আতঙ্কের নাম নারায়ণগঞ্জ
গত এক বছরে শতাধিক ব্যক্তি অপহরণ, গুম ৩৬টি লাশ উদ্ধার নেপথ্যে জমি নিয়ে বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা
আবুল খায়ের ও হাবিবুর রহমান বাদল
ভীতি আর আতংকের আরেক নাম নারায়ণগঞ্জ। প্রায় প্রতিদিনই হত্যা, গুম আর অপহরণের ঘটনা যেন স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে জেলায়। সারাক্ষণই আতংকে থাকেন সাধারণ মানুষ, এই বুঝি দু:সংবাদ আসলো। সাধারণ মানুষের এই আতংকের কারণ বলে দিচ্ছে জেলার অপরাধের পরিসংখ্যান। গত এক বছরেই নারায়ণগঞ্জে ছাত্র, শিক্ষক ও সাংবাদিকসহ শতাধিক ব্যক্তি অপহূত ও গুম হয়েছে। এদের মধ্যে ৩৬ জন লাশ হয়ে ফিরেছে। বাকি মানুষদের কোন হদিস পাওয়া যায়নি। এর আগের বছর অর্থাত্ ২০১২ সালে জেলায় খুন ও অপহরণের ১১৯টি ঘটনা ঘটেছে।
সিটি কর্পোরেশন এলাকা, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, বন্দর ও আড়াইহাজারে জমি নিয়ে বিরোধ, অর্থ লেনদেন, জমি দখল ও পাল্টা দখল, পরকীয়া প্রেম-বিয়ে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এসব অপহরণ, গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী না পেরেছে অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে; না পেরেছে দোষীদের গ্রেফতার করতে।
সর্বশেষ গত রবিবার আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালক এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জন অপহূত হয়েছেন। জেলার মানুষদের মধ্যে এমনিতেই যে আতংক কাজ করছিল, তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে ওই ঘটনায়। প্রতিবাদে গতকাল নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণ ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আন্দোলন, ভাংচুর ও ঘেরাও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বাইরে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা হাইওয়ে এবং নদী এলাকায় ফেলে রাখা হচ্ছে লাশ। অপরাধীরা এই স্থানগুলোকে লাশ ফেলার নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে।
জানা গেছে, জেলার ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও থানায় অপরাধ সংঘটিত হয় বেশি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য, একশ্রেণির মিল কারখানার মালিকদের দখলদারিত্বের লড়াই, জাল জালিয়াত চক্র এবং তাদের গডফাদারদের ইশারায় এই এলাকাগুলোতে অপরাধ বেশি হয় বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ। নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের একটি অংশ অপরাধী চক্রকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার নূরুল ইসলাম দাবি করেন, গত বছর যত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, বেশির ভাগেরই রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জেলায় ৭ থেকে ৮ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রীদের বেশিরভাগই কেউ কারো প্রকৃত পরিচয় জানে না। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বে খুন হলে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
তিনি আরো বলেন, এ ধরনের বিয়েতে দেখা যায় স্বামী সন্তান ফেলে গায়েব হয়ে যায়। আর ওই সন্তানটি বড় হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া জমি, লেনদেন, পরকীয়া ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় অপহরণ, গুম ও খুনের ঘটনা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে তিনি দাবি করেন। সমপ্রতি তরুণলীগ নেতা মাকসুদকে অপহরণের পর তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। গত বছর যুবলীগ নেতা জেড আইভি পারভেজকে ঢাকার গুলশান থেকে সাদা পোশাকধারী একদল লোক অপহরণ করে বলে অভিযোগ করে তার পরিবারের সদস্যরা। এখনো পর্যন্ত পারভেজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিন মাস আগে সোনারগাঁওয়ের আওয়ামী লীগ নেতা কালাম নিখোঁজ হয়। তারও হদিস মেলেনি।
নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী গত বছর অপহূত হওয়ার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। এনিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলছে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা। এ ঘটনা যে কোন সময়ে বড় সহিংসতায় রূপ নিতে পারে বলে নগরবাসী মনে করেন। এছাড়া চলতি বছরের গত তিন মাসের ব্যবধানে ফতুল্লার পঞ্চবটি এলাকার ছিনতাইকারী নূরুজ্জামান নূরা, দেওভোগ এলাকার মেজর, নবীনগর এলাকার যুবলীগ নেতা ইউসুফ অপহরণ হয়। আজো তাদের কোন হদিস মিলেনি।
৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে টানা ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই সময় গড়ে প্রতিদিন একটি করে লাশ পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নারায়ণগঞ্জ পরিণত হয় আতংকের জনপদে।
নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলছেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কোন ঘটনার বিচার না হওয়ায় পরবর্তীতে খুনিরা উত্সাহিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ওরফে লিটুকে প্রকাশ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূঁইগড়ের দেলপাড়াস্থ ভুঁইয়া ফিলিং স্টেশনের অদূর থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাবার পর আবারো প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নাজুক। একই দিন ভোরে মুন্সীগঞ্জ থেকে অপহূত হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ ফতুল্লা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার একটি ডোবা থেকে নিখোঁজ এক ইট ভাটা শ্রমিকের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত বছরের জানুয়ারিতে ব্যবসায়ী ভুলু সাহা নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ এপ্রিল রাতে সোনারগাঁওয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউগড়া এলাকার নিজ বাড়িতে খুন হয় পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী-শ্যালক এবং বাড়ির ২ গৃহপরিচারিকা। ওই ঘটনায় শামীম আহমেদ নামে এক আসামি সোনারগাঁও থানায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে। গত বছর শহরের ২টি স্বর্ণের মার্কেটে প্রকাশ্যে বোমা ফাটিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ আজো ডাকাতি হওয়া স্বর্ণালংকার উদ্ধার করতে পারেনি।
অপহরণের ৩৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মালিভিটা এলাকার একটি ডোবা থেকে স্কুল ছাত্র রাকিবুল ইসলাম ইমনের (১৪) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। গত ২৯ জানুয়ারি বন্দরে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অংকের টাকা আদায়ের জন্য ইমনের আপন চাচাতো ভাই আল আমিনের পরিকল্পনায় অপহূত হয় ইমন। ওই রাতেই তাকে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে ডোবার পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়।
গত ২১ জানুয়ারি সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় দুই স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলাম ও সাকিন আলম। ২২ জানুয়ারি একই এলাকার সাদিপুর ইউপির ভারগাঁও বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে জাহিদুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারি কাঁচপুর ইউপির বেহাকৈর মোল্লা বাড়ির বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহূত অপর স্কুল ছাত্র সাকিন আলমের গলাকাটা বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে তরুণ ব্যবসায়ি রকিকে দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় মাদক ব্যবসায়িরা কুপিয়ে হত্যা করে। ১ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের ভিংরাব এলাকা থেকে নাঈম মিয়া (১৪) নামে অপর এক স্কুল ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন সদর উপজেলার ফতুল্লার পিঠালীপুল এলাকায় একটি মোবাইল ফোন নিয়ে মোস্তফা মিয়া (১২) নামে এক স্কুল ছাত্র তারই বয়সী খেলার সঙ্গীদের হাতে খুন হয়।
৪ মার্চ ফতুল্লার একটি ডোবা থেকে মিনা বেগম নামে নিখোঁজ এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর একটি খাল থেকে সাব্বির নামে নিখোঁজ এক স্কুল ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ মার্চ ফতুল্লার কাশীপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে শোয়েব হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ২ ব্যক্তির পচন ধরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৮ মার্চ সোনারগাঁওয়ের সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন এবং রূপগঞ্জের স্কুল শিক্ষক মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৪ এপ্রিল রূপগঞ্জের বালু নদীতে নিখোঁজ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার শিক্ষক রাজীব আহাম্মদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা কেন্দ্র নিতাইগঞ্জের নায়না ফ্লাওয়ার মিলের ভেতর থেকে জবাই করা অবস্থায় নৈশ প্রহরী আবদুল আজিজ এবং হেলপার হোসেন মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই জোড়া খুনের সন্দেহভাজন শ্রমিক আবু তাহেরকে এখনো গ্রেফতারই করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশ থেকে জবাই করা যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত বছরের ১৩ জুন ফতুল্লার দুর্গম চরাঞ্চল বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাধানগরে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্কুল ছাত্র ইমনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ৯ টুকরা করে ধঞ্চে ক্ষেতের পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়। ২৩ নভেম্বর শহরের মাসদাইরে আদর্শ স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র সিয়াম আহমেদকে প্রতিবেশী ফারুক মন্ডলের ছেলে মেহেদী হত্যার পর লাশ মুন্সিগঞ্জে নিয়ে ফেলে। ৮ নভেম্বর গভীর রাতে বন্দরের মদনগঞ্জ শান্তিনগর এলাকায় ডাকাতদের গুলিতে স্কুল ছাত্র সালমান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার ৯০ নং জালকুড়ি পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্র রমজান শিকদার মাত্র ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের জন্য খুন হয়। ২২ জুলাই আড়াইহাজারে স্কুল ছাত্র মাহাবুবকে হত্যার পর নাক ও কান কেটে নেওয়ার পাশাপাশি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ৯ জুলাই ফতুল্লার পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র নাজমুল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রেম সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ৩ জুলাই রূপগঞ্জের সিনহা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌসুমী আক্তারকে (১৮) পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এবং রূপগঞ্জ উপজেলা লাশ ফেলার উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ৮ কিলোমিটার এলাকার নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।
