার উৎস পূর্ব-পাকিস্তানের চাষজমি। ভারতে কোনো আয়ের পথ ছিল না। সুতরাং দেশত্যাগের কথা প্রথমে ভাবিনি।

আমার বড়দাদার লেখাপড়া ইংরেজ আমলের। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পাশ করার পর বহুকাল কোনো চাকরী পান নি। সামান্য পৈতৃক বিষয় সম্পত্তি দেখা শোনার কাজ করে কাটিয়েছেন। আমার এবং অন্য ভাইদের স্কুলের লেখাপড়া পূর্ব-পাকিস্তানে। আমার ছোটভাই ১৯৫৩ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুবই ভাল ফল করে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় চলে আসে। মেধা ও কর্মশক্তির সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সে ঢাকার ভারতীয় দূতাবাস থেকে Migration Certificate নিয়ে এসেছিল বলে পড়াশোনা করার সময় Refugee Stipend পেয়েছিল। আমি জেলা শহরে দিদির বাড়ীতে থেকে পড়াশোনা করেছি। ওঁরা দেশ ছেড়ে চলে আসার কথা ভাবছিলেন না বলে আমিও আরো কয়েক বছর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি.এ. পরীক্ষাটাও পাশ করে এসেছিলাম। আমি প্রায় নয় বছর পূর্ব-পাকিস্তানে বসবাস করে ১৯৫৬ সালে স্থায়ীভাবে সে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসি। ততদিনে আমাদের পরিবারের বেশ কয়েকজন ভারতে এসে বসবাস শুরু করেছে, যদিও তাদের প্রায় সবাই আর্থিক দূরবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল। আমার বড়দাদাও চব্বিশ পরগনার একটি স্কুলে শিক্ষকতা কাজ পেয়ে এদেশে সপরিবারে চলে আসেন। তার পর অল্পদিনের মধ্যেই পূর্ব-পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একরকম চুকে যায়। ঘনিষ্ঠ আপনজন ঐ দেশে আর কেউ থাকল না।

আমি পূর্ব-পাকিস্তানে স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছি। দুটো স্কুলে শিক্ষকতাও করেছি। কখনও উপদ্রব বা উৎপীড়ন সহ্য করতে হয় নি। 'কাফের' বলে কেউ কখনও কটুক্তি করেনি। সাধারণভাবে সকলের কাছে ভদ্র ব্যবহারই পেয়েছি। এ সব সত্ত্বেও জন্মভূমি ছেড়ে চলে এলাম ভবিষ্যতের কথা ভেবে। ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানে অ-মুসলমানরা সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে না এবং সুবিচার পাবে না – এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকায় দেশ ত্যাগী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হল। কম বয়সের ভাগ্যান্বেষণের প্রবল আকাঙ্খাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়।

Migration Certificate নিয়ে আসার কথাই প্রথমে ভেবেছিলাম, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও সংগ্রহ করা গেল না বলে অগত্যা পাকিস্তানী পাসপোর্ট ও ভারতীয় ভিসা নিয়েই এ দেশে আসি। এর ফলে আমি Refugee Status পাইনি এবং Rehabilitation benefits অধরাই থেকে যায়। নিজের শক্তি সামর্থ্যর ওপর ভরসা করেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছিল। পাসপোর্ট সারেন্ডার করে রেজিস্ট্রেশানের মাধ্যমে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করি। তাতে বছর দুই সময় লেগেছিল।

পূর্ব-পাকিস্তান থেকে বি.এ. পাশ করে এসেছিলাম বলে কলকাতায় এম.এ. পড়ব বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। University College of Arts and Commerce-এ ইংরেজী ও ইকনমিক্সে এম.এ. পড়ার জন্য দরখাস্ত করি। ইকনমিক্সে পড়ার চান্স পাইনি, ইংরেজীতে পেয়েছিলাম। আহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা হল যাদবপুর বিজয়গড়ের রিফিউজি কলোনীতে এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ীতে। সেখানে রিফিউজি কলোনীর জীবন যাত্রার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল। জায়গাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিলিটারি ক্যাম্প ছিল। দলে দলে উদ্বাস্তু এসে জায়গাটা দখল করে নেয়। তাড়াতাড়ি একটা সংগঠন তৈরী করে সরকারের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা শুরু হয়। পল্লীর সদস্যারা প্রত্যেকেই দেড়-দু'কাঠা জমির প্লট পায় আর তার ওপর বাঁশ, বাঁশের চাটাই ও টালি দিয়ে ঘর তৈরী হয়। বেশীর ভাগেরই কাঁচা ভিত। অল্পসংখ্যক, যাদের কিছু পুঁজি ছিল, তারা মেঝেটা পাকা করে নেয়। ঘিঞ্জি বসতি হওয়ায় আর নিকাশি ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষাকালে জল জমে দুর্দশার অন্ত ছিল না। এক কথায় ওখানকার জীবন যাত্রা ছিল প্রায় আদিম। জলের উৎস ছিল ব্যক্তিগতভাবে করা টিউবওয়েল ও পাতকুয়ো। কোনো পৌরসভা জল-সরবরাহ ও আবর্জনা পরিস্কারের দায়িত্ব নেয় নি। জমির ওপর আইনি অধিকার না থাকায় কেউই নিজের অর্থ ব্যয় করে উন্নয়নের চেষ্টা করেনি। অধিবাসীদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ যথেষ্ট না হলেও সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অভাব ছিল না। পরস্পরের বিপদে-আপদে সাহায্য করার লোকাভাব হয়নি। ক্রমে নানা রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ায় উদ্বাস্তুদের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা ও হানাহানি শুরু হয়। এতে সামাজিক পরিবেশ খারাপ হয়ে ওঠে। সামগ্রিকভাবে উদ্বাস্তুদের ওপর বাম-রাজনীতির প্রভাব ছিল বিশেষ প্রবল। CPI(M) বহুকাল উদ্বাস্তুদের ভোট ব্যাঙ্ক হিসাবে কাজে লাগিয়েছে।

আমি বিজয়গড়ে যাঁর বাড়ীতে এসে উঠেছিলাম তাঁর সঙ্গে অনেকটা পেয়িং গেস্টের মত বন্দোবস্ত ছিল। বাড়ীর উঠোনে একটা ফাঁকা টালির ঘর ছিল, সেটাতে থাকতাম, আর খাবার জন্য মাসে চল্লিশ টাকা করে দিতাম। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আসার সময় কিছু সঞ্চিত টাকা-পয়সা এনেছিলাম। তাতে কয়েক মাস চলেছিল। কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম বলে যাতায়াত ও টিফিনের খরচ ছিল। তার পর খাতা-পত্র, টুকিটাকি নানা জিনিসের পেছনেও খরচ ছিল। সব শুদ্ধ আরো গোটা পঞ্চাশেক টাকা প্রতি মাসে লাগত।

তখন ভারতীয় টাকার বিনিময় মূল্য পাকিস্তানী টাকার চেয়ে বেশী ছিল বলে। একটু কম বেশী হাজার খানেক ভারতীয় টাকা ওখান থেকে যা এনেছিলাম তার বিনিময়ে পেয়েছিলাম। হিসাব করে দেখলাম, এই টাকাতে আমার আট-ন'মাস চলতে পারে। ইংরেজী নিয়ে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট পড়ছিলাম বলে ভাল ট্যুইশান পাব আশা করেছিলাম। তাহলে দু-একশো টাকা মাসে অনায়াসেই রোজগার করা যাবে। কিন্তু যেমন আশা করেছিলা তেমন হল না। খুব কম মাইনের দু-একটার বেশী ট্যুইশান পাইনি। এতে বড় রকম আর্থিক সঙ্কটে পড়ে গেলাম। বিজয়গড়ে যাঁর ওখানে থাকতাম তাঁর খুব টানাটানির সংসার ছিল। এই কারণে প্রতি মাসের গোড়াতেই আমার দেয় টাকাটা তাঁকে দিয়ে দিতাম। যখন পুঁজি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসছিল তখন একটা গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হল। পল্লী অঞ্চলে অনেক নতুন স্কুল খোলার দরুণ স্কুল শিক্ষকের চাহিদা খুবই বেড়ে যায়। গ্র্যাজুয়েট হলে সেই কারণে সহজেই গ্রামের স্কুলে শিক্ষকের চাকরী পাওয়া যেত। আর্থিক দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে অগত্যা হুগলি জেলার এক গ্রামে শিক্ষকের চাকরী নিয়ে চলে গেলাম। University College of Arts and Commerce-এর সঙ্গে সম্পর্ক সাময়িকভাবে ছিন্ন হয়ে গেল। স্কুলে মাসিক বেতন পেতাম একশো কুড়ি টাকা। স্কুল হস্টেলে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। তার জন্য মাসে পঁচিশ-ত্রিশ টাকার বেশী খরচা হত না। মাসে সত্তর-আশি টাকা সঞ্চয় হত। সাত মাস স্কুলে চাকতি করেছিলাম। শ'-পাঁচেক টাকা পুঁজি নিয়ে স্কুলের চাকরী ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলাম কলকাতায়। আবার লেখাপড়া শুরু করলাম। এর মধ্যে আমার ছোট জামাইবাবু ভারত সরকারের চাকরীতে বদলী হয়ে কলকাতায় চলে এলেন ও উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়ায় বাসা নিলেন। বিজয়গড়ে আর ফিরে গেলাম না। দিদির ওখানে ফ্রী থাকা-খাওয়ার সুবিধা পেয়ে গেলাম বলে আর্থিক দায় অনেকটা কমে গেল। সাত আট মাস মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে এম.এ. পরীক্ষাটা দিলাম এবং ভাগ্যগুণে একটা সেকেন্ড-ক্লাস ডিগ্রী পেয়ে গেলাম।

এই ডিগ্রীটাই আমার জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার মূলধন ছিল। আমি এম.এ. পাশ করেছি ১৯৫৮-এ। এই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলের তিনটি ক্লাস ছিল – ফার্স্ট, সেকেন্ড ও থার্ড ক্লাস। ৪৫%-এর কম নম্বর পেলে থার্ড ক্লাস দেওয়া হত। সব থেকে বেশী সংখ্যক পরীক্ষার্থীর কপালে ঐ থার্ড ক্লাসই জুটত। এই জন্য একে বলা হত 'জনতা ক্লাস'। আর থার্ড ক্লাস পেয়ে পাশ করলে কলেজে পড়ানোর অযোগ্য বিবেচিত হত। নিয়মিত পড়াশোনায় ছেদ পড়া সত্ত্বেও আমার পক্ষে এম.এ.-তে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া ছিল পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। ফলটা বেরুনোর পর মনে হয়েছিল – "Too good to be true!"

পরীক্ষার ফলটা বেরুনোর পর আমার আর কর্মসংস্থান নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা রইল না। প্রথমে ছ'-সাত মাস আমার বড়দাদার কর্মস্থল গোবরডাঙ্গা খাঁটুরা স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলাম। সেখান থেকে টেলিগ্রাফিকালি Appointment Letter পেয়ে চলে গেলাম আসামের কামরূপ জেলার নলবাড়ী কলেজে। ওখানে বছর খানেক অধ্যাপনা করে ফিরে এলাম পশ্চিমবঙ্গে। এসে ইংরেজীর অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিলাম বীরভূমের রামপুরহাট কলেজে। এখানে কাজে যোগ দিই ১৯৬০ সালে। পঁয়ত্রিশ বছর কাজ করে ১৯৯৫-এ কর্মজীবন থেকে অবসর নিই। এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পেনশান পাচ্ছি আর তা দিয়েই খাওয়া-পরা চলছে।

এই হল সংক্ষেপে আমার কর্মপঞ্জী, Curriculum Vitae।

জীবনে প্রতিষ্ঠিত নিজের চেষ্টাতেই হয়েছি। কোনো সরকারী সাহায্য পাইনি।
___________________________________________________
প্রভাস চন্দ্র মজুমদার রামপুরহাট কলেজ (পশ্চিমবঙ্গ) থেকে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু – সংস্কৃতির সংঘাত

Posted by bangalnama on December 22, 2010
 
 
1 Votes
- লিখেছেন সরজিৎ মজুমদার

"দিদি, এক বাটি আটা দিতে পারেন? কাইল সক্কালে গম ভাঙ্গাইয়া আনলে ফিরত দিয়া দিমু।" পাশের বাড়ির মাসিমার কাছে আটা ধার নিয়ে এক রাত্রির খাওয়া। মাসিমাও তাঁর প্রয়োজনে কোন জিনিস ধার নিয়ে কাজ চালাতেন। এই দেওয়া নেওয়া চলত ১৯৪৭-এর পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত সহায় সম্বলহীন উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে। এরাই বাঙ্গাল। সবারই অবস্থা সমান। সকলেরই জবর দখল করা জমিতে বসবাস। তাই নাম উপনিবেশ বা কলোনি। প্রতিবেশীর কাছে এই ধরণের গৃহস্থালী প্রয়োজনীয় বস্তু ধার নেওয়ার চল ছিল পশ্চিম পাকিস্থান থেকে উচ্ছিন্ন পাঞ্জাবী শরণার্থী পরিবারদের মধ্যেও। হিন্দি সিনেমায় ছিন্নমূল পাঞ্জাবীদের এই ধরণের আটা, চিনি ধার করা ব্যঙ্গাত্মক চরিত্রে দেখানো হয় অপাঞ্জাবীদের মনোরঞ্জনের জন্য। এর পিছনে যে একদল মানুষের সমূলে উচ্ছেদের, জাতি-দাঙ্গার করুণ কাহিনী আছে তা কেউ জানাল না, জানল না। দেশছাড়াদের যন্ত্রণা কেই বা তেমন করে বোঝে? প্রখর বুদ্ধি বা অনুভবি মন থাকলেই এই যন্ত্রণা বোঝা যাবে না। পরের প্রজন্ম, আমাদেরই ছেলেমেয়েরা, আমাদের অতীতের ভয়াবহ সামাজিক সংঘাত, নতুন দেশে বাস, নতুন পরিবেশ, ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামের কষ্ট বোঝে না। দূরের মানুষ বুঝবে সে আশা কোথায়?

১৯৪৬-এর নোয়াখালির দাঙ্গা পরবর্তী সময়ে অনেক মানুষ বিষয় সম্পত্তি বিক্রি করে পূর্ব পাকিস্তানের পাট চুকিয়ে কলকাতা ও অন্যান্য জেলায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছিল। যারা সেখানেই পড়েছিল ১৯৪৭-এ নেহরু-জিন্নার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দেশ ভাগাভাগি তাদের আচমকা ধাক্কা দিল। শুরু হল অনিশ্চয়তা এবং আবার দাঙ্গার আশঙ্কা। পশ্চিমবঙ্গে স্থিতু মানুষরা হয়ত ১৯৪৭-এর ১৫ই অগাস্ট স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করেছে। যারা জাতি-দাঙ্গার রক্তরূপ দেখেছে তাদের পূর্ববাংলার ত্রস্ত দিনগুলোতে স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়া হয় নি। ১৯৪৯-এ আবার দাঙ্গা শুরু। এবার দাঙ্গা লাগল খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ জেলাগুলোতে। ভীতি-আচ্ছন্ন মানুষ দেশভাগের পর যেদিকে "আমাদের লোক" সেদিকে যাওয়াই নিরাপদ মনে করে হাজারে হাজারে শরণার্থী হয়ে চলেছিল পশ্চিমবঙ্গ অভিমুখে। কেউ এসে উঠল আত্মীয়ের বাড়ি, কেউ শরণার্থী ক্যাম্পে, কেউ জায়গা না পেয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম-এ। অনেকে পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কুচবিহারের দিকেও গিয়েছিল। বেশ কিছু উদ্বাস্তুকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আন্দামান ও দন্ডকারণ্যে। সেই ১৯৪৭-এ শরণার্থীদের ভারতে আসার স্রোত কিন্তু আজও বন্ধ হয় নি, যদিও সরকার ইদানীং কালে আসা মানুষদের উদ্বাস্তু বলে স্বীকার করে না।

কলকাতার উপকন্ঠে কলোনিগুলো তৈরি হয়েছিল ১৯৪৯-৫০ নাগাদ। টালিগঞ্জ, যাদবপুর, বাঘাযতীন, অঞ্চলে বিভিন্ন জমিদারের অব্যবহৃত-উদ্বৃত্ত জমি দখল করে শুরু হল কলোনিতে বসবাস। আমরা কলোনিতে ঠাঁই নিলাম ১৯৫৪ সালে।

