অপহরণ ১০ হাজারের বেশি খোঁজ মেলেনি ৭ হাজারের
আবুল খায়ের
এসব ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা ও সাধারণ ডায়রি করে থাকেন স্বজনরা। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেই স্বজনরা এসব ঘটনায় থানাকে অবহিত করে। তবে এ দেশের তুলনায় অন্যান্য দেশে এসব অপরাধের হার কম। নিরাপত্তা বাহিনীর সাফল্যের হারও বেশি। সেসব দেশে দ্রুত এসব ঘটনার রহস্য উদঘাটন করে নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী অপহরণ, গুম কিংবা নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হচ্ছে।
তবে পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার দাবি করেন, হত্যা, গুম ও অপহরণ দেশে অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। ইদানিং নিরাপত্তা বাহিনীর নামে একটি অপরাধী চক্র এসব ঘটনা ঘটাচ্ছে। নানা ধরনের বিরোধের জের ধরেই এগুলো করা হয়ে থাকে। তিনি এসব নিয়ে আতংকিত না হতে বলেছেন সাধারণ মানুষকে। এ ধরনের কোন খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে তা জানানোর আহবান জানান তিনি।
একই সঙ্গে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা দাবি করেন, ধীরে ধীরে নিরাপত্তা বাহিনীর অপরাধীদের গ্রেফতার ও অপরাধ রোধে সাফল্যের হার বাড়ছে। কর্মকর্তারা বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় এ ধরনের অপরাধী গ্রেফতারে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার অভিজ্ঞতা কম নয়। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সফলতার হার বেশি বলে কর্মকর্তারা দাবি করেন।
সামপ্রতিককালে দেশে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ নিয়ে জনমনে চরম আতংক দেখা দেয়। এসব আতংকের চিত্র, স্বজন হারাদের আহাজারি ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার এক যুগে অপহরণ গুম ও নিখোঁজের বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করে বলেন, এদেশে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ নতুন নয়। অতীতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। অতীতের চেয়ে বর্তমানে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের হার বেশি নয়। তবে এখন জনমনে বেশি বেশি আতংক তৈরি করা হচ্ছে।
কারণ হিসেবে জানা গেছে, অপরাধী চক্র অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের ধরন পরিবর্তন করেছে। বর্তমানে র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নাম, তাদের পোশাক ও হ্যান্ডক্যাফ অপহরণ ও গুমের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ সুযোগ গ্রহণ করছে একটি স্বার্থন্বেষী মহল। রাজনৈতিক ফায়দা লোটার, প্রভু রাষ্ট্রকে খুশি করার, দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি ও নানা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ আতংক ছড়ানো হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা পরিচয়ে অপহরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায়, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরবর্তীতে লাশ উদ্ধার এবং ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে এই রহস্য উদঘাটন হয়। রাজধানীর ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার বিএনপি নেতা ও বঙ্গ বাজারের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামকে গত বছরে ঝিনাইদহ শৈলকুপার শ্বশুর বাড়ি থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। র্যাবকে জড়িয়ে মিডিয়া ফলাও করে এই অপহরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে র্যাব রফিকুল ইসলামের হত্যা রহস্য উদঘাটন করে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রফিকুলের শাশুড়িসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা জানায়, অনৈতিক ও অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে রফিকুলকে অপহরণ ও হত্যা করা হয়।
মিরপুরের বহুল আলোচিত 'নিখোঁজ' ব্যবসায়ী পলিন ২ মাস ১০ দিনের মাথায় ফিরে আসে। ভালুকার 'নিখোঁজ' তিন সহোদরও কয়দিন সুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে আসে। মিরপুরের আহাদও কিছু দিনের মাথায় বাড়ি ফিরে আসে। তারা ফিরে এসে নিরাপত্তা বাহিনীকে জানায়, কোন বাহিনী তাদের অপহরণ করেনি।