সিটি কর্পোরেশন এলাকা, ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সোনারগাঁও, বন্দর ও আড়াইহাজারে জমি নিয়ে বিরোধ, অর্থ লেনদেন, জমি দখল ও পাল্টা দখল, পরকীয়া প্রেম-বিয়ে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এসব অপহরণ, গুম ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী না পেরেছে অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে; না পেরেছে দোষীদের গ্রেফতার করতে।
সর্বশেষ গত রবিবার আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়ি চালক এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ জন অপহূত হয়েছেন। জেলার মানুষদের মধ্যে এমনিতেই যে আতংক কাজ করছিল, তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে ওই ঘটনায়। প্রতিবাদে গতকাল নারায়ণগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণ ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আন্দোলন, ভাংচুর ও ঘেরাও অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বাইরে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জ জেলা হাইওয়ে এবং নদী এলাকায় ফেলে রাখা হচ্ছে লাশ। অপরাধীরা এই স্থানগুলোকে লাশ ফেলার নিরাপদ জায়গা হিসেবে বিবেচনা করে।
জানা গেছে, জেলার ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, রূপগঞ্জ ও সোনারগাঁও থানায় অপরাধ সংঘটিত হয় বেশি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ম্য, একশ্রেণির মিল কারখানার মালিকদের দখলদারিত্বের লড়াই, জাল জালিয়াত চক্র এবং তাদের গডফাদারদের ইশারায় এই এলাকাগুলোতে অপরাধ বেশি হয় বলে জানিয়েছে জেলা পুলিশ। নারায়ণগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশের একটি অংশ অপরাধী চক্রকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার নূরুল ইসলাম দাবি করেন, গত বছর যত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, বেশির ভাগেরই রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এ জেলায় ৭ থেকে ৮ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে বিয়ে করা স্বামী-স্ত্রীদের বেশিরভাগই কেউ কারো প্রকৃত পরিচয় জানে না। স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বে খুন হলে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া দুস্কর।
তিনি আরো বলেন, এ ধরনের বিয়েতে দেখা যায় স্বামী সন্তান ফেলে গায়েব হয়ে যায়। আর ওই সন্তানটি বড় হয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া জমি, লেনদেন, পরকীয়া ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় অপহরণ, গুম ও খুনের ঘটনা অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কমে গেছে বলে তিনি দাবি করেন। সমপ্রতি তরুণলীগ নেতা মাকসুদকে অপহরণের পর তার লাশ পাওয়া যায় গাজীপুরে। গত বছর যুবলীগ নেতা জেড আইভি পারভেজকে ঢাকার গুলশান থেকে সাদা পোশাকধারী একদল লোক অপহরণ করে বলে অভিযোগ করে তার পরিবারের সদস্যরা। এখনো পর্যন্ত পারভেজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিন মাস আগে সোনারগাঁওয়ের আওয়ামী লীগ নেতা কালাম নিখোঁজ হয়। তারও হদিস মেলেনি।
নারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী গত বছর অপহূত হওয়ার পর শীতলক্ষ্যা নদীতে তার লাশ পাওয়া যায়। এনিয়ে নারায়ণগঞ্জে চলছে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা। এ ঘটনা যে কোন সময়ে বড় সহিংসতায় রূপ নিতে পারে বলে নগরবাসী মনে করেন। এছাড়া চলতি বছরের গত তিন মাসের ব্যবধানে ফতুল্লার পঞ্চবটি এলাকার ছিনতাইকারী নূরুজ্জামান নূরা, দেওভোগ এলাকার মেজর, নবীনগর এলাকার যুবলীগ নেতা ইউসুফ অপহরণ হয়। আজো তাদের কোন হদিস মিলেনি।
৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে টানা ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। ওই সময় গড়ে প্রতিদিন একটি করে লাশ পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে নারায়ণগঞ্জ পরিণত হয় আতংকের জনপদে।
নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলছেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কোন ঘটনার বিচার না হওয়ায় পরবর্তীতে খুনিরা উত্সাহিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ওরফে লিটুকে প্রকাশ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূঁইগড়ের দেলপাড়াস্থ ভুঁইয়া ফিলিং স্টেশনের অদূর থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাবার পর আবারো প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নাজুক। একই দিন ভোরে মুন্সীগঞ্জ থেকে অপহূত হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ ফতুল্লা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার একটি ডোবা থেকে নিখোঁজ এক ইট ভাটা শ্রমিকের জবাই করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