১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখন কলকাতা আসি আমি তখন খুবই ছোট। বয়স তিন কী চার বছর। টুকরো টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে আছে পূর্ব পাকিস্তান ও শহর কলকাতার। মনে পড়ে গরুর গাড়ি করে নোয়াখালির এক গ্রাম ছেড়ে চলে আসার সময় বাড়ির নেড়ী কুকুর, ভুলু, অনেকটা পথ পেছনে পেছন এসেছিল। ভুলুর অনুসরণ দেখতে ভাল লাগছিল বটে। শিশু ছিলাম, জানতাম না ভুলুকে আর কোনদিন দেখতে পাব না। এসে আশ্রয় নিলাম চারঘর আত্মীয় পরিবার একসঙ্গে খিদিরপুরে এক ভাড়া বাড়িতে। মোট ৬০০ বর্গ ফুটের দুই ঘর এক বারান্দায় চার পরিবারের ২১ জন মানুষের বাসস্থান। পূর্ব পাকিস্তানে তুলনায় অপ্রতুল জায়গা।

আত্মীয় পরিজনদের দাদা-স্থানীয় প্রায় সকলেই শিক্ষা শেষ করে এদেশে এসেছিলেন এবং ১৯৫৩ সালের মধ্যে চাকরি জোগাড় করে অন্যত্র ভাড়া বাড়িতে চলে যান। আমার অগ্রজদের তখনও স্কুলশিক্ষা শেষ হয় নি। তাঁদের শিক্ষার পাট চুকতেই অবশেষে আমরা উদ্বাস্তু কলোনিতে ঠাঁই নিলাম। কলোনিতে আসার আগে আমার স্কুলে যাওয়া শুরু হয় নি। কারণ কোথায় গিয়ে স্থায়ী হব তা অনিশ্চিত ছিল। পশ্চিমবঙ্গে এসে দেখতাম পিতৃদেবের সম্পত্তি-হারানো ইংরেজ-সরকারের-৬৬-টাকা-পেনশন-সম্বল অসহায় মুখ, আর মাতৃদেবীর কঠিন মুখ – অভাবী বাস্তবের মোকাবিলায় সর্বদা প্রস্তুত। ছয় জনের পরিবারের বোঝা কম নয়। বাড়িতে দুই বেকার দাদা, স্কুলে পাঠরত দুজন – দিদি ও আমি। উদ্বাস্তুদের বরাদ্দ সরকারি স্টাইপেন্ড না পেলে কতদূর পড়াশুনা করতে পারতাম জানি না।

উদ্বাস্তু কলোনির মানুষদের ছিল অনেকটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন। কলোনিবাসীদের মধ্যে অনেকেই ছিল ছোট এবং মাঝারি চাষী পরিবারের, যারা পূর্ব পাকিস্তানে ভিটেমাটি ছেড়ে এই বাংলায় আশ্রয় নিয়েছিল। আবার অজস্র ভূমিহীন উদ্বাস্তুও এসেছিল সেই সময়। দেশের কৃষক এবং ভূমিহীন পরিবারের পার্থক্য কলোনিতে এসে বরাবর। সব পরিবারেই শোনা যেত ফুল্লরার বারোমাস্যা। প্রতিবেশীর মধ্যে এটা সেটা ধার করা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যতিক্রমী কিছু খাবার তৈরি হলে প্রতিবেশীকে ভাগ দেওয়া। সবার বাড়িতে ঘড়ির মত প্রয়োজনীয় যন্ত্রও ছিল না। পাশে যার বাড়িতে ঘড়ি ছিল তার কাছে সময় জেনে নিতে হত। এক বাড়ির খবরের কাগজ তিন চার বাড়ির লোকে পড়ত। খেলায় উৎসাহী ছোটরা বড়দের কাছে খবর জেনে নিত ইস্টবেঙ্গল ক'টা গোল দিয়েছে। রেডিও ছিল বিলাসিতা। রবিবার অনুরোধের আসরের গান শুনতে যেতে হত অন্য পাড়ায়। যে বাড়িতে রেডিও ছিল সেই বাড়ির রাস্তার ধারে বসে একদল ছেলে গান শুনতাম।

এছাড়াও জমি দখলের সংগ্রাম ভেদাভেদমুক্ত পরিবারগুলোকে নিবিড়ভাবে জুড়ে দিয়েছিল। যেসব জমিদারিতে কলোনি গড়ে উঠল সেই জমিদারও ছাড়বার পাত্র নন। তারা রাতে লেঠেল পাঠাত বসতি উৎখাতের জন্য। কলোনিবাসীরা লেঠেল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সকলে একসাথে লড়াই করত। সবারই উদ্দেশ্য এক – আশ্রয়টুকু ধরে রাখা।

কলোনির পরিবেশ পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা পরিবেশ থেকে খুব একটা আলাদা ছিল না। অন্তত খিদিরপুরের রুক্ষ কংক্রিট-সর্বস্ব পরিবেশের থেকে অনেক বেশি সহনীয় ছিল। গাছ গাছালি, মাঠ, পুকুর, টিনের চালার বেড়ার বাড়ি, মাটির মেঝে, সবই ছিল পরিচিত। ছিল না শুধু চাষের জমি এবং খাদ্য নিশ্চয়তা। সামর্থ্য অনুযায়ী অল্পেই সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল মায়ের কঠিন শৃঙ্খলায়, অনুশাসনে। ঘরে, বাইরে পিতৃস্থানীয়রা কলোনির ছেলেমেয়েদের ভালভাবে বড় হয়ে ওঠার এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার "প্রাথমিক সূত্র" ধরিয়ে দিয়েছিলেন – "পড়াশুনা করে বৃহত্তর সমাজের দরবারে নিজেদের তুলে ধর"। কলোনির ঘরে ঘরে পড়াশুনার চল ছিল। "প্রাথমিক সূত্রের" জোরে আজ অনেকেই পৃথিবীর নানা দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের নাম উজ্জ্বল করেছে।

সকলের বেশিদূর পড়াশুনা সম্ভব হয় নি। আর্থিক অনটনের দরুণ বৃদ্ধ বাবা-মা'র ১৫ বছরের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে স্কুলের পড়া ছেড়ে আই.টি.আই-তে কারিগরি শিক্ষা নিয়ে চাকরিতে যোগ দিতে হয়েছে। ১৯৫০-৬০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গ ছিল সারা ভারতের বৃহত্তম শিল্প কেন্দ্র। কারিগরি শিক্ষা শেষে চাকরি পেতে কারুর অসুবিধা হয় নি। স্কুলছুট হলেও উদ্বাস্তু প্রতিবেশীদের মধ্যে জোরালো সদ্ভাব অটুট ছিল। সদ্ভাবে ভাটা পড়েছে ১৯৮০-এর দশকের পরে।

কলোনির ভিতরে সবাই আমরা সমান ছিলাম, দু একটা পরিবার বাদে। কলোনি তৈরি হওয়ার আগেই ঐসব অঞ্চলে কিছু কিছু ব্যক্তিমালিকানার ঘর বাড়ি ছিল। সেসব বাড়ির ছেলেমেয়েরা আমাদের সঙ্গে বিশেষ মিশত না। তারা কলোনির স্কুলে – গরিবী চেতনার আতুরঘরে – পড়তে আসত না। তারা পড়ত সাউথ পয়েন্ট, তীর্থপতি ইন্সটিট্যুশনের মত স্কুলে। ছোট ছিলাম, এই বিভেদ বোঝার বুদ্ধি হয় নি। তাছাড়া এই সামান্য দু'একটা পরিবারের উন্নাসিকতা মনে কোন দাগও কাটেনি। এখন ফিরে তাকালে বুঝতে পারি এটা ছিল সংস্কৃতির বিভেদ।

কিন্তু কলেজ জীবনে কলোনির বাইরে যখন পা বাড়ালাম তখন বুঝলাম বাঙ্গাল উদ্বাস্তুরা কলকাতার বনেদি মানুষের কাছে এক আজব প্রাণী। রানীকুঠিতে সরকারি আবাসনের পাশেই কলকাতার বনেদি কিছু পরিবারের ব্যক্তিগত বাড়ি আছে। সেই আবাসন ও বাড়িগুলো ১৯৭০-এর দশকে দেওয়াল ঘেরা এক বাদা জমিতে গড়ে ওঠে। সেই বাড়িগুলোর দুই মালিকের কথোপকথনে পার্শ্ববর্তী উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে তাঁদের দৃষ্টিকোণ পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম। এক মালিক রানীকুঠি অঞ্চলে বাড়ি তৈরি করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। তাঁর ধারণা একে কলোনি অঞ্চল, তার ওপর কচুবন, ঝোপঝাড়ে ভরা জায়গা নিশ্চয়ই শহুরে বাবুদের পক্ষে ভাল হবে না। তাকে আর এক মালিক অভয় দিয়ে বললেন "কচুবন কোথায়? সে তো বাঙ্গালরা খেয়েই সাফ করে দিয়েছে।" বাঙ্গালরা জঞ্জাল খেয়ে সাফ করে দিলে কলকাতার বাবুদের থাকতে আর বাধা কোথায়? কলকাতার উপকন্ঠে আমরা যেন কিছু অবমানব।

তারও আগে ১৯৬৯ সালে যখন এম.এ পড়ি তখন আরও মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক বন্ধুকে বাক্য গঠনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলার dialect-এর সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলো বলেছিলাম। বন্ধুটি মজা পেয়ে সম্ভবত আমার অন্য সহপাঠীদের এবিষয়ে কিছু বলেছিল। একদিন উত্তর কলকাতার ফটফটিয়ে-ইংরাজি-বলা বনেদি বসু পরিবারের এক সহপাঠী আমাকে মাঠে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, "এই তুই না কী অনেক খিস্তি জানিস! আমাদের একটু শোনাবি?" প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও খানিক্ষণ পরে বুঝেছিলাম সে পূর্ববঙ্গের dialect, যা তার ভাষায় "খিস্তি", শুনতে চায়। একে বাঙ্গাল, তাহে উদ্বাস্তু। তাদের মাতৃভাষা অন্য সংস্কৃতির দৃষ্টিতে হয়ে দাঁড়ায় "খিস্তি।" এখানেই তৈরি হয় একটা দূরত্ব। অবশ্য কলকাতার সব স্থানীয় মানুষই একরকম নয়। আমার অনেক বন্ধু ছিল, এবং এখনও আছে যারা আমার সহমর্মী, সমব্যথী। এমনই এক শ্রমিকদরদী, পরিবেশপ্রেমী বন্ধু বাংলাদেশী বা বাঙ্গালদের অতিথি পরায়ণতার কথা প্রায়ই উল্লেখ করেন। মানব গঠন প্রক্রিয়া এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হয়ত কলকাতার স্থানীয় মানুষদের দু'দলে বিভক্ত করে দিয়েছে। তাই সবাইকে একই চোখে দেখা সম্ভব নয়, উচিতও নয়।

তবুও একটা ভয় – আমার সংস্কৃতিকে খাটো হতে দেখার ভয় – সব সময় পিছু তাড়া করেছে একটা সময়। এখনও "হ্যাঁ", "দাঁড়িয়ে" প্রভৃতি বানান লিখতে গেলে চন্দ্রবিন্দু দিতে ভুলে যাই। অতীতের মাতৃভাষা-খিস্তির সাংস্কৃতিক সংঘাত ভুলতে পারি নি। সন্দেহ হয় কোন অস্তিত্বটা আমার। আমি কোন উচ্চারণে কথা বলব? আমার বাঙ্গাল উচ্চারণে কথা বললে কেউ বুঝে নেবে না কেন? আমি কী পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা বাঙাল-উদ্বাস্তু না কী কলকাতারই একজন?

যৌবনে এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতেই মনে পড়ে যেত গুরুজনদের উপদেশাত্মক "প্রাথমিক সূত্র।" সঙ্গে যোগ করে নিয়েছিলাম উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং জীবনে বন্ধুর পথ অতিক্রম করার সঙ্কল্প। এটা আমার একার নয়, প্রায় সকলেই জানত পরভূমে শিরদাঁড়া শক্ত করে না দাঁড়ালে ছাগলে মুড়ে খাবে। তাই একদিকে লেঠেল তাড়িয়ে আশ্রয় সুনিশ্চিত করার সংগ্রাম, আর এক দিকে বৃহত্তর সমাজের মোকাবিলার জন্য উদ্বাস্তুদের গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিকল্প ছিল না।

উদ্বাস্তুদের সমষ্টিগত সংগ্রামের মাধ্যমেই ১৯৫০ সালে গড়ে উঠেছিল বাস্তুহারা পরিষদ। এই পরিষদেরই পরবর্তী রূপান্তর ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল (ইউ.সি.আর.সি)। কলকাতা ও ২৪-পরগনার বিভিন্ন বাস্তুহারা সংগঠন – নিখিল বঙ্গ বাস্তুহারা কর্ম পরিষদ, দক্ষিণ কলিকাতা শহরতলী বাস্তুহারা সমিতি, উত্তর কলিকাতা বাস্তুহারা সমিতি ইত্যাদি – একত্র করে এই কাউন্সিল গঠিত হয়। ইউ.সি.আর.সি-র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কলোনিবাসীর জমির অধিকার স্বীকৃত হতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩৫ বছর। ১৯৮৫ সালে উদ্বাস্তুদের রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন দফতর থেকে জমি অধিকারের অর্পণপত্র দেওয়া হয়েছিল। পরে সেই জমির মালিকানাও দেওয়া হয়। তখন থেকেই উদ্বাস্তুদের গোষ্ঠী বাঁধুনিটা অনেক আলগা হয়ে এল। কারণ, এতগুলো বছরে উদ্বাস্তু পরিবারের অনেক যুবক উচ্চশিক্ষা বা কারিগরিবিদ্যা অর্জন করে নিজেদের ভবিষ্যত সুনিশ্চিত করে ফেলেছিল। তখন আর পাশের বাড়ির মাসিমার কাছে আটা ধার করার প্রয়োজন নেই। আর যারা এভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি, তারা জমির মালিকানার সুযোগ নিয়ে নিজেদের জমির ওপর পাঁচতলা বাড়ি প্রমোট করে দেদার টাকা আয় করতে লাগল। এইসব বাড়িতে যেসব নতুন মানুষ এল, তারা কলোনির অতীত সংগ্রামী দিনগুলোর কথা জানে না। তারা কেউ কারুর সমব্যথী নয়।

উদ্বাস্তু হয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা এলাম তারা একাধিক অর্থে ছিন্নমূল চরিত্র। জন্মভূমি থেকে ছিন্ন। স্থাবর সম্পত্তি, কৃষি জমি থেকে উচ্ছিন্ন। পূর্ববঙ্গের সমাজ সংস্কৃতি বিসর্জন। জন্মভূমি, পুরনো সংস্কৃতি ছেড়ে যখন এলাম তখন কলকাতায় খুঁটি গাড়লাম কী গুজরাতে বা কর্ণাটকে, তাতে কী এসে যেত? সব জায়গাতেই সংস্কৃতির সংঘাত হত। আমাদের মাতৃভাষার জায়গা কলকাতাতেই আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যথার জায়গা পরিচয় সঙ্কট। আমরা কোথাকার মানুষ? ১৯৪৭-এর আগে ছিলাম ভারতবর্ষে। ১৯৫০–এ আবার এলাম ভারতবর্ষে। এটা প্রহসন ছাড়া আর কী?
Be the first to like this post.

One Response to "পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু – সংস্কৃতির সংঘাত"

  1. Soumitra Bose said

    0
    0
     
     
    Rate This
    Oral ebong Aural history i ashol historicism ba itihaas chorjya. Itihaas sudhu chorchar bishoibostui noi, ta yakta chorjya o bote. Uponibesher manush ra ba refugee ra sara prithibiteti ek dhoroner ajob projatir manush, tara bneche thake bortomane kintu itihaas tader kachhe yakta Gham- orthat onekta bedona-bilash, ei bilash e smritimedurota jyamon achhe, bedonar modhye diye yakrokom osmita bodho-o achhe. Tachilyo onek somoie bhushan hoi, amader khetreo tai, etai amader diyechhe yak omogh atmoporichoi ebong yamonki atmombhorita, ei samuheek-samajeek atmombhorita i bneche thakar o lorai korar ebong protijogitar roshod dyai- ei orthe itihaas yakta jeebon chorjya- sudhu chorcha noi. itihaas yakta japon kriya, anra bneche thaki, yak kalponeek oteet ke songye nie jar kono bortoman ostityo kothao nei, ebong amra ta konodin dekhi o ni, ei o-bastob kalponik binirman amader kachhe khubi prasongeek o bastob- refugee manoshikota r etai japon kriya.
    Lekhok Sarajit babu ke dhonyobad, choto choto japon kriya ke tini sahityik shikriti dilen, mone porchhe Mihir gongopadhyay er borishal er kotokotha… eta dokhin er japon kriyar jholok. eguloi itihaas, secondary notes itihaas noi, sarajit babur kotokotha BANGALNAMA.COM er modhye diye doleel hoye uthlo, erpor manush etake prosongo banabe, tokhon seta hobe secondary text. Eta amader colonial mindset, ja post-colonial psycher modhye colonial gouvernmentalism niye bneche achhe, karon amra yakhono de-colonised hote pari ni. Sarajit babu etake bhanglen, etai amader oitihashik matra. itihaas amader modhye proti muhurte bneche acche, itihaas amader kachhe sudhu tai choryao noi, jaapon kriya o bote.


