মে দিবস ॥ শ্রমিকের অনুপ্রেরণা
মোঃ আরিফুর রহমান
‘আজ আমাদের এই নিঃশব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা বেশি শক্তিশালী হবে’- শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পীজ ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই উক্তি করেছিলেন। দৃঢ়চেতা মনোভাব নিয়ে তিনি যে কথা বলেছিলেন তা শোষিত শ্রমিক সমাজের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা। শ্রমিকরা দীর্ঘ সংগ্রাম লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে আজকে তাদের অধিকার অনেকটাই আদায় করতে পেরেছে। আর এর মূলে প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে এক শ’ আটাশ বছর আগে পহেলা মে তারিখে সংঘটিত শ্রমিকদের আন্দোলন। সেই আন্দোলনের মধ্যে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বীজ। সেই আন্দোলনই পথ দেখিয়েছিল শোষক শ্রেণীর অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর। সেই আন্দোলনই শ্রমিক শ্রেণীকে উদ্দীপ্ত করেছিল অধিকার আদায়ে কিভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়।
আজ মহান মে দিবস। এই দিবস মানেই। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। মে দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গেলে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিকাশ যখন থেকে শুরু তখন থেকেই শ্রমিক শোষণের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। মালিক শ্রেণীর দোর্দ- প্রতাপের কাছে শ্রমিকরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পায়নি। বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও দেয়া হতো খুবই স্বল্প মজুরি যা দিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাই কষ্ট হয়ে যেত। সেই সময়ের শ্রমিকদের সীমাহীন কষ্ট, দুর্ভোগ, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্মম অত্যাচার আর শোষণের কাহিনী আমরা অনেক বিখ্যাত লেখকের বইয়ের মধ্যেই দেখতে পাই। গা শিউরে ওঠে সেই দুর্ভোগের কথা পড়লে। বিখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটিতেই শ্রমিক নির্যাতন আর অধিকার হরণের কিছু নমুনা দেখতে পাই। লেখক যেভাবে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন তাতেই সেই সময়কার শ্রমিকদের প্রকৃত চিত্র অনেকটাই ফুটে ওঠে।
সে যাই হোক, বঞ্চনা সইতে সইতে একসময় নির্বাক শ্রমিকরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাদের প্রতিবাদ মালিক শ্রেণীর জুলুমের বিরুদ্ধে। তাদের সংগ্রাম ন্যায্য অধিকার আদায়ে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই সেøাগানের শক্তিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। দীর্ঘ শোষণের শিকল থেকে, দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে আন্দোলন। অধিকার আদায়ের চলমান আন্দোলনের একটি পর্যায়ে ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি আদায়ে ১৮৮৬ সালের মে মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু মালিক পক্ষ থেকে তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। বরং এর জন্য শ্রমিকদের উপর বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। তাই শ্রমিকরা পহেলা মে কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় সাড়ে তিন লাখের মতো শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। পহেলা মে শিকাগো যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। মিছিল মিটিং আর ধর্মঘটের শহরে পরিণত হয়েছিল শিকাগো। আন্দোলন চলতে থাকে তাদের। ৩ মে ম্যাক কমিক রিপার নামক কারখানায় পুলিশ বিনা উস্কানিতে ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করে। আন্দোলনের জোয়ার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশে দলে দলে যোগ দেয় দুনিয়ার মজদুররা। