Wednesday, April 30, 2014

আজ মহান মে দিবস ॥ মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন

আজ মহান মে দিবস ॥ মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়, পাহাড়-কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাদের হাড়, তোমারে সেবিতে হইল যাহারা মজুর, মুটে ও কুলি, তোমারে বহিতে যারা পবিত্র অঙ্গে লাগাল ধূলি; তারাই মানুষ, তারাই দেবতা, গাহি তাহাদেরি গান।’ আজ মহান মে দিবস। কুলি, মুটে মজুর শ্রমিকদের গান গাওয়ার দিন। কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের সংহতি প্রকাশের দিন আজ। খেটে খাওয়া শ্রমিকদের উৎসবের দিন। যারা গায়ের ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন আজ। দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকরা। দিনটির তাৎপর্য স্মরণ করে সারাবিশ্বেই যথাযথ মর্যাদায় পালিত হবে মহান মে দিবস। বাংলাদেশের মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের কাছে এদিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাই দেশেও দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালনের জন্য সরকারী বেসরকারীভাবে বিস্তারিত কর্মসূচী হাতে নেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ দিনটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ এ উপলক্ষে বাণী প্রদান করেছেন।
এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াও বাণী দিয়েছেন। আজ সরকারী ছুটি। এ উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকসমূহে ক্রোড়পত্র প্রকাশ এবং রেডিও টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। এ উপলক্ষে দেশের সব সংবাদপত্র আজ বন্ধ থাকবে।
মহান এ দিনটির পেছনে রয়েছে এক রক্তভেজা ইতিহাস। ইতিহাসের পাতায় এদিনটির রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। মে দিবস এলেই মেহনতি শ্রমজীবী মানুষের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এদিন প্রমাণ করে দিয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য দাবিকে গলা টিপে হত্যা করা যায় না। তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির কাছে মাথা নোয়াতে হয়। শ্রমিকের আন্দোলনের কারণে আজ ৮ ঘণ্টা কাজ করার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও প্রতিষ্ঠাকালীন থেকেই শ্রমিকের এ দাবিকে আইনে পরিণত করেছে। তবে দুঃখের বিষয় যাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন বাংলাদেশের সেসব শ্রমজীবী মানুষের কাছে দিনটির তাৎপর্য আজও ভালভাবে পৌঁছায়নি। অনেক দিনমজুর, গৃহশ্রমিক জানে না মে দিবস কি। ফলে তাদের অধিকার সম্পর্কে তারা এখনও রয়েছে অন্ধকারে।
মে মাসের প্রথম দিনটি বিশ্বের অনেক দেশেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই এদিনটি মে দিবস নামে পরিচিত। কিন্তু কিছু দেশে মে দিবসকে লেবার ডে বা শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দিনটি সরকারীভাবে ছুটির দিন। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ৮ ঘণ্টা শ্রমদিনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি চালানো হলে ১১ জন শহীদ হয়।
হে মার্কেটের ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মে দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে।
দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার আগে শ্রমিকদের দিন রাত অমানবিক পরিশ্রম করতে হত। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৬ দিন। বিপরীতে মজুরি মিলত নগণ্য, শ্রমিকরা খুবই মানবেতর জীবনযাপন করত। ক্ষেত্রবিশেষে তা দাসবৃত্তির পর্যায়েও পড়ত। ১৮৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য তারা সময় বেধে দেয় দেয় ১৮৮৬ সালের ১ মে। কিন্তু কারখানা মালিকরা এ দাবি মেনে নেয়নি। ৪ মে ১৮৮৬ সালে সন্ধ্যাবেলা হালকা বৃষ্টির মধ্যে শিকাগোর হে মার্কেট নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকরা মিছিলের উদ্দেশে একত্রে জড়ো হয়। ১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রার সাফল্যে উদ্বুদ্ধ হয়েই এটি করা হয়েছিল। আগস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ বাহিনী তৎক্ষণাৎ শ্রমিকদের ওপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা সংঘাতে রূপ নেয়। এতে ১১ শ্রমিক শহীদ হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পীজসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়। প্রহসনমূলক বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ নবেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুইস লিং নামে একজন একদিন পূর্বেই কারাভ্যন্তরে আত্মহত্যা করেন। অন্য একজনের পনের বছরের কারাদ- হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহণের পূর্বে আগস্ট স্পীজ বলেছিলেন, আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে। ২৬ জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়ের গবর্নর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন। এ আন্দোলনের ফলেই শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি স্বীকৃতি পায়। এর পর থেকেই মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসেবে।
১২৮ বছর আগে শ্রমিকের রক্তে অর্জিত অধিকারের জন্য আজও সংগ্রাম করে চলেছে শ্রমিকরা। তারা আজো ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশের শিল্প কারখানায় ঝুঁকি নিয়ে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অমানবিক খেটে চলেছে। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই, ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, মারধর, নারী শ্রমিকদের প্রতি চরম অপমান-গঞ্জনা ফ্যাক্টরিগুলোর সাধারণ চিত্র। আর এসব অবর্ণনীয় শোষণ, নির্যাতনে শ্রমিকদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন শ্রমিকরা ফেটে পড়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আন্দোলনে। শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনের ওপর নেমে আসে দমন নির্যাতন।
মহান মে দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপ্রতি আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদসহ দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতারা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি ঐতিহাসিক মে দিবসের গুরুত্ব অনুধাবন করে শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা, কারখানার কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্কের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।
কর্মসূচী
মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক শ্রমিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে সমাবেশ র‌্যালি ও শোভাযাত্রা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মে দিবস উপলক্ষে আজ গাজীপুরের টঙ্গীর শিল্প সংস্থার মাঠে জাতীয় শ্রমিকলীগ আয়োজিত এক জনসভায় ভাষণ প্রদান করবেন। রাজধানী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপির পক্ষ থেকেও শ্রমিক সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া এ সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণ দেবেন।
এ ছাড়া প্রতিবছরের ন্যায় এবারও রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। সকাল ৭টায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। র‌্যালিটি দৈনিক বাংলা থেকে শুরু হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হবে। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে মে দিবস উপলক্ষে সকাল ১০টায় আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এতে বক্তব্য রাখবেন।
মহান মে দিবসকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিভাগীয় শ্রমিক লীগ সমাবেশ ও বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করেছে। সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, মুজিব সেনালীগ, ইরামত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব), বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমিক জোট, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন, জাগো বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, রেডিমেড গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগঠনের পক্ষ থেকে র‌্যালি, আলোচনাসভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=15&dd=2014-05-01&ni=171545

No comments:

Post a Comment