বিদেশী সংবাদপত্রে ১৯৭১: কীসের জন্য তারা পালিয়ে গেল?

পত্রিকার নাম: দি ইকোনমিস্ট
প্রকাশকাল: ১২ জুন, ১৯৭১

কলকাতা থেকে বিশেষ প্রতিনিধির পাঠানো রিপোর্ট

অনুবাদ করেছেন: ফাহমিদুল হক

শিরোনাম ছিল:কীসের জন্য তারা পালিয়ে গেল?

'আমাদের জনসংযোগের যন্ত্র প্রস্তুত ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনীর জনসংযোগ-কর্মকর্তারা ২৫ ও ২৬ মার্চে ঢাকায় ছিলেন না, এবং আমরা অবশ্যই সেখানে বিদেশী প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটা ভুল করেছিলাম।' একজন সিনিয়র পশ্চিম পাকিস্তানি কূটনীতিক এভাবে স্বীকার করলেন যে পূর্ব পাকিস্তানকে তার সরকার যেভাবে মোকাবেলা করেছে তা পুরোপুরি সঠিক ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে কী এমন ঘটেছে যে পৃথিবীর সবচাইতে জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীর ৫০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে উদ্বাস্তুতে পরিণত হলো?

শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা ২৫ মার্চের রাতে অভিযান চালিয়ে গুলিবর্ষণ করে ও ঢাকার একাংশ ধ্বংস করে ফেলে এবং পরের ছয় মাসে পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ অংশে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। এর ফলে লাখ লাখ উদ্বাস্তু সীমান্তবর্তী ভারতীয় রাজ্যগুলোতে পালিয়ে যায়। সেনাবাহিনীর মতে মার্চে আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল এবং এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসরত হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারীরা ( এরা পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে সবসময় ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত) বাঙালিদের দ্বারা নিগৃহীত হতো। আর সেনাবাহিনীর সেদিনের দ্রুত পদক্ষেপ সবকিছু রক্ষা করে।

ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সদস্য এবং পুলিশ ও আধা সামরিক সীমান্তরক্ষীরা সেদিন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা, যারা ভারতে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তারা স্বীকার করেছেন বেশ কিছু পাঞ্জাবী ও বিহারী নিহত হয়েছিল। কিন্তু এটা কোনো পরিকল্পিত ঘটনা ছিল না। কী ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝার আগেই অনেক সৈন্য ও পুলিশকে ধরা হয়েছিল, অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছিল, হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মুজিবকে তার বাসভবন থেকে ধরা হয়েছিল এবং তারা দলের নেতাদের কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, কেউ অল্পের জন্য পালিয়ে বেঁচেছিলেন। সহিংসতা দুই দিক থেকেই হয়েছিল, এবিষয়ে অল্প হলেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মুসলিম ও হিন্দু (এবং খ্রিস্টান), শিক্ষিত ও অশিক্ষিত উদ্বাস্তুর ঢল দেখে বোঝা যায়, জনগোষ্ঠীর প্রধান কেন্দ্রগুলোত নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের জন্য যা করা প্রয়োজন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তার চাইতে বেশি কিছু করেছে।

সেনাবাহিনী কী করেছে? প্রতিটি অভিযানের পর দেখা গেছে গ্রামগুলো পুড়ে ছাই হয়েছে এবং মানুষগুলো মরেছে। একটি ব্যাখ্যা এরকম আছে যে, মাত্র ৭০,০০০ সৈন্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার পুরো পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে এধরনের সহিংসতার পথই নিতে হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য এধরনের নীতি ক্ষতিকর। কারণ রাজনৈতিক সমাধান অস্ত্রের শক্তির ওপর নির্ভর করে না, এখানে মানুষের গণহারে দেশত্যাগের ব্যাপারও রয়েছে। কিছু শিক্ষিত উদ্বাস্তু ব্যাখ্যা দিলেন, 'সৈন্যদের গুলি করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য অফিসাররা তাদের বলে যে এটা একটা ধর্মযুদ্ধ। তারা বলেছে যে ইসলামী রাষ্ট্রটি হিন্দু, আওয়ামী লীগ নেতা ও বুদ্ধিজীবিদের কারণে হুমকির সম্মুখিন।'

মৃত, ধৃত অথবা পলাতক বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবী ও আওয়ামী নেতাদের হিন্দু দেখতে পেলে সেনাবাহিনী খুশি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৭ কোটি জনগোষ্ঠীর এক কোটি হিন্দু এবং এরা গণহারে সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু কেবল সেনাবাহিনীই হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়েছে তা নয়। বিহারী ও ডানপন্থী মুসলিম লীগারদের নিয়ে সম্প্রতি গ্রামে গ্রামে গঠিত তথাকথিত শান্তিকমিটির সদস্যরাও হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে, লুট করেছে এবং তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

সীমান্তাঞ্চলে যে যে স্থানে সেনাবাহিনীর শক্তি বেশি এবং যে যে স্থানে সেনাবাহিনী তাদের অভিযান চালিয়েছে সেখানকার লোকজনের সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে যাবার হার বেশি। প্রথমে এই পালিয়ে যাবার হার ছিল মোটামুটিভাবে অর্ধেক মুসলমান, অর্ধেক হিন্দু। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকে যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, হিন্দুদের পালিয়ে যাবার হার তখন অনেক বেড়ে যায়। ভারতের যেসব রাজ্যে তারা বেশি পরিমাণে যেতে থাকে, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা, সেসব রাজ্যে এই আশংকা কাজ করা শুরু হয় যে সীমান্তের ওপারে একজন হিন্দু থাকা পর্যন্ত এই প্রবাহ চলতে থাকবে। প্রথমে উদ্বাস্তুর সংখ্যা শুনে মনে হয়েছে রাজ্যগুলো কেন্দ্রের সাড়া দ্রুত পেতে হয়ত সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে। কিন্তু জাতিসংঘের স্থানীয় সংস্থাগুলো ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো এই সংখ্যাই যে সঠিক তা গুরুত্বাসহকারে বলেছে। বরং মোট সংখ্যার অর্ধেকরও বেশি ক্যাম্পে অবস্থান করছে বলে সহজে গণনা করা গেছে। বাকিদের সীমান্তে এবং খাবার বিতরণের স্থানে গণনা করা সম্ভব হয়েছে। গত সপ্তাহের মাঝামাঝি ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের হিসেব মতে সাম্প্রতিকতম মোট সংখ্যা হলো ৪৭ লক্ষ, যার মধ্যে ২৭ লক্ষ ক্যাম্পে অবস্থান করছে এবং বাকিরা বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের বাসায় অবস্থান করছে অথবা নিজেদের মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে।

ভারতের প্রাথমিক নীতি ছিল উদ্বাস্তুদের সীমান্তের কাছাকাছি সীমাবদ্ধ রাখতে। এখন সেটা আর কার্যকর নেই। ত্রিপুরার জনসংখ্যা এখন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সীমান্ত এলাকায় বেড়ে গিয়েছে, যেসব উদ্বাস্তু ক্যাম্পে নেই তাদের কারণে শ্রমের মজুরি কমে গেছে। কিছু এলাকায়, যেমন পশ্চিমবঙ্গে, নতুন ক্যাম্প স্থাপন করার জন্য খুব সামান্যই স্থান খালি আছে। সহিংসতার হুমকি প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে কারণ ভারতীয় সীমান্তাঞ্চলের বেশিরভাগ লোকই হলো মুসলমান। ক্যাম্পগুলোর প্রশাসননিক সাফল্য ভালোই বলতে হবে, যেক্ষেত্রে সীমান্তঅঞ্চলগুলোতে কাজ করাটাই ম্যজিস্ট্রেটদের জন্য বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে এসেছে। কলেরা মাহামারি বাকি বিশ্বকে হতবাক করে দিলেও, অনেক বৈদেশিক সংস্থাই কলেরা প্রতিরোধের জন্য কয়েক সপ্তাহ যাবত কাজ শুরু করে দিয়েছে। ভারতীয় সরকারের মে মাসের কেনাকাটার তালিকায় ২৫০,০০০টি তাঁবু ও ত্রিপল থাকলেও তাকে বাড়াতে হবে, যদিও কেউই জানে না কখন প্রকৃত দাবিকে স্পর্শ করা যাবে।

যদি ভারতে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে থাকে, তবে পাকিস্তানে অবস্থা অবশ্যই তার চাইতেও খারাপ। এঅঞ্চলের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম থেকে সারা দেশের বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহর এবং গ্রামে জনগণের অসম চলাচল রয়েছে। গত নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষত এখনও সারিয়ে তোলা হয়নি। যানবহনগুলোকে খাদ্য-পরিবহণের পরিবর্তে সৈন্য-পরিবহণের কাজে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক এলাকাতেই বর্ষা-পরবর্তী প্রধান ফসল ধানের বীজ বপন করা হয়নি। পাকিস্তান নীতিগতভাবে পূর্বাংশে জাতিসংঘের সাহায্য গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পরিবর্তন। একজন কেবল এটাই আশা করতে পারে যে, প্রক্রিয়াটিতে যেন খুব বেশি দেরি না হয়।

লাখ লাখ মানুষের যাত্রা: বিদেশী পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধ, পর্ব ৩৯

০৮ ই জুলাই, ২০০৮ রাত ১০:০৪

শেয়ার করুনঃ
000
সুনন্দ দত্ত-রায়

দি অবজারভার 
১৩ জুন, ১৯৭১।

পূর্ব-পাকিস্তান জুড়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা যেভাবে দেশটিকে জনমানুষশূন্য করে তুলেছে তা দেখে যেকেউ হতাশ হবে। দেশবিভাগের পর থেকে এই মুসলিম দেশে এক কোটি হিন্দু আশা নিয়ে বেঁচে ছিল এবং এরপর ২৩ বছর ধরে অবিচার ও নিবর্তন ভোগ করেছে, এরপর সবশেষে তারা বুঝতে পেরেছে তাদের একমাত্র আশার প্রতিফলন ভারতেই রয়েছে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে এই গণদেশত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত ষাট লাখেরও বেশি মানুষ চলে গিয়েছে। কিছু লোক গিয়েছে সাম্প্রদায়িক ভাবনা থেকে তাদের মহিলাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে। বাকিরা গিয়েছে চাকরি হারানোর পরে, জায়গাজমি খোয়ানোর পরে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলেও হাজার হাজার লোক চলে গিয়েছে; অন্যান্যরা ভারতে চলে গিয়েছে কারণ জীবনের অনিশ্চয়তার ভার তারা আর বইতে পারেনি। 

গত বছরের কোনো এক সময়ে পূর্ববাংলায় এখনও অবস্থানরত হিন্দুরা আওয়ামী লীগের শেখ মুজিবের দেয়া প্রতিশ্র"তি অনুসারে সব ধর্মের মানুষের জন্য সমান জীবনের দাবিতে মিছিল করেছে। শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল এবং বর্তমানে জেলে বন্দি আছেন। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যকে নির্দেশ দেয়া হলো শেখকে শেষ করে দেবার জন্য, সৈন্যদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক যারা আছে, তাদেরও কট্টর হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।

কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশ-মিশনের (পূর্ব পাকিস্তান-মিশন) প্রধান হোসেন আলি বলেন সামরিক শাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান তার অফিসারদের ডেকে নিয়ে হিন্দু লোকজনকে হত্যা করার জন্য ও হিন্দু মেয়েদের ধর্ষণ করার জন্য ও তাদের ফসল নষ্ট করে দেবার জন্য বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরকম নির্দেশ দেয়া হোক বা না হোক, সৈন্যদের কাজকারবার দেখে মনে হয় তেমনই কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু যে দেশে হিন্দু ও মুসলমানরা একই পোশাক পরিধান করে, একই খাবার খায়, একই উপভাষায় কথা বলে, বেসামরিক লোকদের সাহায্য ছাড়া ঐ নির্দেশ পালন করা সম্ভব ছিল না। 

পূর্ব-বাংলায় 'স্বাভাবিকত্ব ফিরিয়ে আনা'র জন্য গঠিত 'শান্তি-কমিটি' এখন কাজগুলো করছে। লিফলেট দিয়ে এবং লাউড-স্পিকারের মাধ্যমে তারা মুসলমানদের আহ্বান করছে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের সম্পত্তি দখল করার জন্য। আওয়ামী লীগের মুসলমানরা ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শান্তি রক্ষার কাজে যোগ দিতে পারে এবং দেশে থেকে যেতে পারে। যেসব হিন্দুরা আওয়ামী লীগকে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভোট দিয়েছে তাদের অবশ্যই চলে যেতে হবে। ফলে ২৫ মার্চের পর থেকে ৪০ লাখ হিন্দু উদ্বাস্তু সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গিয়েছে। যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলেও যায়, হিন্দুরা আর ফিরতে চাইবে না। অন্যদিকে ভারতকে বাকি ষাট লাখ হিন্দুকে, যারা এখনও পূর্ববঙ্গে রয়েছে ও তাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তাদের গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। 

শেখ মুজিবের বাংলাদেশ-আন্দোলনের সময় দু'ধরনের হিন্দু পূর্ববাংলায় ছিল। তাদের একদল ছিল পেশাজীবী লোকজন যাদের জীবন সম্পর্কে পরিকল্পনা ছিল এবং মুহূর্তের নোটিশে দেশত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল। অন্যদল ছিল কৃষকরা যাদের এখন বাধ্য হয়ে যেতে হবে। সফল আইনজীবীরা বাঁশের চাটাইয়ের বা টিনের তৈরী ঘরে থাকতো। ডাক্তাররা নড়বড়ে ঘরে প্র্যাকটিস করতো। তাদের জীবন, ছেলেমেয়ে ও অর্থ সবকিছু নিরাপত্তার জন্য ভারতে পাঠিয়ে দেয়া হতো। অন্য হিন্দুরা ছিল কৃষক, কামার, জেলে, তাঁতি এবং এরা সবাই নিুবর্ণের হিন্দু ছিল। 

বর্তমানে কলকাতায় অবস্থানরত একজন ফেরারী মধ্যবিত্ত হলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার ডিজাইন সেন্টারের প্রধান। তিনি নিশ্চিত যে ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য ছিল দুই ধর্মের মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শেষ করে দেয়া, পুরোপুরি রাজনৈতিক একটি ব্যাপারকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং ভারতীয় মুসলমানদের ওপর পাল্টা আঘাত হানাকে উসকে দেয়া। এধরনের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত সৃষ্টি হতে দেখে বিশ্বের হয়তো সামরিক শাসনের প্রকৃত নিপীড়নমূলক ভূমিকা থেকে দৃষ্টি সরে যাবে। 

এই পরিকল্পনা হয়তো ভালোভাবে বাস্তবায়িত হতো যদি না হিন্দু উদ্বাস্তুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ না হয়ে যেতো। এরপরও ভারতীয় সীমান্ত-শহর বারাসাত ও বসিরহাটে কিছু সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পুলিশের একটি শক্তিশালি দল হিন্দু উদ্বাস্তুদের নিবৃত্ত করতে পেরেছিল। তারা বর্শা, ছুরি, লাঠি হাতে মুর্শিদাবাদ থেকে এখানকার মুসলমানদের ওপর আক্রমণ করতে এসেছিল। একজন উদ্বাস্তু বলল, "শান্তি-কমিটির লোকজন আমাদের বলেছে ভারতে চলে যেতে কারণ এখানেই নাকি আমাদের সবার জন্য খাদ্য ও জমি আছে। এখন আমরা এখানে মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যেতে বলব"।

এরমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বের শহর সিলেটে হিন্দুদের পরিত্যক্ত বাড়িগুলো স্থানীয় মুসলমানরা ন্যূনতম মূল্যে নিলামে তুলেছে। এমনকি ঢাকায় পরিত্যক্ত বাড়িগুলো বণ্টনের একটি আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হয়েছে। ইয়াহিয়া খানের সরকারের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে ধানী জমি বণ্টন করা হয়েছে। এপরিস্থিতিতে নিরাপদে দেশে ফিরে যাবার জন্য ইয়াহিয়ার প্রস্তাব উদ্বাস্তুদের পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন। 