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। অগণিত শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট চত্বর। শ্রমিক পুলিশ সংর্ঘষের এক পর্যায়ে আচমকা বোমা বিস্ফোরিত হয়। মারা যায় আট জন পুলিশ। আর পুলিশের গুলিতে মারা যায় এগারো জন শ্রমিক আর আহত হয় অসংখ্য শ্রমিক। লাঠিচার্জ আর গুলিবর্ষণের পরও শ্রমিকদের উপর থেকে ক্ষোভ যায়নি সরকার ও মালিক পক্ষ। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অস্যংখ শ্রমিককে কারারুদ্ধ করা হয়। শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পীজ যে কিনা ঐ সমাবেশ সংগঠিত করেছিলেন তাকে সহ আরও আট জনকে বোমা বিস্ফোরণ ও গোলযোগ সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় যে, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি আসলে পুলিশের মাধ্যমে মালিক পক্ষেরই কারসাজি ছিল। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে ১৮৮৭ সালের ১১ নবেম্বর প্রকাশ্য অগাস্ট স্পীজসহ আরও ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাদের ফাঁসি সারাবিশ্বের শ্রমিক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। শাসক গোষ্ঠীর নির্মমতার স্বরূপ আরও জোরালোভাবে ধরা পড়েছিল শ্রমিকদের কাছে। ফলে তারা আরও উদীপ্ত হয়েছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্রেডরিক এঞ্জেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে প্রতিবছর মে এর প্রথম দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে জার্মানীর কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই আন্তর্জাতিক মে দিবস পালনের সূচনা হয়। মে দিবসে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর সংগ্রামী মানসিকতার কাছে পরাজিত হয়েছিল সরকার। বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি মেনে নিতে। ১৮৯৩ সালে ইলিয়নরের গবর্নর অভিযুক্ত সেই আট জন শ্রমিককে নির্দোষ ঘোষণা করেন। আর সেই সঙ্গে মেনে নেয় শ্রমিকদের আট ঘণ্টার কাজের দাবি।
সারা বিশ্বেই দেশে দেশে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই দিবসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়। আমেরিকা আর কানাডা ব্যতীত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই দিবসটি উপলক্ষে শ্রমিক সমাজ যেমন নানা আয়োজন করে তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও নানা আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশও প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে মে দিবস পালন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতকি দল, শ্রমিক সংগঠনসহ আরও নানাধরণের এই দিবসটি আয়োজন করে থাকে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এক শ’ আটাশ বছর আগের সেই সব শ্রমিকদের। এবারের আমাদের দেশে শ্রমিক দিবসের স্লোগান- ‘শ্রমিক-মালিক বিভেদ ভুলি সোনার বাংলা গড়ে তুলি’। বাংলাদেশে মালিক আর শ্রমিকশ্রেণীর মাঝে যে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ হচ্ছে সেই দ্বন্দ্ব দেশের উন্নয়নের গতিকে অনেক সময়ই মন্থর করে দেয়। তাই এবার এই সেøাগানকে বুকে ধারণ করে দেশের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ৮টি কোর কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ। আবার বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদ, ১৪ নং অনুচ্ছেদ আর ২০ (১) অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাচ্ছে, শ্রমিকদের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হয়েছে আজ এই সময়ে তা কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য যেন আর খোলে না। এর পেছনে কাজ করে দুষ্টচক্র। মালিক পক্ষ-সরকার-বিদেশী শক্তি-ট্রেড বা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা। শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষিত না হওয়ার পেছনে এই চক্রের কথা শুনে হয়ত অনেকে অবাক হবেন। কিন্তু এরাই যে মূল হোতা, তা বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে যে পোশাক খাত থেকে, যে পোশাক খাতেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিয়োজিত, তার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। শ্রমিকদের স¦ার্থ রক্ষিত হচ্ছে না, অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না- এমন কথা বললে সর্বাগ্রে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের দুর্দশা-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার চিত্র তাই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মধ্যে দিয়ে মুনাফা করছে মালিকপক্ষ, সরকারের কোষাগারে জমা পড়ছে রফতানি শুল্ক, বিদেশীরা পাচ্ছে স্বল্প খরচে সুন্দর পোশাক। অথচ পোশাক শ্রমিকদের অহর্নিশ কাজ করতে হচ্ছে নোংরা পরিবেশে, থাকতে হচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে, বঞ্চিত হতে হচ্ছে ন্যায্য মজুরি থেকে, লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে এই রকম দৃশ্যে অধিকাংশ পোশাক কারখানায় অহরহ। সাভার ট্র্যাজেডি, তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকা-সহ অসংখ্য দুর্ঘটনার শিকারে হাজার হাজার শ্রমিককে প্রাণ হারাতে হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে অনেককেই। তবুও তাদের জন্য তেমন কিছু করা হয় না।
মালিক পক্ষ শোষক শ্রেণী। তারা সবসময় শ্রমিকের ঘাড়ের উপর কাঁঠাল ভেঙ্গেই খাবে এটাই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। তা খাক। সমস্যা নেই। কিন্তু যার ঘাড়ের ওপর কাঁঠাল রাখবে তাকে তো জীবিত রাখতে হবে। তা রাখার চেষ্টা করে না মালিক পক্ষ। ওটাই সমস্যা। ওটাই ঐ শ্রেণীর দোষ। শ্রমিকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের উপর দিয়ে নিজেরা মুনাফা লুঠবে, বিত্ত-বৈভব-বিলাসিতায় গা ভাসাবে তাতেও শ্রমিকদের আপত্তি থাকবে না যদি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা হয়, যদি নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, যদি কর্মস্থলে তাদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা না করা হয়। কিন্তু এর কিছুই করে না মালিকপক্ষ। এটাই সমস্যা।
শ্রমিক ইউনিয়ন এই নিয়ে কথা বললে কাজ হয় না। সুশীল সমাজ এই নিয়ে কথা বললে কাজ হয় না। সাংবাদিকরা নিয়মিত লিখলেও কাজ হয় না। এমনকি সরকার উদ্যোগ নিলেও কাজ হয় না। এর কারণ সরকারের অনেক হোমড়া-চোমড়া কর্তাব্যক্তি অথবা তাদের আত্মীয়স্বজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের চাপে সরকার চাইলেও অনেক সময়ই শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে না। মালিকদের অন্যায়-অবিচারের প্রতি যখন আন্দোলন শুরু করে শ্রমিকরা তখন সরকারের পক্ষ থেকে বেশ হম্বি-তম্বি লক্ষ্য করা যায় কিন্তু তা ঐ পর্যন্তই। এমনটা ঘটছে সব সরকারের আমলেই। কেননা সর্ষের মধ্যেই যে ভূত আছে।
এরপর আসা যাক বিদেশীদের কথায়। এরা শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বড় বড় হৃদয় ভোলানো বুলি আওড়াতে ওস্তাদ। অনেক সিমপ্যাথি দেখায়। দেখতে ভালই লাগে। আহা, আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য কত দরদ। আসলে এরা গাছেরও খাবে, তলারও কুড়াবে টাইপের। তারা পোশাক কেনে একদম সস্তায়। যে পোশাক তারা এই দেশ থেকে বিশ ডলারে কেনে তা ক্ষেত্রবিশেষে হাজার ডলারেও বিক্রি করে। কেন তারা কি একটু বেশি দামে পোশাক কিনতে পারে না? কিনলে তো মালিকরা আর কম মুনাফার দোহাই দিতে পারবে না। বেশি দামে কিনবে না কিন্তু মাতবরী ফলানো চাই-ই চাই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পোশাক খাতের উসিলা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি বন্ধ করে দেয়া। পোশাক খাতে তো ওরা কখনই জিএসপি সুবিধা দেয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ শুল্ক দিয়ে এই দেশের গার্মেন্টস পণ্য সেই দেশে প্রবেশ করে। মানবদরদী সাজার জন্য, শ্রমিক দরদী হিসেবে নিজেদের চেনানোর জন্য জিএসপি সুবিধা যা গুটিকয়েক শিল্প পণ্য পায় তা বন্ধ করে দিয়ে আদৌ অন্যান্য শিল্প শ্রমিকদেরও বারোটা বাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে খুব সূক্ষ্মভাবেই। এতেই প্রমাণ হয়, শ্রমিকদের কল্যাণে বিদেশীদের সদিচ্ছা কতটুকু।
