ভেঙে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন?
বরকতুল্লাহ সুজন
নির্বাচনে ফ্রান্সে জয়ী হয়েছে কট্টর ডানপন্থি দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ফ্রান্স থেকে এবার এই দলেরই ২৪ জন এমপি যাচ্ছেন ব্রাসেলসের ইউরোপীয় পার্লামেন্টে। অথচ এর আগে ন্যাশনাল ফ্রন্টের মাত্র তিনজন ছিলেন সেখানে। দলের নেতা একজন নারী, মেরিন লি পেন। এরই মধ্যে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, অভিবাসীদের ভোট কিভাবে আসে তা দেখে নেবেন। ফ্রান্সের জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে এই নির্বাচনের গুরুত্ব কোন অংশেই কম না। তাই এর মাধ্যমে আরেকটি যে বিষয় প্রমাণিত হয়েছে, তা হলো ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদ এখন বেশ অজনপ্রিয়। নির্বাচনী ফলাফলে তার সমাজতান্ত্রিক দলের অবস্থান তিন নম্বরে। ফ্রান্স যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব প্রকল্পের মধ্যমনি, সেখানে প্রধান দু'টি দলের পশ্চাত্পদ অবস্থান কষ্টের বৈকি। প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ জানিয়েছেন, শুধু ফ্রান্স নয়, গোটা ইউরোপের জন্য এই নির্বাচনী ফলাফল একটা চরম ধাক্কা। ইউরোপে ফ্রান্সের ভাবমূর্তি নিষ্প্রভ হয়ে পড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
যুক্তরাজ্যেও ইইউ বিরোধী তথা ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির বিপুল জয় সবার চোখ কপালে তুলেছে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দলের নেতা নিগেল ফারেজ প্রতিক্রিয়ায় জানান, ওয়েস্টমিনিস্টার মুরগির খোপে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির শেয়াল ঢুকে পড়েছে। আসলেই তাই। কনজারভেটিভ ও লেবার পার্টির জোটকে হারিয়ে ঐ দেশে এক রাজনৈতিক ইতিহাস রচনা করেছে তাঁর ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি। এই দল ইইউ থেকে ব্রিটেনকে সরে আসার জন্য এবং কঠোর অভিবাসী আইনের পক্ষে শুরু থেকেই প্রচারণা চালিয়ে আসছে। তবে ফারেজ ইউরোপীয়ন পার্লামেন্টে ফ্রান্সের ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা অন্য কারো সাথে ইইউ বিরোধী জোট বাধবেন কি-না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। যদিও এরই মধ্যে তিনি লি পেনের সাথে কোন জোট গড়বেন না বলে জানিয়েছেন।
জার্মানির অ্যান্টি ইউরো দল অলটার্নেটিভ ফর জার্মানি-এএফডি। এই দলের সাত সদস্য এবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তারা আদার্স নামের একটি জোট নিরপেক্ষ গ্রুপের শরীক, যারা অ্যান্টি ইইউ নয়। সেখানে প্রত্যেক দলই স্বাধীন এবং নিজেদের পৃথক এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের মৌলিক উপকরণ তথা ইইউয়ের একক মুদ্রা ইউরোর বিরুদ্ধে এএফডি'র প্রচারণা বেশ ভয় ধরিয়ে দিয়েছে ইইউ সমর্থকদের। ইউরো বিরোধী কট্টর অবস্থান নিলে জার্মান করদাতারা হয়তো অনিয়ন্ত্রিত সরকারগুলোকে বা ইইউ সদস্যদের ব্যাংকগুলোকে অর্থ দেয়া বন্ধ করে দিতে পারেন। জার্মানিতে আরেকটি অবাক করার বিষয় হলো নব্য-নাত্সী রাজনীতিক ইউডো ভয়েতের নির্বাচিত হওয়া। তিনি ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনপিডির নেতা। বহুদিন ধরেই এই দলকে নিষিদ্ধ করা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিলো। কিন্তু এনপিডির নেতা-কর্মীরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে পারে আশঙ্কায় তাদের আর নিষিদ্ধ করা হয়নি।