হাসান মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম দালালরা বাঙালি নয়। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রি নূরুল আমিন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টোর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী। কিন্তু তিনিও সামরিক শাসকদের অধীনে পুতুল সরকারের প্রধান হতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এই প্রত্যাখান অন্তঃত একটি ভুয়া গণতান্ত্রিক সরকারের সম্ভাবনাও নাকচ করে দেয় এবং সামরিক শাসন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খানের শাসনের প্রতি কেবল মুসলিম লীগ (যারা সবসময় সামরিক শাসনকে সমর্থন করে এসেছে) এবং কট্টর ইসলামী দল জামায়াত-ই-ইসলামী ও নিজামী-ই-ইসলাম-এর লোকজনের আনুগত্য আছে। একত্রে তারা সারা দেশের ১৯ শতাংশেরও কম। তাদের মধ্যে মাত্র শতকরা পাঁচ জন বাঙালি। বাকিরা হলো বিহারি মুসলমান -- যারা দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে গিয়েছিল এবং পাঞ্জাবী -- অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য যারা পূর্ব-পাকিস্তানে গিয়েছিল। 

এরকম কিছু ঘটনার সংবাদ পাওয়া যায় যেখানে বাঙালি মুসলমান জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এধরনের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ফিরে যাবার জন্য খুব কমই আশা জাগায়। আমি বিশ্বাস করতে প্রস্তুত আছি যে শেখ মুজিব সাড়ে ছয় কোটি মুসলমান ও এক কোটি হিন্দুদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব ও উদারতার কারণে হিন্দু জনগোষ্ঠী ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল। প্রাদেশিক পরিষদের জন্য আওয়ামী লীগের টিকেটে এগারো জন হিন্দু নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে-পরিষদ অবশ্য সামরিক শাসকরা বাস্তবায়িত হতে দেয় নি। 

পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাঞ্চলের জেলা পাবনার জেলাপ্রশাসক আমাকে যা বললেন হিন্দুদের জন্য তা এরচাইতেও আশাপ্রদ ব্যাপার ছিল। জেলাপ্রশাসকের নাম নূরুল কাদের, তিনি কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট। ডিসেম্বরের নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে তিনি এক হিন্দুর কিছু জমিজমা বিক্রির ব্যাপারে কাজ করছিলেন। লোকটি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে যেতে চাইছিল। কিন্তু যখন শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করলেন তখন লোকটি দেশে থেকে যেতে চাইলো এবং কেমব্রিজের তরুণটি এখন নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের জন্য একটি সচিবলায় সংগঠিত করার জন্য কাজ করছেন। কিন্তু এই সরকারের একটি জাতীয় পরিচয় ছাড়া আর কিছু নেই। কিন্তু এই সরকারের কোনো নেতার শেখ মুজিবের মতো কারিশমা নেই। কিন্তু কাদের মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পুনরায় মতৈক্যের কোনো সম্ভাবনা নেই। হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ গভীর দাগ ফেলে গেছে। আর এইসব অপরাধের সঙ্গে ব্যাপকমাত্রায় যুক্ত হয়েছে যৌন হয়রানির ঘটনা। কাদের জানালেন যে, এমনকি উচ্চমধ্যবিত্তের মেয়েদের ক্যান্টনমেন্টের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। 

একজন দাড়িওয়ালা ট্রাভেল-এজেন্ট যুবক, যিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তিনি জানালেন, "সেনাবাহিনীর আক্রমণের পূর্বে মাত্র ১৫ শতাংশ লোক স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিল। এখন মাত্র ১৫ শতাংশ পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো প্রকার যৌথতার ব্যাপারে সায় দেবে"। কিন্তু যদি একত্রিত পাকিস্তানের আর কোনো সম্ভাবনা না থাকে, পূর্ব বাংলার ভবিষ্যতের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক সময় লাগবে। প্রথম প্রতিরোধ শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। প্রথম প্রতিরোধটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, বিচ্ছিন্ন এবং কেবল আবেগগত তাড়না থেকে পরিচালিত হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত টেকে নি। এতে অনেক ভুল ছিল; এটা ছিল অতিমাত্রায় আশাবাদযুক্ত। বাঙালিরা ভেবেছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অভ্যস্ত পরোক্ষ অবাধ্যতার মাধ্যমেই পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কঠোর সৈন্য ও নিষ্ঠুর অফিসারদের মোকাবেলা করবে। 

দ্বিতীয় পর্বের প্রতিরোধ এখন শুরু হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর ২০,০০০ সৈনিক একক নেতৃত্বের অধীনে কাজ করছে। ৮,০০০ কিশোর-তরুণ গেরিলা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। দালালদের শেষ করার জন্য কিলার স্কোয়াড গঠিত হয়েছে। একজন বাংলাদেশী নেতা আমাকে বললেন তিনি সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ "যদি আমরা আমাদের জন্য কাজ করি''। এর মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের জন্য কোনো বিদেশী সাহায্যের জন্য অস্বীকৃতি জানালেন। বর্তমানে পূর্বাংশে চার ডিভিশন পাকিস্তানি সৈন্যর জন্য প্রতিদিন এক কোটি রুপি ব্যয় হচ্ছে। পাকিস্তানের জন্য অর্থনৈতিক চাপ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানী সৈন্যদের জোর কমিয়ে দেবে, কারণ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২,৫০০ মাইল পাড়ি দিয়ে সৈন্যদের জন্য ৩০০ টনের সরবরাহ প্রতিদিন আনতে হচ্ছে। 

বাংলাদেশের আন্দোলনকারীরা একটু আশাবাদী হতে পারে এজন্য যে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ কেবল পূর্ব পাকিস্তানে আর সীমাবদ্ধ নেই, পশ্চিম পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিশিষ্ট পাঠান-নেতা ওয়ালি খানের কথা উল্লেখ করা যায়। মি. ভুট্টো সেনাবাহিনীকে বলছেন রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিবিদদের সমাধান করতে হবে এবং তিনি শিগগীরই ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা বলে আসছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কুখ্যাত ২১ ধনী পরিবারের লোকজন ঠিকই বুঝতে পারছে পূর্ব পাকিস্তানের বাজার হারিয়ে ফেললে কী বিপদ হবে। ইয়াহিয়া খান এখন বুঝতে পারছেন, পশ্চিমের প্রভাবশালী লোকজন এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে পূর্বের যেকোনো সময়ের মতো কঠোর হয়ে উঠবে। রাষ্ট্রপতি হয়তো দমননীতির চূড়ান্ত পর্যায় পার হয়ে এসেছেন। ঢাকায় উদীয়মান রাজনৈতিক শক্তি একসময় যে-সমাধানের কথা বলেছিল, ইয়াহিয়ার কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে তিনি সেদিকেই যাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাপার হলো ঢাকা এখন আর সেকথা শুনবে না। 

কিন্তু একদিন যদি বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়ও, পাকিস্তান সেনাবাহিনী-সৃষ্ট সফল সাম্প্রদায়িক পারিস্থিতি ও বাঙালি হিন্দুদের ব্যাপকমাত্রায় প্রস্থান, বাংলাদেশকে একটি কেবল মুসলমানের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। এমনকি এখনকার তাজউদ্দীনের মন্ত্রিসভায় কোনো হিন্দু সদস্য নেই। এবং বাংলাদেশের জন্য ভারতীয়দের ব্যাপক সহানুভূতি সত্ত্বেও, এটা একটা দুঃখজনক ব্যাপার যে যেসব হিন্দু কয়েক বছর আগে ভারতে বসতিস্থাপনের জন্য গিয়েছিল তারা বাংলাদেশের জন্য কোনোরকম সহযোগিতা প্রদানের বিরোধী। 



আমার প্রিয় পোস্ট

Tuesday 17 April 2007

ফিরে দেখা

১৯৪৭, ১৪ই অগস্ট, রাত বারোটা, পূর্ব বঙ্গ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান 

প্রতি দিন হু হু করে বাড়তে লাগল বঙ্গের পশ্চিম পারের জনসংখ্যা। নতুন পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে মানুষ চলে আসতে লাগলেন 'দেশান্তরে'। লক্ষ করার বিষয়, পশ্চিম ও পূর্ব, দুই পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তুরা কিন্তু একভাবে এলেন না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যাঁরা এলেন, এলেন মোটামুটি একসময়েই। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কিন্তু আসতে লাগলেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে, বছরে বছরে। '৪০ - '৫০-এর দশক ছাড়িয়ে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরেও, এমনকি আজও সঙ্গোপনে নিয়ত বহমান সেই শরণার্থী-ধারা।
সে সময়ই, ১৯৪৮-এ, University Institute Hall-এ এক ভাষণে পশ্চিমবঙ্গবাসীর উদ্দেশ্যে ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার উচ্চারণ করেছিলেন এই মোক্ষম সাবধানবাণী:"I warn West Bengal - do not spurn away such a rich racial element when seeking shelter at your doors. They alone can make you great if you utilise these human materials." এ দিকের সাবেক বাসিন্দাদের মনে তখন মিশ্র অনুভূত। 'ওদের' জন্য সহমর্মিতা, আর নিজেদের জন্য ভবিষ্যতের ভয়। কিন্তু বিপন্নতার তাড়নায় যেন এই শরণার্থী-বেশে-আসা প্রতিশ্রুতিময় মানবসম্পদকে পশ্চিমবঙ্গ কৃপার চোখে না দেখে, দূরে ঠেলে না দেয়: এই কথাটিই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যদুনাথ।
না, পশ্চিমবঙ্গ দূরে ঠেলে দেয়নি। ধৈর্য ও সমব্যথার সঙ্গে এই শরণার্থী স্রোতকে জায়গা করে দিয়েছিল। কাজটা ছিল কঠিন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নামমাত্র সাহায্যের বেশি কিছু করেনি। পুরো দায়টাই বহন করেছিল সদ্যোজাত, সদ্যোবিভক্ত, অনভিজ্ঞ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। কেন্দ্রের ব্যবহারে আঞ্চলিক বৈষম্যও ছিল বৈকি। পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের জন্য ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের যে অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল, পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীর জন্য তার এক দশমাংশও হল না। তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের ভাষায়, পশ্চিমবঙ্গে আগত উদ্বাস্তুদের জন্য কেন্দ্রের খরচ - 'মাথাপিছু দুই বছরে কুড়ি টাকার বেশি নয়।'
প্রসঙ্গত, এমনিতেও বিরাট অর্থনৈতিক সংকটে ছিল সে দিনের পশ্চিমবঙ্গ। পাট ছিল প্রধান কৃষিজাত পণ্য। দেশভাগের সঙ্গে পাট-উত্পাদক অঞলগুলি বেরিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গের নাগাল থেকে, পড়ে রইল কেবল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, ধুঁকতে থাকা কলকারখানা।
এই সামগ্রিক চাপের মধ্যেও উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের বিপুল দায় যে সে দিনের রাজ্য প্রশাসন পালন করতে পেরেছিল, কেননা এতে বড় একটা ভূমিকা নিল - সমাজ। কত মানুষ যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগিয়ে এলেন সাহায্য করতে। প্রায় একটা সামাজিক আন্দোলন বলা চলে। যে আন্দোলনের ইতিহাস কখনও লেখা হয়নি, হয়তো হবেও না। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে নানারকম বাঙ্গালি মিলেমিশে যে একটা নতুন সমাজ তৈরি করে তুলল, তাকে প্রতি দিন সাংস্কৃতিক ভাবে সম্পন্ন করে চলল ঘটি-বাঙাল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, চিংড়ি-ইলিশ বিতর্ক; বেকার সমস্যা বৃদ্ধি; পাড়ার রকের আড্ডার ক্রমবিকাশ; বামপন্থি সাহিত্য সংস্কৃতি কৃষ্টি।
ঐতিহাসিক ভাবে, আর দুটি বড় ঘটনা ঘটল ক্রমে। ভারতের communist party পশ্চিমবঙ্গে যে দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠল, তার পিছনে বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল এই উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, উদ্বাস্তু colony-এর মানবিকীকরণের কাজ। সবচেয়ে বড় communist সমর্থক বাহিনী তৈরি হয়ে উঠতে লাগল এই নতুন আশ্রিত জনগোষ্ঠির মধ্যে থেকে।
দ্বিতীয়ত, উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে গেল মেয়েদের জীবনে ৷ তীব্র অনটন, আর্থিক দুর্দশা এবং পারিবারিক চাপের মুখে বড় দ্রুত ভেঙ্গে গেল অন্তঃপুরের অবরোধ। বাঙ্গালি মেয়েরা আগেও চাকরি করত, সমাজসেবায় যোগ দিত, কিন্তু সে ছিল হাতে গোনা। ১৯৪৭-এর পর, পরিবারের সব ক'জন সদস্যের কাজের খোঁজে না বেরিয়ে আর উপায় থাকল না। বাঙ্গালি মেয়েদের কাছে নারীশিক্ষা তখন আর পোশাকি বিলাশ নয়, পরিবারকে দাঁড় করানোর একান্ত মলিন বাস্তবে বেরিয়ে পড়ার সিঁড়ি।
পাওয়া, হারানো, এবং নতুন অর্জন: ১৯৪৭, পশ্চিমবঙ্গের জন্য রেখে গেল আলাদা তিনটি উত্তরাধিকার।