গত বছরের জানুয়ারিতে ব্যবসায়ী ভুলু সাহা নিখোঁজ হওয়ার দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ এপ্রিল রাতে সোনারগাঁওয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউগড়া এলাকার নিজ বাড়িতে খুন হয় পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী-শ্যালক এবং বাড়ির ২ গৃহপরিচারিকা। ওই ঘটনায় শামীম আহমেদ নামে এক আসামি সোনারগাঁও থানায় নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে। গত বছর শহরের ২টি স্বর্ণের মার্কেটে প্রকাশ্যে বোমা ফাটিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পুলিশ আজো ডাকাতি হওয়া স্বর্ণালংকার উদ্ধার করতে পারেনি।
অপহরণের ৩৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মালিভিটা এলাকার একটি ডোবা থেকে স্কুল ছাত্র রাকিবুল ইসলাম ইমনের (১৪) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। গত ২৯ জানুয়ারি বন্দরে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অংকের টাকা আদায়ের জন্য ইমনের আপন চাচাতো ভাই আল আমিনের পরিকল্পনায় অপহূত হয় ইমন। ওই রাতেই তাকে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে ডোবার পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়।
গত ২১ জানুয়ারি সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় দুই স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলাম ও সাকিন আলম। ২২ জানুয়ারি একই এলাকার সাদিপুর ইউপির ভারগাঁও বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে জাহিদুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারি কাঁচপুর ইউপির বেহাকৈর মোল্লা বাড়ির বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহূত অপর স্কুল ছাত্র সাকিন আলমের গলাকাটা বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে তরুণ ব্যবসায়ি রকিকে দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় মাদক ব্যবসায়িরা কুপিয়ে হত্যা করে। ১ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের ভিংরাব এলাকা থেকে নাঈম মিয়া (১৪) নামে অপর এক স্কুল ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন সদর উপজেলার ফতুল্লার পিঠালীপুল এলাকায় একটি মোবাইল ফোন নিয়ে মোস্তফা মিয়া (১২) নামে এক স্কুল ছাত্র তারই বয়সী খেলার সঙ্গীদের হাতে খুন হয়।
৪ মার্চ ফতুল্লার একটি ডোবা থেকে মিনা বেগম নামে নিখোঁজ এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর একটি খাল থেকে সাব্বির নামে নিখোঁজ এক স্কুল ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ মার্চ ফতুল্লার কাশীপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে শোয়েব হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ২ ব্যক্তির পচন ধরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
২৮ মার্চ সোনারগাঁওয়ের সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেন এবং রূপগঞ্জের স্কুল শিক্ষক মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৪ এপ্রিল রূপগঞ্জের বালু নদীতে নিখোঁজ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার শিক্ষক রাজীব আহাম্মদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা কেন্দ্র নিতাইগঞ্জের নায়না ফ্লাওয়ার মিলের ভেতর থেকে জবাই করা অবস্থায় নৈশ প্রহরী আবদুল আজিজ এবং হেলপার হোসেন মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই জোড়া খুনের সন্দেহভাজন শ্রমিক আবু তাহেরকে এখনো গ্রেফতারই করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশ থেকে জবাই করা যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
গত বছরের ১৩ জুন ফতুল্লার দুর্গম চরাঞ্চল বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাধানগরে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্কুল ছাত্র ইমনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ৯ টুকরা করে ধঞ্চে ক্ষেতের পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়। ২৩ নভেম্বর শহরের মাসদাইরে আদর্শ স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র সিয়াম আহমেদকে প্রতিবেশী ফারুক মন্ডলের ছেলে মেহেদী হত্যার পর লাশ মুন্সিগঞ্জে নিয়ে ফেলে। ৮ নভেম্বর গভীর রাতে বন্দরের মদনগঞ্জ শান্তিনগর এলাকায় ডাকাতদের গুলিতে স্কুল ছাত্র সালমান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার ৯০ নং জালকুড়ি পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্র রমজান শিকদার মাত্র ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের জন্য খুন হয়। ২২ জুলাই আড়াইহাজারে স্কুল ছাত্র মাহাবুবকে হত্যার পর নাক ও কান কেটে নেওয়ার পাশাপাশি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ৯ জুলাই ফতুল্লার পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র নাজমুল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রেম সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ৩ জুলাই রূপগঞ্জের সিনহা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌসুমী আক্তারকে (১৮) পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড এবং রূপগঞ্জ উপজেলা লাশ ফেলার উপযুক্ত স্থান হয়ে উঠেছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ৮ কিলোমিটার এলাকার নিরাপত্তা দিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে পুলিশ।
No comments:
Post a Comment