এবার আসা যাক, শ্রমিক ইউনিয়ন বা ট্রেড ইউনিয়নের কথায়। প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায়, নেতারা শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে মালিকপক্ষের টাকা খেয়ে নিজেরা আঙুল ফুলে কলা গাছ হয় আর শ্রমিকরা সেই আধারেই থেকে যায়। তবে এটা সত্যি যে, যেসব শ্রমিক নেতার বিপক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা খাতের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। তবে আশার কথা যে, পোশাক খাতসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন অন্যান্য শিল্পখাতে এই রকম নেতার সংখ্যা অল্প। যারা আছে তারা মালিকপক্ষের লোক হয়েই শ্রমিকদের ব্যবহার করে। মালিকদের স্বার্থ হাসিলের মধ্যে দিয়ে নিজেরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে ওঠে।
মালিকপক্ষ-সরকার-বিদেশীশক্তি-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এই চক্রই কোন না কোনভাবে শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য দায়ী। এই দুষ্টচক্রের ক্রিয়াকলাপের জন্যই আজও শ্রমিকরা বঞ্চিত। আন্তর্জাতিক আইন, দেশীয় আইন থাকা সত্ত্বেও এই চক্রের কারণেই আজও শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে কম মজুরিতে। কর্মস্থলে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। সহ্য করতে হচ্ছে বঞ্চনা। সময় এসেছে অবস্থার পরিবর্তনের। এসেছে মহান মে দিবসের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার। আর কোন রেষারেষি নয়। ওই চক্রের প্রতিই আহ্বান, লোক দেখানো শ্রমিক কল্যাণ নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করুন শ্রমিকের অধিকার। এতে আখেরে আপনাদেরও লাভ হবে। শ্রমিকের জীবনে আসবে স্বস্তি। বাড়বে উৎপাদন। লাভবান হবে মালিকপক্ষ। সর্বোপরি উপকৃত হবে দেশ।
আজ মহান মে দিবস। এই দিবস মানেই। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। মে দিবসের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গেলে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হয়। যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবিকাশ যখন থেকে শুরু তখন থেকেই শ্রমিক শোষণের মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। মালিক শ্রেণীর দোর্দ- প্রতাপের কাছে শ্রমিকরা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস খুঁজে পায়নি। বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও দেয়া হতো খুবই স্বল্প মজুরি যা দিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটাই কষ্ট হয়ে যেত। সেই সময়ের শ্রমিকদের সীমাহীন কষ্ট, দুর্ভোগ, উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্মম অত্যাচার আর শোষণের কাহিনী আমরা অনেক বিখ্যাত লেখকের বইয়ের মধ্যেই দেখতে পাই। গা শিউরে ওঠে সেই দুর্ভোগের কথা পড়লে। বিখ্যাত লেখক ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাসটিতেই শ্রমিক নির্যাতন আর অধিকার হরণের কিছু নমুনা দেখতে পাই। লেখক যেভাবে শ্রমিকদের নির্যাতন আর বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরেছেন তাতেই সেই সময়কার শ্রমিকদের প্রকৃত চিত্র অনেকটাই ফুটে ওঠে।
সে যাই হোক, বঞ্চনা সইতে সইতে একসময় নির্বাক শ্রমিকরাও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তাদের প্রতিবাদ মালিক শ্রেণীর জুলুমের বিরুদ্ধে। তাদের সংগ্রাম ন্যায্য অধিকার আদায়ে। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই সেøাগানের শক্তিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে। দীর্ঘ শোষণের শিকল থেকে, দাসত্বের শিকল থেকে মুক্তি পেতে শুরু করে আন্দোলন। অধিকার আদায়ের চলমান আন্দোলনের একটি পর্যায়ে ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি আদায়ে ১৮৮৬ সালের মে মাস পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু মালিক পক্ষ থেকে তাদের দাবির প্রতি কর্ণপাত করা হয়নি। বরং এর জন্য শ্রমিকদের উপর বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা। তাই শ্রমিকরা পহেলা মে কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। প্রায় সাড়ে তিন লাখের মতো শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে আসে। পহেলা মে শিকাগো যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। মিছিল মিটিং আর ধর্মঘটের শহরে পরিণত হয়েছিল শিকাগো। আন্দোলন চলতে থাকে তাদের। ৩ মে ম্যাক কমিক রিপার নামক কারখানায় পুলিশ বিনা উস্কানিতে ৬ জন শ্রমিককে হত্যা করে। আন্দোলনের জোয়ার দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।
৪ মে হে মার্কেট স্কয়ারে সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে সমাবেশে দলে দলে যোগ দেয় দুনিয়ার মজদুররা। সমাবেশের শেষ পর্যায়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। অগণিত শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয় হে মার্কেট চত্বর। শ্রমিক পুলিশ সংর্ঘষের এক পর্যায়ে আচমকা বোমা বিস্ফোরিত হয়। মারা যায় আট জন পুলিশ। আর পুলিশের গুলিতে মারা যায় এগারো জন শ্রমিক আর আহত হয় অসংখ্য শ্রমিক। লাঠিচার্জ আর গুলিবর্ষণের পরও শ্রমিকদের উপর থেকে ক্ষোভ যায়নি সরকার ও মালিক পক্ষ। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অস্যংখ শ্রমিককে কারারুদ্ধ করা হয়। শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পীজ যে কিনা ঐ সমাবেশ সংগঠিত করেছিলেন তাকে সহ আরও আট জনকে বোমা বিস্ফোরণ ও গোলযোগ সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ধারণা করা হয় যে, বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটি আসলে পুলিশের মাধ্যমে মালিক পক্ষেরই কারসাজি ছিল। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে ১৮৮৭ সালের ১১ নবেম্বর প্রকাশ্য অগাস্ট স্পীজসহ আরও ৫ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তাদের ফাঁসি সারাবিশ্বের শ্রমিক সমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। শাসক গোষ্ঠীর নির্মমতার স্বরূপ আরও জোরালোভাবে ধরা পড়েছিল শ্রমিকদের কাছে। ফলে তারা আরও উদীপ্ত হয়েছিল অধিকার আদায়ের সংগ্রামে। ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ফ্রেডরিক এঞ্জেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে প্রতিবছর মে এর প্রথম দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে জার্মানীর কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিনের ঘোষণা গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই আন্তর্জাতিক মে দিবস পালনের সূচনা হয়। মে দিবসে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর সংগ্রামী মানসিকতার কাছে পরাজিত হয়েছিল সরকার। বাধ্য হয়েছিল শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজ করার দাবি মেনে নিতে। ১৮৯৩ সালে ইলিয়নরের গবর্নর অভিযুক্ত সেই আট জন শ্রমিককে নির্দোষ ঘোষণা করেন। আর সেই সঙ্গে মেনে নেয় শ্রমিকদের আট ঘণ্টার কাজের দাবি।
সারা বিশ্বেই দেশে দেশে এই দিবস পালিত হয়ে আসছে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই দিবসটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ধরা দেয়। আমেরিকা আর কানাডা ব্যতীত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই এই দিবসটি উপলক্ষে শ্রমিক সমাজ যেমন নানা আয়োজন করে তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও নানা আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশও প্রতিবছর নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে মে দিবস পালন করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তেমনি বিভিন্ন রাজনৈতকি দল, শ্রমিক সংগঠনসহ আরও নানাধরণের এই দিবসটি আয়োজন করে থাকে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এক