http://talking-bird.blogspot.com/2007_04_17_archive.html
বাংলাদেশের উপন্যাসে দেশভাগ মিল্টন বিশ্বাস
দেশভাগ (১৯৪৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ অঞ্চলে রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক ঘটনা। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান দেশভাগের ফলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় মৃত্যু ঘটে প্রায় লাখ পাঁচেক ভারতবাসীর, পঁচাত্তর হাজার নারী নিপীড়িত হয়। আর গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত দেড় কোটি মানুষ নতুন দুটি দেশে উভয় দিক থেকে অভিপ্রয়াণ করে। কিছু পরিবার পারস্পরিক গৃহবিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অভিপ্রয়াণকারী অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়। দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হিসেবে লেখকরা অর্জন করেন হত্যা, দুর্ভোগ, ধর্ষণ আর মানবিক বিপর্যয়ের রক্তাক্ত ইতিহাস। পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের মর্মস্পর্শী ঘটনাগুলো সে সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে আলোড়িত করে চলছে। খুশবন্ত সিং, সালমান রুশদী, আর কে নারায়ণ ইংরেজিতে রচনা করেন দেশভাগের ভয়াবহ বাস্তবতার আলেখ্যময় উপন্যাস। কৃষণ চন্দর, ভীষ্ম সাহীন, সাদত হাসান মান্টোর হিন্দি-উর্দু রচনায় এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র সেন, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী প্রমুখ লেখকের উপন্যাসে স্মরণীয় হয়ে আছে দেশভাগ। দেশভাগকে নিয়ে বাংলাদেশের লেখকদের একইভাবে বেদনাময় চিত্র অঙ্কন করতে দেখা যায়। প্রথম দিকের উপন্যাসে দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু সমস্যা, বাস্তুচ্যুতির জন্য বেদনাবোধ, স্মৃতিকাতরতা ও ভয়ার্ত অস্তিত্ব-সংগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখকদের উদারনৈতিক মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশভাগের ঘটনার ডকুমেন্টিং লক্ষ করা যায়।
দেশভাগের পরবর্তী সময়ে যাঁরা বাংলাদেশের ঔপন্যাসিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁদের মধ্যে অখণ্ড ভারতবর্ষের কলকাতা নগর একটা আগ্রহ ও আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল, বিশেষত সেখানে ফেলে আসা মানুষের স্মৃতি অনবরত তাঁদের তাড়িত করেছে। উপরন্তু যাঁরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে এসেছেন, ঢাকাকেন্দ্রিক নাগরিক জীবনের সুস্পষ্ট রূপ তাঁদের চোখে ধরা পড়েনি। এ কারণে বৃহত্তর গ্রামীণজীবনকে কেন্দ্র করে নিজের অস্তিত্ব শিকড়ায়িত করতে হয়েছে তাঁদের। দেশভাগের বাস্তবতা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের অধিকাংশ ঔপন্যাসিককে আলোড়িত করে, এমনকি ষাটের দশকে আবির্ভূত লেখকের গত বছর প্রকাশিত উপন্যাসেও দেখা যায় দেশভাগের অনিবার্য যন্ত্রণার রূপায়ণ। দেশভাগ মানুষকে ছিন্নমূল ও যাযাবর করেছিল। একাধিকবার ঠাঁই বদল করতে হয়েছিল মানুষকে। তবু নতুন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কথাশিল্পীর চৈতন্যে স্বপ্ন-সংরাগ উজ্জীবিত হয়েছিল। '১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ হলে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র গড়ে উঠল। বাঙালি মুসলমান লেখক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এলেন। বলা বাহুল্য, তাঁরা বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ধারার উত্তরাধিকারটিকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁদের নবযাত্রা শুরু হলো।' (বাংলাদেশের ছোটগল্প, ১ম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯, পৃ. ছয়)
এ নবযাত্রায় শরিক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে দেশবিভাগ প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ ও কাহিনীর মৌল বিবেচ্য হয়েছে যথাক্রমে আনোয়ার পাশা, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবুল ফজল, আবু ইসহাক, সত্যেন সেন, রাজিয়া খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরদার জয়েনউদ্দীন প্রমুখের রচনায়। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী ও সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের ইতিহাস-অভিঘাত রূপায়িত হয়েছে।
বিভাগোত্তর কালে ১৯৪৭-৫৮ সালের ঘটনাপ্রবাহে নবোদ্ভূত মধ্যবিত্তের মোহ ও মোহভঙ্গ, শোষণ ও চক্রান্তের ফলে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবন ঘটে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। মূলত এ সময়ের কালানুক্রমিক ইতিহাস বাঙালির জীবনাভিজ্ঞতার রক্তাক্ত অধ্যায়। একদিকে ব্রিটিশ রাজশক্তির সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিষবৃক্ষ ভারতবিভাগ, অন্যদিকে দেশবিভাগের ফলস্বরূপ বাংলাভাষী অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্তি_এ রাজনৈতিক মীমাংসা অবিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য ছিল অসংগত, ঐতিহাসিক ধারার পরিপন্থী একটি সিদ্ধান্ত। কী অর্থনৈতিক, কী রাজনৈতিক-সামাজিক কোনো দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের সমক্ষক ছিল না। এ জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ধূর্ত শাসকগোষ্ঠী এবং আধুনিক শিক্ষাবিবর্জিত সামন্ত-মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক-বিন্যাসের সুযোগপ্রাপ্ত ঢাকার নবাব পরিবার ও তাদের কিছু অনুসারী পূর্ব বাংলাকে গড়ে তুলতে চাইল আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামন্তবাদী সমাজরূপে। এ ক্ষেত্রে ধর্মশোষণ তাদের মূল হাতিয়ার হিসেবে দেখা দিল। এ সময় পূর্ব বাংলায় দুই শ্রেণীর মধ্যবিত্ত চরিত্রের আত্দপ্রকাশ ঘটল। এক শ্রেণী সামন্ত মূল্যবোধ-আশ্রয়ী ধর্মীয় ঐক্যের মানদণ্ডে স্বাগত জানাল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকে, অন্যদিকে বাংলাদেশে নব্য শিক্ষিত প্রগতিশীল মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রত্যাখ্যান করল ধর্মকেন্দ্রিক পাকিস্তানি শাসকদের জাতিশোষণ, শ্রেণীশোষণ ও সংস্কৃতি-আগ্রাসী মনোভাবকে। পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই মোহভঙ্গের ফলে ঢাকা নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত প্রথম প্রতিবাদ করল ১৯৪৮-এর মার্চে ভাষার প্রশ্নে। অন্যদিকে ১৯৪৭-১৯৫১ সময়প্রবাহে পাকিস্তান শাসিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ঘটে একাধিক ঘটনা। বিভাগোত্তরকালে সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার ভিত্তিতে বিপুলসংখ্যক মুসলমান বাস্তুচ্যুত পরিবারের পূর্বাঞ্চলে আগমন এবং পরবর্তী সময়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনজীবনকে করে তোলে দুর্বিষহ। জনগণ মৌলিক চাহিদা থেকে বঞ্চিত হয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাঙালির জন্য রীতিমতো অত্যাচারের ভয়াল রূপ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা-প্রশ্নে প্রতিবাদের পথ বেয়ে ১৯৪৯-এ জন্ম হয় আওয়ামী মুসলিম লীগের। এ রাজনৈতিক সংগঠনটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান অনুঘটক। অন্যদিকে বিভাগোত্তরকালের কমিউনিস্ট পার্টির একমাত্র প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠন 'প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ' ক্রমেই কমিউনিস্ট বিপ্লবের দ্বিধাবিভক্ত ও তাত্তি্বক বিতর্কের ফলে ১৯৫০ সালের মাঝামাঝি ঢাকা জেলায় এর অস্তিত্ব একেবারে বিলুপ্ত হয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবদমন নীতি ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের নব্য কলোনিতে পরিণত করার চক্রান্তে এবং রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে যে গভীর ষড়যন্ত্র ও বিতর্ক উত্থাপিত হয়, এরই ফলে সংগঠিত হয় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২_এই কালক্রমিক ঘটনাপ্রবাহে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ২১ ফেব্রুয়ারির রক্তদান ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্বের জানান দেওয়ার ঘটনা। দেশবিভাগোত্তর কেন্দ্রীয় প্রশাসনের রাজনৈতিক কূটজাল, অত্যাচার, নিপীড়ন, ধর্মীয় কলহ ও দুর্নীতির ভয়াবহ বিস্তারের বিরুদ্ধে বাঙালির ঐক্য ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ অনিবার্য করে তোলে। কিন্তু যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চক্রান্তে বাংলাদেশের খাদ্য-পরিস্থিতির অবনতি ও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দাঙ্গার সৃষ্টি করে ১৯৫৪ সালের মে মাসে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা পরিকল্পিতভাবে বাতিল করা হয়। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক প্রশাসনের বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের পর দেশে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের ঘটনা ঘটে। সামরিক শাসক দেশের রাজনীতি, সংসৃ্কতি, সাহিত্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়।
মূলত দেশবিভাগ থেকে ভাষা আন্দোলন এবং পরবর্তী পাঁচ বছর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দ্বন্দ্ব-জটিল হলেও এর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটি ছিল সব বিকৃতি, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতা এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সম্প্রদায়গত বৈরীভাবের বিরুদ্ধে মানবতার আদর্শকে রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সব ক্ষেত্রে মহিমাদীপ্ত করার কাল। এদিক থেকে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাগমারীতে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের আন্তর্জাতিক মানের সাংস্কৃতিক সম্মেলনের কথা উল্লেখযোগ্য। রাজনীতির সঙ্গে সংস্কৃতির এ যোগসূত্র বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকদের আলোড়িত করেছিল স্বাভাবিক কারণে। তবে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সালের সামরিক জান্তার করতলগত বাংলাদেশের নগর-গ্রামের গণজাগরণ এ অঞ্চলের সমাজমানসের প্রগতিশীল রূপান্তরের স্বতন্ত্র মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এরপর স্বাধিকার অর্জনের পথে ১৯৬৯-এর পথ বেয়ে ১৯৭১-এর মুক্তিসংগ্রাম দেশবিভাগ-পরবর্তী আরেকটি দেশবিভাগের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে। জন্ম হয় নতুন দেশ_বাংলাদেশ। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারায় আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতাবাদী আদর্শ এবং প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটে। ঔপন্যাসিকরা সেই শ্রেণীর অংশ হিসেবে তাঁদের কাহিনীধারায় ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মাণ করেন স্বাধিকারের সপক্ষে আমাদের সমাজমানসের বিচিত্র তরঙ্গ। মনে রাখা দরকার, দেশবিভাগ থেকে ১৯৭১ পর্যন্তই কেবল নয়, ২০১০ সালে প্রকাশিত হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাসেও দেশবিভাগের অনিবার্য অভিঘাত চিত্রিত হয়েছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতেও দেশভাগের নানা অনুষঙ্গে এ দেশের উপন্যাসে স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ যুক্ত হতে পারে।
পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৩ থেকে দেশবিভাগ (১৯৪৭) সময়বৃত্তে 'সূর্যদীঘল বাড়ী' উপন্যাসের কাহিনী বিন্যস্ত। আবু ইসহাকের মুখ্য অভিনিবেশ ছিল জয়গুনকেন্দ্রিক নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রামের বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা। উপন্যাসের সূচনায় আছে মন্বন্তরের প্রসঙ্গ। দুর্ভিক্ষতাড়িত মানুষ স্বপ্ন দেখেছে, দেশ স্বাধীন হলে চালের দাম কমবে। দেশ একদিন স্বাধীন হয়। পূর্ব ্পাকিস্তান নামের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু জয়গুনদের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষার হয় সমাধি। তাদের ভিটা থেকে আবার উচ্ছেদ হতে হয়। দেশবিভাগ অসংখ্য মানুষকে উদ্বাস্তু করেছিল। সেই বাস্তবতার পরিবর্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রে জয়গুনদের নিরাশ্রয়তার নির্মম আলেখ্য রচিত হয় কাহিনীতে। তবে দেশ বিভক্ত হলে জয়গুনদের স্বপ্নবিলাসের কথা উচ্চারিত হতে দেখা যায় : 'কত আশা-ভরসা আছিল। স্বাদীন অইলে ভাত-কাপড় সাইয্য আইব। খাজনা মকুব অইব। কিন্তু কই? বেবাক ফাঁটকি, বেবাক ফাঁটকি। আবার রেলগাড়ীর ভাড়াও বাইড়া গেল।' দুর্ভিক্ষ ও কুসংস্কার শেষ পর্যন্ত সত্য হয়ে থাকে নিম্নবর্গের জীবনে। আবুল ফজলের 'রাঙ্গাপ্রভাত'-এ দেশভাগ, পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আদর্শগত সংকট, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিম পারস্পরিক সম্পর্কের ভেতর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা প্রকাশিত হয়েছে। একদিকে পাকিস্তানপন্থী সংকীর্ণচেতা ব্যক্তি, অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক চারুবাবু ও কামাল, মায়া, মুকুলের স্বপ্ন উপন্যাসে লেখকের কল্যাণকামী জীবনাদর্শে বিন্যস্ত। সত্যেন সেনের 'পদচিহ্ন' বিভাগোত্তরকালের গ্রামীণজীবনে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা ও সংকটের বস্তুনিষ্ঠ চিত্র। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তির পর পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় যে বিপন্ন অবস্থায় নিক্ষিপ্ত হয় তার বর্ণনা রয়েছে যামিনী মিত্রের সংসারকেন্দ্রিক জীবন রূপায়ণে। উচ্চ শিক্ষিত তরুণ মুসলমান যুবক আনিসকে যামিনী বলেছে, 'আমাদের শিকড় ছিঁড়ে গেছে। এবার আমরা শুকিয়ে ঝরে পড়ব।' নিরাপত্তাহীনতা ও নিজেদের সংস্কার-বিশ্বাসের অন্তর্ধানের আশঙ্কায় যামিনীর অস্তিত্ব প্রকৃত অর্থেই দীর্ঘশ্বাসের সমষ্টি। 'উত্তরণ'-এ বিভাগপূর্ব ও বিভাগোত্তরকালের সমাজ, সংঘাত ও সংকটের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। কেন্দ্রীয় চরিত্র মালেকের মাধ্যমে পাকিস্তান আন্দোলন ও তার সমর্থক হিসেবে তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া উপন্যাসে উপস্থাপিত। '৪৭-এর দেশভাগ সমাজজীবনকে ক্ষতবিক্ষত ও ভারসাম্যহীন করেছিল_তার বর্ণনাও লেখক দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন। শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে মালেক মানুষের শ্রেণী অবস্থানের বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে। 'ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, ভুলো মৎ ভুলো মৎ/দুনিয়ার মজুর কিষাণ এক হও/আমাদের দাবী মানতে হবে/লাল ঝাণ্ডাকী জয়।'_দেশবিভাগের পর বিভিন্ন ঘটনাধারায় এ স্লোগানের সত্যতাও উপলব্ধি করে সে। বিভাগোত্তরকালের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মালেকের মাধ্যমে বাঙালির আত্দস্বরূপ প্রতিবিম্বিত করেছেন সত্যেন সেন।
রাজিয়া খানের 'বটতলার উপন্যাস'-এ দেশভাগজনিত সংকট এবং উপমহাদেশের বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে চরিত্রপাত্রের জটিল সমস্যার বিন্যাস দেখানো হয়েছে। মঈনের স্বদেশ উন্মূলিত বাস্তবতা দেশভাগজনিত। তার ব্যক্তিজীবনের স্বপ্ন, প্রেম, এমনকি পারিবারিক পরিবেষ্টনীকে বিপর্যস্ত করেছে দেশভাগ। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিময় কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পরও মঈন কলকাতার মেয়ে সুমিতার প্রতি গভীর অনুরাগ অনুভব করেছে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনাধারায় সেই অনুরাগ শেষ পর্যন্ত নতুন রাষ্ট্রের জটিল পরিস্থিতিতে শুভ পরিণতিতে উপনীত হতে পারেনি। উপন্যাসের কাহিনীর শেষে দেখা যায় উন্মাদিনী সুমিতার প্রেম ও সম্পর্ক বিনষ্ট হয়েছে, একই সঙ্গে মঈনেরও। শহীদুল্লা কায়সারের 'সংশপ্তক' ১৯৩৮ থেকে ১৯৫১ কালপর্বের কাহিনী। দুটি গ্রাম বাকলিয়া ও তালতলী প্রধান হলেও কলকাতা ও ঢাকার পটভূমিও উপন্যাসটির ঘটনাধারায় বিস্তৃত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধোত্তর কলকাতার দাঙ্গা, দেশবিভাগের পর বাংলাদেশের স্বাধিকার অর্জনের পথপরিক্রমায় এগিয়ে গেছে 'সংশপ্তক'-এর কাহিনী। নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে লেখক জাহেদের মধ্য দিয়ে সংগ্রামী জীবনচেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে সেকান্দর মাস্টারের মুখে বসিয়েছেন এই সংলাপ_'ভুল করছ জাহেদ, ভুল করছ। প্রথমে মানুষ, তারপর ধর্ম। মানুষের জন্যই তো ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।' দেশভাগের পর পূর্ব বাংলার মুসলিম মধ্যবিত্ত মানসের এ চেতনা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি। আলাউদ্দিন আল আজাদের 'ক্ষুধা ও আশা'য় দেশভাগের জন্য অঘোর চ্যাটার্জীর স্বপ্নভঙ্গের কথা আছে। দেশবিভাগকে তিনি ইতিহাসবিধাতার নির্মম ভ্রূকুটি হিসেবে দেখেছেন_'ইতিহাস পড়ে একটা জিনিস আমি বুঝেছি, ইতিহাসের নিজস্ব একটা গতি আছে তাতে ব্যক্তি নিজেকে জড়িয়ে চলে মাত্র, চেষ্টা করলে সেই গতিকে বিভ্রান্ত বা বিলম্বিত করতে পারে কিন্তু রোধ করতে পারে না।'(পৃ. ১৮০)