র্যাব সদর দফতর থেকে জানানো হয় যে, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর অর্থাত্ গত ১০ বছরে প্রায় ১২০০ অপহূত ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। এদের মধ্যে ১১শ জনকেই জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করছে র্যাব। শতাধিককে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব। আটক করা হয় জড়িত ২ হাজার অপরাধীকে। ভুয়া র্যাব ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয় দানকারী ৫ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ব্যক্তিরা র্যাব, পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার নাম পরিচয় ব্যবহার করে অপহরণ করে আসছিল। তারা র্যাবের কাছে অনেক অপহরণ ও গুমের ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানিয়েছে।
এই ১০ বছরে র্যাবের ১৪টি ব্যাটালিয়ন ও সদর দফতর কর্মকর্তারা ২৬৪১টি অপহরণ ও গুমের অভিযোগ তদন্ত করে দেখেন যে, ৪০ ভাগ অভিযোগই ভুয়া। কেউ স্বামী-স্ত্রী বিরোধে আত্মগোপন করেছে, পরকীয়া প্রেমের কারণে ও লেনদেন ব্যাপারে আত্মগোপন করেছে। কেউ প্রতিপক্ষকে ফাঁসানো জন্য আত্মগোপন করেছে।
এ ছাড়া চলতি বছরের তিন মাসে দেশে ১৯৬ জন ব্যক্তি অপহূত হয়েছে। তাদের মধ্যে লাশ হয়ে ফিরেছে ৬২ জন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ, র্যাব পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, মুক্তিপণ আদায়, জমি নিয়ে বিরোধ, অনৈতিক কিংবা অবৈধ সম্পর্ক, আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপহরণ ও গুমের ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে এলাকার আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বেশি বেশি অপহরণ হচ্ছে। গত ৫ বছরে রাজধানী ও আশপাশের জেলা, বরিশাল বিভাগ, চট্টগ্রাম বিভাগ ও খুলনা বিভাগে বেশি অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের ঘটনা ঘটেছে। ঐ সব ঘটনার বেশির ভাগ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটেছে। ঐ সব অপহরণের ঘটনা ও ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এক শ্রেণির সদস্য দায়িত্ব কর্তব্য পালনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আদর্শ ও মহল বিশেষের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।
১২ বছরের মধ্যে ২০০২ সালে ১০৪০, ২০০৩ সালে ৮৯৬ জন, ২০০৪ সালে ৮৯৮ জন, ২০০৫ সালে ৭৬৫ জন, ২০০৬ সালে ৭২২ জন, ২০০৭ সালে ৭৭৪ জন, ২০০৮ সালে ৮১৭ জন, ২০০৯ সালে ৮৫৮ জন, ২০১০ সালে ৮৭০ জন, ২০১১ সালে ৭৯২ জন, ২০১২ সালে ৮৫০ জন ও ২০১৩ সালে ৮৭৯ জন অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ হয়েছে।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার হাবিবুর রহমান বলেন, র্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে অপহরণের কোন ঘটনা ঘটলে তা খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে। অপহূত ব্যক্তিকে উদ্ধার করাকে র্যাব গুরু দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। র্যাবকে অপহরণের সঙ্গে জড়ানোর কাজটি একটি স্বার্থান্বেষী মহল করছে। এটা অতীতেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। অপরাধীরা অপহরণের মত একটা ঘৃণতম অপরাধ সংঘটনে কৌশলগত সুবিধা অর্জনে র্যাবের নাম ব্যবহার করে আসছে। অপহরণ গুম ও নিখোঁজ নিয়ে আতংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই। র্যাব পরিচয় এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় র্যাব কার্যালয়ে কিংবা সদর দফতরে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস
ফাউন্ডেশনের বক্তব্য
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান অপহরণ, গুম ও নিখোঁজ সম্পর্কে বলেন, এমপি মন্ত্রীরা নিজ এলাকায় পছন্দের এসপি, ওসি বদলি করে নিয়ে যান। ঐ সব এসপি-ওসি সবসময় এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের খেদমত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে পুলিশের চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়েছে। অপরহণ, গুম ও নিখোঁজ রহস্যে উন্মোচনে পুলিশ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। অপরদিকে এক শ্রেণীর আইনজীবী অপরাধীদের জামিন নিয়ে ব্যস্ত এবং তারা সহজে জামিনে বেরিয়ে আসে। বিচারের নামে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে অপরাধীরা বের হয়ে আসছে। অপরাধীরা বেরিয়ে এসে প্রতিপক্ষকে অপহরণ গুম ও নানাভাবে সাইজ করে থাকে। অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের ঘটনা বৃদ্ধিই এর অন্যতম কারণ। তাই অতীতের কাসুন্দি না ঘেটে সামনে ভাল করব এই মনমানসিকতা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনকে গড়ে তোলার আহবান জানান তিনি।
No comments:
Post a Comment