শ’ আটাশ বছর আগের সেই সব শ্রমিকদের। এবারের আমাদের দেশে শ্রমিক দিবসের স্লোগান- ‘শ্রমিক-মালিক বিভেদ ভুলি সোনার বাংলা গড়ে তুলি’। বাংলাদেশে মালিক আর শ্রমিকশ্রেণীর মাঝে যে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ হচ্ছে সেই দ্বন্দ্ব দেশের উন্নয়নের গতিকে অনেক সময়ই মন্থর করে দেয়। তাই এবার এই সেøাগানকে বুকে ধারণ করে দেশের উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক সংগঠন হিসেবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকদের অধিকারসমূহ স্বীকৃতি লাভ করে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ৮টি কোর কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ। আবার বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩ নং অনুচ্ছেদ, ১৪ নং অনুচ্ছেদ আর ২০ (১) অনুচ্ছেদে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া দেশে বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ। কিন্তু আমাদের শ্রমিকরা কতটুকু অধিকার পাচ্ছে, শ্রমিকদের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হয়েছে আজ এই সময়ে তা কঠিন এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ লেবার ফোর্সের জরিপ অনুযায়ী দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যা ৫ কোটির কাছাকাছি। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ মহিলা শ্রমিক। মে দিবস যায়, মে দিবস আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ভাগ্য যেন আর খোলে না। এর পেছনে কাজ করে দুষ্টচক্র। মালিক পক্ষ-সরকার-বিদেশী শক্তি-ট্রেড বা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতা। শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষিত না হওয়ার পেছনে এই চক্রের কথা শুনে হয়ত অনেকে অবাক হবেন। কিন্তু এরাই যে মূল হোতা, তা বাংলাদেশের রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসে যে পোশাক খাত থেকে, যে পোশাক খাতেই সবচেয়ে বেশি শ্রমিক নিয়োজিত, তার বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। শ্রমিকদের স¦ার্থ রক্ষিত হচ্ছে না, অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না- এমন কথা বললে সর্বাগ্রে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের দুর্দশা-বঞ্চনা-লাঞ্ছনার চিত্র তাই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে। পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির মধ্যে দিয়ে মুনাফা করছে মালিকপক্ষ, সরকারের কোষাগারে জমা পড়ছে রফতানি শুল্ক, বিদেশীরা পাচ্ছে স্বল্প খরচে সুন্দর পোশাক। অথচ পোশাক শ্রমিকদের অহর্নিশ কাজ করতে হচ্ছে নোংরা পরিবেশে, থাকতে হচ্ছে ঝুঁকির মধ্যে, বঞ্চিত হতে হচ্ছে ন্যায্য মজুরি থেকে, লাঞ্ছিত ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে এই রকম দৃশ্যে অধিকাংশ পোশাক কারখানায় অহরহ। সাভার ট্র্যাজেডি, তাজরীন ফ্যাশন অগ্নিকা-সহ অসংখ্য দুর্ঘটনার শিকারে হাজার হাজার শ্রমিককে প্রাণ হারাতে হয়েছে, পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়েছে অনেককেই। তবুও তাদের জন্য তেমন কিছু করা হয় না।
মালিক পক্ষ শোষক শ্রেণী। তারা সবসময় শ্রমিকের ঘাড়ের উপর কাঁঠাল ভেঙ্গেই খাবে এটাই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। তা খাক। সমস্যা নেই। কিন্তু যার ঘাড়ের ওপর কাঁঠাল রাখবে তাকে তো জীবিত রাখতে হবে। তা রাখার চেষ্টা করে না মালিক পক্ষ। ওটাই সমস্যা। ওটাই ঐ শ্রেণীর দোষ। শ্রমিকের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের উপর দিয়ে নিজেরা মুনাফা লুঠবে, বিত্ত-বৈভব-বিলাসিতায় গা ভাসাবে তাতেও শ্রমিকদের আপত্তি থাকবে না যদি শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না করা হয়, যদি নিরাপদ কর্মস্থলের নিশ্চয়তা দেয়া হয়, যদি কর্মস্থলে তাদের লাঞ্ছনা-বঞ্চনা না করা হয়। কিন্তু এর কিছুই করে না মালিকপক্ষ। এটাই সমস্যা।