সরদার জয়েনউদ্দীনের 'অনেক সূর্যের আশা' উপন্যাসের কাহিনী পরিব্যাপ্ত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। কবি রহমতের স্মৃতিকথার মধ্য দিয়ে দেশভাগ ও দেশবিভাগোত্তর পূর্ব বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উন্মোচিত হয়েছে। স্বপ্নের ভূখণ্ড পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম সমর্থক হায়াত খাঁ টঙ্গী সোনারগাঁ জুট মিলে শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণকালে পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। অনেক সূর্যের প্রত্যাশায় লালিত ভূখণ্ডের এ বেদনার স্বরূপ নির্দেশের মধ্য দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। দেশভাগের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালি মুসলমানের স্বপ্নকল্পনা ও ভাবাবেগ কিভাবে বারবার বিচ্যুত হয়েছে তারই পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা উপন্যাসটির গভীরে প্রোথিত। 'বিধ্বস্ত রোদের ঢেউ' উপন্যাসে সরদার জয়েনউদ্দীন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ কালের ঘটনাধারায় বিবৃত করেছেন বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজাদির ছদ্মবেশে ধর্মীয় উন্মাদনা ও সামন্তাদর্শের রাষ্ট্রকাঠামোর নেতিবাচক দিকগুলো। লেখক কলিমের দৃষ্টিকোণ থেকে পাকিস্তান পরিকল্পনার স্বপ্নদ্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সম্পর্কে বলেছেন, 'ভদ্রলোক বাঙালী মুসলমানকে ছিন্নমূল বৃক্ষে রূপান্তরিত করে দিল। সুচিন্তিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছে।...যে স্বাধীন বাসভূমির জন্যে হাজার হাজার বাঙালী অকাতরে প্রাণ দিল, সেটাও পেল না পাওয়ার মত করে, আর প্রাণ দেওয়ারও শেষ হলো না।' মূলত বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্নভঙ্গ, দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারত্ব, পাকিস্তানিদের চক্রান্ত-শোষণ এবং বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছেন লেখক। আনোয়ার পাশার 'নীড়সন্ধানী' উপন্যাসে ১৯৫১ থেকে '৫৭ সালের বাঙালির জীবনবাস্তবতা হাসান চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। দেশবিভাগোত্তর সমাজ-রাজনীতির জটিল ইতিবৃত্তও এটি। দেশভাগের পর রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাস করে হাসান তার নিজ জন্মভূমি পশ্চিম বাংলায় ফিরে যায়, ভর্তি হয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে। কলকাতায় সে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ঘৃণা ও অবজ্ঞা এবং সেখানকার মুসলমানদের সংকীর্ণ পশ্চাৎমুখিতা এই উভয় দিক দেখে যন্ত্রণামথিত হয়, যদিও কিছু হিন্দু তরুণ-তরুণী তাকে উদারদৃষ্টিতে গ্রহণ করেছে তবু তার ভেতরে-বাইরে আত্দক্ষরণ চলতে থাকে। সমাজজীবনে ধর্মের নামে মানুষে মানুষে ভেদাভেদে বিচলিত হাসান শেষ পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার প্রশাসন কর্তৃক পাকিস্তানের চরে পরিণত হয়ে জেলে যায়। আবু জাফর শামসুদ্দীনের 'পদ্মা মেঘনা যমুনা'র কাহিনী শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে এসে। এরপরই দেশভাগ থেকে শুরু হয়েছে 'সংকর সংকীর্তন'-এর ঘটনা। কলকাতা ও তার আশপাশের পটভূমিতে প্রধান চরিত্র মৌলভী কাজী আবদুর রশীদের জীবন চিত্রিত হয়েছে এখানে। তবে ফরাজি আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের ভারতবিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত এ উপন্যাসের ঘটনা। ব্রিটিশদের স্বার্থচালিত শোষণ-প্রক্রিয়া ও দ্বিজাতিতত্ত্ব উদ্ভাবনের মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন ঔপন্যাসিক। মূলত 'ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' এবং 'সংকর সংকীর্তন'_এই তিনটি উপন্যাসে একটি পরিবারের যোগসূত্রে বাঙালি মুসলমানের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন আবু জাফর শামসুদ্দীন।
শওকত আলীর 'ওয়ারিশ' উপন্যাসে জওহর প্রধান, মুর্শেদ, রায়হান, রঞ্জু_এই চার প্রজন্মের জীবনাচার-জীবনদর্শন সমকালীন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের আত্দ-আবিষ্কারের যন্ত্রণাসূত্রে উন্মোচিত হয়েছে। দেশভাগ থেকে ১৯৮৪ সালের বাংলাদেশ উপন্যাসটির সময় পরিসর। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের যে রূপান্তর এবং তার অভিঘাতে প্রজন্মান্তরের চেতনার যে ব্যবধান তারই বিশাল সময়ের আয়তন এই উপন্যাসে কখনো ফ্ল্যাশব্যাকে, আবার কখনো বর্তমান সময়স্বভাবের চারিত্রে আত্দপ্রকাশ করেছে। রায়হান পশ্চিমবঙ্গের বালিগাঁয়ের ফুফাতো ভাই শাহাবুদ্দিনের পত্র পেয়ে পিতৃসম্পত্তির ভাগীদার হওয়ার জন্য উপস্থিত হয় দেশভাগের ফলে ছেড়ে আসা পূর্ববর্তী পিতৃদেশে। কিন্তু সময়ের অগ্রগতিতে যেমন সব কিছু পাল্টে যায়, তেমনি তার পূর্বপুরুষের স্মৃতিভরা স্থানের পরিবর্তনে সে বিস্ময়াভিভূত হয়; মানুষের আচরণে দেখতে পায় মূল্যবোধের পরিবৃত্তি। এ অনুকল্প বর্তমানের ক্রমবর্ধমান হতাশার মধ্যে সে আত্দ-অন্বেষণে পূর্বপুরুষের স্বপ্নময় জগতে আত্দরোমন্থনের আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। রায়হানের বাবা মুর্শেদের বাল্যকাল ছিল ভারতবর্ষের বিশের দশক। মুর্শেদের বাবা জওহর প্রধান ছিলেন ভারতবর্ষের প্রগতিশীল মুসলমান। বাবার কারণে জীবন সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে মুর্শেদের। দেশভাগের পর মুর্শেদ তার কষ্টার্জিত আদর্শ গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে ঘৃণ্যস্থান পাকিস্তানে চলে আসে। রায়হান তার বাবা মুর্শেদের কথা স্মরণ করেছে এভাবে_'ভারতবর্ষ ভেঙে যদি পাকিস্তান আলাদাভাবে স্বাধীন হতে পারে, তাহলে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ কি স্বাধীন হতে পারে না? সালটা ১৯৫৪; ৯২-ক ধারা জারি করে পূর্ব পাকিস্তানের সদ্য নির্বাচিত মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পরের ঘটনা। আর ৩০ বছর পর ১৯৮৪-তে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারই ছেলে (রঞ্জু) রাজনীতির গুণ্ডাবাজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। এই কি দেশের ভবিষ্যৎ!' উপন্যাসে রায়হান অতীতের দুই পুরুষের ঘটনাপরম্পরায় অনুঘটকরূপে একবার বাংলাদেশ, আরেকবার পশ্চিমবঙ্গে পরিভ্রমণ করে সংগ্রহ করেছে বিশাল পটভূমির ইতিহাস, রাজনীতি-সমাজনীতি-সংস্কার-অর্থনীতি-লোকবিশ্বাস অতীত-বর্তমান সমাজ পরিবর্তনের ধারা। রায়হানের বাবা মুর্শেদ ও মা সালমার অনুভাবনায় দেশভাগ সম্পর্কে অভিমত উপন্যাসের অন্যতম দিকনির্দেশক প্রান্ত। সালমা বলেছে, 'পার্টিশন মানে তো সীমানা দিয়ে একটা এলাকা চিহ্নিত করে দেওয়া যে এই পর্যন্ত পাকিস্তান আর এই পর্যন্ত হিন্দুস্তান হলো না হয় পার্টিশন। আমি একজন মানুষের পরিচয়ের কথা বলছি_তার নানান সম্পর্কের কথা বলছি। বহুদিন ধরে এসব জিনিস হয়ে ওঠে, এগুলো কি মানুষের জীবনের মূল নয়? অথচ রাজনীতিতে এসব জিনিসের কথা বলা হয়নি, হলেও আমি কখনো শুনি নি।' অর্থাৎ দেশভাগের রাজনীতির বলি হয়েছে মানবসমাজের শাশ্বত আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন-সাধ।
সেলিনা হোসেনের 'যাপিত জীবন' ও তিন খণ্ডের 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'য় দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের কথা বর্ণিত হয়েছে। অন্যদিকে 'কাঁটাতারে প্রজাপতি' উপন্যাসে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবন ও তেভাগা প্রসঙ্গের রূপায়ণে পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রসঙ্গ রেখায়িত। 'যাপিত জীবনে' ১৯৪৭-এর দেশভাগ থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ের রাজনীতির
বহির্বাস্তবতা ও তৎসঙ্গে ব্যক্তির অন্তর্বাস্তবতার বিবরণ রূপায়িত। একদিকে সোহরাব আলীর পরিবার ও জাফরের কাহিনী, অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গ ভাষা আন্দোলনের আনুপূর্বিক বিবরণ ২৪টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করা হয়েছে। তবে এখানে ব্যক্তি জাফরের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নীতি-শৃঙ্খলার দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সোহরাব আলী যিনি ভারতের একটি স্কুলে বোটানির শিক্ষক ছিলেন, দেশভাগের ফলে বন্ধু দীপনের সহায়তায় ঢাকার বংশালে একটি বাগানসহ বাড়ি কিনে তিন ছেলে ও স্ত্রী আফসানা খাতুনকে সঙ্গে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। স্থায়ী বাসিন্দা সোহরাবের ভেতর দেশত্যাগের যন্ত্রণা প্রশমিত হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি ভাষার প্রশ্নে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রশাসনকে ধিক্কার জানিয়েছেন। মধ্যবিত্ত মুসলিম শ্রেণী যারা দেশভাগের পর এ দেশে স্থায়ী হয়েছে তারা প্রথম থেকে বাঙালিদের সঙ্গে পাকিস্তানি সরকারের আচরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, যার সাক্ষ্য এ উপন্যাস।
১৯৪৭ সালের মধ্যরাতের স্বাধীনতার নেতিবাচক ফল, উন্মূলিত অস্তিত্বের সর্বগ্রাসী আর্তনাদ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে পালিয়ে আসা দুই প্রধান পরিবারের পারিবারিক পরিমণ্ডলে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে রাজনৈতিক ঘটনা তরঙ্গিত আবর্তের যোগফলের দ্বান্দ্বিক-অন্তর্ময় সম্পর্কসূত্র নিরূপিত ও চিত্রিত হয়েছে 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'র তিন খণ্ডে। '৪৭-এর ভারতবিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের সময় পরিসরকে পটভূমি হিসেবে গ্রহণ করেছেন ঔপন্যাসিক। জাতির সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা এবং সেই সমস্যার আবর্তে ঘূর্ণিত ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনের অন্তরঙ্গ বিন্যাসে এ উপন্যাস বিশিষ্ট।
'গায়ত্রী সন্ধ্যা' প্রথম খণ্ডের ঘটনাকাল ১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়ের সমাজজীবনের দ্বন্দ্ব-সংকট ও সংঘর্ষের অন্তর্ময় রূপায়ণ ঘটেছে উপন্যাসটিতে। মধ্যবিত্ত মানসের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, সংগ্রাম, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গ এবং সর্বোপরি গ্রামীণজীবনে রাজনৈতিক প্রতিঘাত ও পাকিস্তানি প্রশাসনের সহযোগীদের চরিত্র উন্মোচনে ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেনের প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ায় দ্বন্দ্বময় বিষয়ভাবনা লক্ষণীয়। উপন্যাসের শুরুতে দেশবিভাগের ফলে উদ্ভূত সংকটের আবর্তে পতিত কয়েকটি পরিবারের 'মুসলমান' হওয়ার অপরাধে নিজেদের ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এদের মধ্যে তিন পর্বের উপন্যাসটির দীর্ঘ সময়প্রবাহের সাক্ষী আলী আহমদ এবং হেডমাস্টার নসরুল্লাহর পরিবারকে কেন্দ্র করে ঘটনাধারা বিস্তার লাভ করেছে। ভারতের সীমানা অতিক্রম করার পর আলী আহমদের উন্মূলিত হওয়ার যন্ত্রণা মধ্যবিত্তের স্বভাবধর্মকেই প্রকাশ করে। 'ও বিতাড়িত হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। এই অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আলী আহমদ মনে মনে বলে, ধর্ম একটি পবিত্র অনুভূতি, গভীর বিশ্বাস। অথচ ধর্মের নামে মানুষ মানুষকে কুকুর বানাচ্ছে। কিভাবে জীবনের সবটুকু ওলটপালট হয়ে গেল, ভাবতেই শরীর দুলে ওঠে, বমি পায়, মুখভর্তি থুতু। এখন যদি পুষ্পিতাও মরে যায়।' গর্ভবতী স্ত্রী পুষ্পিতা ও জ্যেষ্ঠ সন্তান প্রদীপ্তকে সঙ্গে নিয়ে রোহনপুর স্টেশন থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে তাদের যাত্রা যেন বাঙালি মধ্যবিত্তের দীর্ঘ যাত্রার ইঙ্গিতময় রূপায়ণ। এ সময়ই রেলে জন্ম হয় প্রতীকের। রেলযাত্রা ও প্রতীকের জন্ম আলী আহমদের নতুন দেশে নতুন জীবনের শুরুতে_'ও আমার হৃদয়ের প্রতীক' মনে হলেও মোহভঙ্গের সূচনা হয় উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ থেকেই। মূলত '৪৭-এর ভারতবিভাগজনিত কারণে একটি পরিবারের পূর্ব পাকিস্তানে আগমনের পর ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডলে তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সময়ের পরিবর্তনের ক্রম অভিজ্ঞতার তাৎপর্যপূর্ণ প্রান্ত উন্মোচনে অন্তঃগূঢ় ক্রিয়াশীলতায় ও ঔপন্যাসিকের জীবনার্থের সার্থকতায় শিল্পশোভিত হয়েছে 'গায়ত্রী সন্ধ্যা'। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মানবমুখিনতায় ভাস্বর। সংগ্রামশীল জীবনচেতনায় প্রখর উজ্জ্বলতায় দীপ্ত-প্রদীপ্ত, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনের অন্তরঙ্গ আকাঙ্ক্ষার সময়কে অতিক্রমণে সক্ষম প্রতীক, সংসারের মনোহর দর্পণ মঞ্জুলিকা, শত কণ্টকের যন্ত্রণা অতিক্রান্ত মাতৃসর্বংসহা পুষ্পিতা, আত্দসন্ধান, সত্তাসন্ধান-জাতিসত্তাসন্ধানের নিগূঢ় ভাবনাবীজে আশ্লিষ্ট ও বেদনাজনক পরিণতিতে চির জ্যোতিরিঙ্গ আলী আহমদ, মুক্তিসংগ্রামের দ্বিধাহীন উৎসর্গিত নিষ্কলুষ প্রাণ অহি, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মানবচৈতন্যের প্রাগ্রসরতার স্মারক নসিব এবং ছোটবড় বিচিত্র চরিত্রমালার চিত্রায়ণ ঔপন্যাসিকের শিল্পনির্মিতির স্মরণীয় অংশ।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'খোয়াবনামা'য় তেভাগা আন্দোলন এবং ভারতভাগের ঐতিহাসিক গ্রন্থি-জটিল সময়স্রোতের সঙ্গে সংমিশ্রণ ঘটেছে অতীতের পলাশীর যুদ্ধ, সিপাহি বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ প্রভৃতি আন্দোলনের অনুসূত্রে। কাৎলাহার বিল ও এর পার্শ্ববর্তী গ্রাম গিরিরডাঙ্গা ও নিজগিরিরডাঙ্গা, গোলাবাড়ি হাট প্রভৃতি স্থানের লোকায়ত চেতন-অবচেতন-অচেতন জগতের সঙ্গে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ঘটনাধারার ক্রমরূপান্তরশীল অধ্যায়ের দ্বন্দ্ব-জটিল সংঘাত চিত্রিত হয়েছে উপন্যাসটিতে। স্থানিক পরিচয়ের নিম্নবর্গের অতীত ঐতিহ্য পরিবর্তন হয়ে যায় কম্পানি ও ব্রিটিশের ডাণ্ডা দেশি সাহেবদের হাতে উঠে আসার পর। ভারত ভাগ হয়ে গঠিত হয় নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান, দেশি সাহেবরা নতুন আইন তৈরি করে। কেউ হয় নগরবাসী, কেউ হয় কন্ট্রাকটর। আবার নিজ দেশে পরবাসী হয় কোটি কোটি মানুষ। হিন্দু জমিদার নায়েব চলে যাওয়ার পরও আজাদ পাকিস্তানে জমি আর বিলের মানুষ নিজেদের মাটি আর পানির পত্তন ফিরে পায় না। রাজনৈতিক ইতিহাসের পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেক গাছের সঙ্গে পাকুড়গাছও কাটা পড়ে, উন্নয়নের ধাক্কায় ইটখোলা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃতি বদলে যায়। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় গ্রাম। তমিজের বাবা চোরাবালিতে পড়ে মারা যায়, বৈকুণ্ঠনাথ নিহত হয় নির্মমভাবে। কেরামত আলী তেভাগার কবি থেকে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবিতে পরিণত হয়। আর তমিজ শেষ পরিণতিতে ঢাকাগামী ট্রেনে উঠেও নাচোলের উদ্দেশে নেমে পড়ে। নিম্নবর্গের মানুষগুলো দেশভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক বাতাবরণে নানা নিপীড়নের মধ্যেও নতুন করে স্বপ্ন দেখে, সংগ্রামী মানুষের চিরায়ত আখ্যান সৃষ্টি হয় 'খোয়াবনামা'য়।
'কথাসাহিত্যের কথকতা'য় হাসান আজিজুল হক লিখেছিলেন_'দেশবিভাগের পর যে হৃদয়বিদারক মানব-বিপর্যয় ঘটেছে তা নিয়ে কোনো ঔপন্যাসিকই লিখলেন না।' তবে 'মানবিক বিপর্যয়' কমবেশি অনেক লেখককেই স্পর্শ করেছে। এ প্রবন্ধে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত 'আগুনপাখি' উপন্যাসে হাসান আজিজুল হক দেশবিভাগের পটভূমিতে এক নারীর বাস্তুর প্রতি মমত্ববোধের মানবিক আখ্যান রচনা করেছেন। বর্ধমানের উপভাষার বাধা অতিক্রম করে উপন্যাস কাহিনীর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে লেখক অতি নস্টালজিক স্মৃতিকাতর এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর অবস্থান পার্টিশনের বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে, মানষের পক্ষে। বর্ধমানের একটি গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থান দাঙ্গার অভিঘাতে ভেঙে যাওয়ার পর দ্বিজাতিতত্ত্বের ভারতভাগের অনিবার্য পরিণতিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের মাটির টানের কথা 'আগুনপাখি'র গভীরতর ব্যঞ্জনাকে অভিষিক্ত করেছে।
বস্তুত বাংলাদেশের সাহিত্যে পঞ্চাশের দশক থেকে ঔপন্যাসিকরা তাঁদের উপন্যাসে যেমন দেশবিভাগ-পূর্বকালের জীবনচিত্র রূপায়ণ করেছেন তেমনি বিভাগ-পরবর্তীকালের উদ্বাস্তু সমস্যা, মন্বন্তর, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, দাঙ্গা ইত্যাদি নিয়েও কথাবস্তু সাজিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁদের রচনায় প্রাধান্য পেয়েছে এ দেশের গ্রামীণজীবন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নগরজীবন। দেশভাগের ফলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু নর-নারীর দেশত্যাগ ও পশ্চিমবঙ্গে অমানবিক দুর্দশার মধ্য দিয়ে জীবনসংগ্রামের কাহিনীও আছে। মূলত দেশভাগজনিত উদ্বাস্তু পরিবারের সংগ্রামী বিষয়, অভিনব চরিত্রমালা এবং পটভূমিসহ জীবনের রোমাঞ্চকর অভিযানের লৌকিক-অলৌকিক উপলব্ধির রূপায়ণ দেখা যায়। তবে শেষ পর্যন্ত দেশভাগকে উপজীব্য করে রচিত উপন্যাসে যাপিত জীবনের সংকট ও সমস্যার আলেখ্যই উপস্থাপিত হয়েছে বেশি।