গ্রিসেও অতি জাতীয়তাবাদী নব্য-নাত্সী দল গোল্ডেন ডন পার্টির তিন নেতা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই অপরাধ তদন্ত চলছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গ্রিসের জন্য যতগুলো আসন বরাদ্দ রয়েছে, সেখানে গোল্ডেন ডন পার্টির অবস্থান তৃতীয়। এছাড়া অ্যালেক্সিজ জিপ্রাসের সিরিজা পার্টির বিজয়ও বিস্ময়কর। জিপ্রাস ইউরোপীয় বাম ব্লকের নেতা, যিনি গ্রিসে ইইউ ও আইএমএফের প্রণোদনা বরাদ্দের কড়া সমালোচক। এর শর্ত মেনে নেয়াকে তিনি 'বিপর্যয়' বলে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। জিপ্রাস চান, গ্রিসের নতুন জাতীয় নির্বাচন। শুরু করতে চান প্রণোদনা বরাদ্দ নিয়ে নতুন করে আলোচনা। হাংগেরিতেও ফ্যাসিস্ট দলগুলো ইউরোপীয় পার্লামেন্টের তিনটি আসন জয় করেছে। যাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিবাসীদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা দেখানো। সাম্প্রদায়িক হামলার অভিযোগও আছে তাদের বিরুদ্ধে।
ইতালির ভোটারদের সাড়া অন্য দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি, ৬০ শতাংশ। ভোটাররা নতুন প্রধানমন্ত্রী মাতিও রেঞ্জিকে শক্ত সমর্থন দিয়েছেন। রেঞ্জি মধ্য বামপন্থি ডেমোক্রেটিক পার্টি-পিডির নেতা। মজার ব্যাপার হলো- ইতালির রাজনীতিতে তার উত্থান একেবারেই অল্প সময়ে। খুব বেশি দিন ধরে রেঞ্জি ফ্লোরেন্সের মেয়র ছিলেন না। এমনকি এর আগে কোন সময় তিনি পার্লামেন্টের সদস্যও হননি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে রেঞ্জি বেশ ভাল করেছেন। যা ইইউ সমর্থকদের জন্য আশাব্যঞ্জক। এর উল্টো মানে করলে দাঁড়ায়, গতানুগতিক ও পুরোনো দলগুলোর প্রতি আস্থা হারাচ্ছে ইউরোপবাসী। স্পেনেও আগাম সতর্কবার্তা জানিয়েছে ঐতিহাসিক এই নির্বাচন। মধ্যবাম এবং মধ্যডানপন্থি প্রধান দুই দলেরই জনসমর্থন নেমে গেছে পঞ্চাশ শতাংশের নিচে। আর বিক্ষোভ আন্দোলনের মধ্যে সদ্য জন্মলাভকারী নিউ পডেমোস পার্টির অবস্থান চলে এসেছে একেবারে সাবেক কমিউনিস্টদের পেছনে, চতুর্থ নম্বরে।
এবার আসা যাক ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট সম্পর্কে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সর্বোচ্চ এই পদে কে আসিন হচ্ছেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে নির্বাচনে মধ্য ডানপন্থি ইউরোপীয়ান পিপলস পার্টি বা ইপিপি সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। সে হিসেবে এ দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জিন ক্লদে জাংকার এই পদে নিজের বিজয় দাবি করেছেন। তবে কার নেতৃত্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিবর্তিত আইনের খসড়া রচিত হবে, তা চূড়ান্ত করতে জুন পর্যন্ত সময় পাবেন নেতারা। এরপর পুরো পার্লামেন্টে তা অনুমোদিতও হতে হবে। সব মিলিয়ে পুরো প্রক্রিয়া অক্টোবরের আগে শেষ হচ্ছে না। তবে জানা গেছে, জাংকারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাবেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং হাংগেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান। জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলও তাকে শক্ত সমর্থন দেবেন না বলে জানা গেছে। সবমিলিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নতুন নতুন শক্তির আবির্ভাব গোটা জোটকেই হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
No comments:
Post a Comment