শ্রমিক ইউনিয়ন এই নিয়ে কথা বললে কাজ হয় না। সুশীল সমাজ এই নিয়ে কথা বললে কাজ হয় না। সাংবাদিকরা নিয়মিত লিখলেও কাজ হয় না। এমনকি সরকার উদ্যোগ নিলেও কাজ হয় না। এর কারণ সরকারের অনেক হোমড়া-চোমড়া কর্তাব্যক্তি অথবা তাদের আত্মীয়স্বজন এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এদের চাপে সরকার চাইলেও অনেক সময়ই শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা করতে পারে না। মালিকদের অন্যায়-অবিচারের প্রতি যখন আন্দোলন শুরু করে শ্রমিকরা তখন সরকারের পক্ষ থেকে বেশ হম্বি-তম্বি লক্ষ্য করা যায় কিন্তু তা ঐ পর্যন্তই। এমনটা ঘটছে সব সরকারের আমলেই। কেননা সর্ষের মধ্যেই যে ভূত আছে।
এরপর আসা যাক বিদেশীদের কথায়। এরা শ্রমিকদের কল্যাণের জন্য বড় বড় হৃদয় ভোলানো বুলি আওড়াতে ওস্তাদ। অনেক সিমপ্যাথি দেখায়। দেখতে ভালই লাগে। আহা, আমাদের দেশের শ্রমিকদের জন্য কত দরদ। আসলে এরা গাছেরও খাবে, তলারও কুড়াবে টাইপের। তারা পোশাক কেনে একদম সস্তায়। যে পোশাক তারা এই দেশ থেকে বিশ ডলারে কেনে তা ক্ষেত্রবিশেষে হাজার ডলারেও বিক্রি করে। কেন তারা কি একটু বেশি দামে পোশাক কিনতে পারে না? কিনলে তো মালিকরা আর কম মুনাফার দোহাই দিতে পারবে না। বেশি দামে কিনবে না কিন্তু মাতবরী ফলানো চাই-ই চাই। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ পোশাক খাতের উসিলা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি বন্ধ করে দেয়া। পোশাক খাতে তো ওরা কখনই জিএসপি সুবিধা দেয়নি। বরং ক্ষেত্রবিশেষে অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ শুল্ক দিয়ে এই দেশের গার্মেন্টস পণ্য সেই দেশে প্রবেশ করে। মানবদরদী সাজার জন্য, শ্রমিক দরদী হিসেবে নিজেদের চেনানোর জন্য জিএসপি সুবিধা যা গুটিকয়েক শিল্প পণ্য পায় তা বন্ধ করে দিয়ে আদৌ অন্যান্য শিল্প শ্রমিকদেরও বারোটা বাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে খুব সূক্ষ্মভাবেই। এতেই প্রমাণ হয়, শ্রমিকদের কল্যাণে বিদেশীদের সদিচ্ছা কতটুকু।
এবার আসা যাক, শ্রমিক ইউনিয়ন বা ট্রেড ইউনিয়নের কথায়। প্রায়শই অভিযোগ পাওয়া যায়, নেতারা শ্রমিকদের অধিকার আন্দোলনে মাঠে নামিয়ে মালিকপক্ষের টাকা খেয়ে নিজেরা আঙুল ফুলে কলা গাছ হয় আর শ্রমিকরা সেই আধারেই থেকে যায়। তবে এটা সত্যি যে, যেসব শ্রমিক নেতার বিপক্ষে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায় তার অধিকাংশই সরকারী মালিকানাধীন ব্যাংক, বীমা, বিদ্যুত, টেলিফোন, গ্যাস, ওয়াসাসহ বিভিন্ন সেবা খাতের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। তবে আশার কথা যে, পোশাক খাতসহ ব্যক্তিমালিকানাধীন অন্যান্য শিল্পখাতে এই রকম নেতার সংখ্যা অল্প। যারা আছে তারা মালিকপক্ষের লোক হয়েই শ্রমিকদের ব্যবহার করে। মালিকদের স্বার্থ হাসিলের মধ্যে দিয়ে নিজেরা বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়ে ওঠে।
মালিকপক্ষ-সরকার-বিদেশীশক্তি-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা এই চক্রই কোন না কোনভাবে শ্রমিকদের দুরবস্থার জন্য দায়ী। এই দুষ্টচক্রের ক্রিয়াকলাপের জন্যই আজও শ্রমিকরা বঞ্চিত। আন্তর্জাতিক আইন, দেশীয় আইন থাকা সত্ত্বেও এই চক্রের কারণেই আজও শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে কম মজুরিতে। কর্মস্থলে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। সহ্য করতে হচ্ছে বঞ্চনা। সময় এসেছে অবস্থার পরিবর্তনের। এসেছে মহান মে দিবসের মহিমায় উজ্জীবিত হওয়ার। শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার। আর কোন রেষারেষি নয়। ওই চক্রের প্রতিই আহ্বান, লোক দেখানো শ্রমিক কল্যাণ নয়, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করুন শ্রমিকের অধিকার। এতে আখেরে আপনাদেরও লাভ হবে। শ্রমিকের জীবনে আসবে স্বস্তি। বাড়বে উৎপাদন। লাভবান হবে মালিকপক্ষ। সর্বোপরি উপকৃত হবে দেশ।
http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=16&dd=2014-05-01&ni=171498
No comments:
Post a Comment