বিষয় ঃ কারাগার, বধ্যভূমি ও একঝাঁক স্মৃতি বুলেট 
           বিভাগ ঃ অন্যান্য
           বিষয়টি শুরু করেছেন ঃ kallol
          IP Address : 221.135.208.208          Date:26 Oct 2006 -- 10:12 PM




Name:  kallol           Mail:             Country: 

IP Address : 122.167.30.179          Date:17 May 2009 -- 11:36 AM

আমাদের অনেকেরই (বোধহয় কারুরই) ভোটার তালিকায় নাম নেই। জেল কতৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হলো নাম তোলার জন্য।
এর মধ্যে জেল অফিস থেকে খবর রটেছে - নকশালরা ভোট দেবে। একদিন জ্যোতিদাদের ওখানে আড্ডা চলছে। আমি আকুল আর শম্ভু আড্ডা মারছি। জ্যোতিদা সম্ভবতঃ গৌরদার সাথে দেখা করতে গেছেন এবং সেখানেই সংবাদটি পেয়েছেন। ফিরে এসে আমায় দেখেই ধরেছেন। কি ব্যাপার তোমরা নাকি ভোট দেবে? আমি উৎসাহে সবিস্তারে ব্যাখান করছি কেন আমাদের এই ভোটে অংশ নেওয়া উচিত। জ্যোতিদা মাঝে মাঝে কিসব লিখে নিলেন। পরদিন স্টেটসম্যানে বড় করে খবর -
 Naxals for election । ভুল করে খবরটা কানু সান্যালদের মত বলে ছাপা হয়।
ব্যাস, ওমনি শুরু হলো ঝামেলা। অসিতদারা ক্ষুব্ধ। ওরা মনে করলেন ওদের ব্ল্যাকমেইল করতে খবরটা সোমনাথদারা দিয়েছে। সে এক ধুন্ধুমার কান্ড। আমি দু-একবার বলার চেষ্টা করলাম - ওটা ভুল হয়ে গেছে। জ্যোতিদাকে বললাম। জ্যোতিদা মানলেনও। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। ও আর শোধরানো গেলো না।
ওদিকে অসিতদাদের কেসের তারিখ চলে এলো। অসিতদারা প্রেসে দেবে বলে একটা বিবৃতি তৈরী করে নিয়ে গেলো। তাতে ভোটের কথা কিছু ছিলো না। শুধু ছিলো "স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের লড়াই সমর্থনযোগ্য।
অথচ সেদিন সান্ধ্য হিন্দুস্থান-এ (আনন্দবাজারের সান্ধ্য ইংরাজি কাগজ) লেখা হলো কানু সান্যাল নির্বাচনে অংশ নেবার কথা বলেছেন। ওদের বিবৃতির ঐ অংশটার ছবিও দেওয়া আছে - যারা আজকের এই সময়ে নির্বাচনের বিরোধীতা করছেন, তারা প্রকারন্তরে স্বৈরতন্ত্রের হাতকেই শক্তিশালী করছেন। আমাদের তো প্রায় - জানলায় কাক / আমি তো অবাক - অবস্থা।
পরে দীপকদাকে ধরে জানা গেলো গল্পটা।

এই বিভাগ/লেখাটি সম্পর্কে আপনার মতামত দিন।

৭ জানুয়ারি, লালগড়এই বিভাগের সমস্ত লেখা

হিন্দোল ভট্টাচার্য

বন্দুক গর্জে ওঠে, সকালে ভীষণ নামে রাত
মানবিকতার মুখ থুবড়ে পড়ে হিম ঠাণ্ডা ঘাসের ওপর
লাশের পাশেই লাশ, স্বপ্নগুলো ভিজে রক্তে গড়িয়ে পড়েছে ...
শিকারী হার্মাদদল বুনো কুকুরের মত অন্ধকার গ্রামে
মৃতকে চিতার থেকে তুলে এনে আবারও কোপায়


২ .

দুঃখ পড়ে আছে চুপ করে আজ পুকুরের জলে
নিঃসঙ্গ ছায়ার মতো,-
শস্যক্ষেত জুড়ে আকাশের দিকে উঁচু হয়ে রয়েছে বন্দুক
কী কুয়াশা মুখ তুমি কেন আজও দুঃখ পাও
ক্রোধে না মুখ ঘুরিয়ে কেন আজও ... কেন
হননকারীর দল সারারাত নির্বিবাদে আগুন পোহায়


৩ .

ক্যাম্পের ধূসর রং, হিংসায় কামড়ে আছে টুঁটি
ছোট মেয়েটার গালে এখনও শিকার তার ছায়া ফেলছে নীল
মৃত এই বাংলাদেশ ... প্রতিদিন আরও বেশী কফিন এখন
কোথাও নিঃশ্বাস পড়লে সীসার বুলেট ছুটে আসে

লালগড়এই বিভাগের সমস্ত লেখা

সোমনাথ রায়

ছেয়েছে মৃত্যুরূপ লালমাটি গ্রামের সরানে
বহুদূরে ফেলে আসা শীতল ঘরের কথকতা;
স্বপ্নে এখনও শোনে? সেই শিশু ভয়ের বয়ানে
খবর শুনিয়ে রাখে - টিভি খুলে রাখে সভ্যতা


বনপার্টি জানে সেই শিশু , জানা আছে পুলিশ কেমন -
জানে ছেঁড়া মায়ের আঁচল মুঠোতে এখনও ঠাসা
পার্টির নির্দেশঃ মা গ্যাছে বুলেটে ছাওয়া বন -
নিশানের সভ্যতা তাকে কী শেখাবে- আর কী শেখাবে তাকে ভালোবাসা?

আর্ট ক্যাম্প কুষ্টিয়া - মূর্ছনার সাত দিনএই বিভাগের সমস্ত লেখা

অরণ্য


অবশেষে রাত যখন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গভীরভাবে জেকে ধরল খামারকে, আর আচমকা হিম বাতাস কাঁপিয়ে দিতে থাকল শরীর, তখন সবাই ঘন হয়ে বসেছিলাম অগ্নিকুন্ডের চারপাশে। হয়তবা গভীর রাতের প্রকৃতি আর কুয়াশার চাদর ঘুমের কোলে ঢলে পড়া মানুষগুলোর প্রাণে বাজতে থাকা আনন্দধ্বনি কিছুটা হলেও থিতিয়ে এনেছিল, কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখার চারপাশে মেলে ধরা হাতগুলো বেয়ে শরীরের দিকে অগ্রসরমান উষ্ণতা কেনজানি থিতিয়ে আসা সেই উত্তেজনাকেই পুনরোজ্জীবিত করছিল বারবার আর কয়েকদিন ধরে ক্রমশঃ জমতে থাকা দারুণ স্মৃতিগুলো নিজেদের অজান্তেই থরে থরে সাজিয়ে পড়ছিল প্রাণের গভীরে। কেউ কেউ কিছুক্ষণ পরপরই উসকে দিচ্ছিল আগুন আর আমি গনগনে শিখার দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এমন প্রকৃত অবকাশই শিল্পীদের একান্ত প্রয়োজন, যেখানে সে খুব ভালভাবেই তার বোধের গভীরে প্রবেশ করে অনুধাবণ করতে পারে শিল্প, প্রকৃতি আর শব্দের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা নৈঃশব্দের বিপুল কলরোলের অদৃশ্য যোগসূত্র, যা তাকে হয়ত আরও বেশ কিছুদিন রশদ যোগাবে সামনে এগিয়ে যাবার।
Read more...

উত্তরবঙ্গ - ১০এই বিভাগের সমস্ত লেখা

শমীক মুখোপাধ্যায়


তার পরের ঘটনাগুলো ম্যাজিকের মত ঘটল। দেড়শো ছেলে একসাথে নেমে এল নিচে, প্রথমে হস্টেলের কোলাপসিবল গেট বন্ধ করে তালা মারা হল। তারপর ম্যাজিকের মত সকলের হাতে চলে এল অØষন। জিনিসগুলো এক্স্যাক্টলি আমাদের ঘরেই ছিল, কেউ জানতাম না, কী করে যে সেই মুহুর্তেই জেনে ফেললাম তাও মনে পড়ছে না, কেবল মনে আছে আমার ঘরেই লকারের মাথা থেকে বেরোল একটা হকিস্টিক, একটা চেন। আমি হকিস্টিকটা নিলাম, রুমমেট কে-কে নিল চেন। প্রায় পুরো হস্টেল এই রকম চেন রড হকিস্টিক ইত্যাদি জিনিস নিয়ে নিচে মেন গেটের সামনে লবিতে পজিশন নিল, কেবল মাষন একজন ফোর্থ ডান ব্ল্যাক বেল্টের মোকাবিলা করার প্রচেষ্টায়।
Read more...

দেবকী বসুর 'কবি', ১৯৪৯ - একটি অটেকনিকাল পাঠ (চতুর্থ কিস্তি)এই বিভাগের সমস্ত লেখা

ত্রিদিব সেনগুপ্ত

সেই যে রেলের প্রসঙ্গ থেকে শরত্চন্দ্র আসতে শুরু করল, বারবার মাথায় এসেই যাচ্ছে এগুলো। এই বাবুর শরত্চন্দ্র সংস্করণটা মনে পড়ছে? এলএ পাশ করার পর ডেপুটি হওয়ার অপেক্ষারত নতুনদা? নতুনদা নামে যদি মনে নাও পড়ে, পাম্পশু থেকে নিশ্চয়ই পড়বে। এই বাবুটিরই নিকট কেউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে নতুনদার। নভেম্বর বিপ্লবের বছরে শ্রীকান্ত ছাপা, তার বেশ কিছু বছর আগে ঘটেছিল নতুনদা উপাখ্যান, শ্রীকান্তর কিশোর বয়সে। ১৯০০ সালে শরত্চন্দ্রের বয়স ১৪, তার মানে ১৯০২ নাগাদ ধরে নিতে পারি নতুনদা মাঘের শীতে বরফশীতল নদীর জলে ডুব দিয়ে বসে কুকুরের হাত থেকে বেঁচেছিলেন, তখন যদি তার বয়স বাইশ-চব্বিশ ধরে নিই, তাহলে ১৯৩৮-এ তার বয়স প্রায় ষাট। তাহলে তারাশঙ্করের এই বাবুটির পিতা তিনি হতেই পারেন। এবং এই বংশধারা তো আবহমান ছিলই। শ্রীকান্তর বন্ধু ইন্দ্রর দাদা নতুনদা উপাখ্যান অন্তে একটি অনাবিল অপ্রতিরোধ্য ভাঁড়ে পর্যবসিত হয়েছিলেন, কিন্তু সে তো শরত্চন্দ্রের পোয়েটিক জাস্টিস, কাব্যিক ন্যায়বিচার, আদতে ঘটনাটা ছিল এই যে, যদি এমনকি ভাঁড় হয়েও থাকে, সেই ভাঁড়ই, সেইরকম ভাঁড়েরাই, ফিরে গিয়ে ডেপুটির চাকরি পাবে, ইন্দ্র জানিয়েছিল শ্রীকান্তকে।
Read more...

মায়া মিডিয়াএই বিভাগের সমস্ত লেখা

অনির্বাণ বসু

তিনি বলছেন ইন্ডিয়ার কয়েকশ' মিলিয়ন গরিবলোকের উপকার, যাদের কোনো আইডেন্টিটি নেই, যারা কোনো বেনিফিট পান না। তিনি আরও বলছেন ঝুঁকির থেকেও বড় হল এই গরিবলোকেদের আইডেন্টিটি দেওয়া, তবে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে ঝুঁকি পুরোপুরি দূর হয়। এর পরই অরুণোদয় মুন্সিয়ানার সাথে আমাদের দেখাচ্ছেন একটি উপকারের উদাহরণ। দিনমজুর রাম বাবুর নম্বর না থাকার জন্য এতদিন সেল ফোন হচ্ছিল না, এখন আইডেন্টিফিকেশন হবার সাথে সাথে সেলফোন হল - আই ডি কে ধন্যবাদ। তার পর আবার অরুণোদয়ের তথ্য সম্বৃদ্ধ রিপোর্টিং - ৩০০০কোটি টাকার প্রজেক্ট শুরু হচ্ছে "পুওরেস্ট অফ দ্য পুওর'-দের দিয়ে। ২০১৪ সালের মধ্যে ৬০০ মিলিয়ন ভারতবাসী এই কার্ড পাবেন। একজন আদর্শ সাংবাদিকের মত অরুণোদয় লেখার শেষদিকে ইন্ডিয়ানদের আশার আলো দেখাচ্ছেন। বলছেন, হরি সিং-এর মত ভিখারীরাও, যারা দিল্লীর ওখলা ফ্লাই-ওভারের তলায় থাকেন, আশা করছেন লাইফ বেটার হবে, - "থ্যাংক্স্ টু এ ফিউ ডিজিট্স্।' আই ডি ছাড়া ফ্লাই-ওভারের তলায় থাকা আর আই ডি নিয়ে ফ্লাই-ওভারের তলায় থাকার যে তফাত, তা বুঝে নিতে কোনো অসুবিধেই হল না এইবার।
Read more...

স্প্যানিশ স্যাটারডেঃ পিকো দে তর্তিয়াএই বিভাগের সমস্ত লেখা

নিয়ামৎ খান


আগে তাহলে তর্তিয়া বানানো যাক। একে স্প্যানিশরা বলেন তর্তিয়া দে পাতাতা। অর্থাৎ কিনা আলু দিয়ে অমলেট। পাতাতা মানে পোটেটো ছাড়া কিছু না। কি করতে হচ্ছে তাহলে? একটা বড় পেঁয়াজ কুচিয়ে নিন, আর চার পাঁচ কোয়া রসুন। গোটা তিনেক মাঝারী মাপের আলু খোসা ছাড়িয়ে ছোট ছোট টুকরো করে রাখুন। এবারে বড় দেখে ফ্রাইপ্যান চাপান মাঝারী আঁচে। তিন বড় চামচ সাদা তেল দিয়ে পেঁয়াজ-রসুনের কুচি ছেড়ে দিন। একটু রং ধরলে আলু দিয়ে আঁচ সামান্য কমিয়ে দিন। নেড়ে চেড়ে ভাজতে থাকুন যতক্ষণ না আলু নরম হয়ে যায়। এইবারে হাতা দিয়ে আলু ইত্যাদি অন্য পাত্রে তুলে রাখুন। দেখবেন প্যানে তখনো অনেক খানি তেল রয়েছে। অতটা তেল লাগবেনা আমাদের। বেশির ভাগটাই ছেঁকে তুলে রাখুন।
Read more...

আমারে তুমি অশেষ করেছএই বিভাগের সমস্ত লেখা

শুচিস্মিতা

ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে ছ' বছর আগের ফেলে আসা রাতকে আবার দেখতে পেলাম। নিঃঝুম ক্যাম্পাস। তোলপাড় করে হাওয়া বইছে। হাওয়ার দাপটে যেন সব কিছু লণ্ডভন্ড হয়ে যায়। পণ্ড হয়ে যায়। ক্লান্ত আর শান্ত হয়ে যায়। তারপর সেই শান্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক মগ্ন শিল্পী গেয়ে ওঠেন - "ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব'। সপ্তর্ষিমণ্ডলের কাঁধ থেকে মেঘটা সরে যায়। একে একে সবকটি তারা ফুটে ওঠে আবার। সাইপ্রেস গাছের পিছনে ক্যানভাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোটি হয়ে ঝলমল করেন আমার রবি ঠাকুর। ছ' বছর আগে যে গানটি শুরু হয়েছিল এইখানে এসে তার বিস্তার পূর্ণতা পায়।

সুচিত্রা মিত্র কি আমার সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী? তা নয়। কিন্তু রবীন্দ্রগানে দীক্ষা তাঁর হাত ধরেই। তাঁর নাকি জন্ম হয়েছিল চলন্ত ট্রেনে। তাই তিনি সারা জীবন ছুটেছেন। অদম্য প্রাণশক্তি তাঁর। অশেষ হওয়ার মন্ত্রও তিনিই শিখিয়ে গেলেন।
Read more...

      এই বিভাগ/লেখাটি সম্পর্কে আপনার মতামত দিন।


 নস্টালজিয়া শব্দে বড় কাঁকর৷ সফটওয়ারের কিচাইনে অবিরত বদলে চলেছে আমাদের ইউ আর এল আর নতুন বাসার ঠিকানা৷ বদলে যাচ্ছে আমাদের হ্যালাফেলার আবহাওয়াবিদের আট পকেটের প্যান্টের র ংও আবহাওয়ার সরভাজা৷ যদিও কোথাও কোথাও ঘিয়ে ভাজা কুত্তার ন্যাজের মত কাশফুল দুলছে,পাঁচতারার কেতাবি পন্ডে পদ্ম ফুটছে, পুজো আসছে৷ আমরা এখন আর দুকুর রোদে নতুন ডিয়ার ক্লাব-ডেনিমে ক্যাপ পিস্তল হাতে দৌড়া-দৌড়ি করি না বর ংকেউ কেউ ইরাক বোম্বে ইজরাইলে বরাত মাফিক গাড়ি বাড়ি মানুষ উড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে থাকি, বাকিরা শশীকান্ত হয়ে রাজা উজির বস ল ও উকুন মারি৷ এখন আর দুকুর বেলা চিত্- উবুড় হয়ে শুয়ে শারদ সাহিত্য সম্ভার পড়ি না, বরাত পেলে আখাম্বা উপন্যাস বা টাইট গল্প ছাড়ি আর না পেলে চুয়া ঢেঁকুর তুলি৷ সন্ত্রাস ঘনাইছে দিকে দিকে/ আমাদের কবি প্রতিভা ঢাকিছে বল্মিকে৷ তবু এর মধ্যেই আমরা বিন্দাস আছি৷ ফুকোয়, ফোকে,ফুঁকে এব ংফাঁকে কেটে যাচ্ছে আমাদের সময়৷ এখন আর আমাদের আধুনিকতার তকমায় বেঁচে থাকতে ভালো লাগে না৷ সভ্যতার ভাঙা চিরুনী আর দুর্গতিনাশিনীর পমেটম মাঝে সাঁঝে খুলে বসি৷ পুজোর সময় নানাবিধ চব্ব পড়ে কারুর মন ভার হয়, কান্না-টান্নাও পায় শুনেছি৷ আমাদের ওসবের বালাই নেই৷ এবার পুজোয় আমরা দিলাম হাতের তালু, দেখুন চিনতে পারেন কি ন!

 
এবার তাঁর এপিটাফ লেখা হবে। এবার তিনিও আইকন হবেন।

জীবদ্দশায় তাঁকে প্রায়ই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হত। বিদগ্ধ ভদ্রোমহোদয় ও লেডিসগণ তাঁর নামোচ্চারণেই উঠতি লেখকদের পাকামো করতে নিষেধ করতেন। বাঁধা ছকের বাইরে পা দিলেই চোখ পাকিয়ে বলা হত , সন্দীপনী কোরোনা, সন্দীপনী কোরোনা। কতো, কতো বড়ো লেখক এই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁর নামে সন্দীপনী বলে আস্ত একটা কথাই চালু হয়ে গেল? অজিত চৌধুরী লিখেছিলেন। সে যুগ শেষ। তাঁর নামে এবার অর্ডার দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হবে। হইহই করে বিক্রি হবে উপন্যাস সমগ্র। সভাসমিতিতে বিস্তর অশ্রুবিসর্জন হবে। ফটোয় মালা দিয়ে সভাপতি অধোবদন হবেন। ধরা গলায় বলবেন, আহা কি লিখতেন। মানুষটা প্রাপ্য সম্মান পেলেন না গো। প্রেমাশ্রুবন্যায় ডুবে যাবে ডিহি কলকাতা। সেই জোয়ারে সন্দীপনের লেখালিখি ভেসে যাবে। শুধু জেগে থাকবে ফটো। চৌকো মুখ আর দড়িবাঁধা চশমা। ভদ্দরলোকের মুখ যেমন হয়। অবিকল।


এই পাতায় কিছু বইপত্রের ই-সংস্করণ রাখা হয়েছে৷ বই পত্রের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলবে এরকমটাই আশা৷ ইতিমধ্যেই সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারত, কিন্তু কিছুটা কুঁড়েমি আর কিছুটা যোগাযোগের অভাবের জন্য করা হয়ে ওঠেনি৷ এ ব্যাপারে বেড়ে কাজ করছেন বইপাড়া ডট কম তাঁদের জানাই লালে লাল লাল সেলাম!!!

বাংলা লেখার জন্য স্ট্যান্ডার্ড কোনো ফন্ট আমাদের নেই৷ ফলে এই পাতায় যে ফন্টটা দেওয়া হচ্ছে, সেটিও কোনো স্ট্যান্ডার্ড ফন্ট নয়, যদিও এর কি-ম্যাপ কয়েকটি পপুলার বাংলা ফন্টের সঙ্গে মেলে৷ সঙ্গের বাংলা এডিটর টা আপনাকে ম্যানুয়ালি ইন্সটল করতে হবে, তার ইন্সট্রাকশনও নিচে দেওয়া আছে৷ উইন্ডোজের জন্য একটি অতি উত্তম স্ট্যান্ডার্ড অটোমেটেড ইন্সটলার লেখা হয়েছিল, সেটা এখানে এই মূহুর্তে দেওয়া যাচ্ছেনা

 
 শুনে ঘাবড়ে যাবেন না, শুধু এই সাইটেই রক্ষে নেই, আমাদের একটি ছাপা পত্রিকাও আছে। তারও পোশাকি নাম গুরুচন্ডালি। আদর করে কাগুজে গুরু বলে ডাকা হয়। মাসে একবার প্রকাশিত হয়। কোথায় পাবেন, কি বৃত্তান্ত বিশদে জানার জন্য এই বিভাগটি মন দিয়ে পড়ুন। পাইলেও পাইতে পারেন অমূল্য রতন।

হ্যাঁ, একবার স্টল থেকে খুঁজে একবার কিনে নিতেও ভুলবেন না। স্টলওয়ালারা দুচ্ছাই করতে পারে, কিন্তু তাতে কি? না পড়লে আমাদের ঘন্টা, কিছু যাবে আসবেনা, সমস্যা আপনারই। কি হারালেন, সে আর সারা জানা হবেনা। এ আফশোষ সারা জীবনেও যাবেনা।


 
 এখনও সূচীপত্র দেখছেন? শিগ্গিরি পড়ে ফেলুন, পুজো ইস্পিশান ২০১০।

বাহন-কাহন 
  বাহন-কাহন&শথড়স;--বাহন-কাহন 

প্যাঁচালি 
  ব্রাত্যজনের পাঁচালি&শথড়স;--শর্মিষ্ঠা খাঁ 

পাশবিক 
  ক্ষরা ও খুনের অবেলা&শথড়স;--আনোয়ার সাদাত শিমুল 
  দ্য আদার সাইড&শথড়স;--কৃষ্ণকলি রায় 
  একটি আপাত পাশবিক গল্প&শথড়স;--মিঠুন ভৌমিক 
  প্যাঁচাদের পাড়া&শথড়স;--বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী 
  সাড়া&শথড়স;--শঙ্খ করভৌমিক 
  টিয়ামন্ত্র&শথড়স;--মাজুল হাসান 
  পশুর মৃত্যু &শথড়স;--অনিন্দ্য রহমান 
  স্টেগো বিষয়ক&শথড়স;--বিক্রম পাকড়াশি 

নির্যাণ 
  যাপনকাল&শথড়স;--ইন্দ্রাণী দত্ত 
  কাক&শথড়স;--মাণিক চন্দ্র দাস 
  এক পুরোনো পানকৌড়ি&শথড়স;--সুমন মান্না 

পর্যাণ 
  একটি অতিবাস্তবিক গল্প&শথড়স;--মলয় রায়চৌধুরি 
  অল্ফ বাঘের গল্ফ&শথড়স;--আবু মুস্তাফিজ 
  পরজনমে হইও গাধা&শথড়স;--সুমেরু মুখোপাধ্যায় 
  কাঠাবেড়া৯&শথড়স;--ছাতিম ঢ্যাং 
  একটি পাশবিক প্রতারণা কিংবা প্রেম&শথড়স;--নীড় সন্ধানী 

নিপান 
  পুরা ভারতের পশুভাবনা&শথড়স;--দীপ্তেন 
  জিভের ডগায় জীবজগৎ&শথড়স;--সোমনাথ রায় 
  বেহায়া পাখী ও ইত্যা¢দ&শথড়স;--সম্বিত বসু 
  তিমি, ডায়নোসর থেকেও বিবর্তনের ইতিহাসে বৃহত্তম&শথড়স;--আসিফ 
  বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ি চাষের সাতকাহন&শথড়স;--গৌরাঙ্গ নন্দী 
  জীবজন্তুর ছদ্মবেশ&শথড়স;--আবুল বাসার 
  সর্প ভয় ও প্রেম&শথড়স;--মাহবুব পিয়াল 
  শঙ্খমালা&শথড়স;--শুভেন্দু বর্ধন 
  টিটেনি কাহিনী&শথড়স;--রজিউদ্দীন রতন 

যূনা 
  মধ্যরাতের কীট&শথড়স;--অরণ্য 

যূথ 
  বেড়াল ও একটি পারিবারিক ডি এন এ চর্চা&শথড়স;--যশোধরা রায়চৌধুরী 
  পরস্মৈপদী হাতির গল্প&শথড়স;--শমীক মুখোপাধ্যায় 
  খাসি&শথড়স;--মুস্তাফা হানিফ 
  শিকারোক্তি&শথড়স;--শঙ্কর সরকার 
  সত্যিকারের গল্প&শথড়স;--শুচিস্মিতা 
  একটি গরু, একটি গ্রাম&শথড়স;--শ্রাবণী 
  অথ গজ-অনাথশালা : কম্বু-কলস্বনা কথোপকথনে কলম্বো-ক্যান্ডি ভ্রমণ বৃত্তান্ত&শথড়স;--অনামিক 
  মানুষের কাছে বাঘের গল্প&শথড়স;--ঋতেন মিত্র 
  মশা সম্বন্ধে যে দু চার কথা আমি জানি&শথড়স;--ঈপ্সিতা 

দামনী 
  পিপীলিকাভূকের পিছনে&শথড়স;-- জেরাল্ড ডারেল 
  বাৎসল্য&শথড়স;--পান্থ রহমান রেজা 
  টাট্টু ঘোড়া আয়েগা&শথড়স;--নাজিয়া আফরিন 
  মুরগিচোর&শথড়স;--আনিস হক 
  ফেরোমন&শথড়স;--অভ্র পাল 

বিতংস 
  বিড়ালবৃত্তান্ত&শথড়স;--অর্পণ চৌধুরী 
  বাহন = ধোবি কা কুত্তা&শথড়স;--আর্য্য ভট্টাচার্য্য 
  আষাঢ়ে জব্দগল্পদ্রুম: আহা রে কাঁঠালের আমসঙ্কÄ, ওহো রে খুকির কাঠবিড়া৯&শথড়স;--সাইফুল আকবর খান 
  ব্যাঙ মা&শথড়স;--ব্যাঙ 
  একটা 'গরু' রচনা&শথড়স;--ইমরুল হাসান 

সামনী 
  কসাইখানার স্বপ্ন&শথড়স;--আরফান আহমেদ 
  মস্তিস্ক যখন শূণ্য&শথড়স;--মাহবুবুর রহমান 
  শুয়োর পালন: স্থায়ী ঠিকানা থাকলেও পেশাগত কারণে যাযাবর যারা&শথড়স;--মুর্তাদা বুলবুল 



 
 রাজার পরে রাজা আসে, বসন্তের পর ভোট। গরম পড়েছে বলে বৃষ্টি নামে কোন কোন দিন। আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে। হাঁটুজলে এক্কাদোক্কা খেলে ট্রাম-বাস টেম্পো। দোকানে ঝুলে থাকে রঙচঙে ক্যালেন্ডার আর রোব্বারের পাঁঠা। আয়নার কাঁচে জমে টিপ, হুহু ঝড়ে উড়ে যায় উইন্ডস্ক্রিনের ধুলো আর কে জানে কার আঁচলখানি। পরের সংখ্যা কবে হবে বলে লোকে তাড়া দেয়, আর স্বভাবসুলভ ঢিমে তেতালায় বচ্ছরখানেক পরে অনবধানে আমাদের প্যাকিং বাক্স খুলে দেখি, সারি সারি পান্ডুলিপি চুপচাপ জমে আছে।
বারোর পর তেরো আসে, বিলম্বিত একতালে। হাতে-হাতে কাজ ভাগ করে নিতে জড়ো হয় নতুন-নতুন ছেলেমেয়েরা। এই ভাবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আর চলছে না, বলে হাঁক পাড়ে তারা। নতুন নতুন মাথাগুলি ঝুঁকে পড়ে মনিটরে। মেল চালাচালি, হই হট্টগোল, ছ্যাবলামি আর গম্ভীর আলোচনায় আবারও সরগরম হয়ে ওঠে আমাদের পুঁচকে খেলাঘর। নতুন নতুন প্ল্যান হয় চড়ুইভাতি আর নতুন সংখ্যার। বারোর পর তেরো আসে। আনলাকি হোক আর ছাতার মাথা, কেউ পাত্তা দিক চাই না দিক, গুরুচন্ডা৯ চলছে চলবে।

এপ্রিল ২০, ২০০৯


 
 
দিনকাল পাল্টে গেছে৷ এতদিন আমরা শুধু শিল্প-সমালোচনা পাঠ করেছি৷ সুসংস্কৃত অধ্যাপকেরা আপনাকে-আমাকে জানিয়েছেন ভালো বই কারে কয়, মন্দ সিনেমাই বা কি৷ আমরা পদতলে বসে পাঠ নিয়েছি ভাষার, প্রকরণের৷ সাজিয়ে নিয়েছি নিজেদের বাক্যবিধি৷ জেনেছি সাঁঝের ঝোঁকে অলাবু ভক্ষণ ও না জানিয়া ফর্ম ভাঙা নিষিদ্ধ

দিনকাল পাল্টে গেছে৷ এতদিন আমরা শুধু শিল্প-সমালোচনা পাঠ করেছি৷ সুসংস্কৃত অধ্যাপকেরা আপনাকে-আমাকে জানিয়েছেন ভালো বই কারে কয়, মন্দ সিনেমাই বা কি৷ আমরা পদতলে বসে পাঠ নিয়েছি ভাষার, প্রকরণের৷ সাজিয়ে নিয়েছি নিজেদের বাক্যবিধি৷ জেনেছি সাঁঝের ঝোঁকে অলাবু ভক্ষণ ও না জানিয়া ফর্ম ভাঙা নিষিদ্ধ

দিনকাল পাল্টে গেছে৷ এতদিন আমরা শুধু শিল্প-সমালোচনা পাঠ করেছি৷ সুসংস্কৃত অধ্যাপকেরা আপনাকে-আমাকে জানিয়েছেন ভালো বই কারে কয়, মন্দ সিনেমাই বা কি৷ আমরা পদতলে বসে পাঠ নিয়েছি ভাষার, প্রকরণের৷ সাজিয়ে নিয়েছি নিজেদের বাক্যবিধি৷ জেনেছি সাঁঝের ঝোঁকে অলাবু ভক্ষণ ও না জানিয়া ফর্ম ভাঙা নিষিদ্ধ


 
 এই সাইট বানানোর সময়, আমাদের ইচ্ছা ছিল যে যা লেখা দেবেন, সবই তুলে দেওয়া হবে৷ ভালো লেখা বা মন্দ লেখার সকল পূর্বনির্ধারিত ধারণাকে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ন্যালাক্ষ্যাপার মতো শুরু হবে আমাদের জার্নি, এই ছিল ভাবনা৷ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, তা হয়না৷ প্রথমত: লেখালিখিকে এডিট করে এইচ টি এম এল বানাতে হয়, তারপর একটা নির্দিষ্ট খোপে ভরে ফেলতে হয়, সে অনেক ঝামেলা, এব ংতাতে সমস্ত লেখাকে স্থান দেওয়া অসম্ভব৷ ফলত: এই বিভাগটা খুলতেই হল৷
এখানে যে যা খুশি লিখবেন৷লিখবেন এব ংপোস্ট করবেন৷ তত্ক্ষণাত্ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ যে কেউ যেকোনো বিষয়ে লিখতে পারেন, মতামত দিতে পারেন৷ এখানে এডিটি ংএর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি,এখানে৷


 
যোগাযোগ করুন, মেল লিখুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায়:
guruchandali@gmail.com


No comments:

Post a Comment