Wednesday, April 30, 2014

নারায়ণগঞ্জবাসী আর কত লাশ দেখবে? আবুল খায়ের

নারায়ণগঞ্জবাসী আর কত লাশ দেখবে?

আবুল খায়ের
নারায়ণগঞ্জবাসী আর কত লাশ দেখবে? ইতিপূর্বে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে শোক কাটতে না কাটতে আবারো নারায়ণগঞ্জে রক্তের হোলিখেলা। গতকাল বুধবার বন্দর থানাধীন শীতলক্ষ্যা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৬ জনের লাশ পুলিশ উদ্ধার করে। অপর ৪ জন হলেন নজরুল ইসলামের গাড়ি চালক তাজুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান স্বপন, লিটন এবং নিখোঁজ আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহীম। 

গত রবিবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ আদালতে হাজিরা দিয়ে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম সহযোগীদের নিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। একই সময় আইনজীবী চন্দন সরকার ফতুল্লা জালকুড়ির বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হন। উভয়ের গাড়ি আগে পিছে ছিল। ফতুল্লা স্টেডিয়ামের কাছে গেলে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও প্রবীণ আইনজীবী চন্দন সরকারসহ ৭ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। তিনদিন পর গতকাল দুপুরে বন্দর থানা পুলিশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৬টি লাশ উদ্ধার করে। লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে নিখোঁজ সাতজনের স্বজনরা শীতলক্ষ্যা তীরে যান। প্রথমে কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম এবং পরে একে একে ৫টি লাশ শনাক্ত করেন স্বজনরা। সর্বশেষ আইনজীবী চন্দন সরকারের লাশ শনাক্ত করেন তার কন্যা সেজুতি সরকার। নিখোঁজ রয়েছেন কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের চালক জাহাঙ্গীর। সংবাদ পেয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে শত শত লোক বন্দর থানার শীতলক্ষ্যা তীরে যান। স্বজনদের আহাজারিতে শীতলক্ষ্যার তীরে শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার কণ্ঠে একই দাবি, নারায়ণগঞ্জবাসী আর কত লাশ দেখবে? আমরা এর প্রতিকার চাই। চাই খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। সিদ্ধিরগঞ্জ জুড়ে শোকের ছায়া আর আহাজারি। 

নজরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এলাকাটি সিদ্ধিরগঞ্জ। লাশ সনাক্তের পর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বুকফাটা কান্নার জোয়ার নেমে আসে। এ কান্নার শেষ কোথায়? রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, আধিপত্য বিস্তার, জমিজমা নিয়ে বিরোধ, লেনদেন, দখল-পাল্টা দখল, নারায়ণগঞ্জ শহর ও জেলা জুড়ে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের ঘটনা অহরহ ঘটছে বলে সুশীল সমাজ, র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসূত্রে জানা যায়।

৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তত্কালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে টানা ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধে ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। অর্থাত্ গড়ে প্রতিদিন একটি করে লাশ পড়ে। ওই ঘটনার পর থেকে সন্ত্রাসের জনপদ হিসাবে নারায়ণগঞ্জ দেশব্যাপী আলোচনায় উঠে আসে। 

নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ বলছেন, একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কোন ঘটনার বিচার না হওয়ায় পরবর্তীতে খুনিরা উত্সাহিত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক ওরফে লিটুকে প্রকাশ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ভূঁইগড়ের দেলপাড়াস্থ ভূঁইয়া ফিলিং স্টেশনের কাছ থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর আবারো প্রমাণিত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নাজুক। এর আগে একইদিন ভোরে মুন্সীগঞ্জ থেকে অপহূত হাদিস আলী নামে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ ফতুল্লা এলাকা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এর পরের দিন অর্থাত্ গতমাসেই ফতুল্লার বক্তাবলী এলাকার একটি ডোবা থেকে ২ দিন আগে নিখোঁজ এক ইট ভাটা শ্রমিকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। 

২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্যবসায়ী ভুলু সাহার লাশ নিখোঁজের ২ দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। ৮ মার্চ মেধাবী স্কুল ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয় শীতলক্ষ্যা নদী থেকে। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে নারায়ণগঞ্জসহ দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত আছে। একই বছরের ১৯ এপ্রিল রাতে সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ঝাউগড়া এলাকার নিজ বাড়িতে খুন হয় পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী, শ্যালক এবং বাড়ির ২ গৃহপরিচারিকা। ওই ঘটনায় শামীম আহমেদ নামে এক আসামি সোনারগাঁ থানায় নির্যাতনের কারণে নিহত হয়।

এছাড়া চলতি বছরের ২৮ মার্চ সোনারগাঁয় সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেনকে এবং একই দিন রূপগঞ্জে স্কুল শিক্ষক মেহেদী হাসানকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এর ৭ দিন পর গত ৪ এপ্রিল রূপগঞ্জের বালু নদী থেকে নিখোঁজ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার শিক্ষক রাজীব আহাম্মদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ৬ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ শহরের ব্যবসা কেন্দ্র নিতাইগঞ্জের নায়না ফ্লাওয়ার মিলের ভেতর থেকে জবাই করা অবস্থায় নৈশ প্রহরী আবদুল আজিজ এবং হেলপার হোসেন মিয়ার লাশ উদ্ধার করা হয়। এই জোড়া খুনের সন্দেহ ভাজন শ্রমিক আবু তাহেরকে এখনো গ্রেফতারই করতে পারেনি পুলিশ। গত ১৪ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের পাশ থেকে গলাকাটা যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। 

এছাড়া গত ফেব্রুয়ারি মাসে তরুণ ব্যবসায়ী দেওভোগ মাদ্রাসা এলাকায় রকিকে মাদক ব্যবসায়ীরা কুপিয়ে হত্যা করে। ৪ মার্চ ফতুল্লার একটি ডোবা থেকে মিনা বেগম নামে নিখোঁজ এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৬ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীর একটি খাল থেকে সাব্বির নামে নিখোঁজ এক স্কুল ছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ মার্চ ফতুল্লার কাশীপুর এলাকার একটি ডোবা থেকে শোয়েব হোসেন নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৩ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয় ২ ব্যক্তির পচন ধরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এসব ঘটনা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে অসংখ্য অজ্ঞাত পরিচয় লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। 

এদিকে গত দুই মাসেই ৪ জন শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে। অপহরণের পরে মুক্তিপণ আদায়, পূর্বশত্রুতা ও তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এসব শিক্ষার্থীদের অকালে জীবন দিতে হয়েছে। অপহরণের ৩৫ দিন পর নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মালিভিটা এলাকার একটি ডোবা থেকে স্কুল ছাত্র রাকিবুল ইসলাম ইমনের (১৪) বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। গত ২৯ জানুয়ারি বন্দরে মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অংকের টাকা আদায়ের জন্য ইমনের আপন চাচাতো ভাই আল আমিনের পরিকল্পনায় অপহূত হয় ইমন। ওই রাতেই তাকে হত্যার পর লাশ বস্তাবন্দি করে ডোবার পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়। গত ২ ফেব্রুয়ারি সদর উপজেলার ফতুল্লার পিঠালীপুল এলাকায় একটি মোবাইল ফোন নিয়ে মোস্তফা মিয়া (১২) নামে এক স্কুল ছাত্র তারই বয়সী খেলার সঙ্গীদের হাতে খুন হয়। ১ ফেব্রুয়ারি রূপগঞ্জের সদর ইউনিয়নের ভিংরাব এলাকা থেকে নাঈম মিয়া (১৪) নামে অপর এক স্কুল ছাত্রের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

গত ২১ জানুয়ারী সোনারগাঁও উপজেলার কাঁচপুর এলাকা থেকে অপহরণের শিকার হয় দুই স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলাম ও সাকিন আলম। ২২ জানুয়ারী একই এলাকার সাদিপুর ইউপির ভারগাঁও বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহূত স্কুল ছাত্র জাহিদুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৬ জানুয়ারী কাঁচপুর ইউপির বেহাকৈর মোল্লা বাড়ির বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে অপহূত অপর স্কুল ছাত্র সাকিন আলমের গলাকাটা বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। 

গত বছরের ১৩ জুন ফতুল্লার দুর্গম চরাঞ্চল বক্তাবলী ইউনিয়নের চর রাধানগরে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে স্কুল ছাত্র ইমনকে নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ ৯ টুকরা করে ধঞ্চে ক্ষেতের পানিতে লুকিয়ে রাখা হয়। ২৩ নভেম্বর শহরের মাসদাইর আদর্শ স্কুলের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র সিয়াম আহমেদকে প্রতিবেশী ফারুক মন্ডলের ছেলে মেহেদী হত্যার পর লাশ মুন্সিগঞ্জে নিয়ে ফেলে দেয়। ৮ নভেম্বর গভীর রাতে বন্দরের মদনগঞ্জ শান্তিনগর এলাকায় ডাকাতদের গুলিতে স্কুল ছাত্র সালমান ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। ৭ সেপ্টেম্বর সিদ্ধিরগঞ্জের জালকুড়ি এলাকার ৯০ নং জালকুড়ি পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেণীর ছাত্র রমজান শিকদার মাত্র ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণের জন্য খুন হয়। ২২ জুলাই আড়াইহাজারে স্কুল ছাত্র মাহাবুবকে হত্যার পর নাক ও কান কেটে নেয়ার পাশাপাশি চোখ উপড়ে ফেলা হয়। ৯ জুলাই ফতুল্লার পাগলা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্র নাজমুল হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। প্রেম সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ৩ জুলাই রূপগঞ্জের সিনহা স্কুল অ্যান্ড কলেজের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মৌসুমী আক্তারকে (১৮) পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। এসব নির্মম হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে বেশীর ভাগ সময়ে পুলিশ প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। খুনিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বড়ায় এলাকায়। খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নারায়ণগঞ্জে একের পর এক লাশ পড়তো না বলে প্রশাসন, সুশীল সমাজ ও স্বজনহারাদের দাবি।
The Daily Ittefaq

No comments:

